সাহাবাযুগ থেকে বর্তমান : নারীদের জ্ঞানচর্চা

সুমাইয়া মারজান:

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মহিলা সাহাবীগণ মুসলিম নারী সমাজের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। পবিত্রতম এ নারীগণ ছিলেন ইসলামের দুর্গস্বরূপ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের প্রতি ইমান আনা থেকে শুরু করে দ্বীনের প্রচার-প্রসার, হিজরত, জিহাদে অংশগ্রহণ, ইলমে দ্বীনের নানান শাখায় বুৎপত্তি অর্জন, হাদীস সংরক্ষণ ও বর্ণনা করা, ইবাদত-বন্দেগি ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নসহ নানান কাজকর্মে তারা সবসময়ই ছিলেন অগ্রসর। এছাড়াও ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় মানবজাতির উন্নতির প্রতিটি ধাপে নারীদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। জাহেলি যুগের যে সমাজে স্বাক্ষরতার হার ছিল শূন্যের কোঠায়, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার কোন ব্যবস্থা ছিল না সে যুগেও মহিলা সাহাবীদের বেশ বড় একটি দল পড়ালেখা জানতেন। যারা পড়তে, লিখতে জানতেন না তারা শুধু মুখস্থ করার মাধ্যমেই ইলমে দ্বীনের শিক্ষাগ্রহণ ও চর্চা করতেন। নিয়মিত সাপ্তাহিক বৈঠকে উপস্থিত হয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম থেকে তারা হাদীস শিখতেন। অন্যদেরকেও হাদীস শিক্ষা দিতেন। কখনও প্রশ্ন করার মাধ্যমে, কখনও অন্যের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর জেনে নেওয়ার মাধ্যমে, কখনও বিশেষ অবস্থা ও প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন বিষয় তারা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম থেকে জেনে নিতেন। নববী যুগের এইসব জ্ঞানপিপাসু নারীরা বর্তমানের নারী সমাজের শিকড়। নারীর জ্ঞানচর্চার ধারাবাহিকতা এক বা দুই যুগের নয়। এ ধারাবাহিকতা চৌদ্দশত বছরের।

ইতিহাসের পাতা খুললে আমরা দেখতে পাই তাদের স্বর্ণোজ্জ্বল নাম। সাহাবিয়াদের যুগ থেকে যদি ধরে নিই জ্ঞানচর্চা করা নারীদের কাফেলার শুরু তাহলে এ যাত্রায় অগ্রপথিক হিসেবে বেশ বড় একটি দলের নাম উঠে আসে। উম্মাহাতুল মুমিনীনগণের নাম নেওয়া যায় প্রথমেই। যেমন হযরত আয়েশা বিনতে আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহা। তিনি ছিলেন নবী পত্নীদের মধ্যে অধিক স্মৃতিধর ও বুদ্ধিমতি। ইলমে দ্বীন শিক্ষা ও সম্প্রসারণে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তার জ্ঞানের পরিধি ও ব্যাপকতা ছিল সুবিস্তৃত। শুধু উম্মাহাতুল মুমিনীনদের মধ্যে নয়; সমগ্র নারী জাতির উপর এবং খ্যাতনামা কিছু সংখ্যক সাহাবী ছাড়া সকল সাহাবায়ে কেরামের উপরই তার জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা স্বীকার্য ছিল। আবু মুসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, আমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ কোন কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার নিকট সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করে সঠিক সমাধান পেয়ে যেতাম। আয়েশা ছিলেন নবীজির শিক্ষায়তনের অন্যতম ছাত্রী। প্রতিদিন মসজিদে নববীতে রাসুলুল্লাহর তালীম ও ইরশাদের বৈঠক বসতো। সৌভাগ্যক্রমে আয়েশার ঘর ছিল মসজিদে নববী লাগোয়া। ফলে ঘরে বসেই আয়েশা নবীজির তালীম, ভাষণ, হাদীস, তাফসীর ও ফিকহের পাঠদানে অংশগ্রহণ করতে পারতেন। কখনও কোন বিষয় বুঝতে না পারলে রাসুলুল্লাহ ঘরে ফেরার পর তা জিজ্ঞেস করে বুঝে নিতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তার সময়ের নারীদের শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার ব্যাপারটিকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। তাই নারীদের আলাদা করে তালীমের জন্য দিন ও স্থান ঠিক করে দিয়েছিলেন। নবীজি নির্ধারিত দিনে সেখানে গিয়ে বিশেষভাবে নারীদেরকে ইলমে দ্বীন শিক্ষা দিতেন। এসব বৈঠকে মহিলা সাহাবিগণ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করতেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাদের প্রশ্নের জবাব দিতেন। প্রশ্নোত্তরের জন্য থাকতো নির্ধারিত সময়। এসময়ে নবীজি তাদের দ্বীন ও ফতওয়া শিক্ষা দিতেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা সবসময়ই সাপ্তাহিক তালীমে অংশগ্রহণ করতেন। সেখান থেকে আহরণ করতেন ইলমের মূল্যবান মুক্তো। এধরণের শিক্ষা বৈঠকে বিশেষত আনসারিয়া মহিলাদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও ইলমের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা এ সম্পর্কে বলেন, আনসারিয়া মহিলাগণ কতই না উত্তম! দ্বীন শেখার ব্যাপারে লজ্জা তাদের মাঝে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রধানত নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম থেকেই ইলম অর্জন করেছেন। এছাড়াও তিনি কুরআন, হাদীস, শরয়ী ও পার্থিব অনেক বিষয়েই (যেমন কাব্যচর্চা, চিকিৎসাবিদ্যা) ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন তাঁর পিতা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু, বিশিষ্ট সাহাবী সাদ, হামযা ইবনে আমর আল-আসলামী রাদিয়াল্লাহু আনহু, নবীজির কন্যা ফাতিমাতুয যাহরা এবং মহিলা সাহাবী জুদামা বিনতে ওয়াহাব রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকেও নানান বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করেন।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন নবীজির হাদীসের অন্যতম সংরক্ষণকারিণী। রাসুলুল্লাহ থেকে অসংখ্য হাদীস শিক্ষা লাভ করেই তিনি বসে থাকেননি; সেগুলো অন্যকে শিক্ষা দান ও প্রচার প্রসারেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। সর্বাধিক হাদীস বর্ণনা করেছেন যে ক’জন সাহাবী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাদের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে আছেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার থেকে বিভিন্ন সময়ে সাহাবী ও তাবেঈদের মধ্য হতে অনেকে হাদীস শিক্ষা লাভ করেছেন। ইমাম শামসুদ্দীন আয যাহাবী রহ.১৯০ জন ছাত্রের নাম উল্লেখ করার পরে বলেছেন এছাড়াও আরও একদল ছাত্র থেকে হাদীসের পাঠ নিয়েছেন। তার প্রসিদ্ধ ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে কয়েকজন হলেন- আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদ আন নাখঈ, উরওয়া ইবনে যুবাইর, আমারা বিনতে আবদুর রহমান, কাসিম ইবনে মুহাম্মদ, আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান, আয়েশা বিনতে তালহা, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, সাফিয়্যা বিনতে শাইবা, আতা ইবনে আবু রাবাহ আল মাক্কী, মাসরূক ইবনে আজদা, আবুল আলীয়া রিয়াহী প্রমুখ।

ইলমে হাদীস ছাড়াও তাফসীর, ফিকহ, সাহিত্য, কাব্য, চিকিৎসা প্রভৃতি শরয়ী ও পার্থিব বিষয়ে ছিল তার অসামান্য দখল। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর সময় ধরে রাসুলুল্লাহর পবিত্র সাহচর্যে থেকে কুরআন নাযিল, নাযিলের প্রেক্ষাপট এবং আয়াতসমূহে অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং পরবর্তী জীবনে তার পাঠদান করেন।

অনুরূপ অবস্থা ইলমে ফিকহেও। নবীজি ছিলেন সকল বিষয়ের সিদ্ধান্ত ও ফতওয়া দানের কেন্দ্রস্থল। তাঁর ইন্তিকালের পর ইসলামী শরী’আত ও হুকুম-আহকামে পারদর্শী সাহাবীদের উপর এ দায়িত্ব বর্তায়। বিশেষ কোন সমস্যা আসলে তারা প্রথমে কুরআন ও সুন্নাহে সমাধান তালাশ করতেন। কিন্তু তাতে স্পষ্ট সমাধান না পেলে কুরআন-হাদীসের অন্য হুকুমের উপর কিয়াস বা অনুমান করে সিদ্ধান্ত প্রদান করতেন। খোলাফায়ে রাশিদার যুগের শেষ পর্যায়ে এসে বিভিন্ন কারণে বড় বড় সাহাবী অনেকেই মক্কা, তায়িফ, দামেস্ক, বসরা, কুফা প্রভৃতি নগরীতে ছড়িয়ে পড়েন। পক্ষান্তরে ইবনে আব্বাস, ইবনে ওমর, আবু হুরাইরা ও আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুম এ চার মহান ব্যক্তিত্ব মদীনায় ফিকহ্ ও ফাতাওয়ার কাজ আঞ্জাম দেন।

এ ক্ষেত্রে ইবন উমর ও আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহুমের পদ্ধতি ছিল উদ্ভূত সমস্যা সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের কোন বিধান কিংবা পূর্ববর্তী খলীফাদের কোন আমল থাকলে তারা তা বলে দিতেন। অন্যথায় নীরবতা অবলম্বন করতেন। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এ ক্ষেত্রে কুরআন, সুন্নাহ ও পূর্ববর্তী খলীফাদের আমলে সমাধানকৃত মাসআলার উপর অনুমান করে নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধি অনুযায়ী সমাধান দিতেন। আর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার মূলনীতি ছিল প্রথমে কুরআন ও পরে সুন্নাতের মাঝে সমাধান তালাশ করা। কিন্তু কুরআন ও হাদীসে সমাধান না পেলে স্বীয় জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত প্রদান করা এবং সেগুলোতে যথেষ্ট জ্ঞানের গভীরতা, প্রজ্ঞা ও সুক্ষ্মতার ছাপ রাখতেন।

আরবী সাহিত্য, পত্র সাহিত্য, কাব্যচর্চায়ও তার পাণ্ডিত্য ছিল অসামান্য। সুমিষ্ট, প্রাঞ্জল, অলংকারময় বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথা বলতেন তিনি।

মোটকথা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু। বিশ্বনারী জাতির মাঝে শ্রেষ্ঠতম মহিয়সী । তার মাঝে সমাহার ঘটেছিল ধর্মীয় ও পার্থিব উভয় প্রকার জ্ঞানের । সাহিত্য, কাব্য, চিকিৎসা, ইতিহাস এবং বংশ তালিকার সূত্র পরম্পরা সম্পর্কেও তার ছিল অগাধ জ্ঞান। জাহিলী যুগের কবিদের সুদীর্ঘ কবিতা সমূহ তিনি কন্ঠস্থ করেছিলেন। ধর্মীয় বিষয় সমূহের মধ্যে কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকহ্, ফাতাওয়া তথা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই ছিল তাঁর অসমান্য দখল। এসবকিছুই তাঁর জ্ঞান, প্রতিভা, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার জ্বলন্ত সাক্ষ্য।

উম্মাহাতুল মুমিনীনদের থেকে উম্মু সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহাও ছিলেন অগাধ জ্ঞানের অধিকারিণী। নারী সাহাবিয়াদের মধ্যে হাদীস বর্ণনায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার পরেই তার স্থান। ইবাদত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, ফিকহ, চিকিৎসা এমন সকল বিষয়েই তার বর্ণিত হাদীস পাওয়া যায়। উম্মু সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহার থেকেও হাদীস বর্ণনাকারীর বিরাট একদল ছাত্রের কথা বর্ণিত আছে।

হাফসা বিনতে ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহার তো ছিলো জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ পাণ্ডিত্য। ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও প্রখর মেধার অধিকারিণী। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লেখাপড়া না করলেও বাবা ও স্বামীর কাছে ধর্মীয় বিষয়াদিসহ অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেছেন। শিক্ষার প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। বিভিন্ন ব্যাপারে তার বাক্যলাপ ছিল খুবই গুছানো ও প্রাঞ্জল। তার বাচনভঙ্গিতে মুগ্ধ হয়ে ও শেখার আগ্রহ দেখে নবীজি তার জন্য পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাকে বিভিন্ন জিনিস শেখানোতে আগ্রহী হন। এইজন্য সেকালের পড়াশোনা জানা মহিলা সাহাবিয়া শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহাকে নবীজি হাফসাকে লেখাপড়া শেখাতে বলেন। তিনি হাফসাকে লিখতে শিখিয়েছিলেন।

শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ ‘নামলা’ নামক এক প্রকার ক্ষতরোগ নিরাময়ের ঝাড়-ফুঁক জানতেন। জাহেলী যুগে তিনি এই ঝাড়-ফুঁক করতেন। একদিন তিনি রাসূলুল্লাহর নিকট এসে বললেন, আমি জাহেলী জীবনে ঝাড়-ফুঁক করতাম। আপনি অনুমতি দিলে সেই মন্ত্র আপনাকে শুনাবো। রাসুল শুনে বললেন, এ ঝাড়-ফুঁক তুমি হাফসাকে শিখিয়ে দাও।

অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, রাসুল শিফাকে বলেনঃ তুমি কি হাফসাকে এ ‘নামলা’র মন্ত্রটি শিখিয়ে দেবে না, যেমন তাকে লেখা শিক্ষা দিয়েছ?

এসব বর্ণনা হতে হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহার জ্ঞান চর্চার আগ্রহ-উদ্দীপনা এবং এ বিষয়ে নবীজির ভূমিকা কী ছিল তা অবগত হওয়া যায়।

শিফা বিনতে আব্দুল্লাহর নিকট থেকে হাফসা যেখানে রাসুলের নির্দেশে নামলার মন্ত্র শিখেছেন, সে ক্ষেত্রে দীনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হাদীসের জ্ঞান রাসুল থেকে অর্জন করবেন, এটাই স্বাভাবিক। নবীপত্নী হিসেবে রাসুলকে কাছ থেকে দেখার, তাঁর থেকে অনেক কিছু জানার সৌভাগ্য হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে ইলম শিক্ষা ও বর্ণনায় তিনি উজ্জ্বল অবদান রেখেছেন।

এছাড়াও মাইমুনা বিনতে হারিস, উম্মু হাবীবা বিনতে সুফিয়ান, যাইনাব বিনতে জাহাশ, সাওদা বিনতে যামআ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা ছিলেন অসামান্য জ্ঞানের অধিকারিণী। ইলমের মূল উৎস নবীজির সাহচর্যে তারা সকলেই হয়ে উঠেছিলেন আলো বিলানো জ্ঞানের প্রদীপ!

উম্মাহাতুল মুমিনীন ছাড়াও ইলম চর্চার ধারাবাহিকতায় উঠে আসে আসমা বিনতে ইয়াযীদ, আসমা বিনতে উমাইস, আসমা বিনতে আবু বকর, উম্মু হানী বিনতে আবু তালিব, উম্মু আতিয়্যা বিনতে হারিস, ফাতেমা বিনতে কায়েস, উম্মুল ফযল বিনতে হারিস, উম্মু কায়েস বিনতে মিহসান, ফাতিমাতুয যাহরা বিনতে রাসুলুল্লাহ, খাওলা বিনতে হাকীম,উম্মু সুলায়ম বিনতে মিলহান রাদিয়াল্লাহু আনহুমাসহ প্রমুখের নাম।

একজন দারুণ ব্যক্তিত্বের কথা বলা যাক আলাদা করে। তার সম্পর্কে অবশ্য একটু আগেই কিছুটা ধারণা পেয়েছি। তিনি হলেন লাইবা বিনতে আব্দুল্লাহ। চিকিৎসাশাস্ত্রে দক্ষতা ও খ্যাতির কারণে শিফা উপাধি পেয়েছিলেন। পরে শিফা নামেই পরিচিত হন। যাকে বলা হয় ইসলামের প্রথম শিক্ষিকা। যোগ্যতার আধার তিনি পড়তে ও লিখতে শিখেছেন দক্ষতার সাথে। শিখিয়েছেন অন্যদেরও। স্বয়ং রাসুল তাকে অনুরোধ করেছিলেন উম্মুল মুমিনীন হাফসাকে পড়াশোনা শিক্ষা দেওয়ার জন্য। তিনি তা করেছিলেন। আশ-শিফার স্বামী ছিলেন তারই গোত্রের একজন, যার নাম ছিল আবু হুত্বমাহ ইবনে হুযাইফা। তার ছেলে সুলাইমানও বড় হয়ে একজন ধার্মিক মানুষ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। আশ-শিফা রাসুলের সাথে মদীনায় হিজরতকারিনীদের একজন ছিলেন।

তিনি রাসুলের কাছ থেকে নানা প্রশ্নের মাধ্যমে আরো ভালভাবে দ্বীনী জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করতেন। দ্বীন শিক্ষার জন্য তিনি মসজিদে নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন । তাছাড়া নবীজি প্রায়ই খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য তার বাড়িতে যেতেন। তখন তিনি নবীজির থেকে ইলমে দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়াদি জেনে নিতেন। এভাবে তিনি একজন সুযোগ্যা ‘আলিমা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন। মদীনার সমাজব্যবস্থা উন্নত হবার পর, ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বাজারের ক্রয়-বিক্রয়কেন্দ্রে বিশেষ পর্যবেক্ষণের জন্য লাইবা বিনতে আব্দুল্লাহ আশ -শিফাকে নিযুক্ত করেন। তিনি বাজারে ঘুরে ঘুরে ইসলামী শারীয়াহ অনুযায়ী ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে কী না তা দেখতেন। ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলে দিয়েছিলেন, যে কোন লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়ের বৈধতা নিয়ে যদি কেউ সংশয় বোধ করে তাহলে যেন সে এ ব্যপারে লাইবা বিনতে আব্দুল্লাহ আশ – শিফার কাছ থেকে পরামর্শ নেয়। তার দ্বীনি জ্ঞানের ব্যপারে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু আস্থাশীল ছিলেন। আবার কোন বিষয় যদি আশ-শিফার কাছেও জটিল মনে হতো, তিনি ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছ থেকে পরামর্শ চাইতেন। হয় তিনি নিজে এর সমাধান দিতেন অথবা তার উপদেষ্টা পরিষদের কাছে পাঠাতেন।

সাহাবা যুগ থেকে ইলমচর্চায় নারীর পথচলার ধারাবাহিকতায় যেসব সাহাবিয়ার নাম পাই আমরা তাবেঈ যুগে তাদের ছাত্রীরা এ ধারাবাহিকতার পথ ধরেই হেঁটে চলেন। তার পরের যুগেও চলতে থাকে এই কাফেলার যাত্রা। হাদীসচর্চায় মোটাদাগে যে কয়েকজনের নাম উঠে আসে তারা হলেন,

হাফসা বিনতে সিরিন (যার বর্ণনাকে আয়াস বিন মুআবিয়া রহ.হাসান বসরী, ইবনে সিরিনের বর্ণনার চেয়েও অধিক গুরুত্ব দিতেন), উম্মে দারদা, আয়েশা বিনতে আবদুল হাদি, আমারা বিনতে আব্দুর রহমান,ইয়াজিদের ক্রীতদাসী আবিদা,ফাতেমা বিনতে আব্দুর রহমান, আমাতুস সালাম, কারীমা মারওয়াজিয়্যা, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মদ আস সাহিদাহ, যাইনাব বিনতে আহমাদ, ফাতিমা আল ফাজিলা রহ.প্রমুখ।

ফিকহের উচ্চ শাখায় যারা স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন তাদের থেকে প্রসিদ্ধ কয়েকজন হলেন, যাইনাব বিনতে আবি সালামা, খাদিজা বিনতে সাহনুন, ফাতিমা বিনতে ইয়াহইয়া বিন ইউসুফ আল মাগামী, উম্মে ঈসা বিনতে ইবরাহীম বিন ইসহাক আল হারবী, খাদিজা বিনতে মুহাম্মদ বিন আহমদ আল জুরজানী, আমাতুল ওয়াহিদ সুতাইতাহ বিনতে আব্দুল্লাহ, যাইনাব বিনতে আবুল বারাকাত আল বাগদাদীয়া। (যিনি ফিকহ ও সাহিত্যের ক্লাস নিতেন) আয়েশা বিনতে ইউসুফ আল বাউনিয়া, যুবাইদা বিনতে আসআদ আল কুস্তুনতুনিয়া রহ. প্রমুখ।

এভাবেই শতকের পর শতক ধরে ভারি হতে থাকে এ কাফেলা। প্রতি শতকে সৃষ্টি হতে থাকে অসামান্য পাণ্ডিত্য ও অগাধ জ্ঞানের অধিকারিণী নারীদের একটি করে প্রজন্ম। ইলমুল কেরাত থেকে নিয়ে হাদীসচর্চা, তাফসির, তাসাউফ, ইতিহাস, দর্শন, চিকিৎসাবিদ্যা, কাব্যচর্চা, সাহিত্যিকতার মতো জ্ঞানের প্রতিটি শাখাতেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে বিরাট একদল নারীর অসামান্য দখল ইতিহাসের পাতা খুললেই আমরা দেখতে পাই। এবং তারা সকলেই ছিলেন রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের। অথচ এযুগে এসেও নারীদের মৌলিক জ্ঞান অর্জনের পরে কোন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা, বুৎপত্তি অর্জনের পথে প্রথম বাধাটা আসে রক্ষণশীলতার দোহাই দিয়ে। কারণ আমরা জানি না এ পথে আমাদের চৌদ্দশত বছরের পথচলার ইতিহাস। পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থা ও নারীশিক্ষার প্রচারণার আড়ালে চাপা পড়ে গেছে ইসলামি জ্ঞানচর্চায় নারীদের অংশগ্রহণ, জ্ঞানের যেকোন শাখায় তাদের বুৎপত্তি অর্জন ও অবদানের কথা। এমনকি ইতিহাসের এই অধ্যায়ে নারীদের কোনরকম অবস্থান ছিল কী না তার কোন হদিসও পাওয়া যায় না। ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সমাজে সে ইতিহাস ভুলে থেকে রক্ষণশীলতার দায় দিয়ে নারীদের জ্ঞানচর্চাকে ব্যাহত করার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে!

পশ্চিমা শিক্ষার সাংস্কৃতিক রাজনীতির আড়ালে চাপা পড়ে থাকা মুসলিম সমাজে নারীর জ্ঞানচর্চার ইতিহাস আমাদের তুলে আনা এখন সময়ের দাবি। এ ইতিহাসকে তুলে আনার মাধ্যমে মুসলিম নারীদের জ্ঞানচর্চার ধারাবাহিকতার রূপরেখা তৈরি করা যাবে। এর মাধ্যমে পশ্চিমা শিক্ষা সংস্কৃতির বিপরীতে যুগোপযোগী শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার ব্যবস্থা করে রক্ষণশীল পরিবেশে থেকেও মুসলিম নারীরা একটি সমৃদ্ধ প্রজন্ম ও ইতিহাস গড়ে তুলতে পারবে।

তথ্যসহায়িকা:

১.সহীহ বুখারী।
২.সিয়ারু আলামিন নুবালা।
৩.আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া।
৪.মুসনাদে আহমাদ।
৫.ফাতহুল বারী।
৬.খাওয়াতিমে ইসলাম কে কারনামে।
৭.আলামুন নিসা ফি আলামাইল আরব ওয়াল ইসলাম।

 

আগের সংবাদশবে বরাত উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজন
পরবর্তি সংবাদনারী ফেকাহবিশারদ ও তাঁদের পরিচালিত পাঠ্যসভা