সুদানে শাইখ উসামার যাপিত দিনগুলো:ইব্রাহিম সানুসীর সঙ্গে আলাপ

(আল-কায়েদার নেতা শাইখ উসামা বিন লাদেন ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত দীর্ঘ ৬ বছর সুদানের ইসলামপন্থী সরকারের রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তায় ছিলেন। দেশটির শাসনক্ষমতায় তখন হাসান আত-তুরাবীর নেতৃত্বে ইসলামপন্থী দল। এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে শায়খ উসামা উঠাবসা করেছিলেন ইব্রাহিম সানুসীর সঙ্গে। বরং বলা ভালো—তার ঘনিষ্ঠজনদের একজন হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শায়খ ইব্রাহিম সানুসী ছিলেন সুদানের ইসলামী আন্দোলনের তৃতীয়তম প্রধান ব্যক্তিত্ব। বর্তমানে তিনি সুদানের পপুলার কংগ্রেস পার্টির পার্লামেন্টের একজন সদস্য।

আল জাজিরা ২০১১ সালে এ বিষয়ে শায়খ ইব্রাহিম সানুসীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিল। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন আম্মাদ আব্দুল হাদী আল-খুরতূম। এই সাক্ষাৎকারে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন—শায়খ উসামা, তার ব্যক্তিজীবন, ভাবনা, বিশ্বাস, আল কায়েদা; ইত্যাদি। ফাতেহের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন  আবদুর রহমান রাফি।)

আল জাজিরা: শায়খ ওসামার শাহাদাত সম্পর্কে আপনি কী বলেন?

সানুসী: তার শাহাদাতের পর পাশ্চাত্য যতটা উল্লসিত হয়েছে, তার চেয়েও অধিক গৌরবান্বিত হয়েছি আমরা। কারণ তিনি আল্লাহর পথে শাহাদাতের মহৎ সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছেন। মহান আল্লাহর শুকরিয়া, তিনি বিছানায় শুয়ে মৃত্যুবরণ করেননি। অঢেল সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি জিহাদের ময়দানে ছুটে গিয়েছিলেন— উম্মাহকে উপনিবেশ আর আরব বিশ্বের অত্যাচারী শাসকদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে, ফিলিস্তিনীদের প্রাপ্য পুনরুদ্ধার করতে। আল্লাহ তাকে শাহাদাতের পরম সৌভাগ্য দান করেছেন।

আল জাজিরা: কিভাবে সুদানে তার আগমন ঘটলো?

সানুসী: সুদানে তার আগমন ঘটেছিল—যেভাবে মাতৃভূমিতে একটি নবজাতকের আগমন ঘটে। অথবা যেভাবে মেঘ থেকে অসামান্য স্বাভাবিকতায় বৃষ্টিফোঁটা নেমে আসে পৃথিবীতে; ঠিক সেভাবে। তিনি আমাদের কাছে আসেন ১৯৮৯ এর সুদানি বিপ্লবের বিষয়ে যখন জানতে পারেন, এটি ইসলামী মূল্যবোধ লালন করে ও ব্যাপক প্রকল্প হাতে নিয়ে পথচলা শুরু করেছে। তিনি সুদানে এসেছিলেন তার সম্পদ আর চিন্তা নিয়ে। তিনি উত্তরের খুরতূম শহরের ব্যাপক উন্নয়ন করেন। এছাড়াও পূর্বদিকের শহরগুলিতে বহু কৃষি-প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন।

আল জাজিরা: সেই স্থানগুলো কি তার প্রকল্প, সেনাশিবির ও প্রশিক্ষণস্থল ছিল?

সানুসী: না। তেমনটি ছিল না। তিনি শুধু চাষাবাদ আঞ্জাম দিতেন। একদিন তো ক্ষেত থেকে সিম নিয়ে এসেছিলেন আমার কাছে; ইতিপূর্বে যা আমি কোনদিন দেখিনি।

সুদানবাসীর জন্য তিনি বৃহত্তর কল্যাণ নিয়ে আমাদের সাথে তার দিনগুলো কাটিয়েছিলেন। এবং সে সময়ের মাঝে তিনি বহিরাগত কোন অঞ্চলে সক্রিয় সামরিক তৎপরতায় নিজেকে যুক্ত করেননি। তিনি সুদানের আইন ও নীতিমালাকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন; এখানে কাটানো তার পুরো সময়টিতে।

আল্লাহ তাকে কল্যাণের মানদণ্ডে সর্বোচ্চ প্রতিদান দান করুন।

আল জাজিরা: যেহেতু তিনি আপনার একান্ত বন্ধু ছিলেন; তো তার পক্ষ থেকে আপনি কিরূপ আচরণ পেয়েছিলেন?

সানুসী: অন্যদের ক্ষেত্রে জানিনা। আমি তার থেকে বিনয়ের মাধুর্য আর ইসলামের সর্বোচ্চ আখলাক দেখেছি। এমন বিনয়— জগতের আর কোন সম্পদশালীর হতে পারে না। তিনি অত্যন্ত দুনিয়াবিমুখ ছিলেন। মোটকথা তিনি ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি—যিনি নিজের মাঝে আভিজাত্য, পবিত্রতা ও জিহাদের ক্ষেত্রে ইসলামের সত্যিকারের নীতিগুলোর সমন্বয় ঘটেছিলেন।

তিনি মনে করতেন জিহাদ ইসলামের এমন এক মূল ভিত্তির নাম, যার ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শনের কোন সুযোগ নেই, এবং অবশ্যই তাকে আঞ্জাম দিতে হবে। বিশেষ করে আফগানিস্তান অথবা ফিলিস্তিনের মত করে কোন পরিস্থিতি দাঁড়িয়ে গেলে জিহাদ ছাড়া বিকল্প কোন পন্থা নেই।

আল জাজিরা: কখন থেকে তিনি নিজেকে জিহাদের সঙ্গে জড়িয়েছেন?

সানুসী: সুদানে আসবার পূর্বে। যখন থেকে তিনি আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন। তখন অবশ্য আমেরিকার সমর্থন‌ তার সাথে ছিল। তবে মুসলিম অঞ্চলগুলোর দখলদারিত্বের কারণে তিনি যেভাবে রাশিয়ার সমালোচনা করতেন, সেভাবে আমেরিকার বিরুদ্ধেও কথা বলতেন।

আল জাজিরা: বলা হয় তিনি আরব রাষ্ট্রগুলোর সংস্কার সম্পর্কে অনেক ভাবতেন। আপনি এ সম্পর্কে জানেন কিছু?

সানুসী: সুদানে থাকতে তিনি সৌদি আরবের সংস্কার সম্পর্কে অনেক বলতেন। তিনি খুব করে চাইতেন—সেখানে শুরাব্যবস্থা চালু হোক। একদল লোক রাষ্ট্র-কোষাগার থেকে আমীরদের অবাধ অপচয়কে নিয়ন্ত্রণ করবে। সেইসব অর্থ মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যাবে। এগুলোর ভাবনা তাকে বিভিন্ন সময়ে উদ্বিগ্ন করে তুলতো। তার সংস্কার-ভাবনা সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি আমি শুনিনি।

আল জাজিরা: কেন তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল বা সুদান ছেড়ে যেতে বলা হয়েছিল?

সানুসী: তার চলে যাওয়ার কারণটা বড় অদ্ভুত।

আমি যতটুকু জানি, সুদানের কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা সে সময় একজন আমেরিকান দূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এবং তার কাছে শায়খ ওসামাকে ধরিয়ে দেয়া বা গ্রেফতারের প্রস্তাবনা দেয়। তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিল বিল ক্লিনটন। আমেরিকান দূত তাদের এই প্রস্তাবনার কথা ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন অ্যালব্রাইটের কাছে পৌঁছান। কিন্তু তারা তাকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহ প্রকাশ করেন। শায়খ ওসামার বিরুদ্ধে তাদের হাতে কোন মামলা না থাকার কারণে তারা গ্রেফতারের অক্ষমতার কথা জানিয়ে দেয় সুদানি সরকারি কর্মকর্তাদের।

তখনকার এই মামলাহীনতা থেকে বোঝার মত একটি বিষয় হলো, শায়খ উসামা সুদানে থাকাকালীন কোন সশস্ত্র কর্মকাণ্ড অথবা কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সহিংস কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না। আর লজ্জাজনক বিষয়টি ছিল— কতক সরকারি কর্মকর্তা তাকে ধরিয়ে দিতে চাইলো। বিপরীতে আমেরিকা সে প্রস্তাবনাকে উড়িয়ে দিলো। তবে তার চলে যাওয়ার মূল কারণ সম্পর্কে আমি অবগত নই।

আল জাজিরা: ওসামা বিন লাদেনের শাহাদাতের পর, এখন আমেরিকার গতিবিধি ও সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে আপনি কী বলেন?

সানুসী: আমেরিকা যদি মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতির প্রতি খেয়াল রেখে না চলে, তাহলে নতুন কোন ‘ওসামা’ থেকেও তারা নিরাপদ নয়। আর আবশ্যকীয়ভাবে যে কাজটি করা দরকার, তা হল—তারহীব ও তারগীবের রাজনীতির মাঝে তুলনামূলক বিশ্লেষণ। এভাবে যে, শক্তি দ্বারা তারহীব করা যায় সত্য। তবে এটি সামষ্টিক নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে। পক্ষান্তরে তারগীবে এ বিষয়টি নেই। তারগীব হলো— ভিন্ন বিশ্বাসের বা মতাদর্শের লোকদেরকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আলোচনায় প্রলুব্ধ করা।

আল জাজিরা: শায়খ উসামার শাহাদাতের পর, এখন কি আল কায়েদা ভেঙে যাওয়ার কোন আশঙ্কা আছে?

সানুসী: যেহেতু মৃত্যু আছেই; এবং তার শাহাদাত একটিমাত্র ব্যক্তির মৃত্যু (প্রতিটি মানুষের পরিণতিই এটি), সেহেতু আমরা বলতে পারি— তার সমস্ত চিন্তাধারা ও অবদান বেঁচে থাকবে। আল-কায়েদার কর্ম ও চিন্তা উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করবে। এবং এর সক্রিয়তা অব্যাহত থাকবে যতদিন অত্যাচারী শাসক ও আমেরিকার সেবাদাসরা থাকবে। যতদিন বাকি থাকবে উপনিবেশ…. যতদিন পড়ে রইবে ফিলিস্তিন সমাধানহীন..

তার জীবদ্দশায় বহু মানুষ তার চিন্তাকে গ্রহণ করেছে। তাকে বুকে সম্বল করে চলে গিয়েছে হয়তো আরববিশ্বের কোন প্রান্তে, অথবা এশিয়ায়, অথবা আফ্রিকার কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তাদের মধ্য থেকে বহু মানুষ তাকে সামনাসামনি দেখেনি, কিংবা সে আল-কায়েদার সদস্য নয়। তবুও। এর থেকেই বোঝা যায়, তার সমস্ত চিন্তা ও কর্ম বেঁচে থাকবে। যদি পাশ্চাত্য মুসলমানদের উপর থেকে তাদের বিষময় জাল সরিয়ে নেয়, তাহলেই একমাত্র আল-কায়েদার কর্মতৎপরতা শ্লথ হতে পারে।

আগের সংবাদ‘আল্লাহ কেন দেন বিপর্যয়?’ : বিপর্যয়ের নৈতিক ব্যাখ্যার সন্ধানে
পরবর্তি সংবাদইসলাম ও সায়েন্স ফিকশন