‘সোফি’ কফি হাউজ

কাউসার মাহমুদ

 

এক.

সবেমাত্র দুমাস হলো এই বিদেশবিভুঁইয়ে এসেছি। সবকিছু গুছিয়ে উঠতে এখনও কিছু বাকি। তাই জীবনের সেই তাড়াটি তখনও আক্রান্ত করেনি আমায়। কফিশপ, পার্ক, মার্কেট আর মানুষের ভিড়ের মাঝেই ঢুকে যাচ্ছি বারবার। কখনো আদিগন্ত গ্রাম জুনাবের আশপাশ ঘুরে গভীরভাবে রাখালদের মেষ বকরি চড়ানো দেখি। আর রোজ সন্ধ্যায় আমার অস্থায়ী বাসা থেকে একটু দূরেসোফিকফি হাউজে গিয়ে বসে পড়ি। সাতটাআটটা নাগাদ ওখানে কাটিয়ে চলে যাই রেজমা শহরের কাঁচাবাজারে। গভীর রাত নামতেই আবার হাঁটতে হাঁটতে পেছনের পথ ধরে ফিরে আসি আমার ছোট্ট খুপরিঘরে। যেন এক অদ্ভুত যাপন। কোনো অস্থিরতা নেই, চাঞ্চল্য নেই। শুধু কেবল ধীর শান্ত হয়ে মানুষের জীবনের ভেতর ঢুকে যাবার নেশা। কারা কারা সুখে আছে এই মহাসমারোহের ভেতর, আর কেইবা নিদারুণ দুঃখ আর অসহ্য যাতনা চেপে অপেক্ষা করছে কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণের, যেখানে সে তার শবদাহ প্রস্তুত করে রেখে যাবে জীবন্ত অধিবাসীদের জন্যতা জানার উৎকন্ঠা। সত্যিই! তখন যেন ঘোরগ্রস্তের মতো শুধুই কেবল পথে পথে হাঁটি, আর অন্তর্গত কোনো এক বিভক্ত তাড়নায় মানুষের চলাচল দেখি। পড়তে চেষ্টা করি মানুষের বাহ্যত প্রলেপের আড়ালে লুকিয়ে রাখা সেই দুর্বৈব আহত সত্তাটিকে।

 

এই যখন জীবনের রুটিন, দিনমান শুধু হেঁটে হেঁটে অপরিচিত দেশের লোকাচার জনঅভ্যাসচক্রের অন্তঃপুরী হওয়া, তাই অতিদ্রুত ছন্নছাড়া কিছু শিল্পীসাহিত্যিক বন্ধু আমার জুটে গেল। তাদের কেউ কেউ নতুন কবিতা লিখতে এসেছে, কেউ দীর্ঘদিন যাবত একটি জ্বলন্ত গদ্যরীতি আয়ত্বের অভিপ্রায়ে নিঃসঙ্গবাস নিয়েছে, কেউবা আর্টে আরবজাতকে কাঁপিয়ে দিতে অরণ্যবাসের মনস্থির করেছেসবারই যেন জীবনের প্রতি একটা স্পষ্ট অনীহা। সোসাইটি ভেঙে ফেলার দুর্মর প্রয়াস। লোকে কী বলে, কী ভাবে, এসবের থোড়াই কেয়ার সকলের বৃদ্ধাঙুলে। মোটে মোটে এমন পাগলাটে গোছের জনের একটা দল গড়ে উঠল আমাদের। সেখানে তাদের ভেতর আমিই কেবল বাঙালি অন্যভাষী৷ বাকিরা সবাই দেশীয় গোষ্ঠীগত আরব ভ্রাতা।

 

রোজ সন্ধ্যা নামতেই আমরাসোফিকাফেতে এসে জুড়তাম। আধো আলোঅন্ধকারমাখা এই ক্যাফের একদম কোণার টেবিলটি ছিল আমাদের। এমন হয়ে গিয়েছিল যে, দোকানি আলখেল্লা পরিহিত পৌঢ় সুদানি ভদ্রলোক আমাদের জন্য আগেভাগেই তা প্রস্তত রাখতেন। আর আমরা একেএকে এসে নিশ্চুপ বসে যেতাম আমাদের সেই গুমোট গোলকের ভেতর। বন্ধুদের তিনজন একটুআধটু পানকারী। তাদের চোখ ঢুলুঢুলু রক্তিম লাল। মাঝেমাঝে ভয় পেতাম, এই কঠোর শাসনের দেশে কোনদিন যে তারা পুলিশের খপ্পরে পড়ে! আর হাজতবাস হয় উচ্ছন্নে  যাওয়া দলটির তিন সদস্যের! কখনোসখনো নিয়ে হাসতামও ব্যাপক। বাকি যে দুজন প্রতিটি মুহূর্ত ঠোঁটের নিচে তামাক গুঁজে রাখত, এদের একজন নাদিম। শিল্পী। কাগজে  নারীদের বিভিন্ন অঙ্গের অসহ্যরকমের ছবি নিয়ে হাজির হয়েছে আজ। ওই নিয়ে মেতে আছি আমরা। ফারেস তার ঢুলুঢুলু চোখে কোনোরকম তাকিয়ে বলল, ‘এই রে! পিকাসোর পোঁদ মেরে দিলে! কী স্ক্যাচ মাইরি!’ অমনিই শুরু হয় তর্ক। বেশি বকছিল নাদিমের স্বগোত্রীয় অন্য দুভাই জামিল তুসী। ওরাও আর্টিষ্ট। তাই বাক্যবাগিশ সেজে এক মহাতর্কের উত্থানই যেন ব্রত ওদের।

ফারেসের কথা ধরে হোহো করে হেসে উঠল ওরা। এদিকে ফারেস যেহেতু কবি, তাই নাদিমও তার নতুন এক কবিতার শৈল্পিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কবিদের গোষ্ঠী উদ্ধার করে তবেই থামল। একমাত্র প্রাণী ইয়াসেফই কেবল ঝিম মেরে শুনছে সব। যেন গদ্যের সুঁচালো ছুরিটায় আরও শান দিচ্ছে গম্ভীর ভাবনায়। হয়তো কাল বা পরশুই নিয়ে বিশাল এক তীর্যকপূর্ণ রচনা লিখে তবেই ক্ষান্ত হবে সে। সবার ভেতরই শিল্পের নয়া বীজ। তাই উত্তেজনা কারও থেকে কারও বিন্দুমাত্র কম নেই। ধীরেধীরে তা যেন একটা বাকযুদ্ধে পরিণত হচ্ছিল। এরমধ্যে আমিই কেবল নির্লিপ্ত। তর্কের মাঝে বার কয়েক মতামত চেয়েও দুপক্ষের কেউ কোনো উত্তর না পেয়ে তারা নিজেরাই এখন গেঁজাচ্ছে। আমি তখন তাদের মাঝে নেই। আমার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে সামনে বসা ঊনিশ বা বিশ বছরের ওই যুবক।

হ্যাঁ, যুবকই বলা চলে তাকে। তার যে বয়স শারীরিক গঠন, তাতে যুবা বলা অনুপুযুক্ত হবে না। ঠোঁটের ওপর গোঁফের রেখাটি সরু হয়ে কালোবর্ণ ধারণ করেছে। চোয়াল কিছুটা চাপা। গায়ের রঙ অতিশয় ফর্সা হলেও চোখের নিচের কালো দাগ স্পষ্ট বোঝা যায়। চোখেমুখে এক চরম বিরক্তির ছাপ নিয়ে বারবার ইতিউতি করছিল সে। যেন কিছু হারিয়ে ফেলেছে অথবা নিজেই হারাতে চায়। জামাকাপড়ও অত ভদ্রস্থ নয়। পরিধানে লম্বা জোব্বা গলায় প্যাঁচানো রুমালটিই সার। তাও ভীষণ ময়লা। খুব গভীরভাবে তাকালে তার চোখের ভেতর আগুনের গোল্লা দেখা যায়। যেন এখনই ফেটে পড়তে চাইছে। বার কয়েক চোখাচোখিতে সে কেমন অস্বস্তিবোধ করে। কিন্তু আমাকে টেনে নেয় তার চোখ। অস্থির সে চোখের ভেতর যে আগুন খেলা করছিল তাই আকর্ষণ করে আমায়। কেন যেন নিশ্চিত মনে হয়, এই যুবক অস্বাভাবিক রকমের উত্তেজিত। এবং সে কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। আর তার বুকের ওপর অনেক কথা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে আছে। তাই কিছুটা সঙ্কোচ দ্বিধা জড়িয়ে ইশারায় ডাকলাম তাকে। আমার বন্ধুরা হঠাৎ আমার ডাক শুনে ছেলেটির দিকে তাকায় এবং মনোযোগ নিবদ্ধ করে। কারণ, এই কাফেতে আজ অবধি আমরা কাউকে আমাদের আড্ডায় ডাকিনি। এটা লোকসমাজের প্রতি আমাদের একরকম অহম বৈরাগ্যতা ছিল সেসময় পর্যন্ত।

আমি বেঁচে আছি কি মরে গেছি, দয়া করে কথা জিজ্ঞেস করবেন না। এই যে শরীর, যেটাকে নিদারুণ কষ্টে টেনেটুনে হাঁটছি, তার ভেতর প্রাণটা পুড়ে গেছে। অগ্নিদান হয়েছে আমার সমস্ত অস্থির। ইটের ভাটার মতো দাউদাউ করে যে আগুন ভেতরে জ্বলছিল তাই এখন জ্বলতে জ্বলতে মৃত্যুর পথে।

এই ছিল উমরের প্রথম কথা। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলে সে। কারও সঙ্গে হাত মেলানো বা পরিচয়পর্বের আগেই এক শ্বাসে কাঁপতে কাঁপতে কথাগুলো বলে ও। অপরিচিত এক আগন্তুকের এমন আচরণ আমাদের সবাইকে স্তব্ধ করে দিলেও ওর চোখের সেই আগুনের গোলা যা এখন দীপের মতো জ্বলছে, তার আলোর ভেতর আমরা আটকে পড়ি। ফারেস যে একটুআগেও নেশায় চুর হয়ে আজেবাজে বকছিল, সেও নড়েচড়ে বসে। অবস্থাদৃষ্টে এই মনে হচ্ছিল; যেন এক অপরিচিত আগন্তুক হঠাৎই ঝড়ের মতো এসে আমাদের সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। আর আমরা গভীরভাবে তার প্রতিটি অঙ্গের নড়াচড়া লক্ষ করে তার পরবর্তী শব্দটি শোনার জন্য মুখিয়ে আছি। তার পূর্বমুহূর্তে  আমাদের মাঝে বিরাজ করছে অখণ্ড নীরবতা।

কিছুক্ষণ পর পরিবেশ হালকা করতে নাদিমই জিজ্ঞেস করে–‘কী হয়েছে তোমার, এমন উত্তেজিত কেন? এই শহরে কোথায়ইবা থাকো?’

নাদিমের প্রশ্নের উত্তরে উমর যেন থেমে রয়। কোনো রা নেই। অথচ কী অদ্ভুত! তারপরই কয়েক মুহুর্ত আমাদের সকলের দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে সে যেন জ্বলে ওঠে–‘কে আমি?  আমিআমি..অন্তঃসারশূন্য এক বিভ্রান্ত পথিক। ঘনঘোর অন্ধকারমাখা এই পৃথিবীর বিজন পথে একলা হাঁটছি। আর দেখছি মানুষের মৃত্যুর মিছিল, মানুষের সর্বস্ব হারানোর আর্তনাদ, বাস্তুচ্যুত, গৃহহারা, আপন জন্মমাটির গন্ধ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রিত সেই নারী শিশুদের আর্তনাদ আমাকে মেরে ফেলেছে। খোকলা হয়ে গেছি আমি। মনে হয় এই নামমাত্র আধুনিক সভ্যতা একটা বকওয়াস মাত্র। আন্তর্জাতিক বিচার, অভিবাসী সংস্থা, আরও যতকিছু আছে, এসব ভুয়ো। মনুষ্যত্বের ওপর এক প্রলেপ ছাড়া আর কিছুই না। ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত কোনোকিছুই আলাদা করতে পারছি না আমি। কী এক নিঃসীম অনুভূতিহীনতার চাদর গায়ে কোথায় কোথায় যে চলছি নিজেই জানি না! শুধু কেবল কামনা করছি প্রবল এক মৃত্যুর। একমাত্র এটাই হবে আমার অন্তর্দ্বন্ব অন্তিম শোকের উপশম।

উমরের একেকটি শব্দ বুঝি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো বেরুচ্ছিল। যেন বহুদিনের জমানো ক্ষোভ, রাগ গোস্বা এখন পরিণত হয়েছে দুঃখ, হতাশা বিভ্রান্তিতে। সেইসাথে সে নিজেও এই অন্তর্দহনে পুড়ে পুড়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। তাই এখন সে ছুটি নিতে চায়। বেরোতে চায় মানুষের ভেতর থেকে। তার আগে শেষবার ভেতরের সব কথা বলে যাবার জন্যই উত্তেজনা। কিন্তু সুস্থির, ধীরলয়ে কথা বলার সময় তো তার নেই। তাই বুঝি এমন ছলকে  ছলকে উঠছিল তার প্রতিটি শব্দ। আমরা তাই শুনতে শুনতে ভুলে গেলাম নিজেদের কথা। যেন গভীর এক আত্মমগ্নতায় আমাদের বেঁধে ফেলে উমর।

একটু থেমে সে বলতে থাকে–‘মাত্রই মিসরীয় বন্ধুদের আড্ডায় গুড়গুড় করে হুঁকো টেনে লাথি মেরে তা উল্টে এসেছি। একপ্রস্ত খিস্তি উড়িয়ে ঢেকে দিয়ে এসেছি ওদের। অথচ জানি না এমনটা কেন করলাম। ওরাও বুঝে উঠতে পারেনি যে, হঠাৎই কী হলো আমার। সবাই স্তম্ভিত হতবিহ্বল। কারও মুখে রাটি পর্যন্ত নেই। আমি বা তারা কেউ কিছু না জানলেও এটা তো সত্য, আমরা যে আগুনে আরাম করে হুঁকো টানছি, সে আগুনেই পুড়ছি পৃথিবীর অন্যকোনো দেশ। জ্বলে ভস্মীভূত ছোট ছোট শিশু আর গর্ভবতী মায়েরা। দৈবাৎ আকাশ চমকানোর মতোই আচমকা আমার মনে এলো। আর আমিআমি যেন উন্মাদ মেছোটির মতো তড়পাতে লাগলাম। সারা গায়ে বুঝি কেউ আগুন ঢেলে দেয় আমার। সে আগুনে ঝলসে দিতে ইচ্ছে করে সবাইকে। তাই তো অন্তরঙ্গ সুপরিচিত বন্ধুদের মুখের ওপর লাথি মেরে নিজের সে কষ্ট লাঘবের চেষ্টা। আমি জানি অপমান তারা সইতে পারবে না, আর কোনোদিন হয়তো ডাকবে না আমায়, অথবা সুযোগ পেলে এর শোধও তারা নেবে, কিন্তু আমি কি এর পরওয়া করি? না, একটুও না। কেউ আমাকে ছোরা দিক, আমার বুকটা ছিড়ে চিবিয়ে খাক আরাধ্য। মানব জাতের কেউ একজন আরামে, নিশ্চিন্তে কোনোরূপ বাধা ছাড়াই আমার মাংস খাক আমার পরম প্রার্থিত। বন্য জন্তুরা তো নিস্ক্রিয়, তাদের ভয় এখন মানুষ। কবে না আবার পৃথিবীর তামাম রক্ত শেষ হয়ে গেলে মানুষখেকো মানুষেরা বনে হামলে পড়ে। আমি সেইসব রক্তখেকো মানুষদের আহ্বান করছি, এসো বন্ধুরা! ধীরে, প্রশান্তচিত্তে আমার উরু, পাঁজর বুকের মাংসগুলো খেয়ে যাও। আমার রক্তে ভেজাও তোমাদের আনন্দিত চোখ।

চরম এক মানসিক বিপর্যস্ততা, প্রিয়দের সঙ্গ ত্যাগ বন্ধুদের অপমান করে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির ভেতরই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। হাঁটা নয়, যেন টলছিলাম। কোনোমতে শরীরটা টেনে এগুচ্ছিলাম গলির ভেতর আমার ঘুপচি ঘরটার দিকে। কিন্তু কী যে হলো! চোখে ভাসতে লাগলো ফিলিস্তিনের ছোট ছোট শিশুদের মুখ। পোড়া। কারও হাত উড়ে গেছে বোমায়। কারো চোখটি নেই। মস্তকটি কেমন মিশে আছে দেয়ালে। অর্ধেক গাল ক্ষয়ে ঝুলে আছে। উফ! কী বিভৎস দৃশ্য সব।

কী অদ্ভুত! রোজই তো এগুলো খবরের পাতায় দেখছি। কিন্তু আজ! আজ যেন এই শিশুমুখগুলো আমার পায়ে বাড়ি খাচ্ছে। আর আর্তনাদরত সন্তানহারা, স্বামীহারা, স্বজনহারা নারীপুরুষের বিশাল বিশাল দল চিৎকার করে আমার পথ আগলে আছে। আমি দেখতে চাই না তাদের। তাদের কান্নার আওয়াজ আমাকে জাহান্নামের ভয় দেখায়। আমাকে নিঃসাড় করে দেয়।

আশ্চর্য! না দেখার ভান করে ঘুরে এগুতে গেলেও তারা আমার সামনে চলে আসছে। উফ! কী এক জঘন্য অবস্থা! এরা কি মরতেও দেবে না আমায়? স্বয়ং এদের জাতগোত্রের প্রধান দেশই যখন এদের রক্ত খায়, তখন আমিই বা কে? দিনহীন কপর্দকশূন্য উদভ্রান্ত যুবকের সামনে এরা চিৎকার করছে কেন? এমনিতেই তাদের মৃত্যুর মিছিল দেখে দেখে আমি উন্মাদ প্রায়

দুই.

আসলে কি জানো মিস্টার হ্যারি! ওহ! তুমি আর কী জানবে? তোমরা তো সভ্যভব্য আধুনিক এক জাতি। তোমরা ইউরোপীয়। তোমরা আমেরিকান। তোমাদের দেশে সবাই নিরাপদ। কেউ না খেয়ে মরে না। কেউ পিতৃহারা নয়। কেউ ভিটেহারা নয়। কোনো নবজাত শিশুফুলটি পুড়ে কালো বেগুনের মতো হয়ে যায়নি। তোমাদের দেশে অট্টালিকার ভেতর কৃত্রিম পাখি ডাকে, ফুল হাসে। আর এই যে সিরিয়া, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন; সেখানে সবুজ স্নিগ্ধ মায়াঘেরা ছায়াবীথি, উদ্যান হ্রদগুলোর উপর প্রকৃতি তার আঁচল বিছিয়ে দিয়েছিল। ফলফুল পাখি জলপ্রপাতের সমীর সৌন্দর্যঘেরা এক অপার্থিবতার শ্যামসুন্দর জয়গান ছিল সেসব জনপদের মাটিবাতাসে। তাই পুড়ে ছারখার এখন।

পাখি ডাকে না সেসব দেশের বনে। ফুল ফোটে না আর। ভয়ে কোনো কলি পাতারেখা ভেদ করে মুখটি তুলে চায় না সেসব জনপদের আবহে। সমস্ত প্রজাপতি মরে গেছে। ফুল নেই তো ওরা আসবে কোত্থেকে। আর সেসব দেশের শিশুরা! তারা তো পৃথিবীকে নৃশংস এক নরক মনে করে বেড়ে উঠছে। না না, ভুল বললাম। তারা বেড়ে উঠছে বিকলাঙ্গ হয়ে। অন্ধ, খোড়া, বোবা হয়ে। প্রেম পবিত্র সুন্দরের যে আবিলতা পদক্ষেপ তা তারা বুঝতে শেখেনি। তাদের যারা তোমাদের চাল দেয়া বৈশ্বিক যুদ্ধের আঘাতে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে মারা গেল তারা তো বেঁচে গেল। আর যারা অতটুকুন বয়সেই তাদের সুন্দর কোমল সুশ্রী অঙ্গটি হারিয়ে বেঁচে থাকে, অথবা পরিবারের কোনোরকম বেঁচেবর্তেথাকা কারও সঙ্গে পাড়ি দেয় অন্যশহরে, অভিবাসী হয়ে বা পালিয়ে সীমানা ডিঙিয়ে, তারা যে কী মানবেতর, দুর্বিষহ জীবন পার করছে, তা কোনোদিনই অনুভব করতে পারবে না তোমাদের ইউরোপআমেরিকার কোনো শিশু। তোমরা বয়স্ক পরিণতরাও বুঝবে না। এমনকি তুমিও না।

(তার একনাগাড়ে কথা বলার ভেতর হঠাৎইহ্যারিনামে কাউকে সম্বোধন! আমরা কিছুটা বিভ্রমে পড়ে যাই। নাদিমকে দেখে মনে হলো অজ্ঞাত এই ব্যক্তি সম্পর্কে সে জিজ্ঞেস করতে আগ্রহী। কিন্তু আমিই ওর হাত চেপে বারণ করি; ওকে বলতে দাও। কথার শেষেই জানা যাবে কে এই হ্যারি। কারণ আমি কোনোভাবেই চাচ্ছিলাম না, তার বক্তব্যে কোনো ছেদ পড়ুক। বরং তার বলতে পারার ক্ষোভটা কেটে যাক।)

না.. না, উত্তেজিত হবো কেন হ্যারি? প্রিয় বন্ধু আমার। আমি তো কেবল আকাঙ্ক্ষা করছি একটি মৃত্যুর। অথবা সেই প্রলয়ের ধর্মগ্রন্থে যা বিবৃত। ব্যাস তবেই ল্যাঠা চুকে গেল। এই নারী শিশুদের উত্তপ্ত চিৎকার আমি শুনতে পারছি না আর। তুমিই বলো, বর্তমান পৃথিবী কি আস্ত একটা জতুগৃহ নয়? এই যে মানবিক বিপর্যয়, কোটি কোটি লাখে লাখে মানুষকে শুধু কেবল অর্থ বাণিজ্যের লালসায় কটি দেশ মিলে এভাবে মেরে ফেলছে, পৃথিবী কি বসবাসের উপযুক্ত? তুমি তো নাস্তিক নও। ঈশ্বরকে হৃদয়ে ধারণ করো এবং বিশ্বাস করো আমি জানি। তাহলে তুমিই বলো হ্যারি! তোমাদের অস্ত্রবাণিজ্যের জন্য পৃথিবীর দেশে দেশে তোমরা কি গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দাওনি? অথবা ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নানাবিধ কূটচালে তোমরা কি ধ্বংস করে দিচ্ছ না পৃথিবীর প্রাচীনতম স্থাপত্য সংস্কৃতিকে? এই কি তবে সভ্যতার বিকাশ? যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে নকশা করা হয় একেকটি দেশকে সমূলে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে উপড়ে দেবার। জনপদ, অধিবাসী, বৃক্ষবাগান, উপাসনালয় এমনকি আদিগন্ত ফসলের মাঠগুলোও মুছে দিতে ক্লান্তি নেই। মায়া নেই। অনুরাগ নেই। সে পৃথিবীতে আমার দমটা গলার খাঁজে আটকে আছে, হ্যারি। আমি মরতে চাই

উফ! কী উৎকট বিশ্রী হয়ে চোখে ভাসছে শিশুগুলোর তোবড়ানো মুখ। মেরুদণ্ড পুড়ে পিঠে কেমন গিরিখাদ হয়ে গেছে। সেখান থেকে ভেসে যাচ্ছে রক্তের স্রোতধারা। আর সেই স্রোতধারায় প্রমোদতরী ভাসছে তোমাদের। আধুনিক সভ্য পৃথিবীর নটকীদের।

হ্যারি, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ সে রক্ত? না পাবে না। তুমি বরং আমার মৃত্যুর সময় পাশে থেকো। দ্যাখো, কি অসহ্য অশান্তি নিয়ে আমি আত্মহত্যার পথ পরিস্কার করছি।

না, না আগুনে আমার বড্ড ভয়। তুমিই বরং চুরুটটি ধরাও। কী অদ্ভুত! জিজ্ঞেস করছো আজ এমন উত্তেজিত কেন? আমি তো তোমাকে বলেছিই আমি উত্তেজিত না। বোধহয় উন্মাদ হয়ে গেছি। ধিকিধিকি জ্বলে থাকা বাতিটা নিভে যাবার আগে একবার যেমন চমকে ওঠে। অত্যাচার, হত্যা, লুণ্ঠন, অবিচার সমস্ত রকমের নৃশংসতা দেখতে দেখতে আমি একদমই নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিলাম। তাই এখন থেকে মুক্তি পেতে মৃত্যুকে কামনা করছি। তাই বুঝি প্রদীপের সে অন্তিম মুহূর্তটির মতো নিভে যাবার আগে একবার চমকে উঠলাম। তবে এরও তো একটা কারণ আছে, সে তুমি জানো হ্যারি।

হ্যারি, তোমার কি তালাতের কথা মনে আছে? ওই যে ছোট্ট কালো করে বাচ্চাটা। মাথাভরা কোঁকড়ানো চুল। মোটা পুরু ঠোঁট আর টানা টানা দীঘল চোখ; সে চোখের ভেতর খেলা করে সমুদ্র। সমুদ্রটি গম্ভীর হয়ে যেন ফেটে পড়তে চাইছিল বাইরে, আর তার জল গড়িয়ে যাবে সমস্ত মানুষের পায়ে। কী যে অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিল ! মনে হলো এই জগত সুস্থসবল মানুষের দৃঢ়পদহাঁটা,  হৈহুল্লোড়সব যেন একটা ফ্যান্টাসি তার চোখে। জন্মের পর এসব তেমন ভালো করে দেখতে পায়নি ও। সুন্দর বাচ্চাদের দেখলে ভয়ে কুঁকড়ে যেত। সামনে থাকা শিশুটি চলে গেলে অনেকক্ষণ পর সে তার পঙ্গু পাটা দেখত। খোড়া পায়ের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থেকে কী ভাবত কে জানে! তুমি অনুভব করতে পারো, কী ভাবত ?

 

ওই আমার মাথাটা বিগড়ে দিয়েছে। ওর সঙ্গে একটিবার সাক্ষাতের পরই আমি উন্মাদ হয়ে গেছি। আর তোমাদের পৃথিবীর এই লোকসাজ ভণিতা আমার কাছে একটি আচ্ছাদনে পরিণত হয়েছে। আমি জানি তোমরা মনুষ্য মুখোশ পড়ে আছ, আদপে তোমার একেকটা মানুষখেকো জন্তু। তোমরাই তালাতদের অভিবাসী, শরণার্থী করে পাঠিয়েছ দেশেদেশে। আর তাদের ভিক্ষার হাতটি কার্টুন বানিয়ে তোমাদের গণমাধ্যমগুলো সাজিয়ে তোলো। হাহ.. এও তোমাদের আরেকরকম বাণিজ্য। কাটতি বাড়ে। সে অন্য কথা। নিয়ে বলে কী লাভ আর! আমার বুকের পাথরটা একটু ধরবে হ্যারি। আমি আর পারছি না।

তিন.

আহ তালাত! ছোট্ট খোকার নিস্প্রভ মুখটি মনে করতেই আমার পাজরগুলো ভেঙে আসছে। যখন দেখতাম তার মা সেই আগুনঝরা রৌদ্রের ভেতর এসে কোলে তুলে নিত তাকে। এবং দুপুর গড়াতেই পাহাড়ের দিকে চলে যেত। তখন ভাবতাম মহর্ষীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রাচীন পাহাড়গুলোর ভেতর কোন গুহাটি এত ভাগ্যবান, যেখানে তালাত তার মা ঘুমোতে যায়। তুমি কি একদিনও দেখোনি পৃথিবীর সবথেকে করুণ সে দৃশ্যটি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলছি। অত অস্থির হয়ো না। আজ যেহেতু বলতে বসেছি, বলবই। তবে একটু ধীরে। এই দেখো আমার শ্বাস আটকে গেছে। একটু টেনে নিই।

না জল ছোঁবো না, হ্যারি। তুমিই পান করো। আর শোনো সেই করুণ বিভৎস বিপ্রতীপ শোকগাথা, যা আমাকে নির্বাপিত করে দিয়েছে চিরদিনের মতো। সেদিন খুব ভোর করে ঘুম থেকে উঠি। এবং রোজকার মতোই প্রাতঃকৃত্য সেরে কাজে বেরোই৷ আমার কাজ বলতে বুঝোই তো! ওই দুটো ছেলেপড়ানো আর ঘন্টা চারের একটি বেসরকারি  অফিসের দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর যে কাজ, তাই। তা সেরে দুপুর নাগাদ ঘরে ফিরছি। তপ্ত রোদ। খাঁখাঁ করছে চারদিক। একটু দূরেই রোদের তাপে চোখ ঝলকে যাচ্ছে। দৃষ্টি ধরে রাখা যায় না। মনে হয় আগুনের ছায়ার মতোই কাঁপছে সেই জ্বলন্ত রোদের আবর্ত শরীর। অসহ্য গরমে গা ভিজে একাকার। সে এক নির্মম অবস্থা বলা চলে। তাছাড়া এই মরুর দেশে চারপাশে পাথুরে ভূমি। তা থেকে ছলকে ছলকে তাপ এসে পুড়িয়ে দিচ্ছিল পথচারীদের। আরবদেশ। এককালে যে উট ছিল এখানে সবার বাহন। সময় কাল পাল্টে তাই এখন বাহন হিসেবে গাড়ি। এমন কোনো আরবীয় নেই, যার গাড়ি নেই। ছাড়া উপায়ই বা কী? কত দূরদূর তাদের বসতি। শহরাঞ্চল ছাড়া এই উপশহর গ্রামএলাকাগুলো এমনিতেই জনশূন্য। বিশাল বিশাল পথগুলো মানুষের পদচ্ছাপের অপেক্ষায় যেন হাহাকার করতে থাকে। দিনে রোদের প্রকোপে ওই হয়ে ওঠে একেকটা নরকের রাস্তা। যেন আগুনবিছানো পথ। তারই মাঝে আনমনে হেঁটে চলেছি আমি। এমনিতেই বেশ মাস ধরে সিরিয়া, ইয়ামেন, ফিলিস্তিনের সংবাদ পড়ে পড়ে কেমন নির্লিপ্ত হয়ে গেছি। বুঝতে পারছিলাম ক্রমশ আমি আমার স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে ফেলছি। যেকোনো সময় বড় কোনো মানসিক আঘাতে সমস্ত তছনছ হয়ে যেতে পারে আমার৷ বোধ গুড়ো হয়ে যেতে পারে। তাই রুমমেট প্রতিবেশীদের সঙ্গেও মেপে মেপে কথা বলি। একলা, নিঃসঙ্গতায় ডুবে থাকতেই ভালো লাগছিল বেশ।

কিন্তু সেদিন। সেদিন আমার পূর্বাপর সমস্ত বোধ স্থিতিতা নিমিষেই মিলিয়ে গেল যেন। জড়পদার্থের মতো শুধু কেবল একটা মানুষের আদলে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম সেই কাফেটির সামনে। যেখানে একটু আগেই রোদের তীব্র দাবদাহে অতিষ্ঠ হয়ে একটা কোল্ডকফি নিতে গিয়েছিলাম। একটু দূরেই ছিল তালাত৷ দাঁড়িয়ে ভিক্ষা মাঙছিল। এমন তপ্ত রোদের ভেতরও শিশুটি নিঃসাড়। ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে একটি পয়সার। কারও দয়া হলে গাড়ির গ্লাসটি ফাঁক করে হয়তো দিয়ে যায় দুচার টাকা। নয়তো না।

এভাবেই কয়েক ঘন্টা রোদে দাঁড়িয়ে ভাগ্যে যা জোটে, ওই দিয়ে চলে খানাপিনা। ঘর তো নেই। এদেশে কোথায় কোন খুপরিতে থাকে কে জানে! অথচ ইয়েমেনে তাদের মস্ত উঠোনওয়ালা বাড়ি ছিল। পেছনে বোনের লাগানো ফুল গাছে ভরা বাগ। মা আর দাদুর যত্নআত্তিতে তা নাকি অপরূপ এক বাগানে পরিণত হয়েছিল। গ্রামের অনেকেই বিকেলে দেখতে আসত সে বাগান। ছোট্ট ছেলে বা পাড়ার বড় মেয়েরা এসে কখনো কখনো তাদের থেকে নিয়ে যেত ফুলের চারা। এভাবেই তাদের বাগানের গাছগুলি ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রামের ঘরে ঘরে। আর ধীরে ধীরে পুরো গ্রামটিই যেন মস্ত এক ফুলবাগানে পরিণত হচ্ছিল। এসব আমি কথায় কথায় অন্য একদিন তালাতের মুখ থেকে শুনেছিলাম। তারপর কোনোদিন আমি আর তার কাছে যেতে পারিনি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি ভুলিনি, বলছি হ্যারি, বলছি সেদিন, মানে প্রথম দিনের ঘটনাই বলব তোমাকে। ওইদিন কি আমি ভুুলতে পারবো? তোমাদের সমস্ত সম্পর্ক আমার যাপিত জীবনকে ভুলে যেতে পারি, কিন্ত সেদিনটি ভুলবার ক্ষমতা আমার নেই। তা সে তীব্র রোদে, রাস্তার পাশে কাফেটি দেখে একপ্রকার ছুটেই গেলাম সেখানে। এবং একটি কোল্ডকফি চাইলাম। খুবই সস্তা ধরনের এক টাকার কফি। হালকা বরফকুচি নামমাত্র মিক্সিং কফি পাউডার দিয়ে তৈরি। গরমে আমার চোখ লাল। গায়ের জামাটি ভিজে পিঠে লেগে আছে। যাচ্ছেতাই অবস্থা। তবে আমি যে নিদারুণ ক্লান্ত এবং হাঁপাচ্ছিলাম তা বোঝা যাচ্ছিল। তালাত আমাকে দেখছিল বোধহয়৷ অথবা আমার বিপর্যস্ত অবস্থাটি লক্ষ করছিল। এবং একটুপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে আমার দিকে এগিয়ে আসলো। প্রথমটায় আমি তেমন মনোযোগ না দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কাছে এসে আমাকে অতিক্রম করে যায় ও। তবুও আনমনাই ছিলাম। হঠাৎই চোখ ফেরাতে দেখি, তালাত কফিশপে গিয়ে পাঁচটাকা দামের সবচেয়ে ভালো কোল্ডকফিটি অর্ডার করে। জোব্বার দুপকেট হাতিয়ে এক টাকার তিনটে নোট দুটো সিকি বের করে দোকানীকে দেয়৷ ইচ্ছে হলো ওর টাকাটা আমি দিই, কিন্তু পকেট হাতড়ে সাকুল্যে আড়াই রিয়াল মেলে। তাই আর প্রবৃত্তি হলো না।

কিন্তু হ্যারি, জানো! খানিকবাদেই আমি বিস্ময়ে বিমূঢ়। আমার পাগুলো ওখানেই গেঁথে গিয়েছিল, আর আমি তাকিয়েছিলাম নিজ দেশহারা ছোট্ট খোঁড়া তালাতের দিকে। সেইসাথে নিজেকে মনে হচ্ছিল একটি কীট নিতান্তই হীন কোনো প্রাণী। মনে হচ্ছিল আমার আস্ত মাথাটা গরম কোন চুল্লীর ভেতর ঢুকিয়ে দিলেই বাঁচি। আমরা যে বোধবিশ্বাস সহমর্মিতা নিয়ে বেঁচে আছি, তালাত তা যেন তুড়ি মেরেই উড়িয়ে দিল। ওহ হ্যারি, কী বলব আর সে কথা।

কফিটি হয়ে গেলে তালাত তা নিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে। আর নিস্তেজ ক্লান্ত কণ্ঠে বলে, “তোমায় অনেক ক্লান্ত লাগছে। খুব ঘেমে গেছ। নাও, এটি পান করো।আমি কী বলবো তখন অথবা কী করতে পারতাম, বলতে পারো হ্যারি? তুমিইবা কী করতে? তা এখনইবা কেমন বোধ করছ এই শুনে? খুব সামান্য তুচ্ছ মনে হচ্ছে বুঝি!  তা হতেই পারে। আমাদের যে জীবনাচার, যে প্রক্রিয়ার ভেতর আমরা বেড়ে চলছি, আমাদের কাছে তুচ্ছই। কিন্তু তালাতের কাছে তা নয়। সে জানে তার ঘরে খাবার নেই। একটুপর তার মা এসে তাকে নিয়ে যাবে এবং তার ভিক্ষার টাকায় জুটবে রাতের আহার। অথচ সে তার সর্বস্ব উজাড় করে এক অপরিচিত ক্লান্ত পথিকের গলা ভেজানোর আনন্দ লাভ করছে।

হ্যারি, তুমি কি শুনছ আমার কথা? বুঝতে পারছো আমার অন্তর্দহনের সামান্য কোন তাপ। তুমি চাইলে তালাতকে এখনও হয়তো দেখতে পাবে রেজমা শহরের সেই মোড়টিতে। কফি শপের পাশঘেঁষা ওই খালি জায়গায়। কিন্তু আমিআমি আর ওদিকে যেতে পারিনি। তাকাতে পারিনি ওর মুখের দিকে। তবে শেষ একবার তালাতের কাছে গিয়ে ওর বাবা বোনের মৃত্যুর গল্প শুনেছিলাম। শুনেছিলাম তাদের শান্ত সুনিবিড় গ্রামের কথা। তার পড়ার ঘর মাঠভর্তি ফসলের কথা। ছবির মতো সেগ্রাম জীবনের কথা বলতে বলতে তালাত কেঁপে কেঁপে উঠছিল। আর কেঁদে কঁদে বলছিল তার মায়ের পেটে ক্রমশ বেড়ে ওঠা একটি প্রাণের কথা। যে আসছে, তার ভাই অথবা বোন হয়ে। অথচ তালাত  চিন্তায় বিভোর আসলে খাবে কী! তাদের ঘরে তো বাড়তি কোনো জামা নেই, ছোট্ট প্রাণটিকে আম্মা কী পরতে দেবে!

হ্যারি, কী ভাবছ? কী মনে হচ্ছে তোমার? পাঁচ বছরের ছোট্ট একটি শিশু অনাগত আরেকটি জীবনের খাওয়াপরার হিসেব কষছে! কষতে হচ্ছে। সেইভাবেই দাবার দান দিয়ে রেখেছ তোমরা। তোমাদের মানবসভ্যতায় উত্তরোত্তর বিকশিত জনমানসের বাণিজ্যিক লোভাতুর বোধপরিক্রমা।

তবে কি জানো, আমার উন্মাদনা, পাগলামো নিজের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে আবদ্ধ করে ফেলা যে এর কোনো বিহিত নয় তা আমি জানি। কিন্তু কী করব বলো, সেদিনের পর থেকে আমি যে কিছু খেতে পারি না। কিছু খেতে গেলেই মনে হয় রক্ত খাচ্ছি। আর সে রক্ত দেখতে কফির মতো। কারও সঙ্গে কথা বলতে পারি না। ছোট্ট সুন্দর কোমল কোনো বাচ্চা দেখলেই মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে শিশুদের জন্মের সাথে সাথেই মেরে ফেলা উচিত। তাহলে পরবর্তীজীবনে আর ওদের কোনো ভাবনা নেই। ধীরে ধীরে এই পৃথিবীর সমস্ত শিশু মারা গেলেই থামবে রক্তের খেলা। কারণ, প্রাণের জন্ম না হলেই তো কোনো না কোনোসময় জীবিত প্রাণগুলোর ক্ষয় হবে। তারা নিঃশেষ হবে। যখন আর মরার মতো কেউ থাকবে না, তখনই হয়তো থামবে এই দাবার দান। যেখানে মানুষ হত্যাই কিস্তিমাত।

এই ছিল উমরের গল্প, আমরা যা ঘোরগ্রস্ত হয়ে  শুনছিলাম, আর আমাদের হৃদকম্পন কখনো থেমে থেমে যাচ্ছিল৷ কিন্তু উমর! সে এখনও আমাদের কাছে দুর্বোধ্যই রয়ে গেছে। (আর হ্যারিইবা কে? তাও জানি না৷ তবে আমার মনে হয় তার কোনো পশ্চিমা বন্ধুকে উদ্দেশ্য করেই এসব খেদগুলো উগড়ে দিচ্ছিল সে।) কারণ শেষ বাক্যটি বলার পর সে যেন চমকে ওঠে। যেন সম্বিত ফিরে পায়। চিৎকার করে বলে, ‘আমি এখানে কেন?’ মৃত্যু মৃত্যু বলে সে চোখের পলকে ছুটে বেরিয়ে যায়। আমরা তখনও বজ্রাঘাতের মতো স্থির হয়ে আছি। মনে হলো একটি মৃত্যুকে এসে বেরিয়ে যেতে দেখলাম যেন।

তারপর আজও আমরা উমরকে রেজমা শহরের গলিতে গলিতে খোঁজি। সে যে তালাতের কথা বলেছিল, সেই কাফের সামনে যাই। কিন্তু কোথাও তালাত উমরকে খুঁজে পাই না। কথায় কথায় নামটা বলেছিল শুধু; ওটুকুই ওর যা স্মৃতিচিহ্ন। ফারেস এখনও রাত হলে সেই নাম ধরে ডাকে।

লেখক : তরুণ গল্পকার

আগের সংবাদলাওয়ারিশ
পরবর্তি সংবাদসন্ধ্যা এবং আমরা