হাজী আবেদ হুসাইন : দেওবন্দের বিস্মৃত প্রতিষ্ঠাতা

হাসান ফরাজী:

সাত্তা মসজিদের সামনে একটি ছোট্ট দাওয়াখানা। এর ভেতরে বসে একজন সারাদিন কুরআন তেলাওয়াতে মগ্ন থাকেন। ব্যবসার সাথে তার খুব বেশি সম্পর্ক নেই। রুটি-রুজি নিয়েও বিশেষ কোনো ফিকির নেই। তার যাবতীয় চিন্তা রুটি-রুজির স্রষ্টাকে নিয়ে। কিভাবে সেই স্রষ্টার কাছাকাছি যাওয়া যায় এটিই তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। দাওয়াখানাটিও এই উদ্দেশ্যেই খুলেছেন। এর মাধ্যমে যদি আল্লাহর বান্দাদের কিছু উপকার হয় তাহলে হয়ত তিনি খুশি হয়ে তাকে কাছে টেনে নিবেন।
দাওয়াখানাটি খুব বেশিদিন টেকেনি। তিনি স্রষ্টার আরও কাছাকাছি যেতে চান। তাই একদিন দাওয়াখানা বন্ধ করে রাস্তায় নেমে পড়েন। গলিতে গলিতে ঘুরে তৃষ্ণার্ত মানুষদের পানি পান করান। দেওবন্দে শীতকালে যেমন প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ে তেমনি গ্রীষ্মকালে পড়ে তীব্র গরম। দুপুরে রাস্তাঘাট সব শূন্য হয়ে যায়। মানুষ দোকানপাট বন্ধ করে ঘরে বসে থাকে। একান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ বাইরে বের হতে চায় না। এ সময় আল্লাহপাগল এই মানুষটি গলিতে গলিতে ঘুরে মানুষকে ঠান্ডা পানি পান করান। সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে খুঁজে ফিরেন স্রষ্টার সন্তুষ্টি।

আল্লাহ তার এই পাগলটিকে কবুল করেছেন। তার মাধ্যমে নিয়েছেন জাতির এক মহান খেদমত। বৃটিশ-বেনিয়ার নির্মম নির্যাতনে ভারতবর্ষে যখন ইসলাম-রবি নিভু নিভু করছে, তখন তিনি নতুন করে জ্বেলেছেন ইসলামী শিক্ষার আলো। দেওবন্দের ঘরে ঘরে গিয়ে চান্দা কালেকশন করে ছাত্তা মসজিদের পাশে একটি ডালিম গাছের নিচে সূচনা করেছেন ভারত উপমহাদেশের ইসলামী শিক্ষার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দের। যা আজ ডালপালা মেলে বিশাল মহিরুহে পরিণত হয়েছে। মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনায় অনেকেই অংশিদার ছিলেন। কিন্তু তা কার্যে বাস্তবায়ন করার সৌভাগ্য আল্লাহ তার ভাগ্যেই রেখেছিলেন। যার কারণে ইতিহাস তাকে অবহেলা করলেও পুরোপুরি ভুলে থাকতে পারেনি। আজ আমরা তারই সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু জানার চেষ্টা করবো।

জন্ম এবং বংশ পরিচয়

জীবনী সাহিত্যে অবহেলিত এই বুযুর্গের নাম হাজী আবেদ হুসাইন। ১২৫০হি./১৮৩৪ ইং সনে দেওবন্দের মহল্লা পীরযাদেগাঁ এর বিখ্যাত সাইয়্যেদ বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম আশেক আলি। দাদা কলন্দর বখশ। তার পূর্বপুরুষ ছিলেন শাহ বন্দেগী মুহাম্মদ ইবরাহীম। তিনি সাইয়্যিদুনা হযরত হুসাইন রা. বংশধর। বংশীয় উত্তরাধিকার হিসেবে যেমন পেয়েছেন সামাজিক মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান, তেমনি পেয়েছেন ইবাদাতের প্রতি একান্ত নিমগ্নতা। মহল্লা পীরযাদেগাঁ এর অতীত বুযুর্গদের কারামত আর ইবাদত-মুজাহাদার গল্প এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তাইতো সাত্তার পাশে দাওয়াখানায় বসে যখন তিনি কুরআন তেলাওয়াতে মগ্ন থাকতেন পাশ দিয়ে যেতে তখন অনেকেই মন্তব্য করতেন- ‘তুই ঠিক তোর দাদার মতো হবি!’

শিক্ষা

সাত বছর বয়সে তিনি কোরআন শিক্ষা সমাপ্ত করে পারিবারিক রীতি অনুযায়ী ফার্সি শিক্ষা আরম্ভ করেন। বয়স যখন মাত্র বারো বছর সে সময় সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. এর খলিফা মাওলানা বেলায়েত আলি দেওবন্দে আসেন। হাজী সাহেব তাঁর হাতে বাইয়াত হয়ে পুরোপুরি তার সাথে জুড়ে যান। বেলায়েত আলি দেওবন্দ ছেড়ে সাহারানপুর চলে গেলে তিনিও তার সাথে সাহারানপুর চলে যান। কিন্তু এই বয়সে এভাবে ফকির-দরবেশের জীবন যাপন করা বড় ভাইয়ের পছন্দ ছিলো না। তাই তিনি মাওলানা বেলায়েত আলির কাছে বলে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। শায়েখের বিচ্ছেদে তিনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। কিন্তু মাওলানা বেলায়েত আলির সংস্পর্শ তার ভেতরে যে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে তা তো আর নিভে যায়নি। সেই বয়স থেকে আর কখনও তার তাহাজ্জুদ কাজা হয়নি।

বড় ভাই তো ফেরত নিয়ে এলেন। কিন্তু অস্থির মনে শান্তি ছিলো না। কিছুদিন পর জ্ঞানার্জনের জন্য দিল্লি চলে গেলে সেখানে থাকার জন্য বাছাই করলেন এমন এক মসজিদ, যার পাশে এক বুযুর্গের মাজার। কিন্তু পড়াশোনা খুব বেশিদূর এগুতে পারেনি। আব্বার অসুস্থতার সংবাদ শুনে দেওবন্দে ফিরে আসেন। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। আব্বার ইন্তেকালের পর পড়াশোনা চালু রাখার আর কোনো সুযোগ ছিলো না। ফলে খেদমতে খলকের তাড়না থেকে একটি দাওয়াখানা খুলে বসেন। যার কথা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। বাইরে থেকে এটি নিরেট একটি দাওয়াখানা হলেও ভেতর থেকে ছিলো সম্পূর্ণ কোরআনি খানকা। সারাদিন ভেতরে বসে তিনি কোরআন তেলাওয়াত করতেন।

মিয়াজি করিম বখশের হাতে বায়াত

অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াতের কারণে কলব স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো ঝকঝকে হয়ে উঠলো এবং আবারও বাইয়াত হওয়ার জন্য হৃদয় উতলা হয়ে উঠলো। এই সময় রামপুরের প্রসিদ্ধ বুযুর্গ এবং মুরশিদ হযরত মিয়াজি করিম বখশ দেওবন্দে আগমণ করেন। হাজী সাহেব তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এর মাঝে একদিন মিয়াজি সাহেব স্বপ্নে দেখেন, আকাশে অনেক বড় একটি তারা উঠেছে। সেই তারার আশেপাশে আরও অনেকগুলি তারা। হঠাৎ বড় তারাটি মিয়াজি সাহেবের কোলে এসে পড়লো। সকাল হওয়ার পর মিয়াজি সাহেব ভক্তদের বললেন, একজন সাইয়্যেদ সাহেব আমার হাতে বায়াত গ্রহণ করবে। তার মাধ্যমে লোকজন অনেক উপকৃত হবে। সে সুন্নতের অনুসারী হবে। তার মাধ্যমে দ্বীনের অনেক কাজ হবে। সে দুনিয়াবি ঝগড়াঝাটি থেকে দূরে থাকবে এবং বংশের নাম রওশন করবে।

অপরদিকে সাক্ষাত করে আসার পর হাজী সাহেবও মিয়াজি সাহেবের হাতে বাইয়াত হওয়ার ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা করছিলেন। যখন তাঁর ব্যাপারে মন ছাফ হয়ে গেলো, তখন তিনি বাইয়াত হওয়ার জন্য উপস্থিত হলেন। কিন্তু মিয়াজি সাহেব প্রথমেই বাইয়াত না করে বললেন, তুমি ইস্তেখারা করো। ফলাফল কি হয় আমাকে জানাবে। হাজী সাহেব ইস্তেখারা করে স্বপ্নে দেখেন, মিয়াজি সাহেবের অন্যান্য মুরিদরা হাতে রুটি নিয়ে চড়ুই পাখির মত ঠুকর দিয়ে দিয়ে খাচ্ছে। হাজি সাহেব দেখে বললেন, এটা কোনো খাওয়ার তরিকা হলো? আমাকে দাও আমি শিখিয়ে দিচ্ছি। এরপর তিনি রুটি নিয়ে দুই লুকমা বানিয়ে খেয়ে ফেললেন।

সকালে মিয়াজি সাহেবের কাছে উপস্থিত হয়ে স্বপ্নের কথা বললে মিয়াজি সাহেব তাকে বাইয়াত করে নেন এবং বলেন, ‘আমার কাছে যা আছে সবকিছুর ভাগিদার তুমি।’ মিয়াজি সাহেবের সংস্পর্শে তিনি সুলুকের স্তরগুলো দ্রুত পার হতে লাগলেন। তার যিকির-আযকারের পরিমাণ দেখে মিয়াজি সাহেবও তার প্রতি বিশেষ মনযোগ দিলেন এবং অল্প সময়ে তিনি তাসাউফের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নিত হলেন। কিন্তু এতে তার যিকির এবং রিয়াযত-মুজাহাদায় কোনো কমতি আসেনি।

নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার এক বিরল দৃষ্টান্ত

মিয়াজি সাহেবের হাতে বায়াত হওয়ার আগেই তিনি দাওয়াখানার দোকান খুলেছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে দোকানদারি থেকে মন উঠে গেলে তিনি লোকজনকে পানি পান করানোর কাজ শুরু করলেন। কারণ এই কাজে আত্মশুদ্ধির সম্ভাবনা বেশি। নিজেকে ছোট করেই এই কাজ করতে হয়। পাশাপাশি মানুষের দোয়াও পাওয়া যায়। পিপাসার্ত মানুষ যখন ঠান্ডা পানিতে গলা ভিজিয়ে দোয়া দিবে তখন কার দোয়া কখন নাজাতের ওসিলা হয়ে যায় কে জানে? ফলে হাজী সাহেব সারাদিন মহল্লার অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে মানুষকে পানি পান করাতে লাগলেন। আর রাত হলে আল্লাহর দরবারে সেজদায় লুটিয়ে পড়তেন।

কিন্তু বাড়ির লোকদের কাছে এই কাজ পছন্দ হলো না। এত বড় বংশের ছেলে হয়ে তিনি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে মানুষকে পানি পানের কাজ করবেন? এতে যে খান্দানের নাক কাটা যায়! একরাতে তাই হাজী সাহেবের খালা-খালু তাকে বুঝাতে আসলেন। খালু অত্যন্ত রেগে ছিলেন। দুজনে মিলে দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত তাকে বুঝালেন। কিন্তু হাজি সাহেব খামুশ! কোনো উত্তর দিলেন না। তারা বুঝিয়ে শুনিয়ে যখন চলে যেতে উদ্যত হলেন তখন হঠাত নিরবতা ভঙ্গ করে বলে উঠলেন, এখন যেতে পারবেন না। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে! তারা তো অবাক! বৃষ্টি আসবে কোত্থেকে? আকাশ তো বিলকুল পরিস্কার দেখে এসেছি। মেঘের ছিটেফোঁটাও ছিলো না সেখানে। কিন্তু বাইরে তাকিয়ে দেখেন সত্যি সত্যি বৃষ্টি হচ্ছে। এবার তারা অস্থির হয়ে উঠলেন। এখন ঘরে ফিরবেন কিভাবে? হাজী সাহেব শান্তস্বরে জবাব দিলেন, ‘চিন্তা করবেন না। বৃষ্টি এখনই থেমে যাবে!’ হাজী সাহেবের মুখ থেকে একথা বের হওয়া মাত্রই বৃষ্টি থেমে গেলো। সেই খালা-খালু আর কখনও হাজী সাহেব সম্পর্কে মুখ খুলেননি।

নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার প্রসঙ্গ যখন এসেছে তখন এই সম্পর্কিত আরও দুটি ঘটনা উল্লেখ করে ফেলা যাক। হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলি থানভী রহ. বলেন, আমাদের উস্তাদ মাওলানা ফাতাহ মুহাম্মদ সাহেব আমাদের কাছে তার নিজের ঘটনা শুনিয়েছেন, আমাদের ছাত্রজীবনে একবার আমি হাজী সাহেবের খেদমতে উপস্থিত হয়েছিলাম। তিনি তখন মাদরাসার মুহতামিম। এই সময় এক ডেপুটি অফিসার তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসলো। হাজী সাহেব নিজ আসন থেকে উঠে পড়েছিলেন। এভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই সেই ডেপুটির সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে তাকে বিদায় করে দিলেন। এরপর আমি গেলাম। হাজী সাহেব সঙ্গে সঙ্গে নিজ জায়গায় গিয়ে বসে আমাকেও বসতে বললেন। আমি বললাম, হযরত! প্রয়োজন নেই। আমি এভাবেই কথা বলি।
তিনি বললেন, তুমি কি নিজেকে সেই ডেপুটির সাথে তুলনা করছো? কোথায় সেই দুনিয়াদার আর কোথায় তোমার মতো নায়েবে রাসুল!

হাজী সাহেব মুহতামিম থাকাকালীনই আরেকটি ঘটনা। এক ছাত্র কোনো কারণে হাজী সাহেবের উপর ক্ষিপ্ত হয় এবং ভালোমন্দ নানান কথা বলে। হাজী সাহেব চুপ করে থাকেন। ছেলেটি থাকত ডুমনিওয়ালি মসজিদে। পরে হাজী সাহেব সেই মসজিদে ছেলেটির কাছে যান এবং হাত জোর করে বসে বলেন, মাওলানা মাফ করে দেন! আপনি নায়েবে রাসুল। আপনাকে অসন্তুষ্ট করা আমার জন্য ভালো হবে না! থানভী রহ. বলেন, দিন দিন হালত যেভাবে খারাপের দিকে যাচ্ছে, এখন তো এ ধরনের ব্যক্তি জন্ম নেয়ার আশাও করতে পারি না।

এই দুটি ঘটনা থেকেই বুঝা যায় আল্লাহ তায়াল তার মাধ্যমেই কেন নববী ইলমের প্রচার-প্রসারের কাজ নিয়েছেন। নায়েবে রাসুলের প্রতি যিনি এতটা শ্রদ্ধা রাখেন, নববী ইলমের প্রসারের কাজ তো তার মাধ্যমেই নিবেন।

খেলাফত লাভ

এদিকে হাজী সাহেবের পানি খাওয়ানোর কাজ আগের মতই চালু রইলো। সেই সাথে তিনি সুলুকের স্তরগুলোও ক্রমাগত পার হতে লাগলেন। ধারণা করা হয়, এই কাজ তার শায়েখের ইশারায়-ই হচ্ছিলো। তাই শায়েখ জানা সত্বেও তাকে বাধা দেননি। বরং নির্দিষ্ট সময় পর যখন সুলুকের স্তরগুলো পার হওয়া শেষ হলো, তখন শায়েখ তাকে এই কাজ থেকে ফিরিয়ে নিলেন এবং ভিন্ন পন্থায় মুজাহাদায় নিযুক্ত করলেন। একটি মুজাহাদা এমন ছিলো যে, প্রতি বৃহস্পতিবার দোয়ায়ে সাইফি এবং দালায়েলুল খায়রাত পড়তে পড়তে পীরানে কালিয়ার চলে যেতেন এবং ইশার নামাজ আবার দেওবন্দে এসে পড়তেন। এই পুরো সফর হত পায়ে হেঁটে। তখন সাওয়ারির এত সরঞ্জাম ছিলো না। এই মুজাহাদাও বেশ কয়েক বছর চালু ছিলো। অবশেষে এই মুজাহাদও চূড়ান্ত স্তরে উন্নিত হলো এবং শায়েখ হাজী সাহেবের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন। তাই তাকে খেলাফত দিয়ে বায়াত করার অনুমতি দিয়ে দিলেন।

বিয়ে

আধ্যাত্মিক পূর্ণতা তো তিনি পেয়ে গেলেন। কিন্তু আরেকটি পূর্ণতা তার তখনও বাকি ছিলো। হাদীসে যাকে নিসফুল ঈমান বা ঈমানের অর্ধেক বলা হয়েছে। হাজী সাহেব সেই সুন্নতও পূর্ণ করে নিলেন। বিয়ে করলেন বন্দেগী ইবরাহিমেরই বংশের এক মেয়েকে।

হাজী সাহেবের স্ত্রীও ছিলেন অত্যন্ত বুযুর্গ মহিলা। বংশ যেমন এক ছিলো, উভয়ের রুচি এবং চিন্তা ভাবনাও ছিলো একই রকম। হাজী সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে মিয়াজী সাহেবের হাতে বাইয়াত করে নেন। তিনি প্রচুর পরিমাণে দুরুদ শরিফ পড়তেন। বলা হয়, দুরুদ পড়তে পড়তে তার অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, এখন দুরুদ শরিফ পড়লেই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যিয়ারত হয়। হাজী সাহেব প্রথম হজ স্ত্রীর সাথেই করেন।

প্রথম বায়াতের ঘটনা

হাজী সাহেব অন্তত বিনয়ী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। নাম খ্যাতি পছন্দ করতেন না। তাই শায়েখ থেকে বায়াতের ইজাজত পেয়েও বাইয়াত করতে অনেক ভয় পেতেন। মিয়াজি এই কথা জানতেন। তাই প্রথম বাইয়াতও নিজের তত্বাবধানেই সম্পাদন করলেন। এক লোক বাইয়াত হতে আসলে মিয়াজি সাহেব হাজী সাহেবের খোঁজে লোক পাঠালেন। কিন্তু হাজী সাহেব লাপাত্তা! খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে তাকে এক মসজিদে পাওয়া গেলো। তিনি কাতারের চাটাই জমা করে তার নিচে লুকিয়ে আছেন। মুরিদরা তার কাছে শায়েখের বার্তা পৌঁছালে তিনি কাঁদতে লাগলেন। বললেন, আমার এই যোগ্যতা নেই। এই বোঝা অনেক ভারি। আমি এটা বহন করতে পারবো না। শায়েখ তাকে বুঝয়ে শুনিয়ে বললেন, তুমি বাইয়াত করে নাও। আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করবেন। তখন তিনি কাঁদতে কাঁদতে বাইয়াত করে নিলেন। এরপর থেকে মিয়াজি সাহেবের কাছে কেউ আসলে তিনি তাকে বাইয়াত হওয়ার জন্য হাজী সাহেবের কাছে পাঠাতেন। তার মাধ্যমে তাবিজও লেখাতেন। হাজী সাহেব যদি কখনও বিনয়ের কারণে বাইয়াত করতে গড়িমসি করতেন তখন শায়েখ বলতেন, ‘এখন তুমি ঘাবড়াচ্ছো? তখন কি করবে যখন মানুষ তোমাকে সারাক্ষণ চারপাশ থেকে ঘিরে রাখবে আর তুমি সামান্য ফুরসতও পাবে না!’

শায়েখের এই কথা পরে অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিলো। আল্লাহ তায়ালা তার তাবিজের মধ্যে এই পরিমাণ প্রভাব দিয়েছিলেন যে, যে যে উদ্দেশ্যে নিতো তাই পুরা হতো। ফলে এলাকাবাসী ছাড়াও দূর দূরান্ত থেকে লোকজন তার থেকে তাবিজ নিতে আসতো। এমনকি অমুসলিমরাও তার তাবিজের ভক্ত ছিলো। অনেকে বিরক্তও করত। কিন্তু তিনি কারও উপর রাগ করতেন না। ধৈর্য সহকারে সব বিরক্তি সহ্য করে যেতেন।

থানভী রহ. তার তাবিজের কিছু বিষ্ময়কর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। মানুষ তার তাবিজের প্রতি এত আস্থাশীল ছিলো যে, মামলা-মুকাদ্দমায় তার থেকে তাবিজ নিয়ে কোর্টে দাঁড়িয়ে বিচারককে চ্যালেঞ্জ করত- ‘আমি হাজী সাহেবের কাছ থেকে তাবিজ নিয়ে এসেছি..!’

এছাড়া মিয়াজি সাহেব তার ভক্তদের হাজী সাহেবের কাছে বায়াত হতে পাঠাতেন। হাজী সাহেবকে নিয়ে নিজ এলাকা রামপুরে গিয়ে সেখানকার লোকদেরও তাঁর হাতে বায়াত করান। নিজের ছেলে মিয়া আলি হাসান এবং নিজের পীরের ছেলে মিয়া মুহাম্মদ সিদ্দিককেও হাজী সাহেবের হাতে বায়াত করান। নিজের মুরিদদের যিকির আযকারও তার থেকে নেয়ার জন্য বলতেন। হাজী সাহেবের প্রতি তাঁর এই পরিমাণ আস্থা ছিলো যে, এক পর্যায়ে নিজের সব কাজ হাজী সাহেবের সোপর্দ করে দেন।

মিয়াজি সাহেব হাজী সাহেবকে সব সময় বলতেন, দরবেশি ভিন্ন জিনিশ আর আমল ভিন্ন জিনিশ। আমলহীন দরবেশ অস্ত্রহীন সৈন্যের মতো। দরবেশের আশ্রয় হলো আমল। সুতরাং দরবেশিকে লুকিয়ে আমলকে প্রকাশ করো।

হাজী সাহেব এই কথার উপর পূর্ণ আমল করেছেন। কখনও দরবেশি লেবাস গ্রহণ করেননি। নিজের মুরিদদেরও সেপথেই হেদায়াত দিয়েছেন। পিরজি মুহাম্মদ আনওয়ার নামে হাজী সাহেবের এক মুরিদ যখন বায়াত হয়ে খেলাফত লাভ করেন তখন সুলুকের স্তর পার হতে হতে এক পর্যায়ে গিয়ে খানাপিনা ছেড়ে দেন। হাজী সাহেব তখন তার কাছে চিঠি লিখে বলেন, ‘মানবীয় গুণাবলী ত্যাগ করবে না। আল্লাহ তায়ালা মানুষের সাথে ততক্ষণই সম্পর্ক রাখেন যতক্ষণ মানুষ মানবীয় গুণাবলীর মধ্যে থাকে। অন্যথায় শুধু ইবাদত করার জন্য তো ফেরেশতা আছেই। সুতরাং অল্প করে হলেও খানাপিনা করো।’

একটি হজের ঘটনা

শাহ মুহাম্মদ ইমাম কাদেরী ছিলেন মাদ্রাজের অধিবাসী এবং সে যুগের একজন বড় অলি। হাজী সাহেব খেলাফত পাওয়ার পর ১২৭৮ হিজরীতে প্রথম উলামায়ে কেরামের সাথে হজের সফরে বের হন। সেই হজের কাফেলায় শরিক ছিলেন ইমাম কাসেম নানতুবি, মাওলানা ইয়াকুব নানুতবি, মাওলানা মুজাফফর হুসাইন কান্ধলবি, মাওলানা নুরুল হাসান কান্ধলবি প্রমূখ। মুম্বাই পৌঁছে কাদরী সাহেবের সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। হাজী সাহেব তার থেকে অনেক উপকৃত হন। তিনি হাজী সাহেবকে খেলাফত প্রদান করেন।

এদিকে পীর ও মুরশিদ মিয়াজী সাহেব তার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বার বার বলতেন, ‘আবেদ হুসাইন কবে আসবে? আবেদ হুসাইন কবে আসবে? তার অপেক্ষা করতে করতে আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে।’ দেওবন্দবাসীও তার ফিরে আসার অপেক্ষায় পথ চেয়ে ছিলো। তিনি আসার পর তার সাথে সাক্ষাতের জন্য পুরো দেওবন্দ ভেঙে পড়ে। সবাই আনন্দ প্রকাশ করছিলো। দেওবন্দে পৌঁছে তিনি শায়েখের কাছে সফরের কারগুজারি শোনালেন। ইমাম কাদেরীর সাথে সাক্ষাত, ইস্তেফাদা এবং খেলাফত লাভের কথাও জানালেন। শায়েখ অত্যন্ত খুশি হলেন। বললেন, আমার মেহনত উসুল হয়ে গেছে। আল্লাহর এই আবদালও খেলাফত দিয়ে সেটাই প্রমাণ করে দিলেন।

সাধারণত এক পীরের মুরিদ অন্য পীরের কাছ থেকে সবক নিলে প্রথম পীর রাগ করেন। এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। কিন্তু এখানে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিত্র দেখতে পেলাম। মিয়াজি সাহেব কাদরি সাহেবের কথা শুনে রাগ করবেন তো দূরের কথা; উল্টো তার খেলাফত প্রদানকে নিজের জন্য সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য করলেন! তিনি তাকে বললেন, ‘কেউ কিছু দিলে সেটা অবশ্যই নিয়ে নিবে এবং নিজের ঘরকে যত খুশি আলোকিত করার চেষ্টা করবে।’ আরও বলেন, ‘মানুষ আমানত তার কাছেই রাখে যাকে যে বিশ্বস্ত মনে করে।’ অর্থাৎ, তুমি বিশ্বস্ত ও আমানতদার এবং খেলাফতের আমানত বহনের যোগ্য।

এভাবেই শায়েখ হাজী সাহেবের মর্যাদার স্বীকৃতি প্রদান করেন। মিয়াজি সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন, হাজী সাহেব এমন সন্তান, যে বাবা থেকে প্রাপ্ত মীরাছ তো হেফাজত করবেই, পাশাপাশি সেটা কিভাবে আরও বৃদ্ধি করা যায় সেই ফিকির করবে। এমন সন্তানের প্রতি তো সব বাবাই খুশি হয়।

হাজী সাহেব আরও কয়েকজন শায়েখের থেকে খেলাফত লাভ করেছেন। তাদের মাঝে হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কি, মাওলানা বেলায়েত আলি, শাহ রাজ খান প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মিয়াজি সাহেবের ইন্তেকাল

হাজী সাহেব হজ থেকে আসার অল্প কিছুদিন পরই মিয়াজি সাহেব ভয়াবহ অসুখে পড়েন। হাজী সাহেব তাকে দেখতে যান। তার উপস্থিতিতেই মিয়াজি সাহেব আল্লাহর কাছে চলে যান। সম্ভবত একারণেই তিনি এত তীব্রভাবে হাজী সাহেবের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আর বলছিলেন, ‘হাজী সাহেবের অপেক্ষা আমার বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে!’

শায়েখের ইন্তেকালে হাজী সাহেবের উপর এত মারাত্মক প্রভাব পড়ে যে, তিনি দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত হয়ে পড়েন। নিজের কাপড়-চোপড় সব গরিব দু:খিকে দান করে শুধু একটি লুঙ্গি এবং কম্বল নিয়ে সাত্তা মসজিদে এসে পড়ে থাকেন।

কিছুদিন পর অস্থির হৃদয় শান্ত করতে তিনি দিল্লি করনাল এবং পানিপথ সফর করেন। সেই সফরে শায়েখ রাজ খান সাহেবের দরবারে উপস্থিত হন এবং তার থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হন। রাজ খান সাহেব কাছে হাজী সাহেবের অভ্যন্তরীন অবস্থা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো। তাই তিনিও তাকে খেলাফত দিয়ে দেন। হাজী সাহেবের বৈশিষ্ট্য ছিলো, তিন যখন যেই শায়েখের দরবারে যেতেন শায়েখ তার প্রতি পূর্ণ রূহানী তাওয়াজ্জুহ দিতেন এবং হাজী সাহেবকে আপন করে নিতেন। হাজী সাহেবও কখনও শায়েখদের মাঝে মর্যাদার ক্ষেত্রে তারতম্য করতেন না। সবাইকে সমান সম্মান করতেন। এজন্য সবার চোখেই হাজী সাহেবের সমান গ্রহণযোগ্যতা ছিলো।

রাজ খান সাহেবের কাছ থেকে ফিরে এলে মহল্লাবাসী সবাই স্বাগাত জানানোর জন্য ছুটে এলো। অল্প কিছুদিনের বিচ্ছেদও তাদের সহ্য হতো না। কিন্তু হাজী সাহেব তখন ভিন্ন জগতের মানুষ। সবার থেকে আলাদা হয়ে তিনি চৌধুরী সাবের বখশ এর মসজিদে চিল্লায় বসে যান। চিল্লা শেষে হাজী সাহেবকে নেয়ার জন্য মহল্লাবাসীর ভিড় জমে যায়। তিনি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাকে দোলনায় করে মসজিদ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। এই চিল্লার পর হাজী সাহেবের রূহানী অবস্থা যা হয়েছিলো সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এরপর থেকে হাজী সাহেব সাত্তা মসজিদে এসে অবস্থান করতে শুরু করেন। মানুষ সেখানে এসে তার থেকে উপকৃত হত। জীবনের শেষ পর্যন্ত এই ধারা চালু ছিলো। আটাশ বছর পর্যন্ত হাজী সাহেবের তাকবীরে উলা ছুটেনি।

হাজী সাহেবের দিনরাত

হাজী সাহেব নিজের মামুলাত এবং সময়ের খুব পাবন্দ ছিলেন। প্রত্যেক কাজ তার নির্ধারিত সময়ে আদায় করতেন। এক্ষেত্রে কখনও ব্যতিক্রম হত না। ইয়াকুব নানুতুবী রহ. বলেন, যারা হযরতের আমলের ব্যাপারে জানে তারা না দেখেই বলে দিতে পারত, হযরত এখন অমুক কাজ করছেন! মাদরাসা-মসজিদের দায়িত্ব থাকাকালীন সেটাও যথা সময়ে পালন করতেন। তবে সে সময়েও তার মামুলাতের মাঝে কোনো কমতি আসেনি।

হাজী সাহেবের মামুল ছিলো, শেষরাতে আগেভাগে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ে ফজর পর্যন্ত যিকির-আযকারে মগ্ন থাকতেন। ফজরের নামাজ জামাতের সাথে পড়ে হুজরায় চলে যেতেন। আটটা/দশটা পর্যন্ত সেখানে যিকির-আযকার ও তেলাওয়াতে কাটাতেন। এরপর বাইরে এসে মানুষকে সময় দিতেন। মানুষের ভীড় লেগে যেত। কেউ আসত বায়াত হতে, কেউ তাবিজ নিতে, কেউ যিকির-আযকার জিজ্ঞেস করতে। হাজী সাহেব সবার কথা মনযোগ দিয়ে শুনতেন এবং সাধ্যমত সবার প্রয়োজন পুরা করতেন।

জোহরের পর মুরিদরা আসত। আসর তাদের নিয়ে কাটাতেন। মাগরিবের পর নফল এবং খতমে খাজেগানের পর মেহমান এবং মুরিদদের সাথে কথাবর্তা বলতেন। ইশার আগেই রাতের খাবার খেয়ে ফেলতেন। ইশার পর ঘরে চলে যেতেন। সেখানে মহিলারা অপেক্ষা করত। তিনি তাদের কথাও মনযোগ দিয়ে শুনতেন এবং সাধ্যানুযায়ী তাদের প্রয়োজন পুরা করতেন। এরপর ঘুমুতে যেতেন।

যে সকল সালেকীনের কাজ এখনও শেষ হয়নি তাদের হাজী সাহেব নিজের কাছে রেখে দিতেন। তাদের জন্য উপযুক্ত খাবার এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করতেন। মেহমানের ভীড় সব সময় লেগেই থাকত। সেই অনুপাতে হাজী সাহেবের দস্তরখানও প্রশস্ত হতো। সুস্থতার সময়গুলোতে প্রতি বুধবার এবং বৃহস্পতিবার মজলিস হত। যাকেরীন এবং সালেকীনদের ভীড় লেগে যেত।

রমজানে হাজী সাহেবের আম লঙ্গরখানা চালু থাকত। কমবেশি দুইশ মানুষ সেখানে খানা খেত। এছাড়া প্রতি বছর মুরিদদের নিয়ে পীরানে কালিয়ার যেতেন। আট-দশদিন সেখানে অবস্থান করতেন। সেখানেও লঙ্গরখানা চালু থাকত। প্রচুর পরিমাণ লোক সেখানে খানা খেত। হাজী সাহেবের জীবনীকার মাওলানা নযীর আহমদ লিখেন, পীরানে কালিয়ারে একটা ছোটখাটো মেলা হয়ে যেত। চারপাশ থেকে প্রচুর পরিমাণে মানুষ এসে শরীক হত। হাজী সাহেবের নাম তখন শুধু দেওবন্দ আর পীরানে কালিয়ারেই নয়, বরং চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো। যেখানেই যেতেন মানুষের ভীড় জমে যেত। আল্লাহ তায়ালা তাকে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছিলেন।

জুনাগরের নবাববাড়িতে

হাজী সাহেব একবার তার মুরিদদের কাফেলা নিয়ে আজমীরের উরসে গেলেন। প্রচুর মানুষের ভীড়। পীর-ফকির, দ্বীনদার, দুনিয়াদার সব কিসিমের লোকজনই আছে এখানে। হাজী সাহেব একটি সরাইখানায় অবস্থান করেন। মানুষের মধ্যে কিভাবে যেন জানাজানি হয়ে যায়। লোকজন সরাইখানায় এসে ভেঙে পড়ে। ধনী লোকজন এসে হাজী সাহেবকে অনুরোধ করতে থাকে, আপনি আমাদের বাড়িতে চলে আসুন। সেখানে প্রশস্ত ব্যবস্থাপনা আছে। কিন্তু হাজী সাহেব জনসাধারণের উপকারের কথা ভেবে সরাইখানাতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের না করে দেন। লোকজন সরাইখানায় হাজী সাহেব থেকে উপকৃত হতে লাগলো।
এরই মাঝে একদিন হাকিম মুহম্মদ হাসান এবং মওলবী আমিরুদ্দীন হাজী সাহেবের কাছে জুনাগরের নবাবের দাওয়াতনামা পাঠান। নবাব সাহেব হাজী সাহেবের সাথে সাক্ষাতের জন্য তীব্রভাবে অপেক্ষা করছেন। হাজী সাহেব পরিষ্কারভাবে নিষেধ করে দিলেন। কিন্তু তারাও ছাড়বার পাত্র নয়। এভাবে বারবার দরখাস্ত করতে থাকলে হাজী সাহেব কিছু শর্তে রাজি হলেন। শর্ত হলো, হাজী সাহেব যেখানে ইচ্ছা সেখানে অবস্থান করবেন আর যখন ইচ্ছা তখনই ফেরত চলে আসবেন। হাজী সাহেবের জন্য কোনো বিশেষ সম্মানের আয়োজন করা যাবে না। হাজী সাহেব জানতেন, আমির শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের শান শওকত দেখানোর জন্য ইস্তেকবালে প্রচুর পরিমাণে অপচয় করে। আলিশান গেইট সাজায়। ঢোল-নাকারা বাজে। তোপ-বন্দুক ছুড়া হয়। আতশবাজি ও আলোকসজ্জার আয়োজন করে। মেহমানের জন্য বিশাল মহলের ব্যবস্থা করা হয়। হাজী সাহেব তাই শুরুতেই এইসব পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিলেন।

নবাব রাসুল বখশ সাহেব সকল শর্ত মেনে নিলেন। হাজী সাহেবের পক্ষ থেকে শর্তসহ তারবার্তা পাঠানো হলে নবাব সাহেব সকল শর্ত মেনে নিয়ে ফিরতি তার পাঠিয়ে দিলেন। জুনাগর গিয়ে হাজী সাহেব একটি মসজিদে অবস্থান করলেন। নবাব সাহেব সংবাদ পেয়ে এসে আবদার করলেন, মসজিদে না থেকে আমার বাড়ি চলে আসুন। সেখানে আপনার জন্য সব ধরণের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা আছে। বাড়ির সামনেই মসজিদ আছে। হাজী সাহেব জানিয়ে দিলেন, আমি এই মসজিদেই অবস্থান করবো। কিন্তু নবাব সাহেবও নাছোড়বান্দা! অবশেষে হাজী সাহেব রাজি হয়ে গেলেন।

বাড়িতে যাওয়ার পর নবাব সাহেব আবেদন করলেন, আমি প্রতিদিন আপনার কাছে তিনশ রুপি পাঠিয়ে দিবো। আপনি সেটা গরীব দুখিদের মাঝে দান করে দিবেন। হাজী সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, এর প্রয়োজন কি? নবাব সাহেব বললেন, নইলে আমার বদনাম হবে। লোকে বলবে, নবাবের পীর সাহেব এসেছে অথচ নবাব সাহেব কিছুই দিচ্ছেন না। এতে হাজী সাহেব চুপ হয়ে গেলেন। নবাব সাহেব প্রতিদিন তিনশ রুপি করে পাঠাতে লাগলেন। পাশাপাশি হাজী সাহেবের সাথে যত লোকজন সাক্ষাত ও উপকৃত হতে আসতো সবাইকে খানা খাওয়াতেন। নবাব সাহেবও প্রতিদিন সালাম দেয়ার জন্য হাজির হয়ে যেতেন।

এভাবে হাজী সাহেব সেখানে আটদিন অবস্থান করেন। আটদিনই এভাবে চলতে থাকে। এরপর তিনি ফেরত চলে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। যেহেতু আগে থেকেই শর্ত করা ছিলো, হাজী সাহেব যখন ইচ্ছা চলে আসবেন তাই কেউ আর তাকে বাঁধা দিলো না। নবাব সাহেব তার বিদায়ের জন্য প্রস্তুতি নিলেন। তার জন্য ২০ হাজার রুপির ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু হাজি সাহেব তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। মওলবি আমিরুদ্দীনকে বলে দিলেন, আমি আপনাকে খুশি করার জন্য এসেছি। আপনাকে খুশি করে দিয়েছি। ব্যাস। এই টাকা আমি নিতে পারবো না। অগত্যা রুপি ফিরিয়ে নেয়া হলো এবং নবাব সাহবে নির্দেশ দিলেন যেন হাজী সাহেবকে দেওবন্দ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া হয়।

আটদিন জুনাঘরে অবস্থান করে হাজী সাহেব দেওবন্দে ফেরত আসলেন।

হাজী সাহেবের কারামত

বুযুর্গদের কারামত একটি শরিয়তস্বীকৃত বিষয়। আহলে সুন্নাহর অনুসারীদের আকিদা হলো, আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বান্দাদের থেকেও মাঝে মাঝেও এমন কিছু বিষ্ময়কর ঘটনার প্রকাশ ঘটান, যা সচরাচর ঘটতে দেখা যায় না। তবে এক্ষেত্রে সেই বুযুর্গের নিজস্ব কোনো এখতিয়ার থাকে না। তিনি চাইলেই এমন কিছু ঘটাতে সক্ষম নন। বরং আল্লাহ তায়ালা যখন ইচ্ছা তখনই তা ঘটিয়ে থাকেন।

হাজী আবেদ হুসাইন রহ. থেকেও আল্লাহ তায়ালা অনেক কারামতের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। নিচে কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হলো।

দারোগা সাহেব বেকসুর খালাস!

দেওবন্দ থানায় নুরুদ্দীন নামে এক দারোগা ছিলো। একবার তিনি থানায় এক অপরাধীকে বেদম প্রহার করলে লোকটি হঠাৎ মারা যায়। যদিও তাকে মেরে ফেলার কোনো ইচ্ছে দারোগা সাহেবের ছিলো না। দারোগার নামে হত্যার মামলা হয়। তিনি অনেক চেষ্টা তদবির করেন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। অবশেষে তিনি হাজী সাহেবের কাছে এসে তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে কান্নাকাটি শুরু করেন। হাজী সাহেব তার দিকে তাকিয়ে বললেন, যাও কিছু হবে না।
নির্ধারিত তারিখে সাহারানপুর গেলে তার মামলা খারিজ হয়ে যায় এবং তার আরও প্রমোশন হয়।

হজের ঘটনা

১৩৩০ হিজরীতে হাজী সাহেব সপ্তম হজ করেন। হজের সফরে মুনশি আহমদ আলি সাহেবও ছিলেন। হজ শেষ হওয়ার পর হাজী সাহেব মক্কায় অবস্থান করছেন। মদীনায় আরও কিছুদিন পর রওয়ানা হবেন। মুনশি সাহেব ভাবলেন, হাজী সাহেব তো মদীনায় আরও পরে যাবেন। এখন খাড়ি বম্বুর দিকে যে কাফেলাটি যাচ্ছে আমি তাদের সাথে শরিক হয়ে মদীনা চলে যাই। সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তিনি হাজী সাহেবের কাছে অনুমতি নিতে আসলেন। হাজী সাহেব মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমাদের কাফেলার সাথে যাওয়া উচিত হবে না। সাথীদের আরও যারা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছে সবাইকে যেতে নিষেধ করো।
হাজী সাহেবের কথায় তারা যাত্রা বাতিল করে দিলেন। কিছুদিন পর হাজী সাহেব সবাইকে নিয়ে মদীনায় রওয়ানা হলেন। পথে রাবেক নামক জায়গায় যাত্রা বিরতি দিলেন। হাজী সাহেব মাছ রান্না করালেন। মুনশি সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাই তিনি মাছ খেতে চাচ্ছিলেন না। হাজী সাহেব বললেন, খাও। উপকার হবে। খাওয়ার পর তার অসুখ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেলো। এরপর হাজী সাহেব বললেন, তোমরা যে কাফেলার সাথে যেতে চাচ্ছিলে সেই কাফেলা পানিতে ডুবে গেছে।
পরদিন তারা ফিরতি এক কাফেলার সাক্ষাত পেলেন। তাদের কাছ থেকে জানতে পারলেন ঘটনা সত্য। সেই কাফেলাটি পানিতে ডুবে গেছে।

মাদরাসা প্রতিষ্ঠা

মুসলিম শাসনামলে ভারতবর্ষে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হতো মুসলিম শাসক, আমির-উমারা এবং নবাবগণের সার্বিক তত্বাবধানে। প্রত্যেক শহর ও অঞ্চলে তাদের তত্বাবধানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হত। রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হত। এছাড়া উলামায়ে কেরাম ব্যক্তিগতভাবে নিজস্ব বাসগৃহেও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচলনা করতেন। সরকারিভাবে তারা জায়গির লাভ করতেন।

১৮৫৭ এর সিপাহী বিপ্লব এবং শামেলীযুদ্ধের পর সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। উলামায়ে কেরামের উপর নেমে আসে হত্য-মামলার খড়গ। মাদরাসাগুলোর জায়গির বাজেয়াপ্ত হয়। বন্ধ হয়ে যায় ধর্মীয় শিক্ষার ধারা। পাশাপাশি উলামায়ে কেরামের উপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালানোর ফলে কমতে থাকে উলামায়ে কেরামের সংখ্যা। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে জানাযা পড়ানোর মতো কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়াও কষ্টকর হয়ে পড়ে।

অপরদিকে লন্ডন থেকে আরবি এবং উর্দু ভাষায় পারদর্শী হাজার হাজার পাদ্রি এনে ছড়িয়ে দেয়া হয় পুরো ভারতবর্ষজুড়ে। যারা মুসলমানদের অন্তরে লুকিয়ে থাকা ঈমানের অবশিষ্ট স্ফুলিঙ্গটুকুও নিভিয়ে দেয়ার এক ঘৃণ্য অপপ্রয়াসে লিপ্ত হয়। এহেন পরিস্থিতিতে মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা এবং তাহযীব-তামাদ্দুন হেফাজত, তাদের ভেতর ধর্মীয় এবং স্বাধীনতার চেতনা তৈরি ও শামেলীর অসম্পূর্ণ কাজকে পূর্ণতা দেয়ার লক্ষ্যে সমকালীন দরদি উলামায়ে কেরাম এবং বুযুর্গানে দ্বীনের মনে অনুভূতি জাগ্রত হলো, একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অবাক করা ব্যাপার হলো, সমকালীন উল্লেখযোগ্য উলামা এবং বুযুর্গানে দ্বীন সবার মনেই একই সময়ে এই চিন্তা এলো। তারা যখন পরস্পর একত্র হতেন তখন দেখা যেত কেউ বলছেন, ‘আমার মনে কাশফ হয়েছে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন..।’ কেউ বলছেন, ‘আমার মনেও ইলহাম হয়েছে..।’ অপরজন বলতেন, ‘আমার মনেও এমন কথাই আসছে..।’

সবার মনের এই কাশফ, ইলহাম বা যে নামেই তাকে ডাকি- এটিকে যিনি বাস্তব কার্যে রূপ দিয়েছেন তিনি হলেন হাজী আবেদ হুসাইন রহ.। তিনি একবার সাত্তা মসজিদে চিল্লারত অবস্থায় স্বপ্নে দেখলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলছেন, ‘দ্বীনের প্রচার প্রসার ধরে রাখার জন্য এখানে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হোক। আল্লাহ তায়ালা সাহায্য করবেন।’

পরদিন সকালে তিনি মাওলানা ফজলুর রহমান, মাওলানা যুলফিকার আলি এবং হাজী ফজলে হক প্রমুখকে দাওয়াত করে তাদের সামনে নিজের স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করে বলেন, ‘যদি বড় আলেম না থাকে তাহলে মাসআলা বলার মতো কেউ থাকবে না। এজন্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা দরকার। ইলমে দ্বীন উঠে যাচ্ছে। এমন কিছু একটা করতে হবে যাতে ইলমে দ্বীন বাকি থাকে। দিল্লির মাদরাসাগুলো শেষ হয়ে যাওয়ার পর থেকে কেউ আর ইলমে দ্বীন পড়ছে না।’

উপস্থিত সবাই মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য সম্মত হয়ে যান। কারণ আগে থেকেই তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন। শুধু উদ্যোগ নেয়ার মানুষের প্রয়োজন ছিলো। যখন উদ্যোক্তা পাওয়া গেলো তখন সবাই খুশীমনে তাতে সাড়া দিলেন। হাজী সাহেব বললেন, চাঁদা করে মাদরাসা করা হবে। এরপর নিজের সাদা রোমাল বিছিয়ে নিজের পকেট থেকে তিন রুপি বের করে তাতে রাখলেন। বললেন, ইনশাআল্লাহ প্রতি মাসে আমি এই চাঁদা দিয়ে যাবো। একথা লিখিতভাবেও দিলেন।

পরদিন ইশরাকের নামাজ পড়ে হাজী সাহেব সাত্তা মসজিদ থেকে বের হলেন। সাধারণত তিনি সাত্তা মসজিদ থেকে বের হতেন না। সেদিন ব্যতিক্রম করলেন। গলায় সেই সাদা রোমাল নিয়ে তিনি বের হয়ে গেলেন। প্রথমে গেলেন মাওলানা মাহতাব আলির ঘরে। তিনি দিলেন ছয় টাকা। এরপর মাওলানা ফজলুর রহমানের ঘরে। তিনি স্বাগত জানিয়ে বারো টাকা দিলেন। তারপর মুনশি ফজলে হক সাহেবের ঘরে গেলে তিনি দিলেন ছয় টাকা। এরপর গেলেন মাওলানা যুলফিকার আলি সাহেবের কাছে। তিনিও দিলেন বারো টাকা। এরপর মহল্লা আবুল বারাকাতে গেলেন। আল্লাহ তায়ালা তার যবানে যথেষ্ঠ প্রভাব দিয়েছিলেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত কালেকশন করে প্রায় তিনশ টাকা হয়ে গেলো। যা বর্তমান হিসেবে প্রায় তিন লাখ টাকা হবে।

এই টাকা পেয়ে তার হিম্মত আরও বেড়ে গেলো। এবার তাহলে মাদরাসার কার্যক্রম শুরু করা যায়। মাওলানা কাসেম নানুতুবী রহ. এর শশুরবাড়ি ছিলো দেওবন্দে। সেই সুবাদে দেওবন্দের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিলো। হাজী সাহেবের সাথেও ছিলো তার সুসম্পর্ক। দেখা-সাক্ষাতে তারা মাঝে মধ্যে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে কথাবার্তা বলতেন। হাজী সাহেব মাদরাসা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার পর তাই প্রথমেই নানুতুবী রহ. এর কাছে চিঠি পাঠালেন। হাজী সাহেব লিখলেন, ‘আপনি পাঠদানের জন্য দেওবন্দে চলে আসুন। ফকির (হাজী সাহেব) এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছে।’

নানুতুবী রহ. তখন মিরাঠে একটি ছাপাখানায় কিতাব তাসহীহ এর কাজ করতেন। অবসরে হাদীস পড়াতেন। মাকতাবার সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকায় তাৎক্ষণিক তার জন্য আসা সম্ভব ছিলো না। তাই তিনি জবাবে লিখেন, ‘আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। আল্লাহ তায়ালা কল্যানের ফয়সালা করুন। আমি মোল্লা মাহমুদের ১৫ টাকা বেতনে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেই পড়াবে। আমি মাদরাসার সার্বিক সহযোগিতায় আছি।’

বলা হয় দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার প্রায় সাত বছর পর নানুতুবী রহ. স্থায়ীভাবে দেওবন্দে আসেন এবং পুরোপুরি দেওবন্দ মাদরাসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অবশ্য মাওলানা আসীর আদরবির ভাষ্যমতে, ততদিনে তিনি নানুতা ছেড়ে দেওবন্দে থাকা শুরু করে দিয়েছিলেন। তবে কাজ করতেন মিরাঠে। যাই হোক, এই সাত বছরেও দেওবন্দে তার আসা-যাওয়া অব্যহত ছিলো। শশুরবাড়ির পাশাপাশি মাদরাসার বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণী ও পরীক্ষা গ্রহণ ইত্যাদি নানা উপলক্ষ্যেই তিনি দেওবন্দে আসতেন। সাত বছর পর তিনি পুরোপুরিভাবে দেওবন্দ মাদরাসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দারুল উলুম দেওবন্দের উসূলে হাশতেগানা প্রণয়নসহ প্রতিষ্ঠানটির চেতনা ও আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিতও তারই হাতেই রচিত হয়।

পরে এটি নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে যে, দারুল উলুম দেওবন্দের ‘বানী’ মূলত কে? হাজী সাহেব নাকি নানুতুবী রহ.? পক্ষে-বিপক্ষে বেশ কিছু লেখালেখিও হয়েছে। মূলত যারা হাজী আবেদ হুসাইন রহ.কে বানী বলতে চান তারা বানী বলতে ‘প্রতিষ্ঠাতা’ অর্থ বুঝিয়ে থাকেন। তারা মনে করেন নানুতুবী রহ.কে বানী বলে হাজী সাহেবের অবদানকে অস্বীকার করা হচ্ছে।

অপরদিকে ব্যাপকভাবে কাসেম নানুতুবী রহ.-কেই দারুল উলুম দেওবন্দের বানী হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এর মূল কারণ হলো, প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম হয়ত তার হাত ধরে শুরু হয়নি; কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির চিন্তা এবং আদর্শিক ভিতটি তৈরি হয়েছে তার হাত ধরেই। একটি প্রতিষ্ঠান মানুষের কাছে পরিচিতি এবং গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে তার আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। আর এর বানী যেহেতু নানুতুবী রহ. তাই তিনিই দারুল উলুম দেওবন্দের বানী। সহজ কথায়, নানুতুবী রহ. হলেন দেওবন্দিয়ত বা ফিকরে দেওবন্দের বানী।

তাছাড়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনায় তিনি সহ আরও অনেকেই অংশিদার ছিলেন। হয়ত এই সময়ে এই দেওবন্দেই সেই মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে সেটা অনেকে ভাবেননি। কিন্তু স্থানের বিবেচনা বাদ দিলে মৌলিকভাবে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা তাদের সবারই স্বপ্ন ছিলো। হাজী সাহেব দেওবন্দে তার কার্যে বাস্তবায়ন করেছেন। এ মর্মে হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কি রহ.-এর একটি ঘটনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারি তৈয়ব সাহেব রহ. লিখেছেন, দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম নাজেমে তালিমাত দেওয়ান মুহাম্মদ ইয়াসিন সাহেব একবার হজের সফরে গেলেন। ফেরার সময় তিনি হাজী সাহেবের কাছে বিদায় নিতে গিয়ে বললেন, ‘হযরত! আমাদের মাদরাসার জন্য দোয়া করবেন!’ হাজী সাহেব শুনে বললেন, ‘বাহ! মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য রাতের পর রাত সেজদায় কপাল ঘষলাম আমরা। আর প্রতিষ্ঠার পর এখন সেটা তোমাদের মাদরাসা হয়ে গেছে!’ এরপর তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা ছিলো মাদরাসা থানাভবন বা নানুতায় হবে। কিন্তু কে জানত দেওবন্দবাসী এই সৌভাগ্য ছিনিয়ে নিবে?’

হাজী সাহেবের শেষের এই কথাটুকু অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। মাদরাসা তাদের সবার স্বপ্ন এবং রোনাজারির ফল। হ্যা, সেই ফল দেওবন্দেই প্রকাশ পাবে তা হয়ত তারা জানতেন না। আল্লাহ তায়ালা হাজী সাহেবের মাধ্যমে দেওবন্দে তার প্রকাশ ঘটালেন।

হাজী সাহেব মুহতামিম পদে

প্রতিষ্ঠার পর থেকে হাজী সাহেবই ছিলেন মাদরাসার মুহতামিম। ১২৮৪হি./১৮৬৭ইং তে হাজী সাহেব হজের উদ্দেশে রওয়ানা হলে পৈত্রিক যত সহায় সম্পত্তি ছিলো সব আত্মীয়-স্বজন ও নিকটজনদের মাঝে বণ্টন করে দেন। বুঝাই যাচ্ছিলো তিনি আর ফেরত আসার ইচ্ছা রাখেন না। তাই তিনি মাওলানা রফিউদ্দীন সাহেবকে মুহতামিম হিসেবে নিয়োগ করে যান।

বিদায়কালে এলাকাবাসী তার সাথে সাথে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। কেউ কেউ কয়েক ক্রোশ পর্যন্ত সাথে গেলো। সহায় সম্পত্তি তো সব বণ্টন করে দিয়ে গেছেন। একমাত্র সম্বল ছিলো তাওয়াক্কুল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সফর অত্যন্ত আসান করেন। মক্কায় পৌঁছে প্রথমে হজ করেন। এরপর যান মদীনায়। প্রায় এক বছর পর্যন্ত মদীনায় ছিলো। এক বছর মদীনায় কাটানোর পর হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কি রহ. এর হাতে বায়াত হন। হাজী সাহেব তাকে দেওবন্দে ফিরে এসে মাদরাসা ও মসজিদের কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য নির্দেশ দেন। বলেন, ‘তোমার জন্য সেখানে গিয়ে মাদ্রাসা মসজিদের খেদমত করা মদীনায় জীবন কাটানোর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

শায়েখের নির্দেশে তিনি দেওবন্দে চলে আসেন। ফিরে আসার পর একদিন স্বপ্নে দেখেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মাদরাসার কাজে আত্মনিয়োগ করার নির্দেশ দিচ্ছেন। ফলে তিনি দেওবন্দেই থেকে যাওয়ার ইচ্ছে করেন। হাজী সাহেবের কাছে চিঠি পাঠালে তিনিও অত্যন্ত খুশি হন।
মাওলানা রফিউদ্দীন ১৩০৬হি/১৮৮৮ইং পর্যন্ত ইহতিমামের দায়িত্ব পালন করেন। তার সময়ে দেওবন্দে অনেক উন্নতি সাধিত হয়। নওদারা তার সময়েই নির্মিত হয়। ১৩০৬ হিজরিতে তিনি মক্কায় হিজরত করে চলে গেলে পুনরায় সবার পরামর্শে হাজী সাহেবকে মুহতামিম বানানো হয়। তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের তৃতীয় মুহতামিম সাব্যস্ত হন।

জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা

দেওবন্দ তখন থেকেই মসজিদের শহর। এর অলিগলিতে অসংখ্য মসজিদের ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এতগুলি মসজিদের মাঝে একটিও জামে মসজিদ ছিলো না। তাই প্রয়োজন ছিলো উপযুক্ত জায়গা দেখে একটি বড় জামে মসজিদ নির্মাণ করা। প্রয়োজন তো সবাই অনুভব করছিলো। কিন্তু উদ্যোগ নেয়ার ছিলো না কেউ। দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর হাজী সাহেব এদিকে মনযোগ দিলেন। সবাইকে নিয়ে পরামর্শে বসলেন। বৈঠকে মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গেলো। সবাই মিলে একটি সুন্দর উঁচু জায়গাও পছন্দ করে ফেললেন। কিন্তু মুশকিল হলো, সেখানে এখন কিছু ঘর বানানো আছে। ঘরের মালিকরা জায়গা ছাড়তে রাজি। তবে শর্ত হলো, বিনিময়ে তাদের ভিন্ন জায়গা এবং ঘর দিতে হবে।

হাজি সাহেব প্রস্তাব শুনে সামান্যও চিন্তা করার প্রয়োজন মনে করলেন না। বলে দিলেন, আমার বাড়িঘর তোমরা নিয়ে নাও। এর বিনিময়ে এই জায়গা মসজিদের জন্য দিয়ে দাও।

সে বছরই হাজী সাহেব সহায় সম্পত্তি সব বিলিয়ে দিয়ে স্থায়ীভাবে আরবে চলে যান। কিন্তু হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কি রহ. এর হাতে বায়াত এবং খেলাফত লাভ করার পর তিনি তাকে দেওবন্দ ফিরে আসার নির্দেশ দেন। শায়েখের নির্দেশে তিনি দেওবন্দে চলে আসেন। এসে দেখেন মসজিদের জায়গাই এখনও পরিষ্কার হয়নি। মসজিদ তো আরও দূরের ব্যাপার।

অবস্থা দেখে তিনি কয়েকদিন চুপ করে রইলেন। এরপর কাজে নেমে পড়লেন। গভীর করে ফাউন্ডেশনের কাজ শুরু করলেন। মানুষ দেখে হাসাহাসি করতে লাগলো। এত গভীর ফাউন্ডেশন দিয়ে তিনি কি করবেন? কিন্তু হাজী সাহেবের কারও কথা শোনার সময় নেই। মসজিদের কাজ তার আপন গতিতে চলতে লাগলো। হ্যা, এজন্য দেওবন্দের বাইরে থেকেও কিছু চাঁদা কালেকশন করতে হয়েছে। কারণ এত ভারি খরচের বোঝা দেওবন্দবাসীর জন্য একা বহন করা সম্ভব ছিলো না।

অবশেষে চার বছরে (১৮৬৪-১৮৬৭ই.) মসজিদটির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। এটি এশিয়ার একটি ব্যতিক্রমি মসজিদ। মসজিদের কোনো ছাদ নেই। শুধু গম্ভুজ আর গম্ভুজ। মোট ১৩ টি গম্ভুজ আছে এতে। এছাড়া দুটি বড় মিনার এবং দুটি দুটি ছোট ছোট মিনারও রয়েছে। মসজিদের সাথে কিছু কামরাও বানানো হলো। দারুল উলুম দেওবন্দ সাত্তা মসজিদে শুরু হওয়ার পর যখন ছাত্র বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন তাকে স্থানান্তর করে কাজি মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়। কাজি মসজিদ হলো দারুল উলুম দেওবন্দের বর্তমান অবস্থান থেকে একটু পূর্ব দিকে জামে মসজিদের দিকে যেতে রাস্তার ডান পাশে। সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. যখন দেওবন্দে আসেন তখন এই মসজিদেই অবস্থান করেছিলেন।

যখন কাজি মসজিদেও ছাত্র সংকুলান হচ্ছিলো না তখন তাকে স্থানান্তর করা হয় জামে মসজিদে। জামে মসজিদের এই কামরাগুলো তখন ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ছাত্র আরও বেড়ে গেলে তখন বর্তমান জায়গাটি ক্রয় করে দারুল উলুম স্থায়ীভাবে এখানে স্থানান্তর হয়ে যায়।

কারি তৈয়ব সাহেব দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে চলে যাওয়ার পর দারুল উলুম ওয়াকফের সূচনাও এই জামে মসজিদ থেকেই হয়। পরবর্তীতে মাদরাসার জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা হলে ওয়াকফ সেখানে স্থানান্তর হয়ে যায়।

হাজী সাহেব রহ. এর স্মৃতি বিজড়িত এই মসজিদটি এখনও সাড়ম্বরে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। দেওবন্দে এখন জামে মসজিদের অভাব নেই। দারুল উলুম দেওবন্দের তিনটি মসজিদেই নিয়মিত জুমার নামাজ হয়। তবু জামে মসজিদ বললে সবাই এই মসজিদটিকে চিনে। এর সুমধুর আজান সবাইকে মুগ্ধ করে রাখত। আমরা অপেক্ষায় থাকতাম এই মসজিদের আজান শোনার জন্য।

ইন্তেকাল

হাজী সাহেব রহ. ২৭ জিলহজ বৃহস্পতিবার ১৩৩১হি/১৯১২ইং তে ৮১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। দেওবন্দেই তাকে সমাহিত করা হয়। বর্তমান মাকাবারা কাসেমী থেকে একটু উত্তরদিকে এগুলো তার কবর। পাশে তার স্মরণে একটি মসজিদও নির্মাণ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাকে গরীকে রহমত করুন। যে সওয়াবে জারিয়ার ব্যবস্থা তিনি করে রেখে গেছেন তা তার কবরে কেয়ামত পর্যন্ত পৌঁছতে থাকুক। আমিন।

তথ্যসুত্র:
১। বানীয়ে দারুল উলুম দেওবন্দ: এক তারীখী হাকায়েক, আব্দুল হাফিজ রহমানী
(হাজী সাহেব সম্পর্কিত বেশিরভাগ তথ্য এই বই থেকেই নেয়া হয়েছে)
২। আরওয়াহে সালাসাহ, আশরাফ আলী থানভী রহ.
৩। তারীখে দেওবন্দ : এক তাহকীক, আলী হাসান সাগের
৪। তারীখে দারুল উলুম দেওবন্দ, মাহমুদ রেজভী

আগের সংবাদজৈন দর্শন ও অনুমানের প্রামাণ্য
পরবর্তি সংবাদইসলামী সভ্যতায় লাইব্রেরি ব্যবস্থাপনা