হুজাইফা মাহমুদ
উত্তর–উপবেশিক চিন্তার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ফ্রাঞ্জ ফানোঁ তাঁর বিখ্যাত বই A dying colonialism-এর একজায়গায় লেখেন–‘সে–ই নারী, যে সবকিছু দেখে, নিজেকে অন্যের দৃষ্টির আড়ালে রেখে, সে ঔপনিবেশিকদেরকে হতাশ করে। সে নিজেকে অন্যের কাছে সমর্পণ করে দেয় না, নিজের আত্মসত্তাকে বিকিয়ে দেয় না, নিজেকে আকর্ষণের বস্তু হিসেবে অন্যের কাছে উপস্থাপনও করে না। (unveiled algeria)
ফানোঁ উক্তিটি করেছেন যদিও আলজেরিয়ার উপনিবেশ–বিরোধী নারীসমাজের সাংস্কৃতিক সংগ্রামকে চিত্রায়িত করতে, কিন্তু ব্যাপকভাবে দেখলে সমগ্র মুসলিম নারীসমাজকেই, যাঁরা হিজাব/বোরকাকে নিজেদের আইডেন্টিটির প্রতীক হিসাবে আত্মিকরণ করে নিয়েছেন, তাঁদেরকেও আমরা একই দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে পারি। মুসলিম নারীর অভেদ্য আলখেল্লা আর বোরকার সামনে ঔপনিবেশিক শক্তি নৈরাশ্যে কেন ভোগে, এর একটি কারণ ব্যাখ্যা করতে অ্যাডওয়ার্ড সাইদের শরণ নেয়া যেতে পারে। সাইদ বলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদ হলো আইডেন্টিটির রপ্তানি। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের শিকার দেশগুলোতে নিজেদের আইডেন্টিটি রপ্তানি করে তাদেরকে দাসানুদাস বানিয়ে শাসন ও শোষণ করার অভিপ্রায়। কিন্তু বোরকা, হিজাব ও ধর্মের অন্যান্য একান্ত প্রতীক লালনকারীরা হলেন তাদের সে অভিপ্রায়ের সামনে একটি প্রধান প্রতিরোধ। এসব প্রতীক স্পষ্ট ভাষাতেই এটা বুঝিয়ে দেয় যে, আমরা তোমার আইডেন্টিটিকে গ্রহণ করিনি। সুতরাং এই প্রতিকী প্রতিরোধের মুখে পড়ে ঔপনিবেশিক, সাম্রাজ্যবাদী এবং তাঁদের আদর্শায়িত দোসররা যারপরনাই হতাশ হন।
আইডেন্টিটির রপ্তানি ব্যাপারটা আরও সহজে বুঝতে হলে, উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কিছুদিন আগে যখন আফগানিস্তানে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের ব্যাপারটি আমেরিকার সামনে আসলো তখন ট্রাম্পের পররাষ্ট্র বিষয়ক সচিব সত্তর দশকের এক আফগান নারীর মিনি স্কার্ট–পরা ছবি দেখিয়ে ট্রাম্পকে বলেন, ‘সত্তরের দশকে যদি আফগান নারীরা এতটা পশ্চিমায়িত সংস্কৃতির আজ্ঞাবাহী হতে পারে, তাহলে আমাদের ঐকান্তিক চেষ্টায় সেটা এখনও ফিরিয়ে আনা সম্ভব ‘ এর মাধ্যমে তিনি অতিরিক্ত মোতায়েন এবং সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণের বৈধতা দাবি করছেন। যাইহোক, ফানোঁর বক্তব্যের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন ফানোঁ তাঁর বইয়ে। আরও সুনির্দিষ্ট করে, ঐতিহাসিক দলিল প্রমাণ–সহকারে এর প্রায়োগিক বিশ্লেষণ করেছেন আলজেরিয়ার বিখ্যাত কবি ও বুদ্ধিজীবী মালেক আল্লুলা, তাঁর বই the colonial Harem-এ।
আমাদের আলোচ্য ‘হারেম’ বিষয়ক তদন্তে আমরা এই বইটিকে একটি ‘চক্ষু উন্মোচনকারী’ সূত্র হিসেবে বিবেচনা করতে পারি অনায়াসে।
ফরাসিরা আলজেরিয়াতে উপনিবেশের তাঁবু গাড়ে ১৮৩০ সনে। বিশাল সেনাবহরের সাথে একই জাহাজে করে পর্যটক, ধর্মযাজক, বুদ্ধিজীবী, শিকারি এবং আলোকচিত্রীদের বড় সড় একটা দলও সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। দখলকারি সেনাবাহিনীর সাথে তারাও ছড়িয়ে পড়ে দেশের সর্বত্র। এদের চোখে তৃষ্ণা ছিল তাদের কল্পিত প্রাচ্যকে দেখার। প্রাচ্যের ভূগোল, সমাজ, ধর্ম এবং মানুষ সম্বন্ধে যে উদ্ভট, বর্বর, কামনাময়ী এবং রহস্যময় (exoticism) চিত্র পশ্চিমারা বিগত চারশো বছর ধরে কল্পনা করে এসেছে, প্রাচ্যের যে অলীক চিত্র তারা নির্মাণ করেছে নিজেদের মগজে, সেটাকে বাস্তবচক্ষে দেখার লক্ষ্যে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশজুড়ে।
প্রাচ্য বিষয়ক এই গৎবাঁধা বিকৃত ফ্যান্টাসির নামই ওরিয়েন্টালিজম। শিল্প–সাহিত্য, কবিতা ও নানান বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে একে নির্মাণ করা হয়েছে। যৌনতা ব্যতীত ফ্যান্টাসি হয় না। এই যৌন ফ্যান্টাসির গায়ে জোর হাওয়া দিয়েছিল যে ধারণাটি সেটা মূলত তাদের হারেম সম্পর্কিত ধারণা। মোটাদাগে বললে প্রাচ্যের নারী সম্পর্কে তাদের কল্পনা ছিল এমন—তারা অলস কামুক, হারেমে দিনাতিপাত করে মনিবের সান্নিধ্য লাভের প্রতীক্ষায়, হুক্কা টানে, নিজ গৃহে কারাবন্দী, বসন–ব্যাসনে প্রায় বিবস্ত্র (topless) এবং পুরুষের জৈবিক চাহিদায় তাদেরকে সহজেই নাগালে পাওয়া যায় (sexually available)।
ফ্রান্সের ‘চতুর সুদক্ষ আলোকচিত্রীগণ’ মনে মনে খায়েশ পোষণ করে এসেছিলেন যে তাঁদের এই কল্পিত নারীদের ছবি এঁকে রমরমা ব্যাবসা জমাবেন ফ্রান্সের বাজারে, ভোক্তাদের চাহিদানুযায়ী পৌঁছে দেবেন পছন্দের প্রাচ্যীয় আলোকচিত্র। কিন্তু তাঁরা আলজেরিয়ায় পৌঁছে যে নারীসমাজকে দেখলেন এতে যারপরনাই হতাশ হলেন। এই নারীসমাজ তাঁদের ‘শৈল্পিক দৃষ্টির’ আওতার ভেতরে নেই কোনোভাবেই। এঁদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত সাদা–কালো আলখেল্লায় আবৃত। আল্লুলা বলেন, ‘এই দীর্ঘ ও অভেদ্য আলখেল্লা ও চাদর আলোকচিত্রীদের জন্য ছিল একটি স্পষ্ট প্রত্যাখ্যানস্বরূপ। এই প্রত্যখান তিন ধরনের : প্রথমত, তাঁর ছবি তোলার কামনার প্রত্যাখ্যান। দ্বিতীয়ত, তাঁর ‘শিল্পচর্চার’ প্রত্যাখ্যান। এবং তৃতীয়ত, এমন একটি পরিবেশে তাঁর স্থানের প্রত্যাখ্যান, যেটি তাঁর নিজের নয়।
নারীর অন্তর্জগতের বুনোট এতই ঠাঁসা যে, কোনো ফাঁক–ফোঁকর গলিয়ে আলোকচিত্রীর লেন্স সেখানে পৌঁছাতে পারে না। উপরন্তু নারী তাঁর বোরকার জালের সূক্ষ্ম ফোঁকরের ভেতর থেকে যে নারীসুলভ দৃষ্টি নিক্ষেপিত করেন, তা অনেকটা আলোকচিত্রীর দৃষ্টির মতোই, লেন্সের ভেতর থেকে নিক্ষেপ করা দৃষ্টি যেন। আলোকচিত্রী এই শৈল্পিক দৃষ্টি চেনেন। ফলে বোরকা–পরিহিতা নারীর সামনে গেলে তিনি অস্বস্তিতে পড়ে যান, নারীর উপস্থিতিকে তাঁর কাছে আক্রমণাত্মক মনে হতে থাকে। আলোকচিত্রীর মনে হতে থাকে তিনি নিজেই শিল্পের সাবজেক্টে পরিণত হচ্ছেন। তখন ঔপনিবেশিক আলোকচিত্রী হতাশ ও অসহায় বোধ করতে থাকেন। ফ্রাঞ্জ ফানোঁ কি ঔপনিবেশিকদের এই হতাশার কথাই বলেছেন আমাদেরকে? সম্ভবত তাই।
যাইহোক, আলজেরীয় নারীর এই প্রত্যাখ্যান আলোকচিত্রীকে যারপরনাই ক্ষুব্ধ করে তোলে, এবং এটা তাঁর আত্মমর্যাদায় বেশ জোরেসোরে আঘাত হানে। ফলে তিনি ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন তাঁর শৈল্পিক অভিপ্রায়কে বাস্তবায়নের জন্য। আলজেরিয়ান নারীকে এবং আলজেরিয়াকে উন্মোচন করতে প্রয়াসী হন। সমাজের প্রান্তিকায়িত নারীগোষ্ঠিকে (marginalized), সহজে বললে পতিতালয় থেকে নারীদেরকে ভাড়া করে আনেন। উপর্যুপরি পয়সা খরচ করে তাদের মাধ্যমে আলোকচিত্রী নির্মাণ করেন স্টেরিওটাইপ প্রাচ্য দেশীয় নারীর ডিসকোর্স। সেইসব সচিত্র পোস্টকার্ডে নির্মিত হয় পশ্চিমা হারেম ফ্যান্টাসি, ভয়ারিজম (voyeurism), নারীর জন্য গৃহ–বন্দীশালার কাল্পনিক চিত্রায়ন, বোরকা/হিজাবকে নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে প্রতিকায়ন, এবং তদুপরি নারীকে লাস্যময়ী ও কমনীয় করে তোলেন নিজের ইচ্ছামতন। হারেম বিষয়ক তাঁর পূর্বধারণা তাঁকে উত্তেজিত করে তোলে। ফলে হারেম হিসেবে যা সে চিত্রায়িত করে সেটা অবধারিতভাবেই হয় অলস নারীদের কামুক জগৎ। মনিবের মনোরঞ্জন ব্যতীত যাদের ভিন্ন কোন কাজ নেই।
বাহারি সাজপোষাকে শুয়ে–বসে থাকা নারীর দল, যেন অন্তহীন কোনো উৎসবের অপেক্ষায় আছে তারা। তারপর, ছবিগুলোকে বাস্তবতার যথাযথ প্রতিনিধি হিসাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সেখানে থাকে সাংস্কৃতিক ও নিত্যব্যবহার্য নানান উপাদান। একটা বেডরুম বা রান্নাঘরে যেসব বস্তু থাকে সেগুলোকে চিত্রায়িত করা হয় নিপুণ যত্নের সাথে। স্টুডিওর কাজ শেষ হলে আলোকচিত্রী চতুরতার সাথে সেসব ছবিতে ক্যাপশন যুক্ত করেন। মালেক আল্লুলা তাঁর বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ে এ–জাতীয় ছবিগুলোকে উপস্থিত করেছেন, যেগুলোর ক্যাপশন সাধারণত এমন—পর্দাবৃতা নারী, কারাবন্দী নারী, আপন গৃহে নারীরা (জানালার গ্রিলকে জেলখানার গরাদ হিসাবে দেখানো হয়েছে সেসব ছবিতে), যুগল ও পরিবার, হারেমে নারীরা, প্রনোদিনী নারী, একজোড়া নারী, নারীরা তাদের বক্ষ উন্মোচন করছে, সুন্দরী ফাতেমা হাঁটছে…ইত্যাদি।
ক্যাপশনের মাধ্যমে এসব ছবির ভোক্তাদেরকে এটা নিশ্চিতরূপে বুঝিয়ে দিতে চান যে, এই হলো আলজেরীয় নারীর জগত। এখানে স্মর্তব্য যে, (মুসলিম) প্রাচ্যের নারী সম্পর্কে পশ্চিমের গৎবাঁধা ধারণা মূলত দুইটি প্রপঞ্চকে ঘিরে আবর্তিত হয়। প্রথমত, সেখানকার নারীরা পুরুষ কর্তৃক সামাজিকভাবে নিপীড়িত, বন্দীজীবন যাপন করে।দ্বিতীয়ত, নারীরা হারেম নামক একটি প্রমোদকাননে (Whorehouse) মনোরঞ্জনের কাজ করে। তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘ব্যালি ড্যান্সার’ নামক আরেকটি প্রপঞ্চ। সুতরাং, এসব পোস্টকার্ড বাজারে ওঠে, মানুষের হাতে হাতে যায়, বিভিন্ন মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয় এবং সবশেষে প্রাচ্যের নারীজগত ও হারেম সংক্রান্ত স্টেরিওটাইপ ধারণা মজবুতভাবেই তাদের মগজে জায়গা পায়।
আল্লুলা দেখিয়েছেন, পোস্টকার্ডে আঁকা নারীরা আলজেরিয়ার নারীসমাজের প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং ফরাসিদের মনে লালিত প্রাচ্য–নারী সম্পর্কে কাল্পনিক বিভ্রান্তি ও কামুক–ফ্যান্টাসিকেই প্রতিবিম্বিত করে। এবং অন্যের যৌনকর্ম দেখার (voyuerism) প্রতি তাদের অপ্রতিরোধ্য বিকৃত বাসনাকেও চিত্রায়িত করে। তারা যখন এটা মনে করে যে, এইসব পোস্টকার্ডের মাধ্যমে তারা আলজেরিয়ার বোরকা–আচ্ছাদিত নারীসমাজকে উন্মোচন করে মানুষের হাতে হাতে তুলে দিয়েছে, তখন আসলে বাস্তবতা হলো এর মাধ্যমে পশ্চিমের বিকৃত কামুক চরিত্রেরই উন্মোচন হয় এমন একটি সমাজের কাছে, যারা নিজেদের এই পরিচয়ের ব্যাপারে মোটেও সচেতন না।
‘হারেম’ পূর্বে যেরকম পশ্চিমের নিকট একটি রহস্যময় গোপন কামনার জগত হিসেবে বিরাজমান ছিল, সেইসব পোস্টকার্ড তাদের সে ধারণায় আরও জোর হাওয়া দেয়। আলোকচিত্রীরা হারেমকে ঠিক সেভাবেই উপস্থাপন করে, যেভাবে ভাবতে অভ্যস্ত তাদের ভোক্তারা। আর যেহেতু পোস্টকার্ডে অংকিত সেসব ছবি আলজেরিয়ার নারীসমাজ এবং ‘হারেম’ তাদের নিকট বাস্তবতারই প্রতিনিধিত্ব করে, সেহেতু তা তাদের পূর্বের ধারণা আরও পোক্ত করা বৈ অন্যকোনো রদবদল ঘটায়নি।
এটা হলো হারেমের ঔপনিবেশিক ও ওরিয়েন্টালিস্ট প্রকল্পের নির্মাণ। প্রাচ্যকে বিকৃত করে উপস্থাপন করার সুদীর্ঘ সিলসিলার একটি অপরিহার্য অংশ। আরব, মুসলমি নারীসমাজের এই উদ্ভটায়ন এবং মিস রিপ্রেজেন্টেশন কীভাবে পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদকে পশ্চিমের জন্য একটি ‘অলঙ্ঘনীয় মানবিক দায়িত্ব’ পালনের জন্য বারবার উদ্বুদ্ধ করে, সেটা আমরা দেখেছি।
যাইহোক, ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের এই ফরাসি আলোকচিত্রীরা হারেমের পশ্চিমা অর্থ নির্মাণে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু তারও আগে, হারেমের বিকৃত ধারণা বিদ্যমান ছিল পশ্চিমে, ঠিক একই অর্থে। ষোড়শ শতকে আরব্য রজনীর কেচ্ছাকাহিনিগুলো (আলফু লাইলাহ) ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়ে আসলো এবং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল পাঠকদের কাছে। সেই কেচ্ছাকাহিনির কাল্পনিক চরিত্র ও প্লটকে পশ্চিমারা খুব সহজেই ইসলামিক আরব জাহানের সাথে মিলিয়ে ফেলল। ফলস্বরূপ হারেম বাস্তবিক অর্থেই একটি মোহনীয় কামনাময় জগত হিসাবে নির্মিত হলো।
অবশ্য তখন হারেমকে ভাবা হতো সাধারণত রাজা–বাদশাহদের প্রাসাদ ও মহলকে কেন্দ্র করে। মুসলিম রাজা, বাদশাহ, খলিফা, সুলতান—এঁদের ব্যক্তিচরিত্রকে অকল্পনীভাবে হারেম–কেন্দ্রিক করে রাখা হয়েছে। মুসলিম শাসক মানেই অপরিহার্যভাবে এটা ধরে নেয়া হয় যে তিনি একজন নারীলিপ্সু কামুক চরিত্রের লোক, হারেমের প্রমোদকাননে অগণিত নারীর সাথে বেলেল্লাপনা করা, প্রজাদের ওপর নিপীড়ন আর পররাজ্য দখল করে বেড়ানোই হলো তাঁর বাদশাহি। এমন নেতিবাচক চরিত্র নির্মাণে মূখ্য ভূমিকা পালন করছে যে জিনিসটা, সেটা অবশ্যই রাজ–প্রাসাদের রাজকীয় হারেম।
তো, হারেম বা রাজকীয় হারেম সম্পর্কে এইসব মিথ ও কাল্পনিক গাল–গপ্পো কারা রচনা করল, কবে রচনা করল—এর ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করেছেন প্রফেসর শোহরেহ গুলসুরখি। তিনি লিখেন–‘হারেম সম্পর্কে যাবতীয় মিথ চালু হয়েছিল মূলত পশ্চিমে, এবং সেগুলো আরও তাপিত ও বেগবান হয়েছে বিগত কয়েক শতকে যেসব ইউরোপিয়ান পর্যটক প্রাচ্যে এসেছিল তাদের মাধ্যমে। সকলেরই জানা কথা, ইসলামি সাম্রাজ্যগুলো যখন উন্নতি ও উৎকর্ষতার পরম শিখরে আরোহণ করল, তখন অসংখ্য ইউরোপিয়ান বণিক, ব্যাবসায়ী, অ্যাডভেঞ্চার–সন্ধানী, গুপ্তচর, মিশনারি সেসব সাম্রাজ্যে যাওয়ার প্রতি আকৃষ্ট হলো। অনেকেই সেখানে নিজেদের আবাসস্থলও বানিয়ে ফেলল। শহরে–বন্দরে, গ্রামে–গঞ্জে ঘুরে বেড়াতে লাগল তারা।
সম্পূর্ণ অচেনা, নতুন একটা সভ্যতার সাথে পরিচিত হচ্ছে। সেসব কথা, অভিজ্ঞতা আর নিজেদের নানান কাহিনি তারা নোট করতে লাগল। অনেকে স্কেচ করত। পরবর্তী সময়ে নিজ দেশে ফিরে গেলে এগুলো বর্ণিত হবে তাদের রাজার দরবারে এবং জনপরিসরে। তাদের অনেকেই আবার মুসলিম রাজপ্রাসাদের সাথেও সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হলো। সেখানে আসা–যাওয়া হয় বটে, কিন্তু প্রাসাদের নারীমহল সম্পর্কে তারা একেবারেই বে–ওয়াকিবহাল। সেটা তাদের জন্য এক নিষিদ্ধ এলাকা। ফলে এই দুর্ভেদ্য নারীমহল নিয়ে, যাকে বলা হয় হারেম, তাদের কৌতূহল ও কূটসন্ধানী মন তাদের ভাবনাকে অবধারিতভাবেই যেন এমন একটি দিকে পরিচালিত করেছে, যা নারীদের সাথে খুব সহজেই সম্পৃক্ত করা যায়, কোনো প্রশ্ন ছাড়াই।
এই নিষিদ্ধতায় তারা গোপন আনন্দের সন্ধান করেছে। অসংখ্য রেফারেন্সের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, সেসব পর্যটকের রঙচঙ–মাখানো ন্যারেটিভই এসব মিথ নির্মাণ করেছে। টিপিক্যাল পর্যটকরা যে হারেমের চিত্র তৈরি করেছেন সেটা সর্বাংশে গাল–গপ্পো ও শোনাকথা নির্ভর, এবং অবশ্যই তাদের নিজেদের বন্য কল্পনা। হারেমের এই চিত্রটাই প্রচারিত হলো ধীরে ধীরে। একজন পশ্চিমা পর্যটকের কাছে হারেম হলো একটি আনন্দমহল, যা বাদশাহের জন্য নির্ধারিত এবং যেখানে অসংখ্য নারী সুগন্ধি ও হরেক রকমের সাজসজ্জায় নিজেকে সাজিয়ে রেখে তার কামার্ত মনিবের আহ্বানের অপেক্ষায় বসে আছে। (Gholsorkhi, Pari Khan Khanum : A masterful Safavid Princess)
এই ভুল উপস্থাপনের সবচে বড় শিকার সম্ভবত উসমানি, সাফাভি এবং মোঘল সাম্রাজ্যের হারেম। প্রচুর মুখরোচক গল্প–কাহিনি শোনা যায় এদেরকে কেন্দ্র করে। সুতরাং হারেম বলতে আসলে কী বুঝায়, হারেমে বসবাসকারীদের জীবনযাপন কেমন ছিল, মিথ ও বাস্তবতার মাঝে যোগসূত্র কোন জায়গায়, সেসবের ঐতিহাসিক অনুসন্ধান করাটা কেবল গুরুত্বপূর্ণই না,আবশ্যাকীয় একটি ব্যাপার।
বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে এটা নিয়ে। অনেক পশ্চিমা গবেষকও এই নব ঐতিহাসিক অনুসন্ধানে ব্রত হয়েছেন এবং বাস্তবতাকে উদ্ঘাটন করেছেন। আমরা এখন এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলাম থেকে সংক্ষেপে হারেমের ইতিবৃত্ত তুলে ধরব।
নতুন নতুন ঐতিহাসিক গবেষণার আলোকে ষোল/সতেরশো খ্রিষ্টাব্দের মোঘল, পার্সিয়ান ও উসমানি সাম্রাজ্যের হারেম সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান তথ্য জানা যাচ্ছে। সেগুলো একদিকে আমাদেরকে জানাচ্ছে হারেমে বসবাসকারিণীদের জীবন বাস্তবে কেমন ছিল, অপরদিকে তাদেরকে নিয়ে পশ্চিমা সমাজে যেসব উদ্ভট ও কাল্পনিক মিথ ছিল,সেসবকে দূর করে দিচ্ছে।
এই গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, হারেম ছিল উঁচু মাপের সংগঠিত এমন একটি মিশ্র ও যৌগ নারীসমাজ, যাতে ইতিহাসের পটপরিবর্তনের সাথে সাথে এর চরিত্রগত ও সময়মগত বৈচিত্র্য সাধিত হয়েছে। সেই সমাজে মুসলিমদের পাশাপাশি অমুসলিমরাও শামিল থাকত। সমাজের অভিজাতশ্রেণীর নারী ও শিশুরা শিক্ষা–দীক্ষা লাভ করতেন এবং বিভিন্ন রকমের শিল্প ও শৈলিতে দক্ষতা অর্জন করতেন হারেমে। হারেমের নারীরা দেশের রাজনীতিতেও উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব বিস্তার করতেন। সমাজের মূল স্রোত থেকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ছিলেন না তাঁরা।
একজন শাসকের মা, স্ত্রী, কন্যা এবং পরিচারিকাগণ ছিলেন হারেমের মূল পরিচালনাকারী। তাঁরা এর ভেতরকার রাজনীতির গতিপথ ঠিক করে দিতেন। এবং যুবরাজদের মধ্য থেকে কাউকে তাঁরা পরবর্তী সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে প্রস্তুত করতেন। এই যুবরাজ নির্বাচন ও তাঁর বিয়ে–শাদির ব্যাপারগুলো ছিল হারেমের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এবং অবশ্যই কিছু কিছু হারেমের মা ও স্ত্রীগণ, যেমন উসমানি খেলাফতের হুররেম বিবি (১৫৫৮), সাফাভি খেলাফতের পরি খানম (১৫৭৮) এবং মোঘল সাম্রাজ্যের নুর জাহান (১৬৪৫)–তাঁরা রাষ্ট্রের বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজে অনেক অবদান রেখেছেন। (encyclopedia of islam, ১৯৩৮)
হারেম কেবল নারীদের জন্যই নির্ধারিত ছিল, ব্যাপারটা এমনও না। তুর্কি রাজপ্রাসাদ তুপকাপিতে ‘হারেম–ই–হুমায়ুন’ ছিল; সেখানে তিনটি হারেম ছিল, দুইটা পুরুষদের জন্য, যেখানে রাষ্ট্রীয় গোপন বিষয়–আশয় সম্বন্ধে জরুরি মিটিং ও আলোচনা পর্যালোচনা হতো, এবং একটা নারীদের জন্য।
এ গেল রাজকীয় হারেমে কথা। কিন্তু ব্যাপকভাবে দেখলে সাধারণ মুসলিম সমাজে নারীদের অন্তর্গত জগতটাকেই হারেম বলা যেতে পারে। যেখানে বহিরাগত, অপরিচিত, গায়রে মাহরাম পুরুষদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি নারীদের পিতা বা স্বামীও যদি প্রবেশ করতে চান তাহলে পূর্বানুমতি লাগবে। ঠিক এভাবে, এলাকার অপরাপর পাড়া–পড়শি ও গ্রামের নারীরা মিলে নিজেদের মতো করে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির ভিত্তিতে একটি আন্তঃসমাজ গড়ে তোলেন কখনো কখনো। এটা পূর্বে ব্যাপকভাবেই প্রচলিত ছিল। বিশেষত সেসব সংগঠনের উদ্দেশ্য থাকত নারী ও শিশুদেরকে শিক্ষিত করে তোলা, নৈতিক ও ধর্মীয় জীবন যাপনে উৎসাহিত করা, পারস্পরিক সাহায্য–সহযোগিতার বিনিময় করা ইত্যাদি।
সুতরাং হারেম কি নারীর বন্দীশালা, কামাতুর নারীলিপ্সু পুরুষের ব্যাক্তিগত ভোগালয়,নাকি গার্হস্থ্য রাজনীতির একটি শক্তিশালী প্লাটফর্ম, এবং নারীদের সর্বোচ্চ সম্মান ও ব্যক্তিত্ব নির্মাণের মহোত্তম জায়গা, সেটা বিবেচনা করা আপাতত পাঠকের দায়িত্ব। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, হারেম ব্যাপারটা নিয়ে আমি বেশ অস্বস্তিতেই ছিলাম। আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের শুভ্র পতাকায় একে একটি কলঙ্কের দাগ বলে মনে হতো। কেননা, হারেম সম্পর্কে আমার ধারণা এবং একজন পশ্চিমার ধারণার মাঝে পার্থক্য খুব সামান্যই ছিল।
এখানে আরও একটা ব্যাপার অবশ্য লক্ষ্যনীয়। প্রাচ্যবাদ কর্তৃক মুসলিম নারীদের এই চরিত্র নির্মাণ কীভাবে প্রাচ্যের লোকদের মগজেও শক্তপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে। জ্ঞানের উপনিবেশায়নের প্রক্রিয়া ও প্রকৃতি সম্পর্কে জানার মাধ্যমেই হয়তো এর প্রতিকার সম্ভব।
লেখক : তরুণ কবি ও ক্রিটিক