অচেনা এক নগরীর গল্প

মাহফুজ আবেদীন

পত্রিকার পাতায় গভীর ধ্যানমগ্ন সময় পার করছে শাফিন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছোট-বড়, প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সব খবর পড়ে যাচ্ছে। বিসিএস পরীক্ষার্থীরা যেভাবে পত্রিকার পাতায় ডুবে যায় ঠিক তেমন। তবে শাফিনের খবর পড়াটা মুখ্য নয়। হোম কোয়ারেন্টিনের একঘেয়ে ও বেকার সময়গুলো পার করাই আসল কথা। রীমা এসে দুপুরের খবার প্রস্তুত জানিয়ে গেল। স্ত্রীর কথা কানে পড়লেও ভাবলেশহীন বসে থাকল শাফিন। পত্রিকা রেখে উদাস দৃষ্টিতে সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকল। দেয়ালে সাটানো কেলেন্ডারের পাতা জানান দিচ্ছে লকডাউনের দুমাস পার হতে চলেছে। দু দুটো মাস কিভাবে সে কর্মহীন ঘরে বসে কাটিয়ে দিল ভেবে খুব অবাক লাগল তার। প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল হয়ত সপ্তাহ দুয়েক পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। সবকিছু আগের মতই শুরু হবে আবার। মাঝ দিয়ে বরং দু’এক সপ্তাহের বড় সড় একটা ছুটি পাওয়া গেল। কিন্তু না। দিন যত গড়াতে লাগল প্রতীক্ষার প্রহর বাড়তে লাগল। চাতক পাখির মত ভালো কোনো খবরের প্রত্যাশায় অস্থির সময় কাটতে লাগল। সরকারী অফিসের অধিকাংশ চাকুরীজীবিরা সময়টাকে বেশ আয়েশের সাথে পার করছে। যেনো ‘করোনা’ মহামারী আশীর্বাদ হিসেবেই এসেছে তাদের জন্য। ঘরে বসে বেতন ভাতা সব পেয়ে যাচ্ছে। পরিবার পরিজন নিয়ে ভাবনাহীন জীবন কাটাচ্ছে। অসুবিধা হল শাফিনের মত বেসরকারি অফিসের চাকুরীজীবিদের। প্রথম একমাস অফিস বন্ধ থাকলেও বেতন ঠিকঠাক পেয়ে গেছে। এরপর থেকে কাজকর্মও বন্ধ বেতনও বন্ধ। অনির্দিষ্টকালের জন্য সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে তার কোম্পানি।

আজকে মাসের বাইশ তারিখ। বাড়িওয়ালা ভাড়া পরিশোধের তাগিদ দিয়ে গেছে। হাতে সামান্য কিছু টাকা আছে। ভাড়া পরিশোধ করার পর খুব সামান্যই বাকি থাকবে। কিভাবে সংসারের খরচপাতি যোগাবে আর কিভাবে ঋণ মেটাবে দোটানায় পড়ে গেছে শাফিন। গাজীপুরের দিকে দশ শতাংশের মত একটা জায়গা কিনতে গিয়ে বড় একটা ঋণ করতে হয়েছিল। সেলারির টাকা থেকে কিছু কিছু আদায় করে আসছিল এপর্যন্ত। সেই পথ এখন বন্ধ। বিকল্প কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কী করবে সেটাই মাথায় ধরেনা শাফিনের।

রীমা আবার আসল। ‘অত কী ভাবছো? ব্যবস্থা একটা না একটা হবেই। পুরুষ মানুষ এত ভেঙে পড়লে হয়? আগে এসো খেয়ে নাও।’

শাফিন রীমার কথার উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলনা। পেরেশানির রেখা কপালে নিয়েই খাবার খেতে উঠে দাঁড়ালো।

খাবারের মান ও তরকারীর পদ সংখ্যা উভয়ই হ্রাস পাচ্ছে দিন দিন। খাবার টেবিলে বসলেই সেটা বুঝতে পারে শাফিন। রীমা যথাসম্ভব কম খরচের মধ্যেই সব কিছু আঞ্জাম দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে জোড়াতালি দিয়ে কতদিন চলবে?  অথচ কদিন আগের কথাই। খাবার দাবার কিংবা সংসারের খরচাপাতির জন্য কখনো ভাবতে হয়নি তাদের। সেলারির টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া ও সমস্ত খরচপাতি অনায়েসেই হয়ে যেত তাদের। কিছু টাকা আয়ও করতে পেরেছিল। জমি কিনতে গিয়ে সেগুলোও ব্যায় হয়ে গেছে। কে জানত অজানা অদেখা এক ভাইরাস সব কিছু এলোমেলো করে দিবে? নিশ্চিন্ত জীবনে অনিশ্চয়তার দামামা বেজে উঠবে?

খাবার খেতে খেতে রীমা কথা উঠালো, ‘শুনেছি কিছু কিছু কোম্পানি খুলে দিচ্ছে। কাগজপত্র জমা দিয়ে দেখ কোনো ব্যবস্থা হয় কিনা। তোমার রেজাল্ট তো মন্দ নয়, অভিজ্ঞতাও আছে সাথে। আমার বিশ্বাস চেষ্টা করলে ব্যবস্থা একটা হয়েই যাবে।’

শাফিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, ‘কিছু কিছু কোম্পানি খুলছে তা সত্য। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ব্যবসা বাণিজ্য মন্দা যাচ্ছে। কোম্পানিগুলো খুললেও ব্যাপকভাবে লোক ছাটাই করে দিবে। নতুন নিয়োগের তো প্রশ্নই ওঠেনা।’

রীমা জবাব খুঁজে পায়না। কথা তো ঠিকই বলেছে শাফিন। নামি-দামি কোম্পানিগুলোও মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছেনা। ছোটখাটো কোম্পানিগুলো তো বিলীন হবার উপক্রম। সেখানে নতুন চাকরি প্রত্যাশা করাটাও বোকামী।

সন্ধ্যাবেলা রীমা শাফিনের হাতে একটা জুয়েলারি বক্স ধরিয়ে দিল, ‘আমার স্বর্ণের চেইনটা এমনিতেই পড়ে আছে। এটা বেচে আপাতত বাসা ভাড়াটা দিয়ে দাও। আর হাতে যা টাকা আছে সেগুলো দিয়ে কয়েকদিন সংসার চালিয়ে নাও। এর মধ্যে একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।’

শাফিন জানে এই চেইনটা রীমা শখ করে বানিয়েছিল। নিয়মিত ব্যবহারও করত। গত বছর তাদের প্রথম সন্তান প্রসবের পর সন্তানটি মারা যায়। সেই সময় সে শোকে সব গয়নাগাটি খুলে রেখেছিল। এরপর থেকে শাফিন এই চেইনটি পরতে দেখেনি রীমাকে।

শাফিনের মন এটা বিক্রি করতে সায় দিচ্ছিলনা। কিন্তু রীমার পিড়াপিড়ি আর নির্মম পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করল চেইনটি বিক্রি করতে।

আরো কটা দিন এভাবে কেটে গেল। এরই মধ্যে একদিন নোমান সাহেব এসে উপস্থিত হলেন। মগবাজারে টাইলস এর পাইকারি ব্যবসা তার। তিন লাখ টাকা তিনি শাফিনকে দিয়েছিলেন জমি কেনার সময়। লাখ খানেক টাকা পরিশোধ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। জানালেন তার ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ। দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। এক সপ্তাহের মধ্যে কিছু টাকা যেকোনো মূল্যেই তাকে দিতে হবে। শাফিন তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিদায় করেছে। কিন্তু এক সপ্তাহ পর যে তিনি আবার আসবেন না এর কোনো নিশ্চয়তা শাফিনের কাছে নেই। কারণ প্রত্যেকটা মানুষই অকস্মাৎ নিজ নিজ জায়গায় থমকে গেছে। সবাই দিশেহারা। কী করবে, কিভাবে চলবে কেউ জানেনা। দিনকাল ভালো থাকলে নোমান সাহেব চাপ দিতেন না। এতটুকু ভরসা শাফিনের আছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কারোও উপর ভরসা করা যায়না।

এক সপ্তাহ পর নোমান সাহেব ঠিক ঠিক আবার আসলেন। তিনি নাছোড়বান্দা। ত্রিশ, চল্লিশ হাজার টাকা কমপক্ষে দিতে হবে। না হলে তার চলবে না। শাফিন থলে ঝাড়ার মত করে সব মিলিয়ে বিশ হাজার টাকা নোমান সাহেবের হাতে তুলে দিল। নোমান সাহেব এই বিশ হাজার টাকা পেয়েই যেনো লাখ টাকা পেয়ে গেলেন। গদগদ কণ্ঠে ‘থ্যাংকস’ বলে প্রস্থান করলেন। শাফিন খুব অবাক হল। এত বড় একজন ব্যবসায়ীকেও পরিস্থিতি কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে। কতটা নতজানু করে ছেড়েছে। আর সে তো সামান্য চাকুরিজীবী মাত্র। মূহুর্তেই নিজের অপারগতার দায়ভার যেনো কিছুটা কমে এল তার।

আজ থেকে সম্পূর্ণরূপে কপর্দকহীন হয়ে গেল শাফিন। বুঝমান হওয়ার পর কখনো এমন অর্থনৈতিক টানপোড়নে পরেছে বলে তার মনে পড়ে না।

পরদিন খুব সকাল সকাল বেড়িয়ে পরল শাফিন। রীমা জানতে চাইলে শুধু বলল, ‘একজনের সাথে দেখা করতে হবে। ফিরতে দেরি হবে।’

রীমা দরজা খুলে শাফিনের গমন পথে তাকিয়ে থাকল। স্বামীকে এমন বৈরী পরিস্থিতিতে কখনো দেখে অভ্যস্ত না সে। কী নিদারুণ পেরেশানি আর হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে সে। স্ত্রী হয়ে সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া কিছুই করার নেই তার।

সারাদিন কেটে গেল। শাফিন বাসায় ফেরেনি। কোথায় আছে, কী করছে কিছুই জানেনা সে। বিকেলের দিকে ফোন করে জানাল, ফিরতে রাত হবে তার। এতটুকুই। রীমা এক রুম থেকে আরেক রুম অস্থির পায়চারি করতে লাগল। রাত নয়টার দিকে শাফিন এল। চেহারা শরীরে ক্লান্তির ছাপ। রীমা জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় ছিলে সারা দিন?’

‘এই তো চাকরির খোঁজখবর নিতে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে হল।’

‘তো! ব্যবস্থা কিছু হল?’

‘এখনোও হয়নি। দুএক দিনের মধ্যে হবে ইনশাআল্লাহ।’

শাফিন আর কিছু বললনা। যেনো নীরবতার সামিয়ানায় কোনো কিছু আড়াল করে রাখতে চাইছে।

দুদিন পর শাফিন জানাল তার ছোটখাটো একটা চাকরি হয়েছে। কিন্তু ডিউটি করতে হবে রাত নয়টা পর্যন্ত। সেলারিও যৎসামান্য। রীমা খুশি হলেও ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়ল। কোথায় যেনো একটা চিনচিন ব্যাথা অনূভুত হল। স্বামীর কষ্ট লাঘব করার মত কোনো উপায় তার কাছে নেই। নিয়তিকে মেনে নেয়া ছাড়া কীইবা করার আছে?

শাফিন সকাল সকাল কর্মস্থলে ছুটল। আজ নতুন ঠিকানায় নতুন কর্ম দিবস তার। মগবাজার থেকে পায়ে হেটে রওয়ানা হল সদরঘাটের উদ্দেশ্যে। বাস চলাচল বন্ধ। রিকশা কিংবা সিএনজিতে যেতে বড় অংকের টাকা গুণতে হবে। দুই তিনশ টাকাই এখন শাফিনের কাছে বড় অংক। হাটতে হাটতে পায়ে টান ধরেছে। অভ্যাস না থাকলে যা হয়। কিন্তু অভ্যাসের দোহায় দিয়ে এখন কাজ নেই। নয়টায় পৌঁছতে হবে তাকে। দুই মাস আগেও যেই শহরকে সে জ্যাম নগরী হিসেবে চিনত সেই চীরচেনা চিত্র এখন আর নেই। পথঘাট সম্পূর্ণ ফাঁকা। লোকজনের এলোপাথাড়ি চলাচলের ভীড়ে যেখানে ফুটপাতগুলোতে পা ফেলা দায় ছিল সেই ফুটপাতগুলো আজ কুকুরেরা দখলে নিয়েছে। সিগন্যালগুলোতে লাল বাতি নিভে আবার সবুজ বাতি জ্বলে উঠছে একের পর এক। কিন্তু কে আগে যাবে সেই প্রতিযোগিতা করার মত কোনো গাড়ি নেই। নেই হেল্পারদের ‘নিউ মার্কে, গুলিস্তান,  শাহাবাগ, মালিবাগ, এয়ারপোর্ট’ ইত্যাদি হাঁকডাক। উঁচু উঁচু দালানকোঠা যেনো শহরের এই রূপ দেখে বিস্মিত। শাফিন ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে আটকে থেকে কত দোয়া করেছে যেনো এই অবস্থার পরিবর্তন হয়। কিন্তু প্রিয় শহরের এমন ভৌতিক পরিবর্তন হবে তা কি কেউ কোনো দিন চেয়েছে?

সদর ঘাট পৌঁছে শাফিন সোজা আনোয়ার ভাইয়ের অফিসে ঢুকল। অফিস বলতে টিনশেডের একটি জীর্ণ ঘর। আনোয়ার ভাই তার গ্রামের বন্ধু। এখন সদর ঘাটে মাছের পাইকারি সেল করে। অনেক বছর থেকেই সে এই ব্যবসার সাথে লেগে আছে। এখন সে এই অঙ্গনে মোটামুটি ফেমাস একজন লোক। শাফিন মাঝে মাঝে আনোয়ার ভাইয়ের কাছে ফোন দিয়ে সারা মাসের মাছ কিনে রাখত। গত সপ্তাহে আনোয়ার ভাই ফোন করে জিজ্ঞেস করল, ‘এই মাসে তো মাছ টাছ নিলানা শাফিন! পোলাপানরে দিয়া বাসায় পাঠায়া দিমুনি কিছু? ভালো রুই কাতলা আছে!’

শাফিন চুপ মেরে থাকে। কি বলবে খুঁজে পায় না। কিভাবে বুঝাবে যে তার এখন এক মাস তো দূরের কথা এক দিনের মাছ কেনারও সামর্থ্য নেই।

‘ভাই! এই মাসে মাছ নিতে পারছি না। হাত একেবারে খালি। লাগলে আপনাকে জানাবো। আপনার ব্যবসা কেমন চলছে ভাই!’

শাফিন প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিতে চাইল।

‘আল্লাহর ইচ্ছায় আমার ব্যবসা তো এহনও ভালোই চলতাছে। যেমনে সরকার লকডাউন মারতাছে ভবিষ্যতে কি না কি অয় অইডাই ভাবতেছি।’

শাফিন এই প্রথম কারো অবস্থা ভালো শুনতে পেল।  এরপর থেকে যখনই কিভাবে চলবে, কী করবে ইত্যাদি ভাবত তখনই তার আনোয়ার ভাইয়ের কথা মনে হত। এই কঠিন সময়েও তার ব্যবসা দিব্য চলছে। নোমান সাহেবকে ধুয়ে মুছে বিশ হাজার টাকা দিয়ে দেয়ার পর একবার মনে হল আনোয়ার ভাইকে বলে অস্থায়ী একটা কাজ যোগাড় করা যায় কিনা। নানা দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভোগার পর একদিন আনোয়ার ভাইকে ফোন দিয়ে সব বলল শাফিন। তিনি কথা দিয়েছেন একটা ব্যবস্থা তিনি করবেন সেই আশ্বাস নিয়ে আজ শাফিন আনোয়ার ভাইয়ের অফিসে এসে হাজির হল।

শুরু হল অন্য এক জগতের সাথে পথ চলা। যেই জগতে শাফিন কোনো দিন পা ফেলেনি। পা ফেলার কথা ভাবেওনি। নির্মম নিয়তি তাকে আজ সেই পথেই টেনে আনল। আজ থেকে পথই তার অফিস, পথই তার কর্মস্থল। শাফিন ভাবে, এই মহামারী তার মত না জানি কত মধ্যবিত্তকে নিমিষেই পথে নামিয়ে দিয়েছে।

সারা দিনের হাড়ভাংগা খাটা খটনির পর সন্ধ্যাবেলা জামা কাপড় পালটে আবার হাটা পথে মগবাজার রওয়ানা হল। এবার যেনো কিছুতেই তার পা এগোয় না। শরীরটাকে বিরাট বোঝার মত মনে হচ্ছে। দুপুরে ডাল ভাজি দিয়ে দুটি  পরোটা খেয়েছিল। ক্ষুধায় পেটের ভেতর চিন চিন ব্যথা করছে। তবুও হাটতে হবে। বাসায় পৌঁছতে হবে নয়টার মধ্যেই। নয়ত রীমা আবার টেনশনে পড়ে যাবে।

আগের সংবাদশীতল হাওয়ার জীবন
পরবর্তি সংবাদঅচিনপুর