ইউসুফ কারজাবীর বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা : ইয়াসির কাদীর পর্যালোচনা

নাসিম ইমরান

সদ্য প্রয়াত ড. ইউসুফ আল কারজাবীকে শুধু এ যুগের নয় বরং শতাব্দির উল্লেখযোগ্য আস্থাভাজন ইসলামী স্কলার হিসেবে আখ্যা দেন ড. ইয়াসির কাদী। তিনি মনে করেন ইউসুফ কারজাবী ছিলেন এ যুগের মুজতাহিদ। কারজাবী ছিলেন উম্মাহর বৃহৎ অংশের প্রিয়পাত্র। ইয়াসির কাদী নিজেও কারজাবীর অনেক লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এবং নিজের মত স্বরূপ কারজাবীর ফতাওয়া রেফার করেছেন।

ইউসুফ আল কারজাবীর কিছু লিখনি ও ফতাওয়া সমালোচিত ও বিতর্কিত হলেও উম্মাহর জন্য তার অবদান অনস্বীকার্য। বহুল আলোচিত সমালোচিত ইখওয়ানী এই স্কলারের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে বিভিন্ন ঘরানার ধর্মপ্রান মুসলিম ও স্কলারগন। যদি কারজাবীর সাথে তাদের বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য ছিলো। ইয়াসির কাদী কারজাবীর বুদ্ধিবৃত্তিক তুরাস পর্যালোচনার এক পর্যায়ে বলেন, তিন প্রকার মানুষ ব্যতীত তার মৃত্যুতে আর কেউ খুশি হতে পারে না। যারা তার মৃত্যুতে খুশি হয়েছে তারা হলো- ক. ইহুদীবাদী যারা ইসলামের শত্রু খ. তার জ্ঞান যাদের শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য হুমকি স্বরূপ গ. উগ্র ধর্মান্ধ।

ইউসুফ কারজাবী পশ্চিম মিশরে কায়রোর পাশে অখ্যাত একটি ছোট গ্রামে ৯ সেপ্টেম্বর ১৯২৬ ইং জন্মগ্রহণ করেন। দুই বছর বয়সেই তার বাবা ইনতেকাল করলে তার দ্বায়িত্ব নেন তার চাচা। অল্প বয়সেই সপরিবারে চলে আসেন কায়রো। সুপ্রসিদ্ধ দ্বীনি বিদ্যাপীঠ আল আজহারের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ আজহারী তথা প্রাথমিক স্কুল থেকে নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন আল আজহারেই। হাই স্কুল শেষ করেন ক্লাস টপার হিসেবে। ১৯৫৩ সালে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নম্বরে। ডিপ্লোমা সহ আরবী সাহিত্য এবং কুরআন ও হাদীসের উপর দুইটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬০ সালে কলেজের সর্বোচ্চ নম্বরে। এবং যথারীতি সর্বোচ্চ সংখ্যক পয়েন্টে পিএইচডি শেষ করেন ১৯৭৩ সালে। তিনি সব ক্লাসেই প্রথম তো ছিলেনই, ছিলেন পুরো বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রথম এমনকি ব্যাচেলরে তিনি পুরো দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।

কারজাবী নিকট অতীতের স্কলার এবং প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সুন্নি ধারার প্রায় সকল স্কলার দ্বারা প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত ছিলেন। নিকট অতীতের স্কলারদের কথা বলতে গেলে দুজন স্কলারের কথা বলতেই হয় ১. রশীদ রেজা ২. হাসান আল বান্নাহ। ইয়াসির কাদী মনেকরেন কারজাবী ছিলেন রশীদ রেজার আধুনিক ভার্সন। শত বছর  পূর্বে রশীদ রেজা ছিলেন একমাত্র বৈশ্বিক মুফতী। তাকে কিছু মানুষ পছন্দ করতেন কিছু মানুষ পছন্দ করতেন না। তেমনি কারজাবীও ছিলেন বৈশ্বিক প্রভাবশালী স্কলার, তাকেও কিছু মানুষ পছন্দ করেন কিছু মানুষ পছন্দ করেন না। রশীদ রেজা ছিলেন বৈপ্লবিক চিন্তাবিদ। তাকে একদিকে মোকাবেলা করতে হয়েছে উপনিবেশীক শক্তিকে অপরদিকে উসমানী খিলাফার পতন। কারজাবী সরাসরি রশীদ রেজার সাক্ষাৎ পাননি, রেজা ইন্তেকালের ১২ বছর পর কারজাবীর জন্ম। কারজাবীর সামনে ছিলো রেজার লিখনি, দৃষ্টিকোণ, কর্মপন্থা।

অপরদিকে হাসান আল বান্নাহ ছিলেন মুসলিম ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা। কারজাবী সরাসরি তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। যুবক বয়সে একদিন তার ক্লাসে আসেন ইমাম হাসান আল বান্নাহ, কারজাবী তাকে দেখে অভিভুত হন এবং সরাসরি তার দ্বারা প্রভাবিত হন।

কারজাবী সমকালীন সিনিয়র দুজন স্কলার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, তারা হলেন- ১. ড. মুহাম্মাদ আল গাজালি ২. সৈয়দ সাবেক, প্রসিদ্ধ কিতাব ফিকহুস সুন্নাহ এর লেখক। এ দুজনি ছিলেন রশীদ রেজার স্কুল অব থট এর শিষ্য।

কারজাবী প্রাচীন স্কলারদের মধ্যে ইবনুল কাইয়ুম সহ সুন্নি ধারার ঐতিহ্যবাহী প্রায় সকল স্কলার দ্বারা প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত ছিলেন। তাই দেখা যায় তিনি ইমাম গাজালির হাওলা যেমন দেন তেমনি ইমাম ইবনে তাইমিয়াকেও নিয়ে আসেন।

ইমাম শাতেবী যাকে মাকাসেদে শরীয়ার প্রতিষ্ঠাতা না বললেও তিনি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তার ছয় খন্ডে লিখিত আল মুয়াফাকাত বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। কারজাবী ইমাম শাতেবীর দ্বারা বিপুল পরিমাণে প্রভাবিত। এবং নিজের লেখায় মাকাসেদ ব্যবহার করেছেন প্রচুর পরিমাণে। মুলত মাকাসেদে শরীয়ায় সামগ্রিক শরীয়ার উদ্দেশ্য ও ফিলোসফি নিয়ে ডিপলি আলোচনা করা হয়।

কারজাবীর রাজনৈতিক জার্নি মোটেও সহজ ছিলো না। তিনি অনানুষ্ঠানিকভাবে ইখওয়ানের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫০—৬০ এর মধ্যে মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসের কর্তৃক ইখওয়ানের উপর ব্যপক ভাবে দমন পীড়ন চালানো হয়। কেননা সে ধর্মীয় রাজনীতিকে নিজ শাসনের বিরুদ্ধে হুমকি মনে করেছিলো। উক্ত সময়ে হাজার হাজার ওলামাকে জামাল আব্দুন নাসের জেল বন্দি করেন। সৈয়দ কুতুরকে ফাঁসি দেন। যয়নাব আল গাজালিকে জুলুম নির্যাতন করে। সে সময় কারজাবী মাস্টার্স এর ছাত্র। তারপরও তিনি উক্ত সময়ে তিনবার জেলে যান এবং প্রায় এক বছর ছয় মাস জেলে ছিলেন। সে সময়ে মিশরের অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি মিশর ছেড়ে অন্যান্য দেশে চলে যান।

কারজাবীও চাকরির জন্য ১৯৬১ সালে কাতার গেলে কাতারের রাজপরিবার তাকে কাতারের নাগরিকত্ব দেন, এবং কারজাবী কাতারে স্থায়ী ভাবে বসবাসকেই সমীচীন মনে করেন। তিনি কাতারে অনেক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী স্টাডিজ প্রতিষ্ঠা করেন। এবং ১৯৭৭— ৯০ শরীয়া কলেজের ডিন ছিলেন। এরপর অবসর গ্রহণ করেন।

তিনি মিশরের বর্ণাঢ্য জীবন, শাইখুল আজহার হবার সম্ভাবনা, অঢেল সম্মান ও সম্পদ, পরিবার, জন্মভূমি সব কিছু ত্যাগ করেছেন শুধু সত্য কথা বলার জন্য।

তার রচিত বই প্রায় ১২০ টি। বিভিন্ন প্রবন্ধ ও সংকলন মিলিয়ে প্রায় ২০০ টি বই। কলম ধরেছেন শরিয়ার প্রায় সব বিষয়ে, লিখেছেন আকিদা, উলুমুল কুরআন, উলুমুস সুন্নাহ, ফিকাহ, উসুলে ফিকাহ, দাওয়াত, তারবিয়াত, ফিকহুস সুলুক, ইসলামি অর্থনীতি, ইসলামি আন্দোলন, ইসলামি ব্যক্তিত্ব, সাহিত্য, কবিতা প্রভৃতি শাখায়।  ১৯৬০ এ প্রকাশ হয় তার প্রথম বই ইসলামে হালাল ও হারাম (الحلال والحرام في الإسلام)। বইটি ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করে, এ যাবত পর্যন্ত বইটির ৩৫ টি সংস্করণ বের হয়েছে। কারজাবীর চিন্তা ও কাজের পদ্ধতি প্রকাশ পায় এ বইয়ে। ইয়াসির কাদীর মতে আধুনিক মাইন্ডকে ফিকহ শেখানোর জন্য শ্রেষ্ঠ বই এটি।

তিনি মধ্যমপন্থা নিয়ে বই লিখেছে, ইয়াসির কাদীর মতে তার লেখা বা কাজের একটি কি ওয়ার্ড হলো ‘মধ্যমপন্থা’।

জিহাদ ও উগ্রবাদ সম্পর্কে লিখেছেন, দেখিয়েছেন জিহাদ কোনভাবেই উগ্রবাদ নয়, উগ্রবাদের নামে যা হচ্ছে তা জিহাদ নয়।

কারজাবী ছিলেন যুগ সচেতন আলোচক। আধুনিক সব মাধ্যম ব্যবহার করেছেন নিজের কাজে। রেডিও স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইন্টারনেট ব্যবহার করে সহজেই পৌঁছে গেছেন মানুষের মাঝে।

কিং ফয়সাল অ্যাওয়ার্ড সহ মালয়েশিয়া, দুবাই, কাতার, আরব আমিরাত, আবুধাবি ইত্যাদি দেশের সর্বোচ্চ অ্যাওয়ার্ড রয়েছে কারজাবীর ঝুড়িতে। তিনি রাবেতায় আলোমে ইসলামির সদস্য, রাবেতায় আলোমে ইসলামির ফিকহ কাউন্সিলের প্রধান, ইত্তেহাদুল আলমি লিলওলামা আল ইসলামির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি মুসলিম সংখ্যালঘু দেশগুলো সহ প্রায় সব মুসলিম রাষ্ট্রে সফর করেছেন। বিন বায, আলি নদভী, তকী উসমানি সহ সব ধরনের বৈশ্বিক ওলামার সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিলো।

তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে ইখওয়ানের কোন পদে না থাকলেও ইখওয়ানের একজন প্রভাবশালী চিন্তক ছিলেন।

ফিকহ শাস্ত্রে কারজাবীর ম্যাথডোলজি ছিলো প্রাচীন ও আধুনিক মাসলাকের সমন্বয় তথা শুধু প্রাচীন কিতাব বা শুধু আধুনিক মানসিকতা নয় বরং মধ্যমপন্থা। এই মধ্যমপন্থা কারজাবীর সব কাজেরই প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য। ফিকহের এ পদ্ধতি তিনি পেয়েছেন রশীদ রেজার কাছে থেকে। রশীদ রেজা মাজহাবকে অতিক্রম করে শরীয়ার মূল টেক্সট, তাবেই যুগ ফলো করে বর্তমান যুগের জন্য শরীয়ার নতুন বিন্যাসের চেষ্টা করেছেন। চার শত বছর বা ছয় শত বছর আগের ফিকহি বিন্যাস এ যুগে প্রয়োগ করা যাবে না বলে তিনি মনে করতেন। তিনি প্রথম সালাফী শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যে আমাদের ৭০০ বা ৯০০ বছর পূর্বে নয় বরং মূল সালাফের যুগে যেতে হবে। তবে এ ‘সালাফী’ বর্তমান প্রচলিত সালাফী ধারা নয়, যার সদস্য নাসিরুদদীন আল বানী। প্রচলিত সালাফী ধারা তাবেই যুগে ফিরে গিয়ে তা এ যুগে প্রতিস্থাপন করতে চায়। শুধু কুরআন সুন্নাহর টেক্সটের মাধ্যমে। কিন্তু রশীদ রেজা লক্ষ্য রেখেছেন শরীয়ার উদ্দেশ্য বা মাকাসেদ, মাসলাহাতে আম্মাহ, সামগ্রিকতার বিষয়গুলি। তাই এটি প্রচলিত সালাফী ধারার থেকে ভিন্ন।

কারজাবী ফিকহী অংশগুলকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। ক. ছাওয়াবেত খ. মোতাগইয়িরাত। তথা কোন সমস্ত বিষয় আমরা পরিবর্তন করতে পারবো আর কোনগুলো পারবো না তা পৃথক করে দেখিয়েছেন। মুসলিম সংখাগুরু রাষ্ট্রের ফিকহ ও মুসলিম সংখালঘু রাষ্ট্রের ফিকহ আলাদা হওয়ার ব্যাপারে মত দিয়েছেন কারজাবী।

তিনি ইসলামী শরীয়া গনতন্ত্রের কনসেপ্ট প্রণয়ন করেন। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তার মধ্যমপন্থী ফাতওয়া বিশেষ আলোচিত সমালোচিত হয়েছে। তিনি আরব বসন্তের সাথে সরাসরি জড়িত। তার প্রতিটি ফতাওয়া বিস্তর পর্যালোচনার দাবি রাখে। তার মধ্যমপন্থার কারণে উগ্রবাদীরা তাকে মর্ডানিস্ট মনে করেন, আর মর্ডানিস্টরা তাকে উগ্রবাদী সংগঠনের সদস্য মনে করেন। এমনকি ফিলিস্তিন সম্পর্কিত ফতাওয়ার কারণে ইন্টারপোল তার গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করেছিল। তিনি বলেছিলেন ফিলিস্তিনিদের জন্য আত্মঘাতী হামলা বৈধ। এটিকে পশ্চিমারা টেররিস্ট আখ্যা দিয়ে তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। অথচ আজ যদি কেউ ইউক্রেনের জন্য যুদ্ধ করে জীবন দিতে রাজি হয় তাহলে তাকে বিবিসি সহ পশ্চিমা মিডিয়া বীর বলে প্রচার করবে। কমান্ডারের আদেশে একজন সৈনিক যদি গেরিলা হামলা করে মারা যায় তাকে জাতীয় বীর হিসেবে ভূষিত করা হয়। কাজ একই। ইসলামে আত্মহত্যা হারাম এটি নিয়ে কথা বলা হচ্ছে না। বরং কথা হচ্ছে পশ্চিমাদের দ্বিমুখিতা নিয়ে। তবে কারজাবী যদি বলতেন ফিলিস্তিনিদের জন্য কমান্ডারের আদেশে মৃত্যু-নিশ্চিত গেরিলা হামলা করাও বৈধ তাহলে আরও ভালো হত, যদিওবা দুই কথার অর্থ একই।

লেখক —  গবেষণা বিভাগ, সেন্টার ফর ইসলামিক থট এ্যান্ড স্টাডিজ

আগের সংবাদশরীফুজ্জামান নোমানি থেকে আবরার ফাহাদ: রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের প্রকারভেদ ও বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের স্বকীয়তা
পরবর্তি সংবাদযুগশ্রেষ্ঠ স্কলার ড. ইউসুফ আল কারযাভী র.-এর জীবন ও অবদান