ইফার বৈঠকে মসজিদে জামাত-জানাজা ও গুজব নিয়ে আলেমদের পরামর্শ

ফাতেহ ডেস্ক

করোনাভাইরাসের দরুণ বিরাজমান পরিস্থিতিতে জনগণের সুরক্ষা বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট আলেমরা মসজিদের জামাত, জানাজা ও গুজবসহ নানা বিষয়ে আটটি পরামর্শ দিয়েছেন।

আজ সোমবার (৩০) ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) মহাপরিচালক (ডিজি) আনিস মাহমুদ (অতিরিক্ত সচিব) স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।

প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রোববার (২৯ মার্চ) সকালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আগারগাঁওস্থ প্রধান কার্যালয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বিরাজমান পরিস্থিতিতে জনগণের সুরক্ষা বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের লক্ষ্যে জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। সভায় সভাপতিত্ব করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি আনিস মাহমুদ। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নূরুল ইসলাম।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা বিষয়ে আলেমরা তাদের মতামতে বলেন-

এক. তওবা-ইস্তেগফার ও দোয়া
পৃথিবীতে যা কিছু হয় আল্লাহতায়ালার হুকুমে হয়, আবার তার হুকুমেই নিরাময় হয়। এ বিশ্বাস সব মুমিনের রাখা। চলমান মহামারি থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে। সেই সঙ্গে সবার অপরিহার্য কর্তব্য হলো- সব ধরনের গোনাহ হতে বিরত থেকে তওবা-ইস্তিগফার করা এবং নিম্নে দোয়াগুলো সর্বদা পড়তে থাকা-

بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

উচ্চারণ: বিসমিল্লাহিল্লাজি লা ইয়াদুররু মাআসমিহি শাইউন ফিল আরদি ওয়ালা ফিছছামায়ি ওয়া হুয়াস সামিয়ুল আলিম।

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ، وَالْجُنُونِ، وَالْجُذَامِ، وَمِنْ سَيِّئِ الأَسْقَامِ

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাছি ওয়াল জুনুনি ওয়াল জুযামি ওয়ামিন সায়্যিইল আসকাম।

لَّاۤ إِلَـٰهَ إِلَّاۤ أَنتَ سُبۡحَـٰنَكَ إِنِّی كُنتُ مِنَ ٱلظَّـٰلِمِینَ

উচ্চারণ: লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।

দুই. সতর্কতা অবলম্বন
রোগ ও ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য সতর্কতা অবলম্বন ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সতর্কতা অবলম্বন তাওয়াক্কুল পরিপন্থী নয়। বরং এটা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলালাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত।

তিন. মসজিদ সংক্রান্ত
মসজিদে নিয়মিত আজান, ইকামত, জামাত ও জুমার নামাজ অব্যাহত থাকবে। তবে জুমা ও জামাতে মুসল্লিদেরর অংশগ্রহণ সীমিত থাকবে অর্থাৎ নিম্নলিখিত ব্যক্তিরা জুমা ও জামাতে অংশগ্রহণ করবেন না-
১. যারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত,
২. যাদের সর্দি, জ্বর, কাশি, গলা ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট আছে,
৩. যারা আক্রান্ত দেশ ও অঞ্চল থেকে এসেছেন,
৪. যারা উক্তরূপ মানুষের সংস্পর্শে গিয়েছেন,
৫. যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত,
৬. বয়োঃবৃদ্ধ, দুর্বল, মহিলা ও শিশু
৭. যারা অসুস্থদের সেবায় নিয়োজিত ও
৮. যারা মসজিদে গিয়ে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করেন তাদেরও মসজিদে না আসার অবকাশ রয়েছে।

যারা জুমা ও জামাতে অংশ নেবেন, তারা যাবতীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন। অজু করে নিজ নিজ ঘরে সুন্নত ও নফল আদায় করবেন। শুধু জামাতের সময় মসজিদে যাবেন এবং ফরজ নামাজ শেষে দ্রুত ঘরে চলে আসবেন। সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোয়া, মাস্ক পড়া, জীবাণুনাশক দ্বারা মসজিদ ও ঘরের মেঝে পরিস্কার রাখাসহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সকল নির্দেশনা মেনে চলবেন। হঠাৎ হাঁচি-কাশি এসে গেলে টিস্যু বা বাহু দিয়ে মুখ ঢেকে রাখবেন।

চার. মসজিদের ইমাম-খতিব-মুয়াজ্জিন ও পরিচালনা কমিটির করণীয়
১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পূর্বে সম্পূর্ণ মসজিদ জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা এবং কার্পেট-কাপড় সরিয়ে ফেলা।
২. জামাত সংক্ষিপ্ত করা,
৩. জুমার বয়ান, খুতবা ও দোয়া সংক্ষিপ্ত কর,
৪. বর্তমান সংকটকালে দরসে হাদিস, তাফসির ও তালিম স্থগিত রাখা,
৫. অজুখানায় পর্যাপ্ত সাবান ও টিস্যু রাখা,
৬. বর্তমান পরিস্থিতিতে জামাতের কাতারে ফাঁক ফাঁক হয়ে দাঁড়ানো,
৭. ইশরাক-আওয়াবিন, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির ও অন্যান্য আমল ঘরে করা ও
৮. ঢাকাসহ দেশের কোনো মসজিদে যদি কোনো বিদেশি মেহমান থাকেন তাদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

পাঁচ. করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফন ও জানাজা
হাদিসের বর্ণানুযায়ী মহামারিতে মৃত মুমিন ব্যক্তি শহীদের মর্যাদা লাভ করেন। করোনায় মৃত ব্যক্তির কাফন, জানাজা ও দাফন যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে করা জরুরি। করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফনে সহযোগিতা করুন। তাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ বা কোনোরূপ অসহযোগিতা করা শরিয়তবিরোধী ও অমানবিক।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয়ে বৈঠকে দেশের শীর্ষ আলেমরা, ছবি: বার্তা২৪.কম
ছয়. দান-সদকা
হাদিস শরিফে আছে দান-সদকা দ্বারা বালা-মসিবত দূর হয়। এই সংকটকালীন সময়ে আল্লাহর রহমত লাভের উদ্দেশ্যে দুস্থ ও অসহায়দের বেশি বেশি দান-সদকা করুন। নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে খাদ্যপণ্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

সাত. গুজব সৃষ্টি না করা
এ সমস্ত বিষয়ে গুজব মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই গুজব সৃষ্টি করা বা গুজবে বিশ্বাস করা সর্বোতোভাবে বর্জন নিশ্চিত করতে হবে।

আট. প্রচার-প্রচারণা
আলেমদের এ আহ্বান আন্তরিকতার সঙ্গে ব্যাপক প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য দেশের সব মসজিদের ইমাম-খতিব, মসজিদ কমিটি, গণমাধ্যম, জনপ্রতিনিধি, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী-শিক্ষকসহ সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়।

বৈঠকে করোনাভাইরাসের এই সংকটকালে শরিয়তের দিক-নির্দেশনা চেয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের পরামর্শ গ্রহণ করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আলেমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানান।

সভায় উপস্থিত ছিলেন- কিশোরগঞ্জ শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম আল্লামা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ, মিরপুর আকবর কমপ্লেক্সের মুহতামিম মুফতি দিলাওয়ার হোসাইন, শায়খ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতি মীযানুর রহমান সাঈদ, জাতীয় মুফতি বোর্ডের সদস্য সচিব মুফতি মো. নূরুল আমীন, ঢাকা নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ড. আল্লামা কাফীলুদ্দীন সরকার সালেহী, জামেয়া রাহমানিয়ার মুহতামিম মাওলানা মাহফুজুল হক, চরমোনাই কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা সৈয়দ মো. মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, মদীনাতুল উলুম কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক আল আযহারী, আফতাবনগর মাদ্রাসার মুহতামিম মুফতি মোহাম্মদ আলী, দারুল উলূম রামপুরার মুহতামিম মুফতি ইয়াহ্ইয়া মাহমুদ, জামিয়াতুল উলুমের মুহতামিম মুফতি মাহমুদুল হাসান, ঢালকানগর মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা জাফর আহমাদ, ঢাকা আলিয়ার উপাধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ, মহাখালী হোসাইনিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম আল মারুফ, নারায়ণগঞ্জ ভূমিপল্লী আবাসন জামে মসজিদের খতিব শায়খ আহমাদুল্লাহ, তেজগাঁও জামেয়া ইসলামিয়ার শায়খুল হাদিস ড. মাওলানা মুশতাক আহমদ, বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম মাওলানা মিজানুর রহমান, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফতি মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, মুহাদ্দিস মুফতি ওয়ালিয়ুর রহমান খান ও মুফাসসির ড. মাওলানা আবু ছালেহ পাটোয়ারী, বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি মুহিব্বুল্লাহিল বাকী নদভী, পেশ ইমাম মাওলানা মুহিউদ্দীন কাসেম, চকবাজার শাহী মসজিদের খতিব মাওলানা মুহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন, বড় কাটরা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতি সাইফুল ইসলাম মাদানী, শামসুল উলূম মাদ্রাসার মুহতামিম মুফতি শারাফাত হোসাইন, মাদানীনগর মাদ্রাসার মুহতামিম মুফতি ফয়জুল্লাহ এবং উস্তাদ মুফতি মাহবুবুর রহমান অংশগ্রহণ করেন।

এছাড়া হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফী, পটিয়া মাদরাসার আল্লামা আবদুল হালিম বোখারি, গওহরডাঙ্গা মাদরাসার শিক্ষা সচিব মুফতি নুরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম নানুপুর মাদরাসার মুহতামিম মুফতি মুহাম্মদ সালাহ উদ্দীন, সিলেট দরগাহ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুহিব্বুল হক, চট্টগ্রাম জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের খতিব মাওলানা সৈয়দ আবু তালেব মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়ার প্রিন্সিপাল আল্লামা সৈয়দ অছিউর রহমান ও জামিয়া ইউনুছিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুহতামিম মুফতি মোবারকুল্লাহসহ অন্য আলেমদের কাছ থেকে ই-মেইলে মতামত গ্রহণ করা হয়।

-এ

আগের সংবাদশ্বাসকষ্টে ৩ জনের মৃত্যু, তিন জেলায় ৭০ বাড়ি লকডাউন
পরবর্তি সংবাদপিপিই সংকটে জিম্বাবুয়ের ডাক্তার ও নার্সদের কর্মবিরতি