ইসলামি তুরাস পাঠের রূপরেখা

মূল: ডা. ত্বোহা আব্দুর রহমান
অনুবাদ: খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ

প্রথমে সংজ্ঞার্থ নির্ণয়ের জন্য ইসলামি তুরাসের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরব। যাতে তুরাসের সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়াটা বিকশিত হয় স্বতঃসিদ্ধ স্বাভাবিকতায়। ইসলামি তুরাস বা ঐতিহ্য মূলত নির্দিষ্ট অনুষঙ্গ এবং কিছু ভাষিক ও ধর্মাচরণীয় উপকরণের সমষ্টিগত রূপকে নির্দেশ করে, যা ইসলামি সভ্যতার অস্তিত্বকে নির্ধারণ ও মেরুকরণ করে। সেটা মৌলিক টেক্সট (নস) হতে পারে অথবা আনুষঙ্গিক (ইজতিহাদ) মুক্ত-গবেষণাও হতে পারে , লিখিত উদ্ধৃতি (নস) হতে পারে আবার ভাষিক উচ্চারণও হতে পারে , বাহ্যিক ধর্মাচরণ হতে পারে আবার আধ্যাত্মিক আচরণও হতে পারে, একক হতে পারে আবার সামষ্টিকও হতে পারে।

‘ইসলামি ঐতিহ্য’র বোঝাপড়ায় আমি প্রচুর শ্রম দিয়েছি , যা অন্য প্রসঙ্গে দেইনি কখনও। কারণ আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম, তুরাসের উপর নির্ভরতা ছাড়া আমাদের নিজস্ব পরিচিতি সম্ভব না। পাশাপাশি তুরাস-কেন্দ্রীক কিছু মতাদর্শ দৃষ্টিগোচর হয়েছিল, যা অন্যদের জন্য যেমন উপযোগী ছিল না , নিজেরাও প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করতে পারছিলাম না। পুরোপুরি কিংবা আংশিকভাবে নিশ্চুপে, নির্লিপ্তে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলাম। আমার এই নির্মোহ প্রচেষ্টা বিফলে যায়নি, এটি পরবর্তীতে তুরাসকে বিনির্মাণের প্রতি আমাকে উৎসাহিত করেছে। অবশেষে আমি পূর্ণোদ্যমে ইসলামি ঐতিহ্যের মশহুর চিন্তা ও গবেষণার পাঠোদ্ধারে নিমগ্ন হলাম। বুদ্ধিবৃত্তিক জোরালো অনুষঙ্গ ও গবেষণা-পদ্ধতির পোক্ত রীতিনীতির মধ্যস্থতায় এবং যুক্তিসঙ্গত-শর্ত মোতাবেক আমার তালাশকে জারি রাখলাম। ইসলামি ঐতিহ্যের মশহুর চিন্তা ও গবেষণা তালাশ করার পর ‘তুরাসের’ একটা একক ও মিশ্র বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ল, সেটি হচ্ছে—” (মাসলাক) পথ-পদ্ধতি ও উদ্দেশ্যগত (মাকসাদ) ভিন্নতা সত্ত্বেও তুরাসের প্রায় সকল চিন্তা-ই ইসলামি জ্ঞানতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের মধ্যে স্তরভিত্তিক বিভাজন সৃষ্টির প্রস্তাব দিচ্ছে।” আমি এই মিশ্র ও একক বৈশিষ্ট্যের নাম দিয়েছি ‘তুরাসের বিভাজন-তত্ত্ব’ (তাজযিইয়্যাহ)। এবং যখন তুরাসের সেসব গবেষক ও চিন্তকদের উপর বিভাজন-তত্ত্বের বিরাট প্রভাব লক্ষ্য করলাম, আমি তখন তুরাসের বিভাজনীয় ভাবধারার পেছনে প্রভাববিস্তারকারী কারণগুলোর সন্ধানে নামলাম। অবশেষে এই প্রভাবের পেছনে তিনটি মৌলিক সূত্র আবিষ্কার করলাম, যেগুলো বিশুদ্ধ চিন্তার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ক. ইস্তেনবাতের শর্ত ভঙ্গ

প্রথমত উদ্ভাবন বাধাগ্রস্থ হয়েছে বর্ণনা, বিবরণ কিংবা বিনির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তুরাসকে এমনভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে, যেখানে স্বয়ং তুরাসের প্রতিষ্ঠিত উসুল ও রীতিনীতিকেই বর্জন করা হয়। শুধু তাই না, বরং উসুল ও নীতিমালার শাখাগত (ফুরুঈ) বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে ভিন্ন একটি অনৈসলামিক -প্রাচীন বা আধুনিক- ঐতিহ্য থেকে নকল করা হয়। অথচ তারা জানে যে, বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার জন্য নিজস্ব মানহাজ ও রূপরেখা জরুরি। আর নিজস্ব মানহাজের জন্য জরুরি শর্ত হচ্ছে, অন্যদের পদ্ধতি নকল করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে নিজস্ব উদ্ভাবন-ক্ষমতা অর্জন করা।

খ . প্রগতিশীলতার শর্ত ভঙ্গ

ইসলামি ঐতিহ্য পাঠে প্রচলিত যে পদ্ধতি চালু আছে , সেখানে শাখাগত উসুল ও নীতিমালাকে উপেক্ষা করে, নিছকই তুরাসের বিবরণ ও দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এটি পদ্ধতিগত পন্থা নয় , এখানে বরং জরুরি হল, সর্বপ্রথম উসুল ও উপকরণের প্রতি জোর দেওয়া। বিশেষত উসুল কেন্দ্রীক চিন্তা ও গবেষণাকে গতিশীল করা। হাল-আমলে যারা উসুল কেন্দ্রীক চিন্তা ও গবেষণা করছে বলে দাবি করেন , তারাও পূর্বসূরীদের উসুল সংশ্লিষ্ট কথাবার্তার মধ্যেই সীমিত থাকছেন। দিনশেষে তাদের প্রয়াসও বিবরণ-কেন্দ্রীক হয়ে যাচ্ছে, উসুল কেন্দ্রীক চিন্তা নির্মাণ আর হচ্ছে না।

গ . যোগসূত্র নির্মাণের শর্ত ভঙ্গ

ইসলামি ঐতিহ্য গঠন করতে যেয়ে প্রায়ই অনৈসলামিক ট্র্যাডিশনের ‘অনূদিত পদ্ধতি’কে কোন ধরনের পূর্ব-মূল্যায়ন ও আদর্শিক শুদ্ধি ছাড়া প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। অথচ প্রতিস্থাপনের পূর্বে উচিত ছিল, নিজস্ব ঐতিহ্যিক গঠনের সঙ্গে ‘অনূদিত পদ্ধতির’ সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের দিকসমূহ নিয়ে অনুসন্ধান করা। উভয় পদ্ধতির মাঝে কতিপয় সামঞ্জস্য পেয়ে গেলে পরবর্তীতে আরও গভীরে প্রবেশ করা এবং প্রতিটি স্তরের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সামঞ্জস্য বের করা। পাশাপাশি উভয় পদ্ধতির মোকাবিলা ও পর্যালোচনার নানামুখী চাহিদার প্রতি খেয়াল রাখা। নিরীক্ষণ ও পর্যালোচনার পর সেই অনূদিত পদ্ধতির শুদ্ধি হাসিল হয়ে গেলে, ইসলামি তুরাসে এটি প্রতিস্থাপিত হলে কতটুকু ফলাফল আসবে , তা সন্ধান করা। কেননা কখনও কখনও পদ্ধতি শুদ্ধ হলেও ফলাফল কম হবার কারণে তা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না।

মোটামুটি স্পষ্ট হল যে, তুরাসের ‘বিভাজন-তত্ত্ব’ উপরোক্ত তিন ধরনের সমস্যার সূত্র ধরেই উৎসারিত হয়েছে, সুতরাং ইসলামি তুরাস-পাঠের সময় আমরা যথাসম্ভব এই তিনটি পদ্ধতিগত সংকট থেকে বিরত থাকব। সংকটগুলো থেকে মুক্ত হতে পারলে, ইসলামি তুরাস-পাঠের ক্ষেত্রে ‘বিভাজন-তত্ত্বে’র বদলে আমরা ‘সামগ্রিক নীতি’ অনুসরণ ও প্রয়োগ করতে পারব। আংশিক নীতির স্থানে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণ জারি রাখতে সক্ষম হব। এবং সমস্যা ও সংকট থেকে উত্তরণের পর তুরাসের যে রূপরেখা হাজির হবে, সেটাকেই আমি বলি ‘তুরাসের সামগ্রিক ও পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণ ‘। এই সংক্রান্ত আলোচনা আমি সবিস্তারে বর্ণনা করেছি আমার “তাজদিদুল মানহাজ ফি তাকয়িমিত তুরাস” গ্রন্থে। আমি এখানে সামগ্রিক ও পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণের নীতিমালা বর্ণনা করব। অবশ্য আমরা এতক্ষণে বুঝে ফেলেছি, পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণের জন্য পূর্বের তিনটি সংকট থেকে উত্তীর্ণ হয়ে শর্তগুলি পূরণ করা জরুরি—প্রথমত, (ইস্তেনবাত) উদ্ভাবনের শর্ত। দ্বিতীয়ত, (তাকাদ্দুম) প্রগতিশীলতার শর্ত। তৃতীয়ত, (মুনাসাবা) যোগসূত্র নির্মাণের শর্ত। সামনে প্রত্যেকটা শর্তকে আমি সবিস্তারে বর্ণনা করব।

১ . তাদাউল-নীতি

ইস্তেনবাতের শর্ত সংক্রান্ত আলাপে আমি বলেছি , ইসলামি তুরাসের বিশেষ বিশেষ উসুল ও নীতিমালার উপর নির্ভর করে বিনির্মাণের কাঠামো তৈরি করতে হবে। ভিন্ন ট্র্র্যাডিশনকে অনুকরণের বদলে আমরা যদি তুরাসের নিজস্ব ফর্মুলা ও অবকাঠামো নির্মাণে মনোনিবেশ করি, তাহলে প্রথমেই একটি ব্যতিক্রমী নীতির সন্ধান পাই। সেটি হচ্ছে, তাদাউল-নীতি। তাদাউল-নীতির দাবি হচ্ছে, আকিদা, ভাষা ও জ্ঞানবিজ্ঞান – তুরাসের এই তিনটি তমুদ্দুনিক অনুষঙ্গ তখনই ঐতিহ্যিক হয়ে উঠবে, যখন এগুলো স্বার্থপরতাকে ছাপিয়ে পরোপকার এবং পরহিতসাধনের চাহিদা মোতাবেক পরিচালিত হবে। ইহ-জাগতিক কল্যাণকামিতার সঙ্গে সঙ্গে পারলৌকিক কল্যাণকেও শামিল করবে। সুতরাং, সংক্ষেপে বললে তাদাউল-নীতি হচ্ছে, পরোপকার এবং পারলৌকিক কল্যাণে কাজ করা। আর পরোপকার ও পারলৌকিক কল্যাণের সিলসিলা যেহেতু আকিদা, ভাষা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত, ফলে তাদাউল-নীতিও তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এবং প্রত্যেকটা স্তম্ভ নিজস্ব বলয়ের দ্বারা বিশিষ্ট হয়ে আছে। এই তিনটি স্তম্ভ ও বলয় হচ্ছে —ক. আকিদাচর্চা খ . ভাষাচর্চা গ. জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা। আমরা প্রত্যেকটা স্তম্ভ এবং সংশ্লিষ্ট উসুল ও নীতিমালা নিয়ে আলাপ করব।

১. ১. আকিদাচর্চা

আকিদাচর্চায় যখন ‘কথা ও কাজে’র মিল তৈরি হবে, তখনই এটি পরোপকার ও পারলৌকিক কল্যাণের সিলসিলা মোতাবেক হবে। অথবা বলা যায়, তাদাউল-নীতি অনুসারে আকিদাচর্চার স্বার্থক প্রতিধ্বনি উচ্চারিত হয় কেবল তখনই, যখন কথার প্রভাব ব্যক্তিগত আচার-ব্যবহারে প্রতিফলিত হতে থাকে। আকিদাচর্চার শৃঙ্খলায় তিনটি নীতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রথমত, খোদায়ী প্রত্যাদেশ হিসেবে ‘শরিয়তে’র শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেওয়া। দ্বিতীয়ত, পূর্ণাঙ্গ তাওহিদকে শরিয়তের অন্যতম প্রসঙ্গ হিসেবে স্বীকার করা। তৃতীয়ত, জগতে আল্লাহর ইচ্ছাশক্তির প্রায়োগিকতা মেনে নেওয়া।

১. ২. ভাষাচর্চা

তাদাউল-নীতি অনুসারে ভাষাচর্চা ষোলকলা পূর্ণ হতে হলে একজন লেখক কিংবা বক্তাকে, সম্বোধিত ব্যক্তির উপকারিতার জন্য সুনির্দিষ্ট কানুন এবং যৌথ-প্রযোজিত জ্ঞানকাঠামোর উপর নির্ভর করতে হবে। ফলত তাদাউল-নীতির ভাষাচর্চা হচ্ছে, অপরপক্ষকে তার নিজস্ব উসুল ও পদ্ধতি মোতাবেক সম্বোধনের নাম। ভাষাচর্চা তিনটি ধারাকে জরুরি মনে করে। প্রথমত, কুরআনি মুজেজার দাবি অনুসারে আরবির শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেওয়া। দ্বিতীয়ত, প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে আরবীয় রীতিনীতির অনুসরণ। তৃতীয়ত, চিন্তা ও মনোভাব প্রকাশের বেলায় বাক্য-সংক্ষেপায়নের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া।

১.৩. জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা

তাদাউল-নীতি অনুসারে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাকসাদ হচ্ছে, জ্ঞানচর্চার সঙ্গে কর্মের (আমল) সম্পর্ক থাকা। কর্মের প্রণোদনা যাতে জ্ঞানচর্চার প্রতি অস্থির করে তোলে। এবং জ্ঞানের বিস্তৃতি কর্মে গতি ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ফলত তাদাউল-নীতির জ্ঞানচর্চা হচ্ছে, চিন্তার উপর (আমল) কর্মের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করা। এটির পাটাতনেও তিনটি ধারণা বিদ্যমান। প্রথমত, ইসলামি জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেওয়া। দ্বিতীয়ত, তাত্ত্বিক বুদ্ধিকে ক্রিয়াশীল বুদ্ধির নির্ভরতায় লালিত-পালিত করা। তৃতীয়ত, প্রত্যক্ষবাদি (positivist) দৃষ্টিভঙ্গিকে শরঈ দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল করা।

আমরা এখন দ্বিতীয় ঐতিহ্যিক মূলনীতির প্রতি মনোযোগী হব, যার শৃঙ্খলার অভাবে ইসলামি তুরাসে ‘বিভাজন-তত্ত্ব’র আবির্ভাব ঘটেছে। এটিকে আমরা স্বতঃসিদ্ধ শৃঙ্খলায় সাজিয়ে গুছিয়ে তুরাসের ‘পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণ’ নীতিতে পরিণত করব। সেই দ্বিতীয় নীতি ‘প্রগতিশীলতার শর্ত’কে ‘তাদাখুল-নীতি’ নামে ব্যক্ত করব।

২ . তাদাখুল-নীতি

প্রগতিশীলতার শর্ত সংক্রান্ত আলাপে বলে এসেছি , তুরাসের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিবরণের উপর উসুলকে অগ্রবর্তী করতে হবে। বিবরণ-কেন্দ্রীক আলাপের চেয়ে উসুলি আলাপকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এই শর্ত মোতাবেক আমল জারি রাখলে আমরা ইসলামি তুরাসের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ‘তাদাখুল-নীতি’ পর্যন্ত পৌঁছতে পারব। তাদাখুল-নীতির দাবি হচ্ছে, তুরাস সংশ্লিষ্ট নানামুখী জ্ঞান-বিজ্ঞান তার উসুল ও নীতিমালা সহযোগে একটি সামগ্রিক ইসলামি ঐতিহ্য গঠনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া। এবং সব ধরনের বিভাজন, খারিজি ও রৈখিক নীতি পরিহার করে তুরাসের বিভিন্নমুখী জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিধিকে জমা করা। ‘তাদাখুল-নীতি’ জ্ঞানতাত্ত্বিক তুরাসের দুটি ধারার সাথে সম্পৃক্ত। প্রথমত , মৌলিক জ্ঞান-কাঠামো (যেমন , হাদিস, তাফসির, ফিকহ, কালাম , তাসাউফ ইত্যাদি …)। দ্বিতীয়ত, অনূদিত জ্ঞানকাঠামো (যেমন , যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, অংকশাস্ত্র , জ্যোতির্বিদ্যা , চিকিৎসা বিজ্ঞান ইত্যাদি)। তুরাসের জ্ঞানতাত্ত্বিক এ ধারা দুটির মধ্যে বিচিত্র সম্পর্ক রয়েছে; যেগুলো বহুমাত্রিক রুপ পরিগ্রহ করে। আবার প্রতিটি সম্পর্কের নির্দিষ্ট অথচ ভিন্ন ভিন্ন গতি ও প্রবণতা আছে।

যেমন ধরেন, এখানে মৌলিক জ্ঞানকাঠামোর ভেতর পারষ্পরিক সম্পর্ক আছে, এবং সে সম্পর্কগুলো প্রতিসরণায়মান। ফলত একটা মৌলিক জ্ঞান যখন অপর এক মৌলিক জ্ঞানের মধ্যে দাখিল হয়, তখন নতুন এক মৌলিক জ্ঞানের সৃষ্টি করে। অন্যদিকে মৌলিক জ্ঞানের সাথে অনূদিত জ্ঞানেরও বহুমাত্রিক সম্পর্ক আছে, কিন্তু সেগুলোর প্রতিসরণ ও প্রতিবিম্ব সৃষ্টির সক্ষমতা নেই। সুতরাং একটি অনূদিত জ্ঞান একটি মৌলিক জ্ঞানের ভেতর প্রবেশ করলে , ভিন্ন একটি মৌলিক জ্ঞানের জন্ম দিবে। আর যখন মৌলিক জ্ঞান অনূদিত জ্ঞানের মধ্যে দাখিল হবে তখন একটি অনূদিত জ্ঞান তৈরি করবে। তাহলে আমরা এখানে দুই ধরনের প্রবেশ ও সম্পৃক্ততা পাচ্ছি—প্রথমত, মৌলিক জ্ঞানের মধ্যে অনূদিত জ্ঞানের প্রবেশ। দ্বিতীয়ত, অনূদিত জ্ঞানের ভেতর মৌলিক জ্ঞানের প্রবেশ। তাদাউল-নীতির মতো তাদাখুল-নীতির মধ্যেও তিনটি ভিত্তি ও স্তম্ভ আছে— ক. অভ্যন্তরীণ মিথস্ক্রিয়া খ. বহির্ভাগীয় নিকটতম মিথস্ক্রিয়া গ . বহির্ভাগীয় দূরতম মিথস্ক্রিয়া। সামনে মেছাল দিয়ে দিয়ে প্রত্যেকটা ভিত্তিকে বিশ্লেষণ করব।

২.১ . অভ্যন্তরীণ মিথস্ক্রিয়ার প্রকৃতি

অভ্যন্তরীণ (তাদাখুল) মিথস্ক্রিয়ার দাবি হচ্ছে, যখন মৌলিক জ্ঞানসমূহের (হাদিস, তাফসির, ফিকহ, কালাম, তাসাউফ ইত্যাদির) পারষ্পরিক মিথস্ক্রিয়া ঘটবে, তখন (নাযারি) তাত্ত্বিক না বরং ব্যবহারিক (আমালি) জ্ঞানগুলোর কর্তৃত্ব জারি হবে, যদি বিপরীতমুখী কোন সূচক না থাকে। আরও সুস্পষ্ট করে বললে বলা যায়, মৌলিক তাত্ত্বিক জ্ঞান যদি একটি ব্যবহারিক মৌলিক জ্ঞানের মিথস্ক্রিয়ায় চলে আসে, তবে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারিক জ্ঞানের শর্ত মেনে চলতে হবে। আর উল্টোটা ঘটলে ব্যবহারিক জ্ঞানের জন্য তাত্ত্বিক জ্ঞানের নীতিমালা মেনে চলা জরুরি না, আবশ্যিক দলিল ছাড়া। ব্যবহারিক জ্ঞান তখন নিজস্ব শর্ত-ই মেনে চলবে। অভ্যন্তরীণ মিথস্ক্রিয়ার সবচে বড় নমুনা হচ্ছে, ইলমুল উসুল এবং ইলমুল আখলাকের (নীতিশাস্ত্র) সমন্বিত প্রয়াসে ‘মাকাসিদ শাস্ত্রে’র বিকশিত হবার ঘটনা। অদ্যাবধি মাকাসিদ শাস্ত্র তিন ধরনের তত্ত্বকে শামিল করেছে— প্রথমত, বিধেয়-তত্ত্ব ; এটি বাক্যের বিধেয়কে -ভাবগত ও স্বভাবগত- দুটো নৈতিক গুণসহ শামিল করে। দ্বিতীয়ত, কসদ-তত্ত্ব অনুভবের দৃশ্যায়নের সাথে সাথে -ঐচ্ছিক ও বিমূর্ত- দুই ধরনের নৈতিক গুণসহ সম্পৃক্ত হয়। তৃতীয়ত, মূল্যবোধ সম্পৃক্ত তত্ত্ব যা -নীতিগত ও কল্যাণী- দুটো নৈতিক গুণাগুণের সংযোগে নির্মিত। আদতে নীতিশাস্ত্র যখন ইলমুল উসুলের মিথস্ক্রিয়ায় এসেছে, তখন উসুলকে বস্তুনিরপেক্ষীয় বলয় থেকে বের করে এনেছে। যেমন , প্রথমদিকে উসুলশাস্ত্রের রূপ ও প্রবাহে (আততা’লিলুস সাবাবি) ‘কারণঘটিত ব্যাখ্যা’ই মূখ্য ছিল। মদ নিষিদ্ধতার পেছনে কারণ হিসেবে বিবেচিত ছিল মাতলামি বা ঘোরমত্ততা। কিন্তু পরবর্তীতে মাকাসিদ শাস্ত্রের সাথে মিথস্ক্রিয়ার ফলে নতুন একটি ব্যাখ্যাধারা যুক্ত হল, যাকে বলা হয় ‘বিধেয়ঘটিত ব্যাখ্যা’ ; এবং কারণঘটিত ব্যাখ্যাকে নতুন ব্যাখ্যাধারার উপর নির্ভরশীল করা হল। এই অর্থে যে, (সবব) কারণ (হুকুম) বিধান আবশ্যিক করার ক্ষেত্রে বিধেয়ের উপর নির্ভরশীল। যেমন, মানুষের মেধা ও বুদ্ধির হেফাজতের জন্যই মাদকতাকে নেশাদ্রব্যের নিষিদ্ধতার (সবব) কারণ বানানো হয়েছে। উসুলবিদদের নিকট (মুনাসাবা) যোগসূত্র নির্মাণের ধারণা বলতে বিধেয়-ঘটিত ব্যাখ্যাকেই নির্দেশ করা হয়।

২.২. বহির্ভাগীয় নিকটতম মিথস্ক্রিয়া

নবনির্মাণের লক্ষ্যে অনূদিত জ্ঞান যখন মৌলিক জ্ঞানকাঠামোতে দাখিল হবে , সেটিকে বলছি বহির্ভাগীয় নিকটতম মিথস্ক্রিয়া। মৌলিক জ্ঞান-কাঠামোর ভেতর অনূদিত জ্ঞানের পুরোটা দাখিল হওয়া জরুরি না। বরং নির্দিষ্ট কিছু অনুষঙ্গ, বিবরণ, ধারণা ও উদ্দেশ্যের মিথস্ক্রিয়াই যথেষ্ট। পাশাপাশি এটাও জরুরি না যে, একটা মৌলিক জ্ঞানশাখায় কেবল একটা অনূদিত জ্ঞানের মিথস্ক্রিয়াই ঘটবে। প্রকৃত প্রস্তাবে একটি মৌলিক জ্ঞানশাখায় অনূদিত জ্ঞানের কতিপয় অধ্যায়, পরিচ্ছেদ, ধারণা ও উদ্দেশ্যের মতো একক-ক্ষুদ্র বিষয়ও দাখিল হতে পারে। গ্রীক-দর্শনের কতিপয় অনুষঙ্গ ইলমে কালামের শাস্ত্রীয় আলাপে স্থানদখল করে নেওয়ার ঘটনাই ‘বহির্ভাগীয় নিকটতম মিথস্ক্রিয়া’র উত্তম মেছাল। যেমন, ঐশিতত্ত্বের (জাওহার ও আরজ) মূল ও প্রকাশ , যুক্তিবিদ্যার ‘দলিল’ , পদার্থবিদ্যার ‘অণু-পরমাণু ও গতিময়তা’ (যাররাহ – হারাকাহ) একসময় ইলমে কালামের বলয়ে প্রবেশ করেছিল। ইলমে কালামের সাথে গ্রীক-দর্শনের মিথস্ক্রিয়ার একটা গতিপথ তৈরি হয়েছিল, যার ফলে অনূদিত জ্ঞানের স্বভাব-প্রকৃতিকে মৌলিক জ্ঞানের রুচিপ্রকৃতিতে বদলে দিয়ে একটি নবধারা তৈরি সম্ভব হয়েছিল।

২.৩. বহির্ভাগীয় দূরতম মিথস্ক্রিয়া

পূর্ণতাদানের তাগিদে মৌলিক জ্ঞান-কাঠামো যখন অনূদিত জ্ঞানকাঠামোতে প্রবেশ করে, তাকে আমরা বলছি ‘বহির্ভাগীয় দূরতম মিথস্ক্রিয়া’। পূর্বের মতো এখানেও মৌলিক জ্ঞানের পুরোটা দাখিল হওয়া জরুরি না। বরং অংশবিশেষের মিথস্ক্রিয়াই যথেষ্ট। এটির অতিউত্তম মেছাল হতে পারে, ঐশতত্ত্বে ইলমে কালামের প্রবেশ। ঐশতত্ত্বে প্রমাণ ও জিজ্ঞাসার কালামীয় রীতিনীতির অস্তিত্বকে আমরা ‘বহির্ভাগীয় দূরতম মিথস্ক্রিয়া’র প্রভাব হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। সবশেষে আমরা তৃতীয় ঐতিহ্যিক নীতি , যেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণে ‘বিভাজন-তত্ত্বে’র প্রকাশ ঘটেছে তা নিয়ে আলাপ করব। এবং বিভাজন-তত্ত্বের স্থলে কিভাবে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণ সম্ভবপর হয়ে উঠে , তা পরিষ্কার করব।

৩ . তাকরিব-নীতি

অনূদিত জ্ঞানকাঠামোর কোন অনুষঙ্গকে মৌলিক জ্ঞানে ব্যবহার করতে চাইলে, মৌলিক জ্ঞান-কাঠামোর কিছু গতিপ্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। এটিই তাকরিব-নীতি ; এর দাবি হচ্ছে, জিজ্ঞাসা কিংবা প্রমাণ যেকোন ক্ষেত্রে অনূদিত জ্ঞান যদি প্রভাব ফলাতে চায়, তাকে অবশ্যই তুরাসের চাহিদার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। সে চাহিদা আকিদা সংশ্লিষ্ট হোক, কিংবা হোক ভাষা ও জ্ঞানবিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট। চাহিদামাফিক হবার অন্যতম শর্ত হচ্ছে, বৈসাদৃশ্য পরিহার করে তুরাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ গুণাবলী গ্রহণ করা। যেহেতু উভয় জ্ঞানকাঠামোর মেলবন্ধন তিন ধরনের চর্চার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, ফলত তাকরিব-নীতির ভিত্তি হবে তিনটি। প্রথমত, আকিদাচর্চা। দ্বিতীয়ত, ভাষার সংক্ষেপায়ন। তৃতীয়ত, জ্ঞানচর্চার সহজীকরণ।

৩. ১. আকিদাচর্চা

অনূদিত জ্ঞানশাস্ত্রকে আকিদার সংশ্লিষ্টতায় নিয়ে আসতে হবে। এটি নিম্নের কোন এক পদ্ধতিতে হতে পারে। প্রথমত, মৌলিক জ্ঞানের বিরোধী হয়, এমন স্বভাব-প্রকৃতি ও চরিত্রকে অনূদিত জ্ঞান থেকে অপসারিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, অনূদিত জ্ঞানকে মৌলিক জ্ঞানের ভাবাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তৃতীয়ত, বিশ্বাসগত ভাবাদর্শের পরিপন্থী হলে অনূদিত জ্ঞানের বাহ্যঅর্থকে সামঞ্জস্যপূর্ণ (তাবিল) ব্যাখ্যা করতে হবে। সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাখ্যা অসম্ভব হলে তাকে বাতিল করতে হবে। নতুবা এটি আকিদা-বিশ্বাসের প্রাণকে হত্যা করবে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, এক্ষেত্রে আমরা ইবনে রুশদের পথ ও পন্থার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছি। এক্ষেত্রে ইবনে রুশদের অবস্থান ছিল ভিন্ন, তিনি মনে করতেন, দর্শনের সাথে যদি শরিয়তের বিরোধ তৈরি হয়, তাহলে শরিয়তের বাহ্যঅর্থকে আরবীয় ব্যাখ্যারীতি অনুসারে তাবিল করতে হবে। ১

অদ্যাবধি অপ্রকাশিত থাকা ইমাম গাযালির ‘আসাসুল কিয়াস’২ গ্রন্থে তিনি যেভাবে যুক্তিবিদ্যার ‘ফিকহি ভিত্তি’ রচনা করেছেন, তা আকিদাচর্চার স্বার্থক মেছাল হতে পারে। প্রসিদ্ধ যুক্তিশাস্ত্রীয় পঞ্চনীতি—আততাআদুল আল আকবার, আল আওসাত ও আল আসগর এবং তালাযুম , তাআনুদ ইত্যাদির অভিমুখ তিনি ঘুরিয়ে দিয়েছেন বিধিবিধানের হেতু বিশ্লেষণধারার দিকে। যেমন—আততামাসসুক বিল উমুম, আলফারক, আননাকদ্ব, ক্বিয়াসুদ্দালালাহ, আসসাবরু ওয়াত তাকসিম ইত্যাদি বিশ্লেষণধারা।

৩. ২. ভাষা সংক্ষেপায়ন

অনূদিত জ্ঞানকে মৌলিক ভাষার নিকটবর্তী করা। এটি সফলভাবে সম্পন্ন হবে যদি অনূদিত-জ্ঞানচর্চার প্রকাশভঙ্গিকে আমরা আরবীয় রীতি অনুসারে পরিচালিত করতে পারি। সংক্ষেপায়ন হচ্ছে আরবীয় প্রকাশভঙ্গির অন্যতম রীতি। কেননা আরবীয় চিন্তক সম্বোধিত সত্তার চতুর্মুখী সক্ষমতা এবং বিচিত্র ও যৌথ জ্ঞানভান্ডারের উপর নির্ভর করে থাকে। ফলে প্রকাশভঙ্গি হিসেবে সে সংক্ষেপায়নের নীতি অবলম্বন করে। অতপর অনূদিত বিষয়ের চর্চা যখন মৌলিক ভাষার প্রকাশভঙ্গি মেনে পরিচালিত হবার প্রক্রিয়া সমাপ্ত করবে, তখন নিশ্চিতভাবেই সম্প্রসারণের ধারা শুরু হবে। আর সম্প্রসারণ যেহেতু শব্দ ও বাক্যের গাঠনিকতা উল্লেখ করা, যা বাক্যের বিধেয় বোঝার ক্ষেত্রে সম্বোধিত সত্তার জন্য অপ্রয়োজনীয় বাড়তি অনুষঙ্গ, তাই এই সম্প্রসারণের ফলে মনস্তাত্ত্বিক নিস্পৃহতা তৈরি হবে, চিন্তা অবসাদগ্রস্থ হয়ে যাবে। ভাষা সংক্ষেপায়নের প্রকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন ইবনে হাজম তাঁর ‘আততাকরিব লি হাদ্দিল মানতিক’ (যুক্তিবিদ্যার সীমা নিকটবর্তীকরণ) কিতাবে। তিনি যুক্তিবিদ্যার সঙ্গে ভাষার আত্মীয়তা তৈরি করেছেন, যুক্তিশাস্ত্রের শব্দগত সংজ্ঞার্থ ও ভাষাতাত্ত্বিক বিধেয়ের মাঝে সমন্বয় ঘটিয়েছেন। পাশাপাশি মশহুর এবং প্রাসঙ্গিক প্রচুর উদাহরণ নিয়ে এসেছেন। ৩

৩.৩. জ্ঞানচর্চা সহজীকরণ

এটিও অনূদিত জ্ঞানকে মৌলিক ভাষার নিকটবর্তী করার একটি প্রকল্প। এটি নিম্নের কোন এক পদ্ধতিতে সম্পন্ন হতে পারে—প্রথমত, অনূদিত ট্র্যাডিশনের জ্ঞানগত ধারণাগুলোকে মৌলিক জ্ঞান-কাঠামোর দাবির সঙ্গে পর্যালোচনা করে। দ্বিতীয়ত, ভূমিকা হিসেবে কিছু আনুষঙ্গিক আলাপ তৈরি করে, উভয় কাঠামোর মধ্যে আত্মীয়তা সৃষ্টি করে। যদি উপরের দুটো পদ্ধতিই অগ্রাহ্য করা হয়, তাহলে দুর্বোধ্যতা তৈরি হবে। অর্থাৎ, ভাব তাৎপর্য ও ধারণাগুলো এমন রূপে চিত্রিত হবে, মৌলিক জ্ঞানের চাহিদা ও দাবির সাথে মিলিয়ে পাঠ করার পর সম্বোধিত ব্যক্তি অজানা শঙ্কায় ভুগবে। এবং অনূদিত জ্ঞানে শুদ্ধিকরণের ব্যর্থ চেষ্টা চালাবে। একসময় দেখা যাবে, ব্যক্তি অনূদিত জ্ঞানের পাল্টা-বয়ান তৈরি করতে গিয়ে না পাচ্ছে অনুরূপ কোনকিছু, না পাচ্ছে বিকল্প। অবশেষে বাহ্যিকতার উপর নিশ্চল বসে থেকে এবং দুর্বোধ্যতা সহকারেই নিজস্ব জ্ঞান-কাঠামো সংরক্ষণ করবার অবিরত চেষ্টা চালাবে।

সহজীকরণের চমৎকার মেছাল তৈরি করেছেন ইবনে তাইমিয়া তাঁর ‘আররদ্দু আলাল মানতিকিইয়্যিন’ কিতাবে। এখানে তিনি (মানতেক) যুক্তিশাস্ত্রীয় প্রমান উপস্থাপনকে (ইস্তেদলাল) সম্প্রসারিত করেছেন। এবং মানতেককে ব্যবহারিক চাহিদা ও শরঈ রীতিনীতির উপর ভিত্তিশীল করেছেন। ৪

পরিশেষে, বিক্ষিপ্ত আলাপের সারকথা হিসেবে মোটাদাগের দুটি কথা বলি— তুরাসের বিভাজনতত্ত্বীয় পাঠে উদ্ভাবন, প্রগতিশীলতা ও যোগসূত্র তৈরির যেই তিনটি শর্তকে ভঙ্গ করা হয়েছে, তা যদি পূর্ণ করা যায়, তাহলে তুরাসের ‘পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণ’ হাসিল হবে। তুরাসের সেই পূর্ণতা তিনটি অবকাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে থাকবে —তাদাউল-নীতি, তাদাখুল-নীতি ও তাকরিব-নীতি। প্রত্যেকটারই আবার তিনটি করে সূত্র আছে। তাদাউল-নীতির সূত্র হচ্ছে—আকিদাচর্চা, ভাষাচর্চা ও জ্ঞানচর্চা। তাদাখুল-নীতির তিন সূত্র— অভ্যন্তরীণ মিথস্ক্রিয়া, বহির্ভাগীয় নিকটতম মিথস্ক্রিয়া ও বহির্ভাগীয় দূরতম মিথস্ক্রিয়া। আর সর্বশেষ তাকরিব-নীতির সূত্র তিনটি হচ্ছে—আকিদাচর্চা, ভাষা সংক্ষেপায়ন ও জ্ঞানের সহজীকরণ।

নয়টি সূত্রসহ তিনটি মৌলিক উসুল সম্পর্কে যখন জানলাম, একথা অবধারিত হয়ে গেল যে, তুরাসের পূর্ণতা ছাড়া জাতিসত্তার পূর্ণতা সম্ভব না। আর স্বকীয় চিন্তাধারা ও পদ্ধতি (মানহাজ) ছাড়া তুরাসের পূর্ণতা অসম্ভব। আমাদের চিন্তাধারার তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে—প্রথমত, (abstract) বস্তুনিরপেক্ষ না। এটি বরং (ইলম) জ্ঞান ও (আমল) কর্মকে সমন্বয় করে। দ্বিতীয়ত, নিছক বিবরণ-কেন্দ্রীক না বরং পর্যালোচনা-নির্ভর। সত্যসন্ধান ও সত্যের উপকারিতায় অংশীদারিত্ত্বকে কামনা করে। তৃতীয়ত, নিছক চিন্তার জন্য চিন্তা করে না। বরং সিদ্ধান্ত দেয়।

তথ্যসূত্র

১ .(ইবনে রুশদ, ফাসলুল মাক্বাল ফি মা বাইনাল হিকমাতি ওয়াশ শরিয়াতি মিনাল ইত্তিসাল , ৩৩ পৃ. , দারুল মাআরিফ কায়রো , ১৯৮৩)

২ . আবু হামিদ গাযালির আসাসুল কিয়াসের অপ্রকাশিত কপি ‘সুলাইমানিয়া’ গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। আলোচ্য টপিক গ্রন্থটির ১৭৮ – ২০১ পৃ. তে আছে। লেখক অপ্রকাশিত থাকাকালীন উদ্ধৃতি দিয়েছেন, পরবর্তীতে ফাহাদ বিন মুহাম্মাদ সাদহান এটি তাহকিক করে ছেপেছেন। প্রথম সংস্করণ ১৯৯৩ সালে রিয়াদের ‘মাকতাবাতুল আবিকান’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। – রমজান মরহুম।

৩ . ইবনে হাজম, আততাকরিব লি হাদ্দিল মানতিক ওয়াল মাদখাল ইলাইহি বিল আলফাযিল আম্মিয়া ওয়াল আমছিলাতিল ফিকহিইয়্যাহ , আল মুআসসিসা আল আরাবিয়া বৈরুত, ১৯৮১। রাসায়েলে ইবনে হাজমের তৃতীয় খণ্ডের একটি অধ্যায়।

৪ . ইবনে তাইমিয়া, আররাদ্দু আলাল মানতিকিইয়্যিন , সাইয়্যেদ সুলাইমান নদভীর ভূমিকাসহ বৈরুতের দারুল মা’রেফা থেকে ছেপে এসেছে।

পরিভাষা

তুরাস – ঐতিহ্য, ট্র্যাডিশন
আন্নাজরিয়াতুত তাকামুলিয়া -সম্পূরক-তত্ত্ব
আন্নাজরিয়াতুত তাজযিইয়্যাহ – বিভাজন-তত্ত্ব
মানহাজ – ধারা , পন্থা
ইস্তেনবাত – উদ্ভাবন
তাকাদ্দুম – প্রগতিশীলতা
মুনাসাবা – যোগসূত্র
তাদাউল – কল্যাণভাব
তাদাখুল – মিথস্ক্রিয়া
আততা’লিলুস সাবাবি – কারণঘটিত
আততা’লিলুল গাইয়্যাহ – বিধেয়ঘটিত
তাজরিদিইয়্যাহ – abstract, বস্তুনিরপেক্ষ, অবাস্তব
ইলমুল ইলাহিয়াত – ঐশিতত্ত্ব
জাওহার ও আরজ – মূল ও প্রকাশ
মানতেক – যুক্তিবিদ্যা
তবিঈয়্যাত – পদার্থবিদ্যা
যাররাহ-হারাকাহ – অণু-পরমাণু ও গতিময়তা
নাযারি – তাত্ত্বিক
আমালি – ব্যবহারিক
সবব – কারণ, cause

আগের সংবাদকওমি মহিলা মাদরাসায় টিকাদান কার্যক্রম শুরু
পরবর্তি সংবাদরাজধানীতে যে কোনো স্থাপনায় সিটি করপোরেশনের অনুমোদন লাগবে