কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড : একটি পর্যালোচনা

আশরাফ উদ্দীন খান

আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষাধারা হচ্ছে দেশের প্রচলিত একটি বিশেষ শিক্ষাধারা, যা ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডে’র মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। বিরাট সংখ্যক মুসলমান শিক্ষার্থী এই শিক্ষাধারার সাথে যুক্ত আছেন। এটা দেশের সরকারী মাদ্রাসা-শিক্ষাব্যবস্থা, যার সুচনা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২৪০ বছর আগে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ১৭৮০ সালে তদানীন্তন বাংলা প্রেসিডেন্সির কলিকাতার শিয়ালদা রেলস্টেশনের পাশে একটি ভাড়া করা বাড়িতে এই মাদ্রাসার সুচনা হয়। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন মোল্লা মাজদুদ্দিন। এই মাদ্রাসা যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এই অঞ্চল ছিল ইংরেজদের অধীনস্ত। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে বাংলা প্রেসিডেন্সির গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের অনুমতি ও পৃষ্ঠপোষকতায় এটা প্রতিষ্ঠিত হয়।

‘বিবর্তন’ জীবন ও জগতের একটি শাশ্বত বিধান। যেকোনো ব্যবস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সাথে বিবর্তন-পরিবর্তন সরাসরি সম্পৃক্ত। বর্তমানে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের মাধ্যমে দেশের এই শিক্ষাধারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। আজকের বিদ্যমান সরকারী মাদ্রাসা-শিক্ষা এই রূপে একদিনে উপনীত হয়নি, বরং এর পেছনে আছে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা, ইতিহাস, সংগ্রাম ও আন্দোলন। কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা যেমন এক সময় এই শিক্ষা ব্যবস্থার অভিভাবক হিসাবে ছিল, তেমনি আজকে এই শিক্ষাব্যবস্থার অভিভাবক হিসাবে আছে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড। ‘কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা’ আর ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড’ এই দুই প্রতিষ্ঠানের মাঝে যেমন স্থানভিত্তিক দূরত্ব রয়েছে, ঠিক তেমনি আছে এই দুই প্রতিষ্ঠানের মাঝে ২০০ বছরের কালিক দূরত্ব, সেই সাথে আছে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক উত্থান-পতন, স্বাধীনতা-পরাধীনতার দীর্ঘ ইতিহাস। বক্ষমান এই প্রবন্ধে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার সেই ইতিহাস-উদ্দেশ্য থেকে শুরু করে আজকে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হল, সেই দীর্ঘ ইতিহাস ও আন্দোলনের কিছু সংক্ষিপ্ত চিত্র পেশ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

এই দুই প্রতিষ্ঠানের মাঝে দীর্ঘ স্থানিক ও কালিক ব্যবধান রয়েছে, যেমন বলেছি। ১৭৮০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত এই মাদ্রাসা পরিচালিত হয় সরাসরি ইংরেজি উপনিবেশ শাসনের মাধ্যমে। ৪৭-এ যখন সেই উপনিবেশ শাসনের বিলুপ্তি ঘটে তখন এই অঞ্চল ভারত ও পাকিস্থান নামে দুটি ভিন্ন রাষ্ট্রে ভাগ হয়ে যায়। কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা তখন বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়ে আসে। এর অর্থ এই নয় যে, ৪৭-এর আগে এই অঞ্চলে কোনো আলিয়া মাদ্রাসা ছিল না, বরং এর আগ থেকেই এই অঞ্চলে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার আদলে অনেক মাদ্রাসা গড়ে উঠেছিল। তবে ৪৭-এর পরে স্বয়ং কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসাকে কলিকাতা থেকে এখানে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। এবং তখন থেকে এই মাদ্রাসা এখানেই বিদ্যমান ও ‘মাদ্রাসা-ই-আলিয়া’ বা ‘ঢাকা আলিয়া’ নামে পরিচিত হয়ে আছে।

শিক্ষার ইতিহাস বা শিক্ষাব্যবস্থার ঐতিহাসিক ভিত্তি শিক্ষা-বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপুর্ণ দিক ও বিষয়। নৃ-বিজ্ঞান শাস্ত্রে যেমন মানব জাতির বিভিন্ন পর্ব, বৈশিষ্ট্য, উপাদান, গুণাবলী ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়, শিক্ষাব্যবস্থার ঐতিহাসিক ভিত্তির মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন পর্ব, তাদের বৈশিষ্ট্য, গঠনের উপাদান বা নির্দিষ্ট কোনো কালের শিক্ষা ব্যবস্থার সফলতা ও ব্যর্থতার কারণ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়ে থাকে। এই অঞ্চলের মুসলমানগণ একসময় ইংরেজি ভাষা ও শিক্ষা গ্রহণে অনাগ্রহী ছিলেন–যেটা ঐতিহাসিক ভাবে দাবী করা হয়ে থাকে। এই বিষয়ের ব্যাখা বা বিশ্লেষণ করার সময় যদি সেই সময়ের শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো, নিয়ন্ত্রণ ও উদ্দেশ্য আমাদের সামনে থাকে তাহলে এর ব্যাখা-বিশ্লেষণ যেমন হবে, এই সকল তথ্য সামনে না থাকলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হবে আরেক রকম। যেই কারণে সেই সময়ের মুসলমানদের অবস্থান কারো কাছে সঠিক মনে হতে পারে আবার কারো কাছে ভুলও মনে হতে পারে। শিক্ষার ইতিহাস আলোচনার মাধ্যমে কোনো এক সময়ের শিক্ষা ব্বস্থার ভুল-ত্রুটি বা দুর্বলতার দিকসমূহ চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে। এবং শিক্ষার ইতিহাসকে সামনে রেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি ও অবকাঠামো গড়ে তোলা যায়। এখান থেকেই এই ধরণের আলোচনার গুরুত্ব ও মূল্য অনুভব করা হয়ে থাকে।

দেশে বিদ্যমান সরকারী-ধর্মীয় শিক্ষাধারার পাশাপাশি আরেকটি ধর্মীয় শিক্ষাধারা রয়েছে যা হচ্ছে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাধারা। বর্তমানে এই শিক্ষাধারার সংস্কার, মূল্যায়ন, পুনর্গঠন নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা, পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। এখানে আগ্রহ-উদ্দীপনা যেমন আছে, তেম্নি আছে আশংকা ও ষড়যন্ত্রের আলামতও। যেহেতু এই শিক্ষাধারা একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর সাথে সরাসরি জড়িত এবং এই অঞ্চলের সমগ্র মুসলিম উম্মাহের সাথে সম্পর্ক রাখে তাই এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পুর্বে অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা ও ইবরত গ্রহণ করা অনেক জরুরী। সকল নতুন বিষয়কে গ্রহণ করার মধ্যে যেমন কল্যাণের নিশ্চয়তা নেই, তেমনি কোনো নতুন বিষয়কে গ্রহণ না করার মধ্যেও কল্যাণের নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। ইতিহাস, ঐতিহ্য, বর্তমান প্রেক্ষাপট, যুগ ও সমাজের চাহিদা-প্রয়োজনকে সামনে রেখেই জাতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই এখানে ২০০ বছরের ইতিহাস ফিরে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে।

এই সুদীর্ঘ সময়ের ইতিহাস আলোচনা করা সহজ বিষয় নয়। তাই সেই দীর্ঘ আলোচনার দিকে না গিয়ে আমরা খুব সংক্ষেপে নিম্নে উল্লেখিত কয়েকটি বিষয়ের মাধ্যমে আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করবো। যে কয়টি শিরোনামে আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে, তা হলো–
১. আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার দর্শন ও উদ্দেশ্য
২. আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষাধারার অবকাঠামো ও মেয়াদ
৩. পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা
৪. আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচী, পাঠ্যপুস্তক
৫. মাদ্রাসা প্রশাসন
৬. আলিয়া মাদ্রাসার অর্থব্যবস্থা
৭. বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড
৮. উপসংহার

১. আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার দর্শন ও উদ্দেশ্য

প্রতিটি শিক্ষাব্যবস্থার পেছনে একটি শিক্ষাদর্শন থাকে, যা শিক্ষাব্যবস্থার রুপরেখা, পরিচালনা পদ্ধতি, উদ্দেশ্য ইত্যাদি নির্ধারণ করে থাকে। শিক্ষাদর্শন আলাদা ভাবে সৃষ্টি হওয়া কোনো বিষয় নয়, বরং এটা একটি জাতির মৌলিক জীবন-দর্শন থেকেই আহরিত হয়ে থাকে। একটি জাতি জীবন ও জগত সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে ও তাদের মধ্যে যে মূল্যবোধ বিরাজ করে সেখান থেকেই তাদের শিক্ষাদর্শন নির্ধারিত হয়ে থাকে। শিক্ষাদর্শন আলাদাভাবে উল্লেখ বা লিপিবদ্ধ করা জরুরী নয়, বরং এটা তাদের সামগ্রিক মূল্যবোধ ও বিশ্বাস-আচরণ থেকেই অনুধাবন করা যায়। তাছাড়া শিক্ষা বিষয়ক তাদের বিভিন্ন আচরণ, সুপারিশ, সিদ্ধান্ত ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করার পেছনে তাদের যে উদ্দেশ্য থাকে সেটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় এই অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের ধর্ম ও শিক্ষার চাহিদা পূরণ করার উদ্দেশ্য সামনে রেখে। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র অনুমতি ও পৃষ্ঠপোষকতায়। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হচ্ছে সেই কোম্পানি যারা নৌকা থেকে মসনদে উঠেছিল, এবং এই অঞ্চলের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে এই অঞ্চলের অধিবাসীদের উপর শাসনকার্য পরিচালনা করেছে, আর যাদের জন্যে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করা হলো তারা নিজেদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্যে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে।

এই অবস্থায় সাধারণভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, এখানে এই অঞ্চলের মানুষদের জন্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি ও তাদের জন্যে বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করার পেছনে তাদের নিজেদের কোনো স্বার্থ অবশ্যই থাকবে। ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনা ও ইংরেজদের বিভিন্ন প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এটা অনুমান করা যায় যে, এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করার মাধ্যমে তাদের মধ্যে যতটুকু না এই অঞ্চলের মুসলমানদের দীন ও দুনিয়ার কল্যাণচিন্তা ছিল তার চেয়ে বেশী চিন্তা ও পরিকল্পনা ছিল নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার। এমন মনে করার কোনো জরুরত নেই যে, আমরা এখানে আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা শুরু করছি, বরং এটা আমাদের একটা সাধারণ অনুমান। এই অনুমানের উপর ভিত্তি করে, সামনে আমরা এমন কিছু আচরণ, সিদ্ধান্ত ও বিবরণ পেশ করবো যার মাধ্যমে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পেছনে প্রতিষ্ঠাতাদের চিন্তায় কী দর্শন ও উদ্দেশ্য ছিল সেটা নির্ধারণ করার সুযোগ লাভ করবো।

‘কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে এর প্রতিষ্ঠাতা ওয়ারেন হেস্টিংসের ১৭৮১ সালের ১৭ই এপ্রিল প্রদত্ত একটি বিবরণী থেকে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। সেই বিবরণীতে তিনি উল্লেখ করেন : ‘১৭৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুসলমানদের একটি প্রতিনিধিদল আমার সাথে সাক্ষাত করে আমাকে অনুরোধ করে যে, মোল্লা মাজদুদ্দিন নামের জনৈক ব্যক্তিকে কলিকাতায় স্থায়ীভাবে রাখার ব্যাপারে আমি যেন সচেষ্ট হই। যাতে এখানকার মুসলমান ছাত্ররা প্রচলিত ইসলামী বিষয়ে শিক্ষালাভ করতে পারে। এই ব্যক্তি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগাধ বুৎপত্তিসম্পন্ন। ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই ব্যক্তি বিশেষ যোগ্যতা রাখেন। তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সরকারেরও এমন অসংখ্য অফিসারের প্রয়োজন যাদের প্রচুর যোগ্যতা রয়েছে, এবং ফৌজদারি আদালত ও দেওয়ানী আদালতে এই সময় বিচারক নিয়োগের ব্যাপারে খুবই যোগ্যতাসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য লোকের প্রয়োজন। আমি এই প্রতিনিধিদলকে এই আশ্বাস দিয়ে বিদায় করেছি যে, যতটুকু সম্ভব আমি এই ব্যাপারে চেষ্টা করব। অতঃপর আমি মোল্লা মাজদুদ্দিনকে ডেকে পাঠাই এবং মুসলমানদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের অনুরোধ জানাই। তিনি আমার কথায় সম্মত হলেন এবং ১৭৮০ সালে প্রস্তাবিত মাদ্রাসার জন্যে কার্যক্রম শুরু করে দিলেন।’ (বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা ও সমাজ জীবনে তার প্রভাব, পৃঃ ১২০-১২১)

এরপর তিনি (ওয়ারেন হেস্টিংস) ১৭৮৫ সালে ভারত থেকে ১ম দফা বিদায়ের সময় মাদ্রাসার উদ্দেশ্য সম্পর্কে যা বলেন তা থেকে বিষয়টি আরো বেশী স্পষ্ট হয়ে উঠে। তিনি বলেন, ‘সময়োপযোগী নীতির চাহিদা অনুযায়ী বর্তমানে ফৌজদারি বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ পদে মুসলমান অফিসারদেরকে বহাল করা উচিত। কিন্তু এসব পদের দায়িত্ব পালনের বেলায় শুধু ব্যক্তিগত ও প্রচলিত যোগ্যতাই যথেষ্ট নয়, বরং সেই সাথে আরবি ও ফার্সি ভাষার মাধ্যমে ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রের নিরিখে যুদ্ধ সমস্যাবলির সমাধানের যোগ্যতা থাকাও নেহায়েত জরুরী। আমরা যেহেতু অর্থ বিভাগ নিজেদের আয়ত্তেই রেখেছি, এজন্যে এই বিভাগের সব কর্মচারি হয় ইংরেজ নয় হিন্দু। তাদের পরিমিত শিক্ষা, মিতব্যয়ী স্বভাব, ও সহজাত গুণে অর্থ সংক্রান্ত ব্যাপারে তারা মুসলমানদের চেয়ে অনেক অগ্রসর। এজন্য এই বিভাগে মুসলমান কর্মচারি নেই। মুসলমানদের বর্তমানে এমন আর্থিক সংগতি নেই যাতে তারা তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে উচ্চতর সরকারী পদে বহাল করতে পারে। তাদের এই অবনতি রোধ করার জন্যে গভর্নর বাহাদুর আলিয়া মাদ্রাসা পত্তন করেন। যাতে ভবিষ্যতে মুসলমানরা উপযুক্ত হয়ে সরকারী পদে বহাল হওয়ার সুযোগ পায়।’ (বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষা ও সমাজ জীবনে তার প্রভাব, [সামনে শুধুমাত্র ‘মাদরাসা শিক্ষা’ বলে উল্লেখ করা হবে] পৃঃ ১২২-১২৩)

মাদ্রাসা সংক্রান্ত কিছু বিষয়ের সুপারিশ হেস্টিংসের দপ্তরে পেশ করা হলে, তার জবাবে তিনি বললেন : ‘আমি কমিটির প্রস্তাবে একমত। মাদ্রাসার সংস্কারের ব্যাপারে কমিটি যে প্রস্তাব করেছে তাও যুক্তিযুক্ত। কিন্তু তা অত্যন্ত মন্থর গতিতে করতে হবে। কেননা এতে স্থানীয় জনগণের ভাবাবেগে আঘাত লাগতে পারে। পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের ব্যাপারেও কমিটি যে প্রস্তাব আনয়ন করেছে, তাও গভর্নর অবান্তর বলে উড়িয়ে দিতে চান না। তবে তা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য প্রয়াস। কেননা মুসলমানদের প্রচলিত এই শিক্ষাব্যবস্থা বহুকাল ধরে চলে আসছে। এই শিক্ষার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য মুসলমানদের মনেপ্রাণে মিশে আছে। অতএব এখন এই ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা ঠিক হবে না। তবে আস্তে আস্তে যখন পাশ্চাত্য শিক্ষার উপকারিতা, গুরুত্ব মুসলমানদের মানসিকতার উপর প্রভাব বিস্তার করতে সম্ভব হবে, তখন তা কার্যকর করা কঠিন হবে না।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১২৬-১২৭)।

এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, একদিকে যখন ইংরেজরা কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা স্থাপন করেছিল অন্যদিকে ‘১৭৯৩ সালে একটি ডিক্রি জারির মাধ্যমে দীর্ঘ পাঁচশ বছর যাবত মুসলমানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য মুসলিম শাসকদের নিকট থেকে প্রাপ্ত লা খেরাজ সম্পত্তি সরকারী সম্পত্তিতে পরিণত হয়। যার ফলে বাংলার প্রায় ১ লাখ প্রাথমিক মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১২৯)

‘১৮১৩ সালে ভারতীয় শিক্ষানীতি পাস হয় এবং উক্ত শিক্ষানীতিতে ভারতে খরচের জন্য অনুমোদিত একলক্ষ টাকা হতে খরচের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তবে সেই অর্থ খরচের ব্যপারে সংস্কৃত পণ্ডিত ও সংস্কৃত ভাষার ক্ষেত্রে বেশী সহায়তা দানের কথা বলা হয়। অথচ মাদ্রাসার কথা কিছুই উল্লেখ করা হয়নি।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৩১)

‘১৮২৯ সালের ২৬শে জুন ভারতীয় শিক্ষা কাউন্সিল ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপারে একটি গুরুত্বপুর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করে এই বলে যে, যতদিন সরকারী কাজের ভাষা ইংরেজি না হবে ততদিন ইংরেজি ভাষা যথাযথ মর্যাদা পাবে না, এবং যারা ইংরেজি অধ্যয়ন করছে তাদেরকেও যথার্থ মর্যাদা দেওয়া যাবে না। কাজেই আগামী তিন বছর পর সরকারী দপ্তরের কাজকর্ম ইংরেজিতে সম্পন্ন করতে হবে।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৩৩)

কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ‘ভারতের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজি শিক্ষার জন্যে কলেজ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ভাষাগত ও কাঠামোগত শিক্ষাক্রমের পরিবর্তনের মাধ্যমে খ্রীষ্টকরণের এক চক্রান্ত প্রতিফলিত হয় ১৮৩১ সালের শিক্ষা কমিটির রিপোর্টে। উক্ত রিপোর্টে তারা এদেশে নব প্রতিষ্ঠিত কলেজসমূহের মাধ্যমে তাদের খ্রীষ্ট ধর্মের প্রচার ও প্রক্রিয়াগত সাফল্য তুলে ধরেন। এতে তারা আরও আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, এই প্রজন্মে যাই হোক, পরবর্তী প্রজন্মে এদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি খ্রীষ্ট ধর্মের প্রতি আরও আকৃষ্ট হবে।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৩০)

‘১৮৩৫ সালের ২৮শে জুন, চার্লস ট্রাভলেনের একটি রিপোর্ট হতে এই স্বীকারোক্তি যানা যায় : ‘আমার মতে যে সকল স্কুলে উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে প্রচুর পরিমাণ আর্থিক সাহায্য করা উচিত। আমার উদ্দেশ্য এই নয় যে, এমন কোনো দিন আসবে না যখন সরকারী কলেজসমূহে খ্রীষ্ট ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষা চালু করা যাবে না।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৩৪)

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিল্পবের পরে ‘সরকারের একাংশ কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্রদের এই বিদ্রোহে ইন্ধন আছে বলে ধারণা করে বসে। ১৮৫৮ সালে লেঃ গভর্নর তদানীন্তন ডি. পি. আই. একটি নির্দেশ জারি করেন। তিনি বলেন বর্তমান অবস্থায় সরকার বিরোধী চিন্তা-চেতনার কাজে ব্যবহৃত মাদ্রাসা শিক্ষা সরকারী খরচে পরিচালিত হবে কিনা তা বিবেচনা করার সময় এসেছে। কাজেই ভবিষ্যতে এই শিক্ষা বন্ধ করার ব্যাপারে মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের সাথে পরামর্শ করে তিনি যেন একটি রিপোর্ট পেশ করেন।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৪১)

‘১৮৬৪ সালে ভারত সরকার বেঙ্গলকোড জারি করে, মাদ্রাসার শিক্ষিতদের হাতে না মেরে ভাতে মারার ব্যবস্থা করে। উক্ত বিধি অনুসারে ইংরেজ জজের সাথে মাদ্রাসার শিক্ষিত একজন কাজি ও সরকারের পরিসংখ্যানবিদ নিয়োগ বাতিল করা হয়। ফলে আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষিতরা বৃটিশ সরকারের উচ্চ পদমর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৪৩)

‘১৮৭১ সালে মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন বিচারপতি নরম্যান। ১৮৭১ সালের ১৫ এপ্রিল কমিটি প্রথম বৈঠকে মিলিত হয়। অনেক কিছু আলোচনা হওয়ার সাথে সাথে সভাপতির পক্ষ থেকে এই উপদেশ দেওয়া হলো যে, মাদ্রাসার আরবি পাঠ্য বিষয় হতে এমন সব পুস্তক বা অধ্যায় বর্জন করতে হবে যা যথার্থই ভাবাবেগের সূত্রপাত করে এবং সরকারের বিরুদ্ধে লোকদের মনে বিদ্রোহের দাবানল প্রজ্বলিত করে।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৪৭)

ডাব্লিউ ডাব্লিউ হান্টার ভারত বর্ষের মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করে ‘দ্যা ইন্ডিয়ান মুসলিম’-এ মন্তব্য করেন : ‘এটা কি করে সম্ভব যে, সরকারী চাকুরি এবং স্বীকৃত সমস্ত পেশার দরজা মুসলমানদের জন্য বন্ধ হয়ে গেল? বাংলার মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তির অভাব নেই, এবং দারিদ্রের চাপে তারা সব সময়ই ভাগ্যোন্নতির জন্যে একটা কিছু করার চেষ্টায় লেগে আছে। সরকার বাংলায় অনেক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এর অনেক জেলাই মুসলমান অধ্যুষিত, তথাপি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের প্রতিযোগিতায় কৃতকার্য হতে পারে এবং যেকোনো পেশায় ঢোকার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে এমন কৃতী মুসলমান ছাত্র তৈরি করতে ঐসব স্কুল ব্যর্থ হয়েছে। অথচ প্রতি বছর ঐসব স্কুল থেকে দলে দলে এমন সব সুশিক্ষিত, উচ্চাভিলাষী ও মেধাবী হিন্দু যুবক বেরিয়ে আসছে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভের যোগ্যতা অর্জন করছে এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ কৃতিত্বের সাথে সমাপ্ত করে অর্থ রোজগার ও ভদ্র জীবন যাপনের প্রতিটি ক্ষেত্র অধিকার করে বসেছে। আসল সত্য এই যে, আমাদের প্রচলিত জনশিক্ষাব্যবস্থা হিন্দুদেরকে শতাব্দীর নিদ্রা হতে জাগ্রত করে তাদের নিষ্ক্রিয় জনসাধারণকে মহৎ জাতিগত প্রেরণায় উজ্জীবিত করে তুলতে পারলেও, তা ছিল মুসলমানদের ঐতিহ্যের পরিপন্থী, তাদের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যহীন এবং ধর্মের কাছে অবমাননাকর। ইংরেজ শাসনামলে যেমন, মুসলমানদের শাসনামলেও ঠিক তেমনি, হিন্দুরা নিজেদের ভাগ্যকে বরণ করে নিয়েছিল। বর্তমানে ইংরেজি জানা লোকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে এবং হিন্দুরা ইংরেজি শিখছে। ইতিপুর্বে ফারসি জানা লোকদের অগ্রাধিকার দেয়া হতো এবং তখন হিন্দুরা ফার্সি শিখত। কিন্তু মুসলমানদের বেলায় ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। বুদ্ধিমান হলে, মুসলমানরা পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে তদানুসারে নিজেদের ভাগ্য গড়ে তুলত। কিন্তু একটা প্রাচীন বিজেতা জাতির পক্ষে তাদের স্বর্ণযুগের ঐতিহ্য রাতারাতি বিসর্জন দেওয়া সম্ভব ছিল না।’

প্রাদেশিক সরকারও মুসলমানদের অনগ্রসরতা সম্পর্কে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার ১৮৭১ সালের ৭ই আগস্ট এই ঘোষণায় উল্লেখ করেন : ‘ভারতীয় মুসলমানদের শিক্ষাক্ষেত্রে যে বৈসাদৃশ্য সৃষ্টি হয়েছে, ভারত সরকার বিভিন্ন সুত্রে তার সম্যক ধারণা লাভ করেছেন। প্রকৃত পক্ষে মনে হয় সারা উপমহাদেশের সীমান্ত এবং পাঞ্জাব প্রদেশ ছাড়া আর কোথাও মুসলমানদের শিক্ষার সুষ্ঠু বন্দোবস্ত নেই। গভর্নর জেনারেল আন্তরিকভাবে এই কথা বিশ্বাস করেন যে, বর্তমানে স্থানীয় ভাষায় যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, মুসলমানরা তাতে উপকৃত হচ্ছে না। এমতাবস্থায় এর সাথে যদি আরবি ও ফার্সি সুশৃংখল পদ্ধতিতে প্রবর্তন করা হয় তাহলে মুসলমানদের কাছে তা গ্রহণীয় তো হবেই উপরন্তু তারা এর প্রতি সহযোগিতা প্রদর্শন করবে।’

বাংলা সরকার ১৮৭২ সালের ১৭ই আগস্ট শিক্ষা সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট প্রেরণ করেন। এতে বাংলা সরকার নিজেদের দোষ স্বীকার করে বলেন : ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মুসলমানদের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। মি. বার্নাড তার নোটে লেখেন যে, শিক্ষা পরিদর্শন বিভাগে একজন মুসলমান কর্মচারীও নেই। সরকারী স্কুলসমূহের সাধারণ শিক্ষকের তালিকায়ও কদাচিৎ মুসলমানদের নাম দেখা যায়। বাংলার শিক্ষা বিভাগকে একটি হিন্দু প্রতিষ্ঠানও বলা যায়। … কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের মুসলিম শিক্ষা সম্পর্কিত উদ্যোগ বাংলা সরকারের অর্থ বিভাগে এসে আটকে যায়। ফলে তাদের মানবিক রিপোর্টসমূহ মায়াকান্নায় পর্যবসিত হয়।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৪৯-১৫১)

আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য

উপরে কিছু ইংরেজ দায়িত্বশীল ব্যক্তির মন্তব্য ও কিছু কমিটির প্রস্তাব ও সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই সমস্ত বিবরণ ও মন্তব্য থেকে আমরা এই ধারণায় উপনীত হতে পারি যে, ইংরেজদের পক্ষ থেকে এই অঞ্চলে আলিয়া মাদ্রাসা নামে একটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করার পেছনে এই অঞ্চলের মুসলমানদের দীন ও দুনিয়ার উপকার ও কল্যাণের ইচ্ছা যতটুকু না ছিল তার চেয়ে বেশী উদ্দেশ্য ছিল তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিল করা। উপরের আলোচনায় দেখা যায় যে, ইংরেজ সরকার এই দেশে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রচলিত লা খেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে, সাধারণ শিক্ষা ব্বস্থার জন্যে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ বরাদ্দের ঘোষণা করলেও মাদ্রাসাশিক্ষার জন্যে কোনো কিছু বরাদ্দ করা হয়নি। সরকারি দপ্তরের কাজকর্ম ইংরেজিতে সম্পন্ন করার প্রস্তাব করা হয়, এবং সেই সাথে মাদ্রাসা-শিক্ষিতদের সরকারী কাজি হিসাবে নিয়োগের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু করার উদ্দেশ্যে ও ইংরেজি শিক্ষার প্রচার-প্রসারের জন্যে ভারতের বিভিন্ন স্থানে কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়, এই সব কলেজের মাধ্যমে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের চেষ্ঠা করা হয় এবং সেই সকল স্কুলে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে সিপাহী বিপ্লবের মধ্যে কলিকাতা মাদ্রাসার অংশগ্রহণের কথা চিন্তা করে, মাদ্রাসাকে বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তা পর্যন্ত করা হয় এবং পাঠ্য পুস্তক থেকে এমন বিষয় বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয় যা ছাত্রদের মনে ‘ভাবাবেগে’র উদ্বেগ করতে পারে। এই সব ধারণা সামনে রেখে বলা যায় যে, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পেছনে ইংরেজদের উদ্দেশ্য ছিল–
১. ইংরেজ প্রশাসনে প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি করা
২. এই অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা
৩. পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচার-প্রসার করা
৪. ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রবর্তন করা
৫. খ্রীষ্ট ধর্মের প্রচার-প্রসার করা
৬. এটাও স্বীকার করা দরকার যে, কিছু কিছু ব্যক্তির সুপারিশ ও সিদ্ধান্তে মানবিক কিছু দিক ফুটে উঠে, সেটা হয়তো ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছিল, কিন্তু সামষ্টিক পর্যায়ের সেই সকল মানবিক সুপারিশের বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ দান করা হয়নি।

আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে, এক পর্যায়ে কিছু উৎসাহী মুসলিম শিক্ষা-অনুরাগীর পক্ষ থেকে এই শিক্ষার সংস্কারের রূপরেখা নির্ধারিত হয়েছিল এইভাবে যে, প্রাচীন শিক্ষাক্রমের সাথে সাধারণ শিক্ষাক্রমের একত্রীকরণের দাবী জানানোর মাধ্যমে। এর পক্ষে যেমন মতামত ছিল তেমনি এর বিপক্ষেও মতামত ছিল।

১৯১৪ সালে এই অঞ্চলে সরকারের পক্ষ থেকে নিউ স্কীম শিক্ষাধারা অনুমোদন করা হয়। নিউ স্কীম শিক্ষাধারা ছিল প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থাকে সংস্কার করে ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষাকে একত্রিত করে একটি নতুন শিক্ষাধারা। নিউ স্কীম শিক্ষাধারার প্রচলনের লক্ষ্যে, সরকারী পত্রের ভুমিকায় বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের মুসলমানদের শিক্ষা-সম্পর্কিত একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বর্ণিত হয়। এতে বলা হয়, ‘(ইংরেজ) রাজত্বের প্রথম অবস্থায় মুসলমানগণ তাদের সাহিত্য ও আইনের উচ্চ প্রশংসাপত্র লাভ করে রাজকার্যে উচ্চ স্থান অধিকার করেছিলেন। কিন্তু তখন তারা ইংরেজি শিক্ষার আবশ্যকতা উপলব্ধি করতে পারেননি। ইংরেজ রাজত্ব স্থাপনের প্রথম তিন-চতুর্থাংশ পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষিত যুবকগণ রাজকাজে ও আইন ব্যবসায় অগ্রগণ্য বলে বিবেচিত হতো। সেই সময় মুসলমানগণ তাদের নিজ ভাষা ত্যাগ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং প্রায় এক পুরুষ পর্যন্ত তারা নিজ সাহিত্য ও আইন সম্পর্কে ভালোবাসা ত্যাগ করে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা করতে যায়নি। এই সুযোগে বাংলার হিন্দুরা সময় ক্ষেপণ না করে ইংরেজি শেখা শুরু করে নিজেদেরকে কাজ ও আইন ব্যবসায় উপযুক্ত করে তুলেছিল। হিন্দুদের কাছে ইংরেজি ছিল নিছক এক বিদেশি ভাষার পরিবর্তে আরেকটি বিদেশি ভাষার পরিবর্তন মাত্র।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৮৪-১৮৫)

১৯২১ সালে সৈয়দ শামসুল হুদাকে সভাপতি করে ২৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার আভ্যন্তরীণ সমস্যাদি ও ইসলামী শিক্ষা সংরক্ষণের লক্ষ্যে। এই কমিটি ১৯২৫ সালে শিক্ষা বিভাগে রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টের শুরুতে মাদ্রাসাশিক্ষার ব্যাপারে সরকারের মনোভাব তুলে ধরা হয়। বলা হয় : ‘একটি জাতি হিসাবে মুসলমানরা এমন সব শিক্ষাবিদের জরুরত অনুভব করেন যারা সত্যিকারভাবে ইসলামী শিক্ষা সম্পর্কে অভিজ্ঞ। মুসলমানদের প্রাণের দাবীর প্রেক্ষিতে, গভর্নর ইন কাউন্সিল এমন একটি সরকারী মাদ্রাসা থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, যেখানে বিশেষভাবে ইসলামী শিক্ষা দেওয়া হবে। এখানে ইংরেজি ঐচ্ছিক হিসাবে থাকবে বা থাকবে না। … সরকারের উদ্দেশ্য, আলিয়া মাদ্রাসায় এমন সব ছাত্রের জন্য শিক্ষা চালু থাকবে যারা প্রকৃত অর্থেই পরবর্তীকালে ধর্মযাজক বা ধর্মীয় নেতা হবে। কিন্তু কমিটি এই ব্যাপারে মনোভাব পোষণ করে যে, যেসব ছাত্র এখানকার শিক্ষা সমাপণের পর ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে পরিচয় লাভ করতে চায়, তাদের জন্যেও সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৯০-১৯১)

১৭৮০ সাল থেকে নিয়ে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজদের শাসনে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা পরিচালিত হয়ে আসে। ১৯৪৭ সালে যখন এই উপমহাদেশ ইংরেজদের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে তখন এখানে পাকিস্তানি শাসন কায়েম হয়। ৪৭ থেকে ৭১-এর ২৪ বছর এই অঞ্চল শাসিত হয় পাকিস্তানের মাধ্যমে। সেই সময়েও এই অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা ও আলিয়া শিক্ষাব্যবস্থার পুর্নগঠন ও সংস্কার নিয়ে বেশ কিছু কমিটি, কমিশন গঠিত হয়। সেই সকল কমিশনের পক্ষ থেকে এই শিক্ষা সম্পর্কে কিছু ধারণা ও উদ্বৃতি নিম্নে পেশ করা হল :

মাওলানা আকরাম খাঁ শিক্ষা কমিটি ১৯৫১ সালে সরকারের কাছে যে রিপোর্ট পেশ করে তার সূচনাতে মাদ্রাসাশিক্ষা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলা হয় : ‘সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ দেশের জনসাধারণের মননশীলতাকে বাস্তবায়ন করতে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে প্রয়াসী হলেন। যাতে শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে পাকিস্তান রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনশীল আধুনিক বিশ্বের প্রতিযোগিতায় বিজয় লাভ করতে পারে। এদেশেও শিক্ষাব্যবস্থা সুদীর্ঘকাল যাবত সরকারী নিয়ন্ত্রণে ছিল। তারা জাতীয় ভাবাদর্শের চাহিদা অনুসারে শিক্ষা পরিচালনা করে এসেছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে শিক্ষাসমস্যার সমাধান জরুরী হয়ে পড়ে।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ২১৪-২১৫)

এইভাবে দেখা যায় যে, যখন যাদের হাতে শাসন ব্যবস্থা থাকে, তারা তাদের দর্শন ও উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। ইংরেজরা একটি দীনী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি ও পৃষ্ঠপোষকতা দান করে, তবে এর মাধ্যমে তারা এই অঞ্চলের দীনী শিক্ষাকে নিজেদের ইচ্ছা ও পছন্দ অনুযায়ী পরিচালনা করতে চেয়েছিল। অন্যদিকে ইংরেজদের পরে যারা ক্ষমতায় আসে তাদের চিন্তাধারাতেও দেখা যায় যে, এই শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষাধারার সাথে একত্রিত করে শিক্ষাব্যবস্থাকে এক করা ও মাদ্রাসা থেকে যারা শিক্ষা গ্রহণ করে বের হচ্ছে তারা যেন রাষ্ট্রের কোনো একটি কাজে বা সেবায় নিজেদের উপযুক্ত করে সম্পৃক্ত করতে পারে। তাই প্রায় সর্বত্র দেখা যায় যে, দারসে নিজামি শিক্ষাব্যবস্থার মাদ্রাসার প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থার সাথে আধুনিক সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থাকে একত্রিত করার চিন্তা ও পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে। ইসলামী শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার একত্রীকরণের ব্যাপারে আল্লামা শিবলী নোমানী বলেন, ‘আমি বারবার বলেছি, আর এখনো বলছি যে, মুসলমানদের জন্য শুধু ইংরেজি মাদ্রাসাশিক্ষাই যথেষ্ট নয়, আবার প্রাচীন আরবি মাদ্রাসাশিক্ষাও পর্যাপ্ত নয়। আমাদের সমস্যার সমাধান হলো একটি মিশ্র ঔষধ, যার একটির সম্পর্ক হবে প্রাচ্যের সাথে আরেকটি সম্পর্ক হবে প্রতীচ্যের সাথে।’ (মাদরাসা শিক্ষা, পৃঃ ১৮২)

চলবে…

আগের সংবাদমাত্র ৪০ দিনে কুরআনে হাফেজ বগুড়ার শিশু সাদেক নুর
পরবর্তি সংবাদসঙ্কটে ভারতীয় মুসলমান : জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ কী করছে