জালেম বনাম মাজলুম, মুক্তিযুদ্ধ ব্যাখ্যায় তৃতীয় মত

হামমাদ রাগিব:

পাকিস্তান যেহেতু ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান নিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, এবং পরবর্তী সময়ে ইসলামের নাম ভেঙে যেহেতু নানা রকম কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল, তাই একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এ দেশের ধর্ম সচেতন নাগরিকদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলেন যে, পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া আদৌ কি ঠিক হবে? তাদের এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসতে আসতেই ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্রের আশায় তারা না পারছিলেন মুক্তিযুদ্ধ তৎপরতায় অংশ নিতে, আবার পাকিস্তানিদের সীমাহীন জুলুম নির্যাতনের কারণে না পারছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীকে সমর্থন করতে। এই অংশটির মধ্যে যেমন ছিলেন সাধারণ মানুষ, তেমন ছিলেন দেশের অনেক ওলামায়ে কেরামও।

তবে ওলামায়ে কেরামের বড় একটি অংশ স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুতেই নতুন এক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছিলেন। এই অংশের মধ্যে ছিলেন হজরত হাফেজ্জি হুজুর রহ. ও তাঁর শিষ্য-সহকর্মীদের বড় একটি জামাত। ছিল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কওমি মাদরাসা আল-জামিয়াতুল আহলিয়া মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা, ছিল পটিয়া মাদরাসা-সহ আরও অনেক কওমি মাদরাসা। বাংলাদেশ বেতারের সম্প্রচার প্রথম প্রথম পটিয়া মাদরাসা থেকেই করা হয়েছিল। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার নিরাপদ আশ্রয় ছিল এ মাদরাসাটি।

মুক্তিযুদ্ধে ওলামায়ে কেরামের বৃহৎ এই অংশের সম্পৃক্তি ছিল ধর্মীয় সিদ্ধান্তের আলোকেই। হজরত হাফেজ্জি হুজুর রহ. মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাথমিক পর্যায়েই এই যুদ্ধকে জালেম বনাম মজলুমের যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। বলেছিলেন, বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতে জুলুমের শিকার, এই জুলুম থেকে নিস্কৃতি লাভের জন্য এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ অপরিহার্য। ইসলাম কখনো জুলুমকে সমর্থন করে না। ইসলাম সর্বদা মজলুমের পক্ষে, জালেমের বিরুদ্ধে। তাঁর এই ঘোষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর ছাত্র এবং ঢাকার ওলামায়ে কেরামের অনেকেই সরাসরি সম্পৃক্ত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের তৎপরতার সঙ্গে। মরহুম মাওলানা ইমদাদুল হক আড়াইহাজারীর নাম এ ক্ষেত্রে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

ওলামায়ে কেরামের এই জামাত সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে এই সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, আর যাই হোক পাকিস্তানের হাতে বাঙালি মুসলিম-অমুসলিম কেউই আর নিরাপদ নেই। এরা নিজের স্বার্থটাই দেখে, বাঙালি মুসলমানদের প্রতি সামান্য দরদ-ভালোবাসা দেখানো তো দূরে থাক, উল্টো আরও নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাচ্ছে। অতএব মুসলিম ঐক্যের দোহাই দিয়ে এদের অধীনে থাকা নিজেদের ওপর জুলুম করারই নামান্তর। তাই তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক তৎপরতা থেকে নিয়ে অস্ত্র হাতে সরাসরি ময়দানে ঝাঁপিয়ে পর্যন্ত পড়েছেন।

এ সমস্ত আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধকালীন কর্মপ্রক্রিয়া এবং তৎপরতা সম্পর্কে জানতে কথা বলেছিলাম মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে’-এর লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক মাওলানা শাকের হোসাইন শিবলির সঙ্গে।

শাকের হোসাইন শিবলি বলেন, আমি যখন আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে বইয়ের কাজ শুরু করি, আমার ধারণা ছিল, মুক্তিযোদ্ধা আলেমদের সংখ্যা বোধহয় খুব বেশি হবে না। হাতেগোনা কয়েকজনকে অবলম্বন করে কাজে হাত দিই। কিন্তু কাজে হাত দেওয়ার পর নতুন এক দিগন্ত আমার কাছে উন্মোচিত হতে শুরু করে। আমি একে একে পুরো দেশ চষে বেড়িয়েছি, এবং এখনও এ কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি, মুক্তিযুদ্ধে আলেমদের তৎপরতা এতই ব্যাপক যে একের পর এক এখনও নতুন নতুন সব তথ্য আমার কাছে এসে হাজির হচ্ছে। নামোল্লেখ করে করে তাঁদের বর্ণনা দেওয়াটা এখন আমার জন্য দুরূহ হয়ে উঠেছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের উম্মুল মাদারিস এবং দেওবন্দের পরে উপমহাদেশে যে মাদরাসাটির অবস্থান, চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসা, মুক্তিযুদ্ধের সময়টায় এই মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন আল্লামা আবদুল ওয়াহহাব রহ.। আল্লামা আশরাফ আলি থানভি রহমতুল্লাহি আলায়হির অন্যতম খলিফা ছিলেন তিনি। আমি যখন আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ শুরু করি, তখন একটা ধারণা ছিল যে মাদানি রহমতুল্লাহি আলায়হি যেহেতু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে ছিলেন, অতএব বাংলাদেশে মাদানি ঘরানার ওলামায়ে কেরামই বোধহয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন, আর থানভি রহমতুল্লাহি আলায়হি যেহেতু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন, অতএব বাংলাদেশে তাঁর খলিফা ও ভক্ত-মুরিদানরা বোধহয় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু আবদুল ওয়াহহাব রহ.-এর কর্মতৎপরতা সম্পর্কে যখন আমি জানতে শুরু করি, একের পর এক তথ্য আমাকে বিস্মিত ও অবাক করে তোলে।

শাকের হোসাইন শিবলি বলেন, আলেম ‘মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে’ দ্বিতীয় খণ্ডে বিস্তারিত তথ্যপ্রমাণসহ ব্যাপারটা আমি পরিস্কার করব। এখন সংক্ষেপে শুধু এতটুকু বলি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যেভাবে এগারোটি সেক্টরে ভাগ করে সংঘটিত হয়েছিল, তেম্নি মাওলানা আবদুল ওয়াহহাব রহমতুল্লাহি আলায়হিও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা থানভিধারার ভক্ত-মুরিদানকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তৎপরতা চালানোর জন্য সাতটা সেক্টরে ভাগ করে দিয়েছিলেন। থানভি সিলসিলার বাইরের অনেক আলেমও এ তৎপরতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বরিশালের চরমোনাইয়ের মূল পীর সৈয়দ এসহাক রহমতুল্লাহি আলায়হি। হজরত আবদুল ওয়াহহাব রহমতুল্লাহি আলায়হি গঠিত বরিশাল সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছিলেন চরমোনাইয়ের ভক্ত-মুরিদেরা। সৈয়দ এসহাক রহ.-এর জামাতা মাওলানা ইউসুফ সাহেবকে বিচারক নির্ধারণ করে স্থানীয় রাজাকারদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা। স্থানীয় যারাই মানবতাবিরোধী অপরাধ করত, ইউসুফ সাহেবের কাছে তাদের ধরে নিয়ে আসা হতো। তিনি তাদের উপযুক্ত ও কঠোর বিচার করে দিতেন।

মুক্তিযুদ্ধে হাটহাজারী মাদরাসা কতটা তৎপর এবং কঠোর ভূমিকায় ছিল তা উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এ আলেম গবেষক বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর হাটহাজারী মাদরাসার নোটিশ বোর্ডে ঘোষণা টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই কথা লিখে—কোনো রাজাকার বা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের কেউ আজ থেকে এ মাদরাসায় অবস্থান করতে বা ভর্তি হতে পারবে না।

মাওলানা শিবলি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে আলেমদের অবদান ও তৎপরতার এমন অসংখ্য গল্প আছে, যা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের নানা প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিহিংসার কারণে ইতিহাসের অলিখিত অধ্যায়ে হারিয়ে গেছে। আর এই সুবাদে একটা ট্র্যান্ড দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, দাঁড়ি-টুপিধারী আর আলেম মানেই রাজাকার। অথচ টুপি-দাড়ি পরে রাজাকারি যারা করেছিল, তাদের সিংহভাগই জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত লোক এবং আলেমদের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না।’

এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় ওলামায়ে কেরামের আরও একটি অংশ ছিল, যাঁরা পাকিস্তানের পক্ষ-অবলম্বন করেছিলেন। এবং এই সূত্র ধরে আজকের বাম এবং আলেম-বিদ্বেষী মহল ঢালাওভাবে ওলামায়ে কেরামকে ‘রাজাকার’ আখ্যা দিতে ব্যতিব্যস্ত থাকে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বনকারী এসব আলেমের তৎপরতা বিষয়ে কথা হয়েছিল অধুনা বিলুপ্ত মাসিক রহমত-এর সম্পাদক মাওলানা মনযূর আহমাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, বৃহৎ কল্যাণ চিন্তা থেকেই তাঁরা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের ওপর কোনোরূপ জুলুম-অত্যাচারের সঙ্গে এ সমস্ত আলেমের কেউ জড়িত ছিলেন না। বরং উল্টো আরও তাদেরকের নানাভাবে বাঁচিয়েছেন পাক মিলিটারির হাত থেকে।

তিনি বলেন, তাঁরা মনে করেছিলেন, পাকিস্তান থেকে যদি মুসলিম অধ্যুষিত আমাদের এ ভূখণ্ডটা পৃথক হয়ে যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই ভারতের আগ্রাসনের মুখে পড়বে। ভারতের কাছে নানাভাবে নিগ্রহের শিকার হবে এই ভূখণ্ড। এবং প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে তাঁদের এই চিন্তাধারা যে অমূলক ছিল না, বিবেকবান যে কেউই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন।

মাওলানা মনযূর আহমাদ আরও বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি, ওলামায়ে কেরামের এ অংশটা যদিও পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু কোনোভাবেই বাঙালিদের ওপর নির্যাতনে অংশগ্রহণ করেননি। রাজাকার হিসেবে যে রূপটা আমাদের সামনে বর্তমানে দাঁড় করানো হয়েছে, তার সঙ্গে আলেমদের কোনো সম্পর্কই ছিল না তখন। এমন একটি ঘটনাও কেউ প্রমাণ করতে পারবে না যে, আলেমদের কেউ কোনো বেসামরিক বাঙালিকে নির্যাতনে অংশগ্রহণ করেছেন বা পাক বাহিনীকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছেন। বরং পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে বেসামরিক লোকজনকে বাঁচাতে যুদ্ধের পুরো নয়টি মাসজুড়েই তাঁরা তৎপর ছিলেন।

আগের সংবাদ‘স্বাধীনতার সূচনা ইনশাআল্লাহ’র মাধ্যমে, সমাপ্তি আল্লাহর রহমত-এ’
পরবর্তি সংবাদমুখ ও মুখোশ : মুক্তিযুদ্ধে সেকুলার এলিটদের ভূমিকা