তুর্কি দরবেশ সাঈদ নুরসি ও তাঁর বিস্ময়কর আধ্যাত্মিক মিশন

হামমাদ রাগিব

সাংগঠনিক কোনো কাঠামো নেই এই মিশনের। নেই নেতৃত্ব কিংবা কর্তৃত্বের কোনো ঝামেলা। তুর্কি দরবেশ আলেম বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি রহমতুল্লাহ আলায়হির চিন্তা ও গবেষণাকে গভীর অধ্যবসার মধ্য দিয়ে আত্মস্থ করে এর আলোকে নিজের ব্যক্তিজীবনকে পরিশুদ্ধ করাই মিশনে সম্পৃক্ত লোকজনের প্রধানতম লক্ষ্য। বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি রচিত ও আট খণ্ডে সমাপ্ত বিশাল কলেবরের গবেষণাগ্রন্থ ‘রিসালায়ে নুর’ অধ্যয়ন, চর্চা এবং এর উপর আলোচনা করা এ মিশনের মূল কাজ।

আধ্যাত্মিক সাধনা এ মিশনের মূল কাজ হলেও পীর-মুরিদি কিংবা সুফিজমের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পৃক্তি নেই। সাঈদ নুরসি ‘রেসালায়ে নুরে’ আধ্যাত্মিকতা ও ইসলামের সর্বাঙ্গীন চিন্তার যে পাঠ দিয়ে গেছেন, এর আলোকেই তাঁরা আত্মশুদ্ধির চর্চা করে থাকেন।

আরও পড়ুন : নুরসি : ধর্মনিরপেক্ষতার মোকাবেলায় দাঁড়ানো তুর্কি দরবেশ

মিশনের সাংগঠনিক কাঠামো বা সুনির্দিষ্ট কোনো নেতৃত্ব যেমন নেই, তেম্নি এর নির্ধারিত কোনো নামও নেই। নুরসি-অনুসারী বা নুর জামাত নামে পরিচিত হলেও এটা অফিসিয়াল কোনো নাম না।

তিরিশের দশকে তুরস্ক থেকে যখন কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে ইসলামের নাম-নিশানা মুছে ফেলা হয়, মানুষকে ধর্মচর্চা থেকে জোর করে বিমুখ করে বিস্মৃত করা হয় তাদের ঈমানি চেতনা, ধর্মীয় সঙ্কটের নিদারুণ সেই ক্রান্তিকালে উস্তাদ বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি মানুষের ভেতর ঈমানি চেতনা ও মূল্যবোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যে এ মিশনের সূচনা করেন। প্রচলিত পীর-মুরিদি এবং সুফিজমকে তিনি অস্বীকার করেননি, কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে মানুষকে আধ্যাত্মিক সাধনা ও আত্মশুদ্ধির প্রতি আকৃষ্ট করতে এই ধারাকে উপযোগীও মনে করেননি। তাই সিলসিলাগত আধ্যাত্মিকতার প্রাচীন ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ও অভিনব পদ্ধতিতে মানুষের আত্মশুদ্ধির এক মেহনতের সূচনা করেন। রচনা করেন ‘রিসালায়ে নুর’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থখানির। যেখানে মানুষের জীবন-জিজ্ঞাসার জবাব দিয়েছেন তিনি নতুন এক পদ্ধতিতে। ঈমানের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরেছেন গবেষণার ধাঁচে। আধুনিক তুরস্কের সেকুলার ভাবাপন্ন মানুষ বিপুলভাবে আকৃষ্ট হন তাঁর এ পদ্ধতির প্রতি। বিপুলভাবে পঠিত ও চর্চিত হতে থাকে রিসালায়ে নুর গ্রন্থখানিও।

তিরিশ ও চল্লিশের দশকে তুরস্কের মানুষজন যখন ব্যাপকভাবে নুরসির ভাবাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ইসলামের দিকে ফিরতে শুরু করে, তুরস্কের সেকুলার সরকার তখন নুরসির এ কর্মধারাকে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে। নুরসির প্রতি মানুষের এ আকৃষ্টি থামিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁকে প্রথমে নির্বাসনে পাঠানো হয়। কিন্তু নির্বাসিত এলাকারও মানুষজন যখন নুরসির প্রতি ঝুঁকে পড়ে, সরকার ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বিনষ্ট হবার অজুহাতে নুরসিকে গ্রেপ্তার করে। নিষিদ্ধ করা হয় রেসালায়ে নুরকেও।

সরকারের এ বৈরী আচরণে নুরসির প্রচারণা আরও বৃদ্ধি পায় এবং মানুষজন আরও বেশি করে আকৃষ্ট হতে শুরু করে তাঁর প্রতি। আরও ব্যাপকভাবে পঠিত হয় রেসালায়ে নুর গ্রন্থখানিও।

জীবনের শুরুর দিকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও এবং উসমানি খেলাফতের পতনোন্মুখ সময়ে খেলাফত রক্ষার্থে সরাসরি রণাঙ্গনে লড়াই করলেও কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠা পাবার পর যখন তিনি আধ্যাত্মিক মিশন শুরু করেন, তখন আর রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পৃক্তি রাখেননি। আতাতুর্ক সরকার তুরস্কের মানুষের ঈমানি যে চেতনাকে বিস্মৃত করে দিয়েছিল, তিনি চেয়েছিলেন সেই চেতনাকে পুনরায় জাগিয়ে তুলতে। এবং মাত্র দুই দশকের মেহনতে তিনি বিস্ময়করভাবে সেটা পেরেছিলেনও।

নুরসির কর্মধারা রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখলেও তাঁর এই মিশনের বদৌলতে মানুষের মধ্যে যে বোধ ও বিশ্বাসের পুনর্জাগরণ হয়েছিল, এর প্রভাবেই পঞ্চাশের দশকে তুরস্কের নির্বাচনে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল সেকুলার গোষ্ঠীকে। এ কারণে তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক প্রতিষ্ঠিত সেকুলার শাসনের পতনের নেপথ্য নায়ক বিবেচনা করা হয় সাঈদ নুরসিকে।

ষাটের দশকের শুরুর দিকে সাঈদ নুরসি ইন্তেকাল করেন। কিন্তু তাঁর তিন দশকের মেহনতে পুরো তুরস্ক জুড়ে রেখে যান রেসালায়ে নুরের লাখ লাখ একনিষ্ঠ পাঠক। রেখে যান বেশুমার অনুসারী। তাঁর ইন্তেকালের পর এরাই আঁকড়ে ধরেন তাঁর মিশনকে, এবং নুর জামাত নামে তাঁরা পুরো বিশ্বে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

নুরসির অনুসারী এবং রেসালায়ে নুরের পাঠকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মূলত কলেজ-ইউনিভার্সিটির শিক্ষক-শিক্ষার্থী। নুরসি চেয়েছিলেন আধুনিক শিক্ষিতদের আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক পরিচর্যা করতে, তাই কলেজ-ইউনিভার্সিটিগুলোতেই এ মিশনের লোকজন জোরদার কার্যক্রম চালান। কেন্দ্র-ভিত্তিক কাজ করেন তাঁরা। কেন্দ্রগুলো সাধারণত ম্যাচের আদলে হয়। কলেজ-ভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাঁরা রেসালায়ে নুরের চর্চা করেন, তাঁরা আবাসিকভাবে কেন্দ্রগুলোতে থাকেন। দিনের বেলা ভার্সিটিতে ক্লাস করেন, বাকি সময় কেন্দ্রে অবস্থান করে রিসালায়ে নুর পঠন-পাঠন ও আধ্যাত্মিক মেহনতের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন। এ সকল কেন্দ্রের অফিসিয়াল কোনো নাম নেই, নেই প্রাতিষ্ঠানিক কোনো আদলও। তবে সাধারণত মাদরাসায়ে নুর নামে ডাকা হয়।

নুর জামাতের কার্যক্রমের জন্য যাঁরা নিজেদের উৎসর্গ করেন এবং দিনরাত কেবল এ মেহনত নিয়েই থাকেন তাঁদেরকে ওয়াকেফ বলা হয়। ওয়াকেফ হবার জন্য শর্ত হলো দুনিয়াবি সকল ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকতে হবে, এমনকি সাংসারিক বা বিবাহিতও হতে পারবেন না। তবে হ্যাঁ, বিয়ে করতে কোনো বাধা নেই এবং দুনিয়াবি বা অন্য কোনো ব্যস্ততায় জড়িয়ে থেকেও এ কাজ করা যায়, তবে তখন তিনি আর ‘ওয়াকেফ’ থাকবেন না। নুরসি জামাতের এ হলো আলাদা বৈশিষ্ট্য। মেহনতের জন্য উৎসর্গিত একটা দল রাখার জন্যই মূলত এ পদ্ধতি। তাই নুরসি জামাতের সঙ্গে যাঁরা সম্পৃক্ত তাঁদের অনেকে পড়াশোনা শেষ করার পর কিছুদিন ওয়াকেফ হিসেবে থেকে নিবিষ্ট মনে খেদমত করেন, পরে বিয়ে-শাদি করে সাংসারিক জীবন শুরু করেন। আবার অনেকে এমন আছেন, যাঁরা এ মেহনতে এতটাই উৎসর্গিত হয়ে যান যে, দুনিয়াবি কাজকর্মে তাঁদের অনীহা চলে আসে, এমনকি বিয়ে-শাদিরও আর জরুরত বোধ করেন না। ফলে জীবনভর তাঁরা ওয়াকেফই থেকে যান।

পদ্ধতিটা এসেছে মূলত সাঈদ নুরসির কাছ থেকে। আধ্যাত্মিক মেহনতে তিনি এতটাই ব্যস্ত জীবন পার করেছেন যে, বিয়ে-শাদি করে সাংসারিক হবার অবসরটুকু তাঁর ছিল না। জানা যায়, এ জন্য তিনি শেষজীবনে আফসোসও করেছিলেন। বলেছিলেন, জীবনে দুটো সুন্নত তরক করার কাফফারা স্বরূপ হয়তো আল্লাহ পাক আমাকে জীবনভর কেবল পরিশ্রমই করিয়েছেন। এক হলো, বিয়ে না করা, আর দ্বিতীয়টা দাঁড়ি না রাখা।

তুরস্কসহ বর্তমানে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, ইরান, আফ্রিকার মৌরতানিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নুরসি জামাতের কার্যক্রম চলমান। তুরস্কের ইস্তাম্বুলেই মাদরাসায়ে নুর নামে পরিচালিত তাঁদের কেন্দ্রের সংখ্যা এক হাজারের ওপরে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন তুরস্কের অন্যান্য প্রদেশ ও শহরে এর সংখ্যা আরও বেশি। সৌদি আরবের ১০টি শহরে আছে মাদরাসায়ে নুরের কার্যক্রম।

মাদরাসায়ে নুরের মূল কার্যক্রম হচ্ছে রেসালায়ে নুর অধ্যয়ন এবং চর্চা। প্রতিটা কেন্দ্রেই পাঞ্জেগানা নামাজের ব্যবস্থা থাকে। কেন্দ্রে অবস্থানকারীরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এখানেই আদায় করেন। নামাজের পর তসবিহ ও দোআর বিশেষ আমল থাকে। আমল শেষ হলে রেসালায়ে নুর থেকে অল্প খানিক তালিম হয়। এ ছাড়া প্রতিদিন একঘণ্টা সম্মিলিতভাবে রেসালায়ে তালিমের চর্চা হয়। এর বাইরে ব্যক্তিগতভাবে কিতাবটি অধ্যয়ন ও গবেষণায় নিরত থাকেন কেন্দ্রের বাসিন্দারা। কেন্দ্রের জিম্মাদার থাকেন অভিজ্ঞ ও পুরনো কোনো ওয়াকেফ। জিম্মাদার ওয়াকেফ ছাড়া আরও একাধিক ওয়াকেফ থাকেন প্রতিটা কেন্দ্রে।

বাংলাদেশেও প্রায় বছর দশেক হলো নুরসি জামাতের কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে রাজধানীর আজিমপুরে অরফানেজ রোডে একটি ভাড়া বাসায় পরিচালিত হচ্ছে মাদরাসায়ে নুরের কার্যক্রম। নুরসি জামাত এবং তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এক দুপুরে যাওয়া হয়েছিল আজিমপুরস্থ তাদের সেই কেন্দ্রে। বক্ষমাণ লেখাটির যাবতীয় তথ্য মূলত কেন্দ্রের ওয়াকেফদের আলাপচারিতা থেকেই নেওয়া।

বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রমের বছর দশেক পার হলেও মনে হলো এখনও পুরোপুরি গোছিয়ে উঠতে পারেননি তাঁরা। তিন-চারজন তুর্কি ওয়াকেফ নিয়মিত থাকেন আজিমপুরের কেন্দ্রে। বাংলাদেশি বেশকিছু তরুণ তাঁদের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন বর্তমানে ওয়াকেফ হিসেবে আছেন। এ ছাড়া সেমিনার-সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠান এবং রেসালায়ে নুর থেকে চয়ন করে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর পুস্তক প্রকাশ করে সাঈদ নুরসির আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা বিস্তারে কাজ করছেন তাঁরা। বাংলাদেশের অনেক ওলামায়ে কেরামের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখেন। সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হলে তাঁদেরকে অতিথি হিসেবে নিমন্ত্রণ করেন।

যেসব ওয়াকেফের সঙ্গে দেখা হলো সেখানে, তাঁদের প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত। তুরস্কের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট। বয়সে প্রায় সকলেই তরুণ। একজন কেবল খানিকটা প্রৌঢ়। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। সৌদি আরবের বাসিন্দা তিনি। এবং বর্তমানে সৌদি আরবে নুরসি জামাতের কার্যক্রম পরিচালনার অন্যতম জিম্মাদার। নিজেকে প্রকাশ করতে চান না খুব একটা। তারপরও আলাপচারিতার ফাঁকে বিক্ষিপ্তভাবে জেনে নিলাম তাঁর জীবনের গল্প।

১৫-১৬ বছর বয়সে যখন তিনি স্কুলে পড়েন, নুরসি জামাত ও রেসালায়ে নুর সম্পর্কে তাঁর এক শিক্ষকের কাছ থেকে সর্বপ্রথম জানতে পারেন তিনি। তাঁর পরিবার খুব দীনদার ছিল, ধর্মকর্ম পালনে বেশ কড়াকড়ি আরোপিত হতো পরিবার থেকেই। নামাজে গাফলতি করা যেত না। শরিয়াহ-অপছন্দ কোনো কাজ করা যেত না। তিনি অনেকটা বাধ্য হয়ে ধর্মকর্ম পালন করতেন। নামাজ পড়তেন, ঠিকমতো অন্যসকল এবাদত বন্দেগিও করতেন—কিন্তু সবই পারিবারিক চাপের কারণে। কোনো স্বাদ পেতেন না এসব আমলে। তারপর তাঁর সেই শিক্ষকের কল্যাণে যখন রেসালায়ে নুর অধ্যয়ন শুরু করলেন, নিজের ভেতর বিস্ময়কর এক পরিবর্তন লক্ষ করলেন। ইবাদত-বন্দেগিতে অদ্ভুত ধরনের একটা স্বাদ পেতে লাগলেন। তারপর থেকেই নুরসি জামাতের সঙ্গে সম্পৃক্তি। নুরসি জামাতের টানেই উচ্চশিক্ষার জন্য তুরস্কে পাড়ি জমান। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর পড়াশোনা শেষ করে নিজের জীবনকে এখন উৎসর্গ করেছেন রেসালায়ে নুর ও নুরসি জামাতের খেদমতে।

ফরমাল ইন্টারভিউ দিতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলেন না বিধায় জিজ্ঞেস করা হয়নি, জীবনটা এভাবেই পার করে দেবেন কি-না। তবে আলাপচারিতায় মনে হলো রেসালায়ে নুর ঈমানের যে স্বাদ তাঁকে আস্বাদন করিয়েছে, একজীবনে হয়তো আর সংসারমুখো হবার আগ্রহ পাবেন না তিনি।

আরও পড়ুন : নুরসি : ধর্মনিরপেক্ষতার মোকাবেলায় দাঁড়ানো তুর্কি দরবেশ

আগের সংবাদআজাদীর বাহাত্তর বছর : সিলেট যেভাবে পাকিস্তানের অংশ হলো
পরবর্তি সংবাদহাসান রোবায়েতের কবিতা