দারুননাজাত থেকে ঢাবি: দূরত্ব কতদূর?

হাসান ইনাম:

দারুননাজাত। পাঁচ বছর বেশ বড় সময়। অল্প কয়েকটা শব্দে হাজার দিনের দিনলিপি কিভাবে আটকাবো? দারুননাজাত থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে কতক্ষণ লাগে? দারুননাজাত মাদরাসার সামনে থেকে রিকশা নিয়ে চিটাগাং রোড অথবা স্টাফ কোয়ার্টার। এরপর বাসে শাহবাগ বা চানখারপুল। বড়জোর এক ঘন্টা। খুব বেশি জ্যাম না থাকলে ত্রিশ মিনিটেও যাওয়া যায়। কিন্তু আমার পাঁচ বছর লেগে গেলো। এই পাঁচ বছরের জার্নির কথা কিভাবে লেখবো কয়েক শো শব্দে? রাস্তায় কত কত মানুষের সাথে দেখা হলো। কত কত মানুষ যাত্রাসঙ্গী হলো, কত মানুষকে হারিয়ে ফেললাম।

তবে এমন একটা লেখা লেখবো আমি ভেবেছি অনেকবার। হলের ছাদে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভেবেছি, শীতের রাতে হলের বারান্দায় বসে ভেবেছি। একা একা শীতলক্ষ্যার পাশে হাঁটতে হাঁটতে ছক কষেছি। কিন্তু এখন স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বিহ্ববল হয়ে বসে আছি। তাসের ভর্তি পরীক্ষার দিনের কথা মনে পড়ছে। আমাদের ক্লাসগুলোর নাম আরবিতে ছিল। খামেস, সাদেস, সাবে, তাসে, আশের। আমার তাসে অর্থাৎ ক্লাস নাইনে দারুননাজাতে ভর্তি হই। আমার ধারণা ছিল আমি ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করবো। আমি দুটো পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে খুব টেনশনে ছিলাম। একটা ঢাবির ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট আরেকটা তাসের৷ পরীক্ষার দিনেই রেজাল্ট দিয়ে দেয়৷ আমি মসজিদে বসে আছি৷ খুব চিন্তা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে একটু খুশিও হচ্ছি যে পরীক্ষা খারাপ যেহেতু হয়েছে রেজাল্ট আসবে না৷ আর পাশ না করলে এখানে ভর্তি হতে হবে না। সম্ভবত দারুননাজাতে আসা সব ছাত্র প্রথমেই এটা ভাবে৷ কিন্তু দেখা গেলো আমি পাশ করে গেলাম কোনরকমে৷ ভর্তিও হয়ে গেলাম। দারুননাজাতে নিয়মিত ক্লাস করা বাধ্যতামূলক৷ তাই কওমি মাদরাসার পড়াশোনা শেষ। নতুন যাত্রা শুরু হলো৷

তখন আমার প্রথম বইটা কেবল বের হইছে। ভিতরে ভিতরে বড়সড় লেখক ভাব নিয়ে হাঁটি৷ দারুননাজাতে ভর্তি হওয়ার আগের দুই-তিন বছর খুব এক্টিভ লেখালেখিও করেছি। কেবল লেখালেখি না আরো অনেককিছুই৷ এখনও আমি সেইসব কাজ বা নেটওয়ার্কিং নিয়েই চলছি। তাই স্বভাবতই একটা হামবড়া ভাব ছিল আমার ভিতর৷ দারুননাজাতে যাওয়ার পর সেটা ভেঙে গেলো। আবিষ্কার করলাম আমি কিছুই না৷ কেউ আমাকে চিনে না৷ একটা ঠুনকো মায়াজালের ভিতরে যে ছিলাম কিছুদিন সেটাও আস্তে আস্তে বুঝতে শিখলাম। দারুননাজাতে এসে আমি আমার লেখক পরিচয় বা অন্যসবকিছু পুরোপুরি বুক পকেটে রেখে দিলাম। মাদরাসার ভিতরে খোয়ানি হলের পাঁচ তলায় থাকি৷ নিয়মিত ক্লাসে যাই। সবার সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার উঠাই৷ রাতের বেলা লাইটের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে যাই৷ লাইট কেন অফ করে না রাতে সেটাও কাউকে জিজ্ঞেস করি না। মাদরাসার ভিতরের হলগুলো হেফজখানার মতো বা কওমি মাদরাসার মতোই। বাইরের হলগুলো রুম রুম। প্রত্যেক রুমে তিনটা বা চারটা খাট৷ ভর্তির সময় যাকে যেই হল দেয়া হয় সেখানেই থাকতে হয়, সেখান থেকে নড়াচড়া খুব কষ্টের কাজ৷ কিন্তু কয়েকমাস পরেই আমি বাইরের একটা হলে চলে যাই৷ আননাজাত নামে নতুন একটা হলে উঠি।

মাঝখানে বলে রাখি পড়াশোনার কোনো কথাই আমি এই লেখায় আনবো না। যদি ভুলে একটা-দুটো চলে আসে সেটা ভিন্ন কথা। যাইহোক, এদিকে আমার ততোদিনে নতুন নতুন বন্ধু হচ্ছে৷ রকিব, আমান, নাবিল, আনিস, তাউসিফ, মিয়াদ, মাইনু, রোকন, সাখাওয়াত…। আমান আমার নতুন হলের রুমমেট৷ আননাজাত হলে আমরাই ছিলাম সিনিয়র৷ আর ক্লাস সেভেন বা সিক্সের কিছু ছাত্র ছিল। মাত্র কয়েকমাস ছিলাম। তবে সময়গুলো খুব দারুণ কেটেছে। আননাজাত হলে থাকতেই একটা ঘটনা আমার জীবনের মোড় অনেকাংশে ঘুরিয়ে দেয়। একদিন বিকালে স্থানীয় কিছু বখাটে ছেলেরা আমাকে আক্রমণ করে। মূলত আমার মোবাইল নেয়ার জন্য ওরা আমাকে ধরেছিল। মাদরাসারায় যাওয়ার রাস্তায় একটা পরিত্যক্ত ভবন আছে। ওরা আমাকে ডেকে ওখানে নিয়ে যায়। এই ঘটনা অনেক বড়। সারকথা হলো আমি ওদের হাত থেকে ছুটে মাগরিবের আগেই মসজিদে ঢুকে যাই। ওইদিন ছিল বৃহস্পতিবার। প্রতি বৃহস্পতিবার মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত মাদরাসার মসজিদে এসলাহি জলসা হয়। আমি মসজিদে নামাজের পর সবার সাথে বসে বয়ান শুনছি। এদিকে বাইরে রটে গেছে আমাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। হুলস্থুল অবস্থা। আমি হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে ওদের হাত থেকে ছুটে যখন বের হয়েছি তখন সামনেই দেখি আমার ক্লাসের এক ছাত্র। ওরে শুধু বলেছি, আমাকে ওরা মারধর করছে। তুমি গিয়ে কোন একজন হুজুরকে বলো। ওই ছেলে দৌড়ে গিয়ে মোহাম্মদ স্যারকে জানাইছে। আমি কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মসজিদের দিকে চলে গেছি। মাথায় পানিটানি দিছি। মোহাম্মদ স্যার আরো কিছু ছাত্র নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই হয়তো আসছে। কিন্তু তখন তো আমি মসজিদে। আমি নতুন একটা ছাত্র। সব হুজুর, সব ছাত্র আমাকে এই পরিচয়ে চিনলো যে, আমি মাইর খাইছি। আমি ট্রমার ভিতর পড়ে গেছিলাম। ট্রমা থেকে বের হওয়ার জন্য বুক পকেট থেকে লেখক সত্তা বের করে আনলাম আবার। একদিন সাহস করে প্রিন্সিপাল হুজুরের রুমে একটা লেখা নিয়ে গেলাম। হুজুর সাহিত্যানুরাগী৷ মাদরাসার নিজস্ব মাসিক পত্রিকা আছে। বিভিন্ন স্মারক আর স্মরণিকা বের হয় নিয়মিত। সবচেয়ে বড় কথা মাদরাসার নিজস্ব একটা প্রকশনী আছে।
হুজুরকে আমার লেখাটা দেখালাম। বেশ খুশি হলেন। মুচকি হেসে বললেন, ‘লেখক মানুষ আবার মাইর খায় কেমনে?’
এরপর আস্তে আস্তে ওইদিনের ঘটনা চাপা পড়ে গেলো। মাদরাসার পত্রিকা মাসিক বিকাশে আমার ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপা হতে শুরু করলো। প্রিন্সিপাল হুজুরের নির্দেশে আমি আননাজাত হল ছেড়ে রিয়াজুল জান্নাত- ১২ নম্বর হলে উঠলাম।

বারো নাম্বার হলে ওঠা আমার জীবনের আরেকটা টার্নিং পয়েন্ট। আমি যেই রুমে উঠলাম ওই রুমে নাকি কলরবের আবু রায়হান থাকতো। ভালো একটা সার্কেল পেলাম৷ পরিবেশও খুব সুন্দর। বড় মাদরাসা বা বড় প্রতিষ্ঠানে পড়লে নিজের স্বপ্নটা বড় হয়। এছাড়া আর তেমন কিছুনা। সবখানেই সিলেবাস এক, পড়াশোনা এক। আমার রুমমেট ছিল মাহমুদ ভাই। মাহমুদ ভাই এখন মিশরে আল-আজহারে পড়েন। আমরা যখন আশেরে পড়ি তখন দারুননাজাত থেকে প্রায় ৬৬ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়। আমার হলের মোজাম্মেল ভাই ডি ইউনিটে দশের ভিতরে ছিল। এছাড়াও মুহসিন ভাই, জাওয়াদ ভাই সহ হলের অনেকেই চান্স পায়৷ এরকম কাছ থেকে সফলতা দেখলে স্বপ্নটা আর স্বপ্ন থাকে না। মনে হয় বাস্তব। আমার মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চিন্তা তখন একটু একটু আসছে।
শাহবাগ মোড়ে বড় স্ক্রিনে খেলা দেখানোর কথা। টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ চলছে তখন। সেদিন কোনো কারণে খেলা বন্ধ অথবা সম্প্রচার বন্ধ। আমি টিএসসি বসে আছি। যিয়াদ আসবে বলেছিল, আসেনি। আমি একা বসে আছি। তীব্র রোদ, তপ্ত দুপুর। ওই দুপুরে সম্ভবত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার স্বপ্ন প্রথম দেখেছিলাম। এর আগে রাত বিরাতে, সকালে বা বিকালে বহু বসে ছিলাম ফুলার রোডে, উদ্যানে বা টিএসসিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার কথা চিন্তাও করেছি বা ভেবেছি। কিন্তু সেদিন দুপুরের ব্যাপারটা ভিন্ন। বুকের ভিতর কেমন যেন একটা ছটফটানি। আমি তখন ক্লাস নাইনে।

এই স্বপ্নটা আরো বড় করে তুললো মোহাম্মাদ বিন ইয়াহয়া স্যার। ক্লাস নাইনে স্যারের অসামান্য সব মোটিভেশন, জীবন চলার পাথেয় আমাকে একটু একটু করে সাহসী করে তুলছিল। ভয়াবহতা বা লড়াই সম্পর্কে তখনও কিছু জানি না।

দারুননাজাতে আমাকে আরো একটু জায়গা করে দিল ‘রেনেসাঁ’। ‘রেনেসাঁ’ আমাদের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আমি ক্লাস নাইনেই নাম লেখায় অভিনয়তে। ইংরেজি স্যারের নজরে আসি। স্যার আমাকে নাট্যকার বলে ডাকতেন। আমাদের দাখিল পরীক্ষার রেজাল্টের আগেই স্যার মারা গেলেন। আমি এখনও একাডেমিক ভবন বা মসজিদের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় শুনি স্যার আমাকে নাট্যকার বলে ডাকছে।

দাখিল পরীক্ষার পর আলিমেও দারুননাজাত ভর্তি হই। আগের ছেলেমানুষিগুলো কমে যেতে থাকে। মাদরাসায়ও কিছুটা সিনিয়র হয়ে যাই। আলিমে ‘ডিবেট’ করার সুযোগ পাই। দারুননাজাতের সব হীরাপান্না ছাত্রদের সাথে ডিবেট করতে গিয়ে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সাইফুল্লাহ, জাকারিয়া আমি আর কামরুল ভাই ছিলাম আমাদের শাখার ডিবেট দলে। আমরা প্রথমে আলিফ শাখার সাথে জিতে যাই৷ সাফওয়ান, রাশেদ, আশিক, হুজাইফা ছিল আলিফ শাখার ডিবেট দলে। ওদের সাথে জিতে যাওয়া মানে অনেক বড় কিছু৷ সাইফুল্লাহ, জাকারিয়া থাকতে কোন এক অজানা কারণে আমাকে দলনেতা বানানো হয়েছিল। আলিফ শাখার সাথে জিতে ফাইনাল রাউন্ডে দাল শাখার সাথে হেরে বসি৷ আলিম ফার্স্ট ইয়ার এই ডিবেটেই কেটে যায়৷ সেকেন্ড ইয়ারে ক্লাস ছিল অল্প কয়েকদিন। আমাকে আবার রেনেসাঁর থিয়েটার পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়। এটাও ছিল পরম সৌভাগ্য।

দারুননাজাতে ক্লাস থেকে ক্লাসের বাইরে আমি বেশি শিখেছি। নতুন নতুন অনেক কিছু ভাবতে শিখেছি, করতে শিখেছি। আমার দারুননাজাত এমন একটা মাদরাসা, এখান থেকে আপনি যা হতে চান, তাই হয়েই বের হতে পারবেন। আলিম পরীক্ষা তো আর হলো না। করোনার শুরুতে বাসায় চলে আসি। আমার অন্যান্য বন্ধুদের তুলনায় আমি দারুননাজাতের জার্নিটা ছোট। কিন্তু আমার মনে হয় অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের দিক থেকে আমি একটু বেশি সুযোগ পেয়েছি। এই ছোট্ট লেখাটায় আমি তেমন কিছুই বলতে পারলাম না। আমি যাত্রাপথের কুসুমাস্তীর্ণ অংশটুকুর কথাই লেখলাম। মহাসড়কে ওঠার আগে যে অসংখ্য গলি-ঘুপচি আর গলি-ঘুপচিতে ঘাপটি মেরে থাকা বিষাদ, কষ্ট আর হতাশা, তাদের কথা আর লেখলাম না। তোমকে ধন্যবাদ দারুননাজাত, আমাকে নতুন করে পথ চলতে শেখানোর জন্য।

আগের সংবাদব্রিটেনে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা, সমর্থন জানালেই শাস্তি
পরবর্তি সংবাদ‘গেস্টরুম’ বন্ধে ফেসবুকে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পোস্ট, ৫ ছাত্রকে ছাত্রলীগের নির্যাতন