পদ্মাসেতু উদ্বোধন : সরকার ভাস্কর্য নির্মাণ থেকে সরে এসেছে?

রাকিবুল হাসান নাঈম:

২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সারা দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই অংশ হিসেবে ঢাকার প্রবেশমুখ রাজধানীর ধোলাইপাড় মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু ভাস্কর্য নিয়ে ধর্মীয় মহলের আপত্তি ও বিরোধিতার মুখে ভাস্কর্যটি নির্মাণের কাজ স্থগিত সরকার। তারপর একবছর পেরিয়ে গেছে। উদ্বোধন হয়েছে স্বপ্ন ও প্রত্যাশার পদ্মা সেতু। দেশের গণমাধ্যম এবং কর্তারা মেতে আছেন সেই উৎসবের আমেজে। ধোলাইপাড়ের ভাস্কর্য নিয়ে সবাইকে চুপ দেখে ধারণা হতে পারে, ভাস্কর্য নির্মাণ থেকে সরকার এসেছে। আসলেই কি তাই? সংশ্লিষ্টগণ বলছেন, ভাস্কর্য নির্মাণ থেকে সরকার সরে আসেনি। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে আরও দেরী হবে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা।

সরেজমিন ধোলাইপাড় মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, টিন দিয়ে আগের মতোই ঘিরে রাখা হয়েছে ভাস্কর্যের জন্য নির্ধারিত স্থানটি। ভাস্কর্যের বেদি পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ। এর ওপরে শুধু ভাস্কর্য স্থাপন বাকি। তবে শেষ পর্যন্ত ওই জায়গায় পূর্ব নির্ধারিত ‘মুজিব ভাস্কর্য’ হবে কিনা সেটি কেউ নিশ্চিত করে বলেতে পারেননি। এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ঘোষণাও নেই। বরং ভাস্কর্যটি স্থাপনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে গোপনীয়তা দেখা যাচ্ছে।

কর্তৃপক্ষ কী বলছেন?

ভাস্কর্যটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের যে প্রকল্পের অধীনে বাস্তবায়নের কথা ছিল তার প্রকল্প পরিচালক সবুজ উদ্দিন খান। তাকে ফোন দিলে তিনি বিষয়টিকে ‘স্পর্শকাতর’ উল্লেখ করে বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হননি। তবে তিনি ফাতেহকে জানিয়েছেন,

‘ভাস্কর্যটি মূল প্রকল্প থেকে এখনো বাদ দেয়া হয়নি। যখন সময় হয়, তিনি কথা বলবেন। এখন আর এটি নিয়ে কথা বলবেন না। বিষয়টি নিয়ে সেনাবাহিনী কাজ করছে।’

বর্তমানে বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের কোনো ভাস্কর্য স্থাপন করতে হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অনুমোদন নিতে হয়। চলতি বছরের মার্চে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য একং কিউরেটর মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান জানিয়েছিলেন, জাতির জনকের কোনো ভাস্কর্য করতে হলে এখানে (ট্রাস্টে) আবেদন করতে হবে। বাছাই কমিটিতে বাছাই হবে। তারপরে মূল কমিটি যেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে, যিনি এই ট্রাস্টের সভাপতি, সেখানে একটা মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হবে। আমার জানামতে আলোচিত ওই ভাস্কর্য স্থাপনের কোনো আবেদন এখানে করা হয়নি।

আজ তাকে ফোন দিলে তিনি জানান, ‘তিনি কোভিডে আক্রান্ত। এখন হোম অফিস করছেন, অফিসে যাচ্ছেন না।’তবে ফাতেহকে তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণের আবেদন এখনো জমা পড়েছেন কিনা, তিনি জানেন না। তিনি ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাশুরা হোসেনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। দুঃখজনক হলো, মাশুরা হোসেনের সঙ্গে যোগযোগ করা যায়নি।

তাই বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য এবং ট্রাস্টের এসিস্ট্যান্ট কিউরেটর কাজী আফরীন জাহানের সঙ্গে ফাতেহের পক্ষ থেকে কথা বলা হয়।

তিনি প্রতিবেদককে জানান, ‘কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণের আবেদন জমা দিয়েছেন।’আবেদনের পর অনুমোদনের কাজ কতদূর জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনো ট্রাস্টের পক্ষ থেকে অনুমোদন দেয়া হয়নি। বিষয়টিতে সময় লাগবে।’

ভাস্কর্য স্থাপনের জন্য মসজিদ স্থানান্তর

মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নেমে সোজা এগোলে ধোলাইপাড় মোড়ে ভাস্কর্যের বেদিটি টিন দিয়ে ঘিরে রাখা। পূর্ব পাশে রাস্তা ঘেঁষে বাইতুশ শারফ জামে মসজিদ। মসজিদটি আগে রাস্তার ওপরই ছিল। এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজের সময় রাস্তা সম্প্রসারণের সময় এর বেশির ভাগ অংশই ভাঙা পড়ে।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট আরেকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে জানান, ধোলাইপাড় মোড়ে আগের জায়গাতেই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার আগে সেখানকার একটি মসজিদ স্থানান্তর করা হবে। মসজিদের জন্য নতুন জায়গা ইতোমধ্যেই দেখা হয়ে গেছে।

মসজিদ স্থানান্তরের কারণ জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, মসজিদটি সরকারি রাস্তার ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল, তাই এটির বৈধতা ছিল না। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের সময় মসজিদের বেশ কিছু অংশ ভেঙে ফেলতে হয়।

মসজিদ কমিটির সভাপতি হাজি মো. আজাদ খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাস্তা নির্মাণের সময় আমাদের এই মসজিদটি ভাঙা পড়েছিল। পরে হেফাজতের আন্দোলনের সময় এটি পুনর্নির্মাণের দাবি উঠেছিল। তখন এটি আবার ব্যবহারোপযোগী করে দেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু ছয়-সাত মাস আগে এমপি সাহেব আমাদের ডেকে বললেন, আমাদের মসজিদটা আরও বড় করে বানিয়ে দেবে সরকার। এ জন্য পাশেই একটা জায়গা দেখা হয়েছে। আমরাও এই বিষয়ে কোনো আপত্তি করিনি, কারণ যদি আরও বড় মসজিদ হয়, তাহলে বেশি মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারবে।’

ঢাকা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবু হোসেন বাবলা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাস্তা বড় করার জন্য মসজিদ ভাঙা হয়েছিল। তাই এখন নতুন মসজিদ করে দেয়া হচ্ছে।’

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই অংশ হিসেবে পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকার প্রবেশমুখ রাজধানীর ধোলাইপাড় মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০২০ সালের নভেম্বরে ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করে আন্দোলন হয়। ধর্মীয় মহল ভাস্কর্যকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে এটি প্রতিরোধে মাঠে নামে। মাঠে নামেন চরমোনাই পির ফয়জুল করীম, কড়া হুমকি দেন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। সর্বশেষে হেফাজতের আমির জুনাইদ বাবুনগরী রহ.ও ঘোষণা করেন কঠিন হুশিয়ারি। সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে তখন আলেমদের মতবিনিময়ও হয়। এর পরপরই সরকার ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ স্থগিত করেন।

আগের সংবাদঢাবির ‘খ’ ইউনিটের ফল প্রকাশ, ৯০ শতাংশই ফেল
পরবর্তি সংবাদশিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করলো দশম শ্রেণির ছাত্র!