‘পরিবার পরিকল্পনার বিষবৃক্ষ’ : রাষ্ট্র যেভাবে বন্ধ্যাত্বকরণে উৎসাহিত করছে

মুনশী নাঈম:

প্রজননের হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় এগিয়ে। সক্ষম দম্পতির মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে কিছু রয়েছে স্থায়ী পদ্ধতি। যেগুলো ব্যবহারের ফলে নারী কিংবা পুরুষ বন্ধ্যা হয়ে যায়।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের হার বাড়ছে। কেউ যদি দীর্ঘমেয়াদী কিংবা স্থায়ী জন্মনিরোধক গ্রহণ করতে চায়, অনেকক্ষেত্রে সরকার তাকে সাহায্য করে। এমনকি তাকে সবিশেষ উপহারও দেয়া হয়। পাশপাশি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান খাতে প্রতি বছর বাড়ছে বরাদ্দ। গত দশ বছরে মূল বাজেটের ৪ থেকে ৬ শতাংশ বরাদ্দ থাকছে এই খাতে।

বিনামূল্যে জন্মনিরোধক ও উপহার

বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে জন্মদানে সক্ষম দম্পতিদের মাত্র প্রায় ৮ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করতেন আর ২০১৯ সালে সে হার দাঁড়ায় ৬৩ দশমিক ১ শতাংশে। ২০২২ সালে সেটা ৮০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই। তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে শহর অঞ্চলের মতো গ্রামাঞ্চলেও নারীরাই বেশি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির আওতায় আছেন।

দশকের পর দশক ধরে নারীদের বিনামূল্যে জন্মনিরোধক দিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার৷ নিয়মিত জন্ম নিরোধক বড়ি বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷

কিশেরারগঞ্জের মাঠ পর্যায়ের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সাইদুর রহমান বলেন, যারা দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা নিতে চান, তাদের নিরোধক ও স্বাস্থ্যসেবা পুরোপুরি বিনামূল্যেই দেয়া হয়৷ পাশাপাশি আমরা প্রয়োজনে তাদের অর্থ সহায়তা ও উপহারও দিয়ে থাকি৷ অনেক রক্ষণশীল পরিবারের নারী তাদের স্বামীকে না জানিয়েই জন্ম নিরোধক বড়ি সেবন করে থাকেন৷

পরিবার-পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বুকলেটের তথ্যমতে, বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণে যেসব পদ্ধতি এখন ব্যবহার হচ্ছে সেগুলো হলো: খাবার বড়ি, কনডম, জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশন, ইমপ্ল্যান্ট, আইউডি, ভ্যাসেকটমি ও টিউবেকটমি। এর মধ্যে ভ্যাসেকটমি বা এনএসভি পুরুষদের স্থায়ী পদ্ধতি ও টিউবেকটমি বা লাইগেশন মেয়েদের স্থায়ী পদ্ধতি। আর অস্থায়ী পদ্ধতির মধ্যে ইমপ্ল্যান্ট ও আইউডি দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি।তবে অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, খাবার বড়ির মতো না হলেও অনেক নারী ইনজেকশনও গ্রহণ করছেন। এই ইনজেকশনটি প্রতি তিন মাস পরপর নিতে হয়।

এরমধ্যে খাবার বড়ি ব্যবহার সবগুলো পদ্ধতির মধ্যে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ এবং ইজেকশন ১১ শতাংশ। সেই হিসাবে পুরুষদের জন্য যে দুটি পদ্ধতি তার মধ্যে কনডমের ব্যবহার হচ্ছে মোট ৭ শতাংশ। পুরুষদের ভ্যাসেকটমির হার মোট ১ শতাংশ।

অসুবিধাগুলো জানানো হয় কম

জন্মনিয়ন্ত্রণের যেসব পদ্ধতি নারীদের জন্য রয়েছে তার অনেকগুলোরই রয়েছে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। কিন্তু প্রচারণার সময় অসুবিধাগুলো কমই জানানো হয়। বরং সুবিধাগুলোর প্রচারণাই বেশি করা হয়। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরই তার প্রচারণায় এসব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য দিয়ে থাকে। যেমন কপার টি ব্যবহার করলে তলপেটে ব্যথা হতে পারে, নিয়মিত ফোটা ফোট রক্তস্রাব হতে পারে। অনেক সময় প্রদাহ হতে পারে। চামড়ার নিচে বসিয়ে দেয়া জন্মনিয়ন্ত্রণ ক্যাপসুলে মাসিক অনিয়মিত অথবা উল্টো আবার রক্তস্রাব বেশি হতে পারে। মাথা ব্যথা হতে ব্যথা হতে পারে। ওজন বেড়ে যেতে পারে।

ইনজেকশনেও একই ধরনের সমস্যা হয় ব্যবহারকারী নারীদের। খাবার বড়ি হরমোনে প্রভাব ফেলে। মাসিকের পরিমাণ কমে যায়। যোনিপথ শুষ্ক হয়ে যায়। এসব অসুবিধা সহ্য করেই নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে হয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের এনজিও ও গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেল এক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রেখেছে৷ যেসব জায়গায় পরিবার পরিকল্পনা কর্মীরাও পৌঁছাতে পারেননি, সেখানেও নানা ধরনের প্রচার চালিয়ে কম সন্তান নেয়ার ভালো দিকগুলো তুলে ধরেছে গণমাধ্যম৷

ভবিষ্যৎ প্লান কী

জনবহুল বাংলাদেশে ৫০ বছর আগে অর্থাৎ স্বাধীনতার পর পর প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট-টিএফআর) ছিল ৬ দশমিক ৩। অর্থাৎ ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী একজন প্রজননক্ষম নারী গড়ে ছয়টির বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন। পাঁচ দশক ধরে টিএফআর ক্রমান্বয়ে কমেছে। সর্বশেষ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে টিএফআর ছিল ২ দশমিক ৩। ইউএনএফপিএ তাদের প্রতিবেদনে বলছে, বাংলাদেশের টিএফআর এখন ১ দশমিক ৯। এর অর্থ একজন প্রজননক্ষম নারী সারা জীবনে দুটির কম সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ফিল্ড সার্ভিসের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. পীযূষ চন্দ্র সূত্রধরের সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘২০২০ সালে হিসাব অনুযায়ী আমাদের প্রজনন হার বা নারীপ্রতি সন্তান জন্ম (টিএফআর) ২.৩ শতাংশ। আমাদের লক্ষ্য হলো, ২০২৪ সালের মধ্যে এটা ২ শতাংশে নিয়ে আসা। ইতোমধ্যে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের জন্মনিরোধক ব্যবহার করছে প্রায় ৮০ শতাংশ সক্ষম নারী-পুরুষ।’

রংপুর ও খুলনায় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলেও সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে বাস্তবায়ন করতে পারছেন না বলে জানান প্রোগ্রাম ম্যানেজার। তিনি বলেন, ‘সারা দেশে মোট প্রজনন হার বা নারীপ্রতি সন্তান জন্ম (টিএফআর) যেখানে ২ দশমিক ৩ জন, সেখানে সিলেটে তা ২ দশমিক ৯ জন। আর চট্টগ্রামে তা ২ দশমিক ৫। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারেও এই দুটি বিভাগে দম্পতিরা পিছিয়ে। সিলেটে তা ৪৮ এবং চট্টগ্রামে ৫৫ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে রংপুর ও খুলনা বিভাগ। রংপুর ও খুলনায় তা ১ দশমিক ৯ জন।’

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এ দুটি বিভাগে ধর্মীয় আবহ বেশি। ফলে মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে চায় না। আরেকটি কারণ হলো, এ দুটি বিভাগের ভাষা-দুর্বোধ্যতা। আমাদের তেমন কর্মী নেই। তাদের সঙ্গে আমাদের কন্টাক্ট খুব সহজ হয় না।’

আগের সংবাদজনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রকল্পটি কেন ইসলামফোবিক
পরবর্তি সংবাদতাওহিদ, বিদআত, সুন্নাত ও জিহাদ: তরিকায়ে মোহাম্মদিয়ার মতাদর্শ