পাঠ্যক্রমে ইতিহাস বিকৃতি: যেসব কারণে প্রতিবাদ করছেন ধর্মীয় নেতারা

রাকিবুল হাসান নাঈম:

পাঠ্যপুস্তকে ইসলাম বিদ্বেষ ও মুসলিম ইতিহাস বিকৃতির প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছেন মুসলিম ধর্মীয় নেতারা। তারা বলছেন, নাস্তিক্যবাদ ও আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদ দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে শিক্ষার্থীদের সিলেবাস। এই সিলেবাসকে তারা পুরো একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার পরিকল্পনা বলে অভিহিত করেছেন।

যে কারণে প্রতিবাদ করছেন আলেমরা

এ প্রসঙ্গে কথা হয় ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহর সঙ্গে। কদিন আগে বাইতুল মোকাররমের উত্তর গেইটে বর্তমান সিলেবাস বাতিলের দাবিতে বিশাল বিক্ষোভ করেছে তার দল। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তকে যেসব কন্টেন্ট দেয়া হয়েছে, তা সরাসরি ঈমানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বানর থেকে মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস মিথ্যা ইতিহাস। শিশুদেরকে এই ইতিহাস শেখানো মানে ঈমানবিরোধী ইতিহাস শেখানো। কারণ, আল্লাহ বলেছেন, মানুষকে আমি মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। এর বাইরে অন্য কোনো বিশ্বাস একজন মুসলিম ধারণ করতে পারে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বইগুলোতে মুসলিম ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। এদেশে মুসলিমদেরকে বানিয়ে দেয়া হয়েছে দখলদারের প্রজন্ম। এতে আত্মপরিচয় সঙ্কট তৈরী হবে শিশুদের মনে। এইযে মুসলিমদের ইতিহাস বদলে দেয়া, বিকৃত এই ইতিহাস যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে মুসলমানদের আগামী প্রজন্ম বিপথগামী হবে। তাই এখন এটা নিয়ে জোর গলায় কথা বলা সময়ের দাবি।’

কথা হয় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দির সঙ্গে। ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখ পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতি ও ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রথম ধাপ হিসেবে সংবাদ সম্মেলন করবে তার দল। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তকের ইসলাম বিদ্বেষ প্রসঙ্গে অনেক আগে থেকেই আমরা প্রতিবাদ করে আসছি। এখনও করছি। কারণ, এবার যে বিষয়গুলো পাঠ্যপুস্তকে ঢুকানো হয়েছে, তা আমাদের ঈমানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন ডারউইনের মতবাদ। কিছু আমাদের ধর্মীয় কৃষ্টি ও কালচারের বিপরীত। যেমন অস্বাভাবিক যৌনবিকৃতি স্বাভাবিককরণ এবং মুসলিম ইতিহাস বিকৃতি। আক্রমণ হয়েছে দুদিক থেকেই। ঈমান ও কৃষ্টি একসাথে বদলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই আমাদেরকে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে। ইতোমধ্যেই আলেম-উলামা, বিভিন্ন ফোরাম-সংগঠন আওয়াজ তুলেছেন। আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’

তিনি আরও বলেন, ‘এতে কেবল আলেমদের নয়, তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষেরও প্রতিবাদ জানানো উচিত। কারণ, স্কুলে কিন্তু বিশাল একটা অংশ পড়াশোনা করছে। সাধারণত, মাদরাসা থেকে হাইস্কুলে যায় ১০/১২ শতাংশ। বাকিরা সব কিন্তু যায় স্কুল থেকে। সুতরাং, যারা স্কুল থেকে যায়, এসব বিকৃত ইতিহাস পড়ে তারা বিভ্রান্ত হবে। তাই স্কুল-সংশ্লিষ্ট মুসলমানদেরও এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা উচিত বলে মনে করি।’

এ প্রসঙ্গে আরও কথা হয় খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদেরের সঙ্গে। পাঠ্যপুস্তকে ইসলামবিদ্বেষী কন্টেন্টের বিরুদ্ধে তার দল লিখিত প্রতিবাদ জানিয়েছে। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তকে যে ইতিহাস বলা হয়েছে, তা আমাদের শিশুদেরকে ভুলপথে পরিচালিত করবে। তাদের মনে গেঁথে যাবে ভুল ইতিহাস। যেভাবে বইয়ে ফ্রিমিক্সিং এবং জেন্ডারের বিকৃত পরিচয় শেখানো হয়েছে, তাতে সমাজ ধ্বংস হবে৷ এই বইগুলোর কন্টেন্ট আমাদের ঐতিহ্য বিরোধী। কোথাও দাড়ি-টুপি, মসজিদ-জায়নামাজের কথা নেই। এর বিরুদ্ধে এখন আমাদের প্রতিবাদ করতেই হবে। আমরাও আন্দোলনে নামবো।’

বিষয়টিকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ মনে করছে হেফাজত

হেফাজত বর্তমান সিলেবাসকে দেখছে হিন্দুত্ববাদী সিলেবাস হিসেবে। এক বিবৃতিতে হেফাজতের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, বাংলাদেশের মুসলিম শিশুদের ঈমান-আকিদা ও দেশপ্রেম ধ্বংসের জন্য শিক্ষানীতি প্রণয়নের দায়িত্ব ইসলামবিরোধী শক্তির হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। তারা মুসলমানের সন্তানদের নাস্তিক ও হিন্দুত্ববাদী মানসিকতা তৈরি করার জন্য শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। নাস্তিক্যবাদ ও আরএসএস-এর হিন্দুত্ববাদ দিয়ে ভরে ফেলা হয়েছে শিক্ষার্থীদের সিলেবাস।’

সিলেবাস প্রত্যাখ্যান করে হেফাজত বলেছে, ‘আমাদেরকে বারবার আশ্বস্ত করা হয়েছিল, পাঠ্যবইয়ে ইসলামবিরোধী কিছু থাকবে না; কিন্তু সেই কথা রাখা হয়নি। এতে স্পষ্ট যে, পুরো একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আমরা দাবি, যারা এই গুরুতর অপকর্ম করেছে, তাদের সামনে আনা হোক। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। একই সাথে এই শিক্ষা সিলেবাসে থাকা ইসলামবিরোধী বিষয়গুলোসহ অসঙ্গতিপূর্ণ সব বিষয় বাতিল করে নতুন সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে। এই সিলেবাসে এক দিনও পাঠদান আমরা মেনে নিতে পারি না।’

হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর, ‘কওমী মাদরাসা শিক্ষক পরিষদ-এর সভাপতি অধ্যক্ষ মুহাম্মদ মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ও মুসলমানদের ঈমান আকীদা বিধ্বংসী বিতর্কিত অনেকগুলো বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে ‘বাংলা’, ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (অনুশীলন বই ও অনুসন্ধানী পাঠ)’ বইতে। এতে ইতিহাসের নামে মুসলিম শাসকদেরকে নেতিবাচক ও শোষক হিসেবে উপস্থাপন, মূর্তির নগ্ন ছবিসহ আপত্তিকর অনেক বিষয়কে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মুসলমানদের সামাজিক রীতিনীতির সাথে সাংঘর্ষিক করে উপস্থাপন করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করছি, সরকারের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা স্বার্থন্বেষী গুটিকয়েক লোক এধরনের বিতর্কিত বিষয়গুলো সন্নিবেশ করে এর দায়ভার সরকারের উপর চাপিয়ে গণরোষ সৃষ্টি করে দেশে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। বিষয়টি দ্রুত বিবেচনায় না নিলে এক সময় তা নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছি। এমন বিতর্কিত বিষয় পাঠ্যপুস্তকে বারবার যুক্ত করে একদিকে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে উস্কে দেওয়া হচ্ছে এবং অন্য দিকে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থ নষ্ট করে দেশ ও রাষ্ট্র বিরোধী কাজ করছে।’

আগের সংবাদপাঠ্যবইয়ের ভুল সংশোধন : আলাদা দুই কমিটি গঠন
পরবর্তি সংবাদইসলামীসহ চার ব্যাংকের টাকা ধারের সুকুক বন্ডও ফুরিয়ে গেল