ফরিদপুরীর দৃষ্টিতে তাসাউফ : সংস্কার ও সমন্বয় শাহ আবদুল আজিজ

শাহ আবদুল আজিজ:

ভূমিকা

ব্রিটিশ পিরিয়ডে বাংলা মুলুকে ও স্বাধীনতাপূর্ব পূর্ব পাকিস্তানে যেসব মনীষী ইসলামের বহুমুখী সেবা করে জনমনে স্থায়ী আসন গেড়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল একটি নাম হলো হজরত মাওলানা শামসুল ফরিদপুরি (সদর সাহেব হুজুর) রাহিমাহুল্লাহ। বাংলাভূমে ইসলামকে টিকিয়ে রাখতে তাদের অনন্য ত্যাগের কারণেই আজও এদেশে ইসলাম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আল্লাহ তাআলা তাদের কবরকে আলোকিত রাখুন। মাওলানা ফরিদপুরি ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ও সুফিসাধক হাকিমুল উম্মত হজরত মাওলানা আশরাফ আলি থানবি (র) এর খলিফা ও দীর্ঘ সংশ্রবপ্রাপ্ত। হাকিমুল উম্মতের হাত ধরে তিনি যে আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভ করেছিলেন তাই তিনি এদেশের জনগণের কাছে হৃদয়গ্রাহী করে সহজ ভাষায় উপস্থাপন করেছেন তার লেখনি ও বক্তৃতার মাধ্যমে। সে ধারাবাহিকতায় তিনি হজরত থানবির তাসাউফ সংক্রান্ত বহু রচনাবলি সাধারণ মানুষের পাঠোপযোগী ভাষায় অনুবাদ করে জনগণের হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় বহুল পঠিত গ্রন্থ ‘বেহেশতি জেওর’ তিনিই সর্বপ্রথম ভাষান্তর করে বাঙালী পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। অসংখ্য মানুষ সে বই থেকে উপকৃত হয়েছে। আজকের লেখায় আমরা মাওলানা ফরিদপুরির তাসাউফ সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক বিষয়গুলো হাজির করার চেষ্টা করব।

তাসাউফের সংজ্ঞা ও স্বরূপ

তাসাউফের বিরুদ্ধে অব্যাহত প্রোপাগান্ডা কিংবা কিছু স্বার্থান্বেষী বিদআতপন্থীদের প্রান্তিকতার ফলে তাসাউফ শব্দটি উচ্চারণ করা মাত্রই অধুনা মনে ভেসে উঠে ইসলামের বাইরে ভিন্ন কোন বিষয়ের কল্পনা, যার সঙ্গে ইসলামের আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু আসল বাস্তবতা যে তা নয়; তা সচেতন মানুষ মাত্রের কাছেই দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার। ফরিদপুরি দেখান, তাসাউফ শব্দটি নবী ও সাহাবাযুগে প্রচলিত ছিল না। তাবেয়িযুগের শেষ প্রান্তে এসে এ শব্দটি নতুন মাত্রা লাভ করে। কিন্তু এর অর্থ কখনও এটা নয়, এর বিষয়বস্তুও নবআবিষ্কৃত। বরং এর তাবৎ বিষয়বস্তু কুরআন-সুন্নাহ ও সাহাবা-তাবেয়িনের কর্মপন্থা থেকেই উৎসারিত। শুধুমাত্র নাম বা শব্দের বিশেষ কোন তাৎপর্য নেই। এক্ষেত্রে তিনি তাসাউফকে ফিকহের সঙ্গে তুলনীয় বলেছেন। ফিকহ শাস্ত্র পৃথকভাবে নবী ও সাহাবাযুগে সংকলিত না থাকলেও এর মূল বিষয়বস্তু কুরআন-সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস থেকেই উৎকলিত। এখানে এসে ফরিদপুরি আমাদের সতর্ক করেন, তবে মনে রাখতে হবে একটা হলো প্রকৃত তাসাউফ, যা তাসাউফের মহান ইমামগণ যথা হজরত হাসান বসরি, ইবরাহিম বিন আদহাম, সুফিয়ান সাউরি, ইবনুল মোবারক, হারিস মুহাসিবি, আবদুল কাদের জিলানি, জোনায়েদ বাগদাদি ও ইমাম গাজালি প্রমুখের হাত ধরে উৎকর্ষ লাভ করেছে। আরেকটি হলো কৃত্রিম ও ভুল তাসাউফ। খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদগণ যা ‘সুফিজম’ বলে আখ্যা দিয়ে থাকে। তাদের মতে তাসাউফ ভারতীয় যোগীদের থেকে ধার করা কোন শাস্ত্র। এ দাবির সপক্ষে তারা রাশি রাশি বই লিখে জনগণকে প্রকৃত তাসাউফ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে।

তাছাড়া হালের বিদআতিদের সম্পর্কে সচেতন করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘এরূপে একদল ভণ্ড তপস্বী তাছাউফের নামে পেট পালিবার জন্য, নাম করিবার জন্য, কবর পূজা, পীর পূজা, পয়গম্বর পূজা ইত্যাদি করিয়া, মাজারে টাকা দিলে সকল মাকসুদ হাসিল হইয়া যাইবে, পীরকে জাহিরি আল্লাহ মানিয়া সিজদা করিতে দোষ নাই; বরং সব মাকসুদ হাসিল হইয়া যাইবে, বাতিন ঠিক থাকিলে তরিকতপন্থীদের আর জাহিরি শরিয়তের ইলম হাসিল করার বা শরিয়ত পালনের দরকার হয় না; ইত্যাদি বাতিল কাজ করিয়া বাতিল কথা বলিয়া… আল্লাহর প্রেরিত, আল্লাহর রাসুলগণের প্রচারিত খাঁটি ধর্মকে, খাঁটি ইসলামকে, খাঁটি আধ্যাত্মিকতাকে ধ্বংস করিতেছে।’

এভাবে তিনি খাঁটি ও নকল তাসাউফের মধ্যে পার্থক্যরেখা এঁকে দেন। ফরিদপুরি আমাদের জানান, তাসাউফ কুরআন ও হাদিসের মধ্যেই আছে। যে তাসাউফ কুরআন ও হাদিস বিরোধী সেটা আসল তাসাউফ নয় কিছুতেই। তিনি প্রচুর আয়াত ও হাদিস উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন, কিভাবে কুরআন ও হাদিসে বিষয়গুলো এসেছে। মানুষ কেবল দেহবিশিষ্ট কোন প্রাণী নয়। মানুষের দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে গঠিত প্রাণী। শরিয়তে দেহের যেরূপ বিধান দেওয়া হয়েছে তেমনি শরিয়ত আত্মাকে পরিশুদ্ধ করারও নির্দেশনা দিয়েছে। মানুষের আত্মায় বহু মন্দ অভ্যাসের সমাবেশ ঘটে। যেমন, অহংকার, ক্রোধ, লোভ, রিপু, মোহ, হিংসা, দীর্ঘ আশা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি। এগুলো এমন সব মন্দ অভ্যাস যা ইবাদতের প্রাণ বিনষ্ট করে দেয়। এর পাশাপাশি কিছু ভালো গুণ আছে যেগুলো হৃদয়জগতে অর্জন করা কাম্য। যথা বিনয়, সহনশীলতা, অল্পেতুষ্টি, ধৈর্য, কৃতজ্ঞতা, নিষ্ঠা ইত্যাদি। তাসাউফের মূল বাস্তবতা হলো উল্লিখিত কুঅভ্যাসগুলো থেকে হৃদয়জগতকে পরিচ্ছন্ন করে সেখানে উল্লিখিত উন্নত মূল্যবোধগুলো প্রতিস্থাপন করা। এ কাজটি সহজে অর্জন করা কঠিন পরিশ্রম ও যোগ্য আল্লাহওয়ালার সাহচর্যে নিজেকে নিবিড় পরিচর্যার মধ্যে রাখা ছাড়া। এটি তাসাউফের একেবারে বেসিক কার্যক্রম। এ গুণগুলো অর্জন করার মাধ্যমে ইবাদতে প্রাণ আসতে শুরু করে। এরপর বারবার আল্লাহ তাআলার জিকির, ধ্যানমগ্নতা ও আখেরাতের ফিকিরের মাধ্যমে একজন সাধক ধীরে ধীরে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করতে শুরু করে। এ শাস্ত্রের যাবতীয় কাজ এ উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হয়। সাহাবায়ে কেরাম এ উদ্দেশ্য নবীজির বরকতময় সান্নিধ্যে থেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের সান্নিধ্যে তাবেয়িদের বেশি বেগ পেতে হয়নি এসব গুণাবলি অর্জন করতে হয়। কিন্তু যত সময় গড়িয়েছে মানুষের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে। ফলে এ শাস্ত্রের ইমামগণ বিভিন্ন মাধ্যমে পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালিয়ে এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। আর দশটা শাস্ত্রের মতো এটাও ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে।

ফরিদপুরি আমাদের এও জানান, তবে সর্বাগ্রে জরুরি হলো শরিয়তের জাহিরি ইলম অর্জন করা। এরপর বাতিনি (অন্তর্জগতের জ্ঞান) ইলম অর্জনের চেষ্টা করা। যারা মনে করে কোন পীরের কাছে বাইআত হলে আর জাহিরি ইলম অর্জনের চেষ্টা করার দরকার নেই, মাওলানা ফরিদপুরি তাদের নিন্দা করেছেন। তিনি এক শব্দে বলেছেন তাসাউফ মানে হলো, ‘তামিরুজ জাহিরি ওয়াল বাতিন’। তাসাউফ মানে হলো জাহির ও বাতিনকে শরিয়ার চাহিদামতো বিনির্মাণ করা।

বাইআত হওয়া আবশ্যক কিনা?

এ প্রশ্নের উত্তরে ফরিদপুরি বলেছেন, বাইআত হওয়া ফরজ বা ওয়াজিব নয়। তবে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করা জরুরি। এটা কুরআনের নির্দেশ। স্বয়ং নবীজির আগমনের একটি মুখ্য উদ্দেশ্য হলো ‘তাজকিয়া’ বা আত্মার পরিশুদ্ধি। তবে যেহেতু আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনের জন্য কারো কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে তারবিয়াত গ্রহণ করাটা সহজ পন্থা ও কার্যকরী উপায় তাই এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া নবীজি সা. বহু সাহাবায়ে কেরামকে আমল ঠিক করার বাইআত করেছেন। এমনকি কুরআনে নারীদের বাইআতের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে, তাই একে অন্ততপক্ষে সুন্নত বলতে হবে। তবে হ্যাঁ, বে-শরা পীর-ফকির যাদের শরিয়তের ব্যাপারে জ্ঞান নেই এবং জাহিরি আমলের ব্যাপারে উদাসীনতা আছে এসব পীরের কাছে বাইআত হওয়া হারাম বলেছেন তিনি। এও বলেছেন, এর মাধ্যমে ইমান নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা পর্যন্ত আছে। একজন মানুষকে পীর হতে হলে কমপক্ষে তার কুরআন মাজিদ তরজমা সহ মনোযোগ দিয়ে পাঠ করতে হবে। এবং কোন শিক্ষকের কাছে অন্তত মেশকাত শরিফ বা এ মানের কোন হাদিসগ্রন্থ অদ্যান্ত নিয়মতান্ত্রিক পাঠ করতে হবে। এরপর কোন কামেল পীরের সাহচর্যে থেকে নিজের হৃদয়জগতের পরিশুদ্ধি অর্জন করেছেন। অন্যথায় তাদের কাছে বাইআত হওয়া উচিত নয়। ঠগবাজ পীরদের হাতে বাইআত হলে দীন-দুনিয়া উভয়টাই হারানোর সম্ভাবনা আছে।

ওহাবি-সুন্নি প্রসঙ্গ

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ওহাবি-সুন্নি প্রসঙ্গ অনেক পুরোনো ও প্রাসঙ্গিক। মাওলানা ফরিদপুরিকে প্রশ্ন করা হয়েছে, ওহাবিরা আসলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত নয়? বা বেরেলবিরা কি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত? মাওলানা ফরিদপুরি বলতে চেয়েছেন বেরেলবি, দেওবন্দি, ফুরফুরা ও বাদায়ুনি তারা সকলে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত। মাওলানার ভাষ্য লক্ষ করা যাক, ‘প্রকৃত প্রস্তাবে তাহারা সকলেই সুন্নত জামায়াত। যাহারা দেওবন্দি তাহারাও সুন্নত জামাআতের আন্তর্ভুক্ত। যাহার বেরেলবি তাহারাও সুন্নত জামায়াতভুক্ত। যাহারা আমিন জোরে বলে, রাফে ইয়াদাইন করে তাহারাও সুন্নাত জামায়াতভুক্ত। যাহারা মৌলুদ শরিফ পড়ে দাঁড়াইয়া সালাম করে তাহারাও সুন্নাত জামায়াতভুক্ত। যাহারা মৌলুদ শরিফকে ব্যবসারূপে পরিগণিত করিতে, মৌলুদের মধ্যে মওজু রেওয়ায়েত (জাল হাদিস) বর্ণনা করিতে, শরিয়ত বিরুদ্ধ গান-বাদ্য-নাচ করিতে নিষেধ করেন তাহারাও সুন্নাত জামায়াতভুক্ত। তাবলিগ জামায়াতও সুন্নত জামায়াত, ফুরফুরি, বাহাদুরপুরি, জৌনপুরি, হাটহাজারী ও থানবি ইহারা সকলেই সুন্নাত জামায়াত। অবশ্য সুন্নত জামায়াতের বিরুদ্ধে তাহারা- যাহারা শেষ নবী মুহাম্মাদ সা.-কে স্বীকার করে না বা তাহার পরেও অন্য কউকে নবী বলিয়া মানে, তাহার সাহাবাগণকে খাস করিয়া চার খলিফার নিন্দা করে। তাহারা ব্যতীত আর সকলেই আমরা সুন্নাত জামায়াত’। (তাসাউফ তত্ত্ব: ৩৯)

মাওলানা ফরিদপুরির বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার। তিনি এ ধরনের ফিরকাগত বিভেদ থেকে একশো হাত দূরে থেকে মুসলিম উম্মাহর সামগ্রিক ঐক্য চেয়েছিলেন। একান্ত মৌলিক উসুলের মধ্যে মতবিরোধ না হলে তাদেরকে তিনি আহলে সুন্নাত থেকে বের করতে রাজি ছিলেন না। এতে আমরা তার মধ্যে বিশাল উদারতা লক্ষ করি। অন্য জামাতের আলেমদের মধ্যে যদি এ উদারতা থাকত তবে আমরা নতুন এক সমাজ বাংলাদেশে পেতাম। মাওলানা ফরিদপুরির আরেকটি উদ্ধৃতি লক্ষ করুন, ‘কেহ সুন্নাত জামায়াত বলিয়া দাবি করিয়া অন্যদেরকে জামায়াত থেকে খারিজ করে দেয়। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে বিদআতকে কেউ ভালোবাসে না বা সুন্নতকে কেউ মন্দ জানে না। কেউ নিজেকে ওহাবি পরিচয় দিতে রাজি নহে। অতএব, আমার ভাইদের কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ এই যে, আপনারা ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি মতভেদ, মৌলুদ কিয়াম ইত্যাদির ঝগড়া পরিহার করিয়া সকলে একতাবদ্ধভাবে সক্রিয়ভাবে যাহারা ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতা করিতেছে, ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শত্রুতা করিতেছে- সকলে তাহাদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হউন এবং সত্যিকার ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করুন।’ (তাসাউফ তত্ত্ব: ৩৯)

মিলাদ-কিয়াম প্রসঙ্গ

মিলাদ প্রসঙ্গে মাওলানা ফরিদপুরির বক্তব্য অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ মনে হয়েছে আমার কাছে। তিনি আমাদেরকে জানান, মৌলুদ বা মাওলিদ বা মিলাদ যাই বলি এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে শিশুর জন্ম। এখানে শিশু বলতে আমরা প্রিয় নবীজি সা.-কে বুঝি। এ কারণেই এখানে শরিফ শব্দটি যুক্ত হয়েছে। নবীজির প্রতি সর্বোচ্চ ভালোবাসা প্রদর্শন আমাদের ইমানের দাবি। স্বয়ং নবীজি সা. বলেছেন ‘তোমাদের মধ্যে কেউই প্রকৃত অর্থে মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তোমাদের কাছে তোমাদের পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্তুতি থেকেও প্রিয় না হই।’ (মুসলিম) উম্মাতের জন্য নবীজির দানরাশির কথা বারবার স্মরণ করার মাধ্যমে মনে নবীজির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তৈরি করা জরুরি। যেমন কুরআনে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এজন্য আল্লাহর জিকিরের মজলিসের আয়োজন হয়ে থাকে যেন আল্লাহর মুহাব্বত ও ভালোবাসা আমাদের মনে দৃঢ়ভাবে বসে যায়। এভাবে একাকিও বেশি বেশি জিকির করা আবশ্যক। নবীজিকে বেশি বেশি স্মরণ করা যায় দরুদ শরিফ পাঠ করার মাধ্যমে। এ কারণে যোগ্য ও মুহাক্কিক আলেম ও তালেবে ইলমগণ বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠ করে থাকেন। হাদিস শরিফের কিতাবাদি পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে বিপুল পরিমাণে দরুদ শরিফ পাঠ করার সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু এ ভালোবাসার অর্থ এই নয় যে, নবীজিকে আল্লাহর জায়গায় বসিয়ে দিতে হবে। তার জন্য রুকু-সিজদা করা একেবারেই জায়েয নয়। বরং নবীজিকে নবীজির জায়গায় রেখেই তাকে ভালোবাসতে হবে। এ পর্যন্ত কারুরই কোন দ্বিমত নেই। এখানে দ্বিমত করার সুযোগও নেই।

যারা মিলাদের বিরোধিতা করেন, ফরিদপুরি রহ. তাদের সে বিরোধিতার যুক্তিও তুলে ধরেছেন বলিষ্ঠ ভাষায়। তার ভাষ্য দেখুন, ‘যাহারা মৌলুদ শরিফকে বিদআত বলেন, তাহারা হজরতের মুহাব্বতকে বা হজরতের জিকির-আলোচনাকে বিদআত বলেন না। তাহারা বিদআত বলেন- মৌলুদ শরিফের নামে সমাজে যে অপকর্ম চালু হয়েছে তাহাকে। সমাজে খ্রিষ্টানদের অনুকরণে, হিন্দুদের অনুকরণে, মৌলুদ শরিফের নামকরণে মওজু রেওয়ায়েত গঠন করা হইয়াছে। গান-বাদ্যের আসর জমানো হইয়াছে। গান-বাদ্যের ন্যায়, থিয়েটারের ন্যায়, টাকা রোজগারের জন্য পার্টি সাজানো ও বাইজি নাচানো হইয়াছে। নামাজ-জামায়াত বন্ধ করিয়া পার্টি দেওয়া হইয়াছে গণিকার বাড়িতে পর্যন্ত।’

অর্থাৎ মিলাদের নামে যেসব কুপ্রথা সমাজে অনুপ্রবেশ করেছে তা দমন করার নিমিত্তেই উলামায়ে কেরাম এসব অনুষ্ঠানকে বিদআত বলতে চেয়েছেন। মিলাদের মূল যে বিষয়টি এটি নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়।
কিয়াম প্রসঙ্গে মাওলানা ফরিদপুরি বলতে চান এটা আদৌ ফিকহের বিষয় নয়। এটা তাসাউফের অন্তর্ভুক্ত। মাওলানার ভাষ্য লক্ষণীয়, ‘অর্থাৎ মুহাব্বাত বাড়ানোর উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ (সা) এর তারিফের কাসিদা পাঠ করা হয়। তাহা দ্বারা মুহাব্বাত বাড়ে এবং লোক মুহাব্বতের জোশে খাড়া হইয়া যায়। মুহাব্বাতের জোশে খাড়া হইলে এটাকে বিদআত বলা যায় না। তাহা ছাড়া হজরত (সা)-কে সালাম করিবার সময় বসিয়া বসিয়া সালাম করা শরিফ তবিয়তের কাছে বড়ই বেয়াদবি লাগে। সেই জন্য রওজা শরিফের সামনে নিজেকে হাজির ধ্যান করিয়া খাড়া হইয়া সালাম করাতে কোনই দোষ হইতে পারে না। যেমন মদিনা শরিফে রওজা শরিফের সামনে সালাম করার সময় সকলেই দাঁড়াইয়া সালাম করিয়া থাকেন। অবশ্য কিয়ামকে শরিয়তের হুকুম মনে করা অর্থাৎ হজরত (সা) এর হুকুম মনে করা অত্যন্ত সাংঘাতিক গুনাহ, অন্যায় ও বিদআত। হজরত রাসুলুল্লাহ তাহার জন্য কখনও এমন হুকুম জীবিত অবস্থায়ও দেননাই।’ (প্রাগুক্ত: ৪২)

কিয়ামের ব্যাপারে মাওলানার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ আছে। আজকের লেখায় সে পর্যালোচনা করার সুযোগ আমাদের নেই। মাওলানা ফরিদপুরির দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার করাই আমাদের উদ্দেশ্য। আজকাল মুহাব্বতের জোশে ক’জন মানুষ কিয়াম করে থাকেন তা যাচাই করার বিষয়। বরং যারা কিয়াম করেন, তাদের বক্তব্য থেকে যেটা আমরা উপলব্ধি করি তা হলো, তারা রাসুলকে হাজির-নাজির জেনে এমনটা করে থাকেন। আবার অনেকে করেন নিছক প্রথা হিসেবে। মাওলানা ফরিদপুরি বলতে চেয়েছেন, কারও উপর যদি ভালোবাসা প্রবল হওয়ার কারণে বিশেষ অবস্থা সৃষ্টির কারণে দাঁড়িয়ে যায় এতে বিদআত বলার সুযোগ নেই। কিন্তু আজকাল কিয়ামকারিদের অবস্থা কি আসলে সেরূপ হয়?

আগের সংবাদসামর্থ্য থাকলে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের বেতন বাড়ানো উচিত: উবায়দুর রহমান খান নদভী
পরবর্তি সংবাদপ্রশ্নফাঁসের চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা : শিক্ষামন্ত্রী