মাওলানা আকরম খাঁ : মুসলিম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ আলেম

মুসান্না মেহবুব

মাওলানা আকরম খাঁ কেবল একজন আলেম সাংবাদিকই ছিলেন না, ছিলেন মুসলিম সাংবাদিকতার জনক। গেল শতাব্দীর একদম শুরুতে তিনি যখন সাংবাদিকতা পেশায় আসেন, তখন পর্যন্ত এ দেশের সংবাদমাধ্যমের কর্তৃত্ব হিন্দুদের হাতেই ছিল। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যাঁর হাত ধরে মুসলিম সাংবাদিকতা সর্বপ্রথম বিকাশ লাভ করেছিল। এজন্য তিনি যতটা না আলেম সাংবাদিকদের পথিকৃৎ হিসেবে স্মরণীয়, তারচেয়ে বেশি মুসলিম সাংবাদিকতার জনক হিসেবে সমাদৃত।

মাওলানা আকরম খাঁ একজন আলেম হিসেবে কেমন ছিলেন, কেমন ছিল তাঁর চিন্তাধারা, এ নিয়ে খানিকটা বিতর্ক থাকতে পারে। বিতর্ককে একপাশে রেখে তাঁর সাংবাদিক জীবনের কর্মতৎপরতা ও অবদান নিয়ে আলোচনাই এখানে মূল উদ্দেশ্য।

১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জুন পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাট মহকুমার হাকিমপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পড়াশোনা শেষ করে তরুণ আকরম খাঁ কর্মজীবনে প্রবেশ করলেও সাংবাদিকতা পেশায় তিনি যুক্ত হন বিংশ শতাব্দীর শুরু লগ্নে। একই সঙ্গে রাজনীতিক হিসেবেও তাঁর সক্রিয় ভূমিকা শুরু হয় এই সময়ে। ইংরেজ ঔপনিবেশের কাল তখন, মিডিয়ার জগতে মুসলমানদের অবস্থান শূন্যস্তরে। খ্রিষ্টান মিশনারিদের ইসলাম-বিরোধী অপপ্রচার, হিন্দুদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রে মুসলিম বিরোধিতা ছিল ভয়াবহ মাত্রায়। একই সঙ্গে মুসলমানদের অভাব-অভিযোগের কাহিনি সরকারের কাছে তুলে ধরারও কোনো মাধ্যম ছিল না। মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় তখন একটি পত্রিকার প্রয়োজনীয়তা ছিল অনিবার্য। আকরম খাঁ এই প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে উপলব্ধি করলেন। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি সংবাদপত্র বের করার প্রতি মনোযোগ দেন। আবু জাফর লিখেছেন, ‘মাওলানা আকরম খাঁ যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করেন, তখন এদেশের মুসলমানরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে ছিল অনগ্রসর। একদিকে বৃটিশ শাসন ও শোষণ, অন্যদিকে প্রতিবেশী সমাজের অভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাবের ফলে বাংলার মুসলমানরা অসহায়ের মতো দিন কাটাচ্ছিল। তাদের আশার বাণী শোনাবার জন্য, তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করার জন্য কেউ তখন ছিল না। …বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি (আকরম খাঁ) উপলব্ধি করেন যে, বাঙলার মুসলমানদের উন্নতির জন্য প্রয়োজন তাদেরকে সংগঠিত করার, ইসলাম সম্পর্কে অপব্যাখ্যা দূর করে সত্যিকার ইসলামের নীতি সর্বসমক্ষে তুলে ধরার এবং সর্বোপরি মুসলমান হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য তাদেরকে অনুপ্রাণিত করার। এ কাজের সফলতা লাভের উপায় হিসেবে তথা বলিষ্ঠ জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি পত্রিকা প্রকাশের প্রতি আগ্রহী হন। এজন্য তিনি আজীবন সাধনা করেছেন। মোহাম্মদী, সেবক, জামানা, আজাদ প্রভৃতি পত্রিকা তার সাধনারই উপজাত ফল।’ (ত্রৈমাসিক প্রেক্ষণ, পৃ. ৫৩-৫৪, জুলাই-সেপ্টম্বর ২০০৫)।

মাসিক মোহাম্মদী

মাওলানা আকরম খাঁ’র সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা মাসিক মোহাম্মদী। এটি ১৯০৩ সালের ১৮ আগস্ট কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে পাক্ষিক এবং ১৯০৮ সালে সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। আকরম খাঁ বিচক্ষণ মন ও গভীর অন্তরদৃষ্টি দিয়ে বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে ভাবতেন। হতদরিদ্র এবং শিক্ষা ও অধিকার বঞ্চিত মুসলমানদের মুক্তি ছিল তাঁর কাম্য। সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে তাঁর এ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’র পৃষ্ঠায় মুসলমানদের জাগরণমূলক বহু লেখা ও খবর ছাপা হতে থাকে। মুসলমানরা বহুদিন পর একটি পত্রিকা হাতে পেলেন। সেখানে মুসলমানদের মনের কথা লেখা হচ্ছে। অল্পকালের মধ্যে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী বাংলা, আসাম ও বার্মার মুসলমানদের প্রিয় পত্রিকা হয়ে উঠল। এই পত্রিকার মাধ্যমেই এতদাঞ্চলের বাংলাভাষী মুসলমানরা নিজেদের স্বার্থ এবং অভাব অভিযোগের কথা তদানীন্তন শাসকবর্গের কাছে জানাবার সুযোগ পেয়েছিল।

আকরম খাঁ’র দক্ষ সম্পাদনায় সাপ্তাহিক মোহাম্মদী প্রথম শ্রেণীর পত্রিকায় পৌঁছতে বেশি দেরি করেনি। এর জনপ্রিয়তা ছিল অত্যধিক। মফস্বল এলাকায় এমন স্থান সম্ভবত ছিল না যেখানে সাপ্তাহিক মোহাম্মদীর প্রবেশ ঘটেনি। তৎকালীন হিন্দু প্রধান পত্রিকা আনন্দ বাজার, বসুমতী, প্রবাসী প্রভৃতি পত্রিকার তথ্য সন্ত্রাসের মোকাবিলায় সাপ্তাহিক মোহাম্মদী সাহসী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু কয়েক বছরের মাথায় পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।

আল এসলাম

১৯১৩ সালে ‘আঞ্জুমানে ওলামা’ নামে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গঠিত হলে আকরম খাঁ এ প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। আঞ্জুমানে ওলামার মুখপত্র হিসেবে মাসিক পত্রিকা আল এসলাম প্রকাশিত হলে আকরম খাঁ এর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাসিক মোহাম্মদী’র তৃষ্ণা অনেকাংশেই নিবারণ করতে থাকে আল এসলাম।

দৈনিক জামানা ও সেবক

১৯২৩ সালের ১৪ মে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় উর্দু দৈনিক ‘জামানা’। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে জামানার ভূমিকা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি প্রকাশ করেন বাংলা পত্রিকা ‘সেবক’। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে সেবকের জ্বালাময়ী বক্তব্যে পত্রিকাটি উপনিবেশবাদী সরকারের রোষানলে পড়ে। অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে ‘অগ্রসর! অগ্রসর!’ শিরোনামে বিদ্রোহাত্মক সম্পাদকীয় লেখার কথিত অপরাধে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পত্রিকার জামানত তলব করা হয়। পত্রিকার প্রকাশনাও বন্ধ করে দেয় সরকার। কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট মি. সুইনহোর মাওলানাকে বিচারের প্রহসনে এক বছরের কারাদণ্ড দেন।

জেলমুক্তির পরে তাঁকে সম্পাদক করে সাপ্তাহিক মোহাম্মদীকে দৈনিক মোহাম্মদীতে রূপান্তরিত করা হয়। কিন্তু দৈনিকটি বেশি দিন টেকেনি। বন্ধ হয়ে যায় অল্পকালেই।
মাসিক মোহাম্মদী, দ্বিতীয় পর্যায়

১৯২৭ সালের ৬ নভেম্বর আকরম খাঁ দ্বিতীয় পর্যায়ে আবারও শুরু করেন মাসিক মোহাম্মদী’ প্রকাশ। এই পর্যায়ে মাসিক মোহাম্মদীতে সকল ধরনের লেখা প্রকাশিত হয়। তবে ইসলামি নবজাগরণ ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বিষয়ক লেখার প্রাধান্য থাকত। মাসিক মোহাম্মদীকে কেন্দ্র করে প্রবাসী গোষ্ঠী ও শিখা গোষ্ঠীর বাইরে মুসলিম লেখক ও সাংবাদিকদের একটি গ্রুপ তৈরি হয়। এ সময় ভারতের ‘জাতীয় সঙ্গীত’ হিসেবে সাম্প্রদায়িক সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্রের মুসলিম বিদ্বেষী সঙ্গীত ‘বন্দেমাতরম’কে গ্রহণ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম ‘শ্রীপদ্ম’কে কেন্দ্র করে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে। আকরম খাঁ বন্দেমাতরম ও শ্রীপদ্মের স্বপক্ষে আনীত যুক্তিসমূহ মাসিক মোহাম্মদীতে ক্ষুরধার যুক্তি দ্বারা খণ্ডন করতেন। এ ছাড়া মুসলমান ছাত্রদের সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিমাতাসুলভ আচরণের স্বরূপ উন্মোচনের জন্য আকরম খাঁ একটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা প্রকাশ করেন। ছাত্রদের আন্দোলন আর মোহাম্মদীর ভূমিকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে বাধ্য হয়। মনোগ্রাম থেকে শ্রী বাদ দিয়ে শুধু পদ্ম ফুলকে প্রতীক হিসেবে রাখা হয়।

দৈনিক আজাদ

মাওলানা আকরম খাঁ’র সংগ্রামী জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো দৈনিক আজাদ। ১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর আকরম খাঁ’র সম্পাদনায় কলকাতা থেকে দৈনিক আজাদ প্রকাশিত হয়। ১৯৪০ সালে সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা, বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ, চল্লিশের দশকে মুসলিম লীগের আন্দোলন জনগণের দ্বোরগোড়ায় পৌঁছানো, রাজনীতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের ঘূর্ণাবর্ত থেকে মুসলমানদের বেরিয়ে আসা এবং সমাজ ও ধর্মীয় সংস্কারের ক্ষেত্রে দৈনিক আজাদ যে অবিস্মরণীয় কর্তব্য পালন করে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।

দৈনিক আজাদের প্রকাশনা বাংলার মুসলমানদের কর্মপ্রবাহে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে আসে। আবুল কালাম শামসুদ্দীন অতীত দিনের স্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সত্যিই আজাদ বাংলার মুসলিম সমাজে উৎসাহ উদ্দীপনার যে জোয়ার এনেছি, তা ছিল অভূতপূর্ব। অল্পদিনের মধ্যেই আজাদ মুসলিম বাংলার জাতীয় দৈনিক মুখপাত্র হয়ে উঠল। বাংলা আসামের সুদূরপ্রান্ত থেকে এ কাগজের চাহিদার খবর আসতে লাগল। আজাদকে প্রথম শ্রেণীর কাগজে পরিণত করার জন্য মাওলানার এবং আমাদের উৎসাহ ও কর্মতৎপরতার অন্ত ছিল না।’ (পৃষ্ঠা : ৩৩৬, আবুল কালাম শামসুদ্দিন রচনাবলী, ২য় খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ঢাকা)।

মুসলিম সাংবাদিকতার প্রবাদপুরুষ মাওলানা আকরম খাঁকে বৃটিশ সরকার ও সাম্প্রদায়িক বর্ণ হিন্দুত্ববাদের মুকাবেলা করতে হয়েছে জীবনভর। নিজের খোদাদাদ লিখনী শক্তির মাধ্যমে মৃত্যুর আগ অবধি তিনি এ লড়াই চালিয়ে গেছেন। ১৯৬৮ সালের ১৮ আগস্ট মহান এই আলেম সাংবাদিক মসজিদে এবাদতরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।

আগের সংবাদকাশ্মীর ইস্যুতে কারো সঙ্গে আপস করবে না পাকিস্তান
পরবর্তি সংবাদইসলামি ম্যাগাজিনের সোনালি সময়