মাদরাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় : পাকিস্তান ‘জামিয়াতুর রশিদ’র বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা

|| তাসনিফ আবীদ ||

‘মাদরাসা’ শব্দটি শুনলে অনেকের মনে নানা কারণে পিছিয়ে পড়া এক জনগোষ্ঠীর চিত্র ভেসে উঠলেও তা সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিতে সক্ষম হয়েছে পাকিস্তান ‘জামিয়াতুর রশিদ’।

বিখ্যাত ফাতাওয়ার কিতাব ‘আহসানুল ফাতাওয়া’র রচয়িতা, গবেষক আলেমেদ্বীন মুফতি রশিদ আহমদ লুধিয়ানভি রহ. ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানের করাচির আহসানাবাদের প্রতিষ্ঠা করেন জামিয়াতুর রশিদ । বিশ্বময় ইসলামের শুদ্ধ চর্চা বাড়ানো, গবেষক দাঈ তৈরি ও যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মতো আলেম তৈরির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে মাদরাসা থেকে এখন একটি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তান সরকারের স্বীকৃত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এটিও একটি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি পাকিস্তান বেফাক বোর্ডের অধীনে চললেও লেখাপড়ার মান বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদেরকে জেনারেল ও দ্বীনি শিক্ষার সমন্বয়ে যুগ সচেতন আলেম হিসেবে তৈরি করতে ২০২১ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি পাকিস্তানের জামিয়া বিন্নুরীয়ার সাথে যুক্ত হয়ে ‘মাজমাউল উলুম আল ইসলামিয়া‘ নামে একটি সমন্বিত বোর্ডের অধীনে চলছে। এই বোর্ডের সিলেবাস এমনভাবে সাজানো, যার ফলে প্রতিষ্ঠানটি ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষা প্রদান করছে যাতে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সব জায়গায় সমান সুযোগ গ্রহণ করতে পারে এবং সমাজের উন্নয়নে তারাও ভূমিকা রাখতে পারে।

‘জামিয়াতুর রশিদ’ পাকিস্তানের ফেডারেল শিক্ষা ও পেশাদার প্রশিক্ষণ মন্ত্রণালয় এবং উচ্চ শিক্ষা কমিশন কর্তৃক অনুমোদিত পাঠক্রম পরিচালনা করে। প্রতিষ্ঠানটিতে ‘কুল্লিয়াতুশ শরিয়াহ’সহ ৩৬টি বিভাগ রয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় দ্বীনি ও জেনারেল শিক্ষাকে সুষম বণ্টনের মাধ্যমে অন্তর্ভূক্তির কারণে বিশ্ব দরবারে এখন ‘জামিয়াতুর রশিদ’ অনেকটা রোল মডেল। যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা ইলমে হাদিস, ইলমে ফিকাহ’র পাশপাশি আধুনিক শিক্ষাকারিকুলামও আত্মস্থ করছে। এমনকি ইংরেজি জানার কারণে এবং জেনারেল সার্টিফিকেট থাকার কারণে দেশ-বিদেশে শিক্ষার্থীরা সমানভাবে নিজেদের মেধার জানান দিতে পারছে।

‘জামিয়াতুর রশিদ’র চিন্তা, ফিকির, শিক্ষাব্যবস্থা, ছাত্রদের আবাসন, তরবিয়ত প্রচলিত মাদরাসাগুলো থেকে ভিন্ন ও উন্নত। তাদের রয়েছে অভিজ্ঞ গভর্নেন্স বোর্ড। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আইটি বিভাগ। প্রকাশনা বিভাগ। নিজস্ব মিডিয়া ও নানা কর্মপন্থা।

শিক্ষকদেরকে সচেতন করতে এবং তাদের অভিজ্ঞতাকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধির লক্ষে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। যেখানে ডিজিটাল পদ্ধতিতে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে সময়ের সেরা প্রশিক্ষকদের মাধ্যমে শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়া ‘জামিয়াতুর রশিদ’ তাদের সিলেবাসে দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি জেনারেল শিক্ষাকে যুক্ত করায় শিক্ষাক্রম প্রণয়নের ক্ষেত্রে তারা পাকিস্তানের জেনারেল শিক্ষায় অভিজ্ঞজনদের পরামর্শ গ্রহণ করে থাকে।

এছাড়া ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরকেও যুগ সচেতন আলেমা হিসেবে গড়ে তুলতে ‘জামিয়াতুর রশিদ’র অধীনে পরিচালিত হয় ‘জামিয়া উম্মে হাবিবা লিল-বানাত’, ‘জামিয়া হাফসা লিল-বানাত’ এবং ‘আল-বৈরুনি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ নামক স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

সাধারণ মানুষের মাঝে আলেমদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করানোর জন্য এবং আলেমদের অবস্থান জানান দেওয়ার জন্য ‘জামিয়াতুর রশিদ’ পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় আলাদা আলাদাভাবে সমসাময়িক বিষয়ে বিভিন্ন সেমিনারের আয়োজন করে থাকে।

তাছাড়া সামাজিক ও সেবামূলক নানা কাজেও ‘জামিয়াতুর রশিদ’র উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

‘পরিচ্ছন্ন পাকিস্তান’ গড়ার লক্ষে্য ‘জামিয়াতুর রশিদ’র ছাত্র-শিক্ষকরা বিভিন্ন শহরে পরিচ্ছন্নতার উদ্যোগ নিয়ে থাকে। যার মাধ্যমে শহরের রাস্তা, নালা-ডোবা ও অলিগলিতে পড়ে থাকা ময়লা-আবর্জনা পরিস্কার করে ‍সুন্দর এক শহরের উদাহরণ তারা মানুষের মাঝে উপস্থাপন করে।

তাছাড়া ব্লাড ব্যাংক’র মাধ্যমে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচী, দুস্থ্যদের মাঝে অন্ন-বস্ত্র বিতরণসহ নানা উদ্যোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।

করাচির আহসানাবাদে অবস্থিত এই প্রতিষ্ঠানটির দৃশ্য সত্যিই নয়নাভিরাম। নান্দনিক শিক্ষা ও আবাসিক ভবন। আধুনিক কনফারেন্স রুম। ডিজিটাল ক্লাস রুম। গোছানো মেহমানখানা। সবুজ ঘাসে ঢেকে থাকা প্রশস্ত মাঠ। মাঠের একপ্রান্তে পতপত করে উড়ছে তাদের জাতীয় পতাকা। এমন এক পরিবেশে বাতাসে ভেসে আসছে কুরআন তিলাওয়াতের মধুর সুর, হাদ্দাসানার ধ্বনি এবং জেনারেল শিক্ষার নানা অধ্যায়।

শুধু প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াই নয়। লেখাপড়া ঠিক রেখে ও বোর্ড পরীক্ষায় সেরা রেজাল্ট করার পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যেসব দক্ষতা অর্জন করে তার মধ্য অন্যতম সেল্ফ ডিফেন্স বা আত্মরক্ষার বিদ্যা। শিশুরা যেন ছোট থেকেই শারীরিকভাবে ফিট থাকতে পারে সেজন্য দেশসেরা প্রশিক্ষকদের মাধ্যমে তাদেরকে শেখানো হয় মার্শাল আর্ট। ‘জামিয়াতুর রশিদ’ মার্শাল আর্টের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কয়েকবার প্রশংসাও কুড়িয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি জেনারেল শিক্ষার সমন্বয়ে যদি মাদরাসাগুলোর সিলেবাসকে সাজানো যায় তাহলে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সমন্বয় করে আলেমরা বিশ্বময় কাজের অনন্য একটি ময়দান তৈরি করতে পারবে। পাশাপাশি বিশ্বময় দ্বীনি শিক্ষার আলো ও ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেওয়া সুবর্ণ সুযোগ পাবে।

আগের সংবাদট্রেন লাইনচ্যুত, সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ বন্ধ
পরবর্তি সংবাদ৬৬ বছরের ফিলিস্তিনি নারীর ওপর কুকুর লেলিয়ে নির্যাতন ইসরাইলের