রমজানে মুসলমানদের ঐতিহাসিক বিজয়

আরশাদ ইলয়াস :

ইসলাম ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ সাওম তথা রোজা। বছরের নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন ছাড়া অন্যান্য দিনগুলোতে রোজা রাখা ঐচ্ছিক বিষয় হলেও যে মাসের প্রতিদিন রোজা রাখা বাধ্যতামূলক, সেটা হলো রমজান। একে আমরা রোজার মাস এবং কুরআনের নাযিলের মাস হিসেবে জানি। কিন্তু এর বাইরেও রমজানের রয়েছে বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব। মুসলমানদের অনেকগুলো ঐতিহাসিক বিজয় ও সফলতার স্বাক্ষী মহান এ মাস। মূলত কুরআন নাযিলের মধ্য দিয়ে এই বিজয়ের সূচনা হয়। যদিও এ বিজয় বিশেষ কোনো যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়নি। কিন্তু এর জন্য বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ যে ত্যাগ ও কষ্ট সহ্য করেছেন, তা অনস্বীকার্য। এই লেখায় আমরা রমজানে মুসলমানদের কিছু বিজয়গাঁথা সংক্ষেপে উল্লেখ করার চেষ্টা করবো।

ইসলামের ইতিহাসে পবিত্র রমজান মাসে যেসব ঘটনা ঘটেছে, আমরা যদি সে বিস্ময়কর ঘটনাগুলো বিশেষভাবে চিন্তা করি, তাহলে বুঝতে পারবো, এসব ঘটনা কাকতালীয় বা আকস্মিক ছিলো না। এই মাসেই মুসলমানরা পর্যায়ক্রমে একেকটি ধাপ অতিক্রম করে দুর্বল অবস্থা থেকে সবল অবস্থা অর্জন করেছে। বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার গ্লানি মুছে ফেলে এই মাসেই হাসিল করেছে অধিকার আদায় ও মর্যাদার চাবিকাঠি। এসব সম্ভব হয়েছে শুধু ত্যাগের শিক্ষা সফলভাবে ধারণ করার ফলে।

পবিত্র কুরআনের নিন্মে উল্লেখিত আয়াত সেদিকেই ইঙ্গিত করছে, যেখানে মহান আল্লাহ মুমিনদের এই বলে ত্যাগের আদেশ দিয়েছেন (তরজমা) ‘‘হে মুমিনগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরয করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির ওপরও। আশা করা যায়, এর মাধ্যমে তোমরা আল্লাহভীতি অর্জন করতে পারবে।’’ [সূরাতুল বাকারাহ, আয়াত-১৮৩] আয়াতে বিশেষ একটি শিক্ষা প্রচ্ছন্ন রয়েছে, আর তাহলো আসন্ন বিজয় অর্জনের জন্য মুমিন-মুসলমানদের ত্যাগ শিকার করতে হবে। অর্থাৎ বিজয় অর্জনের যুদ্ধের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।

এ থেকে বুঝা যায় যে, রমজানের সাথে জিহাদের একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। কুরআনের আদেশ-নিষেধ তথা ইসলামি জীবনব্যবস্থা কায়েমের জন্য রমজানেই গুরুত্বপূর্ণ জিহাদগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ হিসেবে আমরা রমজানকে শক্তি ও বিজয়ের মাস বলতে পারি। আমাদের বিশ্বাস, রমজানের বরকতেই মুসলমানরা সেগুলোতে বিজয় লাভ করেছে। মুসলমানরা এই মাসে এত বিজয় লাভ করেছে যা হয়তো অন্য কোন মাসে সম্ভব হয়নি। এই মাসে এমন একটি উল্লেখযোগ্য জিহাদও নেই, যাতে মুসলমানরা পরাজিত হয়েছে।

হিজরি প্রথম সালের প্রথম রমজানে মুসলমানরা সর্বপ্রথম হামযাহ বিন আবদুল মুত্তালিবের নেতৃত্বে ছোট একটি মুজাহিদ বাহিনী পাঠায়। এরপর উবাদাহ বিন হারেস বিন আবদুল মুত্তালিবের নেতৃত্বে আরো একটি মুজাহিদ বাহিনীকে অভিযানে পাঠানো হয়। প্রথম হিজরির রমজানে পরপর দুটি মুজাহিদ বাহিনী পাঠানোর পর মদিনার ইহুদিদের মনে ভয়ের সঞ্চার হয়, মুসলমানদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং জিহাদের প্রস্তুতির জন্য সবাই মানসিকভাবে তৈরি হতে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সময়েই রমজান মাসে দুটো গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ সংগঠিত হয়। প্রথমটি বদরের যুদ্ধ ও দ্বিতীয়টি মক্কা বিজয়।

দ্বিতীয় হিজরির সতেরো রমজান জুমাবার মদিনা থেকে দক্ষিণে বদর প্রান্তরে মক্কা থেকে আগত কাফের কুরাইশ বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলমানদের এক তীব্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে মুসলমানরা জয় লাভ করে। পবিত্র কুরআনে বদরযুদ্ধের এই দিনকে ‘ইয়াইমুল ফুরকান’ তথা সত্য-মিথ্যা ও হক-বাতিলের পার্থক্যকারী দিন বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই দিনেই জিহাদ ফরয হয়। বদরের ঐতিহাসিক এ যুদ্ধের মাধ্যমে আল্লাহ ইসলামের শিকড় মজবুত করেন।

অষ্টম হিজরির ২০ রমজান মুসলমানদের অন্যতম ঐতিহাসিক বিজয় ‘মক্কা বিজয়’ এর ঘটনা ঘটে। এই দিনে দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে। আবু সুফিয়ানসহ মুশরিক-কাফির নেতাদের একটি বড় সংখ্যা ইসলামে প্রবেশ করে। এই বিজয়ের দিনেই কা‘বা চত্ত্বরের ৩৬০টি মূর্তি ধ্বংস করা হয়।

৯ম হিজরির রমজান মাসে তাবুক যুদ্ধের কিছু কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়। তাবুক যুদ্ধ রোমান বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) রমজান মাসেই তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসেন। যুদ্ধ তাঁর লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়। যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল, রোমান বাহিনীকে মুসলিম রাষ্ট্রের শক্তি ও প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত করা। এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবদ্দশায় রমজানে অনেকগুলো ছোট বড় জিহাদ সংঘটিত হয়।

দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমার বিন খাত্তাব (রা.)’ – এর আমলে ১৫ হিজরির ১৩ রমজান হযরত আবু উবাইদাহ বিন জাররাহ জেরুজালেম জয় করেন। মক্কার মত মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্র স্থান বাইতুল মাকদিসও এই পবিত্র রমজান মাসেই জয় করা হয়। হযরত উমার (রা.) এর শাসনামলে পারস্য বিজয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়। কেননা রোমান সাম্রাজ্যের পাশাপাশি তৎকালীন পরাশক্তি পারস্য সাম্রাজ্যও মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। তারা সীমান্তবর্তী আরব মুসলমানদের মধ্যে ইসলামি শাসনের বিরুদ্ধে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।

মহানবীর (সা.) -এর জীবদ্দশায় তাঁর প্রেরিত দূতকে পারস্য সম্রাট খসরু অপমান করেন। এছাড়াও আরবদের সাথে পারস্যের বাণিজ্যিক সম্পর্কও হুমকির সম্মুখীন হয়। তাই খলিফা উমার (রা.) হযরত সা‘দ বিন ওয়াক্কাসকে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি বানিয়ে পাঠান। কাদেসিয়ার ময়দানে পারস্য সম্রাট ইয়াযদাগারদের প্রধান সেনাপতি রুস্তমের সাথে ১৫ হিজরির রমজান মাসে মোকাবেলা হয়। তাতে রুস্তম নিহত হয় ও মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে।

তৎকালীন পরাশক্তি রোমান সাম্রাজ্য ইসলামকে সমূলে উৎখাত করার বহু চেষ্টা চালায়। হযরত আমর ইবনুল ‘আস ২০ হিজরির ২ রমজান ব্যাবিলন দূর্গ অবরোধ করার পথে রোমান বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন। উমাইয়া খলীফা ওয়ালিদের শাসনামলে তাঁর সেনাপতি মূসা বিন নুসাইর ৯১ হিজরির প্রথম রমজান তুরাইফ বিন মালেককে স্পেনের রাস্তা আবিস্কারের জন্য পাঠান। তারপর ৯২ হিজরির রমজান মাসে তারেক বিন যিয়াদের হাতে স্পেন জয় হয়।

তারেক নৌকার মাধ্যমে পানি সীমা পেরিয়ে স্পেনে পৌঁছে মুসলিম সেনাবাহিনীর নৌকাগুলোকে জ্বালিয়ে দিয়ে বলেন, “হে সৈন্যরা, তোমাদের পেছনে সাগর, সামনে শত্রুবাহিনী। আল্লাহর কসম, তোমাদের জন্য ঈমানের দাবিতে সত্যবাদিতার বাস্তবায়ন ও ধৈর্যধারণ ব্যতীত বাঁচার আর কোনো পথ নেই।” এ পরিস্থিতিতে তারা শত্রুবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং বিজয়ের সূর্য ছিনিয়ে আনেন।

৯৩ হিজরীর ৯ রমজান মূসা বিন নুসাইর স্পেনে পরিপূর্ণ জয়লাভের জন্য আক্রমণ চালান। হিজরি ৯৬ সালের রমজান মাসে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের হাতে অত্যাচারী সিন্ধু রাজা দাহির পরাজিত হয় এবং উমাইয়া শাসক ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালেকের শেষ আমলে সেখানে মুসলিম শাসন কায়েম হয়। এই বিজয় ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রচার প্রসারের সূচনা করে।

২১২ হিজরির রমজান মাসে যিয়াদ বিন আগলাবের হাতে ইতালির সিসিলি দ্বীপ জয় হয়। ২২৩ হিজরির ৬ রমজান, রোববার আব্বাসি খলিফা মু‘তাসিম বিল্লাহ বাইজানটাইন সম্রাটকে পরাজিত করে আমুরিয়া জয় করেন। ৫৩২ হিজরীর রমজান মাসে ইমাদুদ্দিন জেনকি’র নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী উত্তর সিরিয়ার আলেপ্পো শহর জয় করেন এবং খ্রিস্টান ক্রুসেডারদেরকে পরাজিত করেন। সিরিয়া তখন রোম সম্রাটের অধীন ছিল।

১১৮৭ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৫৮৩ হিজরির রমজান মাসে মিসরের সুলতান সালাহুদ্দিন ইউসুফ বিন আইউব বাইতুল মাকদিস উদ্ধারের লক্ষ্যে হিত্তিন ময়দানে পৌঁছেন এবং ১ লাখ ৬৩ হাজার খ্রিস্টান অশ্বারোহীকে পরাজিত করেন। মুসলিম বাহিনী জেরুজালেমের খৃস্টান রাজাকে বন্দী, ৩০ হাজার সৈন্য আটক ও অন্য ৩০ হাজার সৈন্যকে হত্যা করে বিজয় লাভ করেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক রমজানে নয় বরং রজব মাসে জেরুজালেম বিজয় হয় বলে উল্লেখ করেছেন।

৬৫৮ হিজরির সফর মাসে তাতারদের নেতা হালাকু খানের হাতে বাগদাদের ইসলামি খেলাফতের পতন হয়। ৬৫৮ হিজরির ২৫ রমজান মোতাবেক ১২৬২ খ্রিস্টাব্দে তাতারিদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের নাবলুস ও সিরিয়ার বিসানের মাঝামাঝি আইনে জালুত নামক স্থানে উপস্থিত হন। জাহের বাইবারস জেরুজালেমের ওপর তাতারিদের আক্রমণ প্রতিহত করে বায়তুল মাকদিসকে রক্ষা এবং তাদের মিসর অগ্রাভিযান প্রতিহত করেন। এই যুদ্ধে মুসলমানরা জয়লাভ করেন।

জাহের বাইবারস ৬৬৬ হিজরীর রমজান মাসে তাতারদের কাছ থেকে তুরস্ক দখল করেন। রমজান মাসে মুসলমানদের বিজয়ের ধারা অব্যাহত থাকে। ৭০২ হিজরী রমজান মাসে মিসরীয় বাহিনী তাতারদের আরেকটি অভিযানকে ব্যর্থ করে দেয় এবং দক্ষিণ দামেস্ক থেকে ১০ হাজার তাতার সৈন্যকে আটক করে।

দীর্ঘ তিন শতাব্দী যাবত খ্রিস্টানরা মুসলমানদের সাথে ক্রুসেডে লিপ্ত থাকে। পূর্ব বাইজাইনটাইন খৃষ্টান সাম্রাজ্য, স্পেন এবং পূর্ব আরব দেশসমূহে ঐ সকল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসানের পর বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন পুনরায় মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে শক্তিশালী করে তোলার প্রয়োজন দেখা দেয়। তুরস্কের উসমানি শাসক সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ দীর্ঘ ৫৯ দিন কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করার পর তা জয় করেন। তিনি পবিত্র রমজানে ১৪০৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ মে বিজয়ীর বেশে কনস্টান্টিনোপল প্রবেশ করেন এবং তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত মসজিদ আয়াসুফিয়ায় নামায আদায় করেন। কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের কারণে বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, যুগোশ্লাভিয়া এবং অষ্ট্রিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইসলামের প্রচার প্রসার শুরু হয়।

এভাবে ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলে আমরা আরও বিজয়ের সন্ধান পাবো। যেমন : ২২২ হিজরির রমজানে খলিফা মু‘তাসিমের আমলে খোরাসানের ‘বাবাক’ শহর বিজয় হয়। ২২৩ হিজরির ৬ রমজান মু‘তাসিম বিল্লাহ’র নেতৃত্বে উমূরিয়্যাহ বিজয়, ৫৭০ হিজরির ১৪ রমজান সুলতান সালাহুদ্দিন আইউবি কর্তৃক শামের ‘বা‘লাবাক’ শহর বিজয় ইত্যাদি।

আমরা দেখলাম রমজানেই অর্জিত হয়েছে মুসলমানদের এক ঐতিহাসিক বিজয়ধারা। মুসলমানরা প্রায় সব ইসলামবিরোধী মতবাদ ও দলের বিরুদ্ধে রমজান মাসেই বিজয় লাভ করেছে। মূর্তিপূজারী মুশরিকদের বিরুদ্ধে বদর ও মক্কা বিজয়। অগ্নিপূজক পারস্যের বিরুদ্ধে বুওয়াইবের যুদ্ধে বিজয়। আন্দালুসের বারবাত উপত্যকায় ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জয়। সুলতান সালাহুদ্দিনের সাফেদ বিজয়। তাতারিদের বিরুদ্ধে আইনে জালুতে বিজয়। অনুরূপভাবে ১৩৯৩ হিজরির ১০ রমজান (৬ অক্টোবর ১৯৭৩ খ্রি.) মুসলমানরা এক মহান স্বাধীনতার বিজয় লাভ করে। সেটা হলো সিনাই উপদ্বীপের স্বাধীনতা লাভ। এসব ঘটনাপ্রবাহ থেকে বুঝা যায়, ত্যাগের মাসেই মুসলমানরা অনেক উল্লেখযোগ্য বিজয় লাভ করেছে।

আগের সংবাদচীনের প্রতিবেশি ভিয়েতনামে কেন একজনও মারা যায়নি করোনায়
পরবর্তি সংবাদরোজা ও স্বাস্থ্য : ধর্ম ও বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যা