শরীয়ত, তরিকত, মারেফত, হাকীকত

সাইফ সিরাজ:

শরীয়ত

বিপুল দ্রোহ নিয়ে তেতে আছে ভাবসরোবর। উজিয়ে চলার তীব্রতা কমছে না। নিমন্ত্রণ যেখানে; চিনি না সেই গন্তব্য। যেখানে যাওয়ার নয়; সেখানেই ফেলেছি নোঙর। সব হাতছানি দেখা যায়। সবার কাছেই যাওয়া যায়।

কিছুটা প্রকাশ্যে। কিছুটা গোপনে। অবনত থাকার প্রতিজ্ঞা। লৌকিক অনুরাগে নিয়ন্ত্রিত আবেগের অবয়বে সিদ্ধান্তের বাহাস। আহ্বান আসে অলোক; আত্মার কাতরতায় করে যাই আত্মসমর্পণ। পালিয়ে ফিরে আসি। বারবার মুখ লুকিয়ে আবার দৃশ্যমান হই। অতীতের ভুল মুছে আগামীর পথ চিনি। বর্তমানের বুকে অনুতাপের চিত্রকল্প এঁকে; অপেক্ষায় থাকি অলোক অনুবাদের।

নিয়মের অনুগামী সভয়ে। আত্মনিয়ন্ত্রণে বাঁচে অনুরাগ। সমর্পনে নির্ভার হয়ে খুঁজি তাকওয়ার পথ। ত্যাগের মিছিলে স্লোগান দিয়ে লুটিয়ে পরি সিজদায়। অনুরাগে বেতাব ফকির হয়ে যাই। বিনয়ের জাম্বিলে চাই ক্ষমার প্রতিদান। দাসত্বের সুখে গোপন রাখি না কিছুই। বিশ্বাস আমার চলার পথের বিনিয়োগ হয়ে যায় অনায়াসে। কৃতজ্ঞতার জন্য শব্দ খুঁজে চলি অনবরত। সমাধির ভাবনাতে মুক্তির বাণিজ্য করি তোমার সঙ্গে। আমার অস্তিত্ব জুড়ে আমিত্বহীন নিবেদনে অনন্ত সুখের স্বপ্ন বুনি।

মুনাজাতে অশ্রু। সিজদাতে নিশ্চল নিথর। রোজায় ব্যাকুল গোলাম। যাকাতের গোপন আলাপে নিঃশর্ত নিবেদন। হজ্বের সফরে নিতান্ত কিশোর যেনো; মুক্তি পেলো পিতার চোখ রাঙানি থেকে।

খোদা! আমার শব্দ নিতান্ত কম। তোমার কাছে মূলত আমি এক আদেশের বাটন। আমি দেখি। আমাকে দেখে। অনুভব করি। আমাকে দেখো। এই দেখাদেখির ভেতর দিয়ে যেই চেনাজানা নিয়ে আসে পরিচয়; সে আমার নিবেদন! আমার ভেতর-বাহির খুলে যায় যিকিরের মগ্নতায়!

তরিকত

কে আমি! কেনো আমি! কোথায় ছিলাম! কোন পথে এলাম! কোন পথে যাবো গন্তব্যে? আমার ‘আমি’ কোথায়? সেই ‘আমি’ এলো কোন পথে? কোথায় এখন তার ঠিকানা! সেই ঠিকানার পথে কে যায়? কে চেনে?

একটা এবস্ট্রাক্ট গাড়ির মতো আমি। সেইখানে চালক হয়ে ঠিকানা গেড়েছে আরেক ‘আমি’। সেই আরেক ‘আমি’র নাটাই ধরেছে আরেক প্রবল প্রতাপ। যাঁর ইশারায় আরেক ‘আমি’ চলছে নতুন ঠিকানার পথে। আমি এক অদৃশ্য পথ ধরে নিরাপদ ঠিকানায় নেমেছিলাম। একদিন সেই ঠিকানার ঠাঁই কমে গেলে নতুন পথে নেমেছিলাম। সেই পথে চলতে চলতে পেয়ে গেলাম এক অরক্ষিত ঠিকানার সন্ধান।

সেই অরক্ষিত ঠিকানার পথে পথে পথিক আমি। ছুটে চলেছি এক অনন্ত ঠিকানার সাক্ষাতে। অচেনা পৃথিবী ছেড়ে চেনা পৃথিবীর পথে সফরে এখন আমি। এই চেনা ঠিকানা থেকে আরেক ঠিকানার সফরে অবিরাম আমার পথ চলা। সে চলার সামনে আছে আমার চূড়ান্ত পরিচয়। আমি চিনবো আমাকে। চিনবো আমার নাটাই।

আমার এইসব পথ যেখানে এসে শেষ হবে; সেখানেই হবে পথ, পথিক আর শব্দের সমাপ্তি। এই পথের পথিক হয়ে আমার ছুটে চলার ইতিহাস থেকে যাবে; আমি ছুটতে থাকবো। ছুটতে থাকবো অনন্ত পথে। অনন্ত সুখের পথে। পথিক হবো যেনো পথের শেষে ঠিকানা পাই। যেই ঠিকানা কামনার। প্রাপ্তির। আরাধনার। যেই ঠিকানা ডাকে আলোর পিদিম নিয়ে। ডাকে সুখের জামা নিয়ে; রাখে পথিকের কামনার মতো সুখে…

হাকীকত

ঘর কার! আমি কার! এইসব প্রশ্নের চেয়ে মূখ্য হয়ে যায় প্রতিটা দৃষ্টি। দৃষ্টিভঙ্গি। আদম থেকে মুহাম্মাদ। মুহাম্মাদ থেকে কিয়ামত। রুহ থেকে প্রাণ। প্রাণ থেকে পৃথিবী। পৃথিবী থেকে কবর। কবর থেকে হাশর। হাশর থেকে প্রতিদান। জান্নাত। জাহান্নাম। এইসব শুধু শব্দ আর ভাষাই থেকে যায়। পেছনে এবং সামনে কিংবা সবখানে তোমার সক্ষমতা।

আমি আর আমি থাকি না। একটা প্রোগ্রামের ইলামেন্ট হয়ে যাই। যেখানে আমার কোন ইচ্ছে থাকে না; থাকে ইচ্ছে নিয়ন্ত্রণের আদেশ। থাকে না আমিত্ব; থাকে আমিত্ব বিনাশের শেষে পরমের সান্নিধ্যের আকাঙ্ক্ষা। বিপুল সুখের ভেতরেও জেগে উঠে কুরবানীর ইতিহাস। জেগে উঠে তোমার সামনে দাঁড়ানোর আদালত।

আমি চিনে যাই তোমাকে। হয়ে যাই তোমার। আমার বলে যতকিছু চিনি সবকিছু ফেলে দেই। ধারণ করি এক পরাক্রমের দাসত্ব। দৃষ্টি অথবা অনুভবে, সৃষ্টি অথবা সৃজনে, পৃথিবী অথবা কবরে, চাঁদ অথবা সূর্যে, সাগর অথবা নদীতে; যেখানেই থামি তোমাকেই পাই। পাই তোমার কুদরতের অস্তিত্ব।

কোথাও আমি থাকি না। আমিত্ব থাকে না। থাকে তোমার সক্ষমতা। আকাশ, মাটি অথবা চেনা পৃথিবীর কোথাও আমার নেই ঠাঁই যেখানে রবো; তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন। আমার আবেগ, অনুরাগ, চৈতন্য, দাসত্ব সব চলে যায় তোমার দখলে। সেই দখলদারি দেখে অপার আনন্দে আমি ফেরার আয়োজনে মগ্ন হই। এরপর আমি থেকে যাই একটা রিমোটের নিয়ন্ত্রণে। আমিত্ব ভুলে হয়ে যাই একটা হুকুম শুধু।

মারেফত

দু’চোখ বন্ধ করি। কানের জন্য সাজাই অপার নিরবতা। নিঃশ্বাসের ধ্বনিকে পাঠাই সুদূর তেপান্তরে। প্রতিবেশে নেমে আসে নিশ্চুপ ও নিশ্চলতার ফেরেশতা। দেহের তন্ত্রীতে বসে শীতল বরফ। মগজের নিউরণে স্তব্ধ অনুভব। নীল জলরাশির আদিগন্ত সমূদ্রের মধ্যিখানে আমি। একা। জেগে আছে চাঁদ। তার পাশে তারাদের টহল। কোথাও ফেরার নেই। কোথাও স্বপ্ন নেই। আবার কোলাহলে মুখরিত হবার বাসনা নেই।

ঠিক তখন একা আমার সঙ্গে চাঁদ কিবা তারা নয়; তুমি থাকো। তোমার পরিচয় পেয়ে যাই আমি। আমি দ্বিধাহীন তুমিত্বে সমর্পিত হই। অপার মুগ্ধতায় চাঁদ আমাকে দেখে। তারারা আমাকে দেখে। সাগরের ঢেউ আমাকে দেখে। কুৎসিত নিরবতা মুখরিত হয় তোমার শংসাতে। পরম সুখে দু’চোখ বুজে ভুলে যাই আমাকেই আমি। এরপর আমার সমগ্র সত্তা জুড়ে থাকে কেবল তোমার পরিচয়।

দাসত্বে নত আমাকে তুমি দেখো। আমি তবুও অনুরাগ ভুলে যাই। স্বাধীন হতে চাই। ছুটে বেড়াই এদিক সেদিক। অনুভবে জেগে উঠে হাজার ‘আমি’। তোমার নিমিত্তে আমার বিনয়ে ভাগ বসায় অগণিত ঔদ্ধত্য। আমি লজ্জিত হই। দেখতে চাই তোমাকেই। যেনো একাগ্রতার অনুভবে হতে পারি পৃথিবীহীন।

আমার দাসত্বে আমি তোমাকে দেখি। নিস্তেজ হতে থাকি। প্রতিটি হাঁড়ের জোড়া শিথিল হয়ে যায়। পেশির টানটান টিস্যূগুলো নেতিয়ে পড়ে। রক্ত চলাচলে এক ঝিমধরা নীরবতা। চোখের সাগরে ঢেউ তুলে অফুরন্ত অশ্রুপাত। অস্তিত্বহীন এক আমিত্বের মুখোমুখি দাঁড়াই। অচিন এক স্পর্শের অনুভবে কোষে কোষে জেগে থাকা যাতনার ইতিহাস মুছে যায় নিমিষেই।

আগের সংবাদসাল্লু আলাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা
পরবর্তি সংবাদআশ্চর্য ডাক