শামসুল হক ফরিদপুরীর অপ্রকাশিত পত্রাবলি

আবদুল্লাহ আল মুনীর

মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরি রহ. সে মহান ব্যক্তিত্বের নাম— বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে যার বরকতের পরশ লেপ্টে আছে। বর্ণাঢ্য এক জীবনে তিনি উম্মাহর কল্যাণে কী না করেছেন! ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাতে তিনি ছিলেন অনন্য। তাঁরই সমকালীন আরেক মহান বুযুর্গের নাম— মুফতি আজম ফয়জুল্লাহ রহ.। সুন্নাহর উজ্জীবন ও বিদআতের মূলোৎপাটনে যিনি পুরো জীবনটি ব্যয় করেছেন৷ যার ফিকহি গবেষণায় উন্মোচিত হয়েছে বহুকাল ধরে সমাজে প্রচলিত হয়ে আসা নানা প্রচলনের প্রকৃতাবস্থা। ফরিদপুরি রহ. এর বিচরণকেন্দ্র ছিলো ঢাকা, আর মুফতি আজম রহ. চট্টগ্রামের মফস্বল এক গ্রামে নিরবে নিভৃতে উম্মাহর কল্যাণে তাজদিদি কাজের আঞ্জাম দিয়েছেন৷ সমকালীন এই দুই বুজুর্গের কি কখনো দেখা হয়েছে? আমার ধারণামতে এর সম্ভাবনা খুবই কম। তবে দুজনের মাঝে পত্রালাপ হয়েছে। আমরা উর্দু ভাষায় লেখা দুটি পত্র খুঁজে পেয়েছি। দুটি পত্রেই আলাপ হয়েছে ফিকহি বিষয়আশয় নিয়ে। তবে এতেও সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষার উপাদান আছে। আগে পত্রদুটো পড়ি—

এক.

মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরির পক্ষ থেকে
২৬ শাওয়াল ৮০ হিজরি,
জনাব মুহতামিম সাহেব ও মুফতি আজম পূর্ব পাকিস্তান, হাটহাজারী মাদরাসার নিকট
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

শায়খুল আযহারের সেই ঈদ সম্পর্কিত সংবাদ হয়তো পেয়ে থাকবেন। তার জবাবে আল্লামা ইহতেশামুল হক থানভী রহ. কিছুটা লিখেছেন, যা রোজনামা জঙ্গে প্রকাশ হয়েছে। তবে এ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুফতি আজমের পক্ষ থেকে বিশ্লেষণধর্মী উত্তর আসা উচিত। আমার ধারণামতে আল্লামা জায়লায়ী রহ.-এর চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতার গবেষণার উপর উলামায়ে কেরামের এক সম্মিলিত ফাতাওয়া আসা চাই। এটা বড় এক ফিতনা, এই ফিতনা থেকে বাঁচার উপায় আপাতদৃষ্টিতে এমনই মনে হচ্ছে আমার নিকট।

—আহকার শামসুল হক

মুফতি আজম রহ. কতৃক চিঠির উত্তর

হামদ ও সালাতের পর। এটা শেষ যামানা। কিয়ামত সংগঠিত হবার আগের যুগ। ফিতনা, ফাসাদ, মুক্ত চেতনা ও নাস্তিকতার যুগ। এই যুগের মানুষদের ভেতর আত্মরায় ও অহংকার প্রবেশ করেছে। ইলমের দাবিদার তথা দীন ও মিল্লাতের উপর যাদের অটল থাকার কথা, তাদের প্রায়ই দীন-ধর্ম, কুরআন-হাদিস ও দীনের নির্দেশনাকে নিজের মতাবলম্বী করে রেখেছে। আল্লাহর নিকট পানাহ চাই । এই নাজুক সময়ে শায়খে আযহারের একটি বক্তব্য প্রকাশ হয়েছে। তিনি বলেছেন, যদি এক শহরে চাঁদ দেখা যায় তাহলে পুরো বিশ্বে ঈদ পালন করতে হবে।

তিনি আরও বলেছেন, যদি কোনো এক মুসলিম দেশে চাঁদ দেখা যায় তাহলে ঐ দেশের উপর ফরয হয়ে যাবে টেলিফোন, টেলিগ্রাম বা রেডিওর মাধ্যমে অন্যন্য দেশগুলোকে খবর পৌঁছিয়ে দেয়া। অবাক হই, কত বড় দাবি, অথচ কোনো দলিল নেই। দাবি শুধুই দাবি। এ ধরনের দাবির ফল লজ্জিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। মানুষ ভুল করে লজ্জিত হয়, আর এ ধরনের মানুষ ভুল না করেও লজ্জিত হয়। উক্ত ফাতাওয়ার লক্ষ্য নিজ নফসের অনুসরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। শায়খে আজহার মুজতাহিদ নাকি মুকাল্লিদ বুঝতে পারছি না। যদি তিনি মুজতাহিদ হয়ে থাকেন, তাহলে তার কাছে প্রশ্ন হচ্ছে, তার দাবি কোন আয়াত বা হাদিসের স্পষ্ট-অস্পষ্ট ব্যাখ্যা বা দলিল থেকে প্রমাণিত হয়? আর যদি তিনি মুকাল্লিদ হয়ে থাকেন, তাহলে তার জন্য উচিত ছিলো তার দাবিকে মাযহাবের গ্রহণযোগ্য কিতাবের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে দেয়া। কিন্তু আফসোস! এসবের কিছুই তিনি করতে পারেননি।

সালাফদের যুগে একই দিনে ঈদ পালনের জন্য কোনো গুরুত্বারোপ করা হতো কি? কখনই না। এ সম্পর্কে হাদিস বা মাযহাবের গ্রহণযোগ্য কোন কিতাবে গুরুত্ব এসেছে? কখনই আসেনি। সুতরাং এই নির্দেশনা পালনের ক্ষেত্রে শরিয়তের কোনো দলিল নেই। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ইচ্ছে হলে ‘রিসালায়ে ইজালাতুল খুবতি ওয়াল হাইমান’ এবং ‘রিসালায়ে ইজহারুল ইখতিলাল ফিল ইতিদাল’ অধ্যায়ন করতে পারেন। ইনশাআল্লাহ এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা হবে।

আহকার ফয়জুল্লাহ আফাল্লাহু আনহু ৪ যিকাদাহ ১৩৮০ হিজরি, হাটহাজারী

দুই.

মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরির পক্ষ থেকে হযরতুল আল্লাম মুফতি ফয়জুল্লাহ সাহেবের নিকট
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু

সালাম বাদ আরজ হচ্ছে, ইদানীংকালে রাষ্ট্রীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাসআলা নিয়ে আমরা বেশ চিন্তিত। কিছুটা সেই প্রসিদ্ধ প্রবাদবাক্যের মত ‘না রয়েছে চলার মত পা, না রয়েছে থাকার মত জায়গা।’ আমার দৃষ্টিতে পুরো পাকিস্তানে আপনার মত ব্যক্তি এমন, যার মাধ্যমে এ মাসআলার সমাধান আশা করা যেতে পারে। এ জন্য আপনার কাছে এ আবেদন, আশা করি সন্তোষজনক উত্তর দিয়ে কৃতজ্ঞ করবেন।

এ ব্যাপারে আরও বিশদভাবে ফরিদপুরি রহ. আরেকটি পত্রে লিখেছিলেন,

‘পাকিস্তানের চলমান নির্বাচনে প্রধান দুইজন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথমজন হচ্ছে— শরিয়তবিরোধী, কুরআন-সুন্নাহর অস্বিকারকারী, শান্তিপূর্ণ সমাজ ভেঙে অন্যায়ের শাসন কায়েমের পক্ষপাতী, জনসাধারণের অর্থসম্পদ আত্মসাৎকারী। দ্বিতীয় প্রার্থী একজন মহিলা। শরিয়তের পরিভাষায় যারা দুর্বল-জ্ঞানের অধিকারী। এমতাবস্থায় যদি আমরা প্রথম ব্যক্তির সমর্থন করি, তাহলে একজন ইসলামবিরোধীকে সমর্থন করা হবে। আর দ্বিতীয় ব্যক্তির পক্ষপাতীত্ব করার অর্থ দাঁড়াবে কারাহাতে লিপ্ত হওয়া। এই অবস্থায় আমার প্রশ্ন হচ্ছে- রাষ্ট্র পরিচালনায় স্থিতিশীলতা, মানুষের শ্রমের উপযুক্ত প্রতিদান, ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামবিরোধীদের বিপক্ষে অবস্থানের লক্ষ্যে আমরা মুহতারামা ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন করতে পারি? উপরিউক্ত ফরজসমূহ আদায় করার পরও কেউ কারাহাতে লিপ্ত হতে পারবে? এই মাসআলাকে কি হজের ঐ মাসআলার উপর কিয়াস করা যায় যে- হজের ক্ষেত্রে ছবি তোলাকে ফুকাহায়ে কেরাম নীতিগত কঠোরতার জন্য জায়েজ বলে থাকেন? অথবা ঐ যুবতী মহিলার অবস্থার উপর কিয়াস করা যায়— যে মহিলা পানিতে ডুবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে আর তাকে বাঁচাতে পানি থেকে ধরে উঠানো আবশ্যকীয় হয়ে যায়? আশা করি এ ব্যাপারে আপনার গুরুত্বপূর্ণ মতামত জানিয়ে বাধিত করবেন।

—আহকার শামসুল হক

উত্তরে মুফতি আজম রহ. লিখেছিলেন,

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তবে দু’চারদিন যাবত অসুস্থতা বেড়ে গেছে। মস্তিস্কে দুর্বলতা অনুভূত হচ্ছে। এই অবস্থায় কোনো কাজ করতে পারছি না। সংক্ষিপ্ত উত্তর লিখছি। একজন নারী নিঃসন্দেহে নাকেসাতুল আকল (অসম্পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী)। নারী কখনও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উপযুক্ত নয়। উপরিউক্ত অবস্থাকে আপনার বর্ণিত মাসআলার দ্বারা কিয়াস করা সঠিক হবে না । তাতে অন্যায়কে অপছন্দ করা হচ্ছে ঠিকই, তবে তা কাল্পনিক ও সন্দিহান এক উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে। যদি উদ্দেশ্য সফল হয়, অর্থাৎ ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা, তবুও আপাতদৃষ্টিতে তা কাল্পনিক, মোটেও বাস্তবতা নয়। আর বর্ণিত মহিলাও তো পরহেযগার ও সহিহ আকিদাসম্পন্ন নয়, নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত আকিদা লালনকারী। তাই এ মাসআলা নিয়ে গবেষণা করা উচিত, সবকিছু বুঝে শুনে করতে হবে।’

—আহকার ফয়জুল্লাহ আফাল্লাহু আনহু
২৫ জুমাদাল উলা ১৩৮৪ হিজরি, হাটহাজারী

দুটি পত্র থেকে দুটি বিষয়কে আমরা উপলব্ধি করবো। প্রথমত, উভয় চিঠিতে আমরা দুজন মহান মনীষীর মাঝে দীনী সংকটকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা দেখতে পাই। নিরঙ্কুশভাবে তারা চেয়েছেন উম্মাহর কল্যাণ৷ এক্ষেত্রে আত্মগরিমাকে বহুদূরে ঠেলে মুফতি আজমের কাছে ফিকহি সমাধান জানতে চেয়েছেন ফরিদপুরি রহ.। বর্তমান সময়ে দীন ও উম্মাহর কল্যাণে আলেমদের পারস্পরিক এই বোঝাপড়া খুবই লক্ষণীয় ও বিবেচ্য।

দ্বিতীয়ত, যত্রতত্র কিয়াসের ব্যবহার নিয়ে দুজন কতটা সতর্ক ছিলেন— তাও লক্ষণীয়। ফরিদপুরি রহ. সমপর্যায়ের ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও একটি কিয়াসি মাসআলাকে রাখঢাকহীন সবিস্তারে খুলে বলেছেন৷ মুফতি আজমও স্পষ্টভাবে নিজের মত ব্যক্ত করেছেন৷ ফাতাওয়ার এ ধরনটি সাধারণ জিজ্ঞাসু মানুষ ও মুফতি— উভয়শ্রেণির জন্য আদর্শ হবার যোগ্য।

আগের সংবাদসামর্থ্য থাকলে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের বেতন বাড়ানো উচিত: উবায়দুর রহমান খান নদভী
পরবর্তি সংবাদপ্রশ্নফাঁসের চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা : শিক্ষামন্ত্রী