হুসাইনিয়া চিশতিয়া : যে সুন্নিরা `কারবালা’ পালন করেন

রাকিবুল হাসান নাঈম:

কাশেদ ইমামবাড়া, সূত্রাপুর, ডালপট্টি। ইমামবাড়ার জন্য এখানে নির্ধারিত কেনো বিল্ডিং নেই। রাস্তার পাশেই এই ইমামবাড়াটি অস্থায়ীভাবে বানানো হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবকদের গায়ে কালো পাঞ্জাবি। মহা উৎসাহে তারা বাঁশ কুপছে, ব্যানার টানাচ্ছে। মহররমের দশ তারিখ কারবালার স্মরণে এখান থেকেই বের হবে তাজিয়া মিছিল। পথের মোড়ে মোড়েও টানানো হয়েছে ডোরাকাটা নিশান। আপাতদৃষ্টিতে তাদেরকে শিয়া মনে হলেও তারা মূলত শিয়া নন। তাদের দাবি অনুযায়ী তারা সুন্নী। ইমাম হোসাইনের স্মরণে তারা তাজিয়া মিছিল বের করেন। কারবালার স্মরণে মিলাদ-মাহফিল আয়োজন করেন।

সুন্নীদের কারবালা পালন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারবালার স্মরণে তাজিয়া মিছিল শিয়াদের অনুষঙ্গ হলেও অনেক সুন্নী মুসলিম কারবালা পালন করে থাকেন। মিলাদ-মাহফিল ও জারিগানের মাধ্যমে দিনটিকে তারা উদযাপন করেন। কাশেদ ইমামবাড়ার একজন স্বেচ্ছাসেবক আরিফ রহমান। তারা শিয়া কিনা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ‘তাওবা, তাওবা। কী বলেন। আমরা সুন্নী। ইমাম হুসাইনের স্মরণে বছরে একটা দিন তাজিয়া মিছিল করি। ইমামবাড়া বানাইতাসি, এখান থেইক্কা মিছিল বের হইব।’

সাধারণত প্রোগ্রাম কেমন হয় জানতে চাইলে আরিফ রহমান বলেন, ‘সকালে তাজিয়া মিছিল। তারপর মিলাদ-মাহফিল৷ সবশেষে তবারক।’

আখাউড়ায় রাজেন্দ্রপুর চিশতিয়া হুসাইনিয়া দরবার শরীফের তত্ত্বাবধানে প্রতিবছরই কারবালা পালন করা হয়। তারাও মূলত সুন্নী। এ দরবার শরীফের তত্ত্বাবধানে ১০৮ বছর ধরে কারবালা পালন করা হয়। এ দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা নাসিরুদ্দিন চিশতি। বর্তমান গদ্দিনশিন পীর জাহের উদ্দিন চিশতি। করোনার কারণে গত দুই বছর বিশাল আয়োজনে কারবালা পালন করতে না পারলেও এবার পালন বড় করেই পালন করবেন তারা।

হুসাইনিয়া দরবার শরীফের ভক্তের মাধ্যমে গদ্দিনশিন পীরের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কথা বলতে না পারায় ভক্ত বলেন, ‘আমি আপনারে বইল্যা দেই। এতদিন ত করোনার কারণে হুজুর নিষেধ করতেন কেউ যেন না আসে। এবার সবাইরে নিয়াই কারবালা পালন করবেন। আগেরবারের মতো এবারও প্রতীকী ঘোড়া তৈরী করা হয়েছে। সবকিছু প্রস্তুত।’

তাজিয়া মিছিলের বিভিন্ন প্রতীক

তাজিয়া মিছিলে কারবালার দৃশ্যায়ন করতে বিভিন্ন প্রতীক ব্যবহার করা হয়। মিছিলে লম্বা বাঁশের মাথায় নানা রকম পতাকা বহন করা হয়। এগুলোকে বলা হয় আলম। এছাড়াও মিছিলের অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন নিশান নিয়ে আসেন। যে যার মতো এই নিশান বহন করেন। তাজিয়া মিছিলের অগ্রভাগে থাকে আলম বহনকারী বাহিনী। তার পেছনে থাকে বাদ্যকর; তৎপশ্চাতে কয়েকজন লোক লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে ও তরবারি চালাতে চালাতে অগ্রসর হয়। এ সময় দুটি শিবিকাসহ অশ্বারোহী সৈন্যের সাজে কয়েকজন লোক শোক প্রকাশ করতে করতে অগ্রসর হয় এবং তার পেছনে একদল গায়ক শোকগান গাইতে থাকে।

মিছিলে সবার পরে থাকে হুসাইন রাজি.-এর সমাধির প্রতিকৃতি। সমাধিটি কাঠ, কাগজ, সোনা, রূপা, মারবেল পাথর ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয়। ঢাকার হুসেনী দালানের তাজিয়াটি কাঠ ও রূপার আবরণ দিয়ে তৈরি, যা নবাব সলিমুল্লাহ দান করেন। তাজিয়া মিছিলে মাতম করা, বুক চাপড়ানো ও জিঞ্জির দিয়ে পিঠের ওপর আঘাত করে রক্তাক্ত করা হয়। তাজিয়া মিছিলে ‘হায় হোসেন’ মাতম তুলে ছোরা, কাঁচি, বর্শা, বল্লম, তরবারি নিয়ে নিজেদের শরীর রক্তাক্ত করা লোকদেরকে বলা হয় ‘পাইক’। এভাবে মিছিলটি নিয়ে লোকজন সম্মুখে অগ্রসর হয় এবং একটি পূর্ব নির্ধারিত স্থানে গিয়ে তা শেষ হয়। কোথাও কোথাও মিছিলে দু’টি কিংবা প্রতীকী ঘোড়াও ব্যবহার করা হয়। আখাউড়ায় রাজেন্দ্রপুর চিশতিয়া হুসাইনিয়া দরবার শরীফে প্রতি বছর কারবালার অনুষ্ঠানে প্রতীকী ঘোড়া বানানো হয়। ঘোড়াটাকে সাজানো বিভিন্ন রঙ্গের ঝাড়বাতি দিয়ে। অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করতে থাকে।

সোমবার সকালে সূত্রাপুর ডালপট্টিতে গিয়ে দেখা যায়, তাজিয়া মিছিল শুরু এবং শেষ করার জন্য একটি ইমামবড়া বানানো হয়েছে। তার আশপাশের গলিগুলোতে উড়ছে নির্দিষ্ট প্রকারের পতাকা।

May be an image of 1 person and outdoors

কারবালার অন্যতম অনুষঙ্গ ‘জারি’

নবীনগর থানার বাজেবিশাড়া গ্রামের পাক পাঞ্জাতন দরবার শরীফেও পালন করা হয় কারবালা। তারা বড় কোনো আয়োজনে জড়ান না। তবে খিচুরি রান্না করে বিতরণ করেন। রাতে আয়োজন করেন মিলাদ-মাহফিলের। আগে জারির প্রচলন থাকলেও এখন অনেকটাই কমে গেছে। একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। তবে জারি অনুষ্ঠানটি যতটুকু টিকে আছে, তাও গ্রামেগঞ্জে, শহরে নয়।

কারবালার হৃদয়বিদারক বিয়োগান্তক ঘটনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করার জন্য হজরত ইমাম হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের স্মরণে জারি গান পরিবেশন করা হয়ে থাকে। যেমন একটি জারি গান হলো: ‘মহররমের ঐ দশ তারিখে কী ঘটাইলেন রাব্বানা/ মায়ে কান্দে জি-এ কান্দে কান্দে বিবি সকিনা/ একই ঘরে তিন জন গো রাড়ি (বিধবা) খালি সোনার মদিনা।’

জারি শব্দের উৎপত্তি আহাজারি থেকে। জারি মূলত শোক সংগীত। কয়েকজন মিলে যৌথভাবে এ শোক সংগীত পরিবেশন করা হয়। মুসলিম সমাজে জারির উৎপত্তি কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মরণ করার উদ্দেশ্যে। যতদূর জানা যায় ইরাক এবং আশপাশের দেশে শিয়া সম্প্রদায় কারবালার জারির প্রচলন ঘটায়। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন আছেন। কিন্তু ব্যাপক আকারে এ অঞ্চলে কারবালার জারি ও অন্যান্য অনুষ্ঠানমালা পালন করেন মূলত সুন্নি সম্প্রদায়। তবে শিয়া সম্প্রদায়ের যে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করেন তারা তাদের নিয়মে মহররমের অনুষ্ঠানাদি পালন করে থাকেন। বাংলাদেশের শিয়া সম্প্রদায়ের মূল কেন্দ্র হচ্ছে পুরান ঢাকার হোসনি দালান। তারাই বাংলাদেশে মহররম কেন্দ্রিক অনুষ্ঠান পালনের সূচনা করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যেও মহররমের এ আনুষ্ঠানিক পালন করা হয়।

কোথাও কোথাও জারির জন্য আলাদা কোনো অনুষ্ঠান করা হয় না। বরং কারবালা কেন্দ্রীক মিলাদ-মাহফিলেই জারি গাওয়া হয়। কথা হয় পাক পাঞ্জাতন দরবার শরীফের গদ্দিনশীন পীর ড. শহীদুল্লাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আহলে বাইতকে মহব্বত করতে আল্লাহ তায়ালাই বলেছেন। ইমাম হুসাইন ছিলেন রাসুলের প্রিয়তম নাতি, মা ফাতেমার নয়নের টুকরা। তার শাহাদাতের ঘটনার স্মরণে আমরা দিনটি পালন করি। বাতিলের সামনে নত না হওয়ার যে শিক্ষা তিনি দিয়ে গেছেন, তার থেকে আমরা প্রেরণা লাভ করি। মিলাদ-মাহফিল করি, পাক-পাঞ্জাতন নিয়া সানা-সিফত গাই। তাজিয়া মিছিল করি, কিন্তু তাজিয়া বানাইনা। প্রতীকী ঘোড়াও বানাই না। আমরা আলোচনা করি হুসাইনের চেতনা নিয়ে, কারবালার শিক্ষা নিয়ে।’

আগের সংবাদআলেমদের সঙ্গে বৈঠক স্থগিত করলো সরকার
পরবর্তি সংবাদসুফি ধারাগুলোর মধ্যে বাড়ছে শিয়া প্রভাব