‘আরবি ভাষার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অনেক’

মাওলানা মহিউদ্দীন ফারুকী। আরবি ভাষাবিদ, তরুণ আলেম। পড়াশোনা করেছেন মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আধুনিক আরবি ভাষার চর্চাকে ব্যাপক করার জন্য কাজ করছেন। এ উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘মারকাজুল লুগাতিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’ নামে বিশেষায়িত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস উপলক্ষে, বাংলাদেশে আরবি ভাষার চর্চা ও আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে ফাতেহ টোয়েন্টি ফোর-এর পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন হামমাদ রাগিব।

  • আপনার দৃষ্টিতে আরবি ভাষা চর্চা করা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

আমার দৃষ্টির কথা বললে আমাদের আকাবির-আসলাফদের দৃষ্টিভঙ্গিটাই বলতে হয়। কুরআন-সুন্নাহর ভাষা আরবি; এ সম্বন্ধে জ্ঞান হাসিল করতে হলে অবশ্যই আরবি ভাষা ভালোভাবে আত্মস্থ করতে হবে। ইসলামি শরিয়াহ সম্পর্কে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে হলেও আরবির ওপর বুৎপত্তি অর্জনের বিকল্প নেই। এ জন্যই মূলত আরবি ভাষা চর্চা করাটা গুরুত্বপূর্ণ।

  • ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি এর কি কোনো সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে?

অবশ্যই আছে। বর্তমান যুগটা অনেকটা অনলাইন নির্ভর হওয়ার কারণে পৃথিবীর সবাই যেন আমরা একই ঘরের বাসিন্দা। ঘরের বড় একটি অংশ আরবি ভাষাভাষী। তাদের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের জন্যও আরবি জানা গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া আরব দেশের সঙ্গে যেহেতু আমাদের ধর্মীয়ভাবে মজবুত একটা বন্ধন আছে, অতএব তাদের রাজনীতি নিয়ে আমাদের জানতে হয়, ভাবতে হয়। এটা করতে গেলেও আরবি ভাষা সম্পর্কে জানাশোনার দরকার পড়ে। তাই আরবি ভাষা জানার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অনেক।

  • বাংলাদেশে আরবি ভাষা চর্চার সার্বিক মূল্যায়ন কীভাবে করবেন? কওমি মাদরাসার অবস্থা ঠিক কেমন?

সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করতে গেলে আসলে প্রথমে দেখতে হবে আরবি ভাষা চর্চার লক্ষ্যটা কী। বিশেষত আমাদের কওমি মাদরাসায় আরবি শেখা হয় কুরআন-হাদিস বোঝার জন্য। কুরআন-হাদিস বোঝা বা ফিকহি কিতাবাদির ইবারত পড়ে তরজমা করাটাকেই এখানে যথেষ্ট মনে করা হয়। সে উদ্দেশ্য অনুযায়ী বিচার করতে গেলে বাংলাদেশে আরবি ভাষার চর্চাটা সফলতার সঙ্গেই হচ্ছে।

কিন্তু এ উদ্দেশ্যের বাইরেও আরবি জানার জরুরত আছে। একজন আলেমের জন্য আধুনিক আরবির ওপর দক্ষতা অর্জন আবশ্যক। কিন্তু আমাদের দরসে নেজামিতে আরবি চর্চার যে ধারাটা চালু আছে, এ ধারায় ছাত্ররা কেবল দরসি কিতাবের আরবি বোঝার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, এর বাইরে আধুনিক আরবি বোঝা বা আরবিতে কথা বলায় তাঁরা খুব একটা দক্ষতা দেখাতে পারেন না। সম্প্রতি আলিয়া মাদরাসার শিক্ষাকারিকুলামে কিন্তু আধুনিক আরবির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের মাদরাসাগুলোতে সেটা এখনও চালু হয়নি।

  • এ সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায়?

এর জন্য শিক্ষাকারিকুলামের দিকে নজর দিতে হবে। যারা আরবি ভাষার শিক্ষক তাদেরকে আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া নাহু-সরফের যে কিতাবগুলো পড়ানো হয়, পড়ানোর সময় কুরআন-হাদিস থেকে উদাহরণ এনে এর বাস্তবিক প্রয়োগের যদি ব্যবস্থা করা হয় তবে আরবি ভাষাটা হৃদয়ঙ্গম করতে ছাত্রদের জন্য সুবিধা হবে।

কয়েক বছর আগে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে ছুটিতে এসে আমি এ ব্যাপারে আলোচনা করেছিলাম বেফাকের মরহুম মহাসচিব মাওলানা আবদুল জব্বার জাহানাবাদী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে। কথা হয়েছিল বেফাকের আরও কয়েকজন শীর্ষ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে। তাঁদের কাছে আবেদন রেখেছিলাম আরবি ভাষার ওপর আরবি বিষয়ের শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। শিক্ষকরা যাতে আরবি বিষয় পড়ানোর সময় আরবি মাধ্যমটাকে গ্রহণ করতে পারেন। আরবি ক্লাসে আরবিতেই যেন ভাববিনিময় করতে পারেন, এর ওপর তাঁদেরকে প্রশিক্ষিত করে তোলার উদ্যোগ যেন বেফাক নেয়। তাহলে যোগাযোগের যে আরবিটা, ‘আল-আরাবিয়াতুল ইত্তেসালিয়া’ যেটাকে বলা হয়, কওমি ছাত্রদের মধ্যে এটা সহজ হয়ে যাবে। বেফাক মহাসচিব তখন সে উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনাও দিয়েছিলেন কিন্তু পরে কেন যেন আর বাস্তবায়ন হলো না। তারপর তো হুজুরের ইন্তেকালই হয়ে গেল।

  • এখন সাধারণ শিক্ষা-মাধ্যমের অনেকে আরবি শিখতে চাইছেন। তাদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?

তাদের উদ্দেশে সর্বাগ্রে যে কথাটা বলতে চাই, যেহেতু এটা কুরআন-হাদিসের ভাষা, তাই ভাষা শেখার আগে সহিহ শুদ্ধভাবে আরবি পড়াটা শিখে নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি ভাষা শেখার জন্য ভাষা বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমদের শরণাপন্ন থাকা দরকার। কারণ নিজে নিজে শিখতে গেলে অনেক সময় বুঝের তারতম্যের কারণে বিভ্রান্তির শিকার হতে হয়।

এখানে উলামায়ে কেরাম, যারা ভাষা বিষয়ে অভিজ্ঞ, তাদের খেদমতে একটা কথা আরজ করতে চাই। আরবি শেখার জন্য এখন অনেক সাধারন শিক্ষিত মানুষ আগ্রহী, কিন্তু আমাদের মাদরাসাগুলোতে তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। উলামায়ে কেরামকে এই ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে হবে। আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের প্রতিষ্ঠান মারকাজুল লুগাতিল আরাবিয়া বাংলাদেশ এই উদ্যোগ নিয়েছে এবং আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি জেনারেল শিক্ষিত ভাইদের আরবি ভাষা শেখার তৃষ্ণা নিবারণের জন্য।

  • মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ ও মাওলানা শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী সাহেবের আরবী ভাষাচিন্তার মধ্যে মিল ও অমিলগুলো ঠিক কী ছিল?

উভয়ই বাংলাদেশের আরবি ভাষা চর্চার দুই দিকপাল। মৌলিক ক্ষেত্রে তাঁদের চিন্তাটা অভিন্ন। উভয়েই কুরআন-সুন্নাহর ভাষা আরবিটা ছাত্ররা যাতে ভালোভাবে আয়ত্ব করতে পারে, সেজন্যই কাজ করছেন। তবে আবু তাহের মেসবাহ সাহেব আরবি চর্চার ক্ষেত্রে কুরআন-হাদিস থেকে উদাহরণ টেনে বোঝানোর চেষ্টা করেন। এবং তাঁর কাজ মূলত প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য। আর ফজলুল বারী সাহেব আরবি চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেন আধুনিক আরবিকে। যাতে বৈশ্বিক একটা চেতনা শিক্ষার্থী অন্তরে রোপিত হয়ে যায়। এবং তাঁর কাজ ছিল মূলত দাওরা ফারেগ শিক্ষার্থীদের জন্য। তাই বলা যায়, উভয়ের কাজের প্লাটফর্ম ভিন্ন এবং প্লাটফর্ম অনুযায়ী তাঁদের প্রচেষ্টা অত্যন্ত সুন্দর এবং উপযোগী।

  • আপনি একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান করেছেন, এর সম্পর্কে কিছু বলবেন?

আমাদের প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য হচ্ছে ছাত্রদেরকে কুরআন-সুন্নাহর ভাষা আরবির ওপর বুৎপত্তি অর্জন করানো। বিশেষত শহিদুল্লাহ ফজলুল বারী সাহেব আধুনিক আরবির যে ধারা তৈরি করে গেছেন, সে অনুযায়ী কাজ করা। আমার আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, মদিনা বিশ্ববিদ্যালেয়র কারিকুলামে এ দেশের ছাত্রদেরকে আরবির ওপর দক্ষ করে তোলা। তাছাড়া সাধারণ শিক্ষিতদের যারা আরবি শিখতে আগ্রহী তাদের জন্য সুব্যবস্থাপনা করা এবং মসজিদের খতিবরা যাতে তাদের খুতবাগুলো বিশুদ্ধ ও চমৎকার আরবিতে ডেলিভারি দিতে পারেন, সেজন্য তাদের নিয়ে বিশেষ কোর্সের আয়োজন করাই আমাদের কাজ।

  • ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে কী ভাবছেন?

প্রতিষ্ঠান নিয়েই ভাবছি। আমাদের ইচ্ছা মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আরবি ভাষার ওপর এখান থেকে শিক্ষার্থীরা ডিপ্লোমা কোর্স করবে। গবেষণা অভিসন্দর্ভ তৈরি করবে। মোটকথা মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামেই আমরা এগোচ্ছি এবং আগামীতে এর আলোকে আরবি ভাষাচর্চার ওপর ভালো কিছু করতে চাই।

  • ফাতেহ টোয়েন্টি ফোরকে সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য মোবারকবাদ।

আপনাদেরও মোবারকবাদ আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। জাযাকুমুল্লাহ।

 

আগের সংবাদঘনীভূত হচ্ছে রাজনৈতিক সঙ্কট : যা ভাবছে সালাফি সমাজ
পরবর্তি সংবাদশতাধিক নেতাকর্মীকে সাধারণ ক্ষমা করেছে আওয়ামী লীগ