আমার বাবা মাওলানা আনসারী

সাইফুল্লাহ আল খালিদ:

১৭ এপ্রিল, ২০২০।

আসরের পর। আব্বুর পাশে বসে আছি। জোরেশোরে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করছেন আব্বু। কিছুটা অবাক হলাম আমরা! আব্বুর হাত-পা দাবিয়ে দিচ্ছি। ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবিনি, কিছুক্ষণ পর আব্বু আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন।

৫টা বেজে ৪৫ মিনিট তখন। আব্বু ধীরেধীরে শুয়ে পড়লেন। আর উঠেননি! অনন্তকাল আর অসীমের যাত্রায় নেমে গেলেন। আকাশটা ভারী হয়ে এলো! মাথার উপর ভেঙে পড়বে মনে হচ্ছে এখনি!

আব্বু ঘুমোচ্ছেন। অনন্তর এক প্রশান্তির ঘুম। আমি কোরআনের আয়াত জপছি—’হে প্রশান্ত আত্মা, ফিরে এসো তোমার রবের কাছে; সন্তুষ্ট এবং সন্তোষভাজন হয়ে। আর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ো,আমার জান্নাতে দাখেল হও।’

আহা!…কি মর্মর ধ্বণি!

আব্বু নিজস্ব অধ্যায় গুছিয়ে নিলেন। চলে গেলেন। সন্তানদের কাছে অমর রয়ে গেলেন। স্মৃতির পাতাগুলো ভিজে যায় আব্বুর রঙে। আব্বুর কবরের সামনে যখন দাঁড়াই–নিজের ক্রান্তিলগ্নে এসেও কতোটা ভালোবেসে আগলে রেখেছেন আমাদের, একটুকরো হাসি ফুটানোর জন্য কতো আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন জীবনভর – সেসব পিছু ধাওয়া করে। একটা কবর; আব্বুর কবর এক খণ্ড দীর্ঘশ্বাসে ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজে যায়। আব্বু জান্নাতে খুব ভালো থাকুক।

খুব সম্ভবত ২০০৩/৪ এর কথা বলছি। আম্মু প্রায়শই গল্পটা বলেন। আমাদের নতুন বাড়ির কাজ চলছে। আব্বু রোজ বিকেলে কাজ দেখতে আসেন। আসরের পর আব্বু তৈরি হচ্ছেন বেরুবেন বলে। রোজকারের মতো আমি আব্বুর পাশে দাঁড়িয়ে আছি।

‘আব্বু,যাইবা আমার সাথে?’ আব্বুর নির্লিপ্ত প্রশ্ন।

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম।

তখন আমি মোটামুটি বড় এবং দেহে-গতরেও বেশ স্বাস্থবান। কিন্তু আব্বু রোজ আমাকে কাঁধে করে নতুন বাড়ি অবদি নিয়ে যেতেন-আসতেন। আব্বুর কাঁধে কালো দাগ বসে গেলো, তাও কোনোদিন আমাকে বুঝতে দেননি তার কষ্ট হয়!

জীবনের শেষ বসন্তগুলোতে আব্বুর সেবা করার সুযোগ পেয়েছি অনেক। অজু করানো, হাত-পা দাবিয়ে দেয়া, খাবারের পর মুখ মুছে পরিষ্কার করা ইত্যাদি। তখন খুব করে আব্বুর সেই কালো দাগটা স্পর্শ করেছি। কি স্পষ্ট দাগটা, এখনো! স্মৃতির দাগ বোধহয় কালোই হয়। আব্বু চলে যাবার পর তাই স্মৃতিগুলো কালো দাগ বসিয়ে-ই যাচ্ছে।

আমাদের প্রত্যেকের প্রথম শিক্ষক, আমাদের বাবা। তিনি রাগী মানুষ ছিলেন। কিন্তু একজন রাগী মানুষ এতো কোমলভাবে ভালোবাসে কিভাবে, আমাদের জানা ছিলোনা। আব্বু আমাদের পড়াতেন—’আলিফ সবসময় খাড়া থাকে,এর মানে কি জানো? আল্লাহ এক!’ এই সবক আমি সর্বপ্রথম আব্বুর কাছ থেকে পেয়েছি। তাওহীদের ভিত্তি, আল্লাহর একচ্ছত্র আধিপত্য।

হেফজখানার দিনগুলোতে আব্বু যত্নে আগলে রেখেছিলেন আমাদের। আমার বড় ভাইয়ারা যখন সবক শোনাতেন, হুজুর চুপিসারে আব্বুকে ফোন দিয়ে রাখতেন। আব্বু দূর থেকে ফোনে সন্তানের তেলাওয়াত শুনে চোখের পানি মুছতে দেখেছি, বহুবার।

এক রমজানের কথা বলি। আব্বু ইফতারের আগে আমাকে তেলাওয়াত করতে বললেন। সবেমাত্র আমি হিফজ  শুরু করেছি। শুরু করলাম তেলাওয়াত। আমি খেয়াল করেছিলাম আব্বুর চোখ টলমল করছে। ‘সাদাকাল্লাহুল আযীম’। আমার তেলাওয়াত শেষ। আব্বু আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি চুপ করে আব্বুর বুকের গন্ধ নিচ্ছিলাম। কি ‘অব্যক্ত সুন্দর’ গন্ধ।

সেদিনও এই গন্ধ পাচ্ছিলাম। নিজেকে প্রবোধ দিয়ে চেপে রাখি। বাবা হারানোর পর সন্তানদের এই যুদ্ধটা করতে হয়।

আব্বু কোরআন-প্রেমী ছিলেন। সারাদিন তার ঠোঁটের কোণে জমে থাকতো কোরআনের সুর।

নরসিংদীর এক মাহফিল। আব্বু তখন আমেরিকার ক্যান্সার হসপিটালের বেডে। মাহফিলে আব্বু ছিলেন প্রধান অতিথি। ফোন দেওয়া হলো সুদূর আমেরিকায়। আব্বুর হাতে ফোন। অনুরোধ করা হলো কোরআন তেলাওয়াত করার জন্য। আহা কোরআন! সুদূর আমেরিকা থেকে ইথারে ভাসিয়ে দিলেন কোরআনের তেলাওয়াত। জনস্রোতে কান্নার শব্দ। আনন্দের কান্না। কোরআনের ভালোবাসার কান্না।

আব্বুর শেষদিকটার কথা বলি। অসুস্থটা আব্বুর মাথায়-ও ইফেক্ট করেছিলো। কী করতেন বা কী করা উচিৎ মাঝেমাঝে বুঝে উঠতে পারতেননা। রাত ১টা বাজে তখন। আমি আব্বুর সামনে বসা। আব্বু শোয়া থেকে উঠে টুপি আর রুমাল নিলেন। আমাকে ইশারা করলেন দরজার কাছে নিয়ে যাবার জন্য। আমি আর আম্মু ধরে ধরে দরজার কাছে নিয়ে যেতেই উনি বোঝাতে চাইলেন, আমাদের ড্রাইভার আঙ্কেলকে যেনো আমরা খবর দিই, উনি মাহফিলে যাবেন।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কথা বলতে পারেননা,চলতে-ফিরতে পারেননা অথচ কোরআনের জলসার প্রতি কী এক অদম্য টান আর ভালোবাসা!

আব্বু যখন সফরে থাকতেন নীরবে বসে কোরআন পড়তেন। এ কথা সবাই বিশ্বাস করে—কোরআনের সাথে এ প্রণয় আর ঘনিষ্ঠতা তাকে করে তুলেছিলো অনন্য।

জামিয়া রাহমানিয়া। আব্বুর নিজহাতে গড়া প্রতিষ্ঠান। মাদরাসার সামনে নিজের কবরের জায়গাটুকুর জন্যও ওসিয়ত করে গেছেন। সেই মাদরাসার সামনেই আব্বু শুয়ে আছেন; অনন্তকালের ঘুম। সন্তানের মতো তিলে তিলে বড় করেছেন মাদরাসাটিকে। আব্বুর ঘাম, কতো হাড়ভাঙা খাটুনি আর মেধার সঞ্চয় এই প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে দেয়ালে, ইটের কণায় কণায়।

‘মরতে হবেই। আপনারা সবাই আমার মাদরাসাটার প্রতি খেয়াল রাখবেন। আপনাদের প্রতি এটি আমার বিশেষ অনুরোধ রইলো।’ আব্বুর শেষ ওছিয়তনামা।

২৪শে মার্চ আব্বুকে দেখতে এসেছিলেন মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, মাওলানা হাসান জামিল। উনাদের সামনে বসেই আব্বু হৃদয়ের সবটুকু ব্যথা আর অব্যক্ত ভরসা রেখে কথাগুলো লিখে গেলেন।

আল্লাহ তায়ালা এই প্রতিষ্ঠানকে কবুল করুক। আমিন।

আগের সংবাদআমাদের মিডিয়া, কয়েকটি খুচরো আলাপ
পরবর্তি সংবাদফিলিস্তিনে ঈদ: আনন্দ-বেদনার কথকতা