প্রধান ধর্মসমূহে আকিদা : সাধারণ প্রতিতুলনা

ইফতেখার জামিল:

বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম, খৃস্টান, ইহুদী, হিন্দু ও বৌদ্ধ—এই পাঁচ ধর্মের অনুসারী। প্রতি এক লাখে প্রায় আশি হাজার মানুষ প্রধান পাঁচধর্মের কোনো একটিতে বিশ্বাসী। যারা নাস্তিক, ধর্মে করে অবিশ্বাস, তারাও পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের প্রেক্ষিতে বিপুলভাবে এই পাঁচ ধর্মে প্রভাবিত। প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যে ইসলামের বয়স সবচেয়ে কম। প্রচলিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী আগামী একশো বছরে ইসলাম সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ধর্মে পরিণত হবে।

যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক বাড়ছে। একই সমাজে বসবাস করছে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ। অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে সব ধর্মের কন্টেন্ট। ধর্মনিরপেক্ষতার আদলে জনপ্রিয় হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও বক্তব্য। হলিউড-বলিউড-নিউইয়র্ক টাইমস আপনাকে শেখাচ্ছে সত্য-মিথ্যা, ভালো-খারাপ, ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাইয়ে। বিনোদন-বিজ্ঞান-দর্শন মোটেই নিরপেক্ষ নয়, ধর্মীয় বাইনারি প্রশ্নে নিরপেক্ষতা অসম্ভব।

প্রিয়াংকা চোপড়ার শরীরে শুধু যৌনতা নয়, আছে হিন্দুত্ববাদের বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞান শেখাচ্ছে বিজ্ঞানবাদ, ম্যাক্স ভেবার আমাদেরকে জানান খৃস্টান ধর্ম পরছে ধর্মনিরপেক্ষতার পোশাক। আপনি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন, আপনি বিবেচনা করছেন না গৃহীত বিশ্বাস ও বক্তব্যের পূর্বানুমান : আকিদার উৎসমুখ । তাই প্রধান ধর্মসমূহের আকিদায় প্রতিতুলনা করা জরুরী হয়ে ওঠছে।

‘হাশরের মাঠে দুর্বল লোকেরা ক্ষমতাসীনদের সাথে কথা কাটাকাটি করবে, “তোমাদের কারণে আমরা ঈমান আনতে পারিনি।” ক্ষমতাসীনরা বলবে, আমরা কি তোমাদের ঈমান আনতে বাঁধা দিয়েছিলাম? তোমরাই তো ছিলে অপরাধী, তোমরা স্বেচ্ছায় অধর্ম গ্রহণ করেছিলে। দুর্বলরা বলবে, তোমাদের দিবারাত্রির ষড়যন্ত্রে আমরা প্রভাবিত হয়েছি। তোমরা বলেছ, আল্লাহর সাথে কুফুরি করতে, তার সাথে শরীক বানাতে। তারপর দুর্বলরা আজাব দেখে লজ্জা ঢাকতে চেষ্টা করবে।’ ( সূরা সাবা, ৩১-৩৩)

‘লাকুম দ্বীনুকুম ওলিয়াদ্বীন’ : বহুত্ববাদ ও স্বতন্ত্রতা

সম্প্রতি (ঐশী/ প্রাতিষ্ঠানিক) ধর্মহীনতা বাড়লেও এখনো পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ উল্লেখিত প্রধান পাঁচ ধর্মের অনুসরণ করে; এসবের ভিত্তিতেই পারস্পরিক সম্পর্ক-সংলাপে জড়ায়। এই আন্তঃধর্মীয় যোগাযোগকে কীভাবে বিচার করবো?

অনেকেই আগ্রহী বহুত্ববাদে (Religious Plurality)। তাদের মতে এককভাবে কোনো ধর্মে নাজাত ও মুক্তি সীমিত নয়, সবধর্মের মূলকথা একই। মানুষ আল্লাহকে পেতে পারে যে কোনো ধর্মমতেই। তাদের মতে, এভাবেই ধর্মীয় হিংসা, বিদ্বেষ ও বিবাদ কমিয়ে আনা সম্ভব। তাদের মূল যুক্তি ধর্মীয় বিষয়ে প্রকৃত সত্য খুঁজে পাওয়া অসম্ভব, ধর্মীয় আলোচনায় শুদ্ধতম মতে পৌঁছাও সম্ভব নয়। তাই সব ধর্মই সত্য, সবাই পাবে আখেরাতে নাজাত ও মুক্তি, দয়ালু আল্লাহ কীভাবে দিবেন যন্ত্রণাদায়ক আজাব? ধর্মীয় সমস্ত ব্যাখ্যা ও বর্ণনাই মহাপুরুষদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আমরা তাদের বাণী থেকে গ্রহণ করতে পারি শিক্ষা, তবে আমরা থাকবো না কারো কাছে বাধ্য। কেননা, তাদের মতে, ধর্ম জাতীয়তাবাদের সমতুল্য। বহুত্ববাদীরা বলেন, আমাদের প্রয়োজন ও প্রজ্ঞার মানদণ্ডে গ্রহণ করবো ধর্মীয় শিক্ষা, সব ধর্মই আমাদের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। এভাবে ধর্মীয় কলহ থেকে আমরা মুক্তি পাবো।

বাংলাদেশে সম্প্রতি বহুত্ববাদের আবেদনে লালন শাহ জনপ্রিয় হয়েছেন। এক গানে তিনি প্রশ্ন রাখেন:

‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।।

শোনায়ে লোভের বুলি
নেবে না কেউ কাঁধের ঝুলি
ইতর আতরাফ বলি
দূরে ঠেলে নাহি দেবে।।

আমির ফকির হয়ে এক ঠাঁই
সবার পাওনা পাবে সবাই
আশরাফ বলিয়া রেহাই
ভবে কেহ নাহি পাবে।।

ধর্ম কুল গোত্র জাতির
তুলবে না গো কেহ জিগির
কেঁদে বলে লালন ফকির
কেবা দেখায়ে দেবে।।

বহুত্ববাদ মানলে ধর্মীয় প্রতিতুলনার কোন সুযোগ থাকে না। সুযোগ থাকে না বুদ্ধি, বিবেচনা ও পর্যালোচনার। যেহেতু সব পন্থাই সত্য, সবাই পাবে নাজাত ও মুক্তি। ভালো-খারাপে কোনো পার্থক্য হবে না, সুযোগ থাকবে না মত-মতান্তরের। কেননা সব মতই যদি সমান হয়, সমান হয় তাদের ফলাফল, তবে প্রতিতুলনা করাই তো অর্থহীন।

তলিয়ে দেখলে বুঝা যাবে, যদি একইসাথে সব ধর্ম সত্য হয়, তবে বিপরীতমুখী অনেককিছুকে সত্য বলতে হবে। একত্ববাদ ও অগ্নিপূজায় কোনো পার্থক্য থাকবে না। পার্থক্য থাকবে না নবুওয়তে-আখেরাতে বিশ্বাস-অবিশ্বাসে। মোটকথা সবকিছুই আপেক্ষিক হয়ে যাবে, সত্য বলে কোনকিছু থাকবে না। প্রত্যেক ধর্মের নিজস্ব কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, সেসব বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকারের অর্থ সংশ্লিষ্ট ধর্মকেই অস্বীকার। যদি সবকিছুই সত্য হয়, তবে একইভাবে সবকিছুই অসত্য। এভাবে বহুত্ববাদে নষ্ট হয় ধর্মীয় মূল আবেদন : সত্যের অনুসন্ধান, নৈতিক জীবনে আবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার।

বহুত্ববাদ ধর্মীয় বিবাদকে প্রশমন করে না। বরং ক্ষমতাবানের ধর্মকে বাধ্যতামূলক করে তুলে। যদি সব ধর্ম সমান হয়, তবে আপনি কেন বিগব্রাদারের ধর্ম মানবেন না? ধর্ম না হয় না মানলেন, কীভাবে করবেন বিগব্রাদারের সংস্কৃতি অস্বীকার? ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ফ্রেঞ্চ সরকার খৃস্টান নারী সিস্টারদের মাথাবন্ধনী নিষিদ্ধ না করলেও নিষিদ্ধ করেছে হিজাব। এভাবে, বহুত্ববাদ ধর্মীয় বিবাদ কমিয়ে আনতে পারে না, ক্ষমতাবানের হাতে জবরদস্তির সুযোগ তৈরি করে দেয়। তাই ধর্মীয় স্বতন্ত্রতা ও বৈশিষ্ট্য মেনে নিলেই বিবাদ প্রশমন সম্ভব।

‘যে ইসলাম ছাড়া অন্যকিছুকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করবে, তার থেকে কোনকিছুই গৃহীত হবে না, আখেরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। ( সূরা আলে ইমরান, ৮৫)

এই লেখায় আমরা প্রধান পাঁচ ধর্মের আকিদাগত স্বতন্ত্রতা ও বৈশিষ্ট্য দেখানোর চেষ্টা করবো। এতে একইসাথে স্পষ্ট হবে ইসলামের নিজস্বতা।

মাক্কি জীবনে ইসলামি আকিদা

নবীজি চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়তপ্রাপ্ত হন, পরবর্তী তেইশ বছর ইসলাম প্রচার করেন। এর মধ্যে মাক্কি জীবন তেরো বছর, মদিনায় ছিলেন আরও বছর দশের মতো। কুরআনের একশো চৌদ্দ সূরার মধ্যে আশিটির বেশী মাক্কি সূরা, বাকিগুলো মাদানি; কয়েকটি সূরা মাক্কি নাকি মাদানি, সে নিয়ে দ্বিমত আছে। এই দুই আমলের কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। আকিদা প্রচার ও প্রশিক্ষণেও তার প্রভাব স্পষ্ট।

মাক্কি সূরাগুলোতে ব্যাপকভাবে আকিদার আলোচনা করা হয়। আইনি দিকগুলোতে গুরুত্ব দেওয়া হয় কম। কেননা আকিদা-ধার্মিকতা সবকিছুর মূলভিত্তি, মৌলিক বাইনারি প্রশ্নের সমাধান। বিশেষত তাওহিদ, রেসালাত ও আখিরাতের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। নানাভাবে পেশ করা হয় আল্লাহর অস্তিত্ব ও গুণাবলীর প্রমাণ, পাশাপাশি বলা হয় পার্থিব জীবন অর্থহীন নয়, আপনি যা ইচ্ছা করতে পারবেন না, আপনাকে রসূলদের কথা মানতে হবে, ভয় করতে হবে আখিরাতের পরীক্ষা।

তাওহিদের কথা : ‘তারা কি স্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি হয়েছে নাকি তারা নিজেরাই নিজেদের স্রষ্টা? স্রষ্টা ছাড়া তো কোনকিছুই সৃষ্টি হতে পারে না, মানুষ কীভাবে করবে নিজেকে নিজে সৃষ্টি? আসমান-জমিন তবে কে সৃষ্টি করল? আসল কথা হল তাদের মধ্যে কাজ করে অসীম সংশয়। তারা কীভাবে এমন নিশ্চিত বিষয়ে করে অবিশ্বাস? তাদের কাছে কি আছে পৃথিবী চালনার খোদায়ী উপাদান, তারা কি পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? ( সূরা নাজম, ৩৫-৩৭)

নবুওয়ত : ‘আল্লাহ কেন ফেরেশতাদের রসূল হিসেবে পাঠালেন না, এ কারণে তারা রসূলদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে না। তারা বলে এ কেমন রসূল, খাবার গ্রহণ করে, বাজারেও যায়। পৃথিবীতে মানুষরা থাকে, তাহলে রসূল তো মানুষই হবেন। আসল কথা হল, তাদের আখেরাতে অবিশ্বাস, তাই আপনাকে করে অস্বীকার। তাদের সামনে যদি আসমান থেকে দরজাও খুলে দেওয়া হয়, তারা সেখানে আরোহণ করতে থাকে সারাদিন, তবু তারা করবে অবিশ্বাস, বলবে আমাদের ইন্দ্রিয়ে বিভ্রাট ঘটেছে, আমরা হয়তো জাদুগ্রস্ত। ( সূরা বনি ইসরাইল, ৯৪-৯৫ ; সূরা ফুরকান, ৭,১১; সূরা হিজর, ১৪-১৫)

আখেরাত : ‘মানুষ কি মনে করে তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া হবে, তার কোন দায়-দায়িত্ব-অর্থ নেই? সে কি ছিল না নিছক বীর্য ? তারপর সে পরিণত হয় রক্তপিণ্ডে, তারপর আল্লাহ তাকে সুগঠিত করে সৃষ্টি করেন, সৃষ্টি করেন নারী-পুরুষ, এসব জেনেও মানুষ কীভাবে মনে করে আল্লাহ মৃতদের জীবিত করে হিসাব নিবেন না? ( সূরা কেয়ামাহ, ৩৬-৩৯)

আকিদার অংশ হিসেবে আলোচনা করা হয় পূর্ববর্তী নবীদের কথা, তারা কীভাবে দাওয়াত প্রচার করেছেন, শ্রোতাদের সাথে তাদের কথোপকথন। আদম-হাওয়া-শয়তানের আলোচনাও আনা হয়। মানুষকে শুনানো হয় ধর্মের ঐতিহাসিক গল্প ও ব্যাখ্যা। মানুষ গল্প শুনতে ভালোবাসে। তত্ত্বকথা অনেকের মাথাতেই ঢুকে না। এভাবে পূর্ববর্তী নবীদের দৃষ্টান্তে তুলা ধরা হয় আকিদার প্রমাণ। এতে নওমুসলিমরাও পায় ধৈর্যের উপকরণ।

‘আমি রসূলদের সব বৃত্তান্তই তুলে ধরেছি, যাতে আপনার মন প্রশান্ত-নিশ্চিন্ত হয়। এতে আছে মুমিনদের জন্য সত্যবাণী, দৃষ্টান্ত ও উপদেশ।’ ( সূরা হুদ, ১২০)

মাদানি জীবনে ইসলামি আকিদা

মদিনায় মুসলমানরা নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। তাদের হাতে চলে আসে রাষ্ট্রক্ষমতা। তাদের ভাবতে হয় নীতিমালা-আইন-পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে। অবতীর্ণ হয় পারিবারিক ও সামাজিক আইন : বিবাহ-বিচ্ছেদ-অর্থনীতি-ফৌজদারি শাস্তি। রাষ্ট্রীয় স্বার্থরক্ষার্থে অনুমোদিত হয় জিহাদ ও প্রতিরোধ যুদ্ধ। ইসলাম নিছক ইবাদত-ধার্মিকতায় সীমিত থাকে না। পরিচালনা-সিদ্ধান্ত-জনসম্মতির প্রশ্নও চলে আসে। গৃহীত হয় প্রশাসন-পরিচালনা ব্যবস্থা।

আইন-পররাষ্ট্র-প্রশাসন ব্যবস্থার সাথে আকিদার সম্পর্ক কোথায়? অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ও আইনি ব্যবস্থা নির্দিষ্ট-বাইনারি ধারা মেনে চলে না। প্রেক্ষাপট-প্রয়োজন ভেদে সিদ্ধান্ত-প্রয়োগ বিভিন্ন রকমের হয়, যেমন দুর্ভিক্ষের মধ্যে ওমর (রাদি.) চুরির শাস্তি স্থগিত করেছিলেন। তবে সেসব ক্ষেত্রেও আকিদার প্রভাব থাকে। গাছের সাথে তুলনা দিলে বুঝা যাবে আরও ভালোমতো। গাছের ডালপালা নানাদিকে ছড়িয়ে যায় প্রয়োজন মতো, তবে গাছের গুঁড়ি দাড়িয়ে থাকে স্থির, নির্দিষ্ট জায়গায়। গাছের গুঁড়িকে আমরা আকিদার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখি। ঠিক সেভাবেই মাদানি সূরাগুলোতেও আকিদায় গুরুত্ব দেওয়া হয়।

আপনি যদি রসূলে করেন অবিশ্বাস, আপনার মধ্যে যদি আখেরাতের ভয় না থাকে, তবে আপনি কেন ও কীভাবে মানবেন ইসলামি আইন ও নীতিমালা? কখনো আপনার প্রবৃত্তি-বুদ্ধির পছন্দ হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপনি ইসলামি সিদ্ধান্ত মানবেন না। আপনি যদি করেন আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাস, তবে আখেরাত-রেসালাত-শরীয়তের কথা তুলাই অর্থহীন।

‘তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবেসে থাকো, তবে আমি রসূলকে অনুসরণ করো, তবে আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন, ক্ষমা করবেন তোমাদের পাপ।’ ( সূরা আলে ইমরান, ৩১) আল্লাহর কসম, মানুষ যেসব বিষয়ে দ্বিমত-বিবাদ করে থাকে, সেসব বিষয়ে রসূলের সিদ্ধান্ত না মানলে, রসূলের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট না হলে তারা মুমিন হতে পারবে না। তাদেরকে রসূলের কথা আপত্তিহীনভাবে মেনে নিতে হবে। ( সূরা নিসা, ৬৫)

রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতিমালার পাশাপাশি মাদানি সূরাগুলোতে আহলে কিতাব ও মুনাফিকদের আলোচনা করা হয়। মুসলিম রাষ্ট্রে থাকবে অনেক অমুসলিমদের বসবাস, মুসলমানরাও জড়িয়ে যাবে নানারকম বিভ্রান্তিতে, কিছু লোক ইসলামের ছদ্মবেশে ষড়যন্ত্র করবে, এসব বিষয় সামনে রেখে আহলে কিতাব ও মুনাফিকদের আকিদা-বিশ্বাস- আলোচনা করা হয়। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক আন্তঃধর্মীয় আলোচনায় মাদানি যুগের দাওয়াতি প্রক্রিয়া থেকে বিশেষভাবে উপকৃত হওয়া যাবে।

‘তারা তো পৃথিবীতে ভ্রমণও করতে পারে, তারা দেখতে পাবে তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম। আল্লাহ কাফেরদের ধ্বংস করেছেন। আল্লাহর সাথে যারা কুফুরি করে, তাদের পরিণাম এমনই হবে।’ ( সূরা মুহাম্মাদ, ১০)

তুলনামূলক আকিদা : পর্যালোচনার মানদণ্ড

আগেই আমরা বলেছি, আন্তঃধর্মীয় যোগাযোগ-সংলাপ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে আন্তঃধর্মীয় পর্যালোচনা বৃদ্ধি করাও জরুরী হয়ে ওঠেছে। মুসলিম সংস্কৃতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে ঢুকে যাচ্ছে অনেক বিজাতীয় বিশ্বাস। আকিদা বা ধর্মীয় বাইনারি প্রশ্নে নিরপেক্ষতা বা বহুত্ববাদের সুযোগ নেই। আমাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে ধর্মীয় স্বতন্ত্রতা।

আমরা এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঁচ ধর্মের প্রধান সাতটি বাইনারি প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করবো। বাইনারি প্রশ্ন বলতে যেখানে একাধিক অপশন গ্রহণ বা দুটোকেই বর্জনের সুযোগ নেই, আপনাকে গ্রহণ করতে হবে নির্দিষ্ট অবস্থান। এই সাত প্রশ্নে স্পষ্ট হবে আপনার ধর্মীয় যুক্তি, বিশ্বাস, নীতি : এককথায় জানা যাবে আপনার আকিদা। জানা যাবে আপনার সকল কাজ-কর্ম-অবস্থানের মূলভিত্তি : আমরা গাছের গুঁড়ির দৃষ্টান্ত দিয়েছিলাম।

এখানে বলে রাখা ভালো, আমরা চাইলেও সকলকে ইসলামে বিশ্বাস করতে বাধ্য করতে পারব না। আমরা শুধু বলতে পারব আমাদের যুক্তি ও বিশ্বাস। তুলে ধরতে পারব আন্তঃধর্মীয় প্রতিতুলনা, আন্তঃধর্মীয় স্বতন্ত্রতা। অপর ধর্মকে ভুল প্রমাণ করে দিলেই তারা মেনে নিবে না, তাতে ইসলামেরও লাভ বিশেষ কিছু হবে না। এই পর্বের প্রধান উদ্দেশ্য তাই স্বতন্ত্রতা উপস্থাপন। সাতটি বাইনারি প্রশ্নে প্রধান পাঁচ ধর্মের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তুলে ধরাই আমাদের আলোচনার মৌলিক মানদণ্ড।

‘আমি রসূলদের সব বৃত্তান্তই তুলে ধরেছি, যাতে আপনার মন প্রশান্ত-নিশ্চিন্ত হয়। এতে আছে মুমিনদের জন্য সত্যবাণী, দৃষ্টান্ত ও উপদেশ।’ ( সূরা হুদ, ১২০)

সৃষ্টিতত্ত্ব : জগত আসলো কোথা থেকে?

সৃষ্টিতত্ত্বে জানা যায় জগত সৃষ্টি-বিকাশ-বিনাশের কথা। ধর্ম, বিজ্ঞান ও পুরাণ, তিনভাবেই সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। বিজ্ঞানে জোর দেওয়া হয় পরীক্ষাযোগ্য-বস্তু-বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্যাখ্যায়; পুরাণে পুঁথি-লোককথা-মিথে বিবৃত হয় অলৌকিক সৃষ্টি-কাহিনী; ধর্মে জোর দেওয়া হয় মহাসত্যে।

আরবের লোকেরা কুরআনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলত এটি নিছক লোককথা, যাতে গৌণ করে দেওয়া যায় ইসলামের সত্যতার দাবী। কুরআন খুব শক্তভাবে বলেছে, ইসলামি ব্যাখ্যা অলৌকিক, তবে লোককথা নয়। ধর্ম ও পুরাণের মধ্যে মূল পার্থক্য পুরাণে মহাসত্যের দাবী করা হয় না, বিশ্বাসের নৈতিক প্রতিক্রিয়ার দায়ও (Epistemic Responsibility) নেওয়া হয় না। এভাবে ধর্ম পুরাণ থেকে স্বতন্ত্র।

‘তাদেরকে কুরআনের আয়াত শুনানো হলে তারা বলে আমরা তো এগুলো আগেই শুনেছি। আমরা চাইলেই এগুলো বানাতে পারি। এগুলো তো পূর্বের কল্পকাহিনী। ( সূরা আল আনফাল, ৩১)

ইহুদী-খৃস্টান-ইসলাম, এই তিন ধর্ম আসমানি বা ইবরাহিমি ধর্ম হিসেবে পরিচিত। এই তিন ধর্মেই মানবসভ্যতার শুরু আদম-হাওয়ার কাহিনী দিয়ে। জান্নাতে আদম-হাওয়ার বসবাস, শয়তানের প্ররোচনায় ফল ভক্ষণ, পরিণামে পরীক্ষাপ্রার্থী হিসেবে পৃথিবীতে অবতরণ। ঘটনা এক হলেও ব্যাখ্যা একেকরকম।

খৃস্টান ব্যাখ্যায় অরিজিনাল সিনের বিষয়টি প্রযুক্ত হয় : মানুষ মাত্রই পাপপ্রবণ, জন্মসূত্রে মানুষ আদম-হাওয়ার পাপের উত্তরাধিকারী, পৃথিবীতে তাই এত বিপর্যয়। পাপের প্রতিক্রিয়ায়, যেহেতু হাওয়া ছিলেন মূল প্ররোচক, মহিলাকে বহন করতে হবে সন্তানধারণের ব্যথাযুক্ত অভিশাপ। যিশু খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ মৃত্যুতে পাপ থেকে মুক্তির আহ্বান, ব্যাপ্টিজমে আল্লাহর দয়ার সাথে পুনরায় সম্পর্ক। অন্যদিকে ইহুদী ধর্মে শয়তানের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, একে মন্দ প্রবণতার রূপক হিসেবে ধরা হয়।

হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয়টি ভারতীয় ধর্ম। হিন্দুধর্ম বলতে অনেক ক্ষেত্রেই নিছক নির্দিষ্ট একটি ধর্ম বুঝানো হয় না, বুঝানো হয় ভারতীয় ধর্মসমষ্টি। এ অর্থে হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয়টি হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত। হিন্দুধর্মে জগত চক্রাকারে পরিচালিত হয়, ইবরাহিমি ধর্মের মতো একরৈখিক নয়। জগত সূচনা, বিকাশ, বিনাশ থেকে আবার সূচনার মাধ্যমে চক্র শুরু। ব্রহ্মা করেন জগত সৃষ্টি, বিষ্ণু জগতের প্রতিপালক, শিব সবকিছু ধ্বংস করেন : এই তিনসত্ত্বা হিন্দুধর্মে ত্রিমূর্তি হিসেবে পরিচিত। ব্রহ্মা একাকীত্ব থেকে নিজেকে ভাগ করেন দুই ভাগে, নারী-পুরুষে। সেখান থেকেই মানবসভ্যতার শুরু। বৌদ্ধ ধর্মে খোদা-ঈশ্বরের সত্ত্বাগত অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়, অস্বীকার করা হয় অলৌকিকত্বেরও, তাই বৌদ্ধধর্মে অলৌকিক সৃষ্টিতত্ত্ব অপ্রয়োজনীয় বিষয়।

ইসলামের ব্যাখ্যা মতে আদম-হাওয়া তাওবা করেন, ক্ষমাপ্রাপ্ত হন, কেউ অরিজিনাল সিনে অভিযুক্ত নয়। মানুষের মধ্যে ভালো-খারাপ উভয় প্রবণতাই বিদ্যমান, নিছক পাপপ্রবণতা নয়। আল্লাহ বলেন, আমি মানুষের মনে প্রক্ষেপ করেছি ভালো-মন্দ স্বভাব। ( সূরা শামস, ৮ ) কুরআন স্পষ্ট করে বারবার বলেছে, কেউ কারো পাপের বোঝা বহন করবে না, আদম-হাওয়ার ভুল তাদের মধ্যেই সীমিত। ‘প্রত্যেকে নিজের গুনাহের দায় বহন করবে, একজন আরেকজনের দায় বহন করবে না। ( সূরা আনআম, ১৬৪) পাশাপাশি হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্বে বহুঈশ্বরবাদ ও সর্বেশ্বরবাদ ( ওহদাতুল ওজুদ) আবশ্যিক হয়ে উঠে, যেটি ইসলামের দৃষ্টিতে পরিত্যাজ্য। পাশাপাশি ইসলাম শয়তানের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করে। আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষকে পাঠিয়েছেন পরীক্ষার জন্য। ফেরেশতাদের নেই মন্দ কাজের ক্ষমতা, শয়তানের কাছে নেই ভালো কাজের প্রণোদনা। আদম সন্তানের আছে স্বাধীনতা, ভালো-মন্দ সে বাছাই করতে পারে, নেমে যেতে পারে শয়তানের পর্যায়ে, অথবা ফেরেশতার চেয়েও উপরে।

ওয়াজিবুল উজুদ : আল্লাহ তুমি কোথায়?

আগেই বলেছি, বৌদ্ধ ধর্মে অস্বীকার করা হয় ঈশ্বরের সত্ত্বাগত অস্তিত্ব, তাদের কাছে প্রাকৃতিক কারণেই চলছে জগত, মানবিক নৈতিকতায় মানুষ পেতে পারে মুক্তি, কল্যাণ ও সুন্দরের সন্ধান। হিন্দুধর্মে বহুঈশ্বরবাদ ও সর্বেশ্বরবাদ প্রচলিত অর্থাৎ তাদের মতে ঈশ্বর ও তার গুণাবলী অনেকের মধ্যে বিভক্ত, প্রকৃতি-মানুষও ঈশ্বরের প্রতিরুপ-অংশ।

খোদা বিষয়ে খৃস্টানদের মৌলিক বিশ্বাস ত্রিত্ববাদে। খোদা তিনজন সহচিরন্তন সমসত্ত্ব ব্যক্তি বা সারত্ব—পিতা, পুত্র (যীশুখ্রীস্ট) ও পবিত্র আত্মা—তিন দৈব ব্যক্তিতে বিদ্যমান এক ঈশ্বর। এই তিন ব্যক্তি ভিন্ন, তবে একই সারবত্তা, সত্তা বা প্রকৃতি। ইহুদীদের বিরুদ্ধেও কুরআন একই অভিযোগ করেছে, ‘ইহুদীরা উযাইরকে আল্লাহর সন্তান আখ্যা দিয়েছে।’ অবশ্য সমকালীন ইহুদীরা এই অভিযোগ অস্বীকার করে। ফখরুদ্দিন রাযি বলেন, ইহুদীদের একটা অংশের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিল, পরে এই বিশ্বাসের সমাপ্তি ঘটে। ইহুদীদের খোদা অনেকটা জাতীয়তাবাদী, তিনি শুধু জাতির খোদা, সে প্রেক্ষিতেই ইহুদী ধর্মে ধর্মান্তর অনেক কঠিন বা অসম্ভব।

সিফাত বা গুণাবলীর ক্ষেত্রেও পার্থক্য দৃশ্যমান। ত্রিত্ববাদের প্রেক্ষিতে খৃস্টানরা স্পষ্টভাবে দেহবিশিষ্ট খোদা বা দেহের মধ্যে খোদার প্রবেশের দাবী করে। ইহুদীদের মধ্যেও একই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান বলে দাবী করেন মুসলিম তাত্ত্বিক ফখরুদ্দিন রাযী ও শাহেরাস্তানি। আমরা কীভাবে করবো এমন খোদার উপাসনা যাকে আমরা চোখে দেখি না, এই যুক্তি থেকে ইহুদীরা বাছুর পূজা শুরু করে, তাওরাতে বর্ণিত আল্লাহর গুণাবলীকে মানবিক গুণাবলীর সাথে তুলনা করে।

অবশ্য গ্রীক দর্শনে আল্লাহর গুণাবলীকে অস্বীকারের প্রবণতা তৈরি হয়। কেননা দার্শনিক প্লেটোর মতে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের মূল যুক্তি : পৃথিবী সৃষ্টিতে একজন প্রাইম মুভার বা আনমুভড মুভার থাকা জরুরী অর্থাৎ তিনি সবকিছুর মৌল কারণ হবেন, অন্য কারণে প্রভাবিত হবেন না, প্রভাবিত হলে আরেকজনের মুখাপেক্ষী হয়ে যাবেন, স্রষ্টা হতে পারবেন না। প্লেটোর তত্ত্বের দোহাইয়ে খৃস্টান ধর্মতত্ত্বে আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকারের প্রবণতা ( তা’তিল) তৈরি হয়। কেননা সিফাতের প্রেক্ষিতে আল্লাহ প্রভাবিত/ মুভড হবার আশংকা তৈরি হয়। তারা মনে করতো, আল্লাহর রাগ করতে পারেন না, কেননা রাগ একটি মানসিক প্রতিক্রিয়া, আল্লাহ তো প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত, এভাবে তারা এমন সিফাতগুলোকে অস্বীকার করে । পরবর্তীতে গ্রীকো খৃস্টানদের ধারাবাহিকতায় মুসলমানদের মধ্যে মু’তাজিলারা এই মত গ্রহণ করে। ইহুদীদের ধর্মতত্ত্বের প্রধান ধারা মাইমুনি ধর্মতত্ত্বেও এই মত গ্রহণ করা হয়।

মোটকথা আল্লাহর সত্ত্বা ও গুণাবলীর প্রশ্নে চারটি বড় প্রবণতা দেখা যায়। ক. বহুঈশ্বরবাদ। খ. সর্বেশ্বরবাদ। গ. দেহবাদ। ঘ. নাকচবাদ। কুরআনে এই চার প্রবণতাকেই সংক্ষিপ্ত বা বিস্তারিতভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়। ‘আল্লাহর কোন সন্তান নেই, নেই কোন সহযোগী খোদা। কেননা সহযোগী থাকলে প্রত্যেকে প্রত্যেকের সৃষ্টি নিয়ে আলাদা হয়ে যেত, একে অপরের উপর প্রবল হত।’ ( সূরা মু’মিনুন, ৯১) যারা বলে আল্লাহ তিনজনের একজন, তারা কাফের। আল্লাহর কোন সহযোগী ইলাহ নেই। (সূরা মায়েদা, ৭৩) আল্লাহর মতো কোন সৃষ্টি নেই, আল্লাহ সমতুল্য কেউ নেই। ( সূরা আশ শুরা, ১১; সূরা ইখলাস, ৪) সর্বেশ্বরবাদে বহুঈশ্বরবাদ ও দেহবাদ উভয়টি আবশ্যক হয়। ‘আপনি তাঁকে আল্লাহ নামে ডাকেন বা রাহমান নামে। যে নামেই ডাকেন, আল্লাহর আছে অনেক সুন্দর নাম। ( সূরা বনি ইসরাইল, ১১০) তাছাড়া যেসব গুণাবলী প্লেটোনিক খৃস্টানরা অস্বীকার করে থাকে, এমন বেশকিছু গুণাবলী কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, যেমন রাগ ও দয়া।

বহুঈশ্বরবাদ ও সর্বেশ্বরবাদে আল্লাহকে একাধিক ও সৃষ্টির সাথে প্রযুক্ত মনে করা হয়। একাধিক ও প্রযুক্ত হলে তিনি স্রষ্টা থাকেন কীভাবে? অনাদি সত্ত্বার সাথে মরণশীল সত্ত্বা কীভাবে যুক্ত হবেন। যদি একাধিকজনের ইচ্ছা কার্যকর হয়, তবে বাঁধবে বিবাদ, ভেঙ্গে যাবে ঐশ্বরিক অনন্যতা। দেহবাদ সৃষ্টির সাথে স্রষ্টাকে প্রতিতুলনা, স্রষ্টা কীভাবে হবেন অধম সৃষ্টির মতো। আল্লাহর গুণাবলী অস্বীকারে খোদায়ী বৈশিষ্ট্য খর্ব হয়। গুণাবলী থাকে একেকজনের মধ্যে একেকভাবে। আল্লাহর দয়ার মানে মহানুভবতা, মানুষের দয়াতে সে মানসিকভাবে প্রভাবিত হয়। শব্দ এক হলেও আল্লাহ-বান্দার গুণাবলী তুলনীয় নয়।

নবুওয়ত : পৃথিবীতে আল্লাহর দূত

আসমানি তিন ধর্মেই নবুওয়তের বিষয়টি রয়েছে। তবে খৃস্টান ধর্মে অরিজিনাল সিনের প্রেক্ষিতে আল্লাহর সন্তান হিসেবে ঈসা/যীশুখ্রিস্টের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা হয়। এ হিসেবে খৃস্টানদের কাছে ঈসা খোদা বা খোদার কাছাকাছি। ইহুদী ধর্মে আদম ও লুত নবী নয়, ইহুদী ধর্মে অনেক নবীর দেখা মিলে অর্থাৎ মুসা তাদের দৃষ্টিতে শেষ নবী নন। ইহুদী ব্যাখ্যায় অনেক নবীকে গুনাহ করতেও দেখা যায়। বাইবেলের একটা বড় অংশে নবীদের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। অনেক নবীকে ইহুদীদের হাতে নিহত হবার সাক্ষ্য পাওয়া যায় ধর্মগ্রন্থগুলোতে।

হিন্দুধর্মে অবতারের প্রচলন দেখা যায়, অবতার মানে দেবতা বা ঈশ্বরের জীবরূপে জগতে আগমন। হিন্দুদের মতে অবতার হলেন মহামানব। গুণাবলীর বিচারে অবতারবাদ নবুওয়তের সাথে তুলনীয়। অবশ্য হিন্দুরা সাধারণভাবে নবুওয়তকে অস্বীকার করে। কেননা তাদের মতে ঐশী বাণী হয়তো বুদ্ধির সমানুপাতিক হবে, অথবা বিরোধী। বিরোধী হলে পরিত্যাজ্য, সমানুপাতিক হলে অপ্রয়োজনীয়। বৌদ্ধরা একই যুক্তিতে ঈশ্বর-আবতার-নবী, সবকিছুকে অস্বীকার করে।

কুরআন বলে, বুদ্ধির সীমা সীমিত, নির্দিষ্ট কিছু বিষয় ছাড়া তার পক্ষে ভালো-মন্দ প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কিছু ক্ষেত্রে নির্ধারণ করা সম্ভব হলেও তাতে থেকে যাবে দ্বিমত। প্রবৃত্তির প্রণোদনা। তাই আল্লাহর ঐশী বাণী ও প্রতিনিধির আগমন জরুরী। ( সূরা বাকারা, ২১৩; আলে ইমরান, ১৭৯) অবতারের ধারণায় বহুঈশ্বরবাদ ও সর্বেশ্বরবাদ আবশ্যকীয় হয়ে উঠে।

যীশুখ্রিস্ট খোদা নন, এটি আগেই বিবৃত হয়েছে। পাশাপাশি ইসলাম মনে করে, রসূলরা গুনাহ করতে পারেন না। বাইবেলে নবীদের বিষয়ে এমন অনেক বর্ণনা দেখা যায়, যেগুলো খুবই বিব্রতকর। যেহেতু সর্বাবস্থায় নবীদের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে, তাই যদি নবীরা গুনাহ করে, তবে সেগুলোই হয়ে উঠবে ধর্মীয় আদর্শ।

কিতাব : কেমনে জানিব তোমার কথা?

বৌদ্ধ ধর্মে যেহেতু ঈশ্বর-নবুওয়তের কথা অস্বীকার করা হয়, তাই ধর্মগ্রন্থ থাকারও প্রাসঙ্গিকতা নেই। বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ ত্রিপিটকে গৌতম বুদ্ধের বাণী-উপদেশ সংকলিত হয়েছে। হিন্দুধর্মে ধর্মগ্রন্থকে দুইভাগে ভাগ করা হয়। শ্রুতি ও স্মৃতি। স্মৃতি নির্দিষ্ট লেখকের ভাষায় লিখিত ধর্মীয় সাহিত্য, এতে বিশেষভাবে মহাকাব্যগুলো অন্তর্ভুক্ত। যেমন বহুল আলোচিত রামায়ন-মহাভারত হিন্দু ধর্মীয় সাহিত্য, এই পুঁথি-পুরাণ সাহিত্যগুলোই হিন্দু সংস্কৃতিতে ব্যাপকভাবে প্রভাবশালী। শ্রুতিশাস্ত্রগুলো সর্বোচ্চ প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থ। এগুলি সেই প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ যেগুলিকে ‘অপৌরুষেয়’ (স্বয়ং ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত) মনে করা হয়। এগুলিই হিন্দুধর্মের কেন্দ্রীয় ধর্মগ্রন্থ। হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো কীভাবে অবতীর্ণ হয়েছে, কীভাবে সংরক্ষিত হয়েছে, সেগুলো অনেক বড় প্রশ্ন। হিন্দু ধর্মীয় ধারা ও ধর্মগ্রন্থগুলোর আত্মবিরোধ প্রশ্নকে আরও জটিল করে।

বাইবেল বলতে পুরাতন অংশ ইহুদী-খৃস্টান উভয় সম্প্রদায় অনুসরণ করে থাকে। নতুন অংশ শুধু খৃস্টানরাই মানে। এখানে বলে রাখা ভালো, মুসলমানরা কোরআনকে পূর্ণ ঐশী বাণী মনে করলেও বাইবেল ঠিক সরাসরি ঈশ্বরের ভাষ্য নয়। কিছু প্রত্যক্ষ ঐশী বাণী, কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা, নবীদের কথা, শ্রুতিলিপি। মোটকথা মুসলিম সভ্যতার অর্থে বললে বাইবেলে ওয়াহি, সুনান, আছার, তাফসীর সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত। তাই প্রামাণ্যতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে, খোদ খৃস্টানদের মধ্যেই। বাইবেল মানুষের নিজস্ব সংকলন, স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ করে তোলার জন্য তৈরি হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বাইবেল। অনুবাদ ও অনুলিপি করা হয়। এভাবে অনুবাদ-অনুলিপি-স্থানিকতায় হাজারো রকমের বিভিন্নতা তৈরি হয়।

ইসলামে ধর্মগ্রন্থ অকাট্যভাবে বর্ণিত হবার শর্ত করা হয়। কুরআন, সুনান, আছার, তাফসীর সবকিছুকে আলাদা ভাগে ভাগ করা হয়। সনদ যাচাই করা হয়। পাশাপাশি একমাত্র আরবি সংস্করণকেই কুরআন মনে করা হয়, অনুবাদকে মনে করা হয় মূলের ব্যাখ্যা। বাইবেলের ক্ষেত্রে এমন সংরক্ষণ নীতি মানা হয়নি। নবী-সাহাবিদের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগকে আবশ্যিক মনে করা হয়। কেননা নবীর ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ না জানলে নিছক ধর্মগ্রন্থের নানারকমের ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এভাবে আমরা ইসলামি ধর্মগ্রন্থের স্বতন্ত্রতা দেখতে পাই। এর ভিত্তিতেই কুরআনে বারবার বলা হয়েছে, অন্য ধর্মগ্রন্থগুলো বিকৃত, যথাযথভাবে সংরক্ষিত নয়।

কর্ম : জগত কীভাবে চলে?

জগতে যা ঘটে, সেগুলো কেন ঘটে? আপনি গরীবের ঘরের সন্তান, পরীক্ষকের দোষে হতে পারেননি সফল। যেমন কর্ম তেমন ফল কথাটির অর্থ কি? যদি অর্থ নাই থাকে, আপনার সবকিছুই যদি হয় পূর্বনির্ধারিত, আপনার কোনকিছু করার কোন ক্ষমতা না থাকে, তবে আপনি কেন দায়ী হবেন? প্রধান ধর্মগুলো এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করেছে বিভিন্নভাবে।

হিন্দুধর্মে কর্ম তত্ত্বের কথা বলা হয়। সবকিছুই নির্দিষ্ট কারণে ঘটে, ‘সৎকর্মে স্বর্গবাস, অসৎকর্মে সর্বনাশ।’ কেউ কোনকিছু করলে তার ফলাফল ভোগ করতে হয়, ভালো কাজে ভালো ফলাফল, মন্দকাজে শাস্তি ভোগ করতে হবে। মাঝেমাঝে শিক্ষার সুযোগ হিসেবেও খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, হিন্দুরা বিপর্যয়কে বলে দেবতাদের খেলা, ভাগ্যের ফের, প্রকৃতির সমন্বয়। মোটকথা হিন্দুধর্মে কর্মতত্ত্ব ও ভাগ্যতত্ত্বে অনেক সময় সমন্বয়হীনতা দেখা যায়।

বৌদ্ধধর্মেও কর্মের গুরুত্ব অনেক। যেহেতু বৌদ্ধরা বিশ্বাস করে প্রাকৃতিক নিয়মে, আল্লাহ-খোদা-অলৌকিকতায় তাদের আস্থা নেই, তাই তাদের কাছে ভাগ্য বলে কিছু নেই, তাদের দৃষ্টিতে সবই কর্মের ফল। তবে সবসময় ভালোকাজের ভালো ফল আসে না; ভালো কাজ বীজের মতো, মাটি-রোদ-পানির পরিমিত মিশ্রণ না থাকলে অনেকক্ষেত্রে বীজ থেকে উদ্ভিদ সৃষ্টি হয় না, একইভাবে অনেকসময় উপযুক্ত পরিবেশ-শর্ত না থাকায় ভালো কাজের ভালো ফলাফল আসে না।

ইহুদী-খৃস্টান-ইসলাম, তিন আসমানি ধর্মেই ভাগ্য-তাকদিরের কথা বলা হয়। কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসহ। খৃস্টান ধর্মে বিপর্যয়-ব্যথার জন্য প্রধানত দায়ী করা হয় অরিজিনাল সিনকে। আদম-হাওয়ার ভুলের প্রেক্ষিতে সমস্ত মানবসমাজ ভুলের প্রতি উৎসাহী, ‘পথচ্যুত ফেরেশতা শয়তানের’ প্ররোচনাও মানুষকে পাপে আগ্রহী করে, তবে মানুষের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা আছে, হয়তো অনেকক্ষেত্রে খোদার পরিকল্পনা বুঝতে অক্ষম হয়, তাই অনেকক্ষেত্রে মানুষ বিপর্যয়ের ব্যাখ্যা বুঝতে পারে না।

ইসলামের দৃষ্টিতে কোনকিছুই অর্থহীন বা মর্মমুক্ত নয়। সবকিছুই আল্লাহর হুকুম ও হেকমতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। ( সূরা আম্বিয়া, ১৬) তবে সর্বক্ষেত্রে, বিশেষত বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট করে নৈতিক উক্তি করা ঠিক নয়। আমরা নিশ্চিত করে জানি না, বিপর্যয় কি ভালো-মন্দ কর্মের প্রতিক্রিয়া নাকি পরীক্ষা। আল্লাহ পৃথিবীতে নেয়ামত ও বিপর্যয় দান করেন। আংশিক প্রতিদান ও পরিণতি দান করেন, তবে চূড়ান্ত হিসাব, প্রাচুর্য ও শাস্তি আখেরাতেই প্রদত্ত হবে। ( সূরা আল কাহাফ, ৪৬) এর আগে দুনিয়াতে বাহ্যিক নেয়ামত ও বিপর্যয় উভয় রকম— ভালো ও মন্দ ব্যাখ্যার সুযোগ রাখে।

মুমিন বিশ্বাস করে, যেহেতু সে সুখ ও দুখ উভয়টাকে পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে, তাই তার কাছে নেয়ামত ও বিপর্যয় উভয়টিই আল্লাহর রহমত। পাশাপাশি কাফের যেহেতু সুখকে চূড়ান্ত সফলতা ও দুখকে চূড়ান্ত ব্যর্থতা হিসেবে দেখে তাই কাফেরের জন্য সুখ ও দুখ উভয়টিই আজাব। ( সূরা আল বাকারা, ১১৬) মুমিন প্রত্যেক ঘটনা থেকে শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করে। নিজের মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করে। সবকিছুকেই পরীক্ষা মনে করে ; কাজেই মনে করে সবকিছুই মুমিনের জন্য আল্লাহর রহমত। আবার কাফেরের জন্য সবকিছুকেই মন্দ মনে করে, তার সবকিছুকেই আজাব।

আখেরাতের ফলাফল : মৃত্যুর পরে কী হবে?

বৌদ্ধ ধর্মমতে জীবন অভিশাপের মতো, মানুষের বারবার জন্ম-মৃত্যু ঘটতেই থাকে। বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ লাভ করতে পারে নির্বাণ। নির্বাণ বলতে একজন মানুষের অন্তিম প্রশান্তি। যাকে আর পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে হয় না, যার কামনা-বাসনা একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে। নির্বাণ লাভের পর মানুষের কী অবস্থা হয়, তা নিয়ে চিন্তা করাকে অনর্থক বলে অভিহিত করা হয় বৌদ্ধ ধর্মে।

হিন্দুধর্মও জীবন-মৃত্যুচক্রে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে পুনর্জন্মেও। মৃত্যুর সাথেসাথে নরকেও যেতে হতে পারে, কারো মতে সাথেসাথেই হতে পারে পুনর্জন্ম, আত্মা স্থানান্তরিত হবে ভিন্নদেহে। খারাপ কাজের পরিণতিতে মানুষ পরিণত হতে পারে জন্তুতে। ভালো কাজের চরম উৎকর্ষে মানুষ লাভ করবে মুখ্য, মিলিত হবে পরমসত্ত্বার সাথে, যার থেকে সে সৃষ্টি হয়েছে। বলাই বাহুল্য, এটি হিন্দুদের সর্বেশ্বরবাদের অংশ।

আসমানি তিন ধর্ম বিশ্বাস করে আখেরাতে। তবে তাদের বিশ্বাসের প্রকৃতিতে পার্থক্য আছে। খৃস্টানরা মনে করে, যীশুখ্রিস্ট অরিজিনাল সিনের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন, বান্দার সাথে আল্লাহর দয়ার সম্পর্ক পুনরায় স্থাপিত হয়েছে। তাই খৃস্টান মতে যীশু খ্রিস্টে বিশ্বাস ও ভালো কাজে মিলবে জান্নাত। কখন হবে আখেরাতের হিসাব, সে নিয়ে খৃস্টানদের মধ্যে দ্বিমত আছে। অধিকাংশ খৃস্টানদের মতে যারা জাহান্নামে যাবে তাদের জান্নাতে ফেরার আর কোন সুযোগ নেই। ইহুদী ধর্মে পরকালের ধারণা অনেক অস্পষ্ট, তারাও স্বীকার করেন। তাদের কাছে ইহকাল অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ, আখেরাতের ভাবনা অনেকের কাছে গুরুত্বহীন। এসব প্রেক্ষিতে আখেরাতের বিষয়ে ইহুদীদের নিশ্চিত ও সর্বসম্মত বিশ্বাস নেই। শেষের দিকে আবার ঈসা আ. ফিরে আসবেন, তখন ‘ভালো মানুষদের’ জীবিত করা হবে। চিরস্থায়ী জাহান্নাম আছে কিনা, সে নিয়ে ইহুদীদের মধ্যে প্রশ্ন আছে। কারো মতে দৈহিক জান্নাত বলে কিছু নেই, সবই মনের ব্যাপার।

আখেরাতের বিষয়ে সবচেয়ে স্পষ্ট আকিদা আছে ইসলামে। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ আখেরাতে ঈমান-আমলের ফলাফল পাবে। শেষ জামানায় ইমাম মাহদি ও ঈসা আ. আসবেন, কিছুদিন পর কেয়ামত হবে। প্রকাশ পাবে ছোট-বড় আলামত। মানুষ পুন্রুত্থিত হবে। যারা আগেই মারা গেছেন, তারা যাবেন বারজাখে। ( সূরা আল মুমিনুন, ১০০) মুমিনরা পাবে জান্নাতের সুবাতাস, কাফের-গুনাহগাররা পাবে জাহান্নামের পূর্বাভাস। কেয়ামতে সবাই পুন্রুত্থিত হবে, প্রদত্ত হবে শাফায়াত এবং হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন হবে। বিচার শেষে ভালোরা যাবে জান্নাতে, খারাপরা জাহান্নামে। আধা-খারাপরা শাস্তি ভোগ করে ফিরবে আবার জান্নাতে।

তাবলিগ : আপনি কি আমার ধর্ম গ্রহণ করিবেন?

ইহুদী ধর্ম অনেকটা জাতীয়তাবাদী ধর্ম। তাই তারা ধর্মপ্রচার ও ধর্মান্তরকে খারাপ চোখে দেখে। ঐতিহাসিকভাবে ইহুদীরা তাই ধর্মপ্রচারে আগ্রহ দেখায় না; কেননা ইহুদী ধর্মে ধরমান্তরের অর্থ শুধু ধর্মগ্রহণই নয়, একইসাথে জাতীয়তার পরিচয় ও সংস্কৃতিগ্রহণ। এটি অবশ্যই কঠিন, পাশাপাশি তারা মনে করে, যারা ইহুদী হিসেবে নির্বাচিত নয়, তারা কীভাবে পাবে মুক্তির সন্ধান? সমকালীন ইহুদীদের অনেকে ধর্মপ্রচারে জোর দিতে চাইলে ইহুদী মূলধারা ও রক্ষণশীলরা এর শক্ত সমালোচনা করে। তারা মনে করে, ইহুদী ধর্মগ্রহণকে বানাতে হবে কঠিন, প্রায় অসম্ভব। হিন্দুধর্মও অনেকটা জাতীয়তাবাদী ধর্ম, পাশাপাশি বহুত্ববাদ, বহুঈশ্বরবাদ, সর্বেশ্বরবাদ ও নবুওয়তহীন ধর্মবিশ্বাস হবার প্রেক্ষিতে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তর অনেকটাই কঠিন। যারা জাতিতে ভারতীয় বা ভারতীয়দের চেয়ে চেতনা-চিন্তায় পিছিয়ে তাদের কাছে হিন্দুধর্ম আবেদন তৈরি করতে পারে। যে কোনো সুগঠিত চিন্তার সামনে হিন্দুধর্ম প্রভাবহীন হয়ে যেতে পারে। আমরা দেখি, বৌদ্ধধর্মে দয়া-যুক্তি-কর্ম-নৈতিকতা-নির্বাণ তত্ত্ব দিয়ে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও একপর্যায়ে হিন্দুরা বৌদ্ধ ধর্মকে হিন্দু ধর্মের অংশ হিসেবে আখ্যা দেয়, বৌদ্ধ ধর্মকে ঘোষণা করে হিন্দু অবতারে। লৌকিকতা-মানবধর্ম বৌদ্ধ চিন্তার মূল বৈশিষ্ট্য।

খৃস্টান ধর্মে ধর্মান্তরের বিশেষ গুরুত্ব বিদ্যমান। যেহেতু জান্নাতে যেতে যীশুখ্রিস্টে বিশ্বাস বাধ্যতামূলক, নইলে অরিজিনাল সিন থেকে মুক্তি নেই, তাই প্রয়োজনে ধোঁকা বা জোর করে ধর্মান্তর করাও খৃস্টানদের দৃষ্টিতে বৈধ। কেননা ধর্মান্তর ও যীশুতে বিশ্বাসটাই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এর সাথে উপনিবেশ ও বিজ্ঞান প্রযুক্ত হয়েছে, সেবাকাজ ও অর্থনৈতিক সামর্থ্যে ধোঁকা-জোর করার প্রবণতা খৃস্টান ধর্মে অনেক বেশী।

ধর্মপ্রচারের প্রশ্নে ইসলামের অবস্থান খৃস্টান ধর্মের মাঝামাঝি। ইসলাম জাতীয়তাবাদী ধর্ম নয়, সবাই গ্রহণ করতে পারে ইসলাম, ইসলাম গ্রহণের প্রক্রিয়াও সহজ। ধর্মীয় সত্য ও নৈতিক দায়েও ইসলামের রয়েছে সুনির্দিষ্ট অবস্থান। অবশ্য ইসলামে জোরপূর্বক বা ধোঁকা দিয়ে ধর্মান্তর বৈধ নয়। কেননা ব্যক্তির বিচার হবে তার বিশ্বাসের ভিত্তিতে। প্রত্যেকেই স্বাধীন, জোরপূর্বক ধর্মান্তরে স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হয়, ব্যক্তি পরিণত হয় না মুসলিমে। জোর করার প্রেক্ষিতে ধর্মপ্রচারকারী বরং গুনাহগার হিসেবে বিবেচিত হয়।

সারকথা

এই লেখায় আমরা পৃথিবীর প্রধান পাঁচ ধর্মের মৌলিক প্রতিতুলনা পেশ করেছি। আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক অনেক বেড়ে গেছে, তাই প্রতিতুলনার বিকল্প নেই। খুঁজতে হবে স্বতন্ত্রতা, ধর্মীয় বহুত্ববাদের কোন সুযোগ নেই। ইসলামের আকিদার বিকাশ ঘটেছে মাক্কি ও মাদানি জীবনে, প্রত্যেক আমলেই ছিল বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য।

পৃথিবীতে সৃষ্টি নিয়ে আছে অনেক ব্যাখ্যা বৈজ্ঞানিক, পৌরাণিক ও ধর্মীয়। বৌদ্ধ ধর্মের আস্থা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায়, হিন্দুরা পৌরাণিক, আসমানি পাঁচ ধর্মে কিছু স্বতন্ত্রতাসহ ধর্মীয় ব্যাখ্যায়। আল্লাহর অস্তিত্ব ও গুণাবলী প্রসঙ্গে চার প্রবণতা দেখা যায়, বহুঈশ্বরবাদ, সর্বেশ্বরবাদ, দেহবাদ ও নাকচবাদ ; ইসলাম এগুলো বাতিল করে নিখাদ তাওহিদের আহ্বান জানায়। হিন্দু-বৌদ্ধরা নবুওয়তকে অস্বীকার করে, আসমানি তিন ধর্মের মধ্যে ইহুদী নবীরা গুনাহ করতে পারে, খৃস্টান প্রধান ব্যক্তি যীশু খোদার সমতুল্য, ইসলাম মনে করে নবীরা নিষ্পাপ মহাপুরুষ, তবে খোদার সমতুল নয়।

পৃথিবীতে কেন কোনকিছু ঘটে, মানুষ কীভাবে পায় প্রতিফল, সেখানে আছে নানা ব্যাখ্যা। বৌদ্ধরা ভাগ্যকে করে অস্বীকার, হিন্দুরাও কর্মতত্ত্বে জোর দেয়, ভাগ্যকে মনে করে গুরুত্বহীন। তিন আসমানি ধর্মে গুরুত্ব দেওয়া হয় ভাগ্য-তাকদিরে, পাশাপাশি বান্দাও অধিকারী থাকে স্বাধীনতার। বৌদ্ধ-হিন্দুরা বিশ্বাস করে চক্রে, যথাক্রমে শেষ ফলাফল নির্বাণ ও মোক্ষলাভ। তিন আসমানি ধর্মে আখেরাতে বিশ্বাস থাকলেও আছে কিছু বিশেষ পার্থক্য। ইহুদী ও হিন্দু ধর্ম জাতীয়তাবাদী, বৌদ্ধ ধর্মে প্রচার চালানো হয় যৌক্তিকতা-নৈতিকতার। খৃস্টান ধর্ম জোরপূর্বক ধর্মান্তরে অনুমতি দিলেও ইসলামে সেটি নিষিদ্ধ।

বি:দ্র: আমরা এই আলোচনায় হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্পর্কে তথ্য গ্রহণ করেছি ক্ষিতিমোহন সেনের হিন্দু ধর্ম ও পিনাকী ভট্টাচার্যের ভারতীয় দর্শন বই থেকে। ইহুদী ও খৃস্টান ধর্ম বিষয়ে BBC Bitesize ওয়েবসাইট থেকে।

তথ্যসূত্র:

World Religions

https://ed.ted.com/lessons/the-five-major-world-religions-john-bellaimey

https://examples.yourdictionary.com/5-main-world-religions-and-their-basic-beliefs.html

https://www.bolton.ac.uk/Chaplaincy/Worldviews/Summary.aspx#gsc.tab=0

https://en.wikipedia.org/wiki/Major_religious_groups

আগের সংবাদআমার বাড়ি বৌডুবি
পরবর্তি সংবাদমুসলিম জ্ঞানশাখাসমূহে ড. মুহাম্মদ হামিদুল্লাহর অবদান : একটি সাধারণ অনুসন্ধান