কী হবে মালয়েশিয়ার আগামী নির্বাচনে?

মুনশী নাঈম:

আগামী ১৯ নভেম্বর মালয়েশিয়ায় অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে আবারও অংশ নিচ্ছেন দেশটির প্রায় শতবর্ষীয় প্রবীণ রাজনীতিবিদ মাহাথির মোহাম্মদ। শনিবার, ৫ নভেম্বর নিজের প্রার্থীতা দাখিল করেছেন তিনি। লংকাউইয়ের হলিডে দ্বীপে নিজের সংসদীয় আসন রক্ষায় তিনি লড়বেন।

এর আগে, দু’বার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিনি। প্রথমবার ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত টানা ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। দ্বিতীয়বার ২০১৮ সালে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে সরাতে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ। এক সময়ের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ার ইব্রাহিমের সহায়তায় নির্বাচনে জিতে আবারও দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন মাহাথির। তবে, নানান রাজনৈতিক ইস্যুতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতেই পদত্যাগ করেন তিনি। দেশটির ক্ষমতাসীন জোটের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা সেই রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে গেল অক্টোবরের ১০ তারিখ দেশটির জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব। ফলে আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় ১০ মাস আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশটিতে।

মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক দল

মালয়েশিয়ায় ৬৯টি রাজনৈতিক দল রয়েছে। এ দলগুলো আবার ৫ টি প্রধান ব্লকে বিভক্ত।

১. ন্যাশনাল ফ্রন্ট অ্যালায়েন্স: এটি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকা জোট। এতে তিনটি প্রধান দল রয়েছে—ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন, মালয়েশিয়ান চাইনিজ অ্যাসোসিয়েশন এবং মালয়েশিয়ান ভারতীয় কংগ্রেস। ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বেশিরভাগ সময় ধরে মালয়েশিয়া শাসন করেছে ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের (ইউএমএনও) নেতৃত্বাধীন বারিসান ন্যাশনাল (বিএন) বা ন্যাশনাল ফ্রন্ট। কিন্তু সম্প্রতি জোট সরকারের নজিরবিহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে জনমনে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয় তাতে শেষ পর্যন্ত তাদের পতন ঘটে।

২. পাকাতান হারাপান (পিএইচ) বা অ্যালায়ান্স অব হোপ: এটি আনোয়ার ইব্রাহিম ১৯৯৮ সালে ক্ষমতা থেকে প্রস্থান করার পর তার নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের একটি সম্প্রসারণ। এতে ৩টি প্রধান দল রয়েছে: পিপলস জাস্টিস পার্টি, ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন (জাতিগত চীনাদের দ্বারা অধ্যুষিত), এবং ন্যাশনাল ট্রাস্ট পার্টি।

৩. ন্যাশনাল কন্ট্রাক্ট অ্যালায়েন্স: প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের নেতৃত্বে এই জোট। এতে রয়েছে মালয় ইউনিটি পার্টি (পার্সাতু), মালয়েশিয়ান ইসলামিক পার্টি এবং ছোট ছোট বিভিন্ন দল।

৪. দ্য ন্যাশনাল ওয়ারিয়র অ্যালায়েন্স: এটি মাহাথির মোহাম্মদের নিজের হাতে গড়া রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অরগানাইজেশনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে গঠিত জোট।এতে বেশ কয়েকটি ছোট দল এবং বেসরকারী সংস্থা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

৫. সাবাহ ও সারওয়াক নিয়ে গঠিত বর্ণিও মালয়েশিয়া: দেশের পূর্বাঞ্চলের ‘সারওয়াক’ এবং ‘সাবাহ’ রাজ্যের দলগুলি রয়েছে এ জোটে। এ জোট গত বছর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সংসদে দুটি রাজ্যের মোট আসন ৫৬ টি, যা ২৫% এর সমান। মোট আসন ২২২টি।

উল্লেখযোগ্য প্রার্থী

মালয়েশিয়ার এবারের নির্বাচন বেশ জটিল এক সমীকরণের দিকে এগোচ্ছে। কারা প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে চলছে আলোচনা-সম্ভাবনা। দেখা যাচ্ছে জনমত জরিপ।

ন্যাশনাল ফ্রন্ট জোটের নেতা জাহিদ হামিদি এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব সহ জোটের নেতৃত্বদানকারী “আমনো” দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা সীমিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হননি। এমনিতেই জাহিদ হামিদির উচ্চাকাঙ্ক্ষা, দুর্নীতির মামলা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রচেষ্টা এবং প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় নেতার মধ্যে বিরোধপূর্ণ ক্ষমতা নিয়ে তার অসন্তোষের বারবার প্রকাশকে ঘিরে বিভিন্ন সন্দেহ উত্থাপিত হয়েছে। পক্ষান্তরে কোনো দুর্নীতির ফাইলে নাম না থাকায় গত কয়েক মাসে ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাসানের চাহিদা ও সম্ভাবনা বেড়েছে। মালয়েশিয়ার ইতিহাসে এটিই প্রথম যে, ক্ষমতাসীন দলের নেতা সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন না।

অন্যদিকে আরও একবার জয় নিশ্চিত করতে চাইছে রাজনৈতিক সংস্কারবাদীদের নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বাধীন জোট পাকাতান হারাপান (পিএইচ) বা অ্যালায়ান্স অব হোপ। হোপ অ্যালায়েন্স পরবর্তী সরকারের প্রধানের জন্য আনোয়ার ইব্রাহিমকে মনোনীত করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইব্রাহিম আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তার বিজয় সহজ হবে না। মালয়েশিয়ার সমাজের বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব করে এমন একটি বৃত্তে জয়লাভের অর্থ হল বিভিন্ন মালয়েশিয়ার জাতিগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে তাকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছে। এজন্য তাকে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হবে।

ন্যাশনাল কন্ট্রাক্ট অ্যালায়েন্সের নেতা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন ক্ষমতায় ফিরে আসার আশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন। দ্য ন্যাশনাল ওয়ারিয়র অ্যালায়েন্সের নেতা হিসেবে লড়বেন মাহাথির মুহাম্মদ।

অন্যদিকে মালয়েশিয়ার দু’টি অংশের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের মতো আসন হলো উপদ্বীপ মালয়েশিয়ায়। বাকিটা সাবাহ ও সারওয়াক নিয়ে গঠিত বর্ণিও মালয়েশিয়ায়। দেশটির দুই অংশের রাজনীতির ধারার মধ্যে পার্থক্যও রয়েছে। বর্নিও মালয়েশিয়ায় দেশটির মূল অংশের বড় দলগুলোর প্রভাব একবারে কম। কয়েক দশক ধরে সারওয়াকে সরকার গঠন করে আসছে স্থানীয় দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত একটি জোট। সাবাহতে একসময় আমনুর শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও সেখানে এখন শক্ত অবস্থানে চলে এসেছে স্থানীয় দলগুলো। বর্নিও মালয়েশিয়ায় যে এক-তৃতীয়াংশের মতো আসন রয়েছে তাতে যারা প্রাধান্য বিস্তার করবে তারা ফেডারেল সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

জরিপে পিছিয়ে মাহাথির

মালয়েশিয়ায় জনমত জরিপের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান মনে করা হয় মারদেকা ফাউন্ডেশনকে। মারদেকা সংসদ ভেঙে দেয়ার পর ১৯ থেকে ২৮ অক্টোবরের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। এ ধরনের ব্যাপকভিত্তিক সমীক্ষা এ পর্যন্ত আর কোনো প্রতিষ্ঠান এবারের নির্বাচন নিয়ে করেনি।

এ সমীক্ষা অনুসারে ১৫তম সাধারণ নির্বাচনে ভোটারদের পছন্দের দিক থেকে আমনুর নেতৃত্বাধীন বারিসান ন্যাশনালকে (বিএন) তার প্রতিদ্বন্দ্বী পাকাতান হারাপান (পিএইচ) পেছনে ফেলেছে। মারদেকা সেন্টারের পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা পিএইচকে এবং ২৪ শতাংশ বিএনকে পছন্দ করেছেন। তারপরে রয়েছে বারাসাতু ও পাসের সমন্বয়ে গঠিত পেরিকাটান ন্যাশনালের (পিএন) স্থান, যার প্রতি সমর্থন রয়েছে ১৩ শতাংশের। তবে এখানে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো যারা তাদের পছন্দের কথা জানাননি তাদের সংখ্যা ৩১ শতাংশ। আর ৪ শতাংশ কোনো ধরনের উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। চূড়ান্তভাবে এ ৩৫ শতাংশের মতো ভোটার পুরো ভোটকে প্রভাবিত করবেন বলে মনে হয়। এর বাইরে দুই শতাংশ বলেছেন, তারা ডা: মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন গেরাকান তানাহ এয়ার (জিটিএ) বা অন্য কোন দলকে ভোট দেবেন।

আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফলের বিষয়ে মন্তব্য করে মারদেকা সেন্টার বলেছে, তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জোটের উপস্থিতি রয়েছে এবার। আর সেই সাথে সম্ভাব্য ভোটের হারের বিষয়ে অনিশ্চয়তার কারণে চূড়ান্ত ফলাফল কী হবে এ মুহূর্তে অনুমান করা কঠিন। এ মুহূর্তে, বিএন-এর জন্য মালয় ভোটারদের সমর্থন প্রত্যাশিত স্তরের চেয়ে কম হওয়ায় এটা ধারণা করা যায় যে, কোনো জোটই এককভাবে মালয়েশিয়ায় ক্ষমতায় আসতে পারবে না। অন্য এক বা একাধিক দল বা জোটের সাথে সরকার গঠনে কোয়ালিশন করতে হবে।

মালয়েশিয়ার শাসনব্যবস্থা

মালয়েশিয়ায় সংসদীয় শাসনব্যবস্থা কয়েম। সেখানে চলে ব্রিটিশ ব্যবস্থার মতো একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। সংসদীয় অধিবেশনের সময়কাল ৫ বছর। সংসদ দুটি কক্ষে বিভক্ত: প্রতিনিধি পরিষদ, যার সদস্য সংখ্যা ২২২ জন। সেনেট, যার সদস্য সংখ্যা ৭০ জন। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন রাজা।

গত জুলাইয়ে, সংসদ একটি সাংবিধানিক সংশোধনী অনুমোদন করেছে। তাতে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যদের নির্বাচনের পরে সদস্যারা তাদের দল পরিবর্তন করতে পারবে না। কারণ এভাব দল পরিবর্তনের কারণে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে গঠিত তিনটি সরকারের মধ্যে দুটির পতন ঘটে।

ইসির তথ্য অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে ২২২টি সংসদীয় আসনে মোট ৯৪৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ৯ অক্টোবর পর্যন্ত হালনাগাদ করা ভোটার তালিকা অনুযায়ী, যা জিই ১৫-এ ব্যবহার করা হবে। ২১,১৭৩,৬৩৮ জন ভোটার রয়েছে, যার মধ্যে ২০,৯০৫,৩৬৬ সাধারণ ভোটার, ১৪৬,৭৩৭ সামরিক কর্মী এবং তাদের স্ত্রী, ১১৮,৭৯৪ জন পুলিশ কর্মী, সাধারণ অপারেশন এবং তাদের ৪ জন সাধারণ ভোটার রয়েছে।

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা

আগের সংবাদপ্রশ্নফাঁসের চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা : শিক্ষামন্ত্রী
পরবর্তি সংবাদখাদ্যে ঝুঁকি বাড়ছে : হালাল স্টান্ডার্ড বাস্তবায়নে জোর দিচ্ছেন আলেমরা