মাহমুদ আব্দুল্লাহ:
১.
সন্ধ্যার ছড়িয়ে পড়া লাল আলো দিগন্তে সবটুকু রং মেলে দিয়ে রাঙ্গা টুকটুকে বউটি সেজে বসে আছে৷ বিকেলের আগে যখন আকাশ গুমোট মেঘের আঁচলে ঢাকা ছিল তখনও ভাবা যায়নি সন্ধ্যাটি এত মনোরম হবে। সারাদিনের জমে ওঠা হাপিত্যেশ আর অসীমের পানে থেকে থেকে ছেড়ে দেওয়া দীর্ঘশ্বাস একসময় ভারি হয়ে বৃষ্টির ফোঁটায় রূপ নিলো। জমে থাকা মেঘের স্তুপ যেন গলে গিয়ে নেমে এল নির্মল ঠান্ডা বারিধারা। দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেত, বাগান আর ফিতের মত ছড়িয়ে থাকা রাস্তায় নেমে এল অবিরত বৃষ্টির ফোঁটা। নেমে এল পুকুরের জলে, টিনের চালে আর ঝুলে থাকা কলাপাতার ওপর।
আকুলিবিকুলি দোল খাওয়া টিয়ে রঙের পাতার ওপর থেকে, কালচে সবুজ খাজকাটা গাছের শরীর বেয়ে নেমে এল প্রার্থনার মত পবিত্র সেই পানির ধারা। ভাদ্রের তৃষিত জমিনের কোলে, চলে যাওয়া পথের ওপর শুকনো ধুলোয়, চষা ক্ষেতের প্রতিটি শিরায় পৌঁছে গেল সেই শান্ত শীতল জলধারা। হেমন্তের লিলুয়া বাতাসে মিশে গেল মাঠ থেকে উঠে আসা মধুর সুরভী, বয়ে যাওয়া হাওয়ায় লাগল অপূর্ব সুবাস। গ্রামের মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে গঞ্জে আসা দূরগ্রামের রিকশাওয়ালার গলায় লাগল সুরের পালক। সবদিকে সুখ সুখ রং ছড়িয়ে দিয়ে সন্ধ্যা নামার আয়োজন পুরো করল নাগরিক সভ্যতা থেকে বহুদূরের এই জনপদ।
ভরদুপুরের গুমোট ভ্যাপসা আবহাওয়া বিকেল নাগাদ হালকা হয়ে যাওয়াতে যে সুখের আবেশ ঘিরে নিয়েছিল এই জনপদকে, তার সাথে সমসুরে সংগত বাঁধতে এগিয়ে এল সন্ধ্যার আবীররাঙা আকাশ। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের গায়ে ছায়া ফেলল পাটে বসা সূর্যের আলো, পূবাকাশে তৈরী হল উষার বিভ্রম আর গাছপালা ঘরবাড়ি ছেয়ে গেল গোলাপি রঙের এক মায়াবী আলোয়৷ হাটের সীমানার বাইরে মজা পুকুরপারের বিশালাকার বটগাছটিও সেই কুহকজাগানিয়া সাঁঝে দাঁড়িয়ে রইল একাকী চুপচাপ।
সারা দিনমান নিরব এই রাস্তার ধারে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা বটের পাতা আর ঝুরিগুলো যেন এই জনপদের সকল ঘটনার সাক্ষী৷ কিষান বউটি বাড়ি থেকে বেঁধে আনা খাবারের পুঁটুলি হাতে করে লজ্জামাখা ঘোমটার আড়ালে অপেক্ষা করে, কখন ঘেমে নেয়ে ক্লান্ত স্বামীটি ক্ষেতের ধুলোমাখা শরীর নিয়ে আসবে এখানে, আর সে মুক্তোর মত ঝরে পড়া ঘাম মুছে হেসে বলবে, ‘ইস কী করছে শরীরটারে!’ তখন গাছটি যেন ঈষৎ ব্রীড়ামাখা লজ্জায় টুপ করে দুটি পাতা ফেলবে তাদের মাঝে৷ কেমন চুপটি করে জানিয়ে দেওয়া আড়াল হতে, আমি আছি তোমাদের মাঝে। কিংবা খুব রোদ ওঠা দুপুরবেলায় যখন মোট বয়ে হাটে যাওয়া হাটুরে ক্লান্ত অবসন্ন শরীর নিয়ে বসে পড়বে এই গাছতলায়, আর কোঁচা হতে সস্তা বিড়ির ঠোঙ্গা বের করে সুখটান দিতে দিতে হিসেব করবে লাভ-লোকসানের। এরপর যাওয়ার আগে জ্বলন্ত বিড়িটি খড়খড়ে গাছের গায়ে চেপে ধরবে নিভিয়ে ফেলবার আশায়, তখন আর সব ঘটনার মত হালকা একটি বাতাস বইবে৷ তাতে এলোমেলো হয়ে নড়ে উঠবে পুরো বটবৃক্ষের ডাল-পালা। এ যেন বাকহীন সাক্ষীর নিরব প্রতিবাদ৷
আজকের সন্ধ্যাবেলা গাছতলায় আগমন ঘটলো এক নতুন আগন্তুকের। এলোমেলো চুল, ধুলোমাখা চেহারা নিয়ে কেমন ছুটতে ছুটতে এসে বসে পড়লো এই পথের ধারে। ভেজা গাছতলায় একটু আড় করে বসে সে কেমন বিহ্বল দৃষ্টিতে খানিক চেয়ে রইল পাতার বরফিকাটা আকাশের দিকে। আজ হাটবার নয়, নীরব সন্ধ্যায় পথে মানুষের হাঁটাচলা খুব একটা নেই৷ খানিক বাদে বাদে একটি কি দুটি রিকশা, হঠাৎ গল্প করতে করতে এগিয়ে আসা দুয়েকজন লোক এইসব নিয়েই আজকের রাতটিকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হচ্ছিল বটগাছটি। তার মধ্যে কে এল এই মানুষ! ভাব দেখে মনে হয় যেন সদ্য বিপদ হয়েছে তার, খুব বড় কিছু হারিয়ে ফেলবার আক্ষেপ মুখে নিয়ে আরও বহুক্ষণ বসে থাকবার আলামত দেখা যাচ্ছে লোকটির মাঝে। ওর কি আজ যাবার জায়গা নেই, নাকি ইচ্ছে নেই, কে জানে!
ধীরে ধীরে সন্ধ্যার চাদর গাঢ় করে জড়িয়ে ধরে সমস্ত পথ-ঘাট জনপদকে। হালকা নীলাভ আলো লেগে থাকে আকাশে শিল্পীর মুছে নেওয়া প্যালেটের মতোন। সেই মৃদু নীল আর বেশ খানিকটা কালো রঙের আসমানে দিগন্তের প্রান্তসীমা থেকে ভেসে আসে কয়েক পাঁজা মেঘ, খেয়ালি মানুষের মতো এখানে এখানে বসে দেখে নীচের পৃথিবীতে জনবিরল নীরব একটি বটবৃক্ষের তলায় একজন মানুষ বসে আছে। বৃষ্টি হয়ে যাওয়া হেমন্তের প্রায়-রাতে থেকে থেকে বয়ে যায় শান্ত শীতল হাওয়া, তাতে মানুষটির পাঞ্জাবীর খুট ওড়ে, দাঁড়ির ডগা ওড়ে, হাতে ধরে রাখা সিগারেটের ধোঁয়া পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উড়ে আসে এই ভেসে থাকা মেঘমালার পানে। ক্ষয়িষ্ণু সিগারেটের ছাই ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে অন্ধকারে আরেকটি মানুষের পদশব্দ পেয়ে সতর্ক হয় আগন্তুক, ইতিউতি চেয়ে বুঝতে চেষ্টা করে কে আসে এই নীরব পথ ধরে, কে হেঁটে যায় এই সন্ধ্যাবেলায় শতবর্ষী পুরাতন বটগাছের তলা দিয়ে।
: কে যায়?
: আমি, কে ওহানে এই সইন্ধা বেলা?
: আমি শমসের বাড়ির বড় পোলা, সলিম।
: কী কও, শমসের বাড়ির পোলা তুমি এহানে ক্যা, তোমার তো বাড়ি থাকনের কথা! জানাযায় যাও নাই?
: সেই দুঃখেই তো বইসা রইছি।
: আহারে, আমি হইলাম এরশাদ মিরধার মেঝো পোলা। আনিস। তোমার লগে ছোটবেলায় কত খেলছি। কিন্তু তুমি আছিলা কই এতকাল। সেই যে বর্ষার দিনে বিকাল বেলায় আব্বার লগে ঝগড়া কইরা বাড়ি ছাইড়া গেলা, আর তো দেখিনাই তোমারে মনে লয়?
: না গো ভাই। সেই যে গেছি আর ফিরা আসা হয় নাই।
আজ ভোরবেলায় যখন শহরের সব বাতিগুলো নিভে যায়নি, তখন সলিমের বাড়িতে বেজে উঠেছিল একটি ফোন। শেষবারের মত বাঁশি ফুঁকতে ফুঁকতে লাঠি হাতে হেঁটে যাওয়া দারোয়ান অবাক হয়ে দেখল ফার্মেসির ওপর তলার বারান্দায় আদুল গায়ে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছেন সলিম খান। সেই চিৎকারে ভেঙ্গে যাওয়া ঘুম নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে দারোয়ানের সারারাতের সঙ্গী কুকুরটি। তার মুখ তুলে জুড়ে দেওয়া চিৎকারে ঢেকে গেলে উৎকণ্ঠিত সলিমের গলা। ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গির হাত নাড়া, থেকে থেকে অস্থির পায়চারি আর চারদিক থেকে একযোগে ভেসে আসা আজানের শব্দে সারারাত্রির ঘুম ভাঙ্গতে শুরু করল নগরীতে। পূবাকাশে সাদা সুতো থেকে কালো সুতো আলাদা করবার মত আলো ঘনিয়ে উঠতেই যে ব্যস্ততা শুরু হয়েছিল মফস্বলের এই দোতলা বাড়িটির ওপরের তলায়, সেটি খুব সময়সঙ্কটে পড়া একজন ভদ্রলোকের বেশে বেরিয়ে এল যখন দিনের প্রথম রিকশার চাকা পথে গড়াতে শুরু করেছে।
: বুঝলেন ভাই, সেই ভোরবেলায় রিকশাওয়ালারে একরকম দৌড়ানি দিয়া স্টেশনে আইসা দেখি সকালের ট্রেনটা এই ছাইড়া গেল!
বটগাছের তলায় অপর সঙ্গীর মুখে শোনা গেল আফসোসের চুকচুক ধ্বনি। ওপরের মনোযোগী শ্রোতাটিও দুটি পাতা টুপ করে ঝরিয়ে দিয়ে শোক জানাল। আকাশে জমতে থাকা একটি দুটি মেঘের টুকরো এখন মিলে-মিশে বিরাট হয়ে উঠেছে। ম্লান চাঁদের আলো সেই চাদরে ঢেকে গিয়ে এখন প্রায় নিভুনিভু৷ কাপড় ঝেড়ে লোক দুটি মুখ থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মিটমিটে বাতি একে একে উঠছে নামছে দুজনের হাতে।
: তারপর এই পর্যন্ত আইলা ক্যামনে?
সন্ধ্যার পর নীরব হয়ে যাওয়া গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটছে দু বন্ধু। চারদিকে বিশাল জমিতে উড়ছে জোনাকি, বিস্তৃত মাঠের ওপর চাঁদের আলো পড়ছে মেঘের উড়নি ভেদ করে। আলোছায়ার মাঝে বয়ে যাওয়া ধূলিধূসরিত পথ, পাশের ঝোপঝাড়ে মানুষের সাড়া পেয়ে চট করে সরে যাওয়া কোন শেয়াল আর নিচু হয়ে আসা গাছের ডাল থেকে বাদুড়ের উড়ে যাওয়া দেখে বহুদিনের তৃষিত দৃষ্টি তৃপ্ত করে নেবার উপায় নেই সলিমের। এতদিন বাদে দেখা হওয়া বন্ধুর সাথে অতীতের স্মৃতিচারণ করবার সুযোগ নেই তার, বরং যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট সলিম সারাদিনের বিত্তান্ত বলে যাচ্ছে অনবরত।
‘বুঝলা মিয়া আনিস, ট্রেন না পাইয়া ছুইটা গেলাম গাবতলী, বাস ধরতে। সেহানে ঘণ্টায় ঘন্টায় বাস ছাড়ে। গাড়ির হুঁইসেল মাইনষের হল্লা, চিটার বাটপাড়ের আড্ডাখানা থিকা যখন টিকিটখান কিইনা নিয়া বাসে গিয়া উঠলাম, মনে হইল রাজ্য জয় কইরা সিংহাসনে বইছি আওরঙ্গজেবের লাহান। বদ দালালগুলান সব টিকিট কাইটা রাখছে আগেই, কাউন্টারে গেলে কয় নাই, বাইরাইলে কানে কানে আইসা কয় ‘কবের টিকিট লাগব কন’। তারও কি দাম, সব শালা লকলইক্কা জিব বার কইরা রাখসে খাওনের লাইগা। ট্যাকা চাই ট্যাকা!’
বাসে উইঠা ঘুম দিলাম, সেই ঘুম ভাঙল সিরাজগঞ্জ আইসা। চোখ খুইলা দেখি সামনে পিছে গাড়ির লাইন সব ধম ধইরা দাঁড়ায় আছে রাগ করা বউয়ের লাহান। ঘটনা কি, ভিআইপি আসতেছে। সামনে পিছনে সীমাহীন গাড়ির লাইন দেইখা আমি তো ভিতরে ভিতরে জ্বইলা পুইড়া গেলাম। বাজানরে আমার হাসপাতাল থিকা জবাব দিয়া দিছে। এখন বুঝি শেষ দেখাও দেখতে পারুম না। দিনডা উঠল তার লাল জিব বাইর কইরা তাপ ঢালতে ঢালতে। ছেলে বুড়ো সব ঘামে ভিজতেছে, পোলাপান কানতেছে—আমিও তখন ভিতরে ভিতরে তাদের সাথে মিল দিয়া কানতেছিলাম—তারা কান্দে যন্ত্রণায়, আমি কান্দি বেদনায়। আর সারাদিন আসতেছে ফোন, আমি তো আর কইতে পারি না কিসমতে আমায় বাইন্ধা রাখছে গাড়ির সিটে। এই অকূল সমুদ্র আমি হাঁইটাও পার হইতে পারুম না। বিকাল বেলায় গাড়ি ছাড়ার আগ দিয়া শেষ ফোন পাইলাম, গণ্যমান্য মাইষেরা মিলা দাফন কাফন শ্যাষ কইরা ফালাইছে৷ শুইনা আমি আর থাকতে পারলাম না মিয়া আনিস, ভরা গাড়িতে হাউমাউ কইরা বইলা উঠলাম, বাজান আমারে মাফ কইরা দিও…!
২
মধ্যদুপুর। উত্তরবঙ্গের বিস্তৃত মাঠের ওপর বাতাসে ঢেউ উঠছে ফসলের। হরিৎ ধানের ডগা মুকুটের মত শীষ দুলিয়ে নেচে নেচে যেন গায়ে মেখে নিচ্ছে গনগনে রোদ। বয়ে যাওয়া হাওয়ায় মাটির রাস্তা থেকে ধুলোর ঝাপটা উড়ে যায় দিগন্তে। শরীরে পাঁচটি শতকের ভাঁজ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একাকী কৃষক চেয়ে থাকে সেই ধূসর মেঘের দিকে। এঁকেবেঁকে যাওয়া পথের মত বৃদ্ধের চেহারায় কালের দাগ বেয়ে নেমে আসে নদীর ধারা। কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে পথের দিকে, বটগাছের দিকে…পথ ধরে আসছে পায়ে হাঁটা ক্লান্ত পথিকের দল৷ গনগনে সূর্য মাথায় করে হাঁটতে থাকা মোট বওয়া ছিটকাপড়ওয়ালা, দূরের হাট থেকে বাজার করে ফেরা ধনী গৃহস্থ , লাঙ্গল কাঁধে ধুলোর রাজ্য থেকে উঠে আসা সুলতানের পটের নায়কেরা সকলেই এখানে আসে দু-দুণ্ড শান্তি পেতে। শরীরে বয়ে যাওয়া মুক্তোদানার মত ঘাম মুছতে মুছতে তাদের মুখে খেলে যায় বিদ্যুত চমকের মত একটুকরো হাসি…
এমন এক মধ্যদুপুরে চাষীরা অবাক হয়ে দেখল ভিনগ্রামের জংলার আড়াল হতে অপরিচিত দুটি লোক হাঁটতে হাঁটতে এসে থেমে গেল ঠিক বটগাছের নিচে। ক্ষেত-নিড়ানির ফাঁকে মুখ তুলতেই দেখা গেল তারা আলাপে মশগুল। ঘাসের শক্ত শেকড় টেনে ওঠাতে ওঠাতে অপাঙ্গে চেয়ে রইল এই আধা শহুরে মানুষগুলোর দিকে। জোয়ান মোরগের ক্ষোভের মত গনগনে রোদ যখন তার সবগুলো ডানা মেলে ধরে ঢেকে নিলো সমগ্র চরাচর, তখন তারা হাতের পাসুন নিড়ানি সমেত ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে এল উঁচু সড়কে। গাছতলায় বসে কৃষকেরা মাঠের গল্পের হারিয়ে যাওয়া সুতো খুঁজতে খুঁজতে কান পেতে রইল দুই আগন্তুকের পানে। সস্তা বিড়ির ধোয়া উড়িয়ে দিতে দিতে শুনল লোকদুটির টুকরো টুকরো কথা। সবটুকু বুঝতে না পারলেও ধরতে কষ্ট হল না, এঁরা গাছটি কিনে ফেলতে চায়। আলাপের মাঝে একজন দম্ভ ভরে মাটিতে পা ফেলে যখন বললো, ‘টাকা কি আমার কম আছে নাকি’ তখন এরা চিনে ফেলল এই হল মহাজন, আর পাশেরজন দালাল। নানা লোকের আনাগোনায় সেই কথার কুণ্ডলিটি ঘুরতে ঘুরতে দূরে সরে যেতেই হালচষা কৃষকের দল আবার খেই ধরতে বসল তাদের হারিয়ে যাওয়া আড্ডার।
‘হেই মকবুল, বিয়াই বাড়ি চোররে পরে কী করছো কইলা?’
‘ব্যাটারা কি কইয়া গেল হুনলা, মনে লয় গাছখান কাইটা লাইব!’ গল্পের আহ্বানে পাত্তা না দিয়ে মকবুল থাকে এই গাছতলাতেই।
‘অত সোজা না মিয়ারা, বৃদ্ধ রতন মিয়া লুঙ্গির ভাঁজ থেকে বিড়ি বের করতে করতে বলে, হেইবার নারানগঞ্জের ব্যাপারির ঘডনাডা মনে করলেই পারো। একলগে সাতদিন খোয়াব দেইখা সেই যে বায়না ফেরত নেবার লাইগা ঝোলাঝুলি শুরু করল!’
‘হুনছিলাম দায়ের কোপ পড়লে নাকি রক্ত বাইরাইত!’ গল্পে তা দেয় তরুণ মবিন মিয়া।
‘কী আর কইতাছ, কথার খেই ধরে পৌঢ় কৃষক তালুকদার, হেইবার বন্যার পরের বছরে যখন কথা উঠল এই গাছ বেইচা হালাইব। মেম্বরে হের পর থিকা যহনই গাছতলা দিয়া যায়, টুপ কইরা ডাল ভাইঙা সামনে পড়ে। যহনই যায় টুপ কইরা ডাল ভাইঙ্গা পড়ে। একবার তো একটুর লিগা মাথা ফাটে নাই। হেরপর থিকা গাছ কাটনের নাম আর কেউ লয় না। এইটা আমগো পয়া গাছ!’
‘এগুলা কি হাছা ঘটনা, চাচা!’ তরুণ মবিনের গলায় উদ্বেগ।
‘হাছামিছা তাইনে জানেন’ বলে আকাশের দিকে উদাস আঙ্গুল তুলে চুপ হয়ে যায় বৃদ্ধ। মুখের সামনে গড়ে ওঠা ধোঁয়ার মেঘ তাকে আড়াল করে নেয় এই আড্ডার আসর থেকে। তরুণ মবিন আলীর ইচ্ছে ছিল কালের ঢেউয়ে পেছনে পড়ে যাওয়া এইসব গল্পেরা জেগে উঠুক, নতুন উপলক্ষ পেয়ে আবার চাগিয়ে ওঠুক কাহিনীর ফেনা। নিরানন্দ কৃষক জীবনে সামান্য বৈচিত্র যোগায় এই রোমহর্ষক কিসসাগুলো, এবং প্রতিবারই ফাও হিসেবে জুড়ে যায় অন্য কোন ঘটনার অপভ্রংশ। এই ভাবে নানা রং মাখতে মাখতে যখন সেই গল্পেরা ক্লান্ত দুপুরবেলায় এই বটতলার মাঠে এসে হাজির হয় তখন তার কতটুকু সত্য আর কোনটুকু মিথ্যা তা ঠাহর করে এমন গুনিন দশগ্রামে নেই।
সূর্য হেলে যেতে থাকে পশ্চিমের দিকে। প্রখর রোদের তাপ কমে গিয়ে আলতো নরম হয়ে পড়ে থাকে পথের ধারে। বটের পাতায় পাতায় ভয় ছড়িয়ে দিয়ে একসময় বিদায় নেয় লোকদুটি। চাষীরাও ফিরে যায় নিজ নিকেতনে। রাস্তার পাশে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা গাছের ছায়াটি দীর্ঘ হতে হতে নেমে যায় ক্ষেতের আল ছাড়িয়ে আরো বহুদূরে। তখন আপনি যদি গ্রামের শেষ বাড়িটির দিকে তাকান, দেখবেন মলিন বেশে একজন নারী হেঁটে আসছে এই পথ ধরে। কদিন আগে মারা যাওয়া শমসের মিয়ার মেয়ে। এই বছর তিরিশের নারীই এই গল্পের উদগাতা। যে মফস্বল শহরে আমার নিবাস সেখানে সে আমাদের প্রতিবেশি। প্রতিদিন দেখা হতে হতে জমা হওয়া গল্পটিই আজ আপনাদের সাথে করছি।
কবে তার সাথে প্রথম দেখা মনে নেই, প্রতিদিন আসতে যেতে চোখ সয়ে গেছিল একসময়। বেলা এগারটার ঝোঁকে যখন শরীর আলসে হয়ে উঠেছে, পূর্বাহ্নের ধীর গতিতে বয়ে যাওয়া সময়ে নিঃশব্দে দুটি টোকা পড়তো দরোজায়। আটপৌড়ে শাড়ির ঘোমটা তুলে সে সোজা চলে যেত রান্নাঘরে। ধীরে ধীরে আলসেমি ছেড়ে দিনের ব্যস্ততা শুরু হতো পুরো বাড়ি জুড়ে। ধোয়া মোছা বাসনের ঠুংঠাং সব মিলে পড়ার ঘর হতে দিব্যি টের পাওয়া যেত সকাল থেকে ঝিমিয়ে থাকা বাড়ি জেগে উঠছে। টেবিলে ঝুকে পড়ে ত্রিকোনমিতির সমস্যা বুঝে উঠতে উঠতে শোনা যেত ছোটদের সাথে তার অযথা বাতচিত। রোদ কড়া হয়ে উঠে যাবার পর কোন কোন দিন যখন চেয়ার পেতে বসতাম চায়ের কাপটি হাতে, দূরাগত কণ্ঠস্বরে শোনা যেত তার আক্ষেপ, ‘বুঝলেন আফা, ভাইয়ের ফার্মেসির সামনে দিয়া হাইডা যাই, ফিরাও চায় না। কী পাষাণরে!’ ছোটগল্পের পাতা হাতে চেপে ধরে উৎকর্ণচিত্তে আগ্রহী হয়ে উঠতাম তার গল্পের প্রতি। এই গার্মেন্টসের সহজ পয়সার যুগে বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে হাত ক্ষইয়ে শরীর ভেঙ্গে কাজ করবার রহস্য জানতে আমার আগ্রহ কম নয়। কিংবা অন্যবাড়ির রসালো আলাপ তার নিজস্ব ক্ষোভ মিশিয়ে বলার যে ভঙ্গি সেটির সাথে আমি পরিচিত নই।
মাছ কুটতে কুটতে আপন মনে যে গল্প করে সে, তার থেকে জানা হয়ে যায় রাস্তার এপার ওপারে দুটি ভাইবোনের বাস করার গল্প। সুদূর গ্রাম হতে উঠে এসে একটি শহরের একই পাড়ায় সলিম আর তার বোনের বাস, অথচ একজন সদা সচেষ্ট থাকে যেন লোকে না জানে এ আমার বোন। তাতে ইসলামি আন্দোলন করা বন্ধুদের সামনে সলিমের মাথা কাটা যাবে। অন্যের বাসায় কাজ করার ফাঁকে বোনের যখন সুযোগ হয় দুটো শখের খাবার তৈরী করার, চুপেচুপে একটি বাটি নামিয়ে রেখে যায় ভাইয়ের ফার্মেসির টেবিলে। অন্তরের প্রাচুর্যে ঐশ্বর্যবান এই দম্পতি ভুলে যায়নি সম্পর্কের গুরুত্ব। ভালবাসার টান, শৈশবের স্বপ্নময় দিনগুলো একসাথে হেসে খেলে বেড়ে ওঠা, ছোট্ট পুতুলের মত শিশুদের কোলেপিঠে মানুষ করার স্মৃতি, তা কি চাইলেই ভুলে যাওয়া যায়৷ চাইলেই কি মুছে ফেলা যায় রক্তের টান! ঠুনকো অর্থের তাপে হয়তো সাময়িক ধুলো লাগে চোখে, কিন্তু সে আর কদিনের।
ঈদের দিনগুলোতে পুরো মহল্লায় উৎসবের রেণু ছড়িয়ে পড়ে। নতুন পাটভাঙ্গা পাঞ্জাবী পরে মুসল্লিরা ধীরে ধীরে হেঁটে যায় ঈদগাহে, ফিরে আসবার সময় কোলাকুলি করে খুশীর পালে আলগা হাওয়া লাগায়। আর সেই ভিড় ঠেলে খুব ধনী কোন বাড়িতে কাজ করতে যায় সে। নিজ-ঘর নিজের সংসার উল্টে ফেলে রেখে তাকে নেড়ে যেতে হয় অন্যবাড়ির সেমাইয়ের হাতা। কোরবানীর ঈদে যখন রাস্তার এপার হতে গোশতের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে রাস্তার ওপারে, তখন হয়ত সারা দিনের ক্লান্তি মাথায় নিয়ে ধীরপদে বাড়ি ফিরছে সে। এমনি করে হয়ত আসে ভাতিজাদের বিয়ের দিন, চোখের সামনে সাজগোজ আনন্দ দেখেও থেমে যেতে হয়। সলিমেরা সাহস করে আমন্ত্রণ করতে পারেনি যে! জগতের ঠুনকো বিত্তের দেয়ালে মাথা ঠুকে মরে তাদের মানবতা, আপন সহোদরার সারাজীবনের স্নেহ ভালবাসা ভুলে যেতে পারে সামান্য গতিময় জীবনের কাছে।
দিন যায়, জগতের আর সব নিয়মের মত ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে বছর যেতে থাকে। ধাবমান মাস সপ্তাহ দিনের ভেলায় চড়ে ভেসে যেতে থাকে জায়মান সময়। উঠোনের ছোট্ট গোলাপচারাটি পাতা-ফুলে মেলে ধরে তার ঐশ্বর্য। আমের গন্ধে ম ম করে চারদিক, হাঁটতে গেলে পায়ের তলা কালো হয়ে আসে। আর ঘড়ির কাঁটার মত একঘেয়ে প্রাত্যহিক জীবনের ছক প্রতিদিন কেবল আবার করে পূরণ হতে থাকে। এর মাঝে একদিন শোনা যায় সলিমের বাবা অসুস্থ। ব্যগ্র কণ্ঠে অনুমতি নিয়ে তার তাড়াহুড়ো করে ছুটে যাওয়া আমাদের দিনযাপনের প্রাত্যহিকতার পরিবর্তন ঘটায়। চেনা ছন্দে তাল হারিয়ে চুপচাপ বসে থাকি টেবিলে, বাড়তি কাজের চাপে কপালের ঘাম মোছেন আম্মু। বাইরে গেলে আড়চোখে দেখি গলির মুখের ফার্মেসি বন্ধ। সবাই গিয়েছে এক মৃত্যুদর্শনে। বিদায়ের ঘন্টাধ্বনি বেজে চলেছে অবিরাম, নিত্য সে ঘন্টার তালে ছুটছে মানুষ। খাট কাঁধে নিয়ে হাঁটছে শোকসন্তপ্ত পরিবার, মুখাগ্নির আগুন জ্বলে উঠছে চিতায়, কফিন আড়াল হচ্ছে কবরখানার নিস্তব্ধতায়। ঘুরে চলেছ মৃত্যুঘড়ি,অনন্ত সে ঘুর্ণন…
সপ্তাহখানেক শোকযাপনের পর যখন তার অনুপস্থিতির কারণে আম্মুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে প্রায়, তখন একদিন দিনের বেলায় আবার দুটো টোকা পড়ে দরজায়। বিরতির অনভ্যস্ততায় থেমে থেকে নয়, যেন নিয়তির বাঁধনে পুনরায় নিজ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় সে। অনিয়মিত জীবনে যখন প্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি তখন আবার তার আগমনে সেটুকু ভুলতে হল বাড়ির সবাইকে। বাড়তি কাজের চাপটুকু ছেড়ে দিয়ে শান্তি পেল সবাই, বাড়ির বিড়ালটিও নিরুদ্বেগ ন্যাওটা হয়ে থাকবার অবলম্বনটুকু ফিরে পেল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্পের টুকরো-টাকরা ভেসে আসাতে শোনা গেল শেষকৃত্যের নানান খবরাখবর৷ বাড়ির আর সব সংবাদের ভেতর থেকে বেড়িয়ে এল সলিমের জানাযা না পাওয়ার কথা। গাড়ির জটিলতায়, সংবাদের অনির্ভরতায় সে রওনা হয়েছিল সবার শেষে। মরণাপন্ন বাবার মৃত্যু-সংবাদে আরও কয়েকবার ছুটে গিয়ে সময় আর অর্থ দুটিরই অপচয় ঘটেছে। তাই এবার বাঘ এসেছে শুনে কান দেয়নি প্রথমে। শেষে সত্যিটা জানবার পর ছুটে গিয়ে শেষমুহূর্তে উপস্থিত হতে চেয়েছে। কিন্তু তা কি আর সম্ভব। বৈষয়িকতায় ডুবে থেকে ওপারের ডাক এত দ্রুত কি আর কানে পশে! ঘড়ির ঘণ্টা বেজে যেতে থাকে অবিরাম, কিন্তু শেষ ঘণ্টায় সাড়া দেবার ইচ্ছেয় থাকলে আলসেমি এতটাই জেঁকে বসে, ঠিক সময়ে আর সাড়া দেয়া হয়ে ওঠে না। তখন ছুটে যেতে গিয়ে দেখা যায় শেষ গাড়ীটি চলে গেছে, শেষ টিকিটটি বিক্রি হয়ে গেছে, দিনের শেষ রিকশাটি গ্রামের পথে চলে গেছে সন্ধ্যাতারার মত পেছনের লাইটটি জ্বেলে দিয়ে। উদভ্রান্ত শোকে পায়ে হেঁটে ছুটে যেতে যেতে যখন দাঁড়িয়ে পড়া যায় কবরস্থানের সামনে তখন লাশ নেমে গেছে মাটির কোলে। অনন্ত বিছানায় শুয়ে পড়বার আগে শেষ সুযোগটিও পাওয়া যায় না বাবার মুখটি দেখবার। তার বদলে মেলে কেবল নতুন মাটির একটি কবর, ঘিরে থাকা মানুষ কতক। শুরু-রাতের চাঁদের আলোর সাথে মিশে যায় সম্মিলিত ঘৃণাধ্বনি, বেদনায় সলিমের হাঁটু ভেঙে বসে পড়া কারও হৃদয় আর্দ্র করে না…
৩
বহুবছর আগের দৃশ্য। গ্রামের ধনী চাষী শমসের মিয়ার বড় ছেলে ঢাকা থেকে পড়াশোনা শেষ করে এসেছে। এই দূরগ্রাম থেকে উঠে গিয়ে শহরের নামি ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ দিয়ে আসায় পাড়ায় খুশীর অন্ত নেই। পাড়াপড়শিরা দেখা করতে আসে, বুড়ো আত্মীয়স্বজন এসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। দোয়া করতে গিয়ে নিজ সন্তানের ব্যর্থতা স্মরণ করে কেঁদে ওঠে কোন কোন দয়ার্দ্র মায়ের হৃদয়। কন্যাদায়গ্রস্থ পিতারা আশায় বুক বেঁধে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। আরও ত্রিশ বছর আগের গ্র্যাজুয়েট নিয়ে পল্লি-এলাকায় আর যা যা হতে পারত সেসব একটু দয়া করে কল্পনা করে নিন। তাতে আমি টাট্টু ঘোড়ার মত এস্কেপ করে সোজা ক্লাইমেক্সে চলে আসতে পারি। প্রশংসা, সম্মান আর নানান প্রকারের পান-ভোজনের পর স্বাভাবিক ভাবে কথা উঠল বিয়ের। ক্রমে ক্রমে এই বার্তা রটি গেল গ্রামে, শমসের বাড়ির সলিমের বিয়ে। বগলে ছাতা হতে দুধারী তরবারির মত ঘটকের দল উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করল। মশলাদার পান আর পিঠের আপ্যায়ন শেষে তারা পকেট থেকে ঝেড়ে দেয় দুচারটে ছবি, তার ব্যবসার মূলধন৷ তাই নিয়ে বুকে বালিশচাপা হয়ে রাতবিরেতে স্বপ্ন দেখে সলিম, নাগরা জুতা পায়ে কলাগাছের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার কিংবা লাজুক বউয়ের ঘোমটা তুলে ধরে হাসবার স্বপ্ন। আমাদের গল্পে সেরকম কোন ক্লাইমেক্স নেই, সহজেই বিয়ে হয়ে গেল সলিমের। তবে এই নিয়ে শমসের বাড়িতে আনন্দ হলো খুব। বংশের পয়লা বিয়ে। সারা গ্রামের লোকজন ভেঙ্গে পড়ে খেয়ে গেল বিয়ের দিন, হালের গরু ক্ষেতের ধান পাড়াপড়শি খাবে তাতে সমস্যার কি আছে!
বিয়ে তো হলো, এইবার কাজ চাই। পাশ দেয়া ছেলের লাঙ্গল কাঁধে ক্ষেতে গিয়ে হাল চষা কি মানায়, নতুন বউয়েরও ইজ্জতে লাগবে তাহলে। এত টাকার পড়াশোনা যদি মরিচের বীজের সাথে মাটিতেই পুঁতে ফেলতে হয়, তবে আর লাভ কী হলো। মহল্লার পাড়াপড়শিরাও তো বসে নেই, কেউ এসে ফুসলায় ‘বাবা, সরকারি চাকরিতে চেষ্টা করছো দুয়েকবার, আমগো এলাকায় কোন ওসি-টোসি নাই!’ বন্ধুরা ফুলিয়ে দেয়, ‘আরে শুনলাম ঢাকায় টাকা ওড়ে, তুই এই গাঁয়ে বসে ভ্যারেণ্ডা ভাজছিস কেন!’ এরকম নানা কথার হাওয়ায় উড়তে উড়তে একদিন সলিম মায়ের আঁচলটি ছেড়ে গ্রামের ছায়াময় পথ দিয়ে শহরের দিকে রওনা দেয়। তার পায়ে সেঁটে আছে নানা ধরনের উপদেশ, বন্ধুদের ঈর্ষান্বিত হয়ে যোগানো সাহস আর তারুণ্যের স্বপ্নময় উদ্দীপনা। ঢাকায় উড়তে থাকা টাকার একটি অংশ তো চাই। নাহলে গ্রামে ইজ্জত থাকবে নাকি!
চাকরি না ব্যবসায়, পুলিশ না কাপড়ের দোকান, এই দ্বিধাদ্বন্দে দুলতে দুলতে আর নানা ইন্টারভিউ বোর্ডে ততোধিক দ্বিধান্বিত ঠোকর খেতে খেতে শেষে আর চলতে না পেরে মেসের পাশে আড্ডা মারার ফার্মেসিতে ঢুকলো সলিম। গ্রামে আশার বেলুন ফুলিয়ে আসা, রোজ রাতে স্বপ্নে দেখা তুলতুলে তোয়ালের নরম গদির স্বপ্ন আরেকবার ঠোকর খেলো পেরেক-ওঠা চেয়ারে বসার সময় নিত্যদিন খোঁচা খেয়ে খেয়ে। মামা খালুর জোর বিহীন কোন যোগাযোগ ছাড়া নিজের চেষ্টায় এটুকুই হয়ত ঢাকায় জোটে৷ উড়তে থাকা টাকার ভাগ পেতে হলে যে সিঁড়ির দরকার সেটি কী করে থাকবে শহরে শেকড়বিহীন ছাপোষা সলিমের। অষুধের গন্ধে মাথা ধরা সারাতে বলুন আর জন্মনিরোধকের বিজ্ঞাপন সামনে নিয়ে বসে থাকা কঠিন হওয়ার জন্যই বলুন, মাসকয়েকের ভেতর এই শহরের দূর্গম এক গলির শেষ বাড়িটির ওপরে চিলেকোঠায় দুটি ঘর ভাড়া নিয়ে টোনাটুনির সংসার পাতল সলিম। শুরু হলো নতুন জীবন। রোজকার সন্ধ্যায় নগরীর কোণে কোণে যে এক বিরাট সিম্ফনি বেজে ওঠে তার ক্ষুদ্র একটি তার হয়ে উঠল সলিমের চিলেকোঠার ঘর। দুটি প্রাণীর একসাথে হাসি, ভিন্নভাবে একই রকম দুঃখবোধ আর পাওয়া না পাওয়ার ভিন্ন ভিন্ন আক্ষেপ মিলে গেল শহরের লাখো নিম্নবিত্ত সংসারের সাথে। একা একা বসে থাকা শান্ত দুপুরের স্মৃতিচারণ, কোন কোন আশ্চর্য বিকেলে একসাথে রিকশাভ্রমণ, খুট করে ভেঙে যাওয়া বাদামের খোসা, এইসব সাধারণ গল্পের মাঝে একরাতে ফিসফিসিয়ে সলিম শোনায় আশ্চর্য এক গল্প। আলফে লায়লার মত একরাতে বড়লোক হয়ে যাওয়ার এক কাহিনী সেটি।
মাসকয়েক পর দেখা গেল ব্যস্ত শহর ছেড়ে মফস্বলে পাড়ি জমিয়েছে সলিম। চাকরি নয় ব্যবসায়েই ভবিষ্যৎ দেখতে চায় সে। ছোট্ট একঘরের সংসার আর বাজারের সামনে একটি অষুধের দোকান। বছরখানেকের অভিজ্ঞতায় এই ব্যবসাই শিখতে পেরেছে সে। তেমন জাঁকালো নয়, মধ্যবিত্ত বাবার পক্ষে এইটুকু জোগান দিতেই বিঘেছয়েক চাষের জমি বেড়িয়ে গেছে। সোনার মতন ধান উঠত যে জমি থেকে তা বাবাকে মুখের কথায় ভুলিয়ে নিয়ে এসেছে। শহরে ব্যবসা হবে, নিয়ন সাইনে বাতি জ্বলবে দোকানের সামনে, ভেতরে জ্বলবে ঝকঝকে লাইট ফ্যান যেসব এই গ্রামের কেউ আগে কখনো দেখেনি। লাল-নীল শহুরে বাতির লোভে পড়ে বৃদ্ধ শমসের আর সব ছেলে মেয়েদের ক্ষোভ সামলে টাকা তুলে দিলেন বড় ছেলের হাতে। শিক্ষিত ছেলে, কোলেপিঠে মানুষ করা, ব্যবসা বোঝা অভিজ্ঞ সলিম কি আর ধরা খাবে। বছর দুয়েকের মাঝে দোকান দাঁড়িয়ে গেলে আর চিন্তা কী, লাভে আসলে তখন ছ’বিঘা জমি দশ বিঘা হয়ে ফিরে আসবে। এমন নানা খোয়াবের তলায় পড়ে রাতারাতি ধনী কৃষক শমসেরের আয় অর্ধেকে নেমে এল। শহরে অবশ্য ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেল সলিমের। অমন জেল্লাদার ঝকঝকে অবশ্য হলো না, আমাদের কটা স্বপ্নই আর পূরণ হয়!
দিন যায়, হঠাৎ আয় কমে যাওয়া বৃদ্ধ শমসের মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে আরও গরীব হয়ে যান। দিন আনা দিন খাওয়া বৃদ্ধের ফোন যায় ছেলের বাসায়। দুপুরে ফোন করলে ছ’বছরের নাতি বলে ‘কে আপনি, আপনাকে তো চিনতে পারছি না!’
ছোট্ট ছেলের কথা শুনে ভেঙে পড়া চোয়ালে হেসে ওঠেন বৃদ্ধ, ‘আমি তোমার দাদা হই, তোমার আব্বুরে দেও’
‘আব্বু তো বাসায় নেই, আপনে পরে ফোন করেন।’
রাতে ফোন দিলে মেয়েলি কণ্ঠে কেউ বলে ওঠে, ‘এই নাম্বারে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না’। সকালে শোনা যায়, ‘দ্য নাম্বার ইজ বিজি নাও’। বিগত শতাব্দির বৃদ্ধ শমসের এইসব কেতাদুরস্ত ইংরেজি শুনে বুঝে উঠতে পারেন না, আগে যে নাম্বারে ফোন দিলে কেবল ছেলের গলাই শোনা যেত, এখন সেটা বাদে আর সব কিছু কেন শোনা যায়। কিছুদিন পর এক রাত্রে ফোন আসে সলিমের, ‘বাবা, আমি সামনে মাসেই টাকা পাঠাইতেছি, আপনে টেনশন নিয়েন না।’ অর্থের চাপে ক্লিষ্ট শমসের ভাঙা গলায় হাসেন, ‘ঠিক আছে বাবা, দিও সময় মতোন। আর তোমার মায়ের অষুধগুলো পাঠায় দিও, ডাক্তারে প্রেসক্রিপশন লিখে দিছে। কয়টা আবার ঢাকা ছাড়া পাওয়া যায় না।’
‘আমি থাকতে টেনশন কি, সব অষুধই পাঠায় দিব। আপনে কারো হাতে প্রেসক্রিপশন পাঠায় দিয়েন।’
সেই প্রেসক্রিপশন হাতে শহর থেকে খালি হাতে ফিরে আসে মাইদুল৷ এখন দোকানে টানাটানি চলছে, আগামি পনেরো তারিখ সলিম আসার সময় নিয়ে আসবে বলেছে।
সেই পনেরো তারিখ আর আসে না। বারবার ভুলে যায় সলিম, কখনে ছেলের অসুখ কখনো শশুর হাসপাতালে। এমনি করে তারিখ পেছাতে পেছাতে একদিন হাটে চাউর হয়, সলিম তো শহরে জমি কিনেছে। অসুস্থ বৃদ্ধ শমসের বাজার করে ফেরার পথে এই গুজব শুনে দাঁড়িয়ে যান পথেই। অজান্তে বেড়িয়ে আসে বেদনাভরা উচ্চারণ, ‘সলিম, তুই তো আমাগোর জানাযাও পড়তে পারবি না। বাঁইচা থাকতে খোঁজখবরের প্রয়োজন রাখলি না, কবরে যাওয়ার আগে তোর দোয়ার আর দরকার নাই!’ ভরা বাজারে পাড়াপড়শি জড়িয়ে ধরে, ‘এ কী করলা শমসের মিয়া। নিজের পোলারে বদদোয়া করলা!’
‘যা করছি, ঠিকই করছি।’
দুহাত ভরে নিজের কৃতকর্মের ফল নিয়ে গ্রাম থেকে ফিরছিলো সলিম। বহুবছরের না থাকা, অনভ্যস্ত এই প্রত্যাবর্তনের লজ্জা নিয়ে সে বড়ই বিব্রত এই কদিন। বুক ভাসিয়ে কান্নার জন্য হলেও একটি আশ্রয় চাই, আশ্রয় চাই প্রত্যবর্তনের লজ্জাকে ঘষে ঘষে তুলে ফেলবার জন্য৷ গ্রাম থেকে শত তিরস্কারের স্মৃতি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সে চলে যেতে যেতে ভাবে সীমানার বাইরের বটগাছটি হতে পারে তার আশ্রয়। সেদিনের হতাশাভরা সন্ধ্যায় সে যেমন একটি সুহৃদ জুটিয়ে দিতে পেরেছিল, আজকের এই বিকেল বেলায় হয়ত আবারও সে তার বিস্তৃত ছায়ায় কোলে তুলে নেবে। গাছ সব সয়, মানুষের শত আঘাত শত বেদনা সয়ে সে ছায়া দিয়ে যায় অবিরাম। শান্ত স্নিগ্ধ শীতলতা দিয়ে বাসযোগ্য করে তোলে পৃথিবীকে।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে একটি ধোঁয়ার কুণ্ডলীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে সলিম। কে কী পোড়ায়? তার ন্যুব্জ দেহটি সোজা করে চারদিকে তাকাতে অবাক হয়ে যায়। এ তো সেই বটতলার মোড়। শতাব্দী প্রাচীন এই গাছটি এমন রাতারাতি নেই হয়ে গেল কী করে। কারা কেটে নিয়ে গেল এই পথের পাহারাদারটিকে। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে তার দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। বাতাসে উড়ছে পাতা। কারা যেন পাতা জড়ো করে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। বিরাট কুণ্ডুলি পাকানো ধোঁয়ায় আবিল হয়ে থাকা চারপাশে কেবল গাছের মৃতদেহের গন্ধ। এই দমবন্ধ পরিবেশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হল এ আগুন কেউ লাগায়নি। গাছের প্রতি এতদিনের অবহেলা অযত্ন আর অকৃতজ্ঞতার ফল হিসেবে গাছ নিজেই নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
এ আগুন সব অবহেলা দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেবার,
এ আগুন বিষাক্ত প্রতিশোধের,
এ আগুন অভিশাপের…