অসিয়ত: হাকিমুল উম্মতের নির্দেশনা

মুনশী নাঈম:

অসিয়ত হলো কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পরে কোনো কিছু করা বা হওয়ার নির্দেশনা প্রদান। আমানত পৌঁছে দেওয়া, সম্পদ দান করা, কন্যা বিয়ে দেওয়া, মৃতব্যক্তিকে গোসল দেওয়া, তার জানাযা পড়ানো, মৃতব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ বন্টন করা ইত্যাদি অসিয়তের অন্তর্ভুক্ত। কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার দ্বারা অসিয়ত শরীয়তসম্মত । আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে , যখন তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হবে, যদি সে কোনো সম্পদ রেখে যায়, তবে তা অসিয়ত করবে’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮০)। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম ব্যক্তির উচিত নয় , তার অসিয়তযোগ্য কিছু রয়েছে আর সে দু’রাত কাটাবে অথচ তার কাছে তার অসিয়ত লিখিত থাকবে না’ (বুখারি, মুসলিম)।

থানবি রহ. ছিলেন একজন মুজাদ্দিদ। মুসলিম জীবনের এমন কোনো অধ্যায় নেই, যেখানে তার চোখ পড়েনি। এরমধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় অসিয়ত। ১৩৪৪ হিজরির রমজান এবং ১৩৪৬ হিজরির সফর মাসে থানবি রহ.-এর দুটি অসিয়ত প্রকাশিত হয়। অসিয়ত দুটি থেকেই স্পষ্ট—থানবি রহ. ছিলেন চূড়ান্ত সতর্ক মানুষ। তিনি তার কর্মে, আচরণে, লেনদেনে এবং সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ স্বচ্ছ এবং নির্মল। অসিয়তগুলোর মাধ্যমে তিনি একটি কথাই তুলে ধরতে চেয়েছেন, মানুষকে সবসময় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। জীবন যাপন করতে হবে পুত পবিত্রভাবে।

থানবি রহ. লিখেছেন, উপরোক্ত হাদিসের অনুসরণে এক হিসেবে অসিয়ত লেখা আবশ্যক। আর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উচিত—আমার বিষয়গুলো আমভাবে জানিয়ে দেওয়া। যেন আমার উপকারের সঙ্গে সঙ্গে অন্যদেরও উপকার হয়।

থানবি রহ.-এর কিছু অসিয়ত তুলে ধরা হলো।

১. আমার বন্ধু এবং শুভাকাঙ্খীদের কাছে আবেদন করছি—আমার সবধরনের গুনাহের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। দোয়া করুন, যেন আমার অন্তর্গত খারাপ গুণগুলো দূর হয়ে যায়।

২. আমার মন্দ স্বভাবের কারণে কাউকে না কাউকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। কারো অধিকার ক্ষুণ্ণ করেছি। হয়তো সে জানেও না। আমি আপনাদের কাছে করজোড়ে মিনতি করছি, আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, তিনি যেন ক্ষমা করে দেন।

৩. ভালোবাসায় অনেকে অতিরিক্ত প্রশংসা করে ফেলে। তাই আমি আমার জীবনচরিত লেখা হোক পছন্দ করিনি। কিন্তু কেউ যদি আমার জীবনী লিখতে প্রবল আগ্রহী হয়, এবং মুহাক্কিক ধর্মীয় ব্যক্তিরা তার অনুমতি দেন, তখন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে জীবনী লিখতে হবে।

৪. আমার রচনায় অনিচ্ছাকৃতভাবে অনেক সময় ভুল হয়ে গেছে। আমার চোখে যা পড়েছে, তা সংশোধন করেছি। যেগুলো ধরা পড়েনি, সেগুলোর ব্যাপারে দুটি কথা। এক—ভুলগুলো সঠিক করে দিবে সর্বশেষ সংস্করণের ভিত্তিতে। আমার কথার সর্বশেষ সংস্করণটাই গ্রহণযোগ্য। দুই—সংশয়পূর্ণ বিষয়টি মুহাক্কিক আলেম থেকে তাহকিক করিয়ে নিবে। তার কথা আমার ওপর প্রধান্য দিবে। আমার লেখা সংশয়পূর্ণ ফতোয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা।

৫. আমার লাইব্রেরিতে সবধরনের বই আছে। অন্য ফেরকার কিছু কিতাব আমার অনিচ্ছাকৃতভাবে জমা করা হয়েছে। তাই আমার লাইব্রেরি থাকলেই বইয়ের বিষয়বস্তু সহিহ, এটা মনে করা যাবে না। শরিয়তের মূলনীতি অনুযায়ী যা সহিহ, তা সহিহ। মূলনীতি অনুযায়ী যা বাতিল, তা বাতিলই।

৬. আমার কোনো ঋণ নেই। সামনে হবেও না ইনশাআল্লাহ। কারো কোনো আমানত৷ আমার কাছে থাকলে বলে কিংবা লিখে জানাতে পারেন। আমি আমার স্ত্রীর মোহরানাও আদায় করে দিয়েছি বাড়ি এবং অন্যান্য জিনিস মিলিয়ে। বাড়িটি এখন তার। এটা সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। ঘরের অধিকাংশ মালামাল তার। যেগুলো দুজনের কিংবা শুধু আমার, সেগুলো আমাদের দুজনের স্মৃতি।

৭. বিশেষ করে শুভাকাঙ্ক্ষীদের এবং সমস্ত মুসলমানদের জোর দিয়ে বলছি, নিজে ইলমে দ্বীন শিখবে এবং সন্তানদের শেখাবে। এটা প্রত্যেকের জন্য ফরজ। চাই সেটা কিতাবের মাধ্যমে হোক কিংবা সোহবতের মাধ্যমে।

৮. তালেবুল ইলমদের বলছি, দরস-তাদরিসের উপর অন্যকিছু যেন প্রবল না হয়ে যায়। আহলুল্লাহদের খেদমত, সোহবতে থেকে পড়াশোনাটা ঠিক রাখবে।

৯. হাদিস থেকে বুঝা যায়, নিজের মৃত্যুর পর স্ত্রীদের জীবিকা নির্বাহের ব্যাপারে চিন্তা করাও সুন্নত। আমি আমার প্রিয় বন্ধুদের বলছি, বিশজন যদি মাসিক এক রুপি করেও দেয়, তাহলে আশা করছি, তাদের কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু মূল তো তাদেরকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে যাচ্ছি। ১৩৩৪ হিজরির রমজানে আমি দ্বিতীয় বিবাহ করেছি। তার জন্যও এই আবেদন থাকবে। অথব প্রথম বিশ রুপির সঙ্গে আরও দশ রুপির ব্যবস্থা করে দুজনকে ১৫ রুপি করে দিয়ে দিবে।

১০. আমার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনকারীদের কাছে আমার আবেদন—প্রতিদিন সূরা ইয়াসিন কিংবা তিনবার সূরা ইখলাস পড়ে আমার জন্য দোয়া করবে। বেদআত কোনো কাজ করবে না।

১১. কখনো আখেরাতের চিন্তা থেকে গাফেল হবে না। মৃত্যুর এমন প্রস্তুতি রাখবে, এখন মৃত্যু এলে যেন পিছুটান না থাকে। আশা রাখবে—যেন খাতেমা বিল খাইর হয়। বিশেষ করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর খাতেমা বিল খাইরের দোয়া করবে।

১২. আমার নতুন বাড়ি এবং নতুন কবরস্থান দুটোই ওয়াকফ রেজিস্ট্রি করা আছে।

এভাবে প্রত্যেকটি বিষয় ধরে ধরে থানবি রহ. অসিয়ত করে গেছেন। খানকায় ব্যবহৃত জিনিসের তালিকা, ঘরের জিনিসপত্রের বিবরণ, ওয়াকফের কাগজপত্র, মৃত্যুর পর আসা চিঠির জবাব দেয়ার পদ্ধতি, আমানতের তালিকা সবকিছুর ব্যবহার ও বন্টন পদ্ধতি তিনি অসিয়তনামায় উল্লেখ করে গেছেন। এই অসিয়তনামা তার নির্মল জীবনের অনন্য দৃষ্টান্ত।

আগের সংবাদহোসনি দালানে বোমা হামলা মামলায় রায় ১৫ মার্চ
পরবর্তি সংবাদমাওলানা থানবির লেখালেখি