ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন:
COVID-19 দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, অবকাঠামো উন্নয়ন, মেঘা প্রকল্প বাস্তবায়ন, আমদানি রপ্তানি, ফরেন রেমিট্যান্স, শিক্ষা, পরিবহন, পর্যটন প্রভৃতি ক্ষেত্রে নির্মম আঘাত হেনে চলেছে। এই বিপর্যয় কত দিন স্থায়ী হয় তা বলার সময় এখনো আসেনি। ক্ষতির ধকল কাটিয়ে উঠতে যে বেশ সময় লাগবে, তা সহজে অনুমেয়। করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষাকার্যক্রম চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আমাদের দেশে ঐতিহ্যগতভাবে মাদরাসা শিক্ষা ত্রিধারায় বিভক্ত-সরকারি আলিয়া, বেসরকারি আলিয়া ও কওমি। বাংলাদেশে সরকারি মাদরাসা রয়েছে তিনটি। ঢাকা আলিয়া, সিলেট আলিয়া ও বগুড়া মুস্তাফাবিয়া। এই তিন মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের ভেতন ভাতা, পেনশন, অবকাঠামো উন্নয়নসহ যাবতীয় ব্যয়ভার রাষ্ট্র বহন করে থাকে।
দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় আলিয়া মাদরাসা রয়েছে ১৯ হাজার ৯৮৫টি এর মধ্যে তিনটি সরকারি এবং বাকিগুলো বেসরকারি। ২০১৫ সালের বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর তথ্য অনুযায়ী, এসব মাদরাসায় দাখিল, আলিম, ফাযিল ও কামিল পর্যায়ে মোট ২৪ লাখ ৯ হাজার ৩৭৩ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। ডয়চেভেলে’র তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে ইবতেদায়ী মাদরাসার সংখ্যা ৬,৮৮২টি, দাখিল মাদরাসা ৯,২২১টি, আলিম মাদরাসা ২,৬৮৮টি৷ ফাযিল মাদরাসা ১,৩০০টি ও কামিল মাদরাসা ১৯৪টি৷ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করেই আলিয়া মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে৷
এসব মাদরাসা এমপিওভুক্ত। বেতন-ভাতা রাষ্ট্র বহন করে। বাড়ীভাড়া ও চিকিৎসাভাতা হিসেবে যা দেয়া হয় তা একেবারে নগণ্য। শিক্ষক-কর্মচারীদের পেনশন সুবিধা নেই তবে অবসর নেয়ার পর ৫/১০ বছর অপেক্ষা করে কল্যাণ তহবিল ও অবসর ভাতা হিসেবে এককালীন নগদ অর্থ পেয়ে থাকেন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় বেসরকারি আলিয়া মাদরাসায় গ্র্যাচুয়েটি ও প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই। যত সংখ্যক শিক্ষক প্রয়োজন ‘জনবল কাঠামো’র কারণে ততসংখ্যক শিক্ষককে এমপিও প্রদান করা হয় না। শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিতে হয়। তাঁদের বেতন-ভাতা মাদরাসা ফান্ড থেকে পরিশোধ করতে হয়। শ্রেণীকক্ষ, অফিস, লাইব্রেরি ভবন, ছাত্রাবাস, অডিটোরিয়াম ও শৌচাগার নির্মাণ, মাদরাসা সম্পসারণের জন্য জমিক্রয়, ঘেরা-বেড়া মেরামত, দৈনন্দিন খরচ, বিশেষ করে বিদ্যুৎ, পানি, অফিসিয়াল সামগ্রী, পাঠাগারের গ্রন্থক্রয়সহ সব খরচ প্রতিষ্ঠানের ফান্ড থেকে নির্বাহ করতে হয়। কিছু কিছু মাদরাসায় ফ্যাসিলিটিজ বিভাগ থেকে দু’একটি ভবন তৈরি করে দেয়া হয়। কিছু মাদরাসা ছাত্রাবাসের স্বল্প সংখ্যক এতিম নিবাসীদের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে কাপিটেশন গ্র্যান্ট পেয়ে থাকেন। এগুলো অনেকটা নির্ভর করে তদবিরের ওপর। এক কথায় এমপিওভুক্ত আলিয়া মাদরাসার পুরো বাজেটের একটি বিরাট অংশ জোগান দিয়ে থাকেন ধর্মপ্রাণ জনগণ। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের সরকারি অংশ, ছাত্রবেতন, বার্ষিক সভা, রামাযানের চাঁদা, কোরবানির পশুর চামড়া, বিত্তশালীদের অনুদান নিয়ে বার্ষিক বাজেট তৈরি করা হয়।
কওমি মাদরাসাগুলো সরকারের পক্ষ থেকে কোনও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বা অনুদান গ্রহণ করে না। এসব মাদরাসা স্থানীয় মুসলমান এবং দ্বীনদরদি পৃষ্ঠপোষকদের অনুদান ও সাহায্য সহযোগিতায় পরিচালিত হয়। প্রায় মাদরাসায় রয়েছে এতিমখানা। সেখানে আর্থিক অনুদান শুধুমাত্র এতিমদের জন্য ব্যয় করার বাধ্যবাধকতা আছে। একেবারে হাতেগোনা কিছু এতিমখানায় ছাত্রদের খাবার হিসেবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় চাল, ডাল, তেল বা নগদ অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে ক্যাপিটেশন গ্র্যান্টের আওতায়। এসব সহায়তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল। এতিমখানায় সহায়তা দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানগুলোর অতীত শিক্ষা কর্মকাণ্ড বিচার বিবেচনা করেন। অধিকাংশ কওমি মাদরাসা ও এতিমখানা সরকারি সহায়তা নিতে ইচ্ছুক নয়।
১৮৬৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এই উপমহাদেশে কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা। এই শিক্ষাব্যবস্থা যুগের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে গড়ে ওঠে, তাও আবার কোনো প্রকার সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই। আর এখন তাঁরা সরকারের স্বীকৃৃতি নিলেও বেতন ভাতা বা অন্য কোনো ধরনের আর্থিক সহযোগিতা নিতে রাজি নন। মাদরাসার জমিক্রয়, বেষ্টনি প্রাচীর তৈরি, ভবন নির্মাণ, কিতাব সংগ্রহ, বিদ্যুৎ, পানি, ছাত্রদের দু’বেলা অথবা তিন বেলা খাবার, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, অফিসিয়াল খরচ মাদরাসা ফান্ড থেকে নির্বাহ করা হয়। সব কওমি মাদরাসায় বার্ষিক মাহফিল হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মাহফিলে সাধারণত চাঁদা তোলা হয় না। তবে স্বেচ্ছায় কেউ কোন দান করতে চাইলে তা গ্রহণের জন্য গেটে অথবা নির্ধারিত স্থানে লোক নিয়োজিত থাকে। কওমি মাদরাসা পরিচালনার অষ্টনীতি (উসুলে হাশতাগানা) এর ভিত্তিতে আল্লাহ তায়ালার ওপর তাওয়াক্কুল ও জনগণের সহায়তায় কওমি মাদরাসা শিক্ষা কার্যক্রম চলে আসছে।
কওমি মাদরাসা মূলত একটি বিশেষায়িত শিক্ষা। তাঁদের টার্গেট কোরান-হাদিসে শিক্ষিত দক্ষ আলিম গড়ে তোলা। প্রথম থেকেই দারসে নিযামীর আলোকে কওমি মাদরাসার ছাত্রদের আরবি নাহু সারফ, আরবি সাহিত্য, তাফসির, উসুলে তাফসির, হাদিস, উসুলে হাদিস, ফারায়েয, আকায়েদ, ফিকহে ইসলামী পড়ানো হয়। যাঁদের আগ্রহ আছে তাঁরা এখানে পড়েন। সিলেবাসে আধুনিক কোন বিষয় নেই। আধুনিক বিষয়ে পড়শোনা করার জন্য তো আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে।
২০১৫ সালের বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদরাসা রয়েছে। এসব মাদরাসায় ছাত্রসংখ্যা ১৪ লাখ। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা আরো বেশি। নূরানি মাদরাসার সংখ্যা এই হিসাবের বাইরে। ৬টি বোর্ডের মাধ্যমে এসব মাদরাসা পরিচালিত হয়ে আসছে। ৬টি বোর্ডকে সমন্বিত করে উচ্চতর একটি প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে, যা ‘হাইয়াতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়াহ’ নামে পরিচিত। এটি সরকারি স্বীকৃত সংস্থা। এটার প্রদত্ত দাওরায়ে হাদিসের সনদ মাস্টার্সের সমমর্যাদা সম্পন্ন। স্বীকৃতি সংক্রান্ত আইনের ২(১) ধারায় কওমি মাদরাসার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে মুসলিম জনসাধারণের আর্থিক সহায়তায় উলামায়ে কেরামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ও ইলমে ওহীর শিক্ষা কেন্দ্রই হল কওমি মাদরাসা।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে জানানো হয় যে, ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পবিত্র রমজান উপলক্ষে দেশের ৬ হাজার ৯৫৯টি কওমি মাদরাসাকে ৮ কোটি ৩১ লাখ ২৫ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। অনুদানের অর্থ ইতোমধ্যে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে মাদরাসাগুলোর কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনুদানপ্রাপ্ত কওমি মাদরাসার মধ্যে রংপুর বিভাগে ৭০৩টি, রাজশাহী বিভাগে ৭০৪টি, খুলনা বিভাগে ১০১১টি, বরিশাল বিভাগে ৪০২টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৯৭টি, ঢাকা বিভাগে ১৭৮০টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৪৮১টি এবং সিলেট বিভাগের ৪৮১টি মাদরাসা রয়েছে। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে এই তালিকা প্রস্তুত করা হয়।
২মে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সিনিয়র সহসভাপতি মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস সাহেবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মজলিসে খাসের এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ‘সরকারি অনুদান গ্রহণ, কওমী মাদরাসার দেড়শত বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং দারুল উলূম দেওবন্দের নীতি আদর্শকে বিসর্জন দেয়া। তাই এধরনের অনুদান গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য সকল কওমি মাদরাসার দায়িত্বশীলদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বেফাক নেতৃবৃন্দ বলেন উপমহাদেশব্যাপী বিস্তৃত কওমী মদরাসাসমূহ ভারতের বিখ্যাত দারুল উলূম দেওবন্দের নীতি-আদর্শ ও শিক্ষাক্রম অনুসরণ করেই পরিচালিত হয়ে আসছে। দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠাকালে অলঙ্ঘনীয় যে মূলনীতি নির্ধারণ করে, তার অন্যতম একটি হলো ‘যে কোনো পরিস্থিতিতে সরকারী অনুদান গ্রহণ থেকে বিরত থাকা’। সুতরাং এই মূলনীতিকে বিসর্জন দিয়ে দেশের কোনো কওমি মাদরাসা সরকারী অনুদান গ্রহণ করতে পারে না। অতীতেও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কঠিন সঙ্কটকালে আমাদের পূর্বসূরিরা অনুদানের জন্য সরকারের দ্বারস্থ হননি (নয়া দিগন্ত, ঢাকা, ০২.০৫.২০২০)।
স্মর্তব্য যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা শহরে আরেক শ্রেণীর প্রাইভেট মাদরাসা আছে যেগুলো প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের। এসব মাদরাসার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। মাদানী বা অন্য বিশেষ নেসাবের অধীন এগুলো পরিচলিত হয়। কওমি ও আলিয়া পাঠ্যক্রমের সমন্বয়ে অনেকে নিজস্ব সিলেবাস তৈরি করে পাঠদান করে থাকেন। এ জাতীয় অধিকাংশ মাদরাসা ভাড়া করা ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। কতিপয় মাদরাসা কর্তৃপক্ষ জনগণের আর্থিক অনুদান গ্রহণ করেন আবার এ জাতীয় অনেক মাদরাসা আছে যারা ছাত্রবেতনের ওপর নির্ভরশীল। জনগণের চাঁদা, যাকাত, সাদাকাহ ও ফিতরা গ্রহণ করেন না।
ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে আহলে হাদিস চিন্তাধারার কিছু মাদরাসা আছে যেগুলো বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। শিক্ষক কর্মচারিদের বেতন-ভাতা ও অবকাঠামো নির্মাণে সরকারি কোন অনুদান নেই। এসব মাদরাসার সিলেবাস তাঁদের স্কলারদের দ্বারা রচিত। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ জনগণের আর্থিক সহায়তা নিয়ে থাকেন। অনেকটা কওমি আদলে এগুলো পরিচালিত হয়।
বহু বছর ধরে স্থানীয় জনগণ কোরবানীর পশুর চামড়া বেসরকারি মাদরাসাগুলোতে দান করে আসছেন। মাদরাসা কর্তৃপক্ষও আবার কিছু চামড়া কিনেন। এসব পশু চামড়া বিক্রি করে মাদরাসার তহবিলে জমা করা হয়। মাদরাসা, এতিমখানা ও হিফযখানার জন্য বড় ধরনের আয়। কিন্তু ২০১৮-২০১৯ সালে নানা কারণে চামড়ার বাজারে ধস নামে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ রফতানি খাত চামড়াশিল্প মুখ থুবড়ে পড়ে। দাম না পেয়ে বিভিন্ন স্থানে মানুষ কুরবানিকৃত পশুর চামড়া রাস্তায় রেখে যায়; ডাস্টবিনে ফেলে দেয় অথবা মাটিতে পুঁতে ফেলে। চামড়াশিল্পে বিপর্যয় নেমে আসার কারণে সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মাদরাসা ও এতিমখানা কর্তৃপক্ষ। চামড়া বিক্রি করলে তা অনাথ, দরিদ্র ও দুস্থদের দান করা শরীয়তের বিধান। এই স্বেচ্ছাদানের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক মাদরাসা, হিফযখানা ও এতিমখানার শিক্ষার্থীগণের খাবার যোগান দেয়া হয়। বিক্রি করতে না পেরে অনেক এতিমখানা চামড়া ভাগাড়ে ফেলে দেয়। এতে মাদরাসাগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে কওমি মাদরাসাগুলোর বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। সাধারণত শা’বান মাসে পরীক্ষা পরিচালিত হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হয়তো ঈদুল ফিতরের পর পরীক্ষার তারিখ পুননির্ধারিত হতে পারে। বেসরকারি মাদরাসাগুলোর আর্থিক সহায়তা লাভের জন্য রামাযানুল মুবারক গুরুত্বপূর্ণ মাস। এই মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ মাদরাসায় অনুদান ও সহায়তা প্রদান করে থাকেন। মাদরাসার বার্ষিক বাজেট এটার ওপর অনেকটা নির্ভর করে। ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ, লকডাউন ও হোম কোয়রান্টাইনের কারণে এ সহায়তা প্রদান করা অথবা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। যারা নিয়মিত দান করতেন তাদের মধ্যে অনেকে কর্মহীনতা ও ব্যবসা বন্ধের কারণে সহায়তা দানে অপারগ হয়েছেন। ইতোমধ্যে বহু মাদরাসা কর্তৃপক্ষ শিক্ষক কর্মচারিদের বেতন ভাতা দিতে পারেননি। যেসব প্রাইভেট বা বেসরকারি মাদরাসা, এতিমখানা ও হেফযখানা ভাড়া করা ভবনে পরিচালিত হয়ে আসছে তাদের অবস্থা বেশ শোচনীয়। এমতাবস্থায় অভিভাবকদের ছাত্রবেতনের জন্য চাপ দেয়াও বেমানান। অনেকে দিচ্ছেন আবার অনেকের পক্ষে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো যায় কি না ভেবে দেখতে হবে। অন লাইনে সব ক্লাশ নেয়া হয়ত সম্ভব হবে না কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্লাশ নেয়া যেতে পারে। কওমি মাদরাসাসমূহে বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। সেক্ষেত্রে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে প্রমোশন দেয়া যেতে পারে। দারুল উলূম দেওবন্দ কর্র্তৃপক্ষ এই পদ্ধতি চালু করেন।
মাদরাসা শিক্ষা আমাদের সমাজের জন্য আল্লাহ তায়ালার রহমত। এই শিক্ষাধারায় বিজ্ঞ আলিম, মুহাদ্দিস, মুফতি, মুনাযির, খতিব, ওয়ায়েয ও পীর মাশায়েখ তৈরি হচ্ছেন যুগযুগ ধরে। ইসলামী শিক্ষা ও কৃষ্টির বিকাশ, সমাজে ধর্মীয় আবহ সৃষ্টি, নৈতিকতার উজ্জীবন ও মানুষকে আখিরাতমুখী করার ক্ষেত্রে মাদরাসা শিক্ষিতদের অবদান ইতিহাসের সোনালী অধ্যায়। মাদক, সন্ত্রাস, সহিংসতা, ইভটিজিং, বেহায়াপনা, যৌতুক, নারী নির্যাতনের মত সামাজিক ব্যাধি দূরীকরণে আলিম ওলামাদের ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবদ্বীপ্ত। মাদরাসা সামাজিক শক্তির কেন্দ্র। সমাজের সদস্যদের সাথে মাদরাসার সম্পর্ক সুনিবিড়।
করোনা পরবর্তী সময়ে সঙ্গত কারণে সব বেসরকারি মাদরাসা কমবেশি একাডেমিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সঙ্কট তৈরি হবে, ধার দেনা বেড়ে যাবে। যে কোনো বৈরী পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মানসিক দৃঢ়তা আলিমদের রয়েছে। তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ, তাকওয়া ও নিশীথ রজনীর চোখের পানির বরকতে আল্লাহ তায়ালা ইলমে নববীর বাগানগুলোকে আবার সজীব করে তুলবেন। ইতিহাসে এমন নজীর ভুরিভুরি। বলশেভিক আন্দোলনের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মসজিদ, মাদরাসা ও খানাকাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। ৭০ বছর পর সমাজতন্ত্রের পতন হলে সেন্ট্রাল এশিয়ায় ইমাম বুখারী রহ. এর মাদরাসাসহ সব মসজিদ-মাদরাসা পূর্ণোদ্যমে পুনরায় চালু হয়ে যায়। আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে।
আমাদের দেশেও করোনা পরবর্তী সঙ্কট ও বিপর্যয়ের ধকল কাটিয়ে উঠতে সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসতে হবে। তাঁরা মাদরাসার প্রতি সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করবেন এবং প্রয়োজন অনুসারে কর্জে হাসানা প্রদান করবেন, এমনটা জনগণ প্রত্যাশা করে। শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের ন্যায় বেতনের দশ শতাংশ কেটে রেখে একটি আপদকালীন তহবিল গঠন করা যেতে পারে। কারণ করোনা, ইবোলা, সার্স অথবা অন্য কোন মারাত্মক ভাইরাস যে কোন সময় মহামারী আকার ধারণ করে মানব সভ্যতাকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলতে পারে। তাদাবির গ্রহণ, সতর্কতা অবলম্বন ও প্রস্তুতি গ্রহণ তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়। মাদরাসা পরিচালনায় পরনির্ভরতা ধীরে ধীরে কমানো যায় কিনা এবং স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করা যায় কিনা ভাবতে হবে। হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী রহ. এটার ওপর জোর দিয়েছেন। যে সব মাদরাসা সরকারি অনুদান নিতে ইচ্ছুক তাদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা অথবা বিনাসুদে কর্জের ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যক। মাদরাসার সব ছাত্র দরিদ্র বা অনাথ নয়; তাদের মধ্যে যারা স্বচ্ছল পরিবারের তাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে মাসিক টিউশন ফি ও খোরাকি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। বহু মাদরাসায় এই নিয়ম চালু আছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হোন।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এম.ই.এস ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম।