আজ আগামী

রহমান মোস্তাফিজ পাভেল:

সোহেল ভাড়া থাকে গাড়ি গ্যারেজের উপরের দোতলা ড্রাইভার রুমটায়। গাড়ি নেই গ্যরেজ খালি। এখন বাড়ির যাবতীয় অকেজো মালামাল রাখার জায়গা নিচতলার এই গ্যারেজ। দোতলার ড্রাইভার রুমটা দেখলে বোঝা যায় এ বাড়ির লোকজন একসময় বেশ বনেদি ছিল। মূল বাড়ি থেকে আলাদা দোতলাটায় একটা বেশ বড় রুম, সাথে বিশাল বারান্দা, বারান্দার সাথে লাগোয়া বাথরুম রান্নাঘর। বাড়ির সাধারণ ড্রাইভারের জন্য এইরকম ব্যাবস্থা চিন্তাই করা যায় না।

এখন এই বাড়ির বনেদি ব্যাপারটা বুড়োবুড়ি বাড়িওয়ালাদের মতই শেষ বেলায় এসে ঠেকেছে। ছেলে মেয়েরা সবাই বিদেশে যে যার মত জীবন তৈরি করে নিয়েছে। আর বুড়োবুড়ি দু’জন এখন কোনভাবে আমোদে আহলাদে জীবনের বাকি রঙ দেখার অভিলাষে এখানেই পড়ে আছে। তিনতলা বাড়িটার একতলায় তারা থাকে বাকি দোতলা আর তিনতলার সাথে ড্রাইভার রুমটা সোহেলকে ভাড়া দিয়ে তাদের জীবন বেশ স্বাচ্ছন্দেই কেটে যাচ্ছে। যদিও সোহেলের বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে তিন মাসের। টিউশনি আর পার্ট টাইম চাকুরি করে ঠিকঠাক মত বাসা ভাড়া দিয়ে বেশ কিছুদিন বাড়িওয়ালার সাথে ভালোই জমিয়েছিলো।

ছাত্রদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়াতে টিউশনিও গেল, আর সাথে ভাড়া নিয়েও কাল পরশু তরশু একের পর এক ভাড়াবিহীন তারিখ দেয়া নেয়ার খেলা শুরু হল। ফুল টাইম চাকুরির চেষ্টা চলছে বহুদিন কিন্তু কোন গতি হচ্ছে না। লোন চেয়েছে কয়েক জায়গায় সবাই মাসের প্রথমে যেতে বলেছে। তার মানে আরো আট দশদিন। এখন চিন্তা এই আট দশদিন কীভাবে বাড়িওয়ালাকে ম্যানেজ করা যায়। ম্যানেজ করার যত রকম পথ খোলা ছিল সব শেষ করে তারপর নিত্য নতুন এক্সপেরিমেন্টাল ও ধানাইপানাই করতে করতে তিন মাস পার করে আজই শেষ সুযোগ চেয়ে নিয়েছিলো।

সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পেরে অনেক রাত করে দেয়াল টপকে বাসায় ফিরতে হয়েছে। কোনরকম রাতটা পার করে বাড়িওয়ালার ঘুম ভাঙার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে যত দ্রুত সম্ভব। এভাবেই টাকা হাতে না আশা পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে। আর বাড়িওয়ালাকে এমন ভাব দেখাতে হবে যে ভয়ানক ব্যস্ততার কারণে দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে না। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘুমাতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাগতে হবে, জেগে উঠে ভাগতে হবে। টেনশনে আবার সোহেলের ঘুম খুব ভালো ও গাঢ় হয়। ভাবতে ভাবতেই ঘুম।
এক ঘুমেই রাত পার করে কখন যে সকাল হয়ে গেছে সে খবরও নেই। বিছানার একপাশে মোবাইলটা বেজে উঠতেই ঘুম জড়ানো চোখে তাকায়, অপরিচিত নম্বর দেখে ভাবে ধরবে কি ধরবে না দ্বিধা দ্বন্দ্বের ভেতর চারদিকে তাকিয়ে দেখে জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে সকালের রোদ ঢুকে পড়েছে। এই সময় ফোন ধরতে গেলেই মনে হয় পাওনাদার বাড়িওয়ালা ফোন করেছে বোধহয়। আবার না ধরলে মনে হয় যদি কোন ইন্টারভিউর সংবাদ অথবা কোন অফিস থেকে চাকরির অফার এসে থাকে। এই ভাবতে ভাবতেই একটু সময় নিয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই বন্ধু বাবরের দরাজ কণ্ঠ ভেসে আসে।
কিরে কী অবস্থা?
সোহেল অবাক হয়ে, আরে তুই এতদিন পর, ফোন নম্বর পাইলি কই?

আরে শালার টুয়েন্টি সেঞ্চুরিতে এসে আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে ঘরের ভেতর বইসা একটা মানুষ বাংলাদেশের গনি মিয়ার মত গরিব চাষির হাড়ির খবর নাড়ির খবর নারীর খবর সব নিয়া ফালাইতাছে। আর তুই কিনা তোর ফোন নম্বর কই পাইলাম এইটা নিয়া অবাক। নাহ তোর ভিসা পাসপোর্ট এই শহর থেকে ক্যান্সেল করা উচিত। শোন একটা জরুরি প্রয়োজনে তোকে ফোন করেছি। তুই এখন কই?
বিছানায় শুয়ে শুয়েই বলে, আমিতো অফিসে। তুই।
আমিও অফিসে।
জরুরি দরকার ছাড়া কি ফোন করা যায় না।
একশো বার করা যায়।

ঠিকাছে বল কী এমন জরুরি বিষয়।
ফোনে জরুরি বিষয়টা বুঝায়া বলা যাবে না সামনা সামনি সাক্ষাতে। তাছাড়া কতদিন দেখা নাই, এই চান্সে আড্ডাও হইল কাজও চলল , পাঁচটায় ফ্রি হইতে পারবি ?
সোহেল বিছানায় শুয়ে শুয়ে এমন ভাবে আড়মোড়া ভাঙ্গে, ফোনের অপর প্রান্ত থেকে মনে হবে, অফিসের গদিওয়ালা চেয়ারে বসে বোধহয় অফিসে কাজের চাপে চাপে, বেচারা চেপ্টা। আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলে, অফিসে যত কাজই থাক তুই যখন বললি তখন কাজ টাজ কোন ব্যাপারই না। শুধু বল কোনখানে কখন আসতে হবে।

তাইলে বিকাল পাঁচটায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আইসা পড়, ওকে। বলে বাবর ফোন রেখে দেয়।
প্রায় তিন বছর পর বাবরের ফোন পেয়ে এখনও বেকার আছে এটা বাবরকে জানাতে ইচ্ছা হল না। বেকার শুনলে সবাই দূরে সরে যায়। সময় সুযোগ মত বাবরকে সত্যটা জানিয়ে দিলে বাবর নিশ্চই মনে কিছু করবে না। কত সুখ দুঃখের সময় বাবর আর সোহেল একসাথে কাটিয়েছে। শাহাবাগ, টি এস সি, ইউনিভার্সিটি হল, হলের অলিগলি, কত রাত দিন কত স্বপ্ন, তারপর কত নিশ্চিত অনিশ্চিত দু’জনের জীবন যাপন।

অনার্স পড়তে এসে বাবরের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। টুকটাক কবিতা লেখার সুত্রে শাহাবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আজীজ মার্কেট, টি.এস.সি. সহ আশ-পাশের এলাকার সাথে প্রেম জমে গেল। সেই প্রেমে লেখাপড়ায়ও দুই বছর গ্যাপ গেলো। এতে করে বাড়ির সাথেও মন কষাকষি চলল কিছুদিন। টাকা আসা বন্ধ হয়ে গেলো, খেয়ে না খেয়ে থাকার জায়গা না পেয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনেক দিন রাত কেটেছে। এতে করে টিকতে না পেরে আবার ঘরের ছেলে ঘরে গিয়ে আবার ছয় মাসের মধ্যে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেছে, পাশ করে এখন চাকুরী খুঁজে বেড়াচ্ছে বেশ কিছুদিন।

বন্ধু বাবর কিন্তু এ শহরেরই ছেলে। বাসাবো এলাকায় নিজেদের বাড়ি। নিজে কিন্তু ঠিকানাহীন জীবন যাপন। এই আছে এই নেই। বিচিত্র এক চরিত্র। জগতের কোন বিষয়ের উপরই সে হতাশ না। জগতকে ঝানু অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে দেখে। বাবর নিশ্চই অনেক ভালো চাকুরি করে। অনেক ভালো চাকুরি মানে অনেক ভালো বেতন। বাবরের কাছে চাইলে বাবর নিশ্চই না করবে না। একবার টিউশন ফি দিতে না পারায় পরীক্ষা দেওয়া যখন প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। তখন বাবর ঠিকই ওদের বাসাবোর বাসায় গিয়ে ওদের এক ভাড়াটিয়ার কাছে ভীষণ বিপদের কথা বলে মাসের ভাড়া অগ্রিম নিয়ে ম্যানেজ করে দিয়ে সে যাত্রায় সোহেলকে রক্ষা করেছিলো। পরে অবশ্য এর মাসুলস্বরূপ বাবরের বাবা বাবরকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল।

বাবরও নিশ্চিন্তে ঘর থেকে বেরিয়ে পার্কে, বন্ধুদের বাসায় বেশ আরামেই দিনাতিপাত করছিল। এরপর একদিন বাবরের বাবা বাবরকে ধরে নিয়ে কয়েকদিন গৃহবন্দি অবস্থায় রেখে দিয়েছিল। বাবর এমনি যে কোন ঝামেলাকেই খুব সহজভাবে নেয়। ঝামেলার বিষয়গুলোকে খুব একটা গুরুত্বের সাথে আমলে নেয় না। বাবরকে বলবে, ওকে যেন কিছু টাকা খুব জরুরি ভিত্তিতে ধার দেয়। তারপর চান্সমত নিজের বর্তমান অবস্থাটা জানাতে হবে যেন ছোট খাট যে কোন একটা চাকরিও ম্যানেজ করে দেয়। সকাল সকাল সেইসব দিনের স্মৃতি ফিরে আসাতে তারপর বহুদিন পর বাবরের সাথে সাক্ষাৎ হবে, বাবরকে চাকরির কথা বলতে পারবে, বাবরকে সব বলা যায়। ভাবতে ভাবতেই মনের মধ্যে আরাম ভাব এসে যায়। সব বলে কয়ে এই দুরাবস্থা থেকে একটা ব্যবস্থা নিশ্চই তৈরি করে নেয়া যাবে।

এইসব ভেবে ভেবে শরীর মন বেশ চাঙ্গা অনুভব করতেই দেখে বাড়িওয়ালা তার রুমে ঢুকছে। কালরাতে ভুলে দরজা লাগানো হয়নি। দরজা লাগানো থাকলে, দরজার মাঝ বরাবর আইবল সাইজের যে ফুটা আছে, সেই ফুটায় চোখ সাইজের যে গ্লাস লাগানো সেটা দিয়ে দেখে একটা কিছু তৎক্ষণাৎ ভাবা যেত। হয়নি যখন তখন কী আর করা। সেই ভুলের মাসুল এখন একেবারে মুখোমুখি, এতোটা মুখোমুখি যে পালাবার কোন পথ নাই। সুতরাং তাৎক্ষণিক একটা কিছু বলে, শুধু এই মুহূর্তে বাড়িওয়ালাকে ট্যাকেল করতে হবে। পরেরটা পরে বোঝা যাবে। এই চিন্তা থেকেই সোহেল বাড়িওয়ালাকে আড় চোখে দেখে নিয়ে বিছানা থেকে এমনভাবে লাফিয়ে উঠে সালাম দেয় যেন এইমাত্র দেখতে পেল, সালাম বিনিময়ের পর বাড়িওয়ালা জিজ্ঞাসা করে,
বাবাজি কি খুব ব্যাস্ত নাকি, ইদানীং দেখি ফিরতে অনেক রাত হয়।

সোহেল যেন বাড়িওয়ালার এমন প্রশ্নের জন্যই অপেক্ষা করছিলো তাই কথা শেষ করতে না দিয়েই খুব গুরুত্বের সাথে বলে, আর বইলেন না, চাকুরি মানেই তো চাকরগিরি, এই চাকরগিরির চাপে রাতদিন কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে আজকাল। কথা বলতে বলতে বাড়িওয়ালার তীব্র চাহনিকে উপেক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে বিছানাসহ অন্যান্য জিনিস গোছগাছ করতে করতে বলতে থাকে। কোন ফাঁকে যে সূর্য ওঠে আর কোন ফাঁকে যে সূর্য ডোবে বুঝি না। সূর্য উঠার সময় হলে মনে হয় ডুবছে আর ডুবার সময় হলে মনে হয় উঠছে। ফলে কোনটা যে সকাল আর কোনটা যে সন্ধ্যা মাঝে মাঝে ধাঁধাঁয় পড়ে যাই, বুঝলেন আংকেল।

আজ লান্সের পর মিটিং তাই অফিসে একটু লেইট করতে গিয়ে বেশী লেইট করে ফেললাম, একদিন আসেননা আমার অফিসে।
বাড়িওয়ালা তার হাতে একটা হাতে লেখা কার্ড সোহেলের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে,
এইটাইতো তোমার অফিসের ঠিকানা তাইনা ?
সোহেল কার্ডটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে না এইটা কোন অফিসের কার্ড। কবে যে ধরিয়ে দিয়েছিল, তবুও ভালো করে দেখে বলে, হ্যাঁ এটাইতো, এইযে নিচেইতো ঠিকানা লেখা আছে, বলে পাশের চেয়ার টেনে বলে, দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন না আংকেল!

বাড়িওয়ালা বসে না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই থাকে, সোহেল মিষ্টি হেসে বলে,
চা দেই আঙ্কেল? একেবারে অরিজিন্যাল পাতা, বাগান থেকে উঠিয়ে ভালো করে শুকিয়ে উইদাউট মেডিসিন একেবারে ঝরঝরা অবস্থায়ই চা পাতাটারে প্যাক করে কুরিয়ার করে পাঠিয়েছে। চুমুক দিলেই পাতার অরিজিনাল ঘ্রাণ নাকে এসে ঠেকে, আর তাতেই অর্ধভোজন আর মুখে দিলেন তো বাকি অর্ধভোজন ব্যস অর্ধেক অর্ধেকে পুরা এককাপের ফুল স্বাদ।
এত কিছু বলার পরও বাড়িওয়ালার চেহারায় কঠিন ভাবটার কোন চেইঞ্জ নেই দেখে সোহেল কিছুটা ঘাবড়ে যায়। বাড়িওয়ালা ওসব কথার ভ্রুক্ষেপ না করে হাতে লেখা কার্ডটা দেখিয়ে বলতে থাকে, এই ঠিকানায় কাল গিয়েছিলাম। তোমাকে পেলাম না। জানতে চাইলাম তুমি কোথায়। ওখানে কেউ তোমাকে চিনতেই পারলো না।
সোহেল চোখে মুখে কৃত্রিম বিস্ময় এনে, বলেন কী, চিনতে পারেনি ! সাথে সাথেই আমাকে ফোন করতেন।
করেছিলাম, তুমি ধরনি।
ওহ্! সরি আঙ্কেল হয়তো ব্যাস্ত ছিলাম। ইডিয়েটগুলো অবশ্য ইচ্ছা করে, আবার মজা করেও না চেনার ভান করতে পারে,
কেনো। আজকালকার জেনারেশন বড় বেয়াদব । ময়মুরুব্বি বড়ছোট এইসব সম্মান করে চলে না। যার তার সাথে মজা করা শুরু করে, হুট হাট করে দেখবেন সিগারেট বের করে বলে বসবে লাইটার হবে। বাপের বয়সি একজনের সামনে সিগারেট বের করা যে কত বড় অন্যায় সেই ন্যায় অন্যায়বোধতো নেইই, উল্টা আরো লাইটার চেয়ে অপমান করে বসবে। তারপর লাইটার পেলে সিগারেটটা ধরিয়ে আপনার সামনেই ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে আধুনিকতার বয়ান ছাড়বে। কীভাবে বাবা বিদেশ থেকে এসে ছেলের সাথে মদ খেতে খেতে তারপর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাপ বেটা দুই ভাই হয়ে যাচ্ছে, নেশাটা আরো জমে উঠলে বাপ বেটা দুইবন্ধু ইয়ার দোস্ত হয়ে যাচ্ছে, ব্যস তারপর ইয়ার দোস্ত হয়ে গেলে যা হয় আরকি।

যত্তোসব ইডিয়েটের দল। এই জন্যই এই চাকুরিটা ছেড়ে দিচ্ছি। নো প্রবলেম সামনের মাস থেকে আরো হাইজেনিক একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করছি। ওখানে বড়দের যেমন সম্মানের চোখে দেখে তেমনি ছোটদেরও স্নেহ করে চলে সবাই। আর গেষ্ট মানে অতিথি! অতিথি মানে সৌভাগ্য। তাই অতিথিকে এরা ব্যবসায়ের ইনভেস্ট মনে করে। অতিথি আপ্যায়নে কোনরকম অসম্মান এখানে কেউ বরদাস্ত করে না। সো নো ফোন কল একদম সরাসরি চলে আসবেন, ফোন করতে হবে না। অল টাইম সিটিং জব নো দৌড়াদৌড়ি। যতক্ষণ ইচ্ছা থাকবেন চা কফি কোল্ডড্রিংকস যা ইচ্ছা খাবেন, আড্ডা দিবেন, এরপর দুজনে একসাথে লাঞ্চ করবো। আপনার জন্য আলাদা একটা আরাম চেয়ারের ব্যবস্থা থাকবে, লাঞ্চ শেষে আরাম চেয়ারে বসে আরাম করবেন যতক্ষণ খুশি। নো বডি ডিস্টার্ব।

বাড়িওয়ালা হেসে ফেলে, তোমার কথা শুনতে তোমার আন্টির খুব ভালো লাগে, তাই মাঝে মাঝে আমাকে বলে, সব সময় যেন তোমার খোজ খবর নেই, কিন্তু তোমার আন্টিতো জানে না তুমি কত ব্যস্ত। তার উপর এখন আবার নতুন চাকুরিতে তার মানে আরো ব্যস্ত। যাক এই বয়সে ব্যস্ততাই থাকা উচিত। তবে শুধু ব্যস্ত হলেই হবে না সেই অনুযায়ি বেতন কেমন কত তারিখে দিবে সব ঠিক ঠাক করে নিও, তা না হইলে অন্য বাড়িওয়ালারা নাও মানতে পারে।
অন্য বাড়িওয়ালা মানে। সোহেল একটু ঘাবড়ে যায়।

বাড়িওয়ালা তার নিজের কণ্ঠে কিছুটা কঠোরতা এনে বলে, আগামী দুইদিনের মধ্যে যদি ভাড়া দিতে না পারো তাহলে টু-লেট ঝুলাবো, পরে এসে তিন মাসের ভাড়া দিয়ে মালপত্র নিয়ে যাবে।
সোহেল মাথা নিচু করে অপরাধীর ভঙ্গিতে বলে, আঙ্কেল আর কয়টা দিন জাস্ট।
বাড়িওয়ালা ততক্ষণে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে, বের হওয়ার সময় চাবিটা দিয়ে যাবে। আর তোমার আন্টি তোমার জন্য নাস্তা তৈরি করে, অপেক্ষা করছে অবশ্যই খেয়ে যাবে। কষ্ট করে বানিয়েছে না খেলে মনে কষ্ট পাবে। বলে সোহেলকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায়। সকাল সকাল বাড়িওয়ালার ঠান্ডা মাথার কড়া কথায় সোহেলের এত সুন্দর প্ল্যান করা সকালটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

বাবরের ফোনে চাকুরি, বাড়িভাড়া সব একসাথে ম্যানেজ হয়ে যাওয়ার যে সুন্দর একটা আসা তৈরি হয়েছে, এত সহজে সেটা নষ্ট হতে দেয়া যায় না। ভাবতে ভাবতেই ঘরের যাবতীয় কাপড় চোপড় নিয়ে সোহেল বাথরুমে ঢোকে। কাপড় কাচলে মনের জ্বালা ক্ষোভ হতাশা অনেকটা মিটে যায়। বাবা মায়ের সুখের সংসারে মাঝে মধ্যে খিটি-মিটি লেগে গেলে মা অনেক কাপড় কাচতেন। সোহেলরা তিন ভাইবোন অবাক হয়ে মায়ের সেই কাপড় কাচা দেখতেন। মায়ের এত কাপড় কষ্ট করে কাচতে দেখে, আপা মাকে সাহায্য করতে গেলে, মা আরো ক্ষেপে যেতেন। ক্ষেপে গিয়ে আনমনে গনগন করে কীসব কথা বলতেন সেটা মা ছাড়া আর কেউ কোনদিন শোনেওনি বোঝেওনি। সোহেল আর জুয়েল দুই ভাই বহুদিন মায়ের খুব কাছাকাছি ঘেঁসে শুনতে চেষ্টা করেছে, পারেনি।

তারপর ওদের একতলার ছাদে কাপড় শুকাতে দিয়ে মা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন কিছুক্ষণ। তারপর ঘরে ফিরে যাকে দেখতেন তাকেই বলতেন, যা দেইখা আয়, আইজকার আকাশটা মাশা-ল্লা কী নীল। সোহেলের হঠাৎ মনে হল মা কী এখনও আকাশে তাকিয়ে নীল দেখতে পায়? চোখে পুরু চশমা, কয়েকদিন আগে বাবার কাছে শুনেছে মায়ের চোখে ছানি পড়ে যাচ্ছে। অপারেশন করতে হবে। আগেভাগে জানিয়ে দিয়েছে অপারেশন করতে ঢাকায় এসে সোহেলের বাসায় উঠবে। বড় ভাই জুয়েলকে ফোনে ব্যাপারটা জানিয়েছিল। জুয়েল এখন পোল্যান্ডে। চেষ্টা করছে ইংল্যান্ডে ঢোকার। ভাইয়াটা খুব ট্যালেন্ট ছিল। লেখাপড়া খেলাধুলা এমনকি আয় রোজগারের ব্যাপারেও বেশ দক্ষ ছিল। কয়েক বন্ধু মিলে ছাত্রাবস্থায় কাঠের ব্যবসায় হাত দিয়ে বেশ জমিয়ে ফেলেছিল। হঠাৎ করেই বন্ধুদের সাথে কী হল রাগে দুঃখে একাউন্টিং এ মাস্টার্স কমপ্লিট না করে ব্যবসাপাতি ফেলে রেখে ইউরোপ যাবে বলে ঠিক করলো।

বাবা মা বাধা দিলেন। অভিমানি মন আর মানলো না কিছুই। এদেশে থাকলে বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে যাবে। বন্ধুদের নাম শুনলেই চোখমুখে এমন ভাব করতো যেনো বন্ধু মানেই বিষাক্ত কিছু। এর কিছুদিন পরে দুলাভাইর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভাইয়া ঠিকই রুমানিয়া পাড়ি দিলেন। এরপর ভাগ্য অন্বেষণে একে একে পাড়ি দিলেন হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়া, জার্মান হয়ে এখন পোল্যান্ড। কোথায় কী করছে কাউকেই ঠিকমত কিছু বলে না। হঠাৎ হঠাৎ উধাও কোথাও কোন খোঁজ নেই। তারপর একদিন দেখা গেল বাবা মায়ের কাছে বেশ কিছু টাকা পাঠালো। ঘনঘন ফোনও চলল, মাকে আসবো আসছি বলে সান্ত্বনা দিয়ে আবার ফোন কল যোগাযোগ সব বন্ধ করে লাপাত্তা।

সোহেল জানে ভাইয়ার হাত এখন খুব খালি। যদিও চাবো চাবো বলে কখনো টাকা পয়সা চায়নি। ভাইয়া তার কাছে ফোন করে পুরা পরিবারের পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর নেয়, কিন্তু সোহেলের খবর কখনও নেয় না। তাই নিজে যেতে সোহেলও কখনও বলে না। সোহেলের বোন আর দুলা ভাই দুজনই খুব রসিক মানুষ, সন্তান সন্ততি নেই। বিয়ে হয়েছে এগারো বছর। দুলাভাই সরকারি কলেজের একাউন্টিংয়ের টিচার। ছাত্রদের সাথে তার সম্পর্ক খুবই মধুর। কেউ ক্লাসে কিছু বুঝতে না পারলে কিংবা ক্লাসে বুঝানোর সময় না পেলে ঘরে গিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে আসার প্রচুর উদাহরণ তিনি তৈরি করে রেখেছেন। সবার ধারণা সন্তান না থাকায় তিনি সবাইকে সন্তানের চোখে দেখেন। এই কথা তার কানে আসলে তিনি হেসে হেসে বলেন, তাহলেতো টিচারদের সন্তান না থাকাটা ছাত্রদের জন্য খুবই জরুরি।

এরপর থেকে টিচার নিয়োগ দিলে নিঃসন্তান আবশ্যক লেখা বাধ্যতামূলক। সোহেল শুনেছে তার আপা ইদানীং পান খাওয়া শুরু করেছেন, এ ব্যাপারে আপার বদ্ধমূল ধারণা পান খেলে মুখে রস আসে। সেই রস থেকে রসালো কথা বের হয়। এই জন্য পান খাওয়া লোকজন খুব রসিক হয়। আর রসিক লোকজন সহসা হতাশ হন না। তাই আপা ইদানীং মা-বাবা কে পান খাওয়ার ব্যাপারে বেশ উপদেশ দিচ্ছেন। কারণ মা-বাবা রসকষহীন খুব গম্ভীর প্রকৃতির হয়ে যাচ্ছেন। সোহেল নিশ্চিত তার মা-বাবা অচিরেই হয়ত পান খাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। কারণ আপা খুব প্রভাব বিস্তারকারী মহিলা। চাইলেই আপা দুলাভাই কিংবা মায়ের কাছ থেকে টাকা নেয়া যায়। কিন্তু ঢাকার মত বিশাল রাজধানী শহরে থেকে টাকা না পাঠিয়ে টাকা নেওয়াটা মান সম্মানের ব্যাপার। ঢাকা থেকে সবাই শুধু টাকা নেবে। ঢাকার শহর টাকার শহর। সুতরাং বাড়িওয়ালার কাছে মান সম্মান থাকা না থাকায় কিছুই যায় আসে না। এখানে তাকে কেউ তেমন আপন করে চেনে না।

ফুটপাতের পাশের হোটেলগুলিতে তেলেভাজা পরোটা জমে উঠেছে। তন্দুর রুটিও চলছে ধুন্ধুমার। শাটা শাট বাকরখানি তৈরি হচ্ছে। গ্লাস টু গ্লাস কবিরাজি শরবত বানানোর সাথে সাথেই হাতে হাতে চলে যাচ্ছে। অনেকগুলো চায়ের কাপে চায়ের লিকার ঢালা হচ্ছে তারপর চিনি মিশিয়ে চামচ দিয়ে নাড়া হচ্ছে টুনটুন করে। চানখারপুলের এইরকম একটা পরিবেশের হোটেলে নাস্তার পর চায়ে লিকার কড়া করে চিনি বেশি দিয়ে কয়েক চুমুকে চা টা শেষ করে বাবর হাঁটতে হাঁটতে কার্জন হল পার হয়। কার্জন হল ক্যাম্পাসের ছাত্র-ছাত্রীদের কোলাহল মুখর পরিবেশটা আড্ডায় আড্ডায় দারুণ জমে উঠেছে। আহ্ ছাত্রজীবন কী আনন্দ! কী দারুণ! কী মায়াবী সময়। বাবরের পকেটের অবস্থা ভয়াবহ। সোহেলের সাথে ফোনে কথা বলার পর বাবরের মনে বেশ আরামবোধ হল। মাসের বাকি দিনগুলো সোহেলের কাছ থেকে লোন করে চালিয়ে দেয়া যাবে। সোহেল যেহেতু চাকুরি করছে সুতরাং পকেটের অবস্থাও নিশ্চই ভাল। ভাবতে ভাবতে বাবর দোয়েল চত্বর হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দিয়ে কোণাকুণি হেঁটে এসে ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের সামনে গেট দিয়ে বের হয়ে বিশাল খালি জায়গাটায় এসে দাঁড়ায়। জায়গাটা বিশাল হওয়ার কারণ, এখানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট, ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের গেট, ফুটওভার ব্রিজের সিঁড়ি, গাড়ি পার্কিং, একইসাথে আবার ফুটপাতও।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় সকালের নরম রোদ থেকে চপচপে রোদ পর্যন্ত কাজমুখি মানুষের ঢল থাকে। গাড়িগুলি হর্ন বাজিয়ে প্রথমে এমন দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে যেন রেসে নেমেছে, এই রেসে প্রথম প্রাইজটা নিশ্চিত। তারপর যখন একবার ট্রাফিক সিগন্যালে থামে, জ্যামে দাঁড়ায়, তারপর আর তার গতি থাকে না। থেমে থেমে চলে, চলে না করতে করতে আগায়। বাবর কিছুক্ষণ পায়চারি করতে করতে ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের গেটের পাশে বুক সমান দেয়ালের উপর দিয়ে ভেতরের পাকা রাস্তাটায় খুব মনোযোগের সাথে লোকজনের আসা যাওয়া লক্ষ্য করছে। দেখলেই বোঝা যাবে কিছু যেন খুঁজছে। ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের ভেতরের রাস্তা দিয়ে পরিপাটি বেশভূষার সমবয়সি এক যুবককে বের হওয়ার গেটের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে; বাবর নিজের মাথার চুল ও শার্ট ঠিক করতে করতে তার দিকে এগিয়ে যায়। ছেলেটির কাছাকাছি গিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
ভাই কি ইন্টারভিউ দিয়া আসলেন?
যুবকটি বাবরের আচমকা প্রশ্নে ভড়কে গিয়ে বলে, আপনি কি আমাকে কিছু বললেন?
বাবর সহজ সরলভাবে হাসি হাসি মুখে আবার একই প্রশ্ন করে। আপনি কি ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরছেন?
যুবকটির সহজ উত্তর, জ্বী
বাবর ছেলেটির সাথে হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটিকে শুনিয়ে নিজে নিজেই বলে, হ একদম যা ভাবছি। বলে হেসে যুবকের আরো ঘনিষ্ট হয়ে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা ভাই ইন্টারভিউতে কী কী জিজ্ঞাসা করল।
যুবক যেন কিছুটা অবাক ও বিরক্ত হয়ে জানতে চায়, মানে?
বাবর সরল হেসে বলে, না মানে, বলতে যদি আপনার কোন আপত্তি থাকে, তাইলে থাক।
যুবক এই বার কিছুটা সহজ হয়ে বলতে থাকে, জিজ্ঞাসা করলো- নাম কি? বাড়ি কোথায়? অভিজ্ঞতা আছে কিনা এইসব।
বাবর খুবই আনন্দিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
আছে?
কী, অভিজ্ঞতা?
না নাই।
আমার আছে। ছেলেটি বাবরের দিকে তাকাতেই বাবর হাসি মুখে গর্বের সাথে বলে, তইলে মনে হয় চাকুরিটা আমার হইয়া যাওয়ার একটা চান্স আছে, তাইনা ভাই?
ছেলেটা বাবরের কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে,
চাকুরিটা আপনার হয়ে যাবে মানে?
মানে আমারো ইন্টারভিউ আছেতো। আর আমার যেহেতু অভিজ্ঞতা আছে তাইলে মনে হয় আমার চাকুরিটা এইবার হয়া যাওনের পুরো চান্স আছে।
হ্যাঁ তাহলেতো হতেও পারে।
আচ্ছা ভাই আর কী কী জিজ্ঞাসা করল।
এই ঢাকার বাইরে যেতে আপত্তি আছে কিনা।
নাই নাই কোন আপত্তি নাই, চাকুরির জন্য ঢাকার বাইরে শুধু না এই দেশের বাইরে মহাদেশের বাইরে এমনকি চান্দের দেশে যাইতেও আমার আপত্তি নাই।
আপনার আছে?
কি?
ঢাকার বাইরে যাইতে আপত্তি।
না আমারও নাই।
বাবর খুশি হয়ে যুবকের সাথে বন্ধুত্বসুলভ হাসি হেসে হাতে হাত মিলিয়ে বলে, তাইলে তো আমার সাথে আপনারও হয়ে যাওয়ার একটা চান্স আছে।
যুবক একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, একসময় আপনার মত আমারও তাই মনে হত, হয়ে যাবে এইবার ঠিক ঠিক চাকুরিটা হয়ে যাবে।
বাবর হেসে বলে, এখন আর মনে হয় না, তাই না?
এক্সাটলি। না হতে হতে আত্মবিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলেছি ।
বলতে বলতে গেট দিয়ে বেরিয়ে ফুটওভার ব্রিজের সিঁড়ির কাছে একটা চা স্টলের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাবর বলতে থাকে, বলেন কী এতো সহজে আত্মবিশ্বাস হারালে কি চলে। ”ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি” পড়েন নাই
না, বিদেশি লেখকের বই খুব একটা পড়া হয় না, তারপর বাবরকে বলে, চা খাবেন?
আপনি যদি খান তাইলে আপনার সাথে এক কাপ খেতে পারি। যুবকটি চায়ের অর্ডার দেয়।
বাবর খুব আগ্রহের সাথে বলতে থাকে, নায়ক খুব বুড়ো।

ছেলেটি বাবরের কথা শুনে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে, নায়ক? কোন নায়ক?
ঐ যে বললাম না, ওল্ড ম্যান এন্ড দ্যা সি। ঐ গল্পের নায়ক বুড়ো, নাম সান্তিয়াগো, মাছ ধরা পেশা, নেশা দুইটাই, জাত জেলে বলতে পারেন, হঠাৎ কইরা কী হইল আশি বিরাশি দিন পার হইয়া গেলো একটা মাছও ধরতে পারলো না। চিন্তা করতে পারেন একটা জাত জেলে, বুঝছেন তো মানে মাছেরা জাগো জালে লাফায়া লাফায়া ওঠে, জাগো বড়শি পানিতে ফালাইতে দেরি মাছ উঠতে দেরি নাই। সেইরকম একটা জেলে যদি বিরাশি দিনেও একটা মাছও ধরতে না পারে তইলে চলে কেমনে।
যুবক চা নিতে নিতে একটু অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলে, বলেন কি বিরাশি দিনেও একটা মাছও ধরতে পারে নাই। বলে আগ্রহ নিয়ে শুনতে থাকে।
বাবর উৎসাহ নিয়ে বলতে থাকে, হ! এইজন্য জেলে পাড়ার সবাই তারে কুফা অকর্মা বুইড়া ভাইবা তার কাছ থিকা দূরে শইরা গেল, মনের দুঃখে বৃদ্ধ শান্তিয়াগো একা বহুদূর নির্জন সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলো, একা একা খায়া না খায়া মহা-সমুদ্রে এত বড় একটা মাছ ধরলো যা কিনা ওর নৌকায়ই জায়গা হয় না, ঐ এলাকার জেলেরা এত বড় মাছ ধরাতো দূরের কথা, কোনদিন চোখেও দেখে নাই, এমনকি কল্পনাও করতে পারে নাই।

বলে বাবর চায়ে ঘন ঘন চুমুক দিতে দিতে বলে, চিন্তা করতে পারেন বুইড়া হালায় বিশাল সমুদ্রে একলা একা যেই মাছটা ধরছিল সেই মাছটা কত বড় আছিলো?
যুবক অবাক হয়ে যায়, তাই নাকি। ইন্টারেস্টিং। পড়তে হবেতো বইটা। কি নাম বললেন বইটার।
বাবর চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, ওল্ডম্যান এন্ড দ্য সি, পড়লে অবশ্য আপনি হতাশও হইতে পারেন।
যুবক অবাক হয়ে এতবড় একটা মাছ ধরার মধ্যে তো মহাআনন্দ, হতাশার কী আছে?
আছে আছে। যত বড় আনন্দ তত বড় হতাশা। বইটা পড়ার মধ্যে হতাশাও আছে কিন্তু আমি যা বললাম সেটার মধ্যে হতাশা বাদ। পুরোটাই আশা। বিশাল সমুদ্র, একা একটা বুড়ো, বিশাল বুকের পাটা নিয়া হাঙ্গরের দল, বাতাসের কাপন, ঢেউ, স্রোত, ক্ষিধা তৃষ্ণার মধ্য দিয়া বিশাল একটা মাছ একা ধরতে পারা ভাবতে পারেন? তাই কই আশা হারাইবেন না।
ঠিকই বলেছেন। বলে যুবক গুরুত্বের সাথে কথাগুলো মেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, আপনার ইন্টারভিউ কয়টায়?
আমার ইন্টারভিউ আজ না কাল।
তাহলে আজ আসলেন যে।
বাবর চা শেষ করে কাপটা রাখতে রাখতে বলে, ইন্টারভিউতে কী কী জিগাইতে পারে তার একটা প্রস্তুতি নিতে, আর তাছাড়া এই মুহূর্তে কোন কাজও নাই তাই।
কথার মধ্যেই বাবরের ফোন বাজতে থাকে, বাবর লক্ষ্য করছে না, ভেবে যুবকটি বাবরের উদ্দেশ্যে বলে, আপনার ফোন বাজছে।
বাবর তাচ্ছিল্যের সাথে বলে, বাজুক, বাজতে বাজতে একসময় ক্লান্ত হয়ে থেমে যাবে।
যুবক একটু সিরিয়াস হয়ে চায়ের বিল মিটাতে মিটাতে বলে, জরুরিও তো হতে পারে ।
জরুরি ফোন কলের আওয়াজ এতো কর্কশ, বিশ্রী, হয় না। জরুরি ফোন কলে দেখবেন একটা সফট ব্যাপার থাকে, পাখির পালকের মতো, নরম আওয়াজে আস্তে আস্তে মিহি সুরে রিংটোন বাজে। রিসিভ করলেই মনের মধ্যে একটা আনন্দের ঢেউ লাগে।
বাবরের বলার ভঙ্গিতে ছেলেটা বেশ মজা পায়, হাসে।

বাবর ছেলেটাকে হাসতে দেখে বলতে থাকে, কি আমার কথা বিশ্বাস হইল না, না? এই দেখেন, বলে পকেট থেকে ফোনটা বের করে বাবর ছেলেটাকে দেখায়। রিং বাজতে বাজতে কেটে গেলেই, বাবর ফোনটা বন্ধ করে দিয়ে বলতে থাকে,
আঠারো নম্বর পাওনাদারের ফোন, একটু পর পর বাজতেই থাকে। বড়ই অধৈর্য। ইন্টারভিউ একটার পর একটা দিয়া যাইতাছি, এই নিয়া সাতাইশ নম্বর ইন্টারভিউ রানিং, লটারির টিকেট আছে ছয়টা। কোন একটা মিলা গেলেইতো একটানে সব শোধ। এত অস্থির হওয়ার কি আছে, বেকার মানুষ ধারদেনা না করলে চলি কেমনে কনতো।

তারপর দূরে আরেকজনকে ইন্টারভিউ দিয়ে আসতে দেখে এগিয়ে যেতে যেতে বলে, ঐ যে আরেকজনের শেষ হয়েছে। আমি তাহলে এখন যাই দেখি ওনারে কী কী জিজ্ঞাসা করল। আবার হয়তো ঘুরতে ঘুরতে আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে, আসি। বলে দূরের ইন্টারভিউ দিয়ে আসা ছেলেটির দিকে চলে যেতে থাকে। বাবরের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে যুবকের বাবরকে ভালো লেগে যায়। তাই বাবরের উদ্দেশ্যে আনন্দের সাথে জোরে জোরে বলতে থাকে, আর চাকুরিটা হয়ে গেলে কিন্তু পার্কে চা খেতে খেতে প্রায়ই আড্ডা দিবো। বাবর দূর থেকে হেঁটে যেতে যেতে পেছন ফিরে ছেলেটার কথার জবাবে বলতে থাকে, আপনার কথা সত্য হলে প্রতিদিন চায়ের বিল কিন্তু আমি দিব।

যুবক হাত নেড়ে হেঁসে, ঠিকাছে, বলে চলে যেতে থাকে। বহুদিন একসাথে থেকেও মানুষ মানুষের কাছের হয় না, আবার কিছু সময়েই একজনের প্রতি আরেকজন টান অনুভব করে। বাবরের জন্য যুবকের সেরকমের একটা টান তৈরি হয়েছে। যদিও দুরত্ব এই টানকে আবার হাওয়ায় মিলিয়ে দেবে একসময়। মানব মনের এই বিচিত্র বৈচিত্রময় ভালোলাগার কারণেই মানুষ মানুষের কাছে সুন্দর হয়ে ওঠে।

বিকালের নরম রোদে সোহেল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট দিয়ে ঢুকে একের পর এক ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু রিং হলেও বাবর ধরছে না দেখে বেশ বিরক্ত। একবার ভাবছিলো চলে যাবে কিন্তু আবার ভাবলো এতদিন পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে ভেতরে একটা চক্কর না দিয়েই চলে যাবে। তার উপর বায়োডাটা সাথে নিয়ে এসেছে বাবরকে দিবে ভেবে। এখন এই সামান্য বিষয়ে অধৈর্য হয়ে চলে গেলেতো হবে না। বাবর নিশ্চই অফিসের কোন ঝামেলায় এমন ভাবে আটকে আছে যে ফোনই হয়ত রিসিভ করতে পারছে না।

বাবর নিশ্চই এখন অনেক বড় কোন কর্মকর্তা। ভাবতে ভাবতে চারদিকে তাকায়, কত স্মৃতি এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জুড়ে। তখন পাবলিক লাইব্রেরি ছিলো সারা দিনরাত খোলা। বিভিন্ন বই পড়ে কত রকমের আলোচনা সমালোচনা। সেই সাথে বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের জীবন সাহিত্য পড়ে কত রকমের বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন। খেয়ে না খেয়ে তুমুল সাহিত্য আড্ডা, থিয়েটার কত কী। আর আজ এইসব থেকে পলাতক। শুধু শুদ্ধ ভাবে বেঁচে থাকার জন্য কাজের প্রয়োজনে শুধুই ছুটে চলা। এই শহরে মাঠের বড় অভাব বলেই সোহরাও্যার্দী উদ্যানের ভেতরে ক্রিকেট খেলা, ফুটবল খেলা, হকারদের চলাফেরা, লোকজনের আড্ডা সবই একসাথে চলে।

সোহেল এসবের মাঝেই কিছুক্ষণ এলোমেলো চলার পর, এক জায়গায় কিছু মানুষের জটলা দেখে কৌতুহলী হয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। মানুষের মাথার উপর দিয়ে উঁকি দিতেই দেখে বাবর একের পর এক নিখুঁত নিশানায় লোকজনকে অবাক করে দিয়ে বন্দুকের গুলিতে সিরিয়ালি বেলুন ফোটাচ্ছে। দূর থেকে মানুষের এই সব জটলা দেখলে মনে হবে দুর্দান্ত কিছু ঘটে যাচ্ছে। আসলে এই শহরে খুব সামান্য কিছু হলেই মানুষ জটলা পাকায়। আবার জটলা পাকিয়ে এমন সব কথা বলতে থাকবে যেন একেকজন বিশ্বের ঘটমান যাবতীয় সব কিছুর বিশেষজ্ঞ। যে কোন সমস্যায় এদের কথাতেই সমধান। এদের কথার বাহিরে সিদ্ধান্ত নিলেই সব ধ্বংস।

তারপর এমন সিরিয়াস ভঙ্গিতে দেখতে থাকে, যেন বিখ্যাত এমন কোন ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, যা কিনা এই মুহূর্তে না দেখলে জীবনে আর দেখার সৌভাগ্য হবে না, ফলে জীবনই বৃথা। এমন একটা ভাব নিয়ে সবাই এইসব সামান্য জিনিসকে অসামান্য কৌতূহল নিয়ে দেখে। সোহেলও সেইরকম কিছু দেখার আশায় জটলা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখে, পূর্ণ মনোযোগে বাবর ঠাশ ঠাশ করে একের পর এক বেলুন ফোটাচ্ছে। পাশে দাঁড়ানো ধুমপানরত একজনের কাছ থেকে সোহেল জলন্ত সিগারেটটা চেয়ে নিয়ে বেলুনগুলোর পাশে রেখে। বাবর বন্দুকের নল থেকে চোখ সরিয়ে তাকায় সোহেলকে দেখে হাসে সোহেলও হেসে বলে, পারলে ফুটিয়ে দেখা।
বাবর চারদিকে তাকিয়ে কৌতূহলী লোকদের উদ্দেশ্যে বলে,
জ্বলন্ত সিগারেট ফুটামু না সিগারেটের ধোঁয়া ফুটামু কোনটা আপনারাই বলেন। লোকজন কথাটা শুনে হেসে ওঠে। বাবর মজা পেয়ে লোকজনদের উদ্দেশ্যে বলে, আর কেউ কিছু দিতে চাইলে দিতে পারেন। এক চান্সেই ঠাস ঠাস কইরা দেই, নো মোর এনাদার চান্স।
একজন ফর্সা উঁচা লম্বা মাঝবয়েসী স্মার্ট লোক হাত উঁচু করে বাবরকে থামিয়ে দিয়ে, একটা কাগজ হাতের তালুতে পেঁচিয়ে সিগারেটের মত গোল করে, কিছু বেলুনের পাশে সিগারেটের একটু দূরে আড়াআড়ি রেখে রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে,
এইটাকে বন্দুকের গুলি দিয়ে ছিদ্র করে দেখান। পারলে ভাল পুরস্কার পাবেন।

বাবর প্রথমে সোহেলের রাখা সিগারেটটা গুলিতে ফুটো করে তারপর লোকটার সিগারেটের মত করে রাখা কাগজটাকে কয়েকটা ফুটো করে। সবাই অবাক। হাততালি দেয়। লোকটার কাগজটা নিচে পড়ে যায়। সবাই পুরস্কার ঘোষণা করা লোকটাকে খোঁজে কী পুরস্কার দেয় দেখতে, কিন্তু লোকটাকে আর দেখতে পায় না কেউ। লোকটার কাগজের প্যাঁচটা খুলে আলগা হতেই বাবর কী মনে করে এগিয়ে গিয়ে কাগজটা হাতে নিয়ে বন্দুকওয়ালার বিল মিটিয়ে দিয়ে চলে আসে। হাঁটতে হাঁটতে সোহেল পুরস্কারওয়ালার কথার প্রসঙ্গে টেনে আনার সাথে সাথেই বাবর বলে,
আরে ধুর মজা নিতে আসছে মজা পায়া মজা নিয়া পলাইছে বাদ দে। বলে হাঁটতে হাঁটতে সেই লোকটার কাগজের ভাঁজটা খুলতে থাকে।

কাগজের ভাঁজটা খুলে ওরা অবাক। ওটা কাগজ না, ওটা একটা একশ ডলারের তরতাজা নোট। ওরা অবাক হয়ে একশ ডলারের নোটটার বেশ কিছু ছিদ্র দেখে আপসোস করে বলে,
শালা একশ ডলার তার মানে আশি টাকা রেট ধরলে প্রায় আট হাজার টাকা। চিন্তা করা যায় আট হাজার টাকা জাস্ট হাওয়া করে দিলো?
সোহেল মন খারাপ করে বলে, হাওয়া না ফুটো। ঐ শালা বলল, আর তুই ফুটো করে দিলি।
আরে শালার আমি জানলে কী ফুটো করতাম। টাকার কী শালাগো কাছে কোন মূল্যই নাই ?
আছে। যার টাকা আছে তার কাছে মূল্য এরকম। যার নেই তার কাছে আরেকরকম। বাদ দে চল। যা গেছে গেছে আফসোস কইরা এখন আর লাভ নাই, শুধু চোখ খোলা রাখ, শালারে দেখা মাত্র ধরতে হবে। বলে ওরা একটা টি স্টলের কাছে যায়।
সোহেল বাবরের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, আর দেখা দিব? বলে আবার চিন্তিত হয়ে বলে অবশ্য দিতেও পারে। যে শালায় আট হাজার টাকা এক মুহূর্তে নাই করে দিতে পারে ঐ শালা অনেক কিছুই পারতে পারে। দেখা যাক দেখা দেয় কিনা।

বাবর প্রসঙ্গ পালটে বলে, চল চা খাই
শুধু চা না, চল বহুদিন পার্কে চা রুটি কলা খাই না।
বলতে বলতে দুজনে চা এর স্টলে থেকে কলা নিজ হাতে ছিঁড়ে রুটি নিয়ে খেতে খেতে গল্প করতে থাকে।
সোহেল অতীতের স্মৃতিচারণ করে বলে, ঐ যে তোগো উপর রাগ কইরা পার্ক ছাড়লাম তারপর আজ ঢুকলাম। এইবার বল তোর বিয়া শাদি বাচ্চাকাচ্চার কী খবর।
বিয়া হয়লো দুই বছর। বাচ্চার বয়স আট মাস বলে বাবর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সোহেল খুশি হয়ে বলে, বাহ চমৎকার।
বাবরও তাল মিলিয়ে বলে, পুরোপুরি চমৎকার। এখন কানাডায় টরেন্টোতে থাকে।
কে ?
-নীলা।
তোর সাথে হল না।
বাবর আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
না হল না আমার চান্সটা পুরাপুরি ডিসফেভার করলো, নীলা, লাকী, জামাই বিজনেসম্যান। বিয়ের পরপরই জামাইসহ কানাডা, তারপরই বাচ্চা। প্রথমদিকে ফেইসবুকে ছবিটবি পোস্ট করতো । বাচ্চা হওয়ার পর অবশ্য যোগাযোগ একদম নাই।
তোর কী খবর? বল্।
-কী আর খবর, ক্যরিয়ারটা জমায়া লইতে লইতেই দেরি হয়ে গেলো, পাত্রী দেখছে পছন্দ হইলেই ব্যস।
বাবর ও সোহেল হাঁটতে হাঁটতে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসে।
সোহেল জিজ্ঞাসা করে, কিরে জরুরি বিষয়টাইতো কইলি না।
বহুদিন দেখা নাই তাই দেখা হওয়াটাই জরুরি। কয়েকদিন ধইরা তোর কথা খুব মনে পড়ছিল। বুচ্ছস না দোস বন্ধু বলে কথা। তুইতো আর আমারে মনে করবি না।
আসলে একটার পর একটা ঝামেলায় পইড়া থাকিতো কী করুম ক।
ঝামেলাতো হালায় সবাইরই আছে। কী ঝামেলা ক। দেখিতো সমাধান করা যায় নাকি।
এইমুহূর্তে হাজার দশেক টাকা খুব জরুরি দরকার। জাস্ট সপ্তাহ খানেকের জন্য। টাকাটা এত জরুরি যে, এতদিন পর তোর সাথে দেখা তবু মান সম্মানের কথা না ভাইবাই চায়া ফালাইলাম।
বাবর চোখে মুখে সিরিয়াস ভঙ্গি করে আপসোসের সাথে বলে, ইশ্ এই ব্যাপারটা সকালে বললেও হয়ে যেত।

সোহেল বাবরকে সহজ করে দিয়ে বলে, ঠিকাছে দশ না পারলে আপাতত পাঁচ থাকলেও দে। সোহেল বলতে থাকে, বাড়ি থিকা হঠাৎ গেস্ট আইসা হাজির ঢাকায় চিকিৎসার জন্য বুঝতেই পারতাছছ কী রকমের ঝামেলার মধ্যে আছি।
বাবর আপসোসের সাথে বলে, আরে তুই যখন ফোন করলি তখনো পকেটে চার হাজার টাকা ছিলো। অফিসে এক কলিগ লোন নিলো। তোর টাকার দরকার তুই আগে কবি না। এট লিষ্ট ফোনে কইলেও ঐ টাকাটাতো তোরেই দেওয়া যাইতো। সোহেল নিজের উপর বিরক্তি নিয়ে বলে, বাসা ভর্তি গেস্ট আসায় আজ থেকে আবার রাতে থাকার সমস্যা। রাতে রেস্টটা ঠিকমতো না হইলে সকালে অফিস করা যায় বলতো। বলেই বাবরের দিকে তাকায়, আইচ্ছা তোর ঐখানে জাস্ট কয়েকদিনের জন্য থাকার ব্যবস্থা করন যাইবো।
থাকার সমস্যা কোন সমস্যাই না। আমার সরকারি কোয়ার্টার যতদিন ইচ্ছা
থাকবি। নো প্রবলেম।
সোহেল উৎফুল্ল হয়ে, থ্যাংক্স দোস্ত। একটা টেনশন থেকে রিলিজ।
বাবর সোহেলকে আশ্বস্ত করে বলে, শোন আপাতত কারো কাছ থেকে লোন নে এক তারিখে বেতন পাইলে বিশ, ত্রিশ হাজার যা লাগে আমার কাছ থিকা নিয়া নিলি।
সোহেল উৎফুল্ল হয়ে, এইবার ক তো ম্যানেজ করলি কীভাবে?
কি?
সরকারি চাকুরি, কোয়ার্টার।
কেন তোর কি থাকার জায়গা মানে সরকারি কোয়ার্টার খুব দরকার?
দরকার মানে হানড্রেড পারসেন্ট দরকার।
ঠিকাছে এই ব্যাপারে নো টেনশন। মনে কর হয়ে গেছে…।
এত সহজে হয়ে যাবে? বিশ্বাস হয় না।
বিশ্বাস অবিশ্বাসের কিছু নাই, মনে কর তোর হয়ে গেছে।
মনে করতে চাই না বাস্তবায়ন চাই।
ঠিকাছে। বাস্তবায়ন করেই দেখাচ্ছি।
পশ্চিম আকাশে সূর্যটা তখন মাত্র ডুব দিয়েছে। ইউনিভার্সিটি মসজিদের মিনারের উপর দিয়ে আকাশটা লাল রঙ ধারণ করেছে। পার্কেও খেলাধুলা গুটিয়ে যাচ্ছে। গাছের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে অন্ধকার নামছে। সেইসাথে চারদিক থেকে একে একে আজান ভেসে আসছে।
সোহেল বাবরকে তাড়া দেয়, চল উঠি। তোর কোয়ার্টারে যাই, একটু ফ্রেশ হয়ে রেস্ট টেস্ট নিয়ে তারপর না হয় আবার বাহির হইলাম।
বাবর সোহেলের কথা শেষ করতে না দিয়েই বলতে থাকে, বাসায় কাজের লোক টোক নাই, আরেকটু পরে একেবারে রাতের খাওয়া দাওয়া কইরাই যাই।

ঠিকাছে যেইটা সুবিধা হয়। বলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে, হাত পা ছেড়ে ঘাসের উপর চিত হয়ে শুয়ে আবৃত্তির মতো করে সোহেল বলতে থাকে, সূর্য ডুবে যাবার পর এখন ধীরে ধীরে লালের তেজ কমে যাচ্ছে, কয়েকটা চিল মাথার উপর দিয়ে চক্কর খাচ্ছে একই বৃত্তে। ঘুমধরা চোখের মতো লাল আর জীবনের গল্পের মতো অন্ধকার একাকার হয়ে চারধারে ধেয়ে আসছে, যদিও আবার বকের সাদা পালকের মত আশা জাগানিয়া জ্বলজ্বলে চাঁদ উঠেছে আকাশে। রাস্তার ল্যাম্পোস্টগুলোয় একটু পর জ্বলে উঠবে হলুদ আলোয়। শুরু হবে নির্জন রাতের হলুদ শহরের গল্প। লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রেরা সাক্ষী হবে সে সবের।

বাবর উদাস গলায় জিজ্ঞাসা করে, এখনও কবিতা লিখিস নাহ?, ভাব আসে, সেই ভাবটারে ভাবনার বাতাসে উড়ায়া দেই, যে পারে বাতাস থিকা ধইরা নিয়া লিখতে থাকুক, লেইখা যাক।
তুই লিখলে ভাল করতি।

ওদের কথার মাঝেই রাস্তায় নিয়ন আলোগুলি আস্তে আস্তে জ্বলে উঠে, আকাশে সাদা বকের শরীরের মত সাদা পুরুষ্ট চাঁদ ওঠে, সাথে অজস্র ছোট বড় উজ্জ্বল তারা। আর নিচে বিভিন্ন রকমের গাড়ি ছুটে যায় আলো ছড়াতে ছড়াতে।
অজস্র রঙের সাইনবোর্ড বিলবোর্ডসহ আলোকিত নগরী ঢাকার রাত জেগে ওঠে। শাহাবাগের আজিজ মার্কেটের পিছনের হাতিরপুলের নির্জন রাস্তার ছাপড়া হোটেলে রাতের খাওয়া শেষ করে ওরা দু’জন পান চিবাতে চিবাতে পি.জি. হাসপাতালের মোড় ঘুরে, জাদুঘর, পাবলিক লাইব্রেরি পার হয়ে হাঁটতে থাকে। মাঝপথে অনেকের সাথেই দেখা হয় সামান্য কথার মাঝেই বিদায় নিয়ে চারুকলার উল্টাপাশের পার্কের গেটের মুখে একটা চা স্টলের কাছে এসে দাঁড়ায়। চা স্টলের শাজাহান মিয়া চলমান চা স্টলের ভ্যানের উপর থেকে বাবরের দিকে একটা পিঠঝোলা ব্যাগ এগিয়ে দেয়। যেন আসিবা মাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে।

বাবর ব্যাগটা নিয়ে সোহেলের সাথে টুকটাক গল্প করতে করতে অনেকটা পথ ভেতর দিয়ে হেঁটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব প্রান্তের গেট সংলগ্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের কাছাকাছি গলফ মাঠটার কাছে আসে। পার্কের ভেতর তৈরি গলফ মাঠের খেলোয়াড়দের বসার জন্য এখানে একসাথে অনেকগুলি বেঞ্চ গা ঘেঁষাঘেঁসি করে পাতা হয়েছে। কিছু বেঞ্চ খালি, কিছু বেঞ্চে
লোকজন শুয়ে আছে। শোয়া অবস্থা থেকেই একজন বাবরের উদ্দেশ্যে বলে, মামা একজন আইসা আপনের বেঞ্চে শুইয়া পড়ছিল পরে হালারে আমি আর উজ্জ্বলে মিলা খেদাইছি। বাবর কথাটা শুনে বলে, খেদাইলি ক্যা আরোতো খালি বেঞ্চ পইড়া ছিল। পইড়া থাক, খালি থাক, হুদাই কেচাল বাড়ায়া লাভ কী? মাঝে মইধ্যে আমগো গেস্ট টেস্ট আয়া পড়লে জায়গা দিমু কই, কনতো?

বাবর একটা বেঞ্চের উপর বসে পড়তে পড়তে বলে, ঠিকাছে এখন ঘুমা। বলে সোহেলের উদ্দেশ্যে বলে,
দোস্ত খুব টায়ার্ড হয়া পড়ছি। রাতে খাওয়ার পর আর নিজেরে ধইরা রাখতে পারি না। ঘুম চইলা আসে।
বলে কাধঝোলা ব্যাগটা কাধ থেকে নামিয়ে খোলে।
সোহেল তাড়া দিয়ে বলে, আমিও খুব টায়ার্ড, চল তাড়াতাড়ি বাসায় যাই।
বাবর ব্যাগ থেকে চাদর ও কাপড়ের পুটলি বের করে বেঞ্চে বিছাতে বিছাতে বলে, এইতো সরকারি কোয়ার্টার, নো বাড়িওয়ালা হেয়ার, নো রেন্ট, নো ডিস্টার্ব। বাবরের কথায় সোহেল কিছু সময় নির্বাক হয়ে যায়।
বাবর সোহেলের দিকে অপলক তাকায়, ব্যাগ থেকে কাপড়ের একটা পুটলি বের করে। পুটলিটার কাপড় দুই ভাগ করে একভাগ নিজে মাথার বালিশ বানায়। বাকিটা সোহেলকে দিতে দিতে বলে, এমন আরামের বাসা কোথায় পাবি?
কিছুই বুজতে না পেরে পুটলিটা হাতে নিয়ে সোহেল জিজ্ঞাসা করে, মানে?
মানে জটিল কিছু না, চাইর মাসের বাড়ি ভাড়া বকেয়া পড়ায় খাট,পালং ভিতরে রাইখা বাড়িওয়ালার ঝাড়ি খাওয়ার ভয়ে বাহির হয়া পড়ছি। এরপর থিকাই বিশ্বনাগরিক, যাকে বলে একদম কমপ্লিট গ্লোবাল সিটিজেন। চাকরি বাকরি নাই, বাড়ি ঘর নাই, তাই, আমি এক যাযাবর, পৃথিবী আমাকে আপন করেছে ভুলেছি নিজেরি ঘর, তাই আমি যাযাবর, বহু যাযাবর লক্ষ্যবিহীন আমারে……।

গান গাইতে গাইতে বাবর বেঞ্চের উপর শোয়ার জন্য সব গোছগাছ করা শুরু করে।
কেন নিজের বাসা?
বাপে আবার গেট আউট করে দিয়েছেরে। আমিও বাপের জিদ্দি পোলা, বাপেরে কইছি, চাকরি জোগাড় না কইরা আর বাড়ি ফিরতাছি না।
খালাম্মা কিছু বলে না।
ফোনে কথা হয়। মায়ের মন বুজছইতো খালি ফিরা যাইতে কয়।
বলে উদাস গলায় আবার গেয়ে ওঠে, আমি এক যাযাবর, পৃথিবী আমাকে আপন করেছে ভুলেছি নিজেরই ঘর।
গান শুনতে শুনতে হঠাৎ আবেগে বাবরের হাত ধরে সোহেল ফিস ফিস করে বলে ফেলে, বিশ্বাস কর, চেষ্টার কোন ত্রুটি করি নাই। তারপরও চাকরি বাকরির
কোন গতি হচ্ছে নারে। বাড়িওয়ালা দুইদিনের সময় দিয়ে গেছে। এইটাই লাস্ট চান্স। এখন কী করি বলতো?
গান থামিয়ে বাবর জিজ্ঞাসা করে, কয় মাসের ভাড়া বাকি।
এই মাসসহ তিন মাসের। এক বন্ধুর কাছে লোন চেয়েছি। কালকে যেতে বলেছে।
বন্ধু কি জানে তোর চাকরি নাই
জানে।
বাবর হেসে বলে, যেতে বলছে যা তবে মনে হয় দিব না।
তোর কেন মনে হল দিব না?
অভিজ্ঞতা। আমার অভিজ্ঞতায় বলে, টাকা মানুষ তারেই দেয় যার কাছ থিকা ফেরত পাওয়া শুধু না, পরবর্তীতে আরো বেশি কিছু আশা করার নিশ্চয়তা থাকে, তোর চাকরি বাকরি নাই মানে তোর কাছ থিকা বেশী কিছু তো দূরের কথা, লোনইতো ফেরত পাওয়ার আশা আপাতত নাই।
না দিলে তো মহা সমস্যায় পড়ব রে।
সমস্যার কিছু নাই যতদিন কোন গতি না হয় ততদিন সরকারি এই কোয়ার্টারে জাস্ট এডজাস্ট কইরা নিবি। থাকা না হয় বুঝলাম, কিন্তু খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা ক্যামনে কি?
ধার দেনা কইরা।
ধার দেনা! কীভাবে?
পরিচিত অপরিচিত সবার কাছেই ঝোপ বুইঝা কোপ। বেকার নামক শব্দটা ডিলিট করে দিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ততা দেখিয়ে বড় বড় আশার কথা শুনাবি, আশার স্বপ্নে ভাসাইতে পারলেই দেখবি ধার দেনা কোন ঘটনা না। সো নো বেকার, উই আর ড্রিম মেকার নো হেজিটেশন।
তোর কথাই ঠিক, বেকার জানলে ধারতো দূরে ঠিকমতোতো কথাই কইতে চায় না।
কইবো, কইবো। যেইভাবে কইলাম ঐভাবে কইতে পারলে দেখবি শুধু কথাই কইবো না, সাথে কইরা ডাইকা নিয়া খাওয়া দাওয়া করায়া আদর কইরা টাকাও ধার দিবো। আর তার সাথে জাষ্ট ধারদেনার উপর একটা মার্কেটিং কোর্স কইরা নিতে পারলেই ব্যস, তাইলেতো কোন কথাই নাই।
ধার দেনার উপর মার্কেটিং কোর্স?
শুধু মার্কেটিং কোর্সইনা, ধার করার পর শোধ না করা পর্যন্ত ম্যানেজ করার উপর লোন ম্যানেজিং কোর্স করলেই দেখবি, ধারদেনা কোন ব্যাপারই না, জাস্ট তোর চাইতে যতক্ষণ,
তাই নাকি।
ইয়েস। আরে চারপাশে তাকায়া দেখনা, হাজার কোটি টাকা লোন নিয়া শোধ না কইরা কি রকম ভাবে ম্যানেজ কইরা চলতাছে। অরাই হইতাছে এইসব কোর্সের পারফেক্ট আইডল, জনক।
তাই নাকি!
আরে হ ঐ কোর্স করার পর, চাইলে দেখবি উত্তর কোরিয়া থিকা দুই চাইরটা পারমাণবিক বোমা ধার লওয়াও কোন ঘটনা না। তহন শুধু কিম জং উনরে কল দিলেই দেখবি কিভাবে বোমা পাঠায়া দেয়। এখনই বোমাটা লোন নিতে পারতাম জাস্ট রাখার জায়গা নাই তাই কিম জং উনরে কল করিনা। হা হা হা।
সোহেলও হাসতে হাসতে বলে, তুই মাঝে মাঝে যা কছ্ না ?
কমু কী বছর দুয়েক যাবততো এইভাবেই ম্যানেজ কইরা চালায়া যাইতাছি।
তাই নাকি? সোহেল অবাক হয়ে বলে, লোন শোধ করতে না পারলে সত্যি সত্যি ম্যনেজ হয়? উলটা পাল্টা কিছু হয় না?
নাইন্টি ফাইভ পারসেন্ট ম্যানেজড বাই বিশ্বাস। টাকা হইলেই পায়া যাইবো এইরকম আস্থা তৈরি কইরা রাখছি। দুই একজনতো উলটা পালটা পইড়াই যায়, বুঝতেই চায় না খালি কল দ্যায়।
এইভাবে কতোদিন?
যতোদিন টাকা পয়সা আয় না হবে।
আমার দ্বারা হবে না।
বাবর সোহেলের দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে, তুই অবশ্য গল্প উপন্যাস লেইখাও একটা চান্স লাগাইতে পারছ।
সোহেলের কণ্ঠে হতাশা, গল্প উপন্যাস এখন প্রচণ্ড মাত্রায় টানটান উত্তেজনা ছাড়া জমে না। আর টানটান উত্তেজনা মানে রহস্য, পরকীয়া সেক্স, ভায়োলেন্স, এসব আমার দ্বারা হবে না।
হবে না হবে না, বললে তো চলবে না দোস্ত। হওয়াতে হবে। জাস্ট মৌলিক বিষয়টারে ইউরোপ বা ল্যাটিনীয় কায়দায় ফালায়া একটা বিদেশি বিদেশি আবহ তৈরি করলেই দেখবি, সব হয়ে যাবে। আমরা আবার অগো পছন্দ অপছন্দের রুচির মধ্য দিয়া নিজেগো আধুনিকতা খুঁজি তো।
কী রকম?
এই ধর সব কিছুতেই ওদের অনুকরণ অনুসরণ করবি, আর যুক্তি দিয়া বুঝায়া দিবি ইউরোপিয়ানরাই সভ্য আর বাদবাকি আমরা সব অসভ্য আছিলাম। ইংরেজরা এদেশে আসছিলো বইলাই আমরা টাই-কোট পরতে শিখছি, টাই কোট পরা মানে ভদ্র ড্রেস পরা। ইউরোপীয় রেনেসাঁ এসেছিলো মানুষের মুক্তির পথ ধরে। আর মানুষের মুক্তি এসেছিলো তখনই যখন মানুষ জানতে পারলো সে
এসেছে বানর থেকে। আর বানর যেহেতু তখনও ন্যাংটা, এখনও ন্যাংটা, তাই ন্যাংটা হওয়ার সাথেই জগতের চাওয়া পাওয়ার ব্যাপারটাও গভীরভাবে জড়িত। এ ব্যাপারে ফ্রয়েডীয় তত্বে যুগপত আস্থা রাখতে পারলে দেখবি সব সহজ হয়ে গেছে।
সোহেল হেসে ওঠে বলে, দোস্ত তোর কথা শুনলে হতাশার মধ্যেও হাসি আসে।
তাইলে হাসতে থাক। কিন্তু ভাবতে যাইস না চিন্তা ভাবনা বেশি করলে ঝামেলা আছে, রাত জাগলে হতাশা বাড়ে। বাদ দে ঘুমা দোস্ত ঘুমা।
ঘুমতো আসে না।
ডাক দে, সুর করে বল, আয় ঘুম আয়। আবার ডাক, আরো সুন্দর করে বল, আয় ঘুম আয়। তারপর চোখ বন্ধ কর। তারপর কল্পনায় ভাব আহ কী সুন্দর রাত। চারদিকে আলো অন্ধকারে কী মায়া, কী দারুণ ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। নির্জনতার মাঝে একটা দুইটা গাড়ি চলে যাওয়ার শোঁশোঁ শব্দের সিম্ফনি মোজার্ট কিংবা বেটোফেনেও পাবি না?
বলে একটা লম্বা সাদা পলিথিন সোহেলের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, সাথে রাখ রাত বিরাইতে বৃষ্টি আইলে এইটা দিয়াই শরীর ঢাইকা ট্যাকল করতে হইবো। আকাশের দিকে তাকায়া দেখছছ চান্দের আশেপাশে দিয়া কেমনে কালা কালা মেঘের দলা ঘুর পাক খাইতাছে। রাত্রে যদি নাইমা পড়ে তহন কিন্তু এইটাই সম্বল।
সোহেল অবাক হয়ে যায়, এতোসব অগ্রীম ব্যাবস্থা তোর সাথেই থাকে? বলে পলিথিনটা মাথার পাশে রাখে।
আগে থাকতো না। তখন কত রাত যে বৃষ্টিতে ভিজছি, শীতে কাপছি তার কোন হিসাব নাই। তাই এখন শীত গ্রীষ্ম বর্ষার সাথে মিছিল মিটিং সব মাথায় রাইখা সেই অনুযায়ী অগ্রীম প্রটেকশন। ঘুমা তাড়া তাড়ি ঘুমা এইখানেতো জানছই ভোরে ভোরে উঠতে হয়।
বাবর আচমকাই সোহেলের দিকে কিছু চকলেট এগিয়ে দেয়, নে।
সোহেল হাত বাড়িয়ে চকলেট হাতে নিতে নিতে, চকলেট পাইলি কই?
পকেটেই থাকে, টাকা থাকলেই একসাথে অনেকগুলি কিনে রাখি। যখন খিদে লাগে, কিন্তু পকেটে খাওয়ার অবস্থা থাকে না, তখন খিদেটারে ধ্বংস করার জন্য দুই গ্লাস পানির সাথে একটা চকলেট চাবায়া, আরেকটা চুইসা খাইতে থাকবি। দেখবি খিদে টিদে সব ধ্বংস। বলে পকেট থেকে চুইংগাম বের করে বলতে থাকে আর বিরক্ত ফিল করলে চুইংগাম চাবাইতে থাকবি কিংবা নাকে সুড়সুড়ি দিয়া হাঁচি দিতে থাকবি কিংবা কানে সুড়সুড়ি দিয়া চুল্কাইতে থাকবি। দেখবি বিরক্তি চলে যায়। তোর এখন যখন তখন জগৎ সংসারের উপর বিরক্তি আসা, ঘুম না আসা, খামাখা ই খেইপা যাওয়া বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে অবশ্য সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ হচ্ছে, জনসম্মুখে হাঁচি ও কান চুলকানি একেবারেই নিষিদ্ধ। হাঁচি কান চুলকানি হবে একা নীরবে নিভৃতে আরামসে। হাঁচির হালকা ঝাঁকুনিতে রক্ত চলাচল সবল হয়ে উঠবে, অলস চিন্তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে সরস করে তুলবে। আর সাথে কান চুলকানি মনের নীরস অবসাদের ভেতর আরামের রস ঢেলে দেবে।
বলে বাবর গেয়ে ওঠে আমি এক যাযাবর, পৃথিবী আমাকে আপন করেছে ভুলেছি নিজেরই ঘর। তাই আমি যাযাবর। গানের সাথে সাথে চারপাশের পরিবেশটাকে সোহেলের বেশ মায়াবী লাগে। একটু দূরে দূরে ল্যাম্পপোস্টের আলো আর গাছের ছায়া মিলে মিশে আলোছায়ার খেলা নির্জন পার্কে জমিয়ে তুলেছে। মাথার উপর হীরার স্বচ্ছ টুকরার মত সারা আকাশ জুড়ে তারারা জ্বলজ্বল করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মাঝে মাঝেই হালকা বাতাশে গাছের পাতাদের শিহরণের শব্দ। সব মিলিয়ে দারুণ একটা পরিবেশে সোহেল চুইংগাম, চকলেট খেতে খেতে গান শুনতে শুনতে গাছ ফাঁকা উদ্যান কোথাও কোথাও আবার গাছ, বাতাসে মাঝে মাঝে শুকনা পাতার দুলতে দুলতে ঝরে পড়া, দেখতে দেখতে এসবের ভেতর মজে যায়।

চাঁদের আলোর সাথে পার্কের বাতিগুলোর আলো আর গাছের ছায়ার মিশ্রণে যে সৌন্দর্য ধারণ করে আছে তা দেখিয়ে বলতে থাকে, এই যে প্রকৃতির সাথে জাগতিক সৌন্দর্যের রাত এ দেখার পিপাশা এ দেখার আনন্দ নিজেকে নিজের ভিতর ডুবায় না ভাসিয়েই রাখে। বাবর ও সোহেল দুজনেই বিমোহিত চোখে দেখে। এই অবস্থাই যে যার মত নিজেদের অজান্তেই তারা ঘুমের ভেতর চলে যায়। তখন পার্কে গাছের ফাঁক দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলো পড়ে, চারপাশ চাদের আলোয় উজ্জ্বল চকচকে মায়াবি পরিবেশে ঘুমিয়ে থাকে সোহেল, বাবরসহ আরো কয়েকজন।

মাঝে মধ্যে কাকের কা কা ডাক পাখা ঝাপটানি, পাশের রাস্তায় মাঝে মাঝে গাড়ির ছুটে চলার শো শো শব্দ, হর্ন ছাড়া পুরা এলাকাটা নির্জন হয়ে যায়। আশেপাশে আরো বহু গৃহহীন লোক শুয়ে আছে এখানে। এই পার্কে রাত্রি যাপন করে এখন বিখ্যাত কবি সাহিত্যিক নাট্যকার চলচিত্রকারও হয়ে গেছে অনেক। এই শাহাবাগ এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আবার বিখ্যাত হতে এসে বহুজন দিশেহারা ঘরবাড়ি হারা হয়ে এখন পথে পথে ঘুরছে। আবার কতজন নিঃস্ব হয়ে ফিরে গেছে নিজের গন্তব্যে।

সোহেল বাবর যেখানে ঘুমিয়ে আছে তার একটু দূরে ঘন ঝোপ জঙ্গলের ভেতর আলো জ্বলছে। চারধার একেবারে নীরব। গাছের কাঁচা পাতার ফচফচ শব্দ, সাথে মানুষদের চাপা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে ফিস্ ফিস্ করে। বাবরের ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাবর চোখ খুলে খুব ধীরে যেদিক থেকে শব্দ ভেসে আসছে সেদিকে তাকায়, দ্যাখে কিছু দূরে ঝোপের আড়ালে আবছায়ায় লোকজনদের অবয়ব।
বিষয়টা কী। এতরাতে কারা ওখানে? লুকিয়ে লুকিয়ে কী করছে। সাথে স্পষ্ট কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
তাড়াতাড়ি কর, তাড়াতাড়ি কর।
এই জাতীয় কথা শুনে বাবর শোয়া থেকে উঠে বসে। কী হচ্ছে ওখানে ভেবে খুব সাবধানে ঝোপ জঙ্গলটার দিকে এগিয়ে যায়। কিছুদূর গিয়ে ঝোপের আড়াল থেকে দেখে, একজন লোক মাটি খুঁড়ছে আরেকজন ছোট্ট টর্চ লাইট জ্বালিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। একটা গর্ত খোঁড়া হয়েছে, দুজন লোক গর্তের ভেতর একটা বেশ বড় সাইজের সুটকেস নামাচ্ছে।
আরেকটু কাছাকাছি যেতেই দেখে লোক দুজনের একজন যার হাতে টর্চলাইট সে অর্ডার করছে অপরজন অর্ডার অনুযায়ী একটা বেশ বড় সাইজের চামড়ার সুটকেসের উপর মাটি চাপা দিচ্ছে। একজন গম্ভীর প্রকৃতির, আরেকজনের চেহারা সাদামাটা। গম্ভীর লোকটির পরনে সুট, টাইয়ের নট আলগা করা, একের পর এক তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে, আরে এইপাশে ভালো করে মাটি দে।
অপরজন যে গর্ত খুঁড়ছিলো সে জিন্স পরা, অর্ডার ফলো করে যাচ্ছে।
বাবর ঝোপের খুব কাছাকাছি চলে যায়। পাতার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে দেখে জিন্স পেন্ট পরা লোকটা গর্তে রাখা সুটকেসটা মাটি দিয়ে ঢেকে ফেলেছে, শুধু হাতলের সামান্য অংশ ছাড়া আর সবটাই মাটি দিয়ে ঢাকা। চারদিকে সাবধানে তাকাচ্ছে। স্যুট পরা লোকটা গাছপালার পাতা ডাল ছিঁড়ে এমনভাবে ছিটিয়ে দিচ্ছে যেন কিছু বোঝা না যায়। স্যুট টাই পরা লোকটা বলছে, খুব সাবধানে চাপা দে, যেন লকারে মাটি না ঢোকে।
জিন্স প্যান্ট পরা লোকটা খুব নিখুঁতভাবে সুটকেসের লকটা ঢাকছে যেনো কোনভাবেই ওটার মধ্যে কিছু ঢুকতে না পারে।

ওদিকে সুট পরা লোকটা তাড়া দিয়েই যাচ্ছে। কী শুরু করলি। আরে আর কতক্ষণ।
তাদের ফিস ফিস করে বলা কথা রাতের নির্জনতা ভেদ করে সোহেলেরও কানে যায়। সোহেলও জেগে ওঠে। চারদিকে তাকায়। কিছু দেখতে পায় না। ফিস ফাস শুনে পাশের বেঞ্চে তাকায়। বাবরকে না দেখে অবাক হয়। বাবর কোথায়?
আরে কেউ এসে পড়বে তাড়াতাড়ি কর। গম্ভীর প্রকৃতির লোকটা চাপা গলায় জোরের সাথে বলা কথাটা শুনে মাথার পেছনে শোয়া অবস্থায়ই ঘুরে তাকায় সোহেল। জংলাটা চোখে পড়ে, ভেতরে আলো দেখা যাচ্ছে, মানুষের অবয়ব নড়াচড়া করছে, কথা শোনা যাচ্ছে, এই হইছে, ব্যস হইছে, আর বুঝা যাইবো না।

কথা শুনে সোহেল উত্তেজিত, ভাবছে, কি হচ্ছে ওখানে, কারা কারা, বাবরও কি ওখানে? কি করছে? কি হচ্ছে ওখানে এত রাতে?
ভাবতে ভাবতে গাছের ছায়ায় ছায়ায় খুব সাবধানে কিন্তু দ্রুত সামনে এগিয়ে যায় সোহেল। কিছুটা এগোতেই সোহেল দেখে বাবর জংলার খুব কাছ থেকে লুকিয়ে জংলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা লোকদের দেখছে। সোহেলও সেখানে লুকিয়ে পড়ে তাদেরকে দেখতে থাকে।

লোক দুজন জংলা থেকে বের হয়ে খুব সাবধানে চারপাশে তাকায় তারপর দ্রুত হাঁটতে শুরু করে। বাবর ওদের পেছনে পেছনে যায় খুব সাবধানে।
বাবরও ওদের পেছনে ওদেরকে ফলো করতে করতে এগিয়ে যায়। সোহেল নিজের মনে বলে, কী ব্যাপার বাবর আমাকে কিছুই না জানায়া ওদের পিছনে পিছনে কোথায় যায়? কিছুই তো বুঝতে পারছি না। আচ্ছা দেখি কেইসটা কী। জংলা থেকে বের হয়ে বেশ কিছুদূর গিয়ে লোক দুজন সিগারেট ধরায়। তারপর রিল্যাক্স মুডে হেঁটে হেঁটে সিগারেট টানতে টানতে অস্পষ্ট কথা বলতে বলতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট পেরিয়ে বাইরে অপেক্ষমাণ একটা প্রাইভেট কারে ওঠে। বাবর গেটের কাছাকাছি গিয়ে একটা গাছের আড়াল থেকে দেখে। সোহেলও তাকিয়ে দেখে বাবরকে গাছের আড়ালে এবং লোক দুজনসহ গাড়িটাকে চলে যেতে।

গাড়িটা বেশ কিছু দূরে চোখের আড়াল হতেই বাবর আড়াল থেকে বেরিয়ে চারদিকে তাকায়। বাবরকে ফিরে আসতে দেখে সোহেল আরো দ্রুত অন্ধকারে গাছের ছায়ায় ছায়ায় মিলিয়ে সাবধানে দ্রুত হেটে বেঞ্চে শুয়ে থাকার ভান করে পড়ে থাকে। বাবর বেঞ্চের কাছে এসে দেখে সোহেল ঘুমাচ্ছে। সোহেলকে ডাকতে গিয়েও ডাকে না, নিজের বেঞ্চের কাছে যায়, বসে বসে কিছুক্ষণ ভাবে। সোহেল মাঝেই মাঝেই হালকা করে চোখ খুলে বাবরের গতিবিধি লক্ষ্য করে। বাবর উঠে দাঁড়ায় ঘুমন্ত সোহেলের দিকে এক পলক তাকিয়ে চারপাশে সাবধানী দৃষ্টি রেখে জংলার দিকে এগিয়ে যায়। সোহেল খুব সাবধানে এক চোখ মেলে তাকায়। বাবরকে জংলার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে উপুড় হয়ে আধশোয়া অবস্থায় বিষয়টা নিয়ে ভেবে আরো কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে দেয়। বাবর জংলার কাছাকাছি চলে গেলে সোহেলও খুব সাবধানে উঠে বাবরকে ফলো করতে করতে জংলার দিকে এগিয়ে যায়। বাবর ঝোপটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, চারদিকে তাকায়। আশেপাশে কেউ নেই দেখে, ঝোপটার ডালপালা খুব আস্তে সরিয়ে ভেতরে ঢোকে।

অন্ধকার ঝোপের ভেতর মোবাইলের টর্চ জ্বালায়। মোবাইলটা মুখের কাছে নিয়ে দুই ঠোঁট দিয়ে শক্ত করে ধরে দুই হাতে আঙুল দিয়ে খামচে মাটি তুলতে থাকে। এভাবে কিছুক্ষণ তোলার পর, মাটির উপর পড়ে থাকা গাছের ডাল দিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকে। খোঁড়া যাচ্ছে না ঠিক মতো, তবুও খুঁড়ছে প্রাণপনে। সোহেল ঝোপটার পাশ থেকে পাতার ফাঁক দিয়ে খুব সাবধানে লুকিয়ে দেখতে থাকে বাবরে মাটি খোঁড়া। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে সুটকেসের হাতলটা মাটির তলা থেকে বের হয়ে পড়ে। সুটকেসের হাতলটা দেখে বাবরের চোখে মুখে প্রচণ্ড উত্তেজনা কাজ করে। বাবর তখন সু্টকেসের হাতলটা ধরে প্রাণপণে কিছুক্ষণ টানাটানি করে বুঝতে পারে শুধু হাতল ধরে টেনে অতো বড় সুটকেসটা তোলা যাবে না তারপর আবার মাটি খুঁড়তে থাকে। আবার হাতল ধরে টানে। উঠাতে পারে না।

সোহেল পাতার ফাঁক দিয়ে বিষয়টা দেখে উত্তেজনা অনুভব করে একবার ভাবে বাবরকে গিয়ে সাহায্য করবে কি না। ভেবে বাবরের দিকে তাকাতেই দেখে, বাবরের চোখে মুখে আতঙ্ক হঠাৎ ভয়ে লাফিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে যায়। পিছিয়ে পড়ে মাটির ভেতর গেড়ে থাকা সুটকেসটার দিকে বাবর ভয় আতঙ্ক নিয়ে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর ভয়ানক কিছু দেখছে মনে করে সুটকেস রাখা গর্ত থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ রাখে। ঘামতে থাকে দরদর করে। চোখ খুলে আবার সুটকেসটার দিকে তাকায়। এগিয়ে যেতে গিয়েও আবার থমকে দাঁড়ায়।
সোহেল বাবরের ব্যাপারটা দেখে রীতিমত বিস্মিত হয়ে যায়। সুটকেসটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে, আশেপাশেও ভালো করে তাকায়। কিছুই দেখতে না পেয়ে বুঝতে পারে না, বাবর কেন এমন ঘামছে, কেনো বাবরের চোখে মুখে ভয় কাজ করছে। বাবরের দিকে তাকায়। বাবর দ্রুত সুটকেসের মাটি যতোটা খুঁড়েছিলো ততোটুকু আবার মাটি চাপা দিতে থাকে। ক্লান্তিতে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে, ঘামতে থাকে, চারদিকে তাকায়, অন্ধকার রাত, এই প্রথম একটা গা ছমছমে ভাব কাজ করে বাবরের ভেতরে। সোহেল অবাক হয়ে নিজে নিজে বলে, ব্যাপারটা কি এতো কষ্ট করে খুড়ে আবার মাটি চাপা দিচ্ছে কেন। নাহ কোন একটা জটিল বিষয় নিশ্চই। বাবর নিজে থিকা কইলে কইবো না কইলে নাই। জটিল কিছু হইলে নিজে থিকা বাবররে জিগায়া ঝামেলা বাড়ানোর দরকার নাই। আমি কিছু দেখি নাই, আমি দেখছি এইটাও কেউ দেখে নাই, ব্যস। সোহেল বাবরকে জংলা থেকে বের হয়ে আসতে দেখে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে বেঞ্চের কাছে চলে যায়।

বাবর ভয় আতঙ্কমিশ্রিত মুখাবয়বে বেঞ্চের কাছে এসে একটা কাপড় দিয়ে শরীরের ঘাম মুছতে মুছতে পাশের বেঞ্চে তাকিয়ে দেখে সোহেল ঘুমাচ্ছে। বাবর নিজেও শরীরের ঘাম মুছে শুয়ে পড়ে। একটা ভাবনা তার মাথার ভেতর এই মুহূর্তে চেপে বসেছে। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছে। চোখের সামনে পত্রিকার পাতায় বড় বড় অক্ষরে লেখা “সুটকেসের ভেতর অজ্ঞাতনামার লাশ” আর সাথে সাথেই মস্তকবিহীন লাশসহ সুটকেসটা তার চোখের একদম কাছে চলে আসে।
বাবর ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে বসে।
নিজে নিজে ভাবে আর বলে, যা শালা যা দেখলাম ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়, বলে সন্দিহান চোখে চারদিকে তাকায়, না কেউ দেখে নাই। নিজে নিজে সাহস সঞ্চয় করার জন্য মুখে বলে, নাহ তাহলে ভয়েরও কিছু নাই।
আশেপাশের বেঞ্চগুলোয় যে যার মত গভীর ঘুমে মগ্ন। এমনকি সোহেলও এই মুহূর্তে নাক ডাকছে। বাবর নিজে নিজে বলে,
চুপচাপ ঘুমায়া থাকি। বলে বেঞ্চের উপর পাশ ফিরে শোয়।
পাশের বেঞ্চে সোহেল চোখ বন্ধ করে শুয়ে শুয়ে ভাবছে,
বাবর আমাকে কিছু জানাতে চাচ্ছে না কেন। বাবর সুটকেসটা উঠাইতে গিয়া আবার ভয় পায়া না উঠায়া চইলা আসলো কেন। বাবর বোধহয় জানে লোকগুলা
সুটকেসে কি রাইখা গেছে। ভালো কিছু না খারাপ কিছু? চিন্তা করতে করতে বেশ কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে, একটা যুক্তি তার মাথায় স্পষ্ট হয়। যদি খারাপ কিছু হত তবে নিশ্চিত এখানে না অন্য কোথাও যেখান থেকে আর কেউ কখনও খুঁজে পাবে না, নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যায় এমন কোন স্থানে ফেলে আসতো। এখানে রেখেছে মানে আবার যেন সময় সুযোগ মত নিয়ে যেতে পারে। তার মানে ভালো কিছু। সেটা চুরি করাই হোক আর ডাকাতি করাই হোক। তাই সোহেলের কল্পনার চোখে দামি দামি জিনিস ভাসতে থাকে। সোহেল কল্পনা করে, সুটকেসের ভেতর প্রচুর স্বর্ণালংকার ও হীরার গহনা, রঙ বেরঙ্গের দামি পাথর। সোহেল চোখ খুলে তাকায় দেখে বাবর পাশ ফিরে শুয়ে আছে। সোহেলের চোখ চকচক করতে থাকে।
বাবর তখন চোখ বন্ধ করতেই দেখতে পায়, সুটকেসের মুখ খোলা , বাবরের চোখের সামনে হেরোইনের প্যাকেট সাজানো। ইয়াবার প্যাকেট সাজানো। পত্রিকার পাতায় নিউজ,”সুটকেস ভর্তি হেরোইন ও ইয়াবার চালান।“
বাবর আতংকিত হয়ে চোখ খোলে, বিরক্তি নিয়ে এপাশ ওপাশ তাকায়, চিন্তিত হয়ে কপাল টিপতে থাকে, অস্থিরতা প্রকাশ পায়, এপাশ ওপাশ করে কিছুক্ষণ।
বাবরকে এপাশ ওপাশ করতে দেখে সোহেল চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে নাক ডাকার মাত্রা বাড়িয়ে দেয় আর ভাবে,
এত দামি গহনা ঘাটি, এইখানে, এই ভাবে রাইখা যাওয়ার মানে নিশ্চিত চুরি কিংবা ডাকাতি করা মালই হইবো। এইটা ভাইবাই মনে অয় বাবর ভয় পাইছে।
বাবর চোখ বন্ধ করলেই তার চোখে এবার ভেসে ওঠে, সুটকেসের ভিতর সুন্দর করে থরে থরে সাজানো গ্রেনেড, পিস্তল ও প্রচুর গুলির প্যাকেট।
বাবর লাফিয়ে উঠে বসে। সোহেলের দিকে তাকায়।
সোহেলকে ডাকতে কাছে যায়, ঘুমন্ত সোহেলের পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়, ডাকতে গিয়েও ডাকে না, কিছুক্ষণ ভাবে,
নাহ্ এই মুহূর্তে না জাইনা না বুইঝা কাউরে কিছু না জানানোই ভালো। পরে জানাজানি হয়া গেলে যদি ঝামেলা বাড়ে। তার চেয়ে কাউরে কিছু না জানায়া চুপ থাকাই ভাল।
সোহেল ঘুমের ভান করে ভাবছে, কি ব্যাপার বাবর এত অস্থির কেন, এদিকে আইসাও আবার চইলা গেলো, কেইসটা কি। বাবর কি আমারে কিছু জানাইতে চাইতাছে? না কি শুধু শুধু অস্থির পায়চারি করতাছে? দেখি কোনটা সত্য?

 

 

সোহেল উঠে বসে। বাবরকে পায়চারি করতে দেখে জিজ্ঞাসা করে কিরে ঘুম আসছে না। বাবর দ্রুত সোহেলের কাছে হেঁটে আসে কিছু বলতে। তারপর কিছু না বলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে উল্টাটাই বলে, তুইতো দারুণ ঘুম, আমার শালার ইদানীং ঘুমটা ছেড়া ছেড়া, তাই কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি কইরা শরীরটারে ক্লান্ত বানায়া নিলে তারপর ক্লান্তিতে যদি ঘুমটা আসে। তুই হঠাৎ জেগে উঠলি কী কোন সমস্যা! সোহেল বেঞ্চ থেকে নেমে গাছের আড়ালের দিকে যেতে যেতে বলে, আমার আবার ঘন ঘন ওয়াটার প্রেশার। বলেই একটু দূরে আবছা অন্ধকারে গাছের আড়ালে যেতে যেতে ভাবে, বাবর আমারে বানায়া বানায়া মিথ্যা কথা বলার কারণ কী? তার মানে, নিশ্চিত বাবর জানে সুটকেসটার ভেতর কি আছে। ঠিকাছে দেখি সকালে কিছু বলে কি না। যদি না বলে তাইলে ধইরা নিমু বাবর জাইনা শুইনাই আমারে কিছু কইতে চাইতাছে না। একলাই সব হজম করার ধান্ধা করতে চাইতাছে।

বাবর নিজের বেঞ্চে গিয়ে বসে ভাবছে, ভালো মন্দ যাই হোক, দেখে জেনে বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যা থাকে কপালে। খারাপ কিছু থাকলে সোহেলরে জানায়া সাক্ষী বাড়ায়া লাভ নাই। ভালো কিছু হইলে সোহেলের সাথে শেয়ার করা যাইবো। দেখা যাক দিনের বেলায় কপালে কী আছে। বলে সটান হোয়ে শুয়ে মাথার চুলে বিলি কাটতে থাকে আর কপাল টিপতে টিপতে চোখ বন্ধ করে ভাবে, যা থাকে কপালে বন্দুক গোলাবারুদ হেরোইন ইয়াবা মাদক, কাটা লাশ, গুপ্তধন ধন দৌলত যা খুশি যত খুশি। আমি ঠিকই দেখুম।

সোহেল বেঞ্চের কাছে এসে শব্দ করে আড়মোড়া ভেঙ্গে শুয়ে পড়ে ভাবতে থাকে, কোন ভাবেই ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না, আমাকে ঘুমে রেখে বাবর সব একা হজম করে ফেলবে। ওইটাতে চরম ধরনের ভালো কিছু আছে এটা নিশ্চিত।
দুই জনের কারোই ঘুম হয় না, হরেক রকমের চিন্তা ভাবনা আর আধা ঘুম আধা তন্দ্রার মধ্য দিয়ে সকাল হয়। চারিদিকে বিপুল পরিমান গাছপালার কারণে অন্যান্য জায়গার চেয়ে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এইখানটায় অনেক বেশি, রোদটাও বেশ লম্বা লম্বা ছায়া নিয়ে নরম থেকে ক্রমশ গরম ভাপ নিয়ে গাছের ফাঁক ফোঁকর ভেদ করে নেমে পড়েছে। সোহেলের মোবাইলটা হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে বেজে ওঠে।
সোহেল মোবাইলে পরিচিত নম্বর দেখে খু্শিমনে মোবাইলে কথা বলে লাইনটা কেটে দেয়। নিজে নিজে বলে, এখনও যেহেতু বাবর কিছুই বলে নাই তার মানে আমার ধারণাই ঠিক। নিশ্চিত সুটকেসটায় দামি কিছু আছে, যেইটা বাবর
একাই সাইজ করার ধান্ধায় আছে । তাহলে কোন অবস্থাতেই বাবরকে এইখানে রাইখা যাওয়া যাবে না।
বলে বাবরে কাছে যায়। বাবরকে ডাকে, বাবর ঘুম জড়ানো চোখে তাকাতেই, সোহেল বলে,
দোস্ত ঐ বন্ধুটা ফোন দিছে। টাকাটা নিতে তাড়াতাড়ি যাইতে কইছে। বাবর শোয়া অবস্থায়ই বলে, যাইতে কইছে তাড়াতাড়ি যা।
তুইও চল
আমি গিয়া কী করব, তা ছাড়া আমার জরুরি কাজ আছে। এক কাজ কর আপাতত তুই তোর কাজে যা আমি আমার কাজে যাই, তারপর দুই জনে কাজ শেষে এইখানে মিট করলাম।
সোহেলের মনের সন্দেহটা আরো গভীর হলেও, বুঝতে না দিয়ে বলে, মাথা খারাপ, এই ইন্সিকিউর্ড জায়গায় আমি আর তোকে থাকতে দিতেছি না।ঐ যে যেই বন্ধুটার কাছে টাকা ধার চাছিলাম ও ফোন দিয়েছে। ওর কাছ থেকে টাকাটা নিয়া বাড়িওয়ালারে টাকাটা দিয়াই দুজনে আমার রুমে একসাথে থাকব। চল তাড়াতাড়ি। বলে একরকম জোর করেই বাবরকে টেনে উঠায়।

দুই বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে পাবলিক লাইব্রেরির ওয়াশরুমে গিয়ে ওয়াশ হয়ে ভালোভাবে হাত্মুখ ধুয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।

সোহেল বলে, চল চা খাই
বাবর মাথা নেড়ে, শোন এখনই চা খাওয়া ঠিক হবে না। কারণ আমরা এখন যেখানে যাব সেখানে এমনিতেই দেখবি চা দেবে। ভাগ্য ভালো থাকলে দেখবি চায়ের আগে নাস্তাও হয়ে যেতে পারে। তারপর সারাদিন অফিস আদালতে হাটে ঘাটে মাঠে যার সাথেই দেখা হয় সেই চা অফার করে। তাই খামোখা নিজের টাকায় চা না খায়া ঐ টাকায় চকলেট চুইনগামের স্টক বাড়ায়া রাখি, ঠিক না? সারাদিন এত চা খায়া পরে চা এর চাঙ্গা ব্যাপারটা নষ্ট করা ঠিক হবে না।
সোহেল বাবরের কথা শেষ করতে না দিয়েই হেসে, আর চকলেট।
শোন, যেখানেই যাবি, অফিস, ইন্টারভিউ বোর্ড, টাকা লোন, সেখানেই টেনশন,
হবে। কী হবে, কী হবে না, পাওয়া যাবে কী যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে অপেক্ষা করাটা বিরক্তিকর আর এইসব স্থানে একটা চকলেট মুখে দিবি দেখবি অনেক বাজে টেনশন কেটে যাবে, তবে চকলেট শুধু মিষ্টি না টক ঝাল, সব ধরনের রাখবি সাথে দুই একটা চুইঙ্গাম। যখন যেইটা মন চায়। কথা বলতে বলতে পি জি হাসপাতাল আর আজিজ মার্কেটের মাঝের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পরিবাগের ভেতরে একটা ছয়তলা বাড়ির সামনে ওরা দাঁড়িয়ে নেইম প্লেট পড়ে। ছয়তলা বাড়িটায় লিফট নেই। পায়ে হেঁটেই উপরে উঠতে হয়। সোহরাও্যার্দী উদ্যান থেকে হেঁটে হেঁটে তারপর সিঁড়ি বেয়ে ছয়তলা উঠতে উঠতে দুজনই হাঁপাতে থাকে, ঘেমেও ওঠে। দুজনই হাঁটছে কথা বলছে খুব সহজ ভঙ্গিতে যদিও। ভেতরে উভয়েরই মন সুটকেসটাকে কেন্দ্র করে মাঝে মাঝেই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়।

সোহেল কলিংবেলে চাপ দিয়ে অপেক্ষায় থাকার কিছুক্ষণ পর বয়স্ক একজন দরজা খুলে দেয়।
বেতের তৈরি সোফা চেয়ার টেবিলে সাজানো ছিমছাম ড্রইংরুম। বসতে বসতেই আশফাঁক হাসি হাসি মুখে ঢোকে। পরিচিত হয় বাবরের সাথে, দেখেই মনে হয় খুবই সহজ সাবলীল ছেলে। কে কোথায় কী করছে, এই সব কথা বলতে বলতে একসময় আশফাঁক একটা খাম সোহেলের হাতে দিতে দিতে বলে, হাতে সময় থাকলে নাস্তা খাওয়ার পর কিছু সময় বসতে পার, জরুরি কথা আছে। বলে ভেতরে চলে যায়। সময়টা দিতে সোহেলের একটুও আপত্তি থাকত না যদি, সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের সুটকেসটা এই মুহূর্তে তাকে অস্থির করে না তুলতো। বাবর সোহেলের দিকে তাকায়, সোহেল চুপ হয়ে আশফাকের কথার লেজ ধরে ভাবছে, তাদের দুজনের কিছুই নেই দেখাবার মত, কিংবা কাউকে দেয়ার মত, আছে শুধু অফুরন্ত সময়। অফুরন্ত এই সময়ের কিছু অংশ আশফাঁক চাইছে। মানুষ তার প্রয়োজন মত ভাবনাকে ধারন করে সিদ্ধান্ত নেয়। সোহেলের মাথাতে রাতের সুটকেসের ব্যাপারটা সকালের আলোয় কিছুটা ফিকে হলেও এখন আবার ফিরে এসে ভাবনার তীব্রতা বাড়াচ্ছে। কী আছে ঐ সুটকেসটায়? ওটার বিষয়ে কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবে? কি থাকতে পারে? চিন্তার জগতে এই মুহূর্তে এইসব খেলা করছে। রহস্যময় সুটকেসটার জন্য অন্য কোন এক সময়ে সময় করে দেখা করবে বলে ওরা বেরিয়ে পড়ল।

রিকশাটা পল্টনের একটা পুরানা আমলের বাড়ির সামনে যেখানে সোহেলের বাসা সেখানে দাড় করিয়ে ভাড়া দিয়ে বাবরকে বলে, চল। বাবর রিক্সা থেকে নেমে সোহেলের পেছন পেছন যায়। বাবরের মাথায় শুধুই এখন সুটকেস। । অতরাতে অতগোপনে লুকিয়ে রাখার কারণে সুটকেসটার ভেতর কী আছে দেখার জন্য বাবর এখন মরিয়া।
সোহেলেরও চিন্তা বাবর কেন এখনও সুটকেসের ব্যাপারটা ওকে বলছে না। তার মানে নিশ্চই এমন কিছু ওটার মধ্যে আছে যা কিনা বাবর একাই সাইজ করতে চাচ্ছে। সুতরাং কোন ভাবেই ওকে এই মুহূর্তে হাতছাড়া করা যাবে না। সুটকেসটা যে করেই হোক বাবরের আগে ওকেই সাইজ করতে হবে এবং অবশ্যই বাবরের অজান্তে।

এইসব ভাবনার মধ্যেই বাড়িওয়ালা দরজা খুলে তাকাতেই সোহেল। খাম থেকে টাকা বের করে গুনে বাড়িওয়ালার হাতে বাড়ি ভাড়ার টাকাটা দিতেই বাড়িওয়ালা হাসিমুখে ওদেরকে ভেতরে যাওয়ার আহ্বান করে। ওরা বিনয়ের সাথে বিদায় নিয়ে চলে আসে। সোহেল টেনশন মুক্ত হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে গাড়ি গ্যারেজের উপরে গ্রিলটানা বারান্দাসহ একরুমের বাসা দেখিয়ে বলে,
চল উপরে যাই এইটাই আমার বাসা, ঐ যে বারান্দাটা ঐটার সাথেই রান্নাঘর আর বাথরুম সব ফিটফাট। আর ভেতরে একটাই রুম। চারপাশে গাছ গাছালি আর পাখির ডাক ছাড়া একদম নিরিবিলি। বিশাল বারান্দায় শুয়ে থাকলে মনে হইবো হুবহু কাইলকা রাইতের মত উদাম পার্কে শুইয়া আছি আর রুমে শুইলে মনে হবে লাসভেগাসের কোন লাক্সারিয়াস হোটেলের চিপগেস্ট রুমে রেস্ট নিতাছি।

চল উপরে যাই, রেস্ট নিয়া দুপুরে একসাথে লাঞ্চ কইরা তারপর যার যা ধান্ধা করার করতে চলে গেলাম আবার রাতে একসাথে ব্যস। দুজনই আপাতত কিছু দিন এখানে নিশ্চিন্তে একসাথে কাটায়া কিছু একটা করার ধান্ধা করলাম। বলতে বলতে ওরা স্টিলের সিঁড়ি বেয়ে উপরে গ্রিল বারান্দার দিকে উঠতে থাকে, বাবরকে চিন্তিত দেখে সোহেল জিজ্ঞাসা করে, কিরে তুই একদম চুপচাপ। বাবর চিন্তিত মুখাবয়বে বলে, ভাবছি রহস্য ভরা জগত সংসারে কিছু রহস্য উদ্ঘাটন হওয়া দরকার। ভালো হোক মন্দ হোক দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর করে দেখা দরকার।
সোহেল হেঁসে, হঠাৎ দার্শনিক কথা বার্তা কেইসটা কী?
না তেমন কিছু না। আসলে রহস্য। জগতের কিছু কিছু রহস্য উদ্ঘাটন করতে না পারলে শান্তি নাই। আমি এখন যাই ।
তোর কথার আগা মাথা গোড়া কিছুইতো বুঝতে পারছি না।
বুঝবি বুঝবি আগে জগতের রহস্যটা উদ্ঘাটন করি।
কিসের রহস্য? খুইলা ক দরকার হলে আমিও তোর সাথে যাই।
নারে একদম সময় নাই পরে তোরে কমুনে এখন যাই। তুইও এই ফাঁকে তোর কোন কাজ থাকলে সাইরা নে। বলে সোহেলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাবর দ্রুত সিঁড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করে। সোহেল সন্দেহের চোখে তাকায়, মাথা নাড়ে ব্যাপারটা আন্দাজ করে হাঁসে আর নিজে নিজেই বলে, তোর আগেই আমি ঐখানে পৌঁছায়া যামু। জগৎ সংসারের রহস্যটা তোর আগে আমি উদ্ঘাটন করুম। বলতে বলতে সোহেলও দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে একটা সি এন জি নিয়ে ছুটে। তখনও পার্কে লোক চলাচল তেমন শুরু হয়নি। আশেপাশে যারা পার্কে রাতে ছিলো ভোরের আলো ফোটার সাথেসাথেই তারা চলে গেছে। চারপাশ মোটামুটি নিরিবিলি। সোহেল চারদিকে সাবধানে তাকিয়ে ঝুপ করে পার্কের জংলাটার ভেতর ঢুকে পড়ে দ্রুত কাজে লেগে যায়। মাটি উঠানোর পর প্রথমে সুটকেসটার উপরের অংশ হ্যান্ডেল ও লকারটা স্পষ্ট হতেই সোহেলের মধ্যে প্রচণ্ড উত্তেজনা কাজ করে। আরো দ্রুত চারপাশের মাটি খোদাই করতে থাকে। নিচের মাটিগুলি বেশ আঠালো। গর্তের ভেতরে হাত ও মাথা ঢুকিয়ে সুটকেসের নিচের মাটি সরানোর কাজ করছে প্রাণপণে। মাঝে মাঝে সতর্ক দৃষ্টিতে মাথা তুলে চারপাশে তাকায়, কেউ তাকে লক্ষ্য করছে কিনা। অল্প সময়ের মধ্যে সোহেল গর্তের মাটি সরিয়ে তারপর খুব সাবধানে সুটকেসটা টেনে তোলে।

চোখমুখ আনন্দ আর উত্তেজনায় চকচক করে, খুব যত্ন নিয়ে সুটকেসের সাথে লেগে থাকা মাটিগুলি নিজের প্যান্টে লেগে থাকা মাটিগুলি গাছের পাতা দিয়ে ঘসে ঘসে সরায়। চিকন ডাল ভেঙ্গে সুটকেসের আনাচে কানাচে লেগে থাকা মাটি খুচিয়ে যতটা সম্ভব তুলে সরায় আর জংলার ফাঁকফোকর দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখে কেউ আছে কি না আশেপাশে। নিখুঁতভাবে সুটকেসটা পরিষ্কার করতে করতে সোহেল ভাবে, কী আছে বিষয়টা দ্রুত জানতে হবে। রাতবিরেতে কেন সুটকেসটা এভাবে লুকিয়ে রেখে গেলো? বাবরওবা কেন গোপন করে গেলো বিষয়টা? সব মিলিয়েই সুটকেসের ভেতরটাই এখন তার সমস্ত চিন্তা চেতনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। যদিও ভেতরে কি আছে সে জানে না ।

তবুও অজানা বিষয়ের উত্তেজনা এখন তার মধ্যে এইরকম পর্যায়ে বিরাজ করছে যে সাথে পিস্তল থাকলে সুটকেসটাকে নেয়ার ক্ষেত্রে কোন রকম সমস্যা হলে দুই চারটা গুলি করে দুই চারজনকে আহত নিহত করে চলে যাওয়া এখন সোহেলের কাছে কোন ঘটনা না। খুব সাবধানে চারপাশে তাকিয়ে জংলা থেকে সুটকেস নিয়ে বের হয়। সুটকেসের সাইজ অনুযায়ী ওজন তো খুব বেশি মনে হচ্ছে না, ভেবে হাঁটা শুরু করে। মাঝে মাঝে চারপাশে তাকায়, লক্ষ্য করে কেউ তাকে ফলো করছে কি না। দুই একজন তাকালেও চোখেমুখে সন্দেহ ছিল না। অথবা সন্দেহ থাকলেও সোহেল সে সবকে মন থেকে ঝেড়ে উড়িয়ে দিয়ে কষ্ট করে কোন ভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে পৌঁছেই একটা সিএনজি নিয়ে সোজা বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।

বাবর হন্তদন্ত হয়ে পার্কে ঢোকে। হাতে মাটি গর্ত করার জিনিস। সুটকেসের তালা খোলার যন্ত্র। ইত্যাদি নিয়ে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে জংলার কাছে আসে। চারদিকে তাকিয়ে দেখে কেউ লক্ষ্য করছে কিনা, না আসে পাশে কেউ নেই দেখে চট করে জংলার ভিতরে ঢুকে অবাক। জংলার ভেতরের সুটকেস রাখার জায়গাটায় একটা বিশাল বড় গর্ত হয়ে আছে। যেনো বিশাল একটা হা করে তাকে গিলে ফেলার অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে। বাবর বুঝতে পারছে না। কীভাবে কী ঘটলো, এত দ্রুত কে বা কারা সুটকেসটা নিয়ে গেল। অবশ্য দ্রুত বললেও ভুল হবে এসব যন্ত্র জোগাড় করতেই বেশি দেরি হয়ে গেলো। তার উপর আবার সোহেলের সাথে ওইসব জায়গায় গিয়ে সময়ের অপচয়টা বেশী করে ফেলেছে। কিন্তু নিলো কে। আর কেউতো রাতে দেখেনি। তাহলে নিশ্চিত যারা রেখেছিলো তারাই রাতের বেলায় রিস্ক মনে করে লুকিয়ে রেখে দিনের আলোয় নো রিস্ক ভেবে মাল নিয়ে হাওয়া। মালটা তাইলে নিশ্চই দারুণ কিছু ছিল। তা না হলে কেন এত দ্রুত নিয়ে যাবে। বাজে কিছু হল নেয়াতো দুরের কথা কাছেই ভেড়ার কথা না। ইস নিশ্চিত দামি কোন জিনিস। এখন বাবরের চরম আফসোস হচ্ছে। বাবরের নিজেকে বোকা ও অসহায় মনে হয়। মাটি গর্ত করার আর তালা খোলার সরঞ্জাম গুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবে, এগুলো জোগাড় করতে গিয়েই দেরিটা বেশি হয়ে যাওয়ায় এটা হয়েছে। মাথার উপরে খোলা আকাশে মাথা গরম করা সূর্যটা যেনো জ্বলন্ত আগুনের ভাপ ছড়াচ্ছে তার মাথার উপর। বাবর মাটি খোদাই করার যন্ত্র তালা খোলার সরঞ্জামগুলো গর্তটায় ছুড়ে ফেলে। কিছুক্ষণ বসে থেকে গর্তের মাটি নিয়ে নাড়াচাড়া করে তারপর উঠে দাঁড়ায়। তারপর সেখানে পা দিয়ে কিছু মাটি গর্তে ফেলতে থাকে। যেন এই মুহূর্তে এ ছাড়া তার আর কোন কাজ নেই।

রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে বেশ কিছু সময় ধরে সোহেল সুটকেসটার লক খোলার চেষ্টা চালাচ্ছে, একসময় বিরক্ত হয়ে শাবল দিতেই চাপ দিতেই সুটকেসের লক ভেঙ্গে উপরের পাট উদাম হয়ে যায়। উদাম হয়ে খুলে যাওয়া সুটকেসের ভেতরে থরেবিথরে সাজানো আমেরিকান ডলার। একশ ডলার নোটের অজস্র বান্ডেলগুলি যেন সোহেলের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সোহেল সুটকেসের ভেতরের ডলারগুলোর মুখোমুখি হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথাটা অবিশ্বাস্য হয়ে অতি উত্তেজনায় সুটকেসের ভিতরে মুখ থুবড়ে পড়ে। সুটকেসের উপরের খাড়া হয়ে থাকা ঢাকনার অংশটা ধপাস করে সোহেলের কাধের উপর পড়ে, ফলে ওর শরীর থেকে কাধসহ মুখাবয়বটা সুটকেসের ভিতরে ঢুকে থাকে। অর্থাৎ শরীরের কাধ থেকে নিচের অংশটা বাহিরে আর কাধ থেকে মাথাটা সুটকেসটার ভেতর ডলারের সাথে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকে। একের পর এক সোহেলের ফোন বাজতে থাকে। বাজতে বাজতে কেটে যায়। আবার রিং হয় একই অবস্থা আবার বাজতে বাজতে কেটে যায়।

এভাবে কয়েকবার হওয়ার পর সোহেল সুটকেসের ভেতর মাথা গোজা অবস্থায় ফোনের শব্দে চোখ মেলে তাকিয়ে বুঝতে পারে না সে কোথায়? একটু পরে সম্বিত ফিরে পেয়ে ফোনটা রিসিভ করে। সুটকেসের ভেতর থেকে মাথা বের করে। সুটকেসটা হা হয়ে খুলে আছে তার চোখের সামনে। খোলা সুটকেস ভর্তি আমেরিকান একশ ডলারের তাকিয়ে আছে সোহেলের দিকে। আর কানের কাছে ফোনে বাবরের কণ্ঠে হঠাৎই ভয় পেয়ে চারপাশে তাকায়। না আশেপাশে কোথাও বাবর নেই। বাবর আছে ফোনের অপর প্রান্তে। অপর প্রান্ত থেকে বাবর হতাশ কণ্ঠে বলছে, দোস্ত জগত সংসারের রহস্য এক চান্সেই জানতে হয়। দেরি করলে রহস্য রহস্যই থেকে যায়।

সোহেল চোখের সামনে চকচকে একশ ডলারের বান্ডেলগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজেকে সংযত রেখে উধ্যত কণ্ঠে বলতে থাকে, নারে পাগল জগতের সব রহস্য সবার জন্য না। কিছু রহস্য জ্ঞানীদের জন্য, বেকুবরা সেই রহস্য জানতে গিয়া রহস্যটারেই আরো রহস্যময় করে ফেলে। বাদ দে ঐসব আধ্যাত্মিক কথা। এখন বল কি ব্যাপার?
নারে ব্যাপারটা আধ্যাত্মিক না, একদম বাস্তব। দাঁড়া ব্যাপারটা তোরে সামনা সামনি বলতে আসছি। হেভি ইন্টারেস্টিং কাহিনি। তুইতো বাসায়ই, তাই না?
নারে দোস্ত হঠাৎ করে দেশ থেকে জরুরি কল আসছে, একটা বড় রকমের ঝামেলা হইছে তাই এখনি দেশে যাচ্ছি। রওয়ানা চার পাঁচদিন পর ফিরে এসে সামনাসামনি বসে তোর ইন্টারেস্টিং কাহিনি শুনব।
ঠিক আছে তাহলে তোর রুমের চাবিটা রেখে যা।
নারে দোস্ত বাড়িওয়ালা আমারে ছাড়া কোন গেস্ট আমাকে ছাড়া এলাউ করবে না। মাত্রতো চারপাঁচ দিন। এই কয়টা দিন পার্কেই ম্যানেজ করে নে। এখন হাতে একদম সময় নাই, দেরি করলে ট্রেন মিস করব। রাখি।
কলটা কেটে দিয়ে সোহেল নিজে নিজেই ডলারগুলার দিকে লক লক চোখে তাকিয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। এরপর বাবরের উদ্দেশ্যে নিজে নিজে বলে, এতগুলা টাকা তুই নিজেই হজম করতে চাইছিলি না? জাইনা শুইনা আমারে না দিয়া একলা একলাই পুরাটা …। পারলি? পারলি না।

সোহেল ডলারগুলোর খুব কাছে যায়, দুইহাত দিয়ে তুলে ধরে বেশ কিছু ডলারের বান্ডেল, সুটকেসের ভেতরে ডলারগুলাকে নিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না উত্তেজনা ক্রমশ বাড়তে থাকে। হঠাৎ করেই তার মনে হল সবকিছু সহজ। এই পৃথিবীতে এখন যা খুশি তাই করা যায়। সে এখন এই মুহূর্তে কী করবে, কী করতে তার ইচ্ছা করছে? নিজের মনকেই যেন নিজের প্রশ্ন। ডলার নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ শোকে, চোখের কাছে নিয়ে ভাল করে ঘ্রাণ শোকে। ডলারগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবে, এখন কী করা যায়, আবার ভাবে যেহেতু এই মুহূর্তে উত্তেজনায় মাথা গরম আছে তাই আপাতত কিছুক্ষণ ঘরে বসে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এগুলো দিয়ে কীভাবে কী করা যায়।

ঠান্ডা মাথায় এখন যেটা করতে হবে সেটা হচ্ছে কিছু ডলার ভাঙিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র কিনে একদম ঘরে বসে দুই একদিনের মধ্যে চুপচাপ একটা প্ল্যান করতে হবে। তারপর সেই প্ল্যান অনুযায়ী টাকাগুলিকে সেইসব খাতে ধীরে ধীরে কাজে লাগাতে পারলেই ব্যস। তাই আপাতত কিছুদিন ঘরে থাকার জন্য যা যা দরকার সেগুলি এক্ষুণি সময় নষ্ট না করে দ্রুত নিয়ে আসতে হবে। কী কী লাগবে কাগজ কলম নিয়ে বসে একটা শর্ট লিস্ট করে, তারপর এক বান্ডেল ডলার পকেটে নেয়। যাওয়ার সময় সুটকেসটার দিকে তাকিয়ে এককোনে চাপিয়ে রাখে। ঘরে তালা দিতে দিতে ভাবে একটা তালায় হবে না, বাড়িওয়ালার কাছ থেকে আরো দুইটা তালা মিথ্যা কথা বলে হলেও ম্যানেজ করে আনতে হবে। এই দরজায় আরেকটা তালা দিতে হবে সাথে আজকে বারান্দায়ও দুইটা তালা মারতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসতে হবে।

বাবর পার্কে বসে হাত পা ছেড়ে ভাবে যা হওয়ার ভালোই হয়েছে। খামাখাই একটা জিনিস নিয়ে ঘুম নষ্ট। আজে বাজে চিন্তায় মাথাটাও ওলট পালট। এখন সেটা না থাকায় কিছুক্ষণ খারাপ লাগলেও এখন এই ভেবে বেশ ফুরফুরে লাগছে যে যার জিনিস তার কাছে চলে গেছে। খুব ভাল হয়েছে। কোন টেনশন নেই কোন আফশোস আর নেই। পার্কে লোকজন কেউ শুয়ে আছে, কেউ বাদাম খচ্ছে, বাদামওয়ালা, চাওয়ালা, কাস্টমার, মানুষের ছোটাছুটি। ফুটওভার ব্রিজ থেকে মানুষের ওঠানামা, রাস্তায় গাড়ি চলার তীব্র প্রতিযোগিতা।

ঢাকা শহরের বড় বড় বিল্ডিং শপিং মল এসবের মাঝে বাবর অসহায় অবস্থায় একা একা হেঁটে যেতে যেতে মাথায় আবার নতুন করে আফসোসটা ভর করে। এই আফসোস যতটা না সুটকেস হারানোর, তার চেয়ে বেশি সুকেসে কী ছিলো সেটা জানার। ভাবনার মধ্যে এখন বারবারই মনে হয় সুটকেসটায় নিশ্চই দামি কিছু ছিলো। টাকা পয়সা গহনাগাটি কিংবা দামি পাথর হীরা পান্না, আরো কত রকমের লোভনীয় চিন্তা। আর এই লোভনীয় চিন্তা যতই মাথার ভেতর ঘুরপাক খায় আফসোসও তত বাড়তে থাকে। এই আফসোস থেকে মুক্তি পেতে বাবর কাগজ পেঁচিয়ে নাকে শিহরণ দিয়ে পরপর কয়েকটা হাঁচি দিয়ে নিজেকে ঝরঝরে করে ভাবে, নিশ্চই এতে এমন কিছু ছিলো যেটা আমার জন্য দেখা ক্ষতিকর ছিল, তাই এটা আমার না দেখাই ভালো হয়েছে।

পৃথিবীতে যে যত কম দেখে কম জানে তার তত ঘুম ভাল হয়, তার তত শরীর মনে আরাম হয়। আগেকার সেইসব গ্রামের বৃদ্ধরা কোন কিছুতেই বিচলিত হত না খুব একটা। সব কিছুকেই সহজ ভাবে নিতে শিখেছিলো বলেই গাছের নতুন পাতা জন্মানো থেকে পাতা ঝরা। ফসলভরা মাঠ থেকে ফসলহীন বিরাণভূমি, পাখিদের কলকাকলি, শীত গরম বর্ষা সবই ছিলো আনন্দের সবই ছিল তাদের কাছে মজার। এই মজাগুলি তাদের জীবনে হুট করে এসে হুট করে আতশ বাজির মত আলোর ঝলকানি দিয়ে শেষ হয়ে যেত না। এটা মনের ভেতর একে একে জমতো আর একেক ভাবে অভিজ্ঞতা হয়ে খুলত আর নতুন নতুন আনন্দের শিহরণ মনের মধ্যে জন্ম নিত। ফলে আনন্দটা শরীর মনে এমন ভাবে জমে যেত যে কষ্ট বা বিষাদের সময়গুলিতে তারা ভাবত এগুলি জগতের স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটে ঘটছে ঘটবে।

এইভাবে ধরে নিয়েই ভীত বা বিচলিত না হয়ে অসুখকেও সুখ বানিয়ে দুঃসময়ে ধৈর্য ধরে করণয়টা করে আত্মতৃপ্তির মধ্য দিয়েই সুখী হত। সুতরাং আমাকেও তাই করতে হবে। একটু আগে কী হয়েছে ঐটা এই মুহূর্তে কোন ঘটনা না। এই মুহূর্তে চারদিকে কি দারুণ ঝকঝকে রোদ, কী দারুণ আমার প্রিয় শহর, চারপাশে মানুষের চলাচল, কোলাহল, দুচোখ মেলে দেখছি কান পেতে শুনছি। কড়া লিকারে এক কাপ চা খেতে ইচ্ছা করছে। নো প্রবলেম এক্ষুণি খেয়ে ফেলব। এসব ভাবতে ভাবতেই বাবর একটা চায়ের স্টলের কাছে যায়, এককাপ চা খেয়ে, খামখাই চাওয়ালাকে বলে ভাই আপনার চা টা দারুণ লাগছে। বহুদিন এইরকম চা খাই নাই। আরেক কাপ দেন । চা ওয়ালা খুশি হয়ে আরেককাপ চা দেয়। বাবরের যদিও আরেক কাপ চা খেতে একটুও ইচ্ছা করছে না, তবুও অর্ডার যখন দিয়ে ফেলেছে আর চা যখন বানিয়ে ফেলেছে প্রায় তখন কি আর করা।

চট করে পাশে বসে থাকা একজন বৃদ্ধর উদ্দেশ্যে বলে খেয়ে দেখেন কি অসাধারণ চা বানায়, বলে চা টা বৃদ্ধর উদ্দেশ্যে এগিয়ে দেয়। দুইজনের দুই কাপ চায়ের বিল দিয়ে চলে আসার সময় চাওয়ালা বলে, ভাই এইদিকে আবার আসলে কিন্তু আমার এইখানে মেহমান হিসাবে চা খাইবেন। বাবর কথাটা শুনে তাকায় চাওয়ালা ও বৃদ্ধর দিকে তাকিয়ে দেখে, দুজনের হাসি মুখ। মুহূর্তেই সমস্ত খারাপ লাগাগুলি ভালো হয়ে উঠলো। মাত্র দুই কাপ চায়ের সাথে একটু ভালো করে কথা বলায় দুটো মানুষ কত খুশি। মনে হল জীবন আসলে অল্পেই সুন্দর।

বাবর আবার তার স্বাভাবিক চিন্তায় ফিরে আসে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেয়ালে লাগানো একটা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে দাঁড়ায়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির নিচে মোবাইল নম্বর তুলে নিয়ে কল করে। মোবাইলে কথা বলতে বলতে হাটছে। হঠাৎ রাস্তার ওপাশে একটা ট্যাক্সিক্যাব থেকে সোহেলকে নামতে দেখে অবাক হয়ে যায়। নিজে নিজে ভাবে, সোহেলের মত মনে হইলো না। ভেবে মোবাইলের লাইনটা কেটে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে যায়। সোহেল ততক্ষণে একটা শোরুমে ঢুকে যায়। যে শোরুমটায় সোহেল ঢুকেছে বাবর সেটার কাছে যায়। শো রুমের বাহির থেকে গ্লাসের ভেতর দিয়ে লক্ষ্য করে সত্যি সত্যি সোহেল কি না।

হ্যাঁ সোহেলই তো, বাবর গ্লাসের ওপারে স্পষ্ট দেখতে পায়। বাবর অবাক হয়ে দেখতে থাকে সোহেল তার সামনে দিয়ে অনেকগুলো কাপড় একসাথে নিয়ে ট্রায়াল রুমে ঢুকছে।। একটুপর বের হয় সম্পূর্ণ নতুন ড্রেস পরে। একটা সানগ্লাস নেয়, স্যু পরে, নিজের পুরানো কাপড়গুলো একটা প্যাকেটে ঢুকায়। বিল দিয়ে বেরিয়ে যায়। বাবরের চোখেমুখে বিস্ময়। সোহেল হঠাৎ এই অবস্থায়। না কি একই রকম দেখতে অন্য কেউ। বাবরের চোখে ও মনে ধাঁধাঁ লেগে যায়, সোহেলের পেছন পেছন যেতে থাকে। সোহেল ইলেক্ট্রনিক্স শোরুমে ঢুকে টিভি, ফ্রিজ দেখছে। সিসি টিভিতে বাবর সোহেলকে লক্ষ্য করছে। সোহেল সেলসম্যানের সাথে কথা বলে ম্যানেজারের কাছে যায়। বাবর জিনিসপত্র দেখার ছলে সোহেলকে ফলো করে। সোহেল ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করছে, আচ্ছা আমি যদি টিভি ফ্রিজের টাকা এখন এডভান্স করে এড্রেস রেখে যাই, আপনারা কি টাইমলি জিনিসগুলো এড্রেস অনুযায়ী পৌঁছে দিতে পারবেন ?
ম্যানেজার বিনয়ের সাথে বলে, অবশ্যই স্যার ,কেনো পারবো না।

সোহেল ম্যানেজারের কাছ থেকে কলম চেয়ে নিয়ে এড্রেস লিখে দিয়ে, অনেকগুলো টাকা ম্যানেজারকে দিচ্ছে। বাবর অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। বাবর দেখতে দেখতে অবাক হয়ে ভাবে সোহেল হঠাৎ এতো টাকা কোথায় পেল। তখন না বলল জরুরি দরকারে বাড়ি যাচ্ছে। বিষয়টা কি। বেশ কিছু শোরুম ঘুরে জামাকাপড় থেকে শুরু করে টিভি, ফ্রিজ, স্ট্যান্ড ফ্যান, ফোল্ডিং খাট, ফোল্ডিং চেয়ার টেবিলের অর্ডার দিয়ে বাড়ি ফিরেছে সোহেল। ফেরার পথে পুরানা জামা জুতা প্যান্টকে একটা পোটলা বানিয়ে চলতি পথে একটা ডাস্টবিনে ফেলে এসেছে। নতুন চকচকে জামা কাপড় পরে বারান্দার জন্য কিনে আনা দামি পর্দাটা টাঙাতে টাঙাতেই নিচে চোখ যায় সোহেলের। তাকিয়ে দেখে বাড়িওয়ালা গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে উপরে তাকিয়ে একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করে, কি ব্যাপার হঠাৎ বারান্দায় পর্দা টাঙাচ্ছ। সোহেল বাড়িওয়ালাকে দেখে সাথে সাথেই সালাম দিয়ে বলে, আংকেল আপনার খোঁজে বাসায় গেলাম, শুনলাম আপনি বাজারে, আপনার সাথে খুব জরুরি কথা আছে।
বাড়িওয়ালা ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে চারপাশে তাকিয়ে নতুন জিনিসপত্রে ঠাসা বারান্দা ও রুমটা দেখে বলে, কি বিষয় বলতো কিছুতো বুঝতে পারছি না।
বাবরও সেই তখন থেকে সোহেলের পেছন পেছন এসে অনেক্ষণ বাড়ির মূল গেটের বাইরে অপেক্ষায় ছিলো। কারণ ভেতরে ঢুকলেই গ্যারেজের দোতলার বারান্দা থেকে বাবরকে দেখা যাওয়ার একটা চান্স থাকে। বাবর যে সোহেলকে ফলো করতে করতে এখানে চলে এসেছে এটা কোন ভাবেই বুঝতে দিতে রাজি না। তাই বাড়িওয়ালার সাথে সোহেলের কথা বলার সুযোগে বাবর খুব সাবধানে দোতলার ঝুল বারান্দার ঠিক নিচে পিলার ঘেষে এসে দাঁড়ায়। লুকিয়ে ওদের উপর লক্ষ্য রাখছে।। উপর থেকে বাড়িওয়ালা ও সোহেলের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
সোহেলও ততক্ষণে হাতটা ভালো করে ধুয়ে, চোখে মুখে একটা লজ্জাবনত কাচুমাচু ভাব এনে বাড়িওয়ালাকে বলে, আঙ্কেল আসলে আপনি বাবার বয়সি মানুষ তাই বলতে একটু লজ্জা পাচ্ছি, কিন্তু না বলেও পারছি না, সামনের মাসেই আমার বিয়ে , পাত্রী ঠিক হয়ে কথাবার্তাও ফাইনাল হয়ে গেছে।
বাড়িওয়ালার মুখাবয়বে চরম বিস্ময়, বল কী?
হ্যাঁ এত তাড়াতাড়ি সব ঠিক হয়ে যাবে আমিও জানতাম না, আজ সকালে আপনাকে ভাড়া দিয়ে যাওয়ার পরই বিষয়টা জানলাম।
বাড়িওয়ালা আত্মতৃপ্তি নিয়ে বলে, যাক অনেকদিন পর একটা ভালো সংবাদ পেলাম।
তাই চিন্তা করে দেখলাম বিয়ে করে বউ কে নিয়ে যেহেতু এখানেই উঠবো,

আসলে এই শহরে বলতে গেলে আপনিই আমার গার্ডিয়ান। তাই ভাবলাম আপনাকে বলে বাড়িটাকে যদি একটু সুন্দর করে রঙ টং করা যেত।
কি বলছো বাবা আমি তো তোমাকে ব্যাচেলর হিসেবে ভাড়া দিয়েছি, এখন দুজন হলেতো ভাড়াটা নতুন করে ঠিক করতে হবে। তাছাড়া রঙ করাতো হুটহাট করে বললেই হয় না।
এসব ব্যাপারে আপনি একদম টেনশন করবেন না। কথা বলতে বলতে সোহেল ও বাড়িওয়ালা বারান্দা থেকে ভেতরের রুমে ঢুকে রুমের পেছনের জানালার কাছে চলে যায়। জানালার ওপাশে পেছনের জায়গাটায় এলাকার যাবতীয় ময়লা ফেলে সবাই। সাথেই রয়েছে কালো ময়লা পানি সর্বস্ব পচা নর্দমা। সোহেল জানালা দিয়ে বাড়িওয়ালাকে সেদিকে ইঙ্গিত করে বলে, এই জানালাটা দিয়া প্রায়ই বিশ্রী গন্ধ আসে জানেনই তো তাই ভাবছি থাই গ্লাস দিয়া, বলে থেমে বাড়িওয়ালার দিকে সরাসরি তাকিয়ে, অবশ্য আপনি যদি না করেন তাহলে করবো না। আপনি যা বলবেন যেভাবে বলবেন আমি তাতেই রাজি। শেষমেষ বউ তো আপনাদেরই। আমিতো কাজের চাপে বলতে গেলে সারাদিনই বাইরে বাইরে থাকব। আর বউতো সারাদিনই আপনাদের সাথেই থাকবে। বাড়িওয়ালা হেসে মাথা নেড়ে বলে, তোমার আন্টিকে বলে দেখি কি বলে। সোহেল কথাটা শুনে বাড়িওয়ালার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকায়, বাড়িওয়ালা সোহেলের তাকানো দেখে বলে, কি আর কিছু বলবে।
না। তেমন কিছু না, এই যে আপনি আন্টিকে না জিজ্ঞাসা করে কথাটা দিতে পারলেন না । এটা আমার খুব ভাল লাগছে। এই যে এই বয়সেও আপনার আর আন্টির মধ্যে শেয়ারিং, এটাই এই শিক্ষাগুলোই আমাদের দরকার। এজন্যই বিয়ে করে আপনাদের পাশেই ওকে রাখতে চাই, আপনাদের পাশে থাকলে অনেক কিছু শিখতে পারবে। বাড়িওয়ালা সোহেলের কথা শুনে খুব খুশি হয়ে উপদেশ দিতে থাকে, নতুন বউয়ের ব্যাপারে কী কী করতে হবে কী করা ঠিক হবে না, এইসব।

সোহেলরা রুমের শেষ প্রান্তে জানালার কাছে কথা বলতে থাকায় বাবর ওদের কোন কথাবার্তা শুনতে পায় না। উপরে সব চুপ, ব্যাপারটা কী বোঝার জন্য নিচ থেকে উঁকি ঝুকি মারে, তাতেও কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে খানিকটা সাহস নিয়ে সিঁড়ির কাছে যায়। এক পা দুই পা করে খুব সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। উপরে উঠতে উঠতে কথাবার্তা আস্তে আস্তে কানে আসতে থাকে।
বাড়িওয়ালা সোহেলের কথাবার্তার মাঝে খুবই অবাকই হয়, ওবাক হয়ে কথাবার্তার মাঝে মাঝেই ভাবে, কাল যাকে ভাড়া দিতে না পারায় বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার কথা ভেবেছিলেন, আজ তার কথাবার্তায় টাকা পয়সার ঝন ঝনানির সাথে আপন করে মায়া বাড়িয়ে নেয়ার ব্যাপারটাও তাকে ভাবায়। আসলে কার অবস্থা কখন কিভাবে যে পালটে যায় তা একমাত্র উপরওয়ালাই জানে।
ভাবতে ভাবতেই সোহেলের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, সামনের বারান্দাটাকে তুমি রুমের মতো বানিয়ে নিয়ে ব্যবহার করতে চাইলে ওটাকে রুম হিসেবে ধরে আরো দুহাজার টাকা বাড়িয়ে দিতে হবে। সাথে এডভান্স করতে হবে তিন মাসের ভাড়া। রুমগুলি নিজের টাকায় রঙ করছো মেরামত করে নিচ্ছ বলে ভেতরের রুমের ভাড়া আর বাড়ালাম না। আচ্ছা মেয়ে আই মিন বউমা কি করে।
একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে স্যোশাল সাইন্সে পড়ে। ওর বাবা আমাদের এলাকার কাউন্সিলর।
বাহ্ বেশ বেশ আঙ্কেল আরেকটা কথা , আমি কিন্তু বাড়ির কাজটা আজ থেকেই শুরু করতে চাই।
আজই ! বলে একটু অবাক হয়ে বলে, এতো তাড়াহুড়ার কী আছে।
আসলে মেয়ে পক্ষ দেখতে আসবে আমি ঢাকায় কোথায়, কীভাবে থাকি। তাই আরকি।
ঠিকাছে যেটা যেভাবে ভালো মনে কর। তবে যাই কর আমাকে না পেলেও তোমার আন্টিকে অন্তত জানিয়ে নিও। তাতে করে তোমারই ভালো হবে।
সোহেল বাড়িওয়ালার কথায় দারুণ উৎসাহী ভাব নিয়ে গদগদ হয়ে বলে, অবশ্যই অবশ্যই, আপনাদের বলবো না তো কাকে বলবো। এখানে আপনারা ছাড়া আমার আপন আর কে আছে।
এমন সময় বাড়িওয়ালার চোখ যায় ঘরের কোনে রাখা সুটকেসটার দিকে, বেশ বড় আর পুরানা আমলের সুটকেসটা দেখে অবাক হয়ে সোহেলকে জিজ্ঞাসা করে, এতোবড় সুটকেস কোথায় পেলে?
হঠাৎই সুটকেসটার প্রসঙ্গ চলে আসায় সোহেল কিছুটা থতবত খায়। চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, বাড়িতে পড়েছিল, বাবা মায়ের বিয়ের স্মৃতি। বাবা মায়ের বিয়ের সময় বাবার বাড়ি থেকে মায়ের কাছে সব জিনিসপত্র এই সুটকেসে করেই পাঠিয়েছিলো, আমিও আমার বিয়েতে মেয়ে পক্ষকে এই সুটকেসে করেই মালামাল পাঠাব ভাবছি। কী বলেন আঙ্কেল কেমন হবে।
বাহ ভালো, আজ কালকার ছেলেমেয়েরা তো বাবা মায়ের স্মৃতি ধরে রাখা দূরের কথা দায়িত্বটাই ভুলে যাচ্ছে, বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
তারপর সুটকেসটার দিকে একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করে বলে, আমাদের সময়ের
জিনিস তো একেবারে অরিজিনাল, একটু ঝাড় পোছ করে নিও। মাটি লেগে দাগ পড়ে আছে। মাটিও দেখা যাচ্ছে।
সোহেল ইতস্ততবোধ করতে করতে বলে, অযত্নে অবহেলায় পড়েছিলো তো এই জন্যেই। বলে সোহেল মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, নাহ সুটকেসটা যেনো আর কারো চোখে না পড়ে এক্ষুণি সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

বাবর রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে ওদের কথা শুনে উঁকি ঝুকি দিয়ে সুটকেসের কথা কয়েকবার কানে যেতেই সেও বারান্দায় শুয়ে পড়ে ভেতরের রুমের চারদিকে তাকায়, সুটকেসটা তার চোখে পড়ে। সে অবাক হয়ে যায়। এ তো সেই সুটকেসটা, যেটার জন্য কাল রাত থেকে নির্ঘুম, যার ভেতর কি আছে দেখার জন্য সকাল থেকে মাথার ভেতর তোলপাড়। এই সুটকেসটা সোহেল কখন সাইজ করল। সুটকেসের কারণেই কি কয়েক ঘন্টার মধ্যে সোহেলের পোশাকে কথায় এত ব্যাপক পরিবর্তন? সোহেল ও বাড়িওয়ালাকে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে জানালার ওপাশে বাহিরে তাকিয়ে কথা বলতে দেখে, বাবর খুব সাবধানে নুয়ে পড়ে যুদ্ধশিবিরে শত্রুকে ফাকি দিয়ে যেভাবে ক্রলিং করে করে সৈনিকরা এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যায় বাবরও সেভাবে রুমের ভেতরের খাটের নিচে ঢুকে যায়। খাটের নিচে লুকানো বাবরের সামনে দিয়ে সোহেল ও বাড়িওয়ালার দুই জোড়া পা কথা বলতে বলতে রুমের ভেতর পাঁয়চারি করে। বাবর তাকিয়ে আছে সুটকেসটার দিকে, কখন সে দেখতে পাবে কি আছে ওটার ভেতর।
সোহেল বেশ কিছু টাকা বাড়িওয়ালাকে দেয়। একইসাথে সুটকেসের ব্যাপারটা এভয়েড করতে যত দ্রুত সম্ভব রুম থেকে বাড়িওয়ালাকে নিয়ে বের হয়ে যায়। বাড়িওয়ালা টাকা নিতে নিতে সোহেলের সাথে রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় চলে আসে। সোহেল রুমের দরোজাটা ভালো করে তালা মারে, তারপর বাড়িওয়ালাকে সাথে করে নিচে নেমে এগিয়ে দিয়ে আসে। বাবর খাটের নিচে থেকে সাবধানে বের হয়ে দরোজায় লাগানো আইবল সাইজের ফুটা গ্লাস দিয়ে বারান্দায় তাকিয়ে দেখে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আশে পাশে কারো কথা শোনাও যাচ্ছে না। কেউ নেই ভেবে বাবর দরজার কাছ থেকে ফিরে আসে, সুটকেসের দিকে তাকায়, ধীরে ধীরে কাছে যায়। সুটকেসটা খুলতে যাবে এমন সময় হঠাৎ একটা শব্দ কানে আসতেই বাবর আবার দ্রুত খাটের নিচে ঢুকে যায়।

একটুপর আর কোন কিছুর শব্দ শুনতে না পেয়ে ভাবিকটু আগের শব্দটা বাহিরে কোথাও থেকে হয়ত আসছিল, ভয়ের কিছু নেই ভেবে, আবার সুটকেসের কাছে গিয়ে সুটকেস খুলে সুটকেস ভর্তি ডলার দেখে প্রথমে বিস্মিত, স্তম্ভিত, পরে খুশিতে আত্মহারা হয়ে দুইহাতে এলোমেলো করতে থাকে ডলারের বান্ডেলগুলোকে। বারান্দায় হঠাৎ লোকজনের কোলাহল শুনে বাবর দ্রুত দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়, বাবর বুঝতে পারে না কিসের শব্দ। একই সাথে শব্দ মিলিয়ে যায় আবার আসে বাবর ফুটা দিয়ে বারান্দায় তাকায়। বারান্দায় নতুন খাট, ফ্যান, ফ্রিজ, টিভি নিয়ে লোকজন ঢুকছে, বের হচ্ছে, সেই জন্যই এত কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। সোহেল তাদেরকে বিভিন্ন স্থান নির্দেশ করে দেখায়, এবং সেই অনুযায়ী সব সেট করার তাগাদা দিতে থাকে এবং নিজেও বারান্দার গ্রিলের পুরাটাই পর্দা দিয়ে ঢাকতে থাকে। সোহেল ও লোকজনদের এইসব ব্যস্ততা দেখে বাবরের ভেতরে প্রচণ্ড রাগ তৈরি হতে থাকে।

বারান্দা জুড়ে সবাইর ব্যস্ততায় দুপুরের মধ্যেই বারান্দাটা অন্যরকম একটা সাজানো গোছানো রুমে পরিণত হয়ে যায়। লোকজন চলে গেলে সোহেল নিজে রুমের কিছু জিনিস নিজে নিজে ঠিক করে নিতে থাকে। টিভিটাকে ওয়্যারড্রবের ওপরে এঙ্গেল করে রাখে। যাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখতে কোনরকম অসুবিধা না হয়। বিছানার জন্য কেনা সব নিজ হাতে ঠিকঠাক করতে থাকে। বাবর দরজার ফুটা গ্লাসটায় চোখ রেখে এইসব দেখে বুঝতে পারে সোহেল এখন নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত থাকবে সুতরাং এই সুযোগেই তাকে ডলারগুলো সরানোর প্রস্তুতি নিতে হবে। বাবর প্রথমে বিছানার চাদরে ডলারগুলো রাখবে ভেবে চাদরটা উঠাতে গিয়ে উঠায় না।

হঠাৎ মনে হয় সোহেল যদি দরজা খুলে প্রথমেই দেখতে পায় বিছানায় চাদরটা গেলো কোথায় তাহলে, ভেবেই আবার চাদরটা যেমন ছিলো তেমনি রেখে, বিছানায় অগোছালো পড়ে থাকা দুইটা বালিশ নেয়, বালিশের কভার খুলে, বালিশ ও কভারগুলি ভালো করে চেক করে নেয় কোথাও কোন ফুটা ফাটা আছে কি না। কোন ফুটা ফাটা নেই দেখে, বালিশ দুইটার কিছু অংশের সেলাই খুলে তার ভেতর থেকে তুলা বের করতে থাকে। এরই মাঝে মাঝে দরজার কাছে গিয়ে গিয়ে দেখেও আসে সোহেল কি করছে। সোহেল তার বারান্দা নিয়ে বেশ ব্যাস্ত আছে দেখে নিয়ে বাবর আলনা থেকে টিশার্ট নামায়। টিশার্টের গলা ও হাতা বাঁধে। হাত দিয়ে টেনে চেক করে নেয় বাঁধাটা শক্ত হয়েছে কিনা। এভাবে পরপর দুটো টিশার্ট বেঁধে তার মধ্যে তুলাগুলি ঢুকাতে থাকে। গেঞ্জিতে তুলা ভরা শেষ হলে সেগুলি খাটের নিচে রাখে। বালিশগুলি তুলা শুন্য করে বালিশের ভেতর ডলারগুলি ভরতে থাকে। সম্পুর্ন ডলারগুলি বালিশে ঢুকিয়ে বালিশের ভেতর উচানিচা আটোসাটো জায়গাগুলিতে আবার প্রয়োজন মত এমনভাবে তুলা দিয়ে ব্যালেন্স করে উপরে কভার দিয়ে ঢেকে দেয়া যে, যে কেউ দেখলে ভাবতেই পারবে না এর ভেতরে তুলাছাড়া অন্য কিছু থাকতে পারে। ডলারের কারণে বালিশগুলির ওজন বেড়ে যায়। বিছানার একপাশে যত্ন করে এমন ভাবে রাখে যেনো কারো নজরে পড়লে বালিশগুলিতে যে ডলার আছে সেটা বোঝা না যায়।

সোহেল সোহরাব মিয়ার সাথে কথা বলছে। সোহরাব মিয়া বেটে টাইপের মানুষ, ঠোঁট পুরু গোঁফ, কাধে গামছা, পরনে সাদা লুঙ্গি শাদা শার্ট। মাথার চুল এমন ছাচে সিথি কেটে আচড়ানো যে বড় ধরনের কোন ঝড় তুফান না হলে তার চুলকে নাড়ানো যাবে না। সোহেলের সামনে সোহরাব মিয়া খাবার সাজাচ্ছে খুব যত্ন নিয়ে। হোটেলের একজন মেসিয়ারের সাথে কয়েকদিন খাবার আনা নেয়ার ব্যাপারে একজন বিশ্বস্ত লোক দেয়ার কথা বলেছিলো সোহেল। তারাই দুপুরের খাবারসহ সোহরাব মিয়াকে পাঠিয়েছে।

সোহেল সোহরাব মিয়ার কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে তাকে খাবার দাবার আনা নেয়ার ব্যাপারে নিয়োগ দেয়ার কথা ভাবছে। এখন সোহরাব মিয়া রাজি হলেই ব্যস। খাবার সাজিয়ে পানির জগ গ্লাস ধুয়ে
টেবিলে রাখতে রাখতে সোহরাব মিয়া বলতে থাকে, আপনার যখন যা লাগব আমি সোহরাব রে খালি ডাক দিয়া কইবেন। দেখবেন হাজির।
সোহেল হেসে, তোমার কাজ আমার খুব ভালো লেগেছে। তোমার মোবাইল আছে
আছে স্যার।
কল করা মাত্র এখানে এইভাবে খাবার পৌঁছিয়ে দিবে। বেতন আট হাজার, এর বাহিরে প্রতি অর্ডারের জন্য আলাদা টিপস পাবে। যা যা বললাম পারবে কি না ভেবে বল।
সোহরাব মিয়া প্রথমে অবাক, তারপর পা ছুঁয়ে সালাম করে বলে, আমার মত ভালো আর কেউ পারব না স্যার, ভাবাভাবির কিছু নাই স্যার। বিকালে কি খাইবেন হালকা না কি নান পরোটা টাইপের কিছু। রাইতের খাওনের অর্ডার কী স্যার এখনই দিবেন নাকি রাইতে?
আগে এখনকারটা শেষ করি। তারপরে যখন লাগবে তখন কল দিব।
আমি তাইলে এখন যাই স্যার?
-ঠিকাছে।
সোহরাব চলে যায়। সোহেল হাত ধুয়ে খেতে বসে।

বাবর ফুটা দিয়ে তাকায়, দেখে ওর চোখের সামনে দরজার ওপাশে সালাদ,
কাচ্চি, বিরিয়ানি, বোরহানি। সোহেল খাচ্ছে। বিরিয়ানি মুখে দিয়ে একটা কাচা মরিচ কামড় দেয়। বাবরের চোখ মুখ খাবার দেখে চক চক করে। খাবারগুলো বাবরের খুব কাছাকাছি শুধু মাঝে একটা দরজার আড়াল তাই ধরতে পারছে না। মনে হচ্ছে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সোহেল হচ্ছে। সোহেল খাচ্ছে সে নিরুপায় হয়ে দেখছে। খাশির চাপ এ একটা কামড় বসাতেই গোস্তের রোয়াসহ দেখা যায়। বাবর দেখছে, সোহেল আয়েশ করে খচ্ছে। খেতে খেতে বোরহানিতে চুমুক দিচ্ছে। মাঝে মাঝে হালকা তৃপ্তির ঢেকুর দেয়।
এইসব দেখতে দেখতে বাবরের খুব খেতে ইচ্ছা করে। একই সাথে সোহেলের উপর বাবরের জেদ চাপতে থাকে। সোহেল বাবরের সাথে এতবড় একটা মিথ্যাচার করে নিজেই সব টাকার মালিক হতে চেয়েছিল। অথচ কাল রাতেও সোহেলের যখন থাকার জায়গা পাচ্ছিল না বাবর থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বিপদে বাবরই সবার আগে দৌড়িয়েছে। সোহেলকে কেন্দ্র করে জীবনের অনেক স্মৃতিই বাবরের মনে আসতে থাকে আর জেদ বাড়তে থাকে। এই জেদ থেকে সে কঠিন সব সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্তের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে কল্পনায়, বাবর কল্পনা করে,
একটা রুমের ভিতর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের খাবার লোভনীয়ভাবে ঝুলিয়ে রাখবে। কোথাও আস্ত গ্রিল করা মুরগী, কোথাও রোস্ট করা রান, খাসির চাপ, গলদা চিংড়ি ফ্রাই, আপেল, আঙুর, কমলা, ছোট ছোট টেবিলে থরে থরে সাজানো বিরিয়ানি, রেজালা, মাছের ফ্রাই, মাছ ভুনা, আস্ত ইলিশ ফ্রাই, মিষ্টান্ন সাথে মোগলাই খাবার চাইনিজ খাবার ইত্যাদি পুরো রুম জুড়ে ।
সোহেলকে হাত মুখ বেধে হুইল চেয়ারে বসিয়ে, মুখ বাধা, হাত বাঁধা অবস্থায়, বিভিন্ন খাবারের কাছে নিয়ে যায়। ক্ষুধার্ত সোহেল খাবারের ঘ্রাণ শুকে মুখ উচিয়ে ঝুলন্ত খাবার খেতে চায়, সোহেলের মুখের চারপাশে খাবারগুলো ঝুলতে থাকে কিন্তু সোহেলের মুখ বন্ধ থাকার কারণে সে খেতে পারে না। হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করতে দেখা যায়, কিন্তু হাত বাধা থাকার কারণে পারে না, নিরুপায় হয়ে খাবারের জন্য মাথা নেড়ে মুখ দিয়ে আকার ইঙ্গিতে কিছু বলতে যায়। কিন্তু গোঁ গোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। খেতে চেষ্টা করে তাও পারে না, চারদিকে তাকায় অসংখ্য খাবার ঝুলছে, খাবারগুলো লোভনীয়ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে এক খাবার থেকে আরেক খাবারের দিকে হুইল চেয়ার নিয়ে ছুটতে থাকে। ক্ষুধার তাড়নায় সোহেল অস্থির হয়ে একের পর এক খাবারের দিকে পাগলের মত ঘুরতে থাকে। কিন্তু কোন ভাবেই খেতে পারে না।
আর বাবর তখন সোহেলকে দেখিয়ে দেখিয়ে আয়েশ করে খেচ্ছে।

তারপর একসময় বাবর সোহেলের চারপাশে খাবার নিয়ে ঘুরতে থাকে, সোহেলও বাবরের সাথে খাবারের আসায় ঘুরতে থাকে। বাবর তখন সোহেলকে দেখিয়ে দেখিয়ে আয়েশ করে খেতে থাকে আর হাসতে থাকে। বাবরের এইসব কল্পনা সোহেলকে শাস্তি দেয়াকে কেন্দ্র করে হলেও বাস্তবে বাবরের অবস্থা এখন কল্পনার সোহেলের মতোই। সামনে অজস্র খাবার কিন্তু খেতে পারছে না। অথচ তারই প্রিয় বন্ধু সোহেল খেয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত বাবর চেয়ে চেয়ে দেখছে, দেখা ছাড়া তার এখন আর কিছু করার নেই। বাবর দরজার ফুটা দিয়ে তাকায় দেখে সোহেল খেয়েই যাচ্ছে।

বাবর মাথায় রক্ত চড়ে যায়। রাগে দুঃখে ক্ষোভে অভিমানে ফুঁসতে ফুঁসতে মনে মনে বলে, খা খা। সেইদিন আর বেশি দূরে নাই যেইদিন আমিও তোকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাব আর তুই তখন খাওয়ার জন্য চরকির মত ঘুরবি, কিন্তু খেতে পারবি না।

তারপর বাবর ফুটা থেকে চোখ সরিয়ে হাসতে হাসতে সুটকেসের কাছে যায়, শুন্য সুটকেসটা হা হয়ে আছে দেখে কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, তোর মতই হা করে থাকবে সোহেল আর আমি সেটা তাকিয়ে তাকিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখব। বলতে বলতে সেটা বন্ধ করে।
বাহিরে তখন কাকের কা কা কা ধ্বনি স্পষ্ট শোনা যায়। সোহেলের ছুড়ে দেয়া খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ নিয়ে কাকদের কলরব শুনছে বাবর। বাবর পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে মুখে দেয়।
টিভিতে প্লট ও ফ্লাট বিক্রির বিজ্ঞাপন চলছে। সোহেল মনোযোগ দিয়ে বিজ্ঞাপনটা দেখে। মোবাইলে ইন্টারনেটে ঢুকে বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানীর নামসহ ফোন নম্বর ডাউনলোড করে, হাউজিং কোম্পানির ওয়েব সাইটে ঢুকে তাদের নম্বর নিয়ে ফোনে কথা বলে। এটা কি ব্রডওয়ে আবাসিক মডেল টাউনের, জ্বী জ্বী আমি কিছু ইনফর্মেশনের জন্য,… পাঁচ কাঠার প্লটগুলো আপনারা কিভাবে বুকিং নিচ্ছেন………… আচ্ছা বুঝলাম……… ধরুন আমি যদি ৮টা প্লট একসাথে আই মিন চল্লিশ কাঠার পুরোটাই নগদ দিয়ে দিতে চাই, সে ক্ষেত্রে আপনারা আমাকে কি কি ফ্যাসিলিটি দিতে পারবেন। ঠিক আছে তাহলে আপনাদের হেড অফিসের এড্রেসটা আর যার সাথে কথা বলবো তার নম্বরটা মেইল করে দিন। ওকে।

বাবর সোহেলের কথা শুনে দরজার ফুটা থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে হাসে, আর মোবাইলে সোহেলের ছবি বের করে সোহেলের ছবির দিকে তাকিয়ে ডলার ভর্তি বালিশগুলো ছবিটাকে দেখিয়ে সোহেলের ছবিটার উদ্দেশ্যে এমন ভাবে কথা বলতে থাকে যেন জীবন্ত সোহেলকেই ফিসফিস করে কথাগুলো বলছে।
কোনভাবেই তুই আর এগুলো স্পর্শ করতে পারবি না প্রয়োজনে জানবাজি। সবাই সব পাইলেও হজম করতে পারে কয়জন। তুইও পারবি নারে বেকুব।
এরপর বাবর কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা চুইনগাম মুখে দিয়ে চাবাতে চাবাতে ভাবে, জীবন এভাবে না জীবন কাটাতে হবে মৌজ মাস্তি আর তানা নানা করে।

সকালে ব্রেকফাস্ট ঢাকায়, ব্রেকফাস্ট করে প্লেনে কলকাতা, সেখানে কেনা কাটা লাঞ্চ সেরে ভুটান বা মালদ্বীপে পাহাড়ের চূড়ায়, বা সমুদ্রের কিনারে বসে ক্যাম্পফায়ার ডিনার। মাঝে মাঝে প্যারিস লাসভেগাসে ক্যাসিনোয়, তিন তাসের জুয়ায়, তারপর যখন যেখানে খুশি, যাকে তাকে নিয়ে অজানায় উড়াল। শালার টাকা থাকলেই হয় না, খরচ করতেও জানতে হয়। এরকম যত স্বাদ আছে অপূর্ণ সব পূরণ করতে হবে এক এক করে। এভাবে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হয়, মন কি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। যাক, যাক না, টাকা হলে মনতো একটু এলোমেলো হবেই। তা না হলে, টাকার উত্তাপ কোথায়? প্রাপ্তির আনন্দ কোথায়? অলি গলি পেরিয়েই তো বড় রাস্তা।

এলোমেলো হয়েই তো সঠিক পথের সন্ধান পেতে হবে। তাতে করে খরচের খাতায় কিছুটা বেশি চলে যাবে মনে হলেও কিন্তু অভিজ্ঞতার জায়গায়ওতো অনেক জমা পড়বে। সে হিসাব করলে সমানে সমান। ডলারগুলো রাখা বালিশগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, বালিশ গুলোর উপর হেলান দিয়ে বসে রুমটার চারদিকে তাকায়, সামনের দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে ভাবে সামনে শুধু একটা দেয়াল মাত্র। এই দেয়ালের ওপাশে যেতে পারলেই, সমাজ সংসার, মান সন্মান, সুন্দর সুন্দরী সব আমার সাথে আমার ইচ্ছামত পেছনে পেছনে ঘুরবে। স্রেফ ইট বালু সিমেন্টের একটা সামান্য দেয়াল শুধু মাঝে বাধা পড়ে আছে। এই দেয়ালটা পার হতে পারলেই ব্যস। বলে শব্দহীন অট্টহাসি দিয়ে সোহেলের ছবির উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, আর তুই চেয়ে চেয়ে দেখবি। বলে বাবর জানালার কাছে যায়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে দূরে মানুষজন গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। হঠাৎই বাবরের মনে হয় নির্বাচনও তো করা যায়।
ভাবতেই চোখের সামনে একটা প্লেকার্ড নাচতে থাকে, প্লেকার্ডে লেখা “বাবর ভাই এগিয়ে চল আমরা আছি তোমার সাথে।” জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার মতো করে বাবরও হাত পা নেড়ে শব্দহীন কথা বলতে থাকে। আর অজস্র মানুষজন বাবরের হাত উঁচিয়ে ভাষণের সাথে সাথে হাত তালি দিতে থাকে। যদিও বাবরের এইসব কল্পনা তার বাস্তব ভাবনায় খুব একটা আশকারা পায় না, শুধুই উঁকি ঝুঁকি দিয়ে একধরনের আত্মতৃপ্তি দেয় শুধু।

সোহেল হিটারে পানি গরম করে। কাপে চিনি ও কফি সাথে গরম পানি ঢালে।
চামচ দিয়ে নাড়ে অনেক্ষণ আনমনে।
চামচ দিয়ে নাড়ার শব্দে বাবর দরজার কাছে এসে ফুটা দিয়ে তাকায়।
সোহেল কফির প্যাকেটটা ফেলে, কাপটা নিয়ে মোবাইলে কল করে কফি খেতে খেতে কথা বলে, আচ্ছা আপনারা কোন এসিটার ক্ষেত্রে থার্টি পার্সেন্ট অফ ঘোষণা করেছেন। ধরুন আমি যদি এসি, রুম হিটার, আইপিএস একসাথে নেই সেক্ষেত্রে আমাকে আপনারা কি কি ফ্যাসিলিটি দিতে পারবেন।
বাবর সোহেলের কথাগুলো শুনতে শুনতে রুমের সিলিং ফ্যানের দিকে তাকায়, তার শারা শরীর ঘর্মাক্ত। ফ্যান ছাড়তে গিয়েও ছাড়ে না, যদি আওয়াজ হয় সেই আওয়াজে যদি সোহেল টের পেয়ে যায়। তার চেয়ে কিছু সময় ধৈর্য ধরে কষ্ট করে কাটিয়ে দেয়াই উত্তম।
সোহেলের মোবাইল কলে এসি কেনার কথা শুনে বাবর রাগে গজগজ করতে থাকে আর বাস্তবে এখন কিছুই করতে না পারলেও কল্পনায় ঠিকই কিছু না কিছু করতেই থাকে।

ছাদের উপর সোহেলকে বেঁধে রাখা হয়েছে। প্রচণ্ড রোদ। মাথার উপর সূর্য। মুখ দিয়ে টপ টপ করে ঘাম ঝরছে, মুখে টেপ মেরে বন্ধ করে দেয়া। সারা শরীর ঘর্মাক্ত। সোহেল করুন চাহনি নিয়ে তাকিয়ে দেখে বাবর আসছে, বাবরের মাথায় একজন ছাতা ধরে আছে। আরেকজন ট্রে নিয়ে পাশে পাশে হাঁটছে তার ট্রেতে আইস, লেবুর সরবত, বাবর সোহেলের খুব কাছে গিয়ে লেবুর সরবতের গ্লাসে আইস ছাড়ে। আইসটা ভাসছে, সোহেল লোভাতুর চোখে চেয়ে আছে গ্লাসটার দিকে। সোহেলের মুখাবয়ব থেকে টপাটপ ঘাম ঝরছে। সোহেলের চোখ বরফ ও লেবুর শরবতের দিকে তাকিয়ে চকচক করছে। বাবর সোহেলের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,
“গরমে এসির হাওয়া, ঠান্ডা ঠান্ডা। শীতে রুম হিটার শরীর গরম রাখতে চাঙ্গা চাঙ্গা”
বলে হাসতে হাসতে লোক দুইজনকে ইশারা করতেই তারা প্রচণ্ড গরম সত্ত্বেও সোহেলের সারা শরীর কম্বল জড়িয়ে দেয়। মাথায় উলের টুপি পরায়। সোহেল কিছুক্ষণ রাগে ক্ষোভে গাইগুই করে তারপর বাবরের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, বাবর সোহেলের অসহায়ত্ব দেখে হাসতে থাকে।
পার্কের মধ্যে লোকজন আগুন পোহাচ্ছে। প্রচণ্ড শীতে কাপতে কাপতে দিনমজুর লোকজন যখন কেউ চাদর জ্যাকেট, স্যুয়েটার পরেও শীত থেকে বাঁচতে পারছে না, কুণ্ডলী পাকিয়ে আগুনের উত্তাপ নিচ্ছে। সোহেলকে তখন দেখা যাবে একটা গাছে বেধে রাখা হয়েছে শুধু একটা স্যান্ডো গেঞ্জি ও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরিয়ে। তার মাথার উপর বরফ খণ্ড থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঠান্ডা পানি পড়ছে। সোহেল শীতে কাপতে থাকে আর বাবরকে দেখা যায়। হাত মোজা পা মোজা পরা, লং কোট পরে গলায় মাফলার পেঁচিয়ে আরামে একটা চেয়ারে বসে ধোয়া ওড়ানো কফিতে চুমুক দিতে দিতে বাবর সোহেলের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, শীতে গরম, গরমে আরাম। খুব আরাম করছো।
এইবার একটু বলে ইশারা করতেই দুজন লোক সোহেলের পেছনে ডানে বামে তিনটা ষ্ট্যান্ড ফ্যান ছেড়ে দেয়। সোহেল প্রচণ্ড শীতের কাঁপুনিতে মরিয়া হয়ে কিছু বলতে চায়, কিন্তু মুখ বাধা থাকায় শুধু গোঙানির শব্দ ভেসে আসে।
বাবর তখন কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাসতে থাকে উচ্চস্বরে। সেই হাসি পার্কের আশেপাশে লোকজনের অদ্ভূত চাহনিতে বাতাসে ভাসতে ভাসতে কল্পনার সমস্ত জায়গা ঘুরে বাবরের রুমে ফিরে আসে। সোহেলকে কল্পনায় কষ্ট দিতে পেরে কল্পনা থেকে বাস্তবেও বাবর হাসতে থাকে শব্দহীন। তারপর কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে তার নিজের শরীরের দিকে চেয়ে দেখে তার শরীর প্রচণ্ড ঘেমে গেছে। আলনা থেকে একটা কাপড় নিয়ে শরীরের ঘাম মুছে আবার সেটা দিয়েই বাতাস করে। বাবর উঠে পানির জগ হাতে নেয়, জগের তলানীতে সামান্য পানি, সেই পানিতে ময়লার আবরন দেখতে পেয়ে পানিটা খেতে গিয়েও খায় না। বালুর স্তরে বাবর সেই বালু ফু দিয়ে সরিয়ে পানি খায় বেশ খানিকটা। বাবর ফুটা দিয়ে বারান্দায় তাকিয়ে দেখছে।

সোহেল হেঁটে হেঁটে কথা বলছে। হ্যাঁ হ্যাঁ ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটটা আমি নিচ্ছি। গুলশান বনানীর গুলোর কি অবস্থা বলেনতো আচ্ছা নিকেতনের ওগুলো কত স্কয়্যার ফিট । প্রাইস কত । ঠিক আছে আমি দুই দিনের মধ্যে আসছি।
বাবর সোহেলের কথাগুলি শুনে শব্দহীন বলতে থাকে কার কাছে টাকা আর কে করে জমিদারি। কর্নারে রাখা টাকার বালিশটার উপর ঘুমায়। ঘুমের ভেতর বাবর দেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের উল্টাপাশে জনতা ব্যাংকের ছাদে দাঁড়িয়ে সে চারপাশ দেখছে। অগণিত লোকজন কেউ হেঁটে, কেউ রিকশায়, কেউ বাসে, কেউ প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস বিভিন্ন দিকে ছুটছে। কার যে গন্তব্য কোথায় কে জানে, হঠাৎ বাবরের মনে হল সবার গন্তব্যকে সে চাইলেই এখন একমুখী করে দিতে পারে। যেই ভাবা সেই কাজ।
উপর থেকে প্রথমে কয়েকটা ডলার নিচে ছুড়ে দেয়, কিছু লোক পায়, কেউ তাকায় দেখে একশ ডলারের নোট। সবাই উপরে তাকায়, বাবর তখন উপর থেকে আরো বেশ কিছু ডলার নিচে ফেলে, এবার ডলার নিয়ে নিচে তুলকালাম কান্ড বেধে যায়। বাবর বেশ মজা পাচ্ছে। মজা পেয়ে বাবর আরও ডলার ছুড়তে থাকে। আর নিচে রিকশা, গাড়ি বাস সব কিছুর মধ্যে রাস্তায় ডলার ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে, বাতাসে ডলার উড়ছে। একশ ডলারের নোট। একশ ডলার মানে প্রায় আট হাজার টাকার মত। যে যেভাবে পারছে ছুটে যাচ্ছে একচান্সে আট হাজার টাকা ধরতে। পুরা এলাকা জুড়ে তীব্র জানজট, একেক গাড়ির একেক রকমের হর্ন, মানুষের কোলাহল, হৈ চৈ, থেকে একসময় ডলার নিয়ে কাড়াকাড়ি, মারা্মারি, দৌড়াদৌড়ি, পুলিশের লাঠি চার্জ, কাঁদানে গ্যাস, ব্যাপকভাবে ছুড়ছে, যাচ্ছেতাই অবস্থা চলছে, এবার উত্তেজিত জনগন গাড়ির কাচ বিল্ডিইংয়ের গ্লাস ভাঙছে, ভাঙচুরের শব্দে ঘুমের মধ্যে থেকে লাফিয়ে উঠে বাবর। লাফিয়ে উঠেও শুনতে পায়, ভাঙচুরের শব্দ। বাবর আসে পাশে তাকায় জানালার কাছে যায়।

 

একটু আগের ঘুমের ঘোরে ভাঙচুরের স্বপ্ন আর এখন জেগে ওঠা ভাঙচুরের শব্দে ভয়, আতঙ্ক, নিয়ে পানি খেতে যায়, জগের পানির উপর থাকা ময়লার স্তরে ফু দিয়ে সেই ময়লা পানিই কিছু পান করে। আবার ভাঙচুরের শব্দ হতেই কেঁপে ওঠে বাবর, চারদিকে তাকায়। খুব সাবধানে দরজার দিকে পা বাড়ায়।
এদিকে প্রচণ্ড ভাঙচুরের শব্দে সোহেলও ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে। চোখে মুখে ভয় আতঙ্ক। সোহেল বারান্দায় তার খাটের নিচে তাকায় কেউ নেই। বারান্দার দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

বাবর দরোজার ফুটা দিয়ে সোহেলের বিছানা খালি দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ে।সোহেল ততক্ষণে বারান্দার দরোজার তালা ভালো করে চেক করে। টর্চের আলোয় ভালো করে বাড়িটার আশেপাশে তাকায়। টর্চের আলোয় রাতের অন্ধকার ভেদ করে সবকিছু সময় নিয়ে ভালো করে দেখে। বাহিরে তেমন কিছুই চোখে পড়ে না, সব নীরব ঠিকঠাক আছে।

তাহলে বিষয়টা কি? সোহেলের চোখে মুখে আতঙ্ক, ঘরে ভেতরের দরজায় কান পাতে, ঘরের ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসছে কি না। দরজা থেকে এসে নিজের বিছানার কাছে যায়। বাবর ফুটা দিয়ে দেখে, সোহেল বিছানার তোষক উল্টিয়ে চাবি নিচ্ছে। তারপর সোহেল সেই চাবি হাতে বাবরের দরজার দিকে এগিয়ে আসছে। বাবরের শীরায় টান টান উত্তেজনা। তার মানে সোহেল কি এখন এই রুমের তালা খুলবে? তাহলে তো ধরা পড়ে যাবে? ধরা পড়ার ভয়, আবার ডলারগুলো নিয়ে ছুটে বেরিয়ে পড়ারও একটা দারুণ সুযোগ। দুইটার যে কোনটাই ঘটে যেতে পারে।

এই সব ভাবনা থেকেই ফুটা থেকে চোখ সরিয়ে বাবর দরজা ঘেঁষে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেনো সোহেল দরজা খুললেই তাকে দেখতে না পারে। পুরানা আমলের দরজার বড় পাল্লার সাথে সেও দরজার আড়ালে মিলিয়ে যাবে। দরজা খোলা এবং বন্ধের সময় তাল মিলিয়ে শরীরটাকে চালালেই হবে। সোহেল চাবি দিয়ে দরজা খোলে। রুমের ভেতরে টর্চ মারে প্রথমে। সুটকেসটার দিকে টর্চ ধরে রাখে বেশ কিছুক্ষণ। দরজার আড়াল থেকে বাবর তখন ভাবে, সোহেল কেন এতক্ষণ সুটকেসটার দিকে টর্চ মেরে রেখেছে। সোহেল কি সুটকেসটার দিকে যাবে না কি? বাবরের ভাবনার মাঝেই সোহেলের টর্চের আলো তখন খাটের নিচে চলে যায়, তারপর জানালাটার দিকে টর্চ মেরে দেখে নিয়ে, নিজে নিজেই বলে, সবতো ঠিকই আছে মনে হয়। জানালার ঐপাশে কি কিছু আছে কি না।

একবার দেখে আসি তো, বলে রুমের ভেতরের দিকে পা বাড়ায়। বাবর সোহেলের কথাটা শুনে আঁতকে ওঠে। চোখে মুখে আতঙ্ক, কি হবে এখন ধরা কি পড়েই যাবে? সোহেলের ছায়াটা দরজা দিয়ে রুমে ঢুকছে কেবল। এমন সময় আরেকটা দ্রুমদ্রাম করে ভাঙচুরের বিকট শব্দ আসে। শব্দটা যে সোহেলের পেছন থেকে আসছে, এটা সোহেল স্পষ্ট বুঝতে পারে। সোহেল দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে বারান্দার দিকে ঘুরে তাকায়। কেউ নেই বারান্দায়। সোহেল রুমটায় দ্রুত তালা মারে। ভাঙচুরের শব্দ হতে থাকে একের পর এক।
রুমে তালা দেয়ায় বাবরের স্নায়ু স্বাভাবিক হলেও ক্রমাগত ভাংচুরের শব্দে চোখ বন্ধ করে আবার খোলে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। চোখের পাতা চারদিকে নাড়িয়ে বুঝার চেষ্টা করে, চোখ বন্ধ করে আবার খুলে তাকায়। কানে আঙুল দেয়। কি হচ্ছে বাহিরে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। ফুটা দিয়ে তাকায় ভয় আতংক নিয়ে। শব্দ হচ্ছেই।

একটু পর সোহেল দেখতে পায় টিভিতে হরর ছবি হচ্ছে, সেই ছবিতে ভৌতিক একটা অবয়ব একটা ঘরের ভেতরে একজনকে ধরতে যাচ্ছে। আর সেই একজন ভৌতিক অবয়বটা থেকে বাঁচতে ঘরের চেয়ার টেবিল আলমারি কাচের জিনিসপত্র, যা পাচ্ছে হাতের কাছে তাই ছুড়ে মারছে, টেনে ফেলে ব্যরিকেড দেয়ার চেষ্টা করছে। এটা থেকেই একটানা ভাঙচুরের শব্দ হচ্ছে দেখে সোহেল টিভিটা বন্ধ করে, সাথে সাথেই হরর মিউজিকসহ ভাঙচুরের শব্দটা উধাউ। চারপাশ সব শান্ত, নীরব, কিছুটা সময় চুপ হয়ে বসে সোহেল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ে।
চারপাশ নীরবতার মাঝে হঠাৎ পানি পড়ার শব্দ হয়। বাবর অবাক হয়ে ফুটা দিয়ে তাকিয়ে দেখে।
সোহেল কিছুটা নার্ভাস হয়ে গ্লাসে পানি ঢালছে, খাচ্ছে। সোহেল পানি খাওয়া শেষে বিছানায় জাম্প করে রিলাক্সমুডে।
সোহেলকে দেখে বাবরেরও পানির পিপাসা পায়। ঘরের কোনে রাখা জগটার দিকে এগিয়ে যায়, মনে পড়ে পানির উপর ময়লার স্তর জমে থাকার কথা, পানি না খেয়ে বাবর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

পরদিন সকালে সোহরাব মিয়া দৌড়ে আসে। সোহেল বারান্দার তালা খুলতে খুলতে অনেকটা বিরক্তির সাথে বলে,
আরে সোহরাব মিয়া তোমারে নিয়াতো আরেক ঝামেলায় পড়লাম। কিছু কইলে ঠিকমত বুঝ না। কইলাম তাড়াতাড়ি আসতে। তুমি আসছো এখন।
কন স্যার কি করতে হইবো।
এখন আর কোন কিছু করতে হবে না আমার সাথে চল।
কই
আমি যেখানে যেতে বলবো সেখানে, কেন কোন সমস্যা আছে?
না স্যার কোন সমস্যা নাই তয় আগে কইলে প্রস্তুতিটা থাকে একরকম আর পরে কইলে আরেক রকম।
তোমার কোনরকম প্রস্তুতির দরকার নাই। তুমি শুধু আমার সাথে যাবে আর আসবে। পারবে?
পারুম না সেইটাতো একবারও কই নাই স্যার তয় বলে আমতা আমতা করতে থাকলে, সোহেল বিরক্তির সাথে বলে, আর একটা কথা বলবে না। গেলে চল, না গেলে বল।
গতকাল সকালে খাওয়ার পর সারাদিন সারারাত না খেয়ে খিদা ও পিপাশায় কাতর বাবর শুয়ে ছিলো ডলার ঢুকানো বালিশে হেলান দিয়ে। হঠাৎ সোহেলের শেষ কথাগুলো বাবরের কানে গেলে বাবর জেগে ওঠে, কথাগুলো ভালো করে শুনে, বুঝতে পারে সোহেল কারো সাথে বাহিরে যাচ্ছে। বাবর ফুটা দিয়ে তাকায়। কেউ নেই। বারান্দার গ্রিলের তালা খোলার ও বন্ধ হওয়ার শব্দ হতেই বাবর খুশি হয়ে ওঠে।সোহেল বারান্দার তালা খুলে বেরিয়ে আবার তালাটা বন্ধ করে ভালো করে টেনেটুনে দেখে সিঁড়ি ভেঙে নিচে চলে যায়।

সিঁড়ি দিয়ে নামার শব্দ পেয়েই বাবর বুঝতে পারে ওরা চলে গেছে। ফুটা থেকে চোখ সরিয়ে দ্রুত দরজা খোলার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে, বুঝতে পারে দরজা খোলার চেষ্টা না করে বরং জানালার গ্রিল ভাঙাটা সহজ হতে পারে। আর তাছাড়া এই দরজা ভাঙার পর আবার বারান্দার তালা ভাঙতে হবে। তার চেয়ে কত দ্রুত জানালার গ্রিলটা ভাঙা যায়, সেটাই এখন চেষ্টার বিষয়। প্রথমে তাকিয়ে দেখে জানালার বাহিরে কাউকে দেখা যাচ্ছে কি না। না আপাতত জানালার ধারে কাছে কেউ নেই দূর থেকেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। টেনশন ও উত্তেজনায় বাবরের মুখাবয়ব ঘামতে থাকে। জানালার গ্রিলগুলোকে হাত দিয়ে চেপে ধরে বাকা করার চেষ্টা করে, তারপর কাঠের স্ট্যান্ডটা জানালার একপাশের গ্রিলের ভেতর ঢুকিয়ে চাপ দিয়ে বাকা করার চেষ্টা করে। খুবই সামান্য বাকা হয়। এভাবে আরো কিছুক্ষণ চেষ্টার পর আরো সামান্য কিছুটা বাকা হয়। কিন্তু প্রচণ্ড ক্ষুধা আর ক্লান্তির কারণে সে হাঁপিয়ে ওঠে। হঠাৎ বারান্দায় কারো আসার আওয়াজ
পাওয়া যায়, বাবর ঐ অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে যায়, ধীরে ধীরে খুব সাবধানে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। ফুটা দিয়ে তাকায়।

তালা খুলে বারান্দায় ঢুকে আবার তালাটা ভালো করে লাগিয়ে হাতে একটা বেশ বড় সাইজের প্যাকেটে সফট ড্রিংস পানির বোতল, ঔষধের প্রেসক্রিপশনসহ সোহেল বিছানায় বসে। হাতের ঠোঙা থেকে আপেল বের করে খায়, কিছু আঙুর ও কমলা বের করে পাশে রাখে, সফট ড্রিংসের বোতলসহ আরো কিছু প্যাকেট ফ্রিজে ঢুকায়। একটা ছোট পানির বোতল বের করে রাখে। ঔষধ খুঁজতে থাকে, বিছানায় প্রেসক্রিপশন বের করে রাখে, কোথাও ঔষধ খুঁজে না পেয়ে ফোন করে।
সোহরাব মিয়া ঔষধগুলাতো পাইতাছি না।
ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে সোহরাব মিয়া বলে,
স্যার ঔষধতো আমার কাছে।
ধুর মিয়া তুমি আমারে ঔষধগুলা মনে করায়া দিবা না। তাড়াতাড়ি দিয়া যাও। না থাক তুমি নিচে দাঁড়াও, আমিই আসতাছি। আমার আরো কিছু জিনিস কেনা বাকি আছে। একবারেই কিনে আনব। তুমি দাঁড়াও, আমি আসছি।

বাবর কথাগুলি ভালো করে শুনে। সোহেল ফোনটা রেখে নিচে নামার সময় ভাবে। এই ভাবে বারবার উঠানামা তালামারা তালা খোলা ব্যাপারটা কেমন নিজের কাছেই সন্দেহজনক মনে হয়। অন্যরা কি ভাবে কে জানে।

বাবর সোহেলের ফোনের কথাগুলো ভালো করে শুনে ফুটা দিয়ে সোহেলকে উঠে যেতে দেখে। বাবর দ্রুত জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়, তালা খোলার ও বন্ধ করার শব্দের অপেক্ষায় থাকে। একটু পরই বারান্দা থেকে তালা খোলা ও বন্ধের শব্দ আসে। তার মানে সোহেল রুমে নেই যা করার এক্ষুণি যত দ্রুত সম্ভব করতে হবে। বাবরের চোখে মুখে উত্তেজনা, কাঠের ষ্ট্যান্ডটা দিয়ে নিজের দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে চাপ দেয়। বেশ কিছুটা বাকা হলেও এই বাকার কারণে জানালার গ্রিলের ফাঁকটা যতটুকু হয় ততটুকু দিয়ে বের হওয়া যাবে না ভেবে আরো কিছুটা বাকা বা ভেঙে ফেলতে পারলে সবচেয়ে ভালো হবে।

যে করেই হোক এখনই করতে হবে, এখনই সময়। যেই ভাবা সেই কাজ। আবার চেষ্টা চালায় গ্রিল বাকা হচ্ছে আরো জোরে আরো কিছুটা হবে হবে করছে, বাবর তার শরীরের সর্বশক্তি ব্যবহার করছে, যে করেই হোক এই সুযোগ ছাড়া যাবে না, যত শক্তি আছে চাপ দিতে হবে, দিচ্ছেও সময় হাতে বেশি নেই যে কোন সময় সোহেলের তালা খোলার আওয়াজ কানে চলে আসতে পারে তার আগেই কাজ সারতে হবে এমন উত্তেজনায় হঠাৎই কাঠের ষ্ট্যান্ডটা ভেঙ্গে যায়। বাবরও পড়ে যায়। পড়ে গিয়ে অবাক এবং হতাশ হয়ে ভাঙা স্ট্যান্ডটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুহূর্তেই আবার হতাশা দূর করে আশা নিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। কারণ সোহেল যে কোন সময় চলে আসতে পারে। আবার ভাঙাটা দিয়ে চেষ্টা করতে যাবে এমন সময় হঠাৎ বেশ শব্দ করে মোবাইলটা বেজে উঠতেই বাবর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়।

ফোনের শব্দ সাথে সাথে কমিয়ে দিয়ে দেখে সোহেলের ফোন। সাথে সাথেই ফোন কেটে দিয়ে রিংটোন অফ করে। দ্রুত দরজার কাছে এসে ফুটা দিয়ে তাকায় সোহেল আসছে কি না দেখতে। দেখে বারান্দা খালি। আবার কল আসে বাবর সাইল্যান্ট করা ফোনটার দিকে তাকায় সোহেলের ফোন। বাবর ফোনটা রিসিভ করে না। কিসের যেনো খচখচ আওয়াজ ক্রমশ বাড়তে থাকে বাবর অবাক হয়ে খোঁজে আওয়াজটা কোত্থেকে আসছে। ঘরের ভেতর থেকে না, দরজার কাছে গিয়ে দেখে দরজার ওপাশ থেকেও না। তাহলে কোথা থেকে! এখন শুধু খচ খচ না সেই সাথে আরো কিছু আওয়াজও আসছে। বাবর জানালা দিয়ে তাকায়, দেখে জানালার ঠিক নিচে একটা কাগজ কুড়ানো ছেলে কাগজ ও কাগজের সাথে বিভিন্ন ধরনের জিনিস কুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকেই শব্দটা আসছে।
এমন সময় সোহেল গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার সময় মোবাইলে ম্যাসেজ লিখতে থাকে। বাবরের মোবাইলটা জলে ওঠে ম্যাসেজ আসছে। বাবর ম্যাসেজ ওপেন করে।
বারান্দায় তখন সোহেলের তালা খোলার শব্দ হয়।
বাবর দেখে সোহেল ওকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। বাবর দারুণ কৌতূহলি হয়ে সোহেলের পাঠানো ম্যাসেজটা পড়ছে, দোস্ত ডোন্ট মাইন্ড। আমি আমার গ্রামের বাড়িতে ভীষণ জরুরি একটা কাজে আটকা পড়ে গেছি। আমার আসতে বেশ কিছুদিন সময় লাগতে পারে। তবে তোকে একটা ভাল সংবাদ দেই, আমি তোকে বেশ কিছু টাকা দিতে চাই, তুই একটা বিজেনেসের লাইন কর। কত লাগবে আর কী করতে চাস পারলে বলিস।

বাবর ম্যাসেজ পড়ে ক্ষেপে গিয়ে মনে মনে বলে, সোহেল আমার সাথে এতবড় মিথ্যা কথা, এত বড় চালাকি করছে। আমার আবিষ্কার আমাকে না জানিয়ে একলা হজম করার ধান্দা করে এখন আমাকেই দান খয়রাত দিতে চাস। এত বড় সাহস।

এবার নিজেও সোহেলের উদ্দেশ্যে ম্যাসেজ লেখা শুরু করে।

সোহেল বাবরের ম্যাসেজ দেখে বেশ অবাক তারপর পড়তে থাকে খুব উৎসাহ নিয়ে।

দোস্ত ডোন্ট মাইন্ড। তুইতো ফকিন্নি, এই শহরে তোরা হলি উদ্বাস্তু, তোরা টাকা পাবি কই? অবশ্য ল্যাংড়া, লুলা কিংবা অন্ধ ফকির হইলেও না হয় একটা কথা ছিলো, রাস্তার পাড়ে বসায়া দিতাম। লেংড়া ,লুলা ফকিরদের আয় রোজগার কিন্তু খারাপ না। চাইলে তোরেও বানায়া দিতে পারি।

ম্যাসেজ পড়ে সোহেল ম্লান হেসে, শালায় আমার কথাটা বোধহয় বিশ্বাস করে নাই। আবার লিখতে শুরু করে। বাবর ডলার ভর্তি বালিশের উপর শুয়ে শুয়ে ম্যাসেজ পড়ছে, সোহেল লিখেছে, আরে শালা ফান করছি না। সিরিয়াসলি বলছি, টাকা পয়সা এখন কোন ঘটনা না তোর জন্য বেশ কয়েক লাখ টাকা বাজেট করা হয়ে গেছে। চাইলে যে কোন সময় দিতে পারি।

বাবর ম্যাসেজ পড়ে আরো খেপে যায়, তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ডলারের বালিশটাতে ঘুসি মারতে মারতে বলতে থাকে। কার হাতে টাকা বাজেট করে কে? তোরে আমি এমন সাইজ করুম যাতে জীবনে কোনদিন আমার কথা ভুলে না যাস।

সোহেল বারান্দায় হাটতে হাটতে ম্যাসেজ পড়ছে ।বাবর লিখেছে, তোরে বাজেট করার জাতীয় দায়িত্ব কান্ধে নিতে কে কইছে। তোর সাহস দিন দিন বাইড়া যাইতাছে । অবশ্য আজ কাল চারদিকে মফস্বলীয় মফু অকিন্নি ফকিন্নিগই চোটপাট বেশি। শোন আমি হলাম সেই রাজা যে ধন সম্পদ হারায়, কিন্তু রাজত্ব হারায় নাই। এখনো যা আছে তাতে করে তোর মত দুই চাইর দশ বিশটার গোষ্ঠী সারাজীবন চালানোর ক্ষমতা রাখি। কথাটা আজীবন মনে রেখে কথা বলবি।

বাবর দরোজার কাছে বসে ফুটা দিয়ে সোহেলকে দেখতে দেখতে ম্যাসেজ পড়ছে।

সোহেল লিখেছে, ফুটপাতে ছিরা কাথায় শুইয়া চান্দের আলোয় অনেকেই স্বপ্ন দেখে, চায়ের দোকানে বইসা অনেকেই বিশ্ব শান্তির সব সিদ্ধান্ত দিয়া ফেলে। তোর অবস্থাও দেখছি ঐরকম। শালা চাইলাম সিরিয়াসলি তোকে কিছু টাকা হেল্প করতে আর তুই কিনা বিশ্বাস না করে উলটা……

সোহেল বিছানায় শুয়ে শুয়ে ম্যাসেজ পড়ছে
বাবর লিখেছে, হেল্প! বিশ্বাস! শোন তোর মতো কিছু জাত চাপাবাজ পোলাপান আমার খুব দরকার। যারা সারাজীবন এই শহরে অন্যের সাহায্য নিয়ে চলে, তারপর তাকেই ল্যাং মেরে উপরে উঠার স্বপ্ন দেখে। টয়লেট মানে পায়খানা পরিষ্কার করার কাজে আমি তোর মত এইরকম কিছু পোলাপানের চাকরির ব্যবস্থা করছি। তোর সিভিটা পাঠায়া দিস। টয়লেট পরিষ্কারের কাজে তোকে যা বেতন দিব তোর চৌদ্দগুষ্টিও একসাথে এত টাকা দেখা তো দূরের কথা কল্পনাও করে নাই। আশাকরি বিষয়টা পরিষ্কার হয়েছে।

ম্যাসেজ পড়ে সোহেল রাগে বিছানা থেকে লাফিয়ে ওঠে। মোবাইল ছুড়ে মারে।

বাবর দরোজার ফুটা দিয়ে তাকায়। ফুটা দিয়ে দেখে সোহেল একটা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আরেক হাতের তালুতে ঘুষি মারতে মারতে জোরে জোরে বলতে থাকে।

নাহ শালার কেন যে হেল্প করতে চাইলাম। মেজাজটাই খারাপ করে দিলো। শালারে এই মুহূর্তে সামনে পেলে থাপড়ায়া সব দাঁত ফালায়া দিতাম। এই শালার মত চিটার বাটপারে শহরটা ভরে গেছে।
বাবর কথাগুলি শুনে সেও ক্ষেপে গিয়ে ফুটা দিয়ে তাকিয়ে মনে মনে বলতে থাকে, খাড়া জাষ্ট এইখান থিকা বাহির হইয়া লই। তারপর কে কারে চড় থাপ্পড় মারে সেটা দেখা যাবে। কে চিটার কে বাটপার আর এইসবের পরিণাম কি ভয়াবহ হতে পারে সেটা কড়ায় গণ্ডায় টের পাবি।

সোহেলের মাথা গরম হয়ে যায়, পায়চারি করতে থাকে। মাথাটা কোন ভাবেই ঠান্ডা হয় না দেখে, প্রেসক্রিপশনটা দেখে একটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে নেয়। টিভি ছেড়ে শুয়ে শুয়ে দেখতে দেখতে ঘুমানোর চেষ্টা করে।

বাবর একটা কিছুর হালকা শব্দ শুনে জানালার কাছে যায়, কাগজ কুড়ানো ছেলেটাকে আবার দেখতে পায়। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ভাবে। ফিরে এসে কিছু ডলার নিয়ে আবার জানালার কাছে যায়। একটা ডলার নিচে ফেলে কাগজ কুড়ানো ছেলেটার পেছনে ডলারটা পড়ে সে সেটাকে কাগজ ভেবে অন্যান্য কাগজের সাথে দলা পাকিয়ে বস্তায় ঢুকায়। উপর থেকে বাবর আরো কয়টা ডলার ফেলে, কাগজ কুড়ানো ছেলেটা উপর থেকে কাগজ পড়তে দেখে উপরে তাকায় বাবর তার দিকে তাকিয়ে হেসে আরো কিছু ডলার ফেলে, ছেলেটা আবার ডলারগুলোকে দলা পাকিয়ে বস্তায় ঢুকায়, বাবর ইশারায় কিছু বলতে চায়, ছেলেটি বুঝতে পারে না। বাবর তাকে কিছু খাবার এনে দিতে ইঙ্গিত করলে ছেলেটা বুঝতে না পেরে বোকার মত তাকিয়ে থাকে । বাবর তাকে হাত দিয়ে মুখে খাবারের লোকমা ঢুকানোর মত করে খাবারের কথা বুঝায়। ছেলেটা কি বুঝে না বুঝে হাসতে থাকে। বাবর বুঝাতে থাকে আর অনেক ডলার দেখিয়ে তাকে দেয়া হবে এই লোভে ফেলতে চাইলে। ছেলেটা কিছুই না বুঝে বাবরের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে চলে যেতে থাকে।

 

টিভিতে টম হাসছে জেরিকে ফাদে ফেলে, একটু পর জেরি হাসছে টমকে ফাঁদে ফেলে টম এন্ড জেরী কার্টুনের নিচে টিভি স্ক্রলিং এ একটা লেখা স্পষ্ট হয়। বিয়ে করতে চান? পছন্দ সই পাত্রপাত্রী খুঁজছেন। আজই আসুন আপনার পছন্দসই পাত্রপাত্রীর জন্য, বিবাহ ঘর, ফোন নম্বর যোগাযোগ ও বিয়ের যাবতীয় বিষয় আশয়সহ বিস্তারিত লেখা। সোহেল মনযোগ দিয়ে টিভি স্ক্রলিংয়ের লেখাটা পড়ে। সোহেল বেশ আয়েসের সাথে বিজ্ঞাপনটা পড়তে পড়তেই হঠাৎই তার মনে হল আরে সেতো চাইলেই এখন বিয়ে করতে পারে। আর তখনি সাথে সাথেই সেখান থেকে মোবাইল নম্বরটা টুকে নেয়।

বিয়ের কথা মনে আসতেই কল্পনা করতে চায় অসাধারণ একটা মেয়ের মুখ। কিন্তু অসাধারণটা যে কি রকম অসাধারণ সেটা এখন আর মনের ভেতর জাগিয়ে তুলতে পারে না। শেষমেষ মনে মনে নিজেই নিজের ফয়সালা করল। স্বচক্ষে চাক্ষুস না দেখে আসলে কল্পনায় ছবি একে আর যাই হোক মেয়ে দেখা হবে না। তার চেয়ে সেও মেয়ে দেখবে মেয়েরাও তাকে দেখবে এভাবেই হয়ে যাবে একদিন। ভাবতে ভাবতেই ফোন করে ফেলল , হ্যালো বিবাহ ঘর? জ্বী জ্বী আমি বিজ্ঞাপন দেখে খোঁজ নিতেই ফোন করেছি … পাত্র আমি নিজে… দেখুন টাকা পয়সা কোন ব্যাপারই না, শিক্ষাগত যোগ্যতায় কোন সমস্যা না, স্মার্টলী যদি বলি দেখতেও আমি বেশ হ্যান্ডসাম। পাত্র হিসেবে যে কারো জন্য ঈর্ষণীয়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, মনের মত মানানসই একজন পাত্রীর জন্যই আপনাদের কাছে ফোন করলাম।

অপরপ্রান্ত থেকে ছবিসহ বায়োডাটা চাওয়া হল। সেই সাথে সরাসরি দেখতে হলে কি করতে হবে এবং কবে নাগাদ দেখা যাবে এ বিষয়েও সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়ে গেল।

সোহেল মোবাইলটা রেখে। টিভিটা বন্ধ করে, বেড সুচ অফ করে, একটা
যথাসম্ভব সুন্দর মেয়েকে কল্পনায় স্ত্রী বানিয়ে বিবাহিত জীবনের সর্বোচ্চ সুখী দম্পতি ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।

ক্লান্ত বাবর বেশ অস্থির হোয়ে একবার দরোজার কাছে যায় ফুটা দিয়ে সোহেলকে ঘুমাতে দেখে আবার জানালার কাছে যায়। পকেট থেকে বের করে একটা চকলেট খায়। গুনে দেখে পকেটে আর একটা চকলেট ও একটা চুইনগাম আছে। আরো কতক্ষণ এখানে এইভাবে কাটাতে হবে কে জানে। ভাবতে ভাবতে খুব সাবধানে ভাঙা স্ট্যান্ডটা দিয়ে জানালার গ্রিল বাকা করার চেষ্টা করে। গ্রিলের
আগের বাকা অংশটায় চাপ দিতেই আরো কিছুটা বাকা হবে হবে মনে হচ্ছে, এই সময়ই হঠাৎ গোঙানির শব্দ ভেসে আসে। প্রথমে বিষয়টা গুরুত্বের সাথে না নিলেও গোঙানির শব্দটা ক্রমশ বাড়তে থাকলে বাবর দ্রুত ফিরে এসে দরজার কাছে যায়, ফুটা দিয়ে তাকায়। দেখে, সোহেল ঘুমের মধ্যে ছটফট করছে। হাত পা এদিক সেদিক নাড়ছে। বাবর অবাক হয়ে সোহেলের দিকে তাকিয়ে ভাবছে। কি হচ্ছে, কি সমস্যা এমন করছে কেন? না কি ঘুমের ভেতর স্বপ্ন টপ্ন দেখছে। দেখা যাক কি হয়।

সোহেল ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখছে সোহেল তাকিয়ে দ্যাখে তার মুখোমুখি একটা মুখোশধারি লোক তার দিকে হিংস্র চোখে তাকিয়ে গলা টিপে ধরে আছে। সোহেল প্রানপনে ছুটার চেষ্টা করছে। সোহেলের চোখ বড় হয়ে যাচ্ছে। সোহেলের চার হাত পা চারজন ধরে আছে , সোহেল অচেতন হয়ে তাকিয়ে আছে শুধু আর তার চোখের সামনে দিয়ে সুটকেস ভর্তি ডলার নিয়ে চলে যাচ্ছে। পলকহীন চোখে তাকিয়ে দেখা ছাড়া সোহেলের কিছুই করার নেই।

সোহেল লাফিয়ে ওঠে। ঘামতে থাকে। চারপাশে তাকায়, সব ঠিকঠাক। বারান্দার
তালাটা টেনে নেড়েচেড়ে দেখে ঠিকই আছে। খাটের নীচে তাকায়, ফাঁকা। রুমের লক নেড়েচেড়ে দ্যাখে, বন্ধই আছে। কিছুক্ষণ ভাবে চোখে মুখে পানি দেয়। রুমের ভেতরে কি অবস্থা দেখার জন্য চাবি নিয়ে রুমের দরজার কাছে যায়।
সোহেলের ছায়া রুমের দরজার কাছে আসতেই বাবর দরজার আড়ালে কাঠ নিয়ে টানটান উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে থাকে। সোহেল রুমে ঢোকা মাত্র মাথায় বাড়ি দিয়ে ফেলে দেবে। তারপরই সে হয়ে যাবে এইসব ডলারের মালিক। সো এখন শুধু সোহেল রুমে ঢোকা মাত্রই কায়দা করে জাস্ট মাথায় একটা বাড়ি। সেই পজিশন নিয়ে দারুণ উত্তেজনায় বাবর।
সোহেল দরজা খুলে চৌকাঠ ঠেলে সরায়। ঘরের ভেতর খাটের নিচে তাকায়। সুটকেসটার দিকে চোখ রাখে, দেখে একইভাবে আছে। সুটকেসেসহ রুমের চারপাশে একবার চোখ বুলায়। সবই ঠিকঠাক দেখে রুমে না ঢুকে সোহেল রুমের দরজাটা আগের মতই বন্ধ করে দেয়।
বাবর আগের মতোই টানটান উত্তেজনায় কাঠটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা বন্ধ হওয়াতে আফসোস করে। তার ধারণা ছিলো সোহেল নিশ্চই রুমে ঢুকবে আর তখনি সোহেলের মাথায় কাঠ দিয়ে বাড়ি মেরে ফেলে তারপর যা করার করে ব্যস সব টাকার মালিক হয়ে যাবে। হিসাব খুব সহজই ছিল কিন্তু রেজাল্ট গোলমাল, মেলে নাই। দিনের আলোটা পর্দার ফাঁক দিয়ে যতটুকু ফাঁক পায় ঢুকে পড়ে রুমটাকে বেশ কিছুটা উজ্জ্বলতা দেয়। সোহেল রুমের চাবিটা তোষকের নিচে একপাশে রাখে। সোহেল ঔষুধের প্যাকেট থেকে ঔষধ বের করে , জগ থেকে পানি ঢালে , পানি দিয়ে ঔষধ খায়। তারপর শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করে, আর চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় কে বা কারা যেন তাকে মেরে টাকা পয়সা সব নিয়ে যাচ্ছে। ফলে ঘুমাতে পারে না জেগে ওঠে চারদিকে তাকায়। উঠে বারান্দার পর্দা সরায়, বাহিরে তাকায়, দ্যাখে ফিরে আসে আবার শোয়, আবার লাফিয়ে ওঠে, চারদিকে তাকায়, চারপাশে ভর দুপুরের নির্জনতাকে খুবই অন্যরকম মনে হয়। নানান ধরনের উলটা পালটা চিন্তা মাথায় কাজ করতে করতে এক সময় নিজের অজান্তেই ঘুমের ঔষধের কার্যকারিতার সাথে দেহ মনের ক্লান্তিতে ঘুম চলে আসে।

সোহরাব মিয়া সন্ধ্যার নাস্তা নিয়ে বারান্দার দরজায় কড়া নাড়ছে। সোহেল জেগে ওঠে। চোখ মেলেই দেখে সোহরাব হাসছে। সোহরাবের হাসি দেখে সোহেল বুজতে পারে না সেকি স্বপ্নের ঘোরে আছে নাকি বাস্তবে।
স্যার নাস্তা।
বলেই আবার হাসছে।
ভর সন্ধ্যায় কথাবার্তা নেই একটা লোক নাস্তা নিয়ে এসে ক্রমাগত হাসছে। কি বিরক্তিকর এই হাসি। এমনিতেই উলটা পালটা স্বপ্নে ঠিক মত ঘুম হয়নি। তার উপর, ওফ, বলে চোখেমুখে বিরক্তির ভাব এনে বলে।
সোহরাব মিয়া তুমি সবসময় এমন হাসি হাসি মুখ করে রাখ কেন? এই খানে কি হাস্যকর কিছু ঘটেছে।
সোহরাব মিয়া হেসে, না স্যার আমি কিন্তু হাসি না, আমার মুখের কাটাটাই ঐরকম। তাই না হাসলেও হাসি হাসি মনে হয়।
সোহেল দরজা খুলে দেয়। সোহরাব ঢোকে নাস্তাটা টেবিলে রেখে সোহেলের দিকে তাকায় হাসে, সোহরাবের হাসিতে সোহেল বিরক্ত হয় কিন্তু আর কিছু বলে না।
সোহরাব মিয়া তার গলায় ঝুলানো গামছা দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বলে, স্যার তাড়াতাড়ি খায়া নেন, সন্ধ্যা হইছে অনেক্ষণ তো, তাই আপনার ডাকের অপেক্ষা না কইরা চইলা আসলাম। খাওয়া শেষ হইলে ডাক দিয়েন। আমি এখন যাই তাইলে।

বলে চলে যেতে যেতে আরেকবার পিছন ফিরে তাকায় সোহেলের সাথে চোখা চোখি হয়, সোহরাব মিয়ার হাসি হাসি মুখাবয়বটা দেখে সোহেল মহাবিরক্ত। সোহেল ভালো করে হাত মুখ ধোয়।
সোহরাব মিয়ার কথাগুলি অতি ভদ্র হওয়ায় মনের ভেতর উঁকিঝুকি দেয়া সন্দেহটা এই মুহূর্তে আরো বেড়ে যাচ্ছে। তার হাসিটা বেশ রহস্যজনক মনে হচ্ছে।
বাবর দরজার ফুটা দিয়ে তাকায়। দেখে সামনে পরাটা, ভাজি, ডিম, নেহারি। বাবর ঠোঁট চাটে জিব চাটে। বাবরের মুখাবয়বটা করুণ দেখায়| চোখের নীচে কালো দাগ স্পষ্ট। বাবরের প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগে।
সোহেল ফ্রেস হয়ে খাওয়া শুরু করতে যাবে এমন সময় সোহরাব মিয়ার হাসিমুখ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সন্দেহজনক হাসি মুখ। এই সন্দেহ থেকে সোহেলের মনে ভয় কাজ করতে থাকে।
সোহেল খাচ্ছে, খেতে খেতে সোহেলের কেমন জানি লাগেছে, সবকিছু কেমন জানি জড়িয়ে আসছে। কিছুটা খাওয়ার পর সোহেলের চোখে মুখে ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে। সোহেল সেখানে সেই অবস্থায় অচেতন হয়ে পড়ে যায়। ঘোলা চোখে সোহেল দেখে সোহরাব মিয়া তার বিখ্যাত হাসিমুখে হাসতে হাসতে তার গলার গামছাটা দিয়ে সোহেলের হাত পা বাঁধছে। মুখে একটা রুমাল গোছের কিছু সোহেলের মুখে ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে দিচ্ছে যেন সোহেল মুখে কোন আওয়াজ করতে না পারে। সোহেল কিছুই করতে পারছে না শুধু তাকিয়ে দেখছে। সোহরাব মিয়া একটু পর রুমের লক খুলে ভেতরে ঢুকে সুটকেসটা নিয়ে বের হয় সোহেলের কাছাকাছি এসে তাকায়, সোহেলের চোখেমুখে অসহায়ত্ব ভেসে আসে, কিন্তু কিছু করার ক্ষমতা নেই, সোহরাব মিয়া সোহেলের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকে। তারপর সোজা বারান্দার সিঁড়ির খোলা দরজাটা দিয়ে বের হয়ে তালাটা ভালো করে লাগিয়ে আবার সেই বীভৎস হাসি দিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। কী বীভৎস। কী নির্দয়। নাস্তা সামনে রেখে এইসব ভাবনা নিজের অজান্তেই সোহেলের মনে ঢুকে পড়ে। তারপর হঠাৎই সোহেলের ঘোর কাটে। এইরকম একটা কল্পনা সোহেলের দেহ মনে চরম সন্দেহ ঢুকিয়ে দেয়। সোহেল খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। গন্ধ শুকে মনে হচ্ছে আজকের খাবারে একটু অন্যরকম গন্ধ আসছে, একবার ভাবে ধুর কিসব উলটা পাল্টা কল্পনা করছি আবার ভাবে উল্টাপাল্টা না সত্যওতো হতে পারে। বিপদ তো সব দিন ঘটে না একদিনই ঘটে, সেই বিপদ যদি সত্যিই আজই ঘটে যায়। এই জন্য আজকের খাবারটাই কেমন যেন লাগছে। তাই খাবারটা মুখে দিতে গিয়েও দেয় না।

বাবর ফুটা দিয়ে দ্যাখে খাবারগুলো তার খুব কাছে, সামনে একটা দেয়ালের কারণে খাবারগুলো ধরতে পারছে না। ছোট বেলায় বহুবার এই দেয়ালের কারণে তাকে ভুগতে হয়েছে। একবার কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে ভয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে, পালাতে পারেনি। সামনে দেয়াল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে কুকুরের কাছে ধরা পড়ে কামড় খেতে বসেছিল, ভাগ্য ভালো ছিলো বিধায় ঐ পথে তখন আসা এক লোক ওকে বাচিয়েছিল। আরেকবার এক চোরকে সবাই মিলে তাড়া করতেই চোরটা দৌঁড়ে প্রায় চলেই গিয়েছিল কিন্তু সামনে একটা দেয়াল পড়ায়, দেয়ালটা টপকাতে না পেরে ধরা খেয়ে বেদম মার খেয়েছিল। সেসব দিন আর আজকের দিন এক না। আজ সেঈসব দেয়াল ভাঙবেই। জীবন বাজি রেখে হলেও ডলারগুলো সে নিয়েই ছাড়বে।

সোহেল খাবারগুলো নাড়াচাড়া করছে, খাচ্ছে না। না খেয়ে একটা ঝুড়িতে ফেলে
দিচ্ছে। বাবর অসহায় চোখে ঝুড়ির খাবারগুলোকে তাকিয়ে দেখতে থাকে। মনে
হয় এক্ষুণি দরজা ভেঙ্গে খাবারগুলি নিয়ে খেয়ে ফেলে। পরক্ষণেই ভাবে লোভে পড়লেই এখন বিপদ। সুতরাং একটু সময় নিয়ে ধৈর্য ধরতে পারলেই ব্যস। সবুরে মেওয়া ফলে। ভেবে পকেট থেকে চকলেট বের করে চুষতে থাকে। আর চুষতে চুষতেই ক্ষুধা ক্লান্তিতে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

রাতের বেলায় না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার কারণে সকাল বেলায় সোহেলের খুব খিদা পায়। জেগে উঠে ফ্রিজ থেকে আপেল আঙুর বের করে খেতে যাবে এমন সময় চোখে পড়ে সামনে পড়ে থাকা সকালের পত্রিকাটার খবর। দ্রুত পত্রিকাটা তুলে নেয়, পত্রিকার যে খবরগুলি তার চোখের সামনে কর্কশ হয়ে দেখা দেয়, সেগুলো হল, “বিষাক্ত ফর্মালিনের ব্যবহারে ফলমুল এখন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে” নিউজটা ডিটেইল পড়ে ভয়ার্ত চোখে আপেলগুলোর দিকে তাকায়, তারপর নিউজটার কিছু লাইন চোখের সামনে বড় হয়ে দেখা দ্যায় যাতে লেখা,” এইসব ফল খাওয়ার ফলে সাথে সাথেই পেটে বিষক্রিয়া দেখা দিতে পারে। সেইসাথে লিভার কিডনি ড্যামেজ হওয়া সময়ের ব্যাপারমাত্র।“

বাবর ঘুমাচ্ছিল, হঠাৎ বারান্দা থেকে কি সব শব্দ ভেসে আসাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়, দরজার কাছে গিয়ে ফুটা দিয়ে দেখে, সোহেল আপেল ছুড়ে মারছে আঙুরগুলো ছুড়ে ফেল দিচ্ছে। বাবর অবাক। সোহেল খাবারের জিনিষগুলি না খেয়ে এভাবে ফেলে দিচ্ছে কেন? সোহেলের সামনে কত খাবার কিন্তু খাচ্ছে না, ফেলে দিচ্ছে। আর বাবর খাবারের অভাবে প্রচণ্ড ক্লান্ত শক্তিহীন হয়ে পড়ছে।

সোহেল সমস্ত খাবারকেই ফেলে দেয়। পত্রিকাটা টান মেরে ইচ্ছামত ছিঁড়ে কুটি কুটি করে।

বাবর দেখে আপেল আঙুর ফ্লোরে ছড়ানো পাশে ঝুড়িতে রুটি ভাজিসহ বিভিন্ন খাবার দেখে বাবর মুখ চাটতে থাকে আর চোখ জোড়া চক চক করতে থাকে।

বাবর কল্পনা করে, তার ছোট ক্লান্ত চোখজোড়া তার লোভনীয় কল্পনার সাথে সাথে বড় হতে থাকে। মুখাবয়বে লোভনীয় আনন্দ। বাবর কল্পনায় খেতে চায়, তাতে করে কিছুটা হলেও ক্ষুধার সাথে লোভটাও সংবরণ হয়। লোভ সংবরণ করতে, বাবর কল্পনায় দেখে, একটা ডাইনিং রুমে বিশাল বড় একটা টেবিলে কলা, আপেল, কমলা, আঙুর , বেদানাসহ বিভিন্ন রকমের ফল সাজানো। বিভিন্ন ডিশে পায়েশ, মিষ্টি, দই, বিরিয়ানি, ফিস ফ্রাই, চিকেন ফ্রাই, রুটি লাচ্ছি কোল্ড ড্রিংকস, জুস, বোরহানি ইত্যাদি সাজানো।

বাবর খুব আয়েশের সাথে খাবারগুলোর সামনে বসে। প্রথমে পানি খেতে পানিসহ গ্লাস ধরতে যেতেই গ্লাসটা সরে যায়, বাবর অবাক হয়ে পানির গ্লাসের পাশে জুসের গ্লাস ধরতে যায় সেটাও সরে যায়, খাবারের ডিস থেকে খাবার নিতে যায় ডিসগুলোও সরে সরে যায়। এভাবে বাবর যা ই ধরতে যায় তাই সরে সরে যায়। বাবর কিছুই ধরতে পারছে না সব কিছুই দূরে সরে যাচ্ছে বাবর ধরতে ছুটছে আর খাবার গুলো সরে সরে যাচ্ছে। এভাবে বাবর কল্পনায় খাবারের পেছনে ছুটতে থাকে এবং খাবারগুলোও আরো লোভনীয় হয়ে বাবরের ধরা ছোয়া থেকে দূরে চলে যেতে থাকে। এভাবে কল্পনায় ছুটতে ছুটতে বাবর কল্পনা থেকে বেরিয়ে বাস্তবেও খুবই ক্লান্ত হয়ে হাপাতে থাকে।
হাঁপাতে হাঁপাতে বাবর দ্রুত নিশ্বাস নিচ্ছে আর অসহায় হোয়ে বসে আছে দরজার পাশে। বাবর বুজতে পারে তার কল্পনাশক্তিও এখন তার মতই ক্লান্ত। তার সাথে এখন আর খাপ খাচ্ছে না। কল্পনার সবকিছুই এখন বাস্তবতার সাথে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ক্ষুদা কিভাবে মানুষের শারীরিক, মানসিক এমনকি কল্পনা শক্তিকেও নষ্ট করে দেয় বাবর সেটা টের পায়। বাবরের কল্পনা এখন বাস্তবতার সাথে হারতে বসেছে। তাই কল্পনায় খেতে চাইলে খাবার দৌড়ে পালাচ্ছে। ফলে ক্ষিধাটা আরো টগবগে হয়ে উঠছে। ক্ষিধা, ক্লান্তি, কষ্টসহ সমস্ত অসহায়তার কারণ সোহেল। সোহেলের আর কোন ক্ষমা নাই। উত্তরোত্তর
তার উপর জেদটা বেড়েই চলছ। কিন্তু তার শরীর মন ক্রমাগত রোগাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। জানালার বাহিরে খচ খচ আওয়াজ হতেই বাবর দ্রুত উঠে যায়, উঠতে গিয়ে দুর্বলতায় মাথা চক্কর খায়, বাবর বসে পড়ে, পকেট থেকে চুইনম বের করে খায়। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। বাবরের কল্পনাগুলো এখন তার কাছ থেকে পালাচ্ছে। সুতরাং এখন আর কল্পনার উপর নির্ভর করে মনে সুখ তৈরি করা যাবে না। এক মুহূর্তও নির্ভর করা যাবে না। পুরাপুরি বাস্তবতার মাঝেই তাকে বাচতে হবে। জগের পানি ময়লা জেনেও এখন সেই পানি খায়। জেদে শরীর মনে এক ধরনের তেজ অনুভব করে।

যেই ডলারে জন্য এত কষ্ট স্বীকার করছে। যে করেই হোক এই ডলারগুলো সে নেবেই নেবে এবং এগুলো দিয়েই সে প্রতিশোধ নেবে সোহেলের উপর, আর জীবনের না পাওয়া সমস্ত কষ্ট ও বিষয় আশয়ের উপর। এই জেদ এই তেজ বাবরের মনের জোর বাড়িয়ে দেয়, বাবর কিছু ডলার নেয়। ডলারগুলো নিয়ে জানালার কাছে যায়। কাগজ কুড়ানো ছেলেটাকে দেখে কিছু ডলার নিচে ফেলে, ছেলেটা উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে ডলার উড়েউড়ে পড়ছে, ছেলেটা হাসি মুখে ডলার ও কাগজ একই সাথে কুড়িয়ে দলা মোচা করে তার কাধ ঝোলানো বস্তার মধ্যে ঢুকাতে ব্যাস্ত। হাসি মুখে উপরে তাকায় বাবর আরো ডলার ফেলে। ছেলেটা ডলার কুড়িয়ে আবার আরো পাবার আশায় উপরে তাকায়। বাবর আরো ডলার দেখিয়ে ইঙ্গিতে কিছু খাবার এনে দিতে বলে, এবং বোঝায় খাবার এনে দিলে ওগুলো দিবে। ছেলেটা হেসে চলে যায়।

বাবর অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকে, বাবর উপরে তাকায় আকাশের দিকে, আকাশে সূর্যের আলো প্রচণ্ড তেজি রূপে দেখা দেয়। আকাশ থেকে ধীরে ধীরে চোখ নামায় সামনে আশে পাশে কোথাও কেউ নেই। ভীষণ গরম, বাবর খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে থাকে কাগজ কুড়ানো ছেলেটার আশায়। একইসাথে এই মুহূর্তে কিভাবে কি করা যায়।
নিউজ পেপারের নেগেটিভ নিউজ তার আজকের দিনের শুরুটাকেই মাটি করে
দিয়েছে। তারা কোন পজেটিভ নিউজ দেয় না। টেলিভিশনেও একই অবস্থা। নিউজগুলির অবস্থা নেশার মত, খারাপ সংবাদ শুনতে ভালো লাগে। পড়তেও ভালো লাগে। পড়ে আলোচনা সমালোচনা করতে আরো ভালো লাগে। তাই দৈনন্দিন কথার মজা আড্ডার মজার জন্য এই সংবাদগুলো সবাই পড়তে চায়। কিন্তু জনজীবনে এই সংবাদগুলো কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তার প্রমাণ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এখন সোহেল। একের পর এক টিভি চ্যানেল দেখতে দেখতে একটার পর একটা চেইঞ্জ করতে করতে একসময় বিরক্তি নিয়ে রিমোটটাকে ছুড়ে ফেলে দেয় সোহেল। চোখে মুখে পানি দেয়, একটা কমলা ছিলে কিছুটা খেয়ে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ে, চোখ বন্ধ করে, টিভিতে জিওগ্রাফি চ্যানেলে বাঘ হরিণকে ধরার জন্য ছুটছে। একসময় ধরে ফেলে। জলজ্যান্ত অসহায় একটা হরিণ রক্তাক্ত অবয়বে লাফাচ্ছে বাঘের মুখের খাবার হয়ে।

এই দৃশ্য দেখে সোহেল লাফিয়ে উঠে জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়। চ্যানেল চেইঞ্জ করে অন্য চ্যানেলে যায়, সেখানে হিন্দি ছবির অ্যাকশন দৃশ্যে দেখা যায় জলজ্যান্ত একটা মানুষের গলা কেটে, কাটা গলা হাতে নিয়ে যাচ্ছে। কি পৈশাচিক দৃশ্য। কি পৈশাচিক ফিল্মি রুচি। সোহেল টিভি অফ করে। শব্দহীন সময় কাটে কিছুক্ষণ, শব্দহীন সময় এখন খুব নিঃসঙ্গ লাগে, অথচ এই রুমেই সে ঘন্টার পর ঘন্টা দিনের পর দিন একাই কাটিয়া দিয়েছে। একা একা ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন দেখছে। সোহেল আবার টিভি ছাড়ে। গানের চ্যানেল, সাউন্ড বাড়ায় কমায়, একের পর এক চ্যানেল চেইঞ্জ করে, কোন চ্যানেলের কোন অনুষ্ঠানই আর ভালো লাগে না। সোহেল পানি দিয়ে বিছানার পাশে রাখা ঔষধগুলো থেকে দুইটা ঘুমের ঔষধ নিয়ে একসাথে খেয়ে ফেলে। তারপর বসে। বিছানায় চিত হয়ে মাথা রাখে। চোখমুখের উপর একটা বালিশ ঢেকে দেয়। অন্ধকার।

বড় বড় অক্ষরে লেখা চিঠি,” এই ডলারগুলোর নিয়ে আমাকে কিছু খাবার ও পানির ব্যবস্থা করে দেন। আমি তাকে আরো প্রচুর টাকা দেবো। বিশেষ কারণে এই ব্যবস্থা, বাড়তি কোন কিছু করতে যাবেন না, তাহলে ঝামেলা বাড়বে। সাক্ষাতে কথা হবে আরো অনেক সাহায্য সহযোগিতা করা হবে।“ বাবর এই চিঠিটা একটা গেঞ্জি ছিঁড়ে রশি বানিয়ে রশির ভাজে ভাজে ডলার বেধে বেশ কিছু ডলারসহ একটা পোটলাও জানালা দিয়ে নিচে ফেলে। পোটলার উপরে চিঠিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রশির অপর প্রান্ত কাঠের স্ট্যান্ডের সাথে বেধে ধরে অপেক্ষায় বসে থাকে বাবর। তার চোখ কোটোরে ঢুকে গ্যাছে, লালবর্ন ধারণ করেছে। ক্ষিধায় চোয়ালের হাড় বেরিয়ে পড়েছে ,অপেক্ষার সময় বাড়তে দেখা যায়। এমন সময় একজন লোককে আসতে দেখা যায় রশিটা নেড়ে চেড়ে লোকটার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। যেভাবে বড়শি ফেলে মাছের আশায় মৎস্য শিকারিরা বসে থাকে সে রকমভাবে বসে কাঠটা নাড়া চাড়া করে, ফলে রশিসহ পোটলাটা উপরে নিচে আশেপাশে ঝুলতে থাকে। জানালার বাহিরে মাটির কাছাকাছি পোটলার সাথে চিঠিটাও দোলে। যার উদ্দেশ্যে এই ব্যবস্থা সেই লোকটা এসব লক্ষ্য না করে চলে যায়। বাবর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, বসে পড়ে জানালার গা ঘেঁষে।
বাবর হতাশ হলেও আবার নতুন আশায় বসে থাকে। একটা শব্দ হওয়ার সাথে সাথে রশিতেও টান পড়ে, যেনো বড়শিতে চাহিদার চাইতেও বড় মাছ পড়েছে। বাবর চোখে মুখে প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে খুব কষ্টে উঠে দাঁড়ায়। জানালা দিয়ে রশিটার দিকে তাকায়, দেখে আশেপাশের কেউ দশাসই একটা পলিথিনের ময়লার পোটলা ফেলে গ্যাছে। পলিথিনে মোড়া ময়লা পোটলাটার নিচে তার লেখা চিঠিসহ ডলারের পোটলাটা চাপা পড়ে গেছে। বাবর তার ডলারের পোটলাটাকে খুভ সাবধানে টেনে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে, কখনো পোটলাটা উঠি উঠি করছে, আবার রশির গিঠটা খুলে যেতে চাচ্ছে। আবার চিঠিটাও ছিঁড়ে যাবার মত অবস্থায় পড়ে যাচ্ছে।

আবার রশিটা লুজ করে দিয়ে ডলারের পোটলাটাসহ চিঠিটাকে খুব আস্তে আস্তে টেনে উঠানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু ময়লা ভর্তি পলিথিনের পোটলার সাথে তার ডলার ভর্তি পোটলাটা পেরে উঠছে না। ফলে ময়লা আবর্জনায় চাপা পড়ে যাচ্ছে বাবরের বাঁচার আকুতি মেশানো চিঠি, আহ্বান। কখনো ময়লার পোটলাটার পাশ দিয়ে চিঠি ও ডলারের পোটলাটা এমন ভাবে উকি দিচ্ছে যেন ময়লার পোটলাটাকে হারিয়ে উঠে আসছে চিঠিসহ ডলারগুলি, আবার দেখা যায় ময়লার পোটলাটার ভারে চাপা পড়েই যাচ্ছে। উঠানো যাচ্ছে, আবার যাচ্ছে না মনে হচ্ছে। এভাবেই কিছু সময় পার হয়ে যাবার পর একসময় বাবরের মতই ক্লান্ত হয়ে লড়াই করতে করতে জয়ী হতে গিয়েও তার রশিটা ছিঁড়ে যায়। বাবর হতাশ হয়ে রশি ছেড়া কাঠটাকে জানালার গ্রিলে আটকে রেখে বসে পড়ে। কাঠে বাঁধা রশিটার সাথে চিঠিটার ছেড়া অংশবিশেষ শুধু দুলতে থাকে বাতাসে।

কাগজ কুড়ানো ছেলেটা আসে। চিঠিটাকে রশির সাথে দুলতে দেখে চিঠি লেখা কাগজটাকেই সে ধরতে লাফায়, চিঠিটাও বাতাসের দোলায় কিছুক্ষণ দোল খেয়ে একসময় ছেলেটার হাতে ধরা পড়ে। টান মেরে চিঠিটা ছিঁড়ে নিতেই রশিতে টান পড়ে, রশিতে টান পড়ার কারণে কাঠের স্ট্যান্ডটা জানালা থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যায় কাঠের স্ট্যান্ডটার নিচে পড়ার শব্দ হতেই বাবরের চোখে মুখে প্রচণ্ড উত্তেজনা কাজ করে। দেয়ালের উপর ভর করে বহু কষ্টে উঠে দাঁড়ায়। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে ছেলেটা চিঠিটাকে তার প্রতিদিনের কুড়ানো একটা উচ্ছিষ্ট কাগজের মতই মুচড়ে ব্যাগে ঢুকাচ্ছে, বাবরের মনে হচ্ছে, তার আশাটাকেই সে দলামোচা করে বস্তাবন্দি করে ফেলেছে।

ছেলেটা আরেক হাতে কাঠটা নিয়ে উপরে তাকায়, বাবর ইঙ্গিতে তাকে ডলারের পোটলাটা দেখাতে ইশারা করে ছেলেটা বোঝে না কাঠটা নিয়ে দৌঁড়ে পালায়। বাবর মরিয়া হয়ে হাতের ইশারায় কিছু বলতে যায়, ছেলেটা ততক্ষণে দূরে বহুদুরে চলে যাচ্ছে। বাবর আবর্জনা ভর্তি সেই পলিথিনটার দিকে তাকিয়ে আছে, যেটার নিচে ঢাকা পড়ে আছে ডলারের পোটলা। আবর্জনাসহ পোটলাটা স্পষ্ট থেকে ঝাপ্সা হতে হতে একসময় বাবরের চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসে, জানালার গ্রিল ধরে বসে পড়ে ।

জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। আর বাবর সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অসহায় নির্বিকারভাবে। তন্দ্রার মত চোখটা লেগে আসতেই সোহেল দেখে কয়েকটা হাতসহ একটা বালিশ তার মুখাবয়বটা চেপে ধরেছে। সোহেল প্রাণ পনে বালিশ থেকে মুখ বের করতে চাইছে কিন্তু পারছে না। তার মুখ দিয়ে গো গো শব্দ বের হতে হতেই একসময় সে লাফিয়ে ওঠে, হাপাতে থাকে। ভয়াবহ রকম ঘামাতে থাকে। হাতের কাছে থাকা ফোনটা নিয়ে দ্রুত ফোন করে। ডাক্তার সাহেব সরি অসময়ে ডিস্টার্ব করছি। কিন্তু কি করবো বলেন, খেতে ইচ্ছা করে না ঘুমাতে পারি না, টিভি দেখতে ইচ্ছা করে না, পড়তে ইচ্ছা করে না, কোন কাজ করতে ভালোলাগে না, ঘুমালেই ভয়াবহ স্বপ্ন দেখি, কারা যেন আমাকে মেরে আমার সব কিছু লুট করে নিয়ে যাচ্ছে, যদিও নেবার মত তেমন কিছু আমার নেই।
এখন কিছুই ভালো লাগছে না। খুব অস্থির লাগছে। আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। ডাক্তার সাহেব একটা কোন ওয়ে দেখান প্লিজ। এমন সময় বারান্দার দরজার বাহিরে চোখ যেতেই দেখে সোহরাব মিয়া হাসি হাসি মুখ নিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে। সোহরাব মিয়াকে হাসি হাসি মুখে দেখে সোহেলের মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে যায়। ইচ্ছা করে দু পাশের দু গালে চাপায় দ্রাম দ্রাম করে কয়টা ঘুশি মেরে শালার চেহারার মানচিত্রটা এমন ভাবে ফাটিয়ে দেয় যেন আর কোনদিন হাসি হাসি মুখ করতে না পারে। দরজার কাছে দাঁড়াতেই সোহেল দূর থেকেই লক না খুলে বলে, শোন আজ আর খাবার লাগবে না। আর কালও আমি খাব না।
এরপর যখন লাগবে তোমাকে কল করবো। ঠিকাছে। আর একটা কথা, সবসময় ঐভাবে হাসবে না। খুবই বিরক্তিকর।
জ্বী আচ্ছা। বলে আবার হাসে।
আমি কি হাসার মত কিছু বলেছি।
না স্যার, কাইলকা থিকাতো আর হাসতে পারুম না তাই আইজকাই শেষ হাসি হাইসা লইতাছি।
কেন কালকে থেকে হাসতে পারবে না কেন?
আমি তো হাসতে ঠিকই পারুম। কিন্তু আপনে তো আর দেখতে পারবেন না। কেন তুমি হাসলে আমি দেখতে পারব না কেন?
ঐ যে কাইলকা থিকা তো আমার চাকরি থাকব না। কে বলেছে
কেউ বলে নাই। আমি এমনেই বুঝি। আইচ্ছা আসি স্যার।
বলে সোহরাব চলে যায়। কিন্তু সোহরাবের কথায় সোহেলের ভেতর কেমন ভয়
ভয় হয়। সোহরাবের হাসির মতই তার কথাও রহস্যজনক মনে হয়। ডাক্তার তাকে যেতে বলেছে, সোহেলের মনে হচ্ছে একবার সোহরাব মিয়াকে ডাকে। আবার মনে হয় না থাক। একা একাই যাবে এবং এমন ভাবে যাবে যেন সোহরাব মিয়া শুধু না, কেউই যেন টের না পায়। যাবে আর দ্রুত চলে আসবে। ভেবে জামা কাপড় দ্রুত চেইঞ্জ করে বেরিয়ে পড়ে।

বাবরের মাথায় কোন বোধবুদ্ধি এখন আর কাজ করছে না। বাবর কোনমতে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে একসময় বসে থাকা অবস্থা থেকেও ঢলে পড়ে যায়। পড়ে গেলেই বাবরের মনে ভয়াবহ আতঙ্ক জেগে ওঠে। আমি কি মরে যাচ্ছি নাকি? নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে অস্ফুটভাবে বেরিয়ে আসতে থাকে, সোহেল আমাকে বাঁচা। আমার টাকা পয়সা কোন কিছুই লাগবে না। আমি শুধু বাচতে চাই। সোহেল আমাকে বাঁচা সোহেল সোহেল, বাবর কথাগুলো খুব জোরে চিৎকার করে বলতে চাইলেও কথাগুলো একেবারেই জোর পায় না। আস্তে গোঙানির মত শোনা যায়। বাবর বুঝতে পারে তার অবস্থা খুব জটিল।

দেয়ালের ওপাশে সোহেলের কাছে ওর কথা পৌঁছাতেই হবে। বার্লিনের দেয়াল ভেঙে যেভাবে দুই জার্মান সব ভুলে আবার একত্রিত হয়েছিল ঠিক সেভাবেই চোখের সামনের এই দেয়ালটা ভাঙার জন্য যে করেই শব্দ পৌঁছাতে হবে। তার নিজেকেও মনে হচ্ছে জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি যে দেয়াল সে দেয়ালে এখন সে অবস্থান করছে। মোবাইলের কথা মনে হতেই প্রচণ্ড মানষিক শক্তি নিয়ে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করার চেষ্টা করে, এখনও যেহেতু সেন্স আছে সুতরাং মোবাইলে কোন ভাবে চেষ্টা করে সোহেলকে বলতে পারলেই হল। জীবন আগে তারপর সব। ভেবে সব রকমের শারীরিক ও মানসিক শক্তি ব্যয় করে বাবর পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে। পকেট থেকে মোবাইল বের করতে তার যে শারীরিক ও মানসিক শক্তি ব্যয় হয়, তাতে সে নিজেই অবাক হয়। খুব কষ্টে ফোন নাম্বারের নব টিপতে থাকে, হঠাৎই মনে হয় আরে ভয় আতঙ্কের কি আছে এই সামনে দেয়ালের ওপাশেই তো সোহেল। ফোন করলেই ছুটে আসবে। এই ভেবে দারুণ উত্তেজনায় মনে কিছুটা শক্তি ফিরে পায়।

ডাক্তারের কাছ থেকে বের হয়েই সোহেলের খুব ফুফুরা লাগে। একটা রিকশা নেয়। রিকশায় উঠতেই মোবাইলটা বেজে ওঠে। সোহেল মোবাইলটা রিসিভ করতে যাবে এমন সময় বাবরের নম্বরটা দেখে ধরবে কি ধরবে না ভাবে। ধরলে বাবর যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলে মেজাজ খারাপ করে দেয়। ডাক্তার যেহেতু বলেছে মেজাজ খারাপ না করতে সেহেতু ফোনটা না ধরাই ভালো। ভাবতে ভাবতেই লাইনটা কেটে যায়। আবার রিং হয়, আবার ভাবে জরুরি কোন বিষয় নাকি? যত যাই হোক বাবর ওর খুব ভাল বন্ধু।

জীবনে বাবরের অনেক সাহায্য সে পেয়েছে। বাবরের বাসায় থেকেছে। বাবরের মায়ের হাতের কত রকমের মজার মজার রান্না খেয়েছে। ভেবে ফোন ধরতে গেলেই আবার মনে হয় না এখন না পরে নিজে থেকেই ফোন করে জেনে নিবে কি বিষয়। আবার ফোন বেজে উঠতেই ধরতে গেলে মনে হয়, না ধরবে না মন যখন দুর্বল থাকে তখন খুব দয়ামায়া কাজ করে। জীবনে উপরে উঠতে হলে এইসব দয়ামায়াকে মন থেকে নির্দয়ের মত চিরে কেটে ফেলতে হবে।
যেভাবে রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার জন্য তাদের ভেতরের মনুষ্যত্বকে উপড়ে ফেলে নিজ দলের প্রপাগাণ্ডাকেই মনের ভেতর চিরস্থাই বসতি দেয়। সুতরাং জীবনে সাফল্যের প্রয়োজনে এখন ডলারগুলো ছাড়া তার চিন্তায় আর কিছুই রাখা যাবে না। সোহেল লাইনটা কেটে দেয়। আবার রিং বাজে। সোহেলের তখন মনে হয়, যত যাই হোক বাবর তার খুব ভালো একটা বন্ধু, এই শহরে একটা সময় সে টিকে ছিল বাবরের কারণেই। শোনাই যাক না বাবর কি বলে? সোহেল ফোন রিসিভ করে হ্যালো বলতেই, লাইনটা কেটে যায়। হঠাৎ লাইনটা কেটে যাওয়াতে এবার সোহেল নিজেই ফোন করে কিন্তু বার বার বাবরের ফোন বন্ধ পায়। মনের মধ্যে খচ খচ করে ওঠে। বাবর কেন ফোন করেছিল আবার কেনইবা বন্ধ করে দিল।

 

চার্জ চলে যাওয়ার সংকেতের সাথে বাবরের মোবাইলটাও বন্ধ হোয়ে যায়। এখন আর কোন উপায়ই নেই। এই সামান্য একটু দুরেই দেয়ালের ওপাশটাকে মনে হয় অনেক অনেক দূর। লক্ষ কোটি মাইল অনতিক্রম দূরত্ব। কোনভাবেই আর যাওয়া যাবে না, কাউকে ডাকা যাবে না। এত এত দূর যে ডাকলেও কেউ আর শুনতে পাবে না। ভয় পেয়ে তন্দ্রার মত কখনও ঘুমে কখনও জাগরনে চিৎকার করে বলতে থাকে আমি মরে যাচ্ছি। সোহেল আমাকে বাঁচা। আমাকে বাঁচা, আমার আর কোন চাওয়া পাওয়া নাই। সোহেল সোহেল সোহেল কে কোথায় আছ বাঁচাও, আমি মরে যাচ্ছি, বাঁচাও।

বাবরের এতসব চিৎকার গলা দিয়ে বের হলেও ঠোটে খুব আস্তে সামান্য গোঙানি ছাড়া আর কিছুই স্পষ্ট হয় না। বাবরের চোখ নিষ্পলক। বাবর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, বিশাল আকাশ, আকাশে আধখানা চাঁদ ভাসছে, তার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শাদা মেঘ। মায়াবি পরিবেশ। এই পরিবেশে বাবর তার বাঁচার ক্ষীণ আশাটাকে জিইয়ে রাখতে ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি এর নায়ক বৃদ্ধ সান্তীয়াগোর কথা মনে করছে। কিভাবে সেই বুইড়াটা বিশাল সমুদ্রে না খেয়ে বাতাসের সাথে হ্যাঙ্গরের সাথে লড়াই করে তার ডিঙিটাকে আর সেই বিখ্যাত মাছটা নিয়ে ঠিকই তার জেলে পল্লীতে ফিরেছিল।

সান্তিয়াগোর জেদ সান্তিয়াগোর সংগ্রাম তার মনে অনুরনন তৈরি করছে। কিন্তু হঠাৎ তার মনে ঢুকে পড়ে সান্তিয়াগো হয়ত তার জেদের কাছে জয়ী হয়েছিল, বিশাল বড় একটা মাছ ধরে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছিলো বুঝিয়ে দিয়েছিল সে ফুরিয়ে যায়নি। আসলে কি সে জয়ী? যখন দেখা গেল তীরে ফিরে এসেছে সে বিশাল একটা মাছের কঙ্কাল নিয়ে, তরতাজা যেই কংকালটা দেখে সবাই বুঝেছিল বিশাল মাছ সে ঠিকই ধরতে পেরেছিল, কিন্তু রাখতে পারেনি হাঙ্গরে তার মাছটার সর্বাংগ খেয়ে কংকালে পরিণত করে দিয়েছে। অহংকার করার মত বিশাল একটা মাছ। কিন্তু ঐ অহংকার তার ব্যাক্তি জীবনে হতাশা ছাড়া আর কি দিয়েছিল? যেমনটা লেখকের জীবনেও ঘটেছিল দুর্দান্ত লেখা জীবদ্দশায় লেখার স্বীকৃতি, অর্থ খ্যাতি সবই ছিল, এতসব প্রাপ্তি তার ব্যাক্তিজীবনে কি দিয়েছিলো? হতাশা ঘুচাতে পেরেছিল? না পারেনি বলেই তার জীবনের জন্য এই সকল প্রাপ্তি অন্তঃ সার শুন্য হয়ে হেমিংওয়েকে আত্মহত্যার দিকেই ঠেলে দিয়েছিল।

না না হচ্ছে না, সান্তিয়াগো না, এরা কেউ না, এরা মনোবল চাঙ্গা করার পরিবর্তে মানুষকে আরো হতাশ করে ফেলেছে। তার চেয়ে বরং নিজের কল্পনায় বাবর জানালা দিয়ে দেখে রঙ বেরঙ্গের ফুল ফুটে আছে, ফল ধরে আছে, পাখি উড়ছে, বাতাশে গাছের পাতা দুলছে, তখন মনে হয়, আহ কি সুন্দর দিন, কি সুন্দর এইসব নির্জন প্রকৃতি। এসবের মাঝে সে নিজেকে কল্পনা করতে যেতেই দেখে ঐসব কিছু আস্তে আস্তে তাদের নিজেদের রঙ হারিয়ে কেবলই ধুসর হয়ে যাচ্ছে, পাতা ফুল ফল গাছপালা এমনকি পাখীরা স্থির হয়ে আছে। আর চোখের সম্মুখে তখন অজস্র ডলার ঝড়ে পড়ছে, বাবরের চোখে মুখে নাকে হাতে পায়ে বুকে পেটে ডলার পড়তে পড়তে একসময় সমস্ত শরীর ঢেকে যায়। তারপরও যেদিকে তাকিয়ে আছে শুধুই ডলার উড়ছে অসংখ্য ডলার উড়ছে, পড়ছে। কেউ নেই নেবার মত।

আছে শুধু বাবর আর ডলার। যেই ডলারের জন্য আজ এই অবস্থা, সেই ডলারগুলিকে এই মুহূর্তে কত তুচ্ছ মনে হচ্ছে। যেই ডলার তাকে এত সুখের স্বপ্ন দেখিয়েছে, অথচ এই মুহূর্তে সেই ডলারগুলি কি অথর্ব, তার জীবনের কোন কাজেই আসলো না। আহ মাথাটা প্রচণ্ড ঝিম ঝিম করছে। পেটের নাড়িভুঁড়ি সব বেরিয়ে আসতে চাইছে। এত এত কষ্ট কিছু করার নেই, কেউ নেই, কোন ডাক্তার, কোন সান্ত্বনা। কেউ থাকার কথাও না মৃত্যু মানেতো একা চলে যাওয়া। এখন তাহলে তার সামনে কি মৃত্যু অবধারিত? মৃত্যু মানে কি এই তীব্র কষ্ট থেকে মুক্তি, শান্তি। নাকি এইসব তীব্র কষ্টকে সাথে নিয়ে অনন্তকাল কষ্ট পাওয়া? এইসব ভাবনা আসতেই অসহ্য যন্ত্রণা আর কষ্ট হচ্ছে।
কে আছো বাঁচাও, সোহেল, সোহেল চিৎকার করতে করতে মুর্ছা যায়।
তার চিতকারে মুখ নড়ে না, তার নিজের কানও শুনতে পায় না। আবার জ্ঞান ফিরলে তীব্র যন্ত্রণা আর কষ্টে কোকড়াতে থাকে, আর যখনই ভাবে কেউ আসবে না, কেউ জানবে না, সে শুধু নীরবে এইসব অসম্ভব কষ্ট নিয়ে মরে যাবে। এই চিন্তায় চরম আতংকে জ্বালা যন্ত্রণা অস্থিরতাগুলো দেহ মনে আরো তীব্ররূপ ধারণ করে। এভাবে জ্ঞান হারানো। আবার জ্ঞান ফিরে আসা আর যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই তার মুহূর্তগুলোকে মনে হচ্ছে হাজার হাজার বছরের সমান। জ্ঞান ফিরে আসলেই মনে হয় জ্ঞান না ফিরিলেই ভালো হত। কিন্তু তার ইচ্ছা অনিচ্ছায় তো আর কিছু চলছে না। তাহলে কার ইচ্ছায় চলছে এইসব?

টেলিভিশন খবরে বলা হচ্ছে,”ভারতে ১০০০ ও ৫০০ রুপির নোট বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।“ সোহেল বালিশে মাথা রাখা অবস্থায় প্রথমে অলস চোখে খবরটা দেখে তারপর কি ভেবে ভালো করে দেখে নেড়ে চেড়ে বসে। আরো ভালো করে দেখতে টিভিটার সাউন্ড বাড়িয়ে দেয়। সেখানেও ভারতীয় চ্যানেলে একের পর এক এই সংবাদের ফলোয়াপ। সোহেল অস্থির ভাবে পায়চারি করে। দাঁড়িয়ে যায়। এই মুহূর্তে তার মনের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে একটা চিন্তা, ভারতের মত যদি হঠাৎ করে ১০০ ডলারের নোট বাতিল করার কথা ঘোষণা করা হয়।

আবার ভাবে, নাহ এটা কখনও সম্ভব না। আবার ভাবে অসম্ভব বলে এখন কোন কিছুই নেই। হুট করে এই যে ১০০০ ও ৫০০ রুপির নোট বাতিল করা হল। এটা কি সম্ভব। এটা কি ওদের দেশে কেউ কল্পনা করতে পেরেছে? পারেনি কিন্তু সত্যিই সেটা হচ্ছে। সুতরাং ডলারের বিষয়টা যে ঘটবে না এমন কেউ কি বলতে পারে। ভাবতে ভাবতেই সোহেলের চোখের সামনে ভেসে আসে, সোহেল ডলারের নিয়ে ব্যাংকে যাওয়ার পর ব্যাংক না করছে, ব্যাংক না করার ফলে, সেই ডলার ভাঙাতে কিছু দালালের কাছে যায়, তারাও না করে, এভাবে যার কাছেই ডলার ভাঙাতে যায় তারাই না করে। বিভিন্নজনের না সূচক ইঙ্গিত দেখার পর দেখে একটা লোক ডলারের দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে, ডলারটাকে দিয়ে নাক ঝেড়ে রাস্তায় ফেলে চলে যাচ্ছে।
আরেকটা লোক গাছতলায় বসে একশো ডলারের নোট গুটিয়ে কান চুলকাচ্ছে।
পানের দোকানে খিলি পান বানিয়ে একশো ডলারের নোট দিয়ে পান মুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
আরেকজন ডলার মুড়িয়ে ঠোঙা বানিয়ে তাতে ঝাল মুড়ি দিচ্ছে।
আরেকজন ডলার মুড়িয়ে নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে হাচি দিচ্ছে। একই সাথে সোহেলেরও হাচি আসে। আচমকা হাচি দিয়ে এতক্ষণের ঘোর থেকে সম্বিত ফিরে পেয়ে চারদিকে তাকায়, দেখে সব স্বাভাবিক, আশেপাশে বা ধারেকাছে কোথাও কোন লোকজন নেই। সোহেল বেশ অস্থির হয়ে পায়চারি শুরু করে, কি করা যায়, কি করবে, ভাবে।

সোহেল একটা ডায়েরি বের করে যেটাতে এই ক দিন বিভিন্ন হিসাব যেমন কোথায় কত টাকা দিতে হবে, কি কি কিনবে, কোথায় দান করবে, কাকে কাকে লোন দিবে, কি কি করবে এসব লেখা, বের করে।
অনেককে সাহায্য করার লিষ্ট থেকে বাবরের সাহায্যের জন্য দশ লক্ষ টাকার আমাউন্টসহ বাবরের নামটা কেটে দিয়ে সোহেল নিজে নিজে কথা বলে, নাহ আর লেট করা ঠিক হবে না। কোন অঘটন ঘটার আগেই সব ওকে করে ফেলতে হবে। বলে মোবাইলে কল করে,
আগে যার কাছে ডলার ভাঙিয়েছিলো সেই লোকটাকে ফোন করতেই সাথে
সাথে লোকটা ফোন রিসিভ করে সালাম দেয়।
আসসালামুয়ালাইকুম স্যার । ভালো আছেন স্যার,
আচ্ছা শোন তোমার কাছে এই মুহূর্তে কি বিশাল অঙ্কের ডলার চেইঞ্জ হবে?
কত স্যার এই ধরো কমপক্ষে দশ বিশ লাখ ডলার আপনে চাইলে কয়েক মিলিওন ডলারও ভাঙাইতে পারবেন। কখন লাগবে বলেন।
আজ বা কালের মধ্যেই ঠিক আছে স্যার কোন সমস্যা নাই। আসার আগে ফাইনালি একটা ফোন দিবেন।
তোমার সাথে আমার ডিলিংসটা, আমি চাই দু জনের মধ্যেই সীমাবধ্য থাকবে। এটা নিয়ে কোন টেনশন করবেন না স্যার, ক্লায়েন্টদের বিশ্বাসই স্যার আমার গুড উইল। আমি স্যার সুইজ ব্যাংকের চাইতেও নিরাপদ।
থাংকস। বলে লাইন কেটে দিয়ে সোহেল ভাবছে, ডলারগুলো কি আজই ভাঙাবে না কি কাল। কিন্তু এখনই ডলার ভাঙিয়ে এত টাকা কোথায় রাখবে। কি করবে। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর মনে হল, আজকের মধ্যেই যত জায়গায় কথা হয়েছে, যা যা কেনার কথা যেখানে টাকা দিয়ে যা যা করার কথা সব লিষ্ট বের করে কাল টাকা তুলে সেই অনুযায়ী পেমেন্ট করলেই ব্যস নো ঝামেলা নো টেনশন। চিন্তা অনুযায়ী সোহেল যেখানে যেখানে ফোন করা দরকার, যা যা লিষ্টে আছে, সেই সাথে নতুন কিছু যা যা দরকার সেগুলো লিষ্ট করতে দ্রুত বসে যায়। বারান্দায় সোহেল তার প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে সে ঘটকের সাথে মোবাইলে কথা বলছে।

সমস্ত খাবারের উচ্ছিষ্টগুলি একটা পলিথিনে ভরে। ঘরটা সুন্দর করে ঝাড়ু দেয় সোহেল। সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর হয়ে সোহেলের মনে এখন প্লট, ফ্ল্যাট, সুন্দরী বউ, এইসব সুখ স্বপ্নে বিভোর। ঘটক সাহেব আমি কালই আপনার সাথে মিট করতে চাই। আপনি পাত্রীর সব কিছু রেডি রাখবেন, বললাম তো পাত্রী পছন্দ হলে আপনাকে পাচ দশ লাখ দিতে আমার হাত কাপবে না। ফ্যামিলি অবশ্যই ভদ্র শিক্ষিত হতে হবে। মেয়েটার চেহারায় থাকবে মায়া, চোখে দুষ্টুমি, লম্বা চুল, গায়ের রঙটা হবে লালচে ফর্সা, রাগলে যেনো মুখাবয়বটা লাল আপেলের মত মনে হয়। আর হাসলে গালে টোল, হৃদয়টা হতে হবে বটবৃক্ষের মত যার ছায়ায় আমার সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়। যার সান্নিধ্যে মনে প্রানে চাঙ্গা ভাব আসে।

বিয়ের জন্য মেয়ে পছন্দ হলে দু একদিনের মধ্যেই বিয়ে করে, আগে কিছুদিন দেশের বাইরে রিলাক্সে কাটিয়ে আসবে। এ নিয়ে এই মুহূর্তে তার মাথায় এক সুন্দরী মেয়ের মায়া শুধুই ঘুরপাক খাচ্ছে। মাথার ভেতর এই ভাবনাটাকে সে ইচ্ছা করেই আরো রঙ্গিন করে তোলার চেষ্টা করছে। কারণ এতে করে মনের ভেতর ফূর্তি কাজ করছে। দুর্বলতা কমে যাচ্ছে। শুয়ে শুয়ে কল্পনার এইসব ডালপালা মেলতে মেলতেই ঘুমিয়ে পড়ে।

আজ থেকে নতুন দিনের শুরু গুন গুন করে গান করতে করতে সেভ করে, জগ থেকে ঢেলে পানি খায়। নতুন জামা প্যান্ট পরে। ভালো করে পারফিউম স্প্রে করে। সোহেলকে বেশ পরিপাটি লাগে। আজ মনে কোন টেনশন নেই বিশাল লিষ্ট তৈরি করে ফেলেছে। সেই অনুযায়ী ডলার ভাঙিয়ে টাকা গুলি পেমেন্ট করে দিলেই, হাতে ক্যাশ টাকা খুব একটা থাকবে না, আর ক্যাশ যত কম থাকে তত টেনশন কম লাগে। কিন্তু বেশকিছু প্লট ফ্ল্যাট কেনার মধ্য দিয়ে ব্যাপক সম্পদের মালিক হয়ে যাবে আজ থেকে। বাকি যা কিছু ক্যাশ থাকবে তা থেকে কিছু দান করবে, কিছু ব্যাংকে রিজার্ভ রাখবে আর কিছু টাকা দিয়ে বিয়ে করবে, দেশের বাহিরে কিছুদিন কাটিয়ে আসবে। ব্যস। লিষ্ট করা ছোট পকেট ডাইরিটা যত্নসহ প্যান্টের পকেটে নিয়ে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে বিছানার নিচ থেকে রুমের চাবিটা নেয়।

দরজার লক খুলে রুমের ভেতর ঢুকে। তিনদিনেই মনে হয় কতদিন পর রুমে ঢুকলো। সুটকেসের কাছে যায়। উপরে ধুলার মত মনে হয়। হাত দিয়ে ধুলা মোছে। সুটকেসটা আলতো করে খোলে। সুটকেসের ভেতর চোখ যেতেই অবাক, শুন্য সুটকেসটা হা হয়ে বোকার মত ওর দিকে তাকিয়ে আছে, কোন ডলার নেই বিশ্বাস হচ্ছে না। খালি সুটকেসের ভেতর দুই হাত দিয়ে হাতড়াতে থাকে। কিছুই নেই। তাহলে কোথায় তার ডলার মাথায় কিছুই কাজ করছে না, কিছুই বুঝতে না পেরে মাথা ঘুরে পড়ে যায়।

পুরো রুমটাই অগোছালো। জগ উল্টে পানি পড়ে রুমের একপাশ ধুলা ময়লার সাথে পানি মিশে কাদা কাদা। এখানে সেখানে তুলার ছোপ ছোপ, ছেড়া গেঞ্জি। গেঞ্জির কাপড়ের ছেড়া অংশ যা দিয়ে বানানো রশি। বিছানার তোষক উলটানো, পেশাবের গন্ধ। বাবর চিত হয়ে পড়ে আছে জানালার পাশে, আর সোহেল কাত হয়ে সুটকেসের পাশে পড়ে আছে।

সোহেলের চোখ ঝাপসা থেকে স্পষ্ট হয়। উপরের সিলিংএ যত্নের অভাবে বিভিন্ন স্থানে মাকড়সার জাল জন্মেছে। কতদিন ভেবেছে এইসব ঝাড় দেবে, কিন্তু বাড়িওয়ালার সাথে ভাড়া নিয়ে ইঁদুর বেড়াল খেলার কারণে আর হয়নি। শরীরের পাস দিয়ে তেলাপোকার ডর ভয়হীন যাতায়াত। এইসব দেখতে দেখতে চারপাশে
মুখ ঘুরিয়ে রুমটার ঐপাশে জানালার কাছে চোখ যেতেই মনে হয় জানালার নিচে খাটের ওপাশে মানুষের মতো কেউ। সোহেল প্রথমে বিশ্বাস করতে পারে না, বুঝে উঠতে সময় নেয় কিছুটা। তারপরই মনে পড়ে সুটকেসে ডলার না থাকার কথা। ডলার কোথায় গেলো এই কথা মনে পড়ে যায়। সাথে সাথেই লাফিয়ে উঠে ছুটে যায় সেখানে। বাবরকে দেখে বিস্মিত, পাগলের মত বাবরের বুকের উপর বসে গলা চেপে ধরে। আর ফিস ফিস করে খুন মাখানো মুখাবয়বে জিজ্ঞাসা করতে থাকে।

আমার ডলার কই, ডলার। বল তাড়া তাড়ি বল তা না হলে আমি তোকে খুন করে ফেলবো বাবর। খুন করে তোর লাশটা পেছনের ডোবায় ইট বেঁধে ফেলে গুম করে দেবো। বলে দুই গালে চড় মারতে থাকে। গলা চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে বলে, এইবার তুই সিদ্ধান্ত নে ডলার নাকি জীবন কোনটা নিবি। তাড়াতাড়ি বল আমার হাতে একদম সময় নেই। বাবরকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে আরো ক্ষেপে যায়, চোখ দিয়ে তাকিয়ে কি দেখিস, তোর চোখ গেলে ফেলব, তাড়াতাড়ি বল ডলার কোথায়? সোহেলকে প্রচণ্ড হিংস্র দেখায়।

বাবর কোন রকমে তার শরীরের শেষ শক্তি নিঃশেষ করে ডলার রাখা বালিশগুলির দিকে হাতের ইশারা করে। সোহেল সেদিকে তাকায়। খাটের উপর চাদরে কি যেনো ঢাকা, সেদিকে যায়, চাদরটা সরায়, ভেতর থেকে বেশ কিছু ডলার বের হয়ে থাকা একটা বালিশ চোখে পড়তেই সোহেল উত্তেজনায় সেদিকে ঝাপ দিয়ে পড়ে বালিশের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিতেই বের হয়ে আসে অসংখ্য ডলার, পাশে রাখা অন্য বালিশেও ডলার রাখা দেখে খুশি হয়ে বাবরের বুদ্ধির তারিফ করে।
ওফ খুব টেনশনে ছিলাম এত ডলার নিয়ে মুভ করবো কিভাবে? অথচ তোর কি
বুদ্ধি বালিশে ডলার! নির্দ্বিধায় যে কোন জায়গায় এই বালিশ নিয়ে ছুটে যাওয়া যায়। সন্দেহ তো দূরে কারো ভাবনার মধ্যেইতো আসবে না। আসলেই তুই একটা জিনিয়াস।
কিছু ডলার বাবরের চোখের সামনে ধরে এলোমেলো করে বলতে থাকে। ডলার ফিরে পাওয়ার আনন্দে সোহেল যা খুশি তা ই বলতে থাকে নে নে ডলার নে, নিয়ে যা। নিতে পারছিস না।
নাকের কাছে নিয়ে বলে, তাহলে ঘ্রাণ শোক। ঘ্রাণ শুকতে শুকতে মর মরে যা, আমাকে নিঃশ্ব করতে চেয়েছিলি। এখন নিজেই নেই। নড়া চড়ার ক্ষমতাও নেই। আর আমি! দ্য কিং, আমার অর্ডারে সব হবে, উঠবে, বসবে, নাচবে, গাইবে, বাজনা বাজবে। যখন যেটা যে ভাবে চাইবো, সে ভাবেই সেটা হবে।

বলে দ্রুত আবার বালিশগুলির ভেতর থেকে যে ডলার গুলি বের করেছিলো সেগুলি পাগলের মত ঢুকাতে থাকে আর বলতে থাকে। ডলার, মাই সুইট কিউট ডলার, মানব সভ্যতার সেরা আবিষ্কার, এই ডলার। বলে ডলারসহ বালিশগুলিকে চুমু খেতে থাকে, আনন্দে হাসে নাচে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। হঠাৎ একটা ছেঁড়া মোচড়ানো ডলার সোহেলের সামনে বাতাসে উড়ে এসে পড়ে। সোহেল মোচড়ানো ছেড়া ডলারটা হাতে নেয়, ডলারের মধ্যে দাঁত দিয়ে কামড়ানোর দাগ স্পষ্ট হওয়ায় সোহেল তাকায় চারদিকে।

বাবরের হাতের দিকে চোখটা স্থির হয়। বাবরের হাতে একইভাবে ছেড়া আরো কিছু ডলার ধরা। কিছুক্ষণ পর পেছন ফিরে বাবরের অসাড় দেহের দিকে তাকিয়ে থাকে এগিয়ে যায়, বাবরের হাত থেকে ডলারগুলো নিয়ে বাবরের মুখের কাছাকাছি মুখ নিয়ে অপলক চোখে চেয়ে দেখে তারপর বাবরের ঠোঁট ফাঁক করে, দ্যাখে বাবরের দাঁতের ফাঁক দিয়ে ডলারের অংশবিশেষ বেরিয়ে আছে। সোহেল বাবরের মুখ ফাঁক করে মুখের ভেতর থেকে বেশ কিছু চাবানো ডলারের অংশ খুব কষ্টে আঙুল দিয়ে বের করে। সোহেলে বাবরের চোখের দিকে মুখের দিকে পুরা মুখাবয়বের দিকে তারপর পুরা শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখে। কি করুন আর অপলক চোখে বাবর তাকিয়ে আছে, চোখ কোটরাগত, মুখের হাড় মাংশ কালশেটে ধরা।

এভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সোহেল বাবরের হাত ধরে। ঠান্ডা হাত যেন বরফ গলা। হঠাৎই সোহেলর ভেতর কেউ যেন কিছু যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। সোহেলের মনে হয় খিদার যন্ত্রণায় কাতর বাবর বোধহয় ডলার খেতে চেয়েছিল, মনে হতেই চাবানো ডলার মোচড়ানো ডলারগুলোর দিকে তাকায়, তারপর মায়া জড়ানো কণ্ঠে ডাকতে থাকে
বাবর বাবর বাবর
বাবর নির্বিকার, অপলক চাহনিতে যেন সোহেলকেই দেখছে।

বাবরের চাবানো ডলারগুলির দিকে তাকিয়ে সোহেল বুঝতে পারে, তার মনে হওয়াটাই সত্য। খাবারের অভাবেই বাবর ডলার খেতে চেয়েছিলো। এটা বুঝতে পেরেই সোহেল দ্রুত উঠে বেরিয়ে যায়, একটু পর পানি ও কমলা নিয়ে ঢোকে, মুখে পানির ছিটা দেয়, কমলা ছিলে রস চিপে চিপে বন্ধ ঠোঁটের মাঝে দেয়, কমলার রস বাবরের ঠোঁটের মাঝে জমে থাকে। সোহেল বাবরের হাত পা ডলতে থাকে। অনেক্ষণ ডলার পর বাবরের চোখের পাতা হালকা নড়ে, দুই ঠোঁটের সামান্য ফাঁক দিয়ে কমলার রসটা একটু একটু করে ঠোটের ভেতরে যেতেই আনন্দ উত্তেজনায় সোহেল আরো কমলার রস মুখে দিতে থাকে, কমলা ছিলতে থাকে, মুখে পানির ছিটা দিতে থাকে। হাত পা ভালো করে ঘসতে থাকে।

সোহেল বাবরকে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে চোখের পলক ফেলতে ও কমলার রস গিলতে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে যায়, কখনও পা ডলতে ডলতে, কখনও হাত ডলতে ডলতে, কখনও কমলার রস খাওয়াতে খাওয়াতে বলতে থাকে, বাবর খা, খা বাবর, খেলেই তোর সব ঠিক হয়ে যাবে। সামনে আমাদের কত সুন্দর দিন। আমাদের কতো স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। এখন থেকে আমাদের দিন হবে আনন্দের দিন ইচ্ছা পূরণের দিন। পৃথিবীটা এখনও অনেক সুন্দর। নীল আকাশের নিচে সবুজ গাছে কত পাখি ডাকছে, ফুল ফুটে আছে, ফল ধরে আছে, সেই সব পাখিদের কোলাহল শুনতে হবে, ফুলেদের ঘ্রাণ নিতে হবে, ফলের স্বাদ, নদী তীরে শুয়ে আকাশ, বাতাসে কাশফুলের উড়ে যাওয়া, পার্কের বেঞ্চে শুয়ে জোতস্নায় নারকেল গাছের পাতার ফাঁক গলে চাদের আলোয় মায়াবি রাতে চারপাশ দেখা। তারপর যখন যেখানে যেভাবে খুশি চলে যাবো, ঘুরব ইচ্ছা মতো।

বাবর স্পষ্ট চোখে সোহেলের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সোহেলের চোখে আবেগে পানি চলে আসে আরো বলতে থাকে , হ্যাঁ আবার তুই আর আমি আমাদের পার্কের সেই সরকারি কোয়ার্টারে, না না আমার বাসায়, না না যেখানে যখন যেভাবে যা খেতে ইচ্ছা করবে, যেখানে চলে যেতে ইচ্ছা করবে চলে যাবো বাবর। হ্যাঁ সত্যি বাবর, তুই সুস্থ হয়ে উঠলে, আমরা আমাদের বাড়ি যাব। কতদিন মাকে দেখি না। দুই জনের বাবা মায়ের জন্য মনের মত জিনিস পত্র কিনব। তাদের মুখে হাসি ফুটাতে হবে। ভাই বোনদের কত ছোট ছোট আবদার টাকার অভাবে পূরণ করতে না পেরে পালিয়ে এসেছি।
এখন থেকে টাকার অভাবে আর আমাদের পালিয়ে থাকতে হবে না। এখন আমাদের এত এত টাকা দুজনে মিলে ইচ্ছা পূরণ করেও শেষ করতে পারব না। মনে জোর এনে তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠ।
কথা শেষ না হতেই বাবরের মুখে হাসির সামান্য রেশ দেখে সোহেলও হেসে ওঠে। হাসতে থাকে আর বলতে থাকে।
খা বাবর, খা, হা করিয়ে কমলার রস চিপে চিপে মুখে দিতে দিতে বলে, না খেলে
শক্তি হবে কিভাবে, শক্তি না থাকলে আমরা আনন্দ করবো কিভাবে
বলে কমলা আনে কমলার রস চিপে চিপে খাওয়াতে থাকে।
এইতো তোর হাত পা শরীর গরম হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। তুই সুস্থ হয়ে যাচ্ছিস। আরেকটু খা, খেয়ে খেয়ে আরেকটু সুস্থ হলেই ডাক্তারের কাছে যাব। সোহেলের চোখে মুখে বাবরকে বাঁচানোর আনন্দ উত্তেজনা কাজ করতে থাকে। সোহেলের সমস্ত চিন্তা চেতনাজুড়ে এখন শুধুই বাবরকে বাঁচানো।

হঠাৎ সোহেলের মাথায় কিসের যেন গুতা লাগে। মনে হল কে যেন পেছন থেকে টোকা দিচ্ছে কিছু দিয়ে। সোহেল ফিরে তাকায় আনন্দিত মুখাবয়বটা হঠাৎই আতঙ্কিত হয়ে যায়। জানালা দিয়ে বন্দুকের নল সোহেলের মাথা বরাবর তাক করা। আরেকটা বাবরের দিকে তাক করা অবস্থায় কালো পোষাকধারী অস্ত্রসজ্জিত কয়েকজন র‌্যাব ও পুলিশ ওদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে। কোনরকম নড়া চড়া বা চালাকি করার কোনরকম চেষ্টা না হাত উঁচু করে ঐ অবস্থায় থাকেন। সোহেল হাত উঁচুতে তোলে । বাবর একই অবস্থায় শুয়ে চেয়ে দেখছে অস্পষ্ট ঝাপসা চোখে।
প্রচুর দেশি বিদেশি টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে নিউজ রিপোর্টাররা নিউজ করছে। আশেপাশে দিয়ে পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনদের ছোটাছুটি করছে। সাধারণ মানুষদের ভিড় কৌতূহল বাড়ছে। এদের মধ্য থেকে একজন নিউজ রিপোর্টার নিউজ শুনিয়ে যাচ্ছে।
এই মুহূর্তে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার পাশেই ঐ বিল্ডিং এর ভেতরই লুকিয়ে আছে দুর্বৃত্তরা। যাদের কাছে ধারণা করা হচ্ছে কয়েক মিলিয়ন ডলার জাল নোটের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র গোলাবারুদের মজুদ আছে। আপনারা জানেন, যে কোন মুহূর্তে বাড়ির ভেতর আক্রমণ হবে। তাই সমস্ত বিদ্যুৎ, ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এলাকাবাসিকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। দর্শকমণ্ডলি এইমাত্র পাওয়া সংবাদে আমরা জানতে পেরেছি দুজনকে আটক করা হয়েছে এবং ভেতরে ব্যাপক অভিযান চলছে।

সারাদেশব্যাপী এই সংবাদ্গুলি বিভিন্ন চ্যানেলের বিভিন্ন নিউজ রিপোর্টারদের বদৌলতে বিভিন্ন রকমের রঙ পেয়ে টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা শ্রোতাদের আড্ডার, কথা বলার দারুণ আহার হিসেবে সরাসরি সম্প্রচার হতে থাকে। চারদিকে আইনপ্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার লোকজনের ভীষণ ব্যস্ততা, অদ্ভুত দ্রুততায় চলাচল। দূরে কৌতূহলি মানুষের ভিড়।

বারান্দার গ্রিল ভেঙে, পেছনের জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গ্যাছে র‌্যাবের দলবল। একে একে বারান্দা, বাথ্রুম, রান্নাঘর, হয়ে রুমের ভিতরে বিভিন্ন পজিশন নিয়ে সসস্ত্র অবস্থায় রয়েছে তারা। জানালার বাহিরে, সিঁড়িতে, পুরো বাড়ি ঘেরাও করে আছে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন প্রয়োগকারি সংস্থার মানুষজন। রেডিও টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানরা, রিপোর্টাররা ছবি ও সংবাদের জন্য ভীষণ ছোটাছুটি করছে।

টেলিভিশনে লাইভ দেখানো হচ্ছে। সোহেলকে হ্যালমেট, লাইফ জ্যাকেট, হ্যান্ডকাপ পরিয়ে সসস্ত্র পাহারার সাথে সিঁড়ি দিয়ে নামানো হচ্ছে। সাংবাদিকরা ছবি তুলছে। সোহেল মাথা নিচু করে চলছে।

বাবরকে একই ভাবে সসস্ত্র পাহারার সাথে লাইফজ্যাকেট ও হ্যান্ডকাপ পরিয়ে একটা বেডে করে স্যালাইন দেওয়া অবস্থায় এম্বুলেন্সে উঠানো হচ্ছে। একের পর এক স্টিল ছবির ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলছে, মুভি ক্যামেরায় একেক জন একেক এঙ্গেল থেকে বিভিন্ন পোজে ছবি ধরায় ব্যস্ত। প্রচুর পত্রিকা ও টিভি ক্যামেরা ছবি তুলছে। রিপোর্টাররা রিপোর্ট করছে। হুলস্থুল পরিবেশ। পুরা রুমের ভেতর বাহির তন্ন তন্ন করে দেখা হয়েছে। যা পাওয়া গেছে সব এক এক করে লিখে নিয়ে একটা গাড়িতে তোলা হচ্ছে। বালিশের ভেতর থেকে ডলারের বান্ডিল গুলি বের করে একটা ব্যাগে হিসেব করে করে ঢুকানো হচ্ছে। একটু পরই সংবাদ সম্মেলন হবে। কোন রকম ঝক্কিঝামেলা বিহীন একটা সাক্সেসফুল অপারেশন করতে পারায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ রেডিও, টেলিভিশন, পেপার পত্রিকার সবাই বেশ খুশি।

ডলারের পাশে দাঁড়ানো হুইল চেয়ারে বসা স্যালাইনসহ বাবরের শরীরের পাশে একটা বোর্ড পেপার ঝুলানো। যাতে লেখা,”জাল ডলার প্রস্তুতকারক, জালি বাবর।“
পাশে দাঁড়ানো সোহেলের বুকের উপর ঝুলিয়ে দেয়া বোর্ড পেপারে লেখা,” জাল ডলার প্রস্তুতকারক, ডলার সোহেল।“

এই ছবি দেখতে দেখতেই হঠাৎই আবার র‌্যাব পুলিশের ব্যাপক ছোটাছুটি আর গুঞ্জন দেখে উপস্থিত সকলেই অবাক। হ্যান্ড মাইকে সাধারণ জনগণ ও নিউজ সংগ্রহকারীদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি দিক নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে, কিছু জায়গা থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিষয়টা কি জানার চেষ্টা করছে সবাই। দিক নির্দেশনার সাথেসাথেই টেলিভিশন ক্যামেরা, স্টিল ফটোগ্রাফারদের দৌঁড়ঝাপও শুরু হয়ে গেছে চোখে পড়ার মত। একটু পরই ব্যাপারটা খোলাসা হল। টেলিভিশনে সেই ব্যাপারটা লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে।

সোহেলের রুমের পেছনের ময়লার স্তুপের উপরে জানালার সাথে রশিতে লটকানো একটা ডলার বাতাসে উড়তে দেখে সেখানে খোজা খুজি করে ময়লার নিচ থেকে ডলার ভর্তি একটা পোটলা পাওয়া যাওয়াতেই হঠাৎই এত উত্তেজনা।

ময়লার স্তুপের নিচে ডলার পাওয়ার ফলে পাশে ডোবাটার উপর সন্দেহ হওয়ায়
মুহূর্তের মধ্যেই সেটার চারপাশ ঘিরে ফেলে সসস্ত্র র‌্যাব পুলিশের লোকজন। বিকট শব্দে ডুবুরিদলের গাড়ি এসে পৌঁছা মাত্রই, একের পর এক ড্রেস পরে ডুবুরিরা নেমে পড়েছে ডোবাটার ভেতর উদ্ধার কাজে। সেখান থেকে দেশি বিদেশি বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলের রিপোর্টাররা সরাসরি নিউজ করে চলছে।
“এই মুহূর্তে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক তার উপরেই সেই জানালা যেখান দিয়ে, রশিতে বাঁধা একটা ডলার দেখিয়ে, এইভাবে লাখ লাখ কোটি কোটি জাল ডলার পাচার হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। ধারণা করা হচ্ছে এদের কাছে এখনো প্রায় বিশ মিলিয়ন ডলার জাল নোট আছে যা কিনা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় দুশ কোটি টাকার মত। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন ডুবুরিদল নেমে পড়েছে, সন্দেহ করা হচ্ছে এখানে লুকানো আছে জাল ডলার প্রস্তুতের সরঞ্জাম ও আগ্নেয়াস্ত্র।“

 

চায়ের স্টলে চা খেতে খেতে অনেক মানুষ মিলে নিউজ দেখছে। পত্রিকার পাতায় ছবি আর টেলিভিশনের রিপোর্ট দেখে এখন চা ষ্টলে চা খেতে আসা রিক্সা ড্রাইভার থেকে রিটায়ার্ডপ্রাপ্ত উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা চায়ের দোকানদার পর্যন্ত প্রত্যেকেই বিশেষজ্ঞর ভূমিকায় কথা বলছে। টেলিভিশন আর পত্রিকার খবর পড়ে, যা ঘটছে তার উপর মতামততো দিচ্ছেই, তার সাথে আরো কিছু যোগ বিয়োগ করে নিজেরাও নিজেদের মত একধরনের নিউজ তৈরি করে চা খেতে খেতে বলে যাচ্ছে। সেই সাথে সামনে কি ঘটবে, এখন কেন ঘটছে? এর পরিণতি কি হতে পারে সব অবলীলায় বলে দিতে পারছে।

পত্রিকায় স্টিল ছবি বাবর ও সোহেলের নিচে লেখা,”আদালত তাদের বারো দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।“
বিশাল হলরুম। পুরো রুম জুড়ে এমন নীরবতা বিরাজ করছে যে মনে হয় চারপাশ বধির হয়ে গেছে। কোথাও সামান্যতমও কোন শব্দ নেই। মাঝখানে একটা টেবিল। টেবিলের দুইপাশে দুইজন বসার জন্য দুইটা চেয়ার পাতা। একটা চেয়ারে সোহেল বসে আছে চুপচাপ। তার সামনে একজন পুলিশ অফিসার। এদের দুজনের মাথার মাঝখানে সামান্য উঁচুতে খুবই স্বল্প আলোর একটা বাল্ব জ্বালানো। উপর থেকে বাল্বটা এমনভাবে নিচের দিকে ঝোলানো যে দাঁড়ালেই মাথায় ঠেকার মত অবস্থা। ঝুলন্ত লাইটের আলো শুধু টেবিলটাকেই স্পষ্ট করে রেখেছে। বাকি চারপাশে ছেতরানো আলোটাকে অন্ধকার কিছুটা গ্রাস করে নিয়ে সোহেল ও পুলিশ অফিসারটির মুখাবয়বে অস্পষ্টতা এনে দিয়েছে। হলরুমটার আর চারপাশই অন্ধকার ফলে টেবিলের উপর কিছু কাগজপত্র ছাড়া আর কোন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। টেবিলের সাইজ ও বাল্বের অবস্থান দেখে অনুমান করা যেতে পারে পুরানা কোন এক আমলে এখানে এই পরিবেশে বিদ্যুৎ সঙ্কটের কালে রোগীদের হয়ত অপারেশন হত। কাটা ছেঁড়া করত। কাটা ছেঁড়া সোহেলকেও করা হবে। তবে শরীরে নয়, মনে। ছুরি চাকুতে না, শব্দ ও বাক্যের ধারালো যুক্তিতে। থমথমে পরিবেশ। গা ছমছমে ভাব। অপারেশনের পূর্বে রোগীর কাগজপত্র টেষ্ট রিপোর্ট যেভাবে চেক করা হয়, সেভাবেই সোহেলের রিপোর্ট ফাইলপত্র পুলিশ অফিসারটি ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে কোথা থেকে কিভাবে শুরু করবে। সোহেল নির্বিকার। তার কোন প্রস্তুতি নেই, ধারণা নেই, অভিজ্ঞতাও নেই। এইরকম একটা পরিবেশে পুলিশ অফিসার সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
ডলার জাল করার সরঞ্জামগুলো কোথায়?
বহুদূর থেকে গম গম করে কথাগুলো আবার রিপিট হচ্ছে।
সোহেল মরিয়া হয়ে বলছে, বিশ্বাস করেন আমি জানিনা।
পুলিশ অফিসার হেসে,যে জানে তার নাম কি? কোথায় থাকে।
আমি এইসবের কিছুই জানি না ।

কেউই প্রথমে কিছুই জানেনা, তারপর যখন মনে পড়ার ঔষধ দেয়া হয় তখন সব অনায়াসে মনে পড়ে যায় আর বলতে থাকে। আমি আপনাকে মনে করার কোন ঔষধ দিতে চাই না। কারণ আপনি একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। ঔষধ ছাড়াই আপনার মনে পড়ার কথা।
ঠান্ডা ভাষায় পুলিশ অফিসার গম্ভীরমুখে যে কথাগুলো বলল তার অর্থ যে ভয়াবহ সেটা বুঝতে পেরে সোহেলের মুখের লালা শুকিয়ে কথা আটকে আটকে আসে,
দেখেন এই ডলারগুলা যে জাল এইটাও আমি জানতাম না।
কিছুই আপনারা জানেন না। প্রথম দিন ডলার বিক্রির দশ লাখ টাকা দিয়ে কি করেছেন।
জামাকাপড় কিনেছি ফ্রিজ টিভি খাট পালং কিনেছি, খাওয়া দাওয়া করেছি আর কিছু ঔষধ কিনেছি।
একটু চিন্তিত মুখে পুলিশ অফিসারটি সোহেলের মুখের কাছাকাছি নিজের মুখাবয়ব এনে জিজ্ঞাসা করে, ঔষধ কিনেছেন! কেন?
ঘুম হতো না, খেতে ইচ্ছা করতো না, কোন কিছুই ভালো লাগতো না তাই।
স্ট্রেইঞ্জ। বলে ডলার রাখা সেই দশাসই সুটকেসটা দেখিয়ে পুলিশ অফিসারটি বলে, এই সুটকেসটা কিনেছেন কোথা থেকে।
যে গর্তের কথা আপনাকে আগে বলেছিলাম সেই গর্তে মানে গর্তের ভেতরই এই সুটকেসটা, আর সুটকেসের ভেতরেই ডলারগুলি ছিল।
সোহেলের কথা শেষ করতে না দিয়েই পুলিস অফিসারটি হালকা ধমকের সাথে বলে,
গর্তের গল্পতো বহুবার শুনলাম। এখন বলেন সেই গর্তের লোকগুলো কোথায়, তারা কারা।
বিশ্বাস করেন আমি এর চেয়ে বেশি কিছু জানিনা।
তাহলে কে জানে? বাবর জানে? আপনার বন্ধু বাবর।

সোহেল হাউ মাউ করে কেদে বলতে থাকে, বিশ্বাস করেন ভাই আমি কিছু জানি নারে ভাই, আমি কিছু জানিনা।
পুলিশ অফিসার ধমক দিয়ে বলে। চুপ একদম চুপ। যা জিজ্ঞাসা করবো শুধু সেটার উত্তর ছাড়া আর কোন কথা না। বাড়তি কোন শব্দ না, কোন কান্নাকাটি না। এখানে কেউ কাউকে দয়ামায়া দেখায় না। দয়ামায়া দেখানোর জায়গা এটা না।
সোহেল বসে থাকে। পুলিশ অফিসারটি কলিং বেলের সুইচ দিতেই কর্কশ শব্দে কলিং বেলটা বেজে ওঠে। বেল বাজার সাথে সাথেই আরেকজন পুলিশ আসে। নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করতে করতে চলে যায়, সোহেল চারপাশে তাকায়, বাধা অবস্থায় নিজেকে একবার দেখে নেয়। মাথাটা চেয়ারে এলিয়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে আবার জিজ্ঞাসাবাদ চলে। প্রথম প্রথম বেশ ভয়, আতংক তৈরি হলেও একসময় সয়ে যায় সব। মনের ভেতর ব্যাপারটা এমনভাবে জমে যায় যে যা হবার হবে আমার আর কিছুই করার নেই।

স্বল্প আলোর একইরকম একটা রুমে বাবর একটা হুইল চেয়ারে বসা। সামনে মুখোমুখি চেয়ারে পুলিশ অফিসারটি বসা। বাবরকে জিজ্ঞাসা করে
এখন কেমন আছেন? শরীরে দুর্বলতা কেটেছে?
বাবর মাথা তুলে বলে, জ্বী এখন ভালো।
ভালো আছেন শুনে ভালো লাগলো।
বলে পুলিশ অফিসারটি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে
শুনেছেন বোধহয় আপনার বন্ধু কিন্তু সব কিছু স্বীকার করে ফেলেছে, এখন আপনার স্বীকারোক্তিটা পেলেই আমরা একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারবো।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কারণে আদালতে আপনাদের জন্য আমরা মিনিমাম শাস্তির আবেদন করবো। যাতে করে আপনারা অল্পসময়ের মধ্যেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন। সুতরাং যা যা জানেন বলতে থাকেন। বাবর বলতে থাকে।
রাত কয়টা বাজে জানি না। হঠাৎ ফিস ফিস শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। উঠে দেখি দুজন লোক পার্কের গর্ত খুড়ে তারপর সেই গর্তে বাক্সটা ফেলে মাটি চাপা দিয়ে চলে যায়। সেই লোক দুজনকে আমি চিনি না।
পুলিশ অফিসারটি বাবরের কথা থামিয়ে দিয়ে বলে।
এই বিষয়টা বাদ দিয়ে অন্য বিষয়ে বলেন।
বিশ্বাস করেন যা দেখেছি তাই বলছি।
মনে করেন আপনার এই কথা আমি বিশ্বাস করলাম না। এইবার এই কথা ছাড়া অন্য আর যেই কথা জানেন সেইটা বলেন, সেইটা বিশ্বাস করতে পারি কি না দেখি। বলে পুলিশ অফিসারটি বাবরের চোখের দিকে সরাসরি তাকায়। বাবর মরিয়া হয়ে বলতে থাকে
এছাড়া আমি আর কিছু জানি না।
আচ্ছা ঠিকাছে যা যা আপনি জানেন না সেগুলি বলেন।

এভাবেই কথার পিঠে কথা। যুক্তি তথ্য দিয়ে কথা। ডর ভয় দেখিয়ে কথা আদায় করার ব্যর্থ চেষ্টার মাঝেই ওদের খাওয়া, ঘুম, জেরা চলতে থাকে। সময় বয়ে যায়। এভাবে কত সময় গেল, কি বার, কত তারিখ, কোন মাস সব কিছুই ওদের কাছ থেকে হারিয়ে গেল। কখন দিন আসে রাত যায়, রাত আসে দিন যায়। কিছুই জানা নেই। দুজন পুলিশের লোক। আর চেয়ার টেবিল এই তাদের জগত। নতুন করে আলো জ্বলে না নেভে না একই রকম থাকে। সেই দুইজন পুলিশ অফিসার ছাড়া আর কারও দেখা নেই, এবং তাদের মুখের ভাষা অবয়বে তেমন

কোন চেইঞ্জ নেই। এই ভাবে একই রকম ভাষা শুনতে শুনতে একইরকম অবয়ব দেখতে দেখতে তারা দুজন যেমন অধৈর্য। পুলিশ অফিসার দুইজনও তেমনি বিরক্ত। তবুও নিরুপায়। যেনো অনন্ত কাল তাদেরকে এই দুজন লোকেরই কাছ থেকে এসবই শুনতে হবে। একটু আগে কোথা থেকে যেন টিকটিকির ডাক শোনা গেল। তখন খুব ভালো লাগল। কতদিন অন্যরকম শব্দ অন্য ভাষা শোনা হয়নি। টিকটিকির ডাক থেমে গেলে মনে হল, আহ আর ডাকে না কেন? আর কিছুক্ষণ যদি ডাকতো। টিক টিক টিক করে কি সুন্দর মায়া জড়ানো কণ্ঠে কথা বলে গেলো ওরা। কতদিন গাঢ় অন্ধকারে ঘুমানো হয় না। চোখের সামনে একটা লাইট সর্বক্ষণ জ্বলে থাকে। একই আলোয় ঘুমে জাগরণে বসে থেকে মাথার ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা করে। মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছা করে, আলোটা বাড়িয়ে দেয়া যায় না। চারিদিক প্রচণ্ড আলোয় ধাবমান হয়ে থাকুক। কিংবা আলোটা নিভিয়ে দেয়া যায় না, অন্ধকারে ডুবে থাকুক কিছুক্ষণ। চারপাশটায় কিছু সময় নিকষ কালো ঘোর অন্ধকার বিরাজ করুক।

হঠাৎ করেই পুরো হলঘরটার সমস্ত আলো চলে যায়। অন্ধকার চারিদিক। অন্ধকার গিলে ফেলল সব আলোকে। অন্ধকার যে ভীষণ অন্ধকার। হঠাৎ করে আলো থেকে ভীষণ অন্ধকারে ঢুকলে প্রথম প্রথম সব কিছুকেই ভীষণ অন্ধকার মনে হয়। চোখে দেখা যায় না কিছুই। তারপর ধীরে ধীরে অন্ধকারকে ছেনে নিয়ে ঝেড়ে নিয়ে তবেই চোখ অন্ধকারের ভেতর এক ধরনের আলোর অস্তিত্ব খুঁজে পায়। তবে এর জন্য কিছু সময়ের অপেক্ষায় থাকতে হয়। কিন্তু সোহেলের অপেক্ষার সময় বেড়েই চলছে। অন্ধকার ভেদ করে সামান্য আলোর বিন্দু বা রেখা কোথাও স্পষ্ট বা অস্পষ্ট হচ্ছে না। অন্ধকার চারপাশে শুধুই নিকষ কালো অন্ধকার। এমন অন্ধকার যে নিজেকেই নিজে দেখতে পারছে না। এর ভেতর সবই অস্তিত্বহীন নিরাকার। অদেখা আকার যতটুকু টের পাওয়া যায় তা শুধু নিজের অঙ্গ প্রতঙ্গকে স্পর্শ করার মধ্যে। সোহেলের চোখের চারপাশটাই কি শুধু অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে? না কি সবই ঠিক আছে সোহেলই শুধু দৃষ্টিহীন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় সোহেলের ভেতরের অন্তরাত্মা অস্থির হয়ে উঠছে। হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। কোন কিছুই মনে আসছে না। কেবলই এখান থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছে। অন্ধকার থেকে সামান্য হলেও নিজের হাত পা বুক পেট নখ আঙুল দেখার আকুতি এই মুহূর্তে তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কি করবে কি করা উচিত। হঠাৎই অন্ধকারে এলোমেলো হাটা শুরু করল উদ্দেশ্যহীন। কিন্তু হঠাৎই মনে হল কোথায় যাচ্ছে? কিভাবে যাচ্ছে? পা নেই, পদচিহ্ন নেই।

একেমন পথচলা? আবার থমকে দাঁড়ায়। কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? নিজের চিন্তা চেতনা কুণ্ডলি পাকিয়ে নিজের ভেতর নিজে ঢুকে অন্ধকারে শুধু ঘুর পাক খাচ্ছে। এখন তার চিন্তায় মা বাবা ভাইবোন আত্মীয় স্বজন বন্ধু কেউ নেই। এমন কি নিজেও কি আছে? থাকলে কোথায় সে? এখন দেখতে কেমন? সেতো তার নিজেকেই দেখতে পারছে না। মাথার মধ্যে কি হচ্ছে। হাসি না, কান্না না। ক্ষুধা যন্ত্রনা কিছুই নেই, কিচ্ছু না। শুধু বুকে আর মাথায় ঘড়ির কাটার মত বিটগুলো দ্রুততার সাথে ধিব ধিব করে যাচ্ছে। মুখাবয়ব থেকে ঘাম ঝরে পড়ছে বুকের উপর। ঘাম বেয়ে পড়ছে ঘাড় থেকে শরীরে। সেই ঘাম বেয়ে পড়ার যে শিহরণ তা যে কত আপন এখন। কিন্তু সেটাও মুহূর্তে শুরু হয়ে মুহূর্তেই মিলিয়ে যাচ্ছে। বহদিনের পুরানা রাজপ্রাসাদের ইটের সারির মত পিঠের মেরুদন্ড বেয়ে শ্যাওলা জমার মত ঘাম জমে যাচ্ছে। ঘামে চপচপা শরীর। কি করবে, কোনদিকে যাবে। এলোমেলো চিৎকার করছে, দিগ্বিদিক ছুটছে।

আরেকদিকে জমাট অন্ধকারে হুইল চেয়ারে বসে থাকা বাবরের নিজেকে নিজে দেখতে না পারা অস্তিত্বের ভেতর যখন চোখের সামনে জনমানবহীন এক অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রান্তর। নিজের কাছেই নিজের অস্তিত্ব এখন প্রশ্নের সম্মুখীন? সে যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে সে কে? কোথায়? তার কোন কিছুই দেখা যাচ্ছে না কেন? ভাবতে ভাবতেই নিজের অজান্তে চিৎকার করে ওঠে,” আমি কোথায়?” সেই সময় তার চিৎকারের পরপরই হয়ত তার চিৎকার শুনেই সোহেলও চিৎকার করে ওঠে। সোহেলের চিৎকার শুনে বিস্মিত হয়ে আনন্দ উত্তেজনায় বাবর চিৎকার করে জানতে চায়, সোহেল তুই কোথায়?
সোহেল বলে, এই যে এখানে। কিন্তু এখানে কোনখানে? সে প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। অপরদিকে বাবরও কোনখানে কোন অবস্থান থেকে কথা বলছে সেই ঠিকানাও সোহেলের অজানা। এরকম অজানা অচেনা ঠিকানাবিহীন, সময়হীন না দেখা এক প্রান্তরে তারা একে অন্যের খুব কাছাকাছি ভেবে, শুধু শব্দের উপর ভর করে শব্দের মাপে মাপে শব্দ ধরে ধরে দুজন দুজনের দিকে ছুটছে। কিন্তু সেই শব্দগুলো কখনো মনে হয় হাতের ডানদিক থেকে আসছে, ডানদিকে ছুটে ছুটে ক্লান্ত হলে মনে হয় বামে গেলেই সঠিক পথ। কিন্তু ডান কিংবা বাম কোন পথেই দুজনকে এক পথে আনতে পারে না।

বদ্ধ অন্ধকার হল ঘরটায় ওদের ডাকাডাকির শব্দ হলঘরের চারদিকে বিভিন্ন স্থানে বাড়ি খেয়ে খেয়ে কথার প্রতিধ্বনি হয়ে সারা ঘরময় উড়ে বেড়ায়। একেকটা শব্দ ফেটে একাধিক শব্দ হয়ে ঘরময় ঘোরা ফেরা করে শুধু। ফলে সেই শব্দের এলোমেলো ধ্বনিতে ওরা ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত দিশেহারা হয়ে শুধু কথাই বলে যায়। অন্ধকারে সোহেল জোরে জোরে বলতে থাকে।
বাবর, আমরা এখন কোথায়?
সোহেলের মত বাবরও জোরে জোরে বলতে থাকে, জানিনা। আমি কিছুই দেখতে পারছি না, তুই কি কিছু দেখতে পারছিস?
না, আমিতো আমার নিজেকেও দেখতে পারছি না।
তাহলে কি আমরা অন্ধ হয়ে গেছি।
জানিনা। বুঝতে পারছি না, আমরা কি অন্ধ হয়ে গেছি না কি আমাদের চারদিক অন্ধকার করে দেয়া হয়েছে।
আচ্ছা অন্ধকারেও তো কিছু না কিছু আবছা হলেও দেখা যায়। কিন্তু এই অন্ধকারে তো নিজেরাই নিজেদের দেখতে পারছি না।
এটা কি তাহলে সেই অন্ধকারের মত?
কোন অন্ধকারের কথা বলছিস?

 

যে অন্ধকার মানুষের ভেতর জন্মায়, যে অন্ধকারে মানুষ তার নিজের ভেতর হারিয়ে যায়। চিনতে পারে না নিজেকে। দেখতে পায় না অন্যকেও।
কি রকম?
এই যেমন অহংকার হিংসা আর জেদের ভেতর ঢুকে গেলে যেমন হয়। ডলারের মালিক হওয়ার অহংকারে আমরা এত অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিলাম যে একজন আরেকজনের এত কাছে থেকেও অহংকারের অন্ধকারে নিজেরা এক অপরকে খুঁজে পায়নি। হিংসায় জ্বলে যাচ্ছিলাম, জেদে খুন পর্যন্ত করতে চাচ্ছিলাম। এত অহংকার কেন? অন্ধকারে যার নিজেকেই দেখা যায় না। সেই আমি এখন কে?
তুই ঠিকই বলেছিস বাবর অহংকার আর হিংসায় এতটা অন্ধকারে পড়েছিলাম যে আসল নকল পর্যন্ত চিনতে পারছিলাম না। নকল জিনিসের মোহে কত স্বপ্ন আশা তৈরি করেছি মনে। এখন সেইসব মিথ্যা স্বপ্ন আশা যে কত ভয়াবহ হতাশা। আহ এত অন্ধকার আর সহ্য হচ্ছে না রে বাবর। আর কতোক্ষণ এই অন্ধকার? বাবর এই অন্ধকার থেকে এখন আমাদের মুক্তির উপায় কি?
আলো। আলো ছাড়া অন্ধকার থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই। আলো মানে মুক্তি। আলো মানে জ্ঞান। আলো আসলেই দেখবি তুই আমি আমরা আমাদের অবস্থান, স্থান, কাল, হাত পা চোখ কান নাক মন প্রাণ, সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। পথের যত অন্ধকার সব দূর হয়ে যাবে।
কিন্তু আলো আসবে কোথা থেকে?
বাবর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, জানিনা।
বাবরের মুখে জানিনা শোনার পর, সোহেল আতংকগ্রস্ত হয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে। কে আছো আলো জ্বালাও। আমরা ভীষণ অন্ধকারে পড়ে আছি। কে আছো আলো জ্বালাও।
সোহেলের চিৎকারে বাবরও চিৎকার করে বলতে থাকে।
আমরা অন্ধকার থেকে বাঁচতে চাই। কে কোথায় আছো আলো জ্বালাও আলো,
হঠাৎ প্রচণ্ড আলো জ্বলে ওঠে হলরুমটায়। আলো দেখেই বাবর খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলতে থাকে।

আলো আসছে আলো। সোহেল দেখ অন্ধকার ভেদ করে কি ভীষণ আলো আসছে।
সোহেলও আত্মতৃপ্তি নিয়ে বলতে থাকে।
হ্যাঁ আসলেই রে আলো ছাড়া জীবনটা খুবই অন্ধকার।
শুধু জীবনই না সমাজ সভ্যতা, সত্য মিথ্যা, বিশ্বাস অবিশ্বাস সবই অন্ধকার।
হঠাৎই সোহেল উপলব্ধি করে, আলোতেও সে কিছু দেখতে পারছে না। তাই সে বাবরের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে।
বাবর তুই কি কিছু দেখতে পাচ্ছিস?
বাবর চারপাশে যেদিকে তাকায় শুধুই আলো দেখতে পায়। আলো ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। বাবর এরপর নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গর দিকে তাকায়, কোন কিছুই দেখা যাচ্ছে না, নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গও না। সেখানেও শুধু আলো ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না, আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এত আলোয় চোখও মেলে রাখা যাচ্ছে না। নিজের এবং চারপাশে আলো শুধুই আলো ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না, সবই অস্তিত্বহীন।
সোহেলও দেখার চেষ্টা করতে করতে প্রচণ্ড আলোয় চোখ মেলে রাখতেই এক পর্যায়ে চোখ ঝলসে যাওয়ার মত অবস্থা তৈরি হওয়ায় চোখ বন্ধ করে ভয় আতংকে চিৎকার করে ওঠে। বাবর, এতো আলোয় আমিতো কিছুই দেখতে পারছি না।
অনেক অন্ধকারে যেমন দেখা যায় না, অনেক আলোতেও তেমনি দেখা যায় না।
দেখাতো দূরের কথা চোখইতো মেলতে পারছি না। এ আলোয় তো চোখই ঝলসে যাচ্ছে। এ কেমন আলোরে বাবর? দেখা যাবে না বলে কি চোখও মেলা যাবে না?
বাবর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, সোহেল ভেবে দেখ আমাদের চারপাশে এত আলো, এত আলো অথচ এসব আলোয় চোখ মেলে দেখাতো দূরের কথা, চোখ থাকতেও অন্ধের মত চোখ বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে। কি অদ্ভুত তাই না?

 

এ কোন জগতে আমরা এসে পড়লাম রে বাবর যে জগতের আলোটা অন্ধকারের চাইতেও তো জঘন্য। অন্ধকার থেকে মুক্তির পথ যে আলো। এই কি সেই আলো? এই যদি সেই আলো হয় তাহলে তো আমাদের অন্ধভাবে চোখ বন্ধ রেখেই মৃত্যুর দিন ধ্বংসের দিন গুনতে হবে?

দুজনই চুপ। শব্দহীন কিছুসময় চলে যায়। শব্দহীন মানে একেবারেই শব্দহীন যেখানে নিজেদের শ্বাস প্রশ্বাস আর হার্টবিটের শব্দগুলোই শুধু বড় হয়ে অস্বস্তির সাথে কানের চারপাশে শো শো করছে আর বুকের ভেতর ঢিব ঢিব করছে শুধু। আর কোন সাড়া শব্দ নেই আশেপাশে কাছেদুরে কোথাও। বাবরের কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে সোহেল অস্থির হয়ে বাবরকে ডেকে বলতে থাকে। বাবর তুই চুপ কেন? তোর কি কিছু হয়েছে?
বাবর খুব গম্ভীর অথচ ভয়ে ভয়ে বলে, টের পাচ্ছিস সোহেল, চারদিক কি নীরব।
সোহেল কিছুক্ষণ চুপ থেকে চারপাশের নীরবতা ভালো করে লক্ষ্য করে।
সোহেলও নীরবতা অনুভব করে ভয়ে ভয়ে বলে, হ্যাঁ আসলেইতো চারদিক খুব নীরব। কোথাও কারো কোন সাড়াশব্দ নেই, ঝি ঝি পোকা, কিংবা কাকের কা কা, বাচ্চাদের কোলাহল, বড়দের হৈ চৈ, কিংবা কোথাও কোন কিছুই নেই। এতো এতো নিরব কেনো? আমাদের চারপাশে কি কেউ নেই? কোন কিছু নেই? সব কি নীরবে নিঃশব্দে ধ্বংস হয়ে গেল নাকি।

সোহেলকে চুপ থাকতে দেখে বাবর অস্থির হয়ে সোহেলকে ডাকতে থাকে। সোহেল তুই চুপ কেন? কথা বল। যা মনে আসে বলতে থাক। কথাই এখন আমাদের একমাত্র সম্বল, কথাই এখন একমাত্র শব্দ। আমরা এখন শুধু কথাই বলে যাব। কথার কথা, বানানো কথা, কথার পিঠে কথা, শুধু শুধুই কথা বলতে থাক, কথা বলা ছাড়া আমাদের এখন আর কিছু করার নেই।
সোহেল চিৎকার করে বলতে থাকে, শুধু কথা না, চিৎকার করে কথা বলে জানান দিতে হবে আমরা এখনও বেচে আছি, এই জঘন্য কুৎসিত আলো অন্ধকারের মাঝেও আমাদের অস্তিত্ত্ব টিকে আছে। আমরা জেগে আছি।

অন্ধকারের পর যে আলোর আশায় আমরা ছিলাম। যে আলো অন্ধকারে আমরা থাকি আমরা চলাফেরা করি, আমরা বাঁচি। যে আলো মানে জ্ঞান, যে আলো সমস্ত অস্পষ্টকে স্পষ্ট করে। যে আলো সমস্ত অন্ধকার দূর করে পথ দেখায়, অন্ধকারের ভয় সংশয় দূর করতে যে আলো, সব ধরনের অন্ধকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী যে আলোকে আমরা জানি। সেই আলোয় আমরা আমাদেরকেই দেখতে পারছি না। দেখার চোখই ঝলসে যাচ্ছে। আমরা অনুভব করতে পারছি না। আমাদের অনুভূতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আমাদের চিন্তাগুলি অবসাদগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের অস্তিত্ত্ব শুন্য হয়ে যাচ্ছে। এ আলোর পর কি?
জানিনা, আমার মাথায় কিছুই কাজ করছে না। বাবর কোথাও কোন সামান্য শব্দ হচ্ছে না কেন? চারপাশে সব কি ধ্বংস হয়ে গেল নাকি। যেমন ধর সব ধ্বংস হয়ে গেছে আশেপাশে গাছপালা পশুপাখি মানুষ সব। বেচে আছি শুধু তুই আর আমি এভাবে এখানে এবং এভাবেই, যেভাবে আছি। এভাবেই কি বেচে থাকা সম্ভব?
অসম্ভব। কি বলছিস তুই। সোহেল আমার দম আটকে আসছে।
ওরা কেউ কাউকে দেখছে না শুধু কথা বলে যায়। একসময় কথাও ফুরায়। যখন কথা বলার ভাষা হারিয়ে যায়। চিন্তার জগতে আর কিছু কাজ করে না সব এলোমেলো ওলট পালট। কেউ কিছু দেখতে পারছে না, প্রচণ্ড আলোর ঝলকানিতে চোখ মেলতে পারছে না। শুনতে পারছে না। আশেপাশে সব নীরব। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কথা বলেওবা আর কতক্ষণ অস্থিরতা অনিশ্চয়তাকে আটকে রাখা যায়। সোহেলের মনে পড়ে ছেলেবেলায় একবার নৌকায় করে বিলের মাঝে গোসল করতে গিয়ে নৌকা ডুবে পানিতে তলিয়ে যাবার সময়ও এমনি মনে হয়েছিল। চোখের চারপাশে উপরে নিচে শুধুই পানি, আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পানি থেকে ভেসে উঠার জন্য হাত পা নাড়াচ্ছে এলোমেলো, কিন্তু কিছুই করা যাচ্ছিল না শুধু পানি খেতে খেতে ডুবেই যাচ্ছিল। ওই কয়েক মুহূর্তকে যে কত শত হাজার বছরের মত মনে হচ্ছিল তখন, সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আজো জ্বলজ্বলে হয়ে মাথায় গেথে আছে।

নাকে নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না পানি ঢুকে যাচ্ছিল, পানির চাপে কানে কোন শব্দ ঢুকছিল না। সব এলোমেলো অসাড় হয়ে আসছিলো। এভাবে পানি খেতে খেতে, পানি দেখতে দেখতে, পানিতে তলিয়ে যেতেই, হঠাৎ ছোট মামা তার দুই হাতের ছোবলে পানি থেকে তুলে এনেছিলেন, মনে আছে। কিন্তু এখন এত আলোয় যখন আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে, আলোর মাঝে হাতড়াচ্ছে, ছুটছে, কথা বলছে, মনে করতে গিয়েও মনে আসছে না। অতীতের স্মৃতি, ভবিষ্যতের আশা আকাঙ্ক্ষা সব ধুয়ে মুছে যাবার মত অবস্থা। আলোর সাথে কবরের নির্জনতা মনে হয় একাকার হয়ে ধেয়ে আসছে। এখন কে বাঁচাবে? চিৎকার করে তখন শুধু বলে চলছে।
কে আছো সাড়া দাও, কে আছো আওয়াজ করো,
এইসব আলো অন্ধকার থেকে আমাদের বাঁচাও।
আমরা চিন্তা চেতনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষা স্মৃতি কথা ভাষা সব এলো মেলো হয়ে যাচ্ছে।
আমরা নেই হয়ে যাচ্ছি
আমাদের চারপাশ কি আছে না নাই? ধ্বংস কি সব
স্বজোরে চিৎকার করে বলতে থাকে, আমরা দেখতে চাই, যা হোক একটা কিছু দেখাও। হোক সুন্দর, কুৎসিত, বর্বর যা কিছু দেখাও দেখতে চাই, শুধু দেখতে চাই, কতদিন দেখার জন্য যে চোখ, সে চোখ দেখতে না পেয়ে, দেখার ক্ষুধায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাস কর চোখ আছে কিন্তু সে চোখ মেলে কিছু দেখতে পারছি না। অথচ চারপাশ আলোয় আলোকিত। ভাবতে পারছো কেউ।
বলা ছাড়া আর কিছুই বাকি নেই তাই, আরো জোরে গলা ফাটিয়ে বলতে থাকে আমাদের চারপাশ এত এত নীরব কেন? আমরা শুনতে চাই, মানুষের হৈ চৈ চিৎকার আনন্দ, খারাপ শব্দ ভালো শব্দ। যা হোক একটা কিছু। শোনার জন্য এই কানটা অস্থির হয়ে আছে, কিছুই শুনতে না পেয়ে মরে যাচ্ছে। পাখির কিচির মিচির, আনন্দ উল্লাস, চেঁচামেচি হাসিকান্না যা হোক একটা কিছু শোনাও।
আমরা কিছুই শুনতে পারছি না। অথচ আমরা অন্ধ না, আমরা বধির না।

যেনো সোহেল বাবরের খুব কাছে, খুব কাছের আপন জন বন্ধু ভাই, তাই দরদি কণ্ঠে খুব যত্ন নিয়ে ধীরে ধীরে বলে, সোহেল আমার খুব মানুষ দেখতে ইচ্ছা করছেরে। মানুষ কি বেঁচে আছে রে? আমার খুব তোকে দেখতে ইচ্ছা করছে। কতদিন মনে হয় তোকে দেখি না , কতদিন কোন মানুষ দেখি না। হাত পা চোখ মুখ নাক কান ওয়ালা জলজ্যান্ত মানুষ। মানুষের কোলাহল শুনি না কতদিন কত মাস, কত বছর।
সোহেলের ভেতর তখন অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতার তীব্রতায় তাকে উন্মাদনায় পেয়ে বসে। সোহেল চিৎকার করে বলতে থাকে আমরা দেখতে চাই, শুনতে চাই, যা কিছু হোক পচা গলা, সুন্দর অসুন্দর খারাপ ভাল দেখাও শুনাও। বাঁচাও আমাদের বাঁচাও। আমরা এই আলো থেকে এই নীরবতা থেকে বাচতে চাই। কে আছো বাঁচাও। আমাদের দেখতে দাও, শুনতে দাও।
ঠিক তখনি ডানে বায়ে সামনে পেছনে উপরে নিচে একে একে বিভিন্ন দৃশ্য তাদের সামনে ভেসে আসে। মানুষের আর্তনাদ, কান্নার ধ্বনি, চিৎকার, ছোটাছুটি, গুলির শব্দ, গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়া মানুষ।
শরণার্থী মানুষের ঢল, আহত মানুষের দল, মানুষের সারি বাঁধা লাশের স্তূপ, সাহায্যের আশায় মানুষের অসহায় মুখাবয়ব।
বাবর তখন এসব দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে হুইল চেয়ারে একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু যাখানেই ছুটছে সেখানে একই দৃশ্য চোখের সামনে একই হাহাকার ধ্বনি, ছোটাছুটি করে কি হবে ভেবে এসব শব্দ দৃশ্য থেকে মুক্তি পেতে চোখ কান বন্ধ করতে যাবে তখনি সোহেলের কণ্ঠ শুনতে পায়। তাকায় দুজনই দুজনকে দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা, চোখে পানি এসে যায়। দুজনই দুজনের কাছাকাছি পৌঁছে দুই বন্ধুতে বাঁচার আনন্দে আশাবাদী হয়ে কিছু বলতে যাওয়ার মুহূর্তেই বিকট শব্দে চারপাশটা কেঁপে ওঠে। ওরা তাকায় ক্রমাগত আওয়াজের সাথে আর্তনাদ ভেসে আসে।
কিছু বুঝতে না পেরে ভয়ার্ত চোখে পাশেই তাকিয়ে দেখে ধেয়ে আসা যুদ্ধ বিমান থেকে বোমা পড়ছে একইসাথে ট্যাংক থেকে গোলা ছুড়ছে। আর মানুষের দল দিগ্বিদিক ছুটছে। বাড়িঘর, গাছপালা সব ভেঙে পড়েছে। চারপাশে যেদিকেই তাকাচ্ছে রক্তাক্ত মানুষ শুয়ে, বসে, কাতরাচ্ছে। হাত পা চোখ কানবিহীন মানুষের খণ্ডাংশ এলোমেলো ছড়ানো ছিটানো। এইসব দৃশ্য থেকে মুখ লুকাতে যেদিকে তাকায় উপরে নিচে ডানে বায়ে সামনে পেছনে সব জায়গায় একই দৃশ্য, এইসব দৃশ্য দেখে সোহেল চোখ বন্ধ করে বলে। এসব কি দেখছি। মানুষ বড় কঠিন সময়ের মধ্যে পড়ে গেছেরে বাবর। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
বাবরও তখন মাথানিচু করে বলতে থাকে। আমিও পারছি না। মানুষের এরকম
অবস্থা আমারও সহ্য হচ্ছে না। হাসি খুশি সুস্থ সবল মানুষ দেখলাম না একজনও। কোথাও কি এরকম মানুষ নেই? মানুষ দেখতে চেয়েছি বলে কি সব এইরকম বিকলাঙ্গ, মুমূর্ষূ, মৃত মানুষ? হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। আমাদের এ অবস্থা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে হবে।
এমন সময় একপাশের দেয়াল জুড়ে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্টদের ভাষণের দৃশ্য পর্দায় ভেসে উঠতেই উদ্ভ্রান্ত সোহেল তাদের কাছে তাদের উদ্দেশ্যে দুহাত উঁচু করে বলতে থাকে,
হেল্প হেল্প প্লিজ হেল্প, আমাদের বাঁচাও, আমাদের বাঁচাও, এ অবস্থা থেকে আমাদের বাঁচাও
বাবর সোহেলের কাছে এসে বলতে থাকে।
তুই কি পাগল হয়ে গেলি নাকি। এরাতো মানুষ না, ছায়া। ছায়াদের কোন কিছু করার ক্ষমতা নেই। ছায়ারা অক্ষম। সোহেলকে তবুও একইভাবে কথা বলতে দেখে বাবর সোহেলের শরীরে প্রচণ্ড ঝাকি দিয়ে আবারও একই ভাবে বুঝাতে থাকে এসবই ছায়া। ছায়া শুধু সঙ্গী হয়। ছায়ার কোন ক্ষমতা থাকে না। কিছুক্ষণ পর সোহেল অসহায় মুখাবয়বে মরিয়া হয়ে বাবরকে জিজ্ঞাসা করে, মানুষ ছাড়া মানুষের ছায়া আসবে কোথা থেকে? মানুষ বিহীন ছায়া অসম্ভব। নিশ্চই মানুষ কেউ আছে কোথাও না কোথাও।

বাবর সোহেলকে বুঝিয়ে বলে, সেই মানুষ আর মানুষের ছায়া মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে রে, এখন কোনটা যে মানুষ আর কোনটা যে ছায়া কিছুই স্পষ্ট না।
সোহেল অবাক হয়ে বলে, ঠিক যেভাবে আলো অন্ধকারগুলো মিলে মিশে একাকার হয়ে আমাদেরকে অন্ধ করে দিচ্ছে, সেরকম?
হ্যা ঠিক তাই তাহলে কি আমাদের আশেপাশে কথা শুনারও কোন মানুষ নেই? এই অবস্থা
থেকে মুক্তি দেয়ার কেউ নেই?
মানুষ যখন আছে তখন অবশ্যই মুক্তির কোন না কোন পথতো নিশ্চই আছে। বাবরের এই কথাটা স্পষ্টভাবে পুরাপুরি শোনার আগেই সোহেলের কানে তখনই চারপাশে আস্তে থেকে জোরে একসময় কান ফাটিয়ে একদিকে সিনেমার সংলাপ, নাচ, গান বাজনা, ও অন্যদিক থেকে খেলার মাঠের চরম উত্তেজনার আওয়াজ ভাসতে থাকলে, সেসবকে উপেক্ষা করে সোহেল চিৎকার বলতে থাকে,
তুই কি কিছু বলছিস বাবর? আমি তোর কথা কিছুই শুনতে পারছি না।
বাবর আর সোহেল খুব কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও গান, গানের সাথে ঝাঁজালো বাদ্যযন্ত্রের বাজনা আর খেলার আওয়াজে, সিনেমার সংলাপে তারা একে অপরের কোন কথাই শুনতে পায় না। পর্দায় তখন একদিকে উত্তেজনাকর নাচ গান বাজনা অন্যদিকে খেলার উত্তেজনাময় মুহূর্তের ধারাবিবরনী ও দর্শকদের কোলাহলের ব্যপকতা বেড়ে যেতে থাকে। তখন দুজন দুজনের হাত চোখ মুখ ঠোটের নাড়াচাড়া দেখে বুঝতে পারে তারা একে অপরের উদ্দেশ্যে কিছু বলছে। কি বলছে বা বলতে চাচ্ছে বা বোঝাতে চাচ্ছে তার সবটাই গান বাজনা আর খেলাধুলার উত্তেজনায় শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে। হাত নেড়ে ইঙ্গিতে বোঝাতে গেলেও দেখা যাচ্ছে দৃশ্যের আলোছায়ায় তা অস্পষ্ট হয়ে ঢেকে যাচ্ছে।

ওরা যত জোরে কথা বলে চারপাশের আওয়াজ আরো জোরে আসে। ওরা আওয়াজ ছাপিয়ে আরো জোরে বলতে থাকলে। ওদের কথাকে ছপিয়ে আরো জোরে খেলার উত্তেজনাকর মুহূর্তের ধারাবিবরণী কথোপকথন চলতে থাকে, প্রচণ্ড শব্দে গানের মিউজিক, বোমার ফেলার তীব্র আওয়াজে, বোমার আঘাতে মানুষের তীব্র আর্তনাদ ভেসে যায়। শেষমেষ ওদের দুজনের কথাগুলি যুদ্ধ, গুলির শব্দ, ভাষণ, যুদ্ধাহত মানুষের আর্তনাদ খেলা আর নাচ গানের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়।
একটু পর শব্দ ও দৃশ্যগুলো এমন ভাবে আসতে থাকে যে, কোনটাই আর স্পষ্ট
শোনা যায় না, গানের আওয়াজের ভেতর ঢুকে যায় বোমা গুলির শব্দ ফলে গান আর গোলা গুলি আলাদা করা যায় না। মনে হয় গোলাগুলি আর বোমার শব্দ যেন গানেরই মিউজিক ভিডিও।
খেলার আওয়াজের মাঝে মানুষের আর্তনাদ, রক্তাক্ত দেহ, মৃত্যু, লাশের সারি এমন ভাবে ঢুকে পড়ে, দেখলে মনে হয় যেনো আর্তনাদ, মৃত্যু, স্তূপাকৃত লাশের সারি, যুদ্ধ এসব খেলারই অংশ। এর বাহিরে কিছু না।
একইভাবে মানুষের চাওয়া পাওয়ার, মানুষের অধিকারের সংবাদ, খবরগুলো বনজঙ্গলে বন্য বাঘ সিংহ, হায়নার থাবায় রক্তাক্ত হরিণ মহিষের তীব্র ছটফটানির দৃশ্যের সাথে বিশ্বশান্তি আর মুক্তির ভাষণগুলো, বোমার আঘাতে আঘাতে নগর জনপদের ধ্বংসের দৃশ্যগুলোর সাথে এমন ভাবে মিশে সব এলোমেলো একাকার যে অবয়ব ছাড়া বোঝার উপায় নেই কে যে হায়না বাঘ আর কে যে মানুষ। বাঘ সিংহ হায়নার থাবায় যেমন রক্ত ঝরছে, তেমনি রক্ত ও মৃত্যু আরো বেশি হচ্ছে বোমা আর গুলিতে। রক্ত আর মৃত্যুর সাথে লড়াই হরিণ মহিষের যেমন মানুষেরও তেমন। এভাবে একের পর এক চোখ ঝলসে দেয়া কান নষ্ট করা দৃশ্য ও শব্দের যাঁতাকলে পড়ে সোহেল ও বাবর দুজনে দুজনের কান চেপে ধরে দুজন দুজনের দিকে অসহায়ভাবে তাকায়। চারপাশের চলমান রঙিন দৃশ্যেরগুলির রঙের সাথে আলো অন্ধকার এমনভাবে ওদের মুখাবয়বে খেলা করছে যে কোনভাবেই কেউ কারো চেহারাও এখন আর স্পষ্ট রূপে ধরতে পারছে না। ফলে ওদের সমস্ত চিৎকার, আকার ইঙ্গিত ব্যর্থ হয়ে যায়। বীভৎস শব্দ আর রঙিন আলো অন্ধকারের খেলায় ওরা আজ কত অর্থহীন, শব্দ বাক্যহীন অবয়ব মাত্র। সোহেল কি যেন বলতে চাচ্ছে, কি বলতে চাচ্ছে? নাকি এটা বাবরের দৃষ্টিভ্রম।

আসলে সত্যিই সোহেল বাবরকে কিছু বলছিল? কিন্তু বাবর কিছুই বুঝতে পারছিলো না? কিংবা সোহেল কিছু বলছিলো বাবর তা ধারণাই করতে পারছিল না। চারপাশের মানুষের আর্তনাদ, কষ্ট, চার, ছক্কা, ফ্রী কিক, গোল, মৃত্যু, হতাশা, ভোট, ভাষণ, নাচ, গান, সিনেমা, যুদ্ধ, শান্তি, পুরস্কার, চিৎকার সব একটা আরেকটার ভেতর ঢুকে অস্পষ্ট হ-য-ব-র-ল এক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মাথাগুলোও কি একটার ভেতর আরেকটা ঢুকে এগুলোর মত হ-য-ব-র-ল হয়ে যাচ্ছে। এর থেকে তাদের বের হওয়ার পথ কি?

ভাবতেই মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে পরে ওরা দুজন তীব্র ক্লান্তি হতাশা আর বোধহীন শুন্যতা নিয়ে কখন যে চিত হয়ে পড়ে আছে। চোখ বন্ধ তাই ভালো মন্দ কোন দৃশ্য নেই। মুখ বন্ধ আর কোন কথা নেই, কোন আশা নেই, চাওয়া পাওয়া নেই। এভাবে পড়ে থাকা ছাড়া তাদের আর কোন উপায়ও নেই। এই অবস্থা থেকে কেউ মুক্তির পথ দেখাবে সে আশাগুলোও দুরাশা হয়ে ওদেরই পড়ে থাকার মত ওদের মনের ভেতরে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সমস্ত ইচ্ছাশক্তিগুলি একে একে হতাশার সাথে মৃত্যুপূর্ব মুহূর্তের মত এগিয়ে যাচ্ছে যেন খুব ধীরে ধীরে মৃত্যুরই দিকে। প্রতি সেকেন্ডকে মনে হচ্ছে অনন্ত সময়। ভেসে উঠছে চোখের সামনে শৈশব, কৈশর, যৌবন ভালোমন্দ। আহা কত ছোট এ জীবন। বুঝে উঠার আগেই শেষ হয়ে যায়। এই জীবনের হাসি কান্নাগুলো কি ব্যর্থ কি তুচ্ছ হয়ে ধরা দিচ্ছে। না পাওয়ার ব্যাথাগুলি, পাওয়ার গৌরবগুলি এখানে কি ভীষণ অর্থহীন গৌণ।

মা বাবা ভাইবোন প্রিয় অপ্রিয় সব যেন মায়া ছায়া কায়া। নিশ্চিত মৃত্যু এসে গেছে, ডেকে প্রস্তুত হতে বলছে। বড় কঠিন তীব্র কর্কশ তার ধ্বনি, প্রচণ্ড ভয় আর আক্রোশের সুরে অন্তরাত্মা বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। চলে যাচ্ছে জীবন, জীবনের সব অনুভূতিকে মেরে কেটে ধ্বংস করে মৃত্যু আসছে সগৌরবে। চাই বা না চাই সে আসছেই। টিক টিক, টিক টিক, ডিব ডিব শব্দে আস্তে আস্তে রাজসিক পায়ে আসছে। তার নাই কোন ভয়, তার নাই কোন চাওয়া পাওয়া, তার নাই কোন লোভ হতাশা, সে আসে অনন্ত সময়কে শুন্য করে তারপর একে একে মারে আশা আকাংখাকে, লোভ লালশাকে, হিংসা অহংকার আর ক্ষমতাকে। বাকি রাখে শুধু আফসোস। বড়বেশি দয়ামায়াহীন সে কাউকে ছাড়ে না করুণ মুখ থেকে হাসিমুখ। শুস্ক শুকনো মানুষ, দামি মানুষ, নামি মানুষ থেকে তরতাজা বিশাল দেহকে অসাড় করে শুন্য করে চলে যায়।

বাবর ও সোহেল এই মেনে মৃত্যু ছাড়া জীবনের আর কোন দরজা খোলা নেই জেনে, নিথর পড়ে আছে। যেভাবে পড়ে থাকে আত্মাহীন দেহ। মৃত্যু মানেই দেহ থেকে আত্মা বেরিয়ে পড়া। কিন্তু মৃত্যু সে আত্মাকে নিয়ে যায় কোথায়?
সমস্ত শব্দকে নীরব করে, সমস্ত দৃশ্যকে ম্লান করে, সমস্ত অনুভূতি আর চিন্তার ধূসরতাকে পেছনে ফেলে স্পষ্ট শব্দে আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত ফজরের আজান ভেসে আসে চারদিক থেকে। আজানের সমস্ত শব্দগুলো বাবরের কানে খুবই নরম সুশীতল ভোরের বাতাসের সাথে প্রবেশ করে। বাবর খুব ধীরে ধীরে চোখ মেলে। চোখের কাছাকাছি চারপাশটায় এমন আবছা আলো অন্ধকারের মাঝামাঝি ঝাপসা ঝাপসা দেখে প্রথমে বুঝতে পারে না, সে কি দেখছে। হালকা আলো আর অন্ধকারে গাছের অস্পষ্ট ছায়ার উপর আকাশের মত মনে হলেও বিশ্বাস হচ্ছে না, সে ঠিক দেখছে কিনা। চোখ বন্ধ করে, আবার খোলে, কানে আজানের শব্দটা তখনও স্পষ্ট শুনতে পেয়ে শুয়ে শুয়েই উপরের দিকে চোখ যেতেই আকাশটা আরো স্পষ্ট হয়। হালকা অন্ধকারে চোখের উপর ভেসে ওঠে ভোরের বাতাসে গাছের পাতাদের দোল খাওয়া, পাতাদের ফাঁকে ছোট ছোট নীল আকাশ। দূরে কাছে অজস্র মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজানের সাথে সাথে অন্ধকার ভেদ করে আলোর আগমন শুরু হয়ে যায়। বাবর চারদিকে তাকায়, দেখে বিশাল আকাশটা আস্তে আস্তে আলোকিত হয়ে আসছে।

গাছপালায় ঘেরা উন্মুক্ত উদ্যানে পাখিদের কিচির মিচির কলগুঞ্জন কাকের কা কা কি ভীষণ ভাবে চারদিককে জাগিয়ে তুলছে। বাবর বুঝতে পারে, জীবনের এক ভয়াবহ কোনঠাসা অবস্থা থেকে তার দেহ মন এখন মুক্তি পেয়ে গেছে। তার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আনন্দ উত্তেজনায় কাঁপছে। সে মরেনি বেঁচে আছে, বন্দি নেই, সে মুক্ত। জীবনে এই আনন্দ কোনদিন কাউকে বোঝানো যাবে না। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলতে থাকে, আমার মাথার উপর বিশাল আকাশ, আমার চারপাশে কত গাছগাছালি, আমার নাকে ভোরের বাতাসে ফুলের গন্ধ উড়ে আসছে। আমার চারপাশে কতজন কতভাবে ঘুমে বিভোর।
এতক্ষণ যা দেখেছে সব তাহলে ঘুমের ভেতরে স্বপ্ন দেখেছে। তার এই রক্ত ঠান্ডা করে দেয়া স্বপ্ন সোহেলের সাথে শেয়ার করতে মন আনচান করছে।এতক্ষণ যা দেখেছে সব তাহলে ঘুমের ভেতরে স্বপ্ন দেখেছে। চরম আনন্দ আর উত্তেজনায় বাবর সোহেলকে ডাকছে, ডেকেই যাচ্ছে, বাবরের ডাকে একসময় সোহেল হন্তদন্ত হোয়ে লাফিয়ে উঠে, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়, চোখ মেলে তাকায়। দৃষ্টিতে অচেনা ভাব। বাবরের দিকে এমন অস্পষ্টভাবে তাকায় যেন চিনতে কষ্ট হচ্ছে। উপরের গাছে পাখিরা বড় বেশি রকমের কিচিরমিচির করাতেই সোহেল চারদিকে অবাক দৃষ্টিতে চারপাশে কাছে দূরে তাকায়, উঠে দাঁড়ায়। ততোক্ষণে, অন্ধকার কেটে ভোরের আলো ফুটে গেছে, চারদিক ফর্সা হয়ে গেছে, গাছের ফাঁক গলে ভোরের আলোক রশ্মির ভেতর দিয়ে কার্পাশ তুলার মত ফেটে লাল সূর্য বেরিয়ে পড়েছে। সূর্যের নরম লাল রোদের ঝাপটা এসে পড়েছে তাদের কাছে। বাবর সোহেলের অবাক চাহনিতে নিজেও অবাক হয়ে জিজ্ঞসা করে
কিরে কি ব্যাপার বলতো?

সোহেল বাবরের দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তারপর চারদিকে ভালো করে লক্ষ্য করে বলে, পার্ক নাকি? তারপর নিজে নিজেই বলে, হ্যাঁ সত্যি সেই সোরাওয়ার্দী উদ্যানই তো। পাখিদের কোলাহল, কিছু পাখি এই ডাল সেই ডালে ছোটাছুটি করছে। সোহেল লাফিয়ে ওঠে বলে, তার মানে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম! ঘুম আর ঘুমের ভেতর স্বপ্ন, আর সেই স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে স্বপ্নঘোর মুহূর্ত পার করে সোহেল খুব স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে এখন পার্কে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

বাবর সোহেলের কথা শুনে অবাক হয়ে বলে, তুইও কি আমার মত এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলি না কি?
তোর মত কি না জানিনা। স্বপ্নে দেখলাম বাক্সভর্তি ডলার, তারপর সেই ডলারের লোভে তুই আমাকে আমি তোকে….. কেউ হজম করতে পারলাম না। তারপর
বাবর সোহেলের কথা শেষ করতে না দিয়ে বলতে থাকে। তারপর আলো অন্ধকারে…।
এভাবেই দুজনের কথোপকথনে দুজনই আশ্চর্য হয়ে যায়। বুঝতে পারে দুজনে একই স্বপ্ন দেখেছে। সেই স্বপ্নের বিভীষিকা থেকে মুক্তির আনন্দে এখন ভাসছে। বাতাসে গাছের পাতা দুলছে। সূর্য উঠছে। রোদের তাপ বাড়ছে। ঘাসে বালু মাটিতে রোদ পড়ে বালু কণা ঝকঝক করছে। ঘাসের উপর কয়েকটা টুনটুনি আর চড়ুই পাখি টুইট টুইট করে লাফাতে লাফাতে কি যান খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। এদৃশ্য বাবর জীবনে বহুবার দেখেছে। কিন্তু আজ চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে দেখতে দেখতে সোহেলের উদ্দেশ্যে বলে,
আহ কি আনন্দ, গাছের পাতা কি সুন্দর, চারদিক কি সুন্দর, আকাশ কি নীল, পাখি, পাখির ডাক, মানুষের কণ্ঠ, আহ কি দারুণ।

প্রচণ্ড খুশিতে সোহেল চিৎকার করে বলতে থাকে, আমি সোহেল আমি খুব ভালো আছি। বাবর তোর কেমন লাগছে?
কেমন লাগছে বলে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না, এতো ভালো আর কোনদিন লাগে নাই, চারদিকে এমন সুন্দর কোনদিন দেখি নাইরে।
ওদের চিৎকারে আশেপাশের লোকজন ফিরে ফিরে তাকায়, অবাক হয়।
সোহেল বাবরের উদেশ্যে বলে, যা দেখছি সব স্বপ্ন, সত্য না। বেঁচে আছি এই যে পার্কে আছি এখন এই মুহূর্তে আমাদের মত সুখী আর কেউ নাই, তাই নারে? বলে বাবরের দিকে তাকিয়ে বাবরকে হঠাৎ চুপ হয়ে যেতে দেখে, চিন্তিত দেখে জিজ্ঞাসা করে, কিরে তুই চুপ কেন?
বাবর তবুও কিছু বলছে না দেখে সোহেল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়, কিরে হঠাৎ এত চিন্তিত ?
বাবর খুব চিন্তিত মুখাবয়বে সোহেলওকে জিজ্ঞাসা করে,
আচ্ছা কাল রাতে যা দেখলাম, যখন দেখছিলাম তখন কি একবারও কি মনে হয়েছে , যা দেখছি তা সব স্বপ্ন।
আরে না মনে হলে কি আর ওইরকম যন্ত্রণা পাই। মনে হচ্ছিল ঐটাই সত্য, একদম বাস্তব সত্য, ওফ কি ভয়াবহ।
একবারও কি মনে হয়েছে স্বপ্নের পর ঘুম ভেঙ্গে যাবে তারপর এখন যা দেখছি এইখানে আবার ফিরে আসবো?
না তাতো একবারও মনে হয় নাই। বরং উল্টা সেই স্বপ্নটারেই সত্য মনে করে সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে কি যে প্যাচে পড়ে গেলাম। ভাগ্য ভালো ঐটা স্বপ্ন ছিলো
তাই ঘুম ভাঙ্গতেই মৃত্যুর হাত থেকে, বন্দিদশা থেকে ছাড়া পেয়ে গেলাম।
বাবর সোহেলের কথাটা শুনে উত্তেজিত ভঙ্গিতে লাফিয়ে উঠে সোহেলের মুখোমুখি এসে বসে বলে, ইয়েস। স্বপ্নের পর জেগে উঠে যা দেখলাম তা ই এই জগৎ। এই জগতটারেই এখন মনে হচ্ছে সত্য। আর যা দেখলাম তা কি সত্য না? শুধুই স্বপ্ন?
বাবরের কথায় সোহেলও দ্বিধাদ্বন্ধে পড়ে যায়, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকইতো, ঐটা হয়ত পুরাপুরি সত্য না কিন্তু পুরাপুরি মিথ্যাও তো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভেবে ভেবে বলতে থাকে, স্বপ্নটা ছিলো একটা মায়াজালের মত। যেখানে বাস্তবে দেখা তুই আমি আমাদের চাওয়া পাওয়া স্থান কাল পাত্র সবই সত্য সত্য উপস্থিত ছিলো। শুধু ঘটে যাওয়া ঘটনাটা সত্য ছিলো না।
বাবর যেন অন্য কোন কিছুর আচ করছে আর বলছে, স্বপ্নের ভেতর যা কিছু
দেখেছি যা কিছু নিয়ে এত ঘটনা তার কোন কিছু কি নিয়ে আসতে পেরেছি?
সোহেলের সরাসরি উত্তর, না।
স্বপ্নে দেখা সেই বস্তুগুলি স্বপ্নেই রয়ে গেছে এখানে মানে বাস্তবে এখন আনা যায়নি। কিন্তু চিন্তাগুলি মস্তিষ্কের মাধ্যমে ঠিকই চলে এসেছে। যেমন সেখানে দেখা আনন্দ আবেগ ভয় সংশয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব দৃশ্যপটগুলি এখনও একই ভাবে মনের ভেতর চিন্তা ভাবনার ভেতর বিদ্যমান আছে বলেই ঘটে যাওয়া স্বপ্নটা বলে দিতে পারছি। হুবহু। তার মানে, কি মনে হয় জানিস।
সোহেল সিরিয়াস হয়ে নতুন কিছু সন্ধানের প্রত্যাশায় বলে, কি মনে হয়।
মনে হয় এই জগতে যা কিছু দেখছি তাও গতরাতে দেখা স্বপ্নের মতই। এখান থেকেও কিছুই নিয়ে যাওয়া যাবে না। না কোন বাড়ি গাড়ি ডলার পাউন্ড টাকা পয়সা খাবার দাবার কিছুই না। সেই জগতে যেখানে আমরা যাবো মৃত্যুর ভেতর দিয়ে, তখন মৃত্যুর পরে এই জগটারেই স্বপ্নের মত মনে হবে। তারপর মৃত্যুর ভেতর দিয়া আরেকটা যে জগৎ আসবে সেই জগতে গেলে ঐটারে মনে হবে সত্য আর এইটারেই মনে হবে স্বপ্ন। আর সেই সত্যের ভেতর চলে যাবে আমাদের এই জগতের সকল ভালোমন্দ চিন্তা সব।

দুজনেই চুপ হয়ে কিছুক্ষণ ভাবে।

সোহেল ভাবনার মাঝে পড়ে যায়। ভেবে দেখে বলে, তাইতো, এইভাবে তো ভাবি নাই। আসলেই তো এই সময়টাও তো একটু আগের স্বপ্নের মতই আরেকটা সময়? মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে স্বপ্নসময়ের শেষ হয়ে যাবে। মৃত্যুর পরের জগৎটাই কি তাহলে মূল সত্য, বাস্তব? যেখানে এখান থেকে নেয়া যাবে না কিছুই। কেবল চিন্তা ভাবনাগুলোই সব চলে যাবে ওখানে।

বাবর সোহেলের কথাটাকে গুরুত্ব দিয়ে সোহেলের দিকে তাকায়, সোহেলও তাকায়। বাবর বলে, হ্যাঁ ঠিক, আমরা আসলে স্বপ্নের মতই এ জগতেরও অস্থায়ী
কেউ। স্থায়ী কিছু না। মৃত্যুর ভিতর দিয়ে যাকে চলে যেতে হবে।
কিন্তু কোথায়?
যেখান থেকে এখানে এসেছি।
সোহেল অবাক হয়ে, তাহলে আমরা কোথা থেকে এলাম বলে তোর ধারণা।
মৃত্যু পরবর্তী যে জগতে আমরা ফিরে যাব। সেখান থেকেই আমরা এসেছি।
তার মানে ঐ যে বলে রুহের জগৎ।
হ্যাঁ
কিন্তু সেই রুহের জগৎ থেকে যদি এসে থাকি তাহলে সেই জগতের কিছুই মনে পড়ছে না কেন?
স্বপ্নের জগতে কি একবারও মনে হয়েছে আমরা আসলে স্বপ্নের জগতের কেউ না। আমরা সেখানে গিয়েছি এখান থেকে?
না একবারও মনে হয়নি। তখনতো মনে হয়েছিলো ঐটাই সত্য। ঐ জগতের বাহিরে আর কোন জগতের অস্তিত্বও মনে পড়েনি।
অথচ দেখ ঘুম ভাঙার পর সব ঘোর কেটে গিয়ে এখন দেখতে পাচ্ছি এই জগৎ থেকেই আমরা ঘুমের মধ্য দিয়ে স্বপ্নের জগতে চলে গিয়েছিলাম, আবার ঘুম ভাঙ্গতেই ফিরে এলাম। ঠিক তেমনি এই জগৎ থেকেও এখন মনে পড়ছে না, রুহের জগতের কথা। কিন্তু মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা যখন সেখানে ফিরে যাবো তখন ঠিকই মনে পড়ে যাবে, আমরা আসলে সেই রুহের জগৎ থেকেই এখানে এসে ছিলাম, আবার সেখানেই ফিরে গেলাম। স্বপ্নের জগতে যেমন মনে হয়নি ঘুম ভাঙ্গলেই এ জগতে ফিরে আসতে হবে ঠিক তেমনি এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে মৃত্যু হলেই আমরা ফিরে যাবো আমাদের সেই রুহের জগতে। যেখান থেকে আমাদের যাত্রা হয়েছে।

মৃত্যুর পরই আমদের মনে পড়ে যাবে আমরা রুহের জগৎ থেকে কিভাবে এই জগতে এলাম তারপর এখান থেকে কি কি করে আবার সেখানে ফিরে গেলাম, এই সবকিছুই। ঠিক যেভাবে স্বপ্নের জগতের যা যা হয়েছে, এখানে এসে সব মনে পড়ে যাচ্ছে, তেমনি করে নিশ্চই।
সোহেল তখন একটু দূরে বসে নীরবে ভাবতে থাকে, আজ যাকে মৃত্যু মানে সব শেষ ভাবছি, আসলে তা শেষ না। আরেকটা জীবনের শুরু মাত্র। জীবন ও মৃত্যু কোনটাই শেষ কথা না, স্থানান্তর মাত্র।
এভাবে গতরাতের স্বপ্নের সাথে আজকের বাস্তবতা, আজকের বাস্তবতার সাথে আগামীকালের অর্থাৎ মৃত্যু পরবর্তী জীবনের বিশ্লেষণ করতে করতে ওরা এগিয়ে যায়। দৃষ্টি প্রসারিত করে চারপাশে তাকায়, আর ভাবতে থাকে তাহলে মৃত্যু পরবর্তী জগতের জন্য এই মুহূর্ত থেকে জীবনকে অন্যভাবে ভাবতে হবে। যে জীবনে নেই কোন হঠকারিতা, লোভ, অহংকার আর মিথ্যা। কারণ এই জীবন শুধু এই জগতে যাপন করার জন্যই না, আর একটা জগতের জন্যও। বেঞ্চে শুয়ে থাকা মানুষজন তখন ঘুম থেকে জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। আর গাছে গাছে ফুল পাখি মৌমাছির গুঞ্জন আর সবুজ পাতার শিহরণে আরেকটা নতুন দিনের আহ্বান শুরু হয়ে গেছে তখন।

আগের সংবাদমুনতাসির: দ্যা আনফর্চুনেট প্রিন্স
পরবর্তি সংবাদমাকাল ফলের দিন