আদনান ইবরাহীমের চোখে : কেন কারজাবীর রাজনৈতিক প্রকল্প সমস্যাজনক ?

আব্দুল্লাহ আল মাহী

ইউসুফ আল কারজাবী রহিমাহুল্লাহ। পরিচিত মুখ। উম্মাহর জন্য হয়ে ওঠা একজন মানুষ। আমাদের বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তিনি বেশ আলোচিত ও সমালোচিত একজন জ্ঞান ও গুণে ঋদ্ধ আলেম— ফকিহ। আলোচিত হয়েছেন তার অসাধারণ যুগ সচেতনতা তৈরি কারী ফিকহি ইজতেহাদ সমুহের জন্য। আর সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন ওই সমস্ত ইজতেহাদে সাধারণের মেজাজ মর্জি কিংবা শরিয়তের আবহমান কাল থেকে পালিত কিংবা লালিত হয়ে আসা কোন বিধান বা বিশ্বাসে নাড়া দেয়ার জন্য (?)।

আজ কারজাবী রহিমাহুল্লাহ’র জীবনের ভিন্ন একটি দিক নিয়ে আলোচনা করতে চাই আমরা। মিশর থেকে কাতারে হিজরতের যেই দিকটা সব সময়ই তার এই জীবনে খুব করে প্রভাবিত করে এসেছিল। তবে আজকে আমাদের এই বিষয়ের আলোচনা আমরা ধার করছি ড. আদনান ইবরাহিম এর কাছ থেকে। তবে দু’জনের মাঝে যোগসূত্র টানার দায়িত্ব আমরা নিচ্ছি।

প্রথম কথা 

রাজনীতি ও ইলম; দু’টি ভিন্ন কিছু নাকি একই? অথবা একই ছিল, পরবর্তীতে উভয়ের মাঝে ভিন্নতা নিয়ে আসা জরুরি হয়ে পড়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তরের একটি মূলনীতি থাকা দরকার, যেন আলাপে কোন রকমের বিন্যাসগত ত্রুটি না থাকে।

আলাপে প্রবেশ করার আগে একটা ঐতিহাসিক বাস্তবতা দেখি। রাজনীতির চলমান সংজ্ঞা। মানে, বইয়ের পাতা থেকে নয়, মানুষ কীভাবে দেখছে রাজনীতিকে সেটা দেখা জরুরি। রাজনীতি স্বতন্ত্রভাবে ভালো। কিন্তু এর বর্তমান বা আবহমানকালের ব্যবহার একে খারাপ করে উপস্থাপন করেছে। আমাদের এই অংশের মৌলিক কথা হচ্ছে, এই রাজনীতির চর্চা কাউকে কলুষিত করতে পারে কি না?

উত্তরঃ হ্যাঁ, কলুষিত করতে পারে। কিন্তু আরেকটু বিশেষায়িত করে বললে, কাজ দেখে বলতে হবে, তিনি ভালো রাজনৈতিক কি— না। তারমানে, প্রথমত বর্তমান জনগণের মনে রাজনীতির অর্থ হচ্ছে অনাচার, জুলুম, অনৈতিকতা। পরবর্তীতে কেউ ভালো করলে ইসতিসনা; অপ্রত্যাশিত রকমের একটা ভালো খবর।

মূলনীতি— “রাজনীতি করা জরুরি (এটা পৃথিবী টিকিয়ে রাখার মাধ্যম)। ইসলামের নাম ভাঙিয়ে রাজনীতি করা ফিতনা।

আদনান ইবরাহিম বলছেন, দ্বীনের সম্পর্ক পবিত্রতার সাথে আর সিয়াসাতের সম্পর্ক বিভিন্ন রকমের অস্থিরতা ও ঝামেলার সাথে। 

এই মোটাদাগের কথার ওপর তিনি আলোচনা চালিয়ে যান। অনেকটা এরকম, সার সংক্ষেপে এমন, কারজাবী রহিমাহুল্লাহ অনেক বড় মাপের আলেম, ফকিহ, মুজতাহিদ, তার অনেক কিতাবাদী থেকে এখনও আমি উপকৃত হই। বিশেষত, তার ফিকহুয যাকাত এবং ফিকহুল জিহাদ কিতাব দু’টি থেকে। হলফ করে বলতে পারব, তার মৃত্যু সংবাদ শুনে আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝড়েছে। তবে তার কিছু ফতওয়া যা রাজনৈতিক প্রকল্প হিশেবে কাজ করেছে আমি এর সমর্থন করতে পারি না। ধর্মের নাম ব্যবহৃত হচ্ছে এক্ষেত্রে। অথচ ফায়দা লুটছে কাফেররা। ফিতনা তৈরি হচ্ছে। বিভক্ত হচ্ছে জাতি। পরোক্ষভাবে আমি যেন তাদের সাহায্য করছি। ফিতনার কারণ হচ্ছি।”

আদনান ইবরাহিম বলেন, “কারজাবী রহিমাহুল্লাহকে একটি অনুষ্ঠানে বলা হয়েছিল, আপনি রাজনৈতিক জিহাদের যেই ফতওয়া দেন সেক্ষেত্রে ফেতনার সৃষ্টি হয়। উত্তরে শায়খ কারজাবী বললেন, যদি এইটা ফেতনা-ই হয়ে থাকে তাহলে আমি এই ফেতনার প্রধান। হে আল্লাহ আমাকে এই ফেতনার প্রধান রেখেই মৃত্যু দিও, আবার ফেতনার প্রধান করেই উঠিয়ো!

আদনান ইবরাহিম বলেন, হাদিস এবং আসার (সাহাবি, তাবেই, তাবে তাবেই, সালাফদের কীর্তিগাথা) থেকে জানা যায় সালাফরা কতভাবে ফিতনা থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করা আর গৃহযুদ্ধ করার মাঝে পার্থক্য বুঝতে হবে। কারজাবী রহিমাহুল্লাহ তার কিতাবের দুই জায়গায় উল্লেখ করেছেনে, যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি যে মারতে আসে তার সাথেই কেবল  যুদ্ধ করো!

অথচ শায়খ নিজেই এই কথার বিপরীত আমল করেছেন। এক অনুষ্ঠানের শেষ মুহুর্তে তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, যারা সিরিয়ান সরকারের সাথে উঠাবসা করে তাদের হুকুম কী? প্রশ্নে রমাজান আল বুতির নামও উল্লেখ করেছিল ওই মূর্খ প্রশ্নকর্তা। উত্তরে শায়খ কারজাবী বললেন, আমরা তাদের সাথে লড়াই করব। চাই সে আলেম হোক বা মূর্খ। সাংবাদিক হোক বা সৈনিক, স্যেকুলার কিংবা উম্মি— আনপরই হোক, সবার সাথে লড়াই করব। ঠিক এর চারদিন পরে সাঈদ রমাজান আল বুতি রাহিমাহুল্লাহ শহাদাত বরণ করেন।”

আদনান ইবরাহিম এর ফেতনার ব্যাখ্যা থেকে এই কথা বুঝে আসে, বিভিন্ন রকমের ফতওয়া দেয়া হচ্ছে, কিন্তু এর অথরিটি দরকার ছিল, যে ফতওয়াগুলো কার্যকর করবে। যদি ফতওয়া কার্যকর করার অথরিটি না থাকে বরং ফতওয়ার অপব্যবহার এর আশংকা থাকে তখন তো ফতওয়া দেয়া যাবে কি যাবে না, তা নিয়েই বরং ফতওয়া তৈরি করা জরুরি! ফতওয়ার এমন রাজনৈতিক ব্যবহারে তৈরি হয় বিশৃঙ্খলা। সৃষ্টি হয় গৃহযুদ্ধ। বিষয়টা শুধু কারজাবী রহিমাহুল্লাহ এর সাথে বিশেষায়িত নয়; বিশ্বের যেকোন প্রান্তে এ ধরণের ধর্মের নামের রাজনৈতিক ব্যবহার যা ধর্মকে হেয় করে, ফিতনাকে উস্কে দেয় তাদের জন্য ধিক্কার!

আদনান ইবরাহিম বলেন, উসমান রাযি. ফেতনার সময় কী বলেছিলেন— আমি কিছুতেই খেলাফত ছাড়ব না। এবং মুসলমানদের এক ফোটা রক্ত ঝাড়ানোর কারণও হবো না।

রাজনৈতিকভাবে ইখওয়ানের সম্পর্ক সবচে ভালো ছিল সৌদি আরবের সাথে। কিন্তু সৌদি মুখ ফিরিয়ে নিলে তাকেও গালিগালাজ করতে ছাড়েননি কারজাবী রহিমাহুল্লাহ।

এরপর শায়খ কারজাবী রহিমাহুল্লাহ এর আরও কিছু রাজনৈতিক সমস্যাজনক প্রকল্পের কথা আদনান ইবরাহিম তুলে ধরেন। এবং তিনি বলেন, মিশর থেকে যেহেতু কারজাবী রহিমাহুল্লাহ এর হিজরত করতে হয়েছে তাই তিনি বলেন, মিশরের সাথে যে শান্তি আলোচনা করবে আমি তার সাথে কিছুতেই শান্তি আলোচনায় বসব না। অথচ তাঁর উচিত ছিল, ইরাক এবং সিরিয়া এর মতো অবস্থা যেন মিশরে সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া। কারণ, মিশরকে বিভক্ত করে চারটা ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত করার আলাপসালাপ অনেক আগে থেকেই চলে আসছে ইয়াহুদী লবিতে। এমন পরিস্থিতিতে বিদগ্ধতার সাথে সমন্বয় চিন্তা করা দরকার ছিল। আদনান ইবরাহিম বলেন, আমার এই আলোচনার আহ্বান হচ্ছে, উম্মাহর মাঝে বিভক্তি না করে উন্নয়ন প্রচেষ্টা অব্যহত রাখার প্রতি। এবং তাদের প্রতি যারা ফেতনা তৈরি করে বিভাজন সৃষ্টি করেন।

উপসংহার

এখানে কিছু কথা ও প্রশ্ন রাখা জরুরি ভাবছি-

০১. আদনান ইবরাহিম এর বক্তব্য সামগ্রিকতা রক্ষা করে। সুতরাং ধর্মের নাম ব্যবহার করে রাজনীতি করা যে কারও জন্য শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে যায়েজ নাই।

০২. ফেতনা তথা বিভক্তি, বৈষম্য বৃদ্ধির সহায়তা করে কি না আমার ফতওয়া, ধর্মীয় ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এটা খেয়াল রাখা অত্যাবশ্যক। অন্যথায় এই মাকাম পরিত্যগ করা জরুরি।

০৩. ফতওয়া এবং কাযা’ তথা ফতওয়া কার্যকর করার ক্ষমতা আছে কি না তা বুঝে ফতওয়া প্রদান করা।

মোটাদাগের এই তিনটি কথা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের মাথায় রাখা জরুরি। নয়তো ধর্মের অবমাননা হবে। কারণ হবো আমি।

 

আগের সংবাদশরীফুজ্জামান নোমানি থেকে আবরার ফাহাদ: রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের প্রকারভেদ ও বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের স্বকীয়তা
পরবর্তি সংবাদযুগশ্রেষ্ঠ স্কলার ড. ইউসুফ আল কারযাভী র.-এর জীবন ও অবদান