আব্বাস ইবনু আবদিল মুত্তালিব

মুহাম্মদ মাসুম মুনতাসির:

নুতায়লার মেঘশুভ্র কপাল জুড়ে ফুটে উঠেছে চিন্তার রেখা। ছেলেটা যে এভাবে শিশুবয়সেই হারিয়ে যাবে, অমন কথা কখনও তার চিন্তার চৌহদ্দিতেও আসেনি। ভীষণ দুশ্চিন্তার সাগরে সাঁতার কাটছিলেন তিনি, টুপ করে এক মিষ্টি ভাবনা রূপচাঁদার মতো ভেসে উঠল তার করোটিতে- আরে রাব্বে কাবা তো আছেন! তিনিই সহায়। এই ভেবে তিনি কাবার মালিকের নামে মানত করলেন- যদি ছেলেকে ফিরে পান, কাবাকে জড়াবেন মিহি রেশমি গিলাফে। একসময় তিনি ছেলেকে ফিরে পান, তখন তিনি তার অঙ্গীকার পূরণ করেন।

শৈশবের হারিয়ে যাওয়া এই ছেলেটিই ছিলেন আব্বাস ইবনু আব্দিল মুত্তালিব। তাঁর মা নুতায়লা-ই ইতিহাসে সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি প্রেমের কাবার দুধসাদা গায়ে জড়িয়েছিলেন রেশমি কালো গিলাফ।[১]

জন্ম ও বংশপরিচয়

আব্বাস রা. -এর উপনাম আবুল ফযল। পিতা আবদুল মুত্তালিব। পিতামহ আবদে মানাফ। জন্ম ৫৬৮ ঈসায়ি সনে। আসহাবে ফীলের ঘটনার বছর তিনেক আগে।[২]

তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামের সম্মানিত চাচা। রাসূলের দু’বছরের বড়। তিনি দীর্ঘদেহী ও ধবধবে ফর্সাবরণের ছিলেন। ছিলেন দশ ছেলের জনক। তাঁর কিছু অসাধারণ গুণ তাকে করে তুলেছিল বিরলপ্রজ।

তিনি খুব বিচক্ষণ ও গভীর জ্ঞানের আধার ছিলেন। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা, অভাবীকে সাহায্য করা ছিল তাঁর চিরাচরিত অভ্যাস।

ইসলামপূর্ব জীবন

আব্বাস বিন আব্দিল মুত্তালিব ছিলেন একজন অভিজাত ব্যক্তিত্ব। আজন্ম আভিজাত্যের সাথেই তাঁর ওঠাবসা। বনেদি কুরাইশ বংশের সন্তান। রক্তে তাঁর মিশে ছিল বদান্যতা, পরোপকার ও মানবসেবা। তাই ইসলাম ও জাহেলি উভয় যুগেই তিনি ছিলেন সম্মানের দৌড়ে শীর্ষ সীমান্তস্পর্শী।

জাহেলি যুগেই তিনি ছিলেন কুরাইশদের গোত্রপতি। কাবা ঘরের রক্ষণাবেক্ষণ ও হজের মৌসুমে বাইতুল্লাহর মুসাফিরদের পানি পানের ব্যবস্থা করা ছিল তাঁর দায়িত্ব।[৩]

তিনি যখন পূর্বসূরিদের ধর্মের শিকড় আঁকড়ে ছিলেন, তখনও তিনি ছিলেন মহানবীর পরম হিতৈষী। যার প্রমাণ বহন করে আকাবার ঐতিহাসিক দ্বিতীয় বাইআতের ঘটনা। নবমুসলিমদের উপর কুরাইশ নেতাদের নিগ্রহের জগদ্দল পাথর যখন শক্তভাবে গেড়ে বসেছিল, তখন মদীনার কিছু সম্ভ্রান্ত লোক নবীজিকে হিজরত করার প্রস্তাব দেন। নবীজি তাদের সাথে হজের সময় মিনায় পরামর্শ-বৈঠক করেন। তখন আব্বাস রা. তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে মদিনাবাসী! আমাদের কাছে মুহাম্মদের মর্যাদা কতটুকু, তা তোমরা জানোই! আমরা এতদিন তাকে শত্রুদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করে এসেছি। এখন তিনি তোমাদের কাছে যাবেন। যদি তোমরা তাকে রক্ষা করার অঙ্গীকার করতে পারো, তাহলে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করো! নয়তো তিনি স্বগোত্র ও স্বদেশে ভালোই আছেন।আব্বাস রা. -এর অভিব্যক্তিই বলে দেয়, তিনিই রাসূলের কতটা কল্যাণপ্রত্যাশী ছিলেন।[৪]

ইসলামগ্রহণ

কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, তিনি বদর যুদ্ধের পূর্বে ইসলামের ছায়াসুনিবিড় শ্যামলীতে ঠাঁই খুঁজে নিয়েছিলেন। কিন্তু মাতৃভূমি ছেড়ে হিজরতের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে রাসূল -এর নিকট চিঠি লিখলে, তিনি বলেন- চাচা, আপনার মক্কায় থেকে যাওয়াই শ্রেয়। আপনিই হবেন সর্বশেষ মুহাজির, যেমন আমি সর্বশেষ নবী।[৫]

তিনি ছিলেন ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। জীবন উৎসর্গ করে যারা ইসলামের সুনীল আকাশে সকালের মিষ্টি রোদের কমলা রঙে সৌভাগ্যের চাঁদ এঁকেছেন, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। কেননা, তিনি ইসলামের স্বার্থেই ইসলামগ্রহণের পরও সত্য গোপন করে কাফেরদের মাঝে অবস্থান করেছিলেন দীর্ঘকাল। এই সময়ে তিনি অতি সন্তর্পনে কাফেরদের গতিবিধি ও যুদ্ধপরিস্থিতি আগাম জেনে নিতেন এবং সঙ্গোপনে মহানবীর কাছে দূত মারফত সবিস্তারে লিখে পাঠাতেন। শুভ্র কপোতের সোনালি ডানায় চড়ে আসা এসব সবুজসঙ্কেত ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কতটা উপকার বয়ে এনেছিল, তার সঠিক মূল্যায়নের কোন ভাষা পৃথিবীর জানা নেই।[৬]

কোন কোন ইতিহাসবিদ অবশ্য এ মতও পোষণ করেছেন যে, তিনি খায়বার বিজয়ের পূর্বেই ইসলামের স্বর্ণোদ্যানে বিশ্বাসের কিশলয় রোপন করেছিলেন এবং মক্কা বিজয়ের কিছুদিন পূর্বে মদীনায় হিজরত করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি তায়েফ অবরোধ, তাবুক অভিযান ও হুনাইন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।[৭]

মহানবীর সান্নিধ্য

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আপন পিতার মতো শ্রদ্ধা ও সমীহ করতেন। তাইতো তাঁর ব্যাপারেই তিনি উচ্চারণ করেন মুক্তাঝরা সেই উক্তি- যে আব্বাসকে কষ্ট দেয়, সে আমাকে কষ্ট দেয়। কারণ, চাচা পিতৃতুল্য।[৮]

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি সালামের ভালোবাসার পুষ্পিত আঙিনায় ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত। তাই নবীজি কখনও তাঁর দুঃখ সহ্য করতে পারতেন না। যখন তিনি বদর যুদ্ধে বন্দী হন, প্রথম রাতে রশির শক্ত বাঁধনে ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠেন। তাঁর গোঙানির শব্দে রাসূলের হৃদয়-সৈকতে বেদনার নীল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে। দুচোখের পাতায় ঘুম নামে না তাঁর। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করেন, হে প্রিয় হাবিব! কেন আপনি নির্ঘুম জেগে আছেন? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, আব্বাসের আর্তনাদ আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে![৯]

সাহাবাদের মাঝে তিনি

সাহাবায়ে কেরামও তাকে খুব সম্মানের চোখে দেখতেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর সাথে পরামর্শ করতেন। তাঁর মতামত গ্রহণ করতেন। এমনকি আবুবকর ও উমর রা. যদি কখনও ঘোড়ার পিঠে চড়ে তাঁর সামনে দিয়ে অতিক্রম করতেন, তাহলে তাঁর সম্মানার্থে নিচে নেমে আসতেন।[১০]

সাহাবাদের মাঝে তিনি কতটা সম্মানে ভূষিত ছিলেন, শুধু একটা ঘটনা থেকেই তা অনুমান করা যায়।

উমর রা. -এর শাসনকাল। আরবের বুকে অগ্নিশ্বাস ছাড়ছে দুর্ভিক্ষ। গ্রীষ্মের খরতাপে পুড়ে জমিন শুষ্ক; রুক্ষ। বৃষ্টি-তৃষ্ণায় বালুকণাও কাতর। পরিস্থিতি ভয়াবহ দেখে ইহুদি ধর্মজ্ঞ কাব আহবার এলেন উমর রা.-এর কাছে। বললেন, পূর্বযুগে নবীদের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি-প্রার্থনা করা হত। উমর রা. বললেন, আমরা নবীজির চাচার মাধ্যমে বৃষ্টি-প্রার্থনা করব। তাই হলো। আব্বাস রা. আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্য আকুতিঝরা কাকুতিভরা প্রার্থনা করলেন। মুনাজাত শেষ না হতেই পর্বতপ্রমাণ ছাইরঙা মেঘ আকাশ ঢেকে নিল। ঝুম ঝুম বৃষ্টিতে মরুবালুর তৃষ্ণাও নিবারণ হল। অবিরাম বৃষ্টিতে পানি তখন দেয়াল ছুঁইছুঁই। মরুভূমির কোলে প্রাণ ফিরে এলো। মরু-উপত্যকায় সজীবতা নেমে এলো।[১১]

মৃত্যু

হিজরতের ৩২তম বর্ষের রজব বা রমযানের ১২ তারিখে শুক্রবার তিনি ইহকাল ত্যাগ করে অনন্তের পথে পাড়ি জমান। তিনি জীবনের উদ্যানে বয়সের আটাশিটি ফুলবসন্ত উপভোগ করেন। তাঁর বয়স-বৃক্ষ ইসলামপূর্ব যুগে ৫৬টি এবং ইসলামপরবর্তী যুগে ৩২টি শাখা-বিশাখা ছড়ায়। জান্নাতুল বাকিতে মাটির কুটিরে তিনি শায়িত হন।[১২]

ইসলামের জন্য তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ইতিহাসের ধূসর পাতায় স্বর্ণে খোদাই করে লেখা থাকবে তাঁর নাম। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কবরকে স্বর্গীয় দ্যুতিতে দ্যোতিত করে দিন! আমিন!

সূত্র
[১] উসদুল গবাহ ফি মা’রিফাতিস সাহাবাহ, পৃষ্ঠা- ৬৩২, ইবনুল আসীর, দারু ইবনু হাযম।
[২] তারিখে দিমাশক, ২৬/২৭৮, ইবনু আসকারি।
[৩] উসদুল গবাহ ফি মা’রিফাতিস সাহাবাহ, পৃষ্ঠা- ৬৩২, ইবনুল আসীর, দারু ইবনু হাযম।
[৪] সীরাতে ইবনে হিশাম, ১/৪৪১, আব্দুল মালেক বিন হিশাম।
[৫][৬]উসদুল গবাহ ফি মা’রিফাতিস সাহাবাহ, পৃষ্ঠা- ৬৩২-৩৩, ইবনুল আসীর, দারু ইবনু হাযম।
[৭] আল-ইসতিয়াব ফি মা’রিফাতিল আসহাব, পৃষ্ঠা- ৮১২
[৮] জামে তিরমিযি, হাদিস নং- ৩৭৫৮
[৯] উসদুল গবাহ ফি মা’রিফাতিস সাহাবাহ, পৃষ্ঠা- ৬৩২, ইবনুল আসীর, দারু ইবনু হাযম।
[১০] আল-ইসতিয়াব ফি মা’রিফাতিল আসহাব, পৃষ্ঠা- ৮১৪
[১১] প্রাগুক্ত
[১২] উসদুল গবাহ ফি মা’রিফাতিস সাহাবাহ, পৃষ্ঠা- ৬৩৪, ইবনুল আসীর, দারু ইবনু হাযম।

আগের সংবাদ‘কবিতাই আমার অস্ত্র’ : মাহমুদ দারবিশের সাক্ষাৎকার
পরবর্তি সংবাদউম্মু জামিইল কুরআন: আন-নাওয়ার বিনতে মালিক রাদি.