আমওয়াস মহামারীর দিনগুলো

রাকিবুল হাসান:

আবু সালেহ খাটের ওপর শুয়ে আছে। এই দিনের বেলাতেও খাটে মশারি টানানো। পৃথিবীতে যত বিরক্তিকর জিনিস আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো দিনের বেলা মশারি টানিয়ে শুয়ে থাকা। কিন্তু বিরক্তিকর হলেও তাকে এই নিয়ম মানতে হবে। হেকিমের কড়া নির্দেশ, ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। মশার উপদ্রব খুব বেড়েছে।

মাদায়েনের আবহাওয়া খুবই নিম্নমানের। বৃষ্টি নেই, বাদলা নেই। চারদিকে সাদা কুয়াশার মতো ধুলো ওড়ছে। বাইরে বের হলে নাক-মুখ কাপড়ে ঢেকে বের হতে হয়। নয়ত বাতাসের সঙ্গে শোঁ শোঁ করে নাকে ঢুকতে থাকে ধুলো। তার ওপরে বেড়েছে মশার উপদ্রব। ভয়ংকর এই পরিবেশ দূষণে মাদায়েনের অধিবাসীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সাহাবিরা একদমই মানিয়ে নিতে পারছেন না নিজেদের।

আবু সালেহও এই পরিবেশ দূষণের শিকার। তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। চেহারার রং কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে। বয়স তার পঁচিশ হলেও দেখাচ্ছে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধের মতো। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেকে চিনতে পারে না আবু সালেহ। হাত দিয়ে সে তার চেহারায় হাত বুলায়। চামড়া খসখস করে কর্ণফুলি খাতার মতো।

‘আয়নায় কী দেখছো?’
আবু সালেহ পেছনে তাকিয়ে দেখে তার স্ত্রী সামিরা। তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
‘হাসছো কেন?’
‘তোমাকে দেখে।’
‘আমাকে দেখে তোমার দুঃখ পাবার কথা। উলটো হাসছো?’
‘হাসবো না তো কী করবো। চেহারায় দাগ দেখে মন খারাপ হয় নারীদের। পুরুষেরও মন খারাপ হয়, এই প্রথম দেখলাম।’
কপাল কুঞ্চিত করে আবু সালেহ বললো, ‘আমি যদি মারা যাই?’
সামিরা ভ্রু বাঁকা করে বললো, ‘মারা তো যেতেই হবে আজ কিংবা কাল। কিন্তু এই রোগে কেউ মারা যায় না।’
আবু সালেহ বললো, ‘আমি ভাবছি মাদায়েন ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাব। হাওয়া বদল করলে তাজাদম হয়ে উঠবো।’
সামিরা বললো, ‘কোথায় যাবা?’
আবু সালেহ বললো, ‘হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদি.কে জিজ্ঞেস করবো। তিনি নিশ্চয়ই ভালো কোনো পরামর্শ দিবেন।’

আসরের পর মুসল্লিদের নিয়ে মসজিদের প্রাঙ্গনে বসে আছেন সাদ রাদি.। তার চোখ কাকে যেন খুঁজছে। গত কয়েকদিন তাগড়া যুবক আবু সালেহকে দেখা যাচ্ছে না। কেউ তার ব্যাপারে কোনো কথাও বলেনি। সেও কোনো খবর পাঠায়নি। সাদ রাদি. জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবু সালেহকে দেখা যাচ্ছে না কয়েকদিন।’
একজন বললো, ‘দেখা যাবে কী করে। তিনি তো অসুস্থ হয়ে শয্যা নিয়েছেন।’
সাদ রাদি. বললেন, ‘কী হয়েছে তার?’
লোকটি বললো, ‘সবার যা হচ্ছে তাই।’

সাদ রাদি. বিষয়টি নিয়ে কিছুদিন ধরে বেশ চিন্তিত। মাদায়েন বসবাস অযোগ্য হয়ে উঠছে। ধুলোবালির যন্ত্রণা, মশার উপদ্রব। চারদিক থেকে লোকদের অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর আসছে। তিনি বুঝতে পারছেন না কী করবেন। এভাবে আর কিছুদিন থাকলে সবাই অসুস্থ হয়ে পড়বে। হেকিমের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। হেকিম স্থান বদলের পরামর্শ দিয়েছেন। বললেই তো আর বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে হুট করে জায়গা বদল করা যায় না।

সাদ রাদি. খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত ওমর রাদি. এর কাছে পরামর্শ চেয়ে চিঠি লিখলেন। উত্তরে হজরত ওমর রাদি. লিখলেন:

মহামান্য সাহাবি,
আপনাদের কুশল জেনে এই চিঠি লিখছি। আপনারা মাদায়েনে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারছেন না। পরিবেশ দূষণ মারাত্মক। আপনারা এবং আপনাদের উটগুলো ক্রমশই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। হেকিম বলছেন, জায়গা পরিবর্তন করতে। আমারও পরামর্শ জায়গা বদল করুন। যে জায়গা উট বসবাসের উপযোগী নয়, সে জায়গা আরবদের বসবাসেরও উপযোগী নয়।
ইতি
ওমর ইবনুল খাত্তাব

আবু সালেহ কিছুটা সুস্থ হলে সাদ রাদি. এর দরবারে উপস্থিত হলো। সাদ রাদি. তখন বিকেলের মেঘমুক্ত আকাশের নিচে পায়চারি করছেন। তিনি কিছু বলার আগেই আবু সালেহ বললো, ‘হাওয়া বদল করতে চাই। পরামর্শের জন্য এসেছি।’
সাদ রাদি. বললেন, কোথায় যেতে চাও?’
আবু সালেহ বললো, ‘আপনি যেখানে বলবেন।’
সাদ রাদি. বললেন, ‘আর কিছুদিন অপেক্ষা করো। মুসলমানদের জন্য নতুন আবাসভূমি খোঁজা হচ্ছে।’
আবু সালেহ বললো, ‘তাহলে সবাই জায়গা বদল করব?’
সাদ রাদি. বললেন, ‘হুম। ইনশাআল্লাহ।’

কুফা এসে পৌঁছলেন হুযায়ফা এবং সালমান ইবনে যিয়াদ রাদি.। তাদেরকে পাঠিয়েছেন সাদ রাদি.। যে জায়গা তাদের পছন্দ হলো, তা কংকর এবং লাল বালুময়। দুপুরের রোদে চিকচিক করছে সোনার মতো। এখানে তিনটি যাজক নিবাস আছে। এক. হুরকা ইবনে নুমান যাজক নিবাস। দুই. উম্ম আমর যাজক নিবাস। তিন. সিলসিলা যাজক নিবাস। উট থেকে নেমেই তারা প্রথম খেজুর গাছের ছায়ায় জোহরের নামাজ আদায় করলেন।
হুরকা ইবনে নুমান যাজক নিবাসের একজন এগিয়ে এলো। তার নাম নিহাল ইবনে আশজা। অনেক্ষণ ধরেই সে দাঁড়িয়ে দেখছিল এই দুই সাহাবির কর্মকাণ্ড।
‘কিছু খুঁজছেন?’
হুযায়ফা রাদি. বললেন, ‘বসবাসের ভূমি খুঁজছি।’
নিহাল বললো, ‘আপনারা কারা?’
হুযায়ফা রাদি. বললেন, ‘আমরা রাসূল সা. এর সাহাবি।’
নিহালের মাথা নুয়ে এল শ্রদ্ধায়। বিনীত হয়ে সে বললো, ‘আপনাদের দেখা পেয়ে আমি ধন্য। দুপুরের খাবার যদি আমার ঘরে খেতেন, আমি খুশী হতাম।’

সাহাবি দুজনের কাঁধব্যাগে খাবার আছে। তবুও নিহালের পীড়াপীড়িতে তার ঘরে যেতে হলো। ঘরে ঢুকেই তারা দেখেন মাটিতে একটা শিশু খেলা করছে। শিশু নয় যেন একটা ফেরেশতা। অচেনা দুজন লোক দেখে শিশুটি তাকিয়ে আছে। সালমান রাদি. শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে তার দুই গালে দুটি চুমু খেলেন। চুমু পেয়ে শিশুটি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। গুলুমুলু হাত দুটি নাড়িয়ে এবং হাসি দিয়ে জানালো, এই চুমু তার পছন্দ হয়েছে। এবার তারা দুপুরের খাবার খেতে পারে।

খাবার খেতে খেতে কুফার পরিবেশ, আবহাওয়া নিয়ে অনেক কথা হলো। নিহাল বললো, নিশ্চিন্তে এখানে চলে আসুন। এখানের মতো তাজাদম হাওয়া আর কোথাও পাবেন না। কুফার রোদের তাপ নিলে সব রোগ দূর হয়ে যাবে । আর সব মন খারাপ দূর হয়ে যাবে কুফার বৈকালিক হাওয়ায়। আপনারা এলে এই ভূমি শস্য-শ্যামলিমায় আরও ভরে উঠবে। আপনাদের বরকতে আরও সজীব হয়ে উঠবে।

সাহাবি দুজন সিদ্ধান্ত নিলেন, কুফাই হবে মুসলমানদের আবাসভূমি। খাবার খেয়ে তারা দুজন দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ, আসমান ও আসমানের ছায়ায় অবস্থিত সবকিছুর মালিক! হে পৃথিবী ও পৃথিবীস্থিত সবকিছুর মালিক! এই কুফাতে আমাদের জন্য বরকত নাজিল করুন। এই ভূমিকে আমাদের স্থায়ী বাসস্থানরূপে মঞ্জুর করুন।’

হজরত সাদ রাদি. সবাইকে কুফা গমনের নির্দেশ দিয়েছেন। পথে নেমেছে কুফাগামী মানুষের দল। দলের নেতৃত্বে সাদ রাদি.। এই দলে যুক্ত হয়েছে আবু সালেহ এবং তার স্ত্রী সামিরা। অবু সালেহ এখনো সুস্থ হয়নি। শরীরে দুর্বলতা প্রকট। সামিরা বললো, ‘আমি উট চালাব। তুমি আমার পেছনে বসবে।’
চোখ বড় করে তাকালো আবু সালেহ। মৃদু হাসি দিয়ে বললো, ‘তুমি চালাবে?’
সামিরা মাথা নাড়লো, ‘হুম।’
আবু সালেহ বললো, ‘আমিই চালাতে পারবো।’
সামিরা বললো, ‘আমাকে বোধহয় বিশ্বাস হচ্ছে না—এত দূরের পথ আমি উট চালাতে পারব কিনা।’
আবু সালেহ বললো, ‘আমাদের বিয়ের তিন বছর হলো। একদিনও তোমাকে উট চালাতে দেখিনি।’
সামিরা বললো, ‘কারণ, তুমি সুস্থ ছিলে। তোমার ওপর ভরসা করতে পারতাম। আমি কেন উট চালাতে যাব। এতদিন তুমি আমার দায়িত্ব নিয়েছ, এখন আমি তোমার দায়িত্ব নিব।’
আবু সালেহ হাসলো।
সামিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘মানুষের সবচে বেশি কি প্রয়োজন জানো?’
আবু সালেহ ভ্রুকুঞ্চিত করে বললো, ‘কী?’
সামিরা বললো, ‘একটা ভালোবাসার মানুষ, একটা ভরসার হাত। ভালোবাসার মানুষটা পাশে বসে যখন ভরসার হাতটা কাঁধে রাখে, তখন পৃথিবীকে মনে হয় জান্নাত। মনে হয় এই পৃথিবীতে আমার আর কিচ্ছু চাই না। পৃথিবী উলটে যাক, তাতে আমার কী। শুধু এই মানুষটা আমার পাশে থাকুক, তার হাত আমার কাঁধে থাকুক। কিন্তু সবসময় অপরজনই যে আমার কাঁধে হাত রাখবে, বিষয়টা এমন নয়। কখনও অপর প্রান্তের মানুষটারও ইচ্ছে করবে—আমি যেন তার পাশে বসি। তার কাঁধে হাত রেখে বলি—সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন অবশ্যই আমাকে সেই চাওয়া পূর্ণ করতে হবে।’
আবু সালেহ বললো, ‘এই যেমন এখন তুমি আমার পাশে দাঁড়ালে। উট চালানোর দায়িত্ব নিলে।’
সামিরা হেসে বললো, ‘মনে রাখবা—নতুন ভূমিতে আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। তুমি আমাকে নিয়ে যাওনি।’
আবু সালেহ বললো, ‘বুঝতে পারছি—আজ থেকে দিনে দশবার আমাকে এই কথাটা শুনতে হবে।’
সামিরা বললো, ‘হুম। কানটাকে প্রস্তুত করো।’

দলটি যখন কুফায় পৌঁছলো, তখন মুহররম মাস। কুফায় সর্বপ্রথম তৈরী করা হলো একটি মসজিদ। সেই মসজিদের সামনে সবাই দাঁড়িয়ে। মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হজরত সাদ রাদি. এক তীরন্দাজকে নির্দেশ দিলেন, ‘তীর ছুঁড়ো।’
তীরন্দাজ বললো, ‘কোথায়?’
সাদ রাদি. বললেন, ‘মসজিদের চারদিকে। যেখানে তীর পড়বে, সেখানেই একেকজন একেকটি করে ঘরবাড়ি তৈরী করবে।’

তীরন্দাজ মহা উৎসাহে তীর ছুঁড়তে লাগলো। একটি তীর ছুঁড়ছিল আর মিটমিট করে হাসছিলো। সে যেন তার অন্তরচোখে দেখছিলো—লোকদের পদচারণায় এই কুফা নগরী একদিন গমগম করছে। খেলাফতের রাজধানী হয়ে উঠছে কুফা। বিভিন্ন দেশবিজয়ী দল এসে থামছে কুফার এই মসজিদের কাছে। বিশ্রাম নিচ্ছে, বিজয়ের গল্প শুনাচ্ছে। কুফার এই মসজিদে বসে দরস দিচ্ছেন যুগশ্রেষ্ঠ হাদিসবিশারদগণ। তীরন্দাজ যেন সব দেখতে পাচ্ছিলো। সাদ রাদি. জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি হাসছ কেন?’ তীরন্দাজ তূণীর থেকে তীর বের করতে করতে বললো, ‘যে শহরের গোড়াপত্তন করেছি আমরা, তা একদিন পৃথিবী বিখ্যাত হবে। কিন্তু কিভাবে হবে, তা আমি জানি না। জানি শুধু বিখ্যাত হবে।’

লোকজন বাড়িঘর তৈরী করলো বাঁশ ও কাঠ দিয়ে। মসজিদের মেহরাবের পেছনে সাদ রাদি. একটি প্রসাদ নির্মাণ করলেন প্রশাসনিক কার্যালয় ও রাষ্ট্রীয় কোষাগার হিসেবে ব্যবহারের জন্য। কুফার তাজাদম বাতাসে বুকভরে শ্বাস নিতে নিতে সুস্থ হয়ে উঠলো সবাই। কিন্তু বিপদ তখনো পিছু ছাড়েনি মাদায়েন থেকে চলে আসা এই মুসলিমদের। বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাঁশ ও কাঠের তৈরী বাড়িগুলো আগুনে পুড়ে যায়। সাদ রাদি. খলিফা ওমর রাদি. এর অনুমতি নিয়ে ঘারবাড়িগুলো ইট দিয়ে তৈরী করে দেন। নগর জমিয়ে তোলার লক্ষ্যে সাদ রাদি. অন্যান্য গোত্র ও শাসনকর্তাদের কুফায় আগমনের দাওয়াত দিলেন। আবু হিয়াজকে নির্দেশ দিলেন ঘরবাড়ি বানানোর ব্যবস্থা করার জন্য। তিনি আবু হিয়াজকে বলে দিলেন, ঘরবাড়ি এমনভাবে বানাতে হবে, যেন প্রধান সড়কের জন্য ৪০ হাত জায়গা ছেড়ে দেয়া হয়। উপপ্রধান সড়কগুলোর জন্য ৩০ ও ২০ হাত রাখা হয়। গলিপথের জন্য ছাড়তে হবে ৭ হাত করে।

সাদ রাদি. বাজারের পাশে বাসভবন করে বেশ বিপদে পড়েছেন। বাজারে সবসময় টুংটাং ভুংভাং শব্দ হতেই থাকে। দিন নাই রাত নাই অবিরাম কুলি ডেকে যায়। বাজারের শোরগোলের কারণে তিনি ঠিকমতো কথা বলতেও পারছেন না, শুনতেও পারছেন না। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আজ থেকে তার বাসভবনের দরজা বন্ধ। একজন জনপ্রতিনিধির দরজা বন্ধ থাকবে—খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত ওমর রাদি. মানতে পারলেন না। তিনি মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাকে কুফায় পাঠালেন। তার দায়িত্ব—সাদ রাদি. এর বাসভবনের দরজা পুড়িয়ে ফেলা। কারো কথা শোনা যাবে না। কাজ সমাধা করে সোজা ফিরে আসতে হবে মদীনায়।

বাসভবনের দরজা পুড়িয়ে হজরত সাদ রাদি. এর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা। পিনপতন নীরবতা-মৌনতা। সর্বপ্রথম মৌনতা ভাঙলেন মাসলামা, ‘ক্ষমা করবেন। খলিফার নির্দেশে এটা করতে হলো।’
সাদ রাদি. বললেন, ‘খলিফা খুব নাখোশ?’
মাসলামা বললেন, ‘জি। তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন এই দরজা যেন কখনো বন্ধ না হয়। মানুষ এসে যেন ফিরে না যায়। দরজায় কোনো প্রহরী থাকবে না। সাক্ষাৎপ্রার্থী সোজা আপনার কাছে আসবে।’
সাদ রাদি. বললেন, ‘হুকুম শিরোধার্য। আপনাকে কিছু উপহার দিতে চাই।’

মাসলামা কোনো উপহার গ্রহণ করলেন না। খলিফার কাজ সমাধা করে মদীনার পথে পা বাড়ালেন।

শামের হিমস নগরীতে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। এমন ঝুম বৃষ্টি নামার মতো মেঘ আকাশে ছিল না। বিচ্ছিন্ন কয়েক টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াতে দেখে মনে হয়েছিল—কয়েকফোঁটা বৃষ্টি পড়বে, তারপরই সব ঠুস। ঠা ঠা রোদ উঠবে৷ বৃষ্টিভেজা মাঠ তখন চিকচিক করতে করতে রোদের স্তুতি গাইবে। কিন্তু হলো একদম বিপরীত। এমন ঝুম বৃষ্টির দিনকে বলা যায় ‘বাদলা দিন’।

জানালায় মুখ রেখে বৃষ্টি দেখতে দেখতে স্মৃতি কাতর হয়ে পড়েছেন হজরত আবু উবায়দা রাদি.। রোমান সাম্রাজ্যের এশিয়াকেন্দ্রীক রাজধানী ছিল হিমস। ঐতিহাসিক শহর বা’লাবাক জয় করে মুসলমানগণ যখন হিমস পৌঁছে, তখন প্রচণ্ড শীতকাল। এমন তীব্র শীত—সাধারণ মানুষদের হাতপা অবশ হয়ে যেত। রোমানদের বহুলোক মোজা এবং গরম জুতা পড়েও চলাফেরা করতে পারতো না। কারো আঙুল, কারো পা নিথর অবশ হয়ে যেতো। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম তীব্র শীতেই হিমস অবরোধ করেন। তারা সাধারণ পোশাক এবং সাধারণ জুতা পরেই চলাফেরা করতেন। কারো কোনো কষ্ট হতো না। সেই অবরোধ অনেক দীর্ঘ হয়েছিল। আবু উবায়দা রাদি. এর চোখে এখনো ভাসছে—সাহাবায়ে কেরাম একদিন একত্র হয়ে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে তাকবির দিলেন। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে হিমসের সুউচ্চ দেয়ালে কম্পন তৈরী হয়। কিছু দেয়ালে ফাটল ধরে যায়। এই দৃশ্য দেখে শহরবাসী মুসলমানদের নিকট শহর সোপর্দ করে দেয়।

সেই হিমস শহর নিয়ে গোপনে আবার খেলা শুরু হয়েছে। জাযিরার অধিবাসীরা রোমানদের উসকে দিচ্ছে হিমস পুনর্দখল করার জন্য। এতে ৩০ হাজার সৈন্য দিয়ে রোমানদের সাহায্য করতে রাজি তারা। তাদের আশ্বাস পেয়ে ইতোমধ্যে রোমানরা বেরিয়ে পড়েছে হিমস অবরোধের উদ্দেশ্যে। আবু উবায়দা রাদি. সাহায্য এবং পরামর্শের জন্য খালিদ ইবনে ওলিদকে ডেকে এনেছেন কিন্নাসিরিন থেকে। বিষয়টি তিনি জানিয়েছেন হজরত ওমর রাদি.-কেও। কেন্দ্র থেকে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি—রোমানদের মোকাবেলা কিভাবে করা হবে। তিনি খেলাফতের কেন্দ্রের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছেন।

রোমানরা হিমস শহর অবরোধ করে ফেলেছে। সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে অবস্থানরত মুসলিম সৈনিকগণ নিজ নিজ শহরের আইন-শৃঙ্খলা ও প্রশাসন স্বাভাবিক রাখতে ব্যস্ত। তারা আবু উবায়দা রাদি. এর সাহায্যে আসতে পারছে না। তারা নিজেদের শহর ছেড়ে বেরুলেই প্রশাসন ভেঙে পড়বে। আবু উবায়দা রাদি. পরামর্শে বসলেন। খালিদ রাদি. বললেন, ‘আমাদের উচিত শহর থেকে বেরিয়ে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়া। দুশমনদের নাস্তানাবুদ করা।’ তবে অন্যরা তার সঙ্গে একমত হলেন না। সবাই বললেন, ‘শহরে থেকেই আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’ আবু উবায়দা রাদি. সিদ্ধান্ত নিলেন, ‘হিমস নগরীর অভ্যন্তরে থেকেই আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।’

শামের আমওয়াস অঞ্চলে অদ্ভুত এক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। রোগ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। সকালে গায়ে ফোঁড়ার মতো টিউমার হচ্ছে, বিকেলে ব্যথায় মারা যাচ্ছে। প্রতিদিনই তৈরী হচ্ছে নতুন কবর, পড়তে হচ্ছে নতুন জানাযা। হেকিমদের সঙ্গে কথা বলেছেন আবু উবায়দা রাদি.। তারা জানিয়েছে, আমওয়াস থেকে এই রোগ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে। সামনে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। সাধারণ ফোঁড়ায় তারা যে ওষুধ ব্যবহার করেন, তাতে ফোঁড়া সেরে যাবার কথা। কিন্তু তাদের ওষুধ ব্যবহার করার পরও কয়েকজন মারা গেছে। নতুন পথ্য খুঁজতে হবে। হেকিমদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে—নতুন পথ্য খুঁজে বের করার জন্য।

আমওয়াস জয় করেছিলেন আবু উবায়দা রাদি. খোদ নিজেই। বাইতুল মাকদিস বিজয়ের সময় এই আমওয়াস ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি সেনাঘাঁটি। আল কুদস এবং রামলার মধ্যভাগে এর অবস্থান। যে আমওয়াস ছিল বিজয়ের আশ্রয়কেন্দ্র, সেই আমওয়াস থেকে শুরু হয়েছে এক ধ্বংসাত্মক রোগ। একদিক থেকে ধেয়ে এসেছে রোমানদের স্রোত, আরেকদিক থেকে এসেছে আমওয়াসের ধাক্কা। দুই ধাক্কা একসঙ্গে সামলানো কঠিন। রোমানরা যদি শুনতে পারে এই রোগের কথা, তাদের উৎসাহ বেড়ে যাবে। তারা দেখবে—যুদ্ধ ছাড়াই আমাদের লোকেরা মারা যাচ্ছে। তখন তারা আরও পাগলা হয়ে যাবে। তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘এই রোগের কথা যেন রোমানরা জানতে না পারে। যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখতে হবে খবর।’

সাদ রাদি. এর হাতে হজরত ওমর রাদি. এর পাঠানো চিঠি। জোহর নামাজ শেষ করে তিনি তিনি কুফার মসজিদের বারান্দায় বসেছেন। উত্তুরে হাওয়া বইছে। পাটি পেতে গা এলিয়ে দিলেই ঘুম চলে আসে। এমন সময় চিঠি এসে পৌঁছলো। খলিফার চিঠি পেয়ে তিনি সটান হয়ে বসে গেলেন। নিশ্চয়ই কঠিন কোনো নির্দেশনা চিঠির ভেতর। খাম খুলে তিনি চিঠি পড়তে শুরু করলেন—

সেনাপতি সাদ,
রোমানরা হিমস অবরোধ করেছে। আমার চিঠি পাওয়া মাত্রই কা’কা ইবনে আমরের নেতৃত্বে একটি বাহিনী গঠন করে আবু উবায়দা রাদি. এর সাহায্যে পাঠাবে। জাযীরার অধিবাসীগণ আবু উবায়দার বিরুদ্ধে রোমানদের সাহায্য করছে। ইয়ায ইবনে গানামের নেতৃত্বে আরেকটি বাহিনী গঠন করে তাদের শায়েস্তা করতে পাঠাবে। কুইক—দেরী করা যাবে না।
বি:দ্র: আমিও রওয়ান হচ্ছি হিমসের উদ্দেশ্যে।
ইতি
ওমর ইবনুল খাত্তাব

কা’কা ইবনে আমরের নেতৃত্বে যে দলটি গঠিত হলো, তার সৈন্যসংখ্যা চার হাজার। তাতে অংশগ্রহণ করেছে আবু সালেহ। অসুস্থতা কাটিয়ে সে সুস্থ হয়েছে কবেই। এখন সে টগবগে। জিহাদের জন্য শতভাগ প্রস্তুত। সামিরার কাছে এসেছে বিদায় নিতে। সামিরা তার প্রিয় খাবার বকরিভুনা নিয়ে বসে আছে।
‘জিহাদ থেকে কবে ফিরবে?’
‘মৃত্যু এবং জিহাদ থেকে ফেরা—এ দুটো সময় আমরা কখনোই বলতে পারি না।’
‘তাহলে অনিঃশেষ অপেক্ষা?’
আবু সালেহ বললো, ‘হুম।’
‘আমি অপেক্ষা করবো। কিন্তু তোমার ছেলে কিন্তু অপেক্ষা করবে না।’
বিস্মিত হয়ে আবু সালেহ বললো, ‘মানে?’
সামিরা হাসে, ‘মানে বুঝতে হবে না।’
আবু সালেহ বিস্মিত উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, ‘আমি বাবা হচ্ছি? ‘
সামিরা চোখের ইশারায় বললো, ‘হুম।’
আবু সালেহ সামিরাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। দুই বুকের উষ্ণতা একাকার হয়ে গেলো খুব চেনা কোনো উপত্যকায়। সামিরা আবু সালেহকে আরও গভীরভাবে চেপে ধরে বললো, ‘জলদি ফিরবে বিজয় নিয়ে।’
‘এখন তো জলদি ফিরতেই হবে।’
সামিরা বুকে মাথা রেখেই বললো, ‘হুম। খুব জলদি।’
আজ তারা দুজন এক বাসনে খাবার খেলো। লোকমা তুলতে গিয়ে ইচ্ছে করেই আঙুলে জড়ালো আঙুল। এক লোকমা ভাগ করে নিলো দুজন। খাবার শেষে তরবারি-ঢাল নিজেই এগিয়ে দিল সামিরা। নিজের স্বামীকে সাজিয়ে দিল যোদ্ধা সাজে। কপালে চুমু খেয়ে বললো, সুস্থ থাকো। আমার পাখি ফিরে এসো আমার কাছে।

রোমান শিবিরের অবস্থা এখন তথৈবচ। তারা ঠিক বুঝতে পারছে অবরোধ মচমচ করে শুকনো ডালের মতো ভেঙে পড়ছে। আর কোনোভাবেই টিকিয়ে রাখা সম্ভব না। জাযীরার অধিবাসীগণ জেনে গেছে—রোমানদের সাহায্য করার অপরাধে তাদের শায়েস্তা করতে কুফা থেকে মুসলিম সেনাবাহিনী এগিয়ে আসছে। ভয়ে তাদের কলজে শুকিয়ে গেছে। অবরোধ ত্যাগ করে তারা চলে গেছে নিজ নিজ শহরে। রোমানরা এখন একা। ইতোমধ্যেই তারা শুনতে পেরেছে—আবু উবায়দাকে সাহায্য করার জন্য স্বয়ং খলিফা ওমর সেনাদল নিয়ে যাত্রা করেছেন। এই খবর শোনার পর তাদের অনেকেই পিছুটান দিয়েছে।

খালিদ রাদি. আবু উবায়দা রাদি.-কে পরামর্শ দিলেন, রোমানরা এখন টালমাটাল। সেনাসাহায্যের অপেক্ষা না করে অবিলম্বে তাদের ওপর আক্রমণ করুন। আবু উবায়দা রাদি. তাই করলেন। রোমানগণ শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। হজরত ওমর রাদি. এবং কুফার সেনা সাহায্য মিলিত হবার তিনদিন পূর্বেই বিজয় অর্জিত হয়ে যায়। খলিফা অবস্থান করছিলেন জাবিয়াতে। সেনাপতি আবু উবায়দা তাকে চিঠি লিখে জানালেন, ‘সেনা-সাহায্য পৌঁছার তিনদিন পূর্বেই বিজয় অর্জিত হয়েছে। এখন প্রেরিত সেনাদলকে গনিমতের মাল দেয়া হবে কিনা?’ খলিফা জবাবে লিখলেন, ‘তারা গনিমতের মাল পাবে। কারণ, সেনারা যাত্রা করেছে শুনেই শত্রুপক্ষ ভয় পেয়ে অবরোধ ত্যাগ করেছে। আল্লাহ কুফাবাসীদের প্রতি দয়া করুন। তারা নিজেদের ভূখণ্ড রক্ষা করে এবং অন্যান্য নগরবাসীকে সহযোগিতা করে।’

গনিমতের মাল বণ্টনের ব্যস্ততা শেষ করে খলিফা ওমর রাদি. এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে জাবিয়া এসেছেন সেনাধ্যক্ষগণ। তাদের মধ্যে রয়েছেন আবু উবায়দা রাদি., ইয়াযীদ ইবনে আবি সুফিয়ান রাদি., খালিদ ইবনে ওলিদ রাদি. প্রমুখ। তারা জানালেন, সিরিয়ায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। প্লেগ আমওয়াস ছাড়িয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। তবে এখনো মহামারী আকার পায়নি। হেকিমরা চেষ্টা করছেন পথ্য তৈরী করার।

হজরত ওমর রাদি. সংশয়ে পড়ে গেলেন। সিরিয়ায় প্রবেশ করবেন, নাকি জাবিয়া থেকেই ফিরে যাবেন মদীনায়। প্রবীণ সাহাবিদের মধ্যে কেউ পরামর্শ দিলেন, ‘এতদূর যখন এসেছেন, সিরিয়া পরিদর্শন করেই যান।’ কেউ পরামর্শ দিলেন, ‘খলিফার উচিত এখনই মদীনায় ফিরে যাওয়া।’ হজরত ওমর রাদি. আনসার ও মুহাজিরদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। তারাও দু’দলে ভাগ হয়ে দু’রকম পরামর্শ দিলো। সবশেষ তিনি প্রবীণ কুরাইশদের পরামর্শ চাইলেন। তারা সবাই একবাক্যে সিদ্ধান্ত দিলেন—সিরিয়ার সফর স্থগিত করে আপনার মদীনায় ফিরে যাওয়া উচিত। আপনি আপনার সঙ্গীদের প্লেগের দিকে ঠেলে দিবেন না।

হজরত ওমর রাদি. মদীনায় ফিরে যাবার প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করলেন। আবু উবায়দা রাদি. চাচ্ছিলেন, খলিফা যেহেতু এসেছেন, সিরিয়া পরিদর্শন করেই যান। তাই ওমর রাদি. এর সিদ্ধান্ত তিনি মন থেকে মানতে পারেননি৷ মুখফুটে বলেই ফেললেন, ‘আপনি কি আল্লাহর নির্ধারিত তাকদির থেকে পলায়ন করছেন?’
প্রশ্নটি হজরত ওমর রাদি. এর হৃদয়ে কাঁটার মতো বিঁধলো। ভেতরে রক্ত পড়তে লাগলো ফোঁটায় ফোঁটায়। এ ফোঁটার টুপটুপ অনুভব করতে পারছিলেন কেবল তিনিই। আবু উবায়দা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ সাহবির অন্যতম একজন। খলিফা তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন। অথচ তিনি তাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন!
আস্তে করে ওমর রাদি. বললেন, ‘এ প্রশ্নটি তুমি করলে? তুমি ছাড়া যদি অন্যকেউ করতো, মানতে পারতাম!’
আবু উবায়দা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছেন। কোন উত্তর দিচ্ছেন না।
হজরত ওমর রাদি. বললেন, ‘আমি আল্লাহর তাকদির থেকে পালিয়ে যাচ্ছি না। বরং এক তাকদির থেকে আরেক তাকদিরের দিকে ফিরে যাচ্ছি। আচ্ছা বলোতো—তোমার কিছু উটকে তুমি এমন কোনো উপত্যকায় নিয়ে গেলে যেখানে দুইটি মাঠ আছে। মাঠ দুইটির মধ্যে একটি মাঠ সবুজ শ্যামলে ভরপুর। আর অন্য মাঠটি একেবারে শুষ্ক ও ধূসর। এখানে বিষয়টি কি এমন নয় যে, যদি তুমি সবুজ-শ্যামল মাঠে উট চরাও, তা আল্লাহর নির্ধারিত তাকদির অনুযায়ীই চরাবে। আর যদি শুষ্ক মাঠে চরাও, তা-ও আল্লাহর তাকদির অনুযায়ী চরাবে?’
আবু উবায়দা রাদি. বললেন, ‘জি।’
খলিফা বললেন, ‘আমি তো তাই করছি।’

দৃশ্যপটে এতক্ষণ উপস্থিত ছিলেন না হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাদি.। বিতর্কের মধ্যেই তিনি এসে উপস্থিত হলেন। সবকিছু শুনে তিনি মুচকি হেসে বললেন, রাসূল সা. বলেছেন—‘তোমরা যখন কোনো এলাকায় মহামারী প্লেগের বিস্তারের কথা শুনো, তখন সেখানে প্রবেশ করো না। আর যদি কোনো এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব নেমে আসে, আর তোমরা সেখানে থাকো, তাহলে সেখান থেকে বেরিয়েও যেও না।’
রাসূল সা. এর এই নির্দেশনা হজরত ওমর রাদি. এর জানা ছিল না। মাত্রই জানতে পেরে তার সব সংশয় দূর হয়ে গেলো। মদীনা ফিরে যাবার যে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন, তা সঠিক। শোকর আলহামদুলিল্লাহ।

মুজাহিদ শিবিরে প্লেগের প্রথম থাবা পড়েছে। এই থাবার শিকার আবু সালেহ। তার কাঁধে ফোঁড়ার মতো একটা টিউমার বেরিয়েছে। ক্রমশ ব্যথা বাড়ছে। কুফার সৈন্যরা আজকেই ফিরে যাবার কথা। মনে হয় না আবু সালেহ ফিরে যেতে পারবে। তার শিয়রে একজন হেকিম বসা। তিনি লতাগুল্ম দিয়ে কী ওষুধ যেন বানাচ্ছেন। লতাগুল্ম ছেঁচতে ছেঁচতে তিনি বললেন, ‘বিশ বছর হলো ফোঁড়া সারাই। বলতে পারেন আমি ফোঁড়া বিশেষজ্ঞ।’
আবু সালেহ কাতরাতে কতরাতে বললো, ‘আমার ফোঁড়া কি সারবে?’
হেকিম বললেন, ‘আমার ওষুধে ফোঁড়া সারতো না, এ তল্লাটে কেউ বলতে পারেনি। কিন্তু এখন সময় খারাপ। সবার ফোঁড়া সারে না।’
আবু সালেহ আরও কাতর স্বরে বললো, ‘আমার ফোঁড়াটা সারিয়ে দিন হেকিম। আমার স্ত্রী আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
হেকিম বললেন, ‘সবার জন্যই কেউ না কেউ অপেক্ষা করে। কারো অপেক্ষা ফুরায়, কারো অপেক্ষা ফুরায় না।’

আবু সালেহের মনে ভয় ঢুকে গেছে। কেমন রসকষহীন কথা বলছেন হেকিম। তার কথা শুনে মনে হচ্ছে—তার ওষুধে তার নিজেরই বিশ্বাস নেই। আচ্ছা, সে যদি কুফায় ফিরে যেতে না পারে, সামিরা সবকিছু একা সামলাতে পারবে! মেয়েটা ওপরে যতটাই শক্ত, ভেতরে ততটাই নরম। আমি দূরে থাকলে তার মন সবসময় পুড়তে থাকে। আর যদি না-ই থাকি, তাহলে? আবু সালেহ আর কিছু ভাবতে পারে না। তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। এ জীবনে সেথিতু হতে পারেনি কোথাও। মাদায়েন থেকে চলে এলো কুফায়। তারপর চলে এলো সিরিয়ায়। ভাগ্যের ফেরে এখন সে প্লেগের শিকার। হায়াত বাকি হয়তো আর কয়েকঘণ্টা।

আবু সালেহকে রাখা হয়েছে আলাদা একটা তাবুতে। সর্বসাধারণের এখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। হেকিম এবং সেবক ছাড়া আর কেউ তাবুতে ঢুকতে পারে না। কুফার সেনারা যাত্রা করেছে সকালে। আবু সালেহের জন্য সেনাপতি কাকা ইবনে আমর এক প্লাটুন সৈন্য রেখে গেছেন। তিনি সুস্থ হলে তাকে নিয়ে কুফায় যাবেন। কিন্তু হেকিমের ওষুধ দেবার পরও কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যে হাতে ফোঁড়া, মনে হচ্ছে সে হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে।

হাত অবশ হয়ে যাবার আগেই সামিরাকে একটি চিঠি লেখা দরকার। কাগজ আনিয়ে চিঠি লিখতে বসলো আবু সালেহ। ব্যথাক্রান্ত হাত চলতে চাইছে না। তবুও জোর করে সে লিখলো—

সামিরা,
আমার দেহে ভয়ংকর প্লেগ দানা বেঁধেছে। যে হাতে চিঠি লিখছি, তা অবশ হচ্ছে ক্রমশ। হেকিমের ওষুধে কাজ হচ্ছে না। আমার খুব ভয় করছে সামিরা। তোমার কাছে ফেরাটা অনিশ্চিত হয়ে গেলো। হয়তো আমি আমার সন্তানের মুখ দেখে যেতে পারব না। ছেলে হলে তার নাম রাখবে মুহাম্মদ। গতকাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখলাম। একটা শিশু তোমার কোলে হাসছে। তুমি তাকে বলছো, ‘মুহাম্মদ, তোমার বাবার গল্প শুনবে?’ স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে গেলাম। শরীর ঘাম দিচ্ছিলো। স্বপ্নে আমি তোমাদের দেখছিলাম, কিন্তু তোমরা আমাকে দেখছিলে না। এরচে কষ্টের আর কিছু আছে?

প্রতিদিনই কারো না কারো জানাযা হচ্ছে। কোনদিন আমার জানাযার ডাক আসে, বলা যায় না। রাসূল সা. বলেছেন, মহামারীতে যদি কোনো মুসলিম মারা যায়, সে শহীদ। মৃত্যুর ডাক এলেও আমি শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করবো। তোমাদের দুজনকে একা রেখে যাচ্ছি। তোমার পুরো জীবন পড়ে আছে সামনে। আমি চলে যাবার পর চাইলে অন্য কারো হাতে হাত রাখতে পারো। কুফার বাজারের দোকানটা তোমার। দোকান ভাড়া দিয়ে যে টাকা আসবে, তা দিয়ে টেনেটুনে চলতে পারবে।

এই চিঠি যখন তোমার কাছে পৌঁছবে, তখন আমি হয়তো পরকালের যাত্রী হয়ে যাবো। কিংবা আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবো। অলৌকিক কিছুর জন্য অপেক্ষা করছি। জান্নাতের দরজায় তোমার জন্য আমি দাঁড়িয়ে থাকবো। মাআস সালাম।

ইতি
আবু সালেহ

জাযিরাতুল আরবে অনেক দিন বৃষ্টি নেই। খরাবৃষ্টিতে এবার ফসল জন্মায়নি। পথে পথে ধুলো উড়ছে। পাতিলে খাবার নেই, ক্ষেতে ফসল নেই। প্রখর রৌদ্রতাপে সবুজ গাছপালা পুড়ে বিবর্ণ। রাস্তায় বেরুলে দেখা যায় ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার। ঘাস না পেয়ে গবাদি পশুগুলোও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। জবাই করে হাড্ডি ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। গ্রাম থেকে ভুখা মানুষের মিছিল ছুটছে মদীনা শহরের দিকে। তাদের চোখেমুখে প্রবল প্রত্যাশা—খলিফা তাদের খাবার দিবেন। ক্ষুধায় তাদের হাত-পা কাঁপছে। তবুও হাঁটা বন্ধ করছে না।
পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ খলিফা ওমর। তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন—যারা গ্রাম থেকে আসবে, মদীনার উপকণ্ঠে তাদের জন্য শরণার্থী শিবির নির্মাণ করা হোক। শিবিরে আশ্রয় নেয়া প্রত্যেকের খাবার দেয়া হবে বাইতুল মাল থেকে। যতদিন দুর্ভিক্ষ না যাবে ততদিন। নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হয়েছে। দলের পর দল ভুখা মানুষের মিছিল আসছে, শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে। পাকঘরে সকাল থেকে শুরু হয় রান্না, চলে মধ্যরাত অবধি। প্রত্যেকটি ভুখা মানুষের মুখে তুলে দেয়া হচ্ছে বাইতুল মালের আহার। খলিফা ওমর ঘোষণা দিয়েছেন—যতদিন দুর্ভিক্ষ না যাবে, যতদিন বৃষ্টি না নামবে, তোমাদের আহারের দায়িত্ব আমার। আমি সব ব্যবস্থা করবো।

ঘিয়ে ভাজা রুটি এবং গোশত খলিফা ওমরের প্রিয় খাবার। সাধারণত তিনি এই ম্যানুতেই খাবার সারেন। আজও তার দস্তরখানায় ঘিয়ে ভাজা রুটি এবং গোশত দেয়া হয়েছে। খাদেম ইয়ারফা খলিফাকে বললেন, ‘খাবার প্রস্তুত।’

খলিফা বললেন, ‘আজ আমি একা খাব না। একজন গ্রাম্য লোককে ডেকে আনো। একসঙ্গে খাব।’

গ্রাম্য লোকটি এলো। এক প্লেটে আজ খাবার খেতে বসলেন খলিফা ওমর এবং সাধারণ গ্রাম্য একজন লোক। তার মুখাবয়বে ক্ষুধার ছাপ স্পষ্ট। খলিফা লোকটিকে লক্ষ্য করছেন। খলিফার সামনে একজন সাধারণ লোকের যতটুকু ইতস্ততা করার কথা, তা এই লোকটির মধ্যে নেই। ঘি এবং গোশত পেয়ে যেন তার ক্ষুধা চাগিয়ে উঠেছে। কোনোদিকে না তাকিয়ে লোকমার পর লোকমা তুলছে।

খলিফা বললেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে ঘি তুমি কখনো খাওনি।’
লোকটি বললো, ‘জি। এতমাস হলো—ঘি খাইনি এবং কাউকে খেতেও দেখিনি।’

লোকটির কথা শুনে খলিফা চমকে উঠলেন। যে খাবার তার নিত্যদিনের, সে খাবার এই লোকগুলো কতদিন হলো দেখেই না। খাবার তো দূর কী বাত! খলিফা কসম করে বললেন, ‘যতদিন দুর্ভিক্ষ না যাবে, ঘি-গোশত সুলভ মূল্যে বাজারে না পাওয়া যাবে, আমি ঘি এবং গোশত স্পর্শ করবো না।’

কিছুদিন পরই বাজারে ঘি এবং দুধের কৌটা এলো। ইয়ারফা চল্লিশ দিরহামে এক কৌটা দুধ এবং এক কৌটা ঘি কিনে আনলো। হাসিতে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে সে ওমর রাদি.কে বললো, ‘আমিরুল মুমিনিন! আপনার কসম পূর্ণ হয়ে গেছে। বাজারে এখন দুধ-ঘি পাওয়া যাচ্ছে। আমি আপনার জন্য চল্লিশ দিরহামে কিনে এনেছি।’ ওমর রাদি. বললেন, ‘এত দামে ঘি কিনেছো? অপচয় আমি পছন্দ করি না। ঘি এবং দুধ গরিব কাউকে দিয়ে দাও। প্রজাদের মতো কষ্ট যদি না করি, তাহলে প্রজাদের কষ্ট বুঝবো কী করে?’

ঘি এবং গোশতের বদলে শুধু যাইতুন তেল দিয়ে রুটি খেতে শুরু করেছেন খলিফা ওমর। চেহারার রং বদলে গেছে তার। মেঘের মতো কালো ছায়া পড়েছে মুখে। তার এই কৃচ্ছতা কাটানোর কসরত করছে খাদেমরা। আজ তার দস্তরখানায় দেয়া হয়েছে উটের গোশত। খলিফা জিজ্ঞেস করলেন, ‘গোশত এলো কোত্থেকে?’
ইয়ারফা বললো, ‘লোকজন আজ উট জবাই করেছে। তার থেকে সারি গোশত দেয়া হয়েছে আপনাকে।’
খলিফা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আহ! আমি কতবড় বাদশা হয়ে গেলাম! আমি খাব গোশত, লোকজন খাবে হাড্ডি। এসব আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও।’

খলিফার রুদ্রমূর্তি দেখে ভয় পেয়ে গেলো ইয়ারফা। মনে মনে লজ্জিতও হলো খানিক। গোশত রেখে খলিফার সামনে এনে দিলো তেল এবং রুটি। খলিফা রুটি টুকরো টুকরো করে তেলে মেশাচ্ছেন আর বলছেন, ‘ইয়ারফা! ওই গোশতগুলো ইয়াসমাবাসীকে দিয়ে আসো। তিনদিন হলো তাদের খোঁজ নিতে পারছি না। তাদের ঘরে খাবার আছে কিনা কে জানে।’

মদীনার উপকণ্ঠে শরণার্থী শিবিরে ভুখা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এক সপ্তাহ আগে রাতের খাবারে অংশ নিয়েছে সাত হাজার লোক। এক সপ্তাহ না পেরুতেই সেই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে চল্লিশ হাজারে। বাইতুল মালের আটার গুদাম উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রান্না হচ্ছে। অফিসারদের তত্ত্বাবধানে বিতরণ করা হচ্ছে খাবার। ওমর রাদি. শুধু শিবিরের লোকদেরই খাবার দিচ্ছেন না; যারা শিবিরে আসতে পারেনি, তাদের ঘরেও খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন।

আজ খলিফা ওমর এবং আসলাম বেরিয়েছেন এমনই একটি কাজে। তাদের সঙ্গে দুই ঝুড়ি শস্য এবং এক টিন তেল। দুজন অদলবদল করে জিনিসগুলো বহন করছেন। দেখেই বুঝা যাচ্ছে—বেশ ভারী। আবু হুরায়রা রাদি. এই পথেই কোথাও যাচ্ছিলেন। দুজনকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। খলিফা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় গিয়েছিলে?’ আবু হুরায়রা রাদি. বললেন, ‘এইতো কাছেই।’ উত্তর দিয়েই তিনি এক ঝুড়ি শস্য নিজের পিঠে তুলে নিলেন। হাঁটতে হাঁটতে তাদের সঙ্গে গিয়ে উপস্থিত হলেন যেরারে। এখানে বিশ সদস্যের একটি পরিবার কোনরকম দিনগুযরান করছিলো।

খলিফা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কোত্থেকে এসেছেন?’
তারা বললো, ‘অনেক দূর থেকে। ক্ষুধার কষ্ট আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে।’
খলিফা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী খাচ্ছেন?’
তারা মৃত প্রাণীর চামড়া এবং পঁচা হাড্ডি দেখিয়ে বললো, ‘এইসব।’

এসব দেখে খলিফার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। আর এক মুহূর্তও তিনি দেরী করলেন না। গায়ের চাদর ছুঁড়ে ফেলে নিজেই রান্না শুরু করলেন। খলিফার হাতের রান্না তারা তৃপ্তিভরে খেলো। তাদের তৃপ্তি দেখে খলিফার চোখ চিকচিক করছিলো আনন্দে। তাদের খাওয়া শেষ হলে খলিফা আসলামকে বললেন, ‘উটের ব্যবস্থা করো। তাদেরকে জুবানা নিয়ে যেতে হবে। এখানে থাকলে না খেয়ে মারা যাবে।’ জুবানা এনে খলিফা তাদের আশ্রয় দিলেন। কাপড় এবং খাবার দিলেন।

ভুখা মানুষের দীর্ঘ এই মিছিলকে সামাল দেয়া যাচ্ছে না। যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে দিয়ে খাবার এবং কাপড় ভর্তি একটি উটের কাফেলা নজদে পাঠিয়েছেন খলিফা ওমর। তাকে বলে দিয়েছেন, প্রত্যেক পরিবারকে খাবার ভর্তি একটি উট দিবে। একজনকে দুটি করে কাপড় দিবে। একটি গরমের, একটি শীতের। তাদের বলে দিবে—উট জবাই করে গোশতগুলো যেন পক্রিয়াজাত করে রাখে। যেন অনেকদিন খেতে পারে। যুবাইর ইবনুল আওয়াম রওয়ানা হয়েছেন। এদিকে মদীনার উপকণ্ঠেও ভুখা মানুষের স্রোত বেড়েছে। প্রতিসন্ধ্যায় ৬০ হাজার লোককে খাওয়াতে হচ্ছে।

বাইতুল মালের যে মজুত ছিল, তাও কমে আসছে। খলিফা ওমরের কপালে ভাঁজের পর ভাঁজ পড়ছে। পথ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। শামে মহামারী, জাযীরায় দুর্ভিক্ষ। এশার নামাজ পড়ে তিনি নামাজে দাঁড়ান। কিয়ামে কুরআন তেলাওয়াতে কাঁদেন, রুকুতে কাঁদেন, সেজদায় কাঁদেন। কাঁদতে কাঁদতে তার দাড়ি ভিজে যায়। গলার স্বর নত হয়ে আসে। দু হাত তুলে মহামহীমের দরবারে প্রার্থনা করেন—হে আল্লাহ! আমার খেলাফতকালে উম্মতে মুহাম্মদীকে তুমি ধ্বংস করে দিও না। দুর্ভিক্ষ দিয়ে আমাদের বরবাদ করে দিও না। এই বিপদ ও পরীক্ষা থেকে আমাদের রক্ষা করো।

খলিফা ওমর সঙ্কট উত্তরণে মুসলিম বিশ্বের গভর্নরদের কাছে হাত বাড়ালেন। খাদ্য সহায়তা চেয়ে সবার কাছেই চিঠি লিখলেন। চিঠির জবাবে সর্বপ্রথম শাম থেকে সাহায্য নিয়ে এলেন আবু উবায়দা রাদি.। তিনি এনেছেন চার হাজার উট ভর্তি খাবার। প্রতিনিধি পাঠাননি, তিনি নিজেই এসেছেন। খলিফা তাকে বললেন, ‘মদীনার চারপাশে খাবারগুলো আপনিই বণ্টন করে দিন।’

বণ্টন শেষ হলে খলিফা তাকে চার হাজার দিরহাম দিতে চাইলেন। আবু উবায়দা বললেন, ‘আমিরুল মুমিনিন! আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং আখেরাতের প্রস্তুতি হিসেবে এসব খাদ্য বিতরণ করেছি। টাকার জন্য করিনি। আমাকে টাকা চাপিয়ে দিবেন না।’ খলিফা বললেন, ‘নিয়ে নাও। না চেয়ে যদি কিছু পাওয়া যায়, তা নিতে অসুবিধা নেই।’ তবুও আবু উবায়দা রাদি. নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। এবার খলিফা বললেন, ‘একবার রাসূল সা.ও এমন একটি কাজে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। কাজ শেষে তিনি আমাকে কিছু দিচ্ছিলেন, আমি না নিয়ে তোমার মতো জবাব দিচ্ছিলাম। তবুও রাসূল সা. আমাকে দিয়েছিলেন।’ এবার আর না করতে পারলেন না আবু উবায়দা রাদি.। দিরহামগুলো নিয়ে তিনি শামের পথ ধরলেন। খলিফা ওমর তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না—আবু উবায়দা নামক এই মহান মানুষটির সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে না।

মদীনায় চারদিক থেকে সাহায্য আসতে শুরু করেছে। মুআবিয়া ইবনে সুফিয়ান রাদি. পাঠালেন আটাভর্তি তিন হাজার উটের একটি কাফেলা। ইরাক থেকে এলো আটাভর্তি এক হাজার উটের একটি কাফেলা। ওমর রাদি. খাদ্য সহায়তা পৌঁছলেই তড়িঘড়ি তা বন্টন করতে শুরু করতেন। শরণার্থী শিবিরের পাশাপাশি পাঠাতেন দূরবর্তী অঞ্চলেও।

আবু উবায়দা রাদি. জানাযার নামাজে উপস্থিত হয়েছেন। সারি করে রাখা দশটি লাশ। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে তারা আজই মৃত্যুবরণ করেছে। শামে প্রতিদিনই শত শত লোক মারা যাচ্ছে। কোথাও কোথাও খনন করা হচ্ছে গণকবর। মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে এ অঞ্চল। প্লেগের ভয়ে শাম ছেড়ে একশজনের একটি দল বসরায় যাচ্ছিলো। পথে আক্রান্ত হয়ে সবাই মারা গেছে। বসরা পৌঁছেছে কেবল চারজন। জীবন এতটা সঙ্গীন, এতটা বিভীষিকাময় হয়ে পড়েছে। চোখের সামনে প্রাণ নিভে যাচ্ছে প্রিয়তমার, চোখ বুজে যাচ্ছে মায়ের, দেহ নিথর হয়ে যাচ্ছে সন্তানের। কেউ কিছু করতে পারছে না। যুদ্ধের ময়দানে বহু সঙ্কটে পড়েছে মুসলমানগণ। বদরের ও ওহুদের লড়াই , হুনাইনের যুদ্ধের মতে সঙ্কট পাড়ি দিয়ে এসেছে তারা। কিন্তু আজকের এই সঙ্কটে যেন পথের সব আলো নিভে গেছে। বিদ্যুচ্চমকের মতো এক চিলতে আলোও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। একের পর এক রচিত হচ্ছে বেদনার গল্প।

এই দশজন মৃতদেহের একজন আবু সালেহ। রোমানদের অবরোধ থেকে হিমস উদ্ধার করতে কাকা ইবনে আমরের নেতৃত্বে প্রেরিত কুফার সেনাদলের সঙ্গে শামে এসেছিলো সে। রোমানদের থেকে হিমস উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু আবু সালেহ আটকা পড়ে গেছে প্লেগের জালে। তার আর কুফায় ফেরা হবে না। সামিরা এখনো অপেক্ষা করছে তার। সে ফিরবে, একসঙ্গে খাবার খাবে। কিন্তু আবু সালেহের লিখে যাওয়া চিঠি যখন তার কাছে পৌঁছবে, সে জানতে পারবে—আর অপেক্ষা করে লাভ নেই। আবু সালেহ পাখি হয়ে উড়ে গেছে জান্নাতে।

আজকের জানাযার নামাজের ইমামতি করবেন আবু উবায়দা রাদি.। জানাযার আগে তিনি জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এই মহামারী রবের পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য রহমত। তোমাদের নবি হজরত মুহাম্মদ সা.-এর দোয়ার বরকত। তোমাদের পূর্ববর্তী নেককারদের মৃত্যুর কারণ। আমি দোয়া করি—এই রহমত ও বরকতের অংশ আল্লাহ তায়ালা যেন আবু উবায়দাকে দান করেন।’ সংক্ষিপ্ত এই কথা বলেই তিনি নামাজ পড়ালেন।

দুর্ভিক্ষে মদীনাতে মানুষ মারা যাচ্ছে। ভুখা মানুষের ভুখ নিবারণ করতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে খলিফা ওমরের। তবুও শামের করুণ পরিণতি তাকে ভাবাচ্ছে। তিনি চাচ্ছেন না—অমন ভয়ংকর মহামারীপূর্ণ এলাকায় আবু উবায়দা রাদি. অবস্থান করেন। তার মতো এমন দক্ষ সেনাপতি কমই জন্মায়। তাকে হারিয়ে ফেললে ওমর রাদি. এর একটি বাহু হারিয়ে যাবে। কিন্তু সরাসরি ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে বললে তিনি কখনো বের হবেন না। এত মানুষকে বিপদে রেখে নিজেকে বাঁচানোর মতো মানুষ নন তিনি। তিনি সমর্পিত সত্তা। রাসূল তাই তাকে উপাধি দিয়েছিলেন—আমিনুল উম্মাহ। এই উম্মতের বিশ্বস্ত আদমি।

উদ্দেশ্য গোপন রেখে ওমর রাদি. কৌশলে একটি চিঠি লিখলেন।

সালামুন আকাইকা। পর সংবাদ—আপনার সঙ্গে আমার জরুরী একটি প্রয়োজন আছে। এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে আমি মুখোমুখি বসে আলাপ করতে চাচ্ছি। আমার দৃঢ়বিশ্বাস—চিঠি পাওয়া মাত্রই আপনি মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন। চিঠি হাত থেকে মাটিতে রাখা পরিমাণ সময়ও বিলম্ব করবেন না।

চিঠি পড়েই আবু উবায়দা রাদি. বুঝতে পারলেন—মহামারীর এলাকা থেকে তাকে বের করার জন্যই খলিফা এই কৌশল অবলম্বন করেছেন। তিনি জবাবি চিঠিতে লিখলেন—আল্লাহ তায়ালা আমিরুল মুমিনিনকে ক্ষমা করে দিন৷ হে আমিরুল মুমিমিন! আমার সঙ্গে আপনার কী প্রয়োজন, তা বুঝতে পারছি। আমি তো সেনাবাহিনীর সঙ্গে আছি। তাদের বাদ দিয়ে আমি শুধু আমার কল্যানের কথা ভাবতে পারছি না। আল্লাহর চূড়ান্ত ফায়সালা ছাড়া আমি তাদের ছেড়ে যেতে পারব না। সুতরাং আপনার ইচ্ছে পরিত্যাগ করুন। আমাকে সৈন্যদের সঙ্গে থাকতে দিন।

জাবাবি চিঠি পড়ে কেঁদে ফেললেন খলিফা ওমর। তার কান্না দেখে অন্যরাও ভয় পেয়ে গেলো। সবাই জিজ্ঞেস করলো, ‘আমিরুল মুমিনিন, আপনি কাঁদছেন কেন? আবু উবায়দা কি মারা গেছেন?’ খলিফা চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ‘মারা যায়নি; তবে মারা যাবার পথে।’

মহামারী এলাকা থেকে যেহেতু আবু উবায়দা ফিরবেন না, তাকে বিকল্প কোনো পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। ফিরতি আরেকটি চিঠিতে ওমর রাদি. লিখলেন—সালামুন আকাইকা। পর সংবাদ—আপনি একটু নীচু অঞ্চলে অবস্থান করছেন। লোকদের নিয়ে একটু উঁচু অঞ্চলে চলে আসুন।’

খলিফার চিঠি পেয়ে আবু মুসা রাদি.কে ডেকে পাঠালেন আবু উবায়দা। তাকে চিঠি পড়তে দিয়ে বললেন, ‘কী লেখা আছে দেখছেনই তো। আপনি উঁচু ভূমির খোঁজে বেরিয়ে পড়ুন। ভূমি পেয়ে গেলে আমরা সেখানে চলে যাব।’

ভূমির খোঁজে বের হবার আগে আবু মুসা রাদি. বাড়িতে গেলেন। বাড়িতে গিয়ে তিনি এমন দৃশ্য দেখবেন, কল্পনাও করতে পারেননি। তার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। তিনি দেখলেন—তার স্ত্রী প্লেগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। শ্বাস নিতে তার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। শরীরে দেখা দিয়েছে গোটা গোটা টিউমার। আবু মুসা রাদি. সহ্য করতে পারলেন না। স্ত্রীর মুখে মুখ রেখে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখার চেষ্টা করলেন। ফুসফুসে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে তিনি স্ত্রীর ফুসফুসে দিতে চাইলেন প্রাণশক্তি। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর স্ত্রীর শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হলো। তিনি দৌড়ে এলেন আবু উবায়দার নিকট। হন্তদন্ত হয়ে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমার স্ত্রীও আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।’

আবু উবায়দা রাদি. বললেন, ‘তুমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে থাকো৷ আমি ভূমির খোঁজে বের হই।’

এই বলে তিনি উটের পা-দানিতে পা রাখলেন। পা-দানিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও প্লেগে আক্রান্ত হয়ে গেলেন। তিনি যেদিন প্লেগে আক্রান্ত হন, একই দিন প্লেগে আক্রান্ত হন ফিলিস্তিনের আমির শুরাহবিল ইবনে হাসানা রাদি. এবং আবু মালেক আশআরী রাদি.।

মুযাইনা গোত্রের একটি পরিবারে দুর্ভিক্ষের ছোঁয়া লেগেছে। ক্ষুধায় তাদের চেহারা হয়ে গেছে বিবর্ণ। তাদের একটি বকরি আছে। ঘাস না পেয়ে বকরিটি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে কবেই। ক্ষুধার তাড়নায় বেলাল ইবনে হারিস মুযানির নিকট পরিবারের সবাই অনুরোধ করলো—এই বকরিটি জবাই করা হোক। তিনি বললেন, ‘বকরির গায়ে তো কোনো গোশত নেই। জবাই করে কী হবে?’ কিন্তু সবার পীড়াপীড়িতে তাকে বকরিটি জবাই করতে হলো। বকরির গায়ে কোনো গোশত পাওয়া গেলো না। দেখা গেলো গোশত শুকিয়ে হাড্ডিগুলো লাল হয়ে গেছে। বেলাল ইবনে হারিস করুণ এই দৃশ্য দেখে বলে উঠলেন, ‘আয় মুহাম্মদ, আপনি থাকলে কখনো এমন হতো না!’

প্রবল দুঃখ নিয়ে ঘুমাতে গেলেন বেলাল ইবনে হারিস মুযানি। খুব প্রশান্তির ঘুম কবে হয়েছে তিনি ভুলেই গেছেন। ঘুমের স্বভাব একটু রাজকীয় ধরণের। পেটে ভাত থাকলে, বিছানা তুলতুলে হলে—ঘুম দৌড়ে আসে। পেটে ভাত না থাকলে বাবা-খালু ডেকেও ঘুম আনা যায় না। বেলাল ইবনে হারিসও ঘুম ডাকেন, আসে না। তবে আজ ঘুম ডাকতে হলো না। বালিশে মাথা রাখতেই তরতর করে ঘুম চলে এলো চোখে। প্রশান্তিময় ঘুমে তিনি চলে গেলেন স্বপ্নের জগতে। সেখানে রাসূল সা. এর সঙ্গে তার মোলাকাত হলো। রাসূল সা. তাকে বিষণ্ণ দেখে বললেন, ‘জীবনের সুসংবাদ গ্রহণ করো। গ্রহণ করো বেঁচে থাকার সুসংবাদ। তুমি ওমরকে গিয়ে আমার সালাম জানাও। তাকে বলো—আমার সঙ্গে আপনার চুক্তি তো পূর্ণ করতেই হবে। ওই চুক্তি সুদৃঢ়। সুতরাং হে ওমর, বুদ্ধিমত্তার পথ অনুসরণ করুন। বুদ্ধিমত্তার পথ অনুসরণ করুন।’

স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন বেলাল ইবনে হারিস। সে রাতে আর ঘুম হলো না। দু রাকাত নামাজ পড়ে সেজদায় লুটিয়ে তিনি কাঁদলেন। একাকী জায়নামাজ ভেসে গেলো তার চোখের শ্রাবণজলে। যত কাঁদছেন, মনে হচ্ছে বুক থেকে জগদ্দল কোনো পাথর নেমে যাচ্ছে। তিনি হালকা হচ্ছেন। মানুষের যদি কান্না না থাকতো, মানুষ যদি কাঁদতে না পারতো, দুঃখের জমাটবাঁধা মেঘ বুকে বিস্ফোরণ ঘটতো। পৃথিবীর একান্ত ব্যক্তিগত দুঃখগুলো সমাধান হয় কান্নায়।

সকাল সকাল খলিফার দরবারে উপস্থিত হলেন বেলাল ইবনে হারিস। প্রহরীকে বললেন, ‘খলিফাকে বলো—রাসূল সা. এর একজন দূত এসেছেন।’ দূতকে ভেতরে আসার অনুমতি দেয় হলো। রাসূলের দূতের স্বপ্নের কথা শুনে অস্থির হয়ে গেলেন খলিফা ওমর। তিনি ঠিক কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। তড়িঘড়ি করে মিম্বরে উঠে লোকজনকে বললেন, ‘যে মহান আল্লাহ আপনাদেরকে ইসলামের পথ দেখিয়েছেন, তার দোহাই দিয়ে বলছি—আপনারা কি আমার অপছন্দনীয় কোনো আচরণ দেখেছেন?’ লোকজন বললো, ‘কসম! তেমন আচরণ দেখিনি। হঠাৎ এসব কথা কেন বলছেন?’ খলিফা ওমর ইঙ্গিতে বেলাল ইবনে হারিস মুযানিকে দেখিয়ে বললেন, ‘সে এসব বলছে।’ লোকজন বললো, ‘তিনি তো সত্যই বলেছেন। রাসূল সা. আপনার সলাতুল ইসতেসকার বিলম্বের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। আপনি আমাদের নিয়ে সালাতুল ইসতেসকা আদায় করুন।’

ওমর রাদি. চমকে উঠলেন। এরা তো সত্যই বলছে। অদ্ভুত! এতদিনে সালাতুল ইসতেসকার কথা একবারও মাথায় আসেনি! ওমর রাদি. সূরা নূহের দশ-এগারো নং আয়াত তেলাওয়াত করলেন। তার অর্থ—’সুতরাং আমি বলছি, তোমরা তোমাদের রবের নিকট ক্ষমা চাও। তিনি সর্বদা পরম ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষণ করবেন।’

লোকসকল! ভেতর-বাহির সবক্ষেত্রেই আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ তায়ালা আমাকে তোমাদের মাধ্যমে, তোমাদেরকে আমার মাধ্যমে পরীক্ষা নিবেন। আমি জানি না—আল্লাহর অসন্তুষ্টি আমার ওপর পতিত হয়েছে নাকি তোমার ওপর। এই অসন্তোষ আমাদের সকলের ওপর। চলো আমরা সবাই মিলে আল্লাহর কাছে দোয়া করি—তিনি যেন আমাদের রহম করেন, সংশোধন করেন। সর্বোপরি এই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।’

ওমর রাদি. সিদ্ধান্ত নিলেন, সালাতুল ইসতেসকা আদায় করবেন। সমস্ত গভর্নর এবং অফিসারদের প্রতি লিখিত নির্দেশ জারি করলেন—সবাই যেন অমুক দিন মাঠে উপস্থিত হয়ে আল্লাহ তায়ালার নিকট কান্নাকাটি করে, বৃষ্টির প্রার্থনা করে। নির্ধারিত দিনে ওমর রাদি. সালাতুল ইসতেসকার জন্য বের হলেন। সযতনে পকেটে পুরে নিলেন রাসূল সা. এর একটি চাদর। মাঠে এসে তিনি সবার সামনে খুতবা দিলেন। নামাজ পড়ালেন। নামাজের পর লোকজন বৃষ্টির প্রার্থনায় রোনাজারি শুরু করলো। ওমর রাদি. মগ্ন রইলেন তাওবা-ইসতেগফারে। যখন ফিরবার সময় হলো, তিনি দু হাত উঁচু করে রাসূল সা. এর চাদর ডানে-বায়ে দোলাতে লাগলেন।

চাদর দোলানো শেষ করে ওমর রাদি. দোয়ায় হাত তুললেন। প্রবল কান্নায় ভিজে গেলো তার দাড়ি। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ! রাসূল সা. এর উসিলা দিয়ে তোমার নৈকট্য চাইতাম। আজ রাসূলের চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব রাদি.-এর উসিলায় তোমার নৈকট্য চাইছি। বৃষ্টি দিয়ে তুমি আমাদেরকে পরিতৃপ্ত করো।’

আব্বাস রাদি. এর চোখ দিয়েও অশ্রু ঝরছিলো। দোয়ায় হাত বাড়িয়ে তিনি বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ! গুনাহের কারণে বিপদ আসে। তাওবার কল্যানে তার সমাপ্তি ঘটে। আপনার নবির সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কের খাতিরে তারা আমার উসিলায় আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। গুনাহে রঙিন আমার এ হাত আপনার সামনে বাড়িয়েছি, তাওবায় আমাদের কপাল আপনার কদমে সমর্পিত। আপনি বৃষ্টি দিয়ে আমাদেরকে পরিতৃপ্ত করুন। হে রহমানুর রহিম! আমাদেরকে আশাহত করবেন না। হে আল্লাহ! লোকদের বৃষ্টি দিন, রহমতের বৃষ্টি। নিরাশ করে তাদের ধ্বংস করে দিয়েন না।’

দোয়া শেষ হতেই আকাশে মেঘ জমতে শুরু করলো। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো সূর্য। লোকজন যার যার জায়গা থেকে নড়েনি। তার আগেই ঝপঝপ করে নেমে এলো বৃষ্টি। মানুষ ইচ্ছেমতে পরিতৃপ্ত হলো সেই বৃষ্টিতে। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় তারা অনুভব করছিলো রহমতের স্পর্শ, ঐশী ভালোবাসার ছোঁয়া।

করুণ এই দুর্ভিক্ষের দিনে ওমর রাদি. দুটো জিনিস রহিত করে দিয়েছিলেন। এক—চুরির শাস্তি। কারণ, এই সময় কেউ চুরি করার জন্য চুরি করতো না, চুরি করতো প্রাণ বাঁচানোর দায়ে। দুই—এ বছরের যাকাতও রহিত করে দিয়েছিলেন৷ বলেছিলেন, ‘এ বছরের যাকাত সামনে বছর নেয়া হবে।’

সামিরার মন কু ডাক ডাকছে। তার মন যখন কু ডাক ডাকে, তখন অদ্ভুত ভয়ংকর সব চিন্তা মাথায় আসে। এই যেমন এখন তার মাথায় ঘুরছে—আবু সালেহ রোমানদের হাতে বন্দী। তাকে খেতে দেয়া হচ্ছে না। দিনে একবার একটি রুটি দেয়া হয়। রুটির সঙ্গে সিরকা নেই। খালি রুটি খেতে গিয়ে আবু সালেহ তার কথা ভাবছে। বাড়ি থাকলে আমি তাকে রুটি কখনো খালি খেতে দিতাম না। সঙ্গে রান্না করে দিতাম গোশত, কিংবা ভেজে দিতাম ঘিয়ে।

আবার মনে হচ্ছে—নাহ। আবু সালেহ বন্দী হয়নি। শত্রুর তীর বুকে নিয়ে ছটফট করছে। তীব্র ব্যথা এবং যন্ত্রণা। সামিরার কথা মনে করে আবু সালেহ সেই ব্যথা ভুলে থাকবার চেষ্টা করছে। মনে করবার চেষ্টা করছে সুন্দর সব স্মৃতিগুলো। জোছনা ধোয়া রাত। তারা প্রথম এই কুফায় এসেছে। ঘর এখনো বানানো হয়নি। ছনের ছাউনিটা পূর্ণ হয়নি এখনো। তারা দুজন শুয়ে আছে পাটি বিছিয়ে। অপূর্ণ ছনের ছাউনির ফাঁক গলে তাদের দুজনের গায়ে এসে পড়ছে জোছনা। আবু সালেহ ডাকলো, ‘সামিরা।’
সামিরা বললো, ‘হুম।’
‘এই প্রবল জোছনায় তোমাকে দেখে ঈর্ষা হচ্ছে।’
‘কেন?’
‘তোমার সৌন্দর্যের কারিশমা দেখে।’
‘শুধু ঈর্ষা হচ্ছে?’
‘উহু।’
‘তো?’
‘গর্বও হচ্ছে।’
ঠোঁট বাঁকা করে সামিরা বললো, ‘রহস্যটা কী?’
‘সবাই সুন্দরের কাছে যেতে পারে না। সৌন্দর্য সবার হাতে ধরাও দেয় না। আমি যেতে পেরেছি। সৌন্দর্য আমার হাতে ধরাও দিয়েছে। কষ্ট করতে হয়নি। গর্ব করার জন্য এতটুকু রহস্য যথেষ্ট না?’

সামিরা উত্তর দেয় না। উবু হয়ে ঝুঁকে আবু সালেহের চোখে চোখ রাখে। আবু সালেহের গায়ের রং কৃষ্ণ হলেও তার চোখের মণি স্বর্গীয় সুন্দর। সামিরার বাবা যখন তার কাছে আবু সালেহের বর্ণনা দিচ্ছিলো, চোখের মণিটার কথা উল্লেখ করেছিলো। বলেছিলো, মানুষের চোখ দেখে তার ভেতর পড়া যায়। চোখ হচ্ছে মানবদেহের আয়না। কেউ যখন কোনো কথা লুকায়, অনৈতিক কোনো কাজে জড়িয়ে পড়ে, তার চোখে লেখা থাকে। কেউ যখন পবিত্র কোনো কাজ করে, তার দ্যুতিও টের পাবি চোখে। ভালোবাসায় সবচে বেশি কথা বলে চোখ।

সামিরা বললো, ‘খুব প্রেমময় একটা ছবি দেখছি।’
আবু সালেহ বললো, ‘কোথায়।’
‘তোমার চোখে।’
‘মানে?’
‘আমি যে উবু হয়ে আছি, তোমার চোখের মণিতে আমাকে দেখা যাচ্ছে।’
‘বাহ। এই প্রমময় ছবিটা আমি কখনোই দেখতে পাব না।’
‘সব সুন্দর দেখতে নেই। কিছু সুন্দর দৃশ্য দেখার ক্ষমতা আল্লাহ সব মানুষকে দেননি। এই দৃশ্যটা তেমন।’
আবু সালেহ বললো, ‘হুম।’
সামিরা বললো, ‘জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার চোখের মণিতে আমাকে দেখে যেতে চাই।’

সামিরার ভাবনায় ছেদ পড়লো প্রচণ্ড আঘাতে। আঘাত করেছে গর্ভের সন্তান। আর কিছুদিন পরই সে পৃথিবীতে আসবে। বড় যে হচ্ছে, তার জানান দিচ্ছে। আঘাতে দাঁড়ানো থেকে একদম বসে গেলো সামিরা। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এলো খাদেমা। সামিরার পিঠে ঠেস দিয়ে তাকে শোয়াতে শোয়াতে বললো, ‘আপনারে কতদিন বলছি—এইভাবে এতক্ষণ দাঁড়ায় থাকবেন না। আপনি তো আমার কোনো কথা শুনেন না।’
সামিরা বললো, ‘এইতো দাঁড়ালাম।’
খাদেমা বললো, ‘এইতো মানে আধাঘণ্টা। কতক্ষণ ধরে দেখছি। দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া কী যেন ভাবেন।’
সামিরা বললো, ‘বুঝতে পারিনি।’
খাদেমা বললো, ‘জানি—ভাইয়ের কথা ভাবতেসেন। সবাই ফিরা এলে, ভাই কেন ফিরলো না।’
সামিরা বললো, ‘লোকটার কী হলো। তার সঙ্গে নাকি সেনা আছে। তারাও আসতেসে না।’
খাদেমা বললো, ‘বিশেষ কাজে আটকে গেছে। আসবো আসবো। এত দুশ্চিন্তা করলে হবে?’
সামিরা বললো, ‘কেউ ইচ্ছে করে কখনো দুশ্চিন্তা করে না। অনাহুত মেহমানের মতো না চাইলেও এসে পড়ে।’

সামিরা এতদিন একাই থাকতো। গর্ভের সন্তানের বয়স বাড়ায় একজন খাদেমা রেখেছে। তার নাম জুওয়াইরিয়া। মেয়েটি যেমন চঞ্চল, তেমন দুঃখী। কাজে নিয়োগের সময় দুঃখের গল্প শোনা হয়নি। নিজের ঘরে দুঃখের গল্প না থাকলে তো কেউ অন্যের ঘরে কাজ করতে যায় না। সামিরা একদিন বললো, ‘জুওয়াইরিয়া, তোর দুঃখের কাহিনীটা কী, বলতো!’

খাদেমা বললো, ‘আপনারই তো দুঃখের অভাব নাই। আমার দুঃখের কাহিনী শুনে কী করবেন?’

সামিরা বললো, ‘নিজের দুঃখ থাকা সত্ত্বেও অন্যের দুঃখে কাতর হওয়ার নাম দুঃখবিলাস। আমি দুঃখবিলাস করবো।’

খাদেমা বললো, ‘আমার স্বামী বড় একজন ব্যবসায়ীর দোকানে কাজ করতো৷ ব্যবসার প্রয়োজনে তাকে বিভিন্ন অঞ্চল ঘুইরা বেড়াইতে হইতো। সেবার মালিক তারে পাঠাইলো শামে। কে জানতো শামে রোগ ছড়াইবো। মানুষ মইরা তামা তামা হইবো। শামে যখন রোগটা ছড়ায় পড়লো, ব্যবসায়ীর একটা দল শাম ছাইড়া বাড়ির পথ ধরলো। কিন্তু পালাইতে চাইলে কি আর পালাইতে পারে? কপালে থাকতে হয়। একশজনের সেই দলের সঙ্গে আমার স্বামীও ছিল। তারা শাম থেকে বের হইসে ঠিক, শরীরে রোগ ঢুকে গেছিলো আগেই। পথে সবাই মইরা গেলো। বসরা যাইতে পারলো মাত্র চারজন। সেই চারজনের একজন আমার মামা। তিনিই আইসা আমারে খবর দিলেন। আমি বিধবা হইলাম।’
সামিরা বললো, ‘তোর ভাইও তো শামে। তাইতো চিন্তা করি এত।’
খাদেমা বললো, ‘আল্লায় বাচাইলে কেউ মরে না।’
সামিরা বললো, ‘তোর স্বামী তোকে খুব ভালোবাসতো?’
খাদেমা বললো, ‘সে ঘরে থাকছে, আর আমারে ছাড়া একা খাইসে, এমন কখনো হয় নাই। আমার পেট ভরা থাকলে সে আমারে এক লোকমা হইলেও খাওয়াই দিসে।’
সামিরা বললো, ‘বেশি ভালোবাসলে মানুষের আয়ু কমে যায়। তাই অল্প ভালোবাসা উচিত।’

আবু সালেহের সঙ্গে থাকা সৈন্যদলটি কুফায় ফিরেছে। তাদের কেউ আক্রান্ত হয়নি। তারা সাদ রাদি. এর কাছে আবু সালেহের চিঠি হস্তান্তর করেছে। চিঠি পড়ে সাদ রাদি. বিমর্ষ হয়ে গেছেন৷ তবে আরও একটি খবর তার বিমর্ষতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। শামের সেনাপতি আবু উবায়দা রাদি. প্লেগে আক্রান্ত।
সাদ রাদি. ভাবেন, আবু উবায়দা যখন মদীনায় হিজরত করেন, রাসূল সা. সাদ ইবনে মুআজের সঙ্গে তার ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দিয়েছিলেন৷ তিনি সাদ ইবনে মুআজ, আমি সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস। দুজনের নাম একই। উহুদ যুদ্ধে রাসূল সা. এর মুখে বর্মের আংটা ঢুকে গিয়েছিলো। আবু উবায়দা তার দাঁত দিয়ে কামড়ে আংটা বের করেছিলেন। আংটা বের করতে গিয়ে তার সামনের দুটো দাঁত পড়ে গিয়েছিলো।
সাদ রাদি. বললেন, ‘আবু উবায়দার কোন জিনিসটা সবচে সুন্দর জানো?’
সৈন্যরা বললো, ‘তরবারি চালনা?’
সাদ রাদি. বললেন, ‘সবচে সুন্দর তার হাসি। সামনের দন্তহীন আর কোনো ব্যক্তিকে এত সুন্দর করে হাসতে দেখিনি।’

সাদ রাদি. দুজন সৈন্যকে দায়িত্ব দিলেন চিঠি সামিরার বাড়িতে পৌঁছে দিতে। সঙ্গে হাদিয়া হিসেবে প্রয়োজনীয় জিনিস বোঝাই করা একটি উট পাঠালেন। সৈন্যদের থেকে চিঠি গ্রহণ করলো খাদেমা। আড়াল থেকে সামিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘তিনি কোথায়?’ একজন সৈন্য বললো, ‘প্লেগে তিনি ইনতেকাল করেছেন। শামেই তাকে কবর দেয়া হয়েছে। তারা জানাযার নামাজের ইমামতি করেছেন বিখ্যাত সাহাবি আবু উবায়দা রাদি.। ইন্তেকালের পূর্বে আবু সালেহ একটি চিঠি লিখে গেছেন। আর সাদ রাদি. এই উট হাদিয়া দিয়েছেন।’
আবু সালেহের মৃত্যুর খবর শুনে সামিরা এক ফোঁটাও কাঁদলো না। আসলে কান্নার শক্তি-ই ছিলো না। বজ্রাহতের মতো সে পাথর হয়ে গেলো। মনে হলো থেমে গেছে পৃথিবী। থেমে গেছে পৃথিবীর আলো-বাতাস সব। সামিরা বোবা হয়ে গেলো। তার মুখ থেকে একটি শব্দও বেরুলো না। চিঠি ধরা রইলো তার হাতে। এই চিঠি খোলার সাহস তার কোনদিন হবে কিনা, তাও সে জানে না।

আবু মুসা রাদি. এর স্ত্রী ইনতেকাল করেছেন। তাকে দাফন করে সোজা আবু উবায়দার কাছে এসেছেন তিনি। শোক পালন করার সময় নেই এখন। একজনকে দাফন করে আরেকজনের জানাযার নামাজ পড়তে যেতে হয়। আবু উবায়দা রাদি. এর ফোঁড়ায় ব্যথা বেড়েছে। তিনি সবাইকে ডেকেছেন। তাকে ঘিরে সবাই বসে আছে। সবার চাতক দৃষ্টি তার দিকে। যে সিংহ যুদ্ধের ময়দানে হুংকার ছুঁড়ে শত্রুর হৃদয়ে কাঁপন তুলেছেন, যে সেনাপতি শহরের পর শহর জয় করে উড়িয়েছেন বিজয়ের কেতন, সে তিনি এখন সামান্য একটা ফোঁড়ার ব্যথায় কাতর হয়ে আছেন। শুধু তিনি নন, পুরো শামই কাতরাচ্ছে মৃত্যুর বিছানায়।

আবু উবায়দা রাদি. একজনের কাঁধে ভর দিয়ে বিছানায় উঠে বসলেন। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে কিছু নসিহত করতে চাই। এগুলো মানতে পারলে দুনিয়া এবং আখেরাতে শান্তি এবং নিরাপত্তার সঙ্গে থাকতে পারবে। নামাজ কায়েম করো, যাকাত আদায় করো, রোজা রাখো, দান-সদকা করো, হজ-ওমরা পালন করো, পরস্পর সৌহার্দ্য এবং ভালোবাসা অটুট রাখো, শাসকের সঙ্গে সত্য বলো, তাদের বিভ্রান্ত করো না। মনে রেখো—দুনিয়ার ফাঁদে পড়ে উদাসীন হয়ো না। যত দীর্ঘ হায়াত-ই পাও, মৃত্যুর চৌকাঠ একদিন মাড়াতে হবেই, যেমন আমি মাড়াচ্ছি। আল্লাহ সবার কপালেই মৃত্যু লিখেছেন, নিঃসন্দেহে সবাইকে মরতে হবে। সবচেয়ে বুদ্ধিমান সে, আল্লাহর প্রতি সবচেয়ে বেশি যে অনুগত, যে আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহে মনোযেগী।’

আবু উবায়দা রাদি. এর গলা ধরে এলো। যেন তিনি বড্ড ক্লান্ত। তার চোখের দিকে তাকালে নিভু নিভু সলতের কথা মনে হয়। তার নসিহত শুনে অনেকের চোখেই জল চলে এসেছে। সবাই বুঝে গেছে—আর বেশিক্ষণ তিনি থাকবেন না। জীবন নৌকা পরপারের ঘাটে ভীড়ে গেছে। একটু পরই পাল তুলে দিবেন।
মুআজ ইবনে জাবাল রাদি. পাশেই বসে ছিলেন। নামাজের সময় হয়ে এসেছে। তার হাত ধরে আবু উবায়দা রাদি. বললেন, ‘মুসল্লিদের নামাজ পড়াও।’ মুআজ রাদি. নামাজ পড়ালেন। সেই নামাজের দৃশ্য দেখতে দেখতে আবু উবায়দা রাদি. সবুজ পাখি হয়ে জান্নাতে উড়ে গেলেন।

চারদিকে সাড়া পড়ে গেলো—আবু উবায়দা রাদি. আর নেই। রোজকার মৃত্যুর খবরের চেয়ে এ খবর দারুণ বেদনাদায়ক। দিগ্বিজয়ের নায়ক একজন সিপাহসালারের মৃত্যু হলো আজ। সবাই জড়ো হতে লাগলো মসজিদে। মুআজ রাদি. শোকাহত জনতার সামনে আবেগঘন একটি ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন—
উপস্থিত মুসলিম ভাইয়েরা! খাঁটি হৃদয়ে আল্লাহর কাছে তাওবা করো। খাঁটি তাওবা নিয়ে যে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে, তিনি অবশ্যই তাকে ক্ষমা করে দিবেন। ঋণদাতার ঋণ আদায় করো, বাকি রেখো না। রাতে কারো সঙ্গে মনোমালিন্য হলে সকালেই সব মিটমাট করে ফেলো। তার সঙ্গে মুসাফাহা করো। তিনদিনের বেশি সম্পর্ক ছিন্ন করে রাখা কোনো মুসলমানের জন্য জায়েয নেই।

মুসলিম ভাইয়েরা! আজ তোমরা এক মহান ব্যক্তিকে হারিয়েছো। আল্লাহর কসম! তারচেয়ে বড় নরম হৃদয়, স্বচ্ছ দিল, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূর, উম্মাহর কল্যানকামী আর কাউকে দেখিনি। তোমরা তার জন্য রহমতের দোয়া করো। জানাযার নামাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। আল্লাহ তায়ালা তার সমস্ত গোনাহ মাফ করে দিন। আল্লাহর কসম! তোমাদের নিকট তার মতো আর কোনো শাসক আসবে না।’

মুআজ রাদি. কি শোকাহত জনতার শোক আরও উসকে দিলেন! তার বয়ান শোনার পর আর কেউ চোখের জল আটকে রাখতে পারলো না। এতদিন জানাযার নামাজ পড়াতেন আবু উবায়দা। আজ তার জানাযার নামাজ পড়তে উপস্থিত সবাই। কাতার বেঁধে সবাই দাঁড়িয়ে গেলো। পিনপতন নীরবতা। কারও মুখে শব্দ নেই। মুআজ রাদি. সামনে এগিয়ে জানাযার নামাজ পড়ালেন৷ আবু উবায়দাকে কবরে নামানোর জন্য কবরে নামলেন মুআজ, আমর ইবনে আস, যাহহাক ইবনে কায়েস। আমিনুল উম্মাহকে মাটিতে সোপর্দ করে তারা উপরে উঠে এলেন। বিসমিল্লাহি ওয়ালা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহর গুঞ্জন উঠলো। কবরে পড়তে লাগলো ঝুরঝুর মাটি। মাটির নীচে অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগলেন শামের সিপাহসালার।

একটু একটু করে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আবু উবায়দার দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মুআজ ইবনে জাবাল। বিড়বিড় করে বলছেন, হে আবু উবায়দা! আপনার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। আল্লাহর কসম! আপনার সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি, ততটুকু প্রশংসা করবো। কখনো মিথ্যা প্রশংসা করবো না। ভয় করে—মিথ্যা বললে আল্লাহর আজাব আমার টুটি চিপে ধরবে। হে আবু উবায়দা! আমরা জানি—আপনি আল্লাহকে সবচে বেশি স্মরণ করতেন। পথ চলতেন বিনীত হয়ে। জাহেলদের সঙ্গে তর্ক করতেন না, তাদের ক্ষমা করতেন। রাত কেটে যেত আপনার সেজদায়-কিয়ামে। কখনো আপনি অপচয় করতেন না, আবার কৃপণতাও করতেন না। মিতব্যয়িতা অবলম্বন করতেন। আমি জানি—বিনয়প্রিয়, এতিম এবং মিসকিনদের প্রতি রহম করতেন। নির্দয় এবং অহংকারীকে ঘৃণা করতেন।’

আবু উবায়দা রাদি. মৃত্যুতে সবচে বেশি আঘাত পেয়েছিলেন মুআজ ইবনে জাবাল রাদি.। আবু উবায়দার যাবতীয় দায়িত্ব এসে বর্তায় তার ওপর। তিনি খলিফা ওমর রাদি. এর নিকট একটি চিঠি লিখেন—

পরসংবাদ—যে ব্যক্তি আমিনুল্লাহ ছিলেন, তার ওসিলায় আল্লাহ তায়ালার নিকট সাওয়াব প্রত্যাশা করছি। তিনি আল্লাহকে বড্ড ভালোবাসতেন। হে আমিরুল মুমিনিন! তিনি আমার এবং আপনারও অনেক প্রিয় ছিলেন। আমি আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাদি. এর কথা বলছি। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন। তিনি ইনতেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমরা বিশ্বাস করি—আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে তিনি একজন নেককার। আল্লাহর প্রতি আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস—তিনি তাকে ভালো রাখবেন।

এমন এক সময় আমি আপনার নিকট চিঠি লিখছি, যখন মৃত্যু এবং মহামারী হাত ধরাধরি করে চলছে। কে কখন মারা যাবে, কেউ বলতে পারবে না। এখন যে জীবিত, একটু পরই তার জানাযার জন্য ছুটতে হতে পারে। আল্লাহ যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাই কল্যানকর। তিনি জীবিত রাখেন কিংবা মৃত্যু দান করেন, আশা করছি তিনি কল্যানই দান কবেন। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।’

মুআজ রাদি. এর চিঠি পড়ে কান্না শুরু করলেন ওমর রাদি.। প্রিয় আবু উবায়দা আর নেই—এটুকু ভাবতেই বুকভেঙে উথাল-পাতাল শুরু হলো। চোখে নামলো অশ্রুর প্লাবন। কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি সবাইকে শোকসংবাদ শোনালেন। এই সংবাদ যে শুনলো, সেই কান্না করলো। শোকের আবহাওয়ায় পরিবেশ ভারী হয়ে উঠলো।

আবু উবায়দা রাদি. এর মৃত্যুর পর নামাজ পড়াচ্ছেন মুআজ রাদি. নিজেই। এদিকে ভয়ংকরভাবে বাড়ছে প্লেগের প্রকোপ। মৃত্যু বেড়েছে আশঙ্কাজনকহারে। ঘর-বাড়ি, গ্রাম-শহর বিরান হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই। ভয়ে সবাই কুঁকড়ে আছে। মারা গেছেন ফিলিস্তিনের আমির শুরাহবিল ইবনে হাসানা। রাসূল সা. এর চাচাত ভাই ফজল ইবনে আব্বাস। আবু জান্দাল ইবনে সুহাইল। ইয়াজিদ ইবনে সুফিয়ান। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে কাতরাচ্ছেন হারিস ইবনে হিশাম। মনোবল ভেঙে গেছে মানুষের। মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুণছে সবাই।

একদিন আমর ইবনুল আস রাদি. মুআজ রাদি.কে বললেন, ‘আমাদের উচিত এ স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়া। এ রোগ নয়, এ যেন আগুন।’

তাঁর এ কথায় হযরত মুআজ রাদি. দারুণ অসন্তুষ্ট হলেন। নামাজ শেষে সকলকে সম্বোধন করে একটি ভাষণ দিলেন। ভাষণের মধ্যে তিনি বলেন, ‘লোকসকল! এই রোগ তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতিপালকের রহমত। তোমাদের নবির দোয়ার বরকত। তোমাদের পূর্ববর্তী নেককারদের মৃত্যুর কারণ। আমি রাসূলুল্লাহর সা. বলতে শুনেছিলাম, মুসলমানরা শামে হিজরত করবে। শাম ইসলামী পতাকাতলে আসবে। সেখানে একটি রোগ দেখা দেবে যা ফোঁড়ার মত হয়ে শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি করবে। কেউ তাতে মারা গেলে শহীদ হবে। তার সকল আমল পাক হয়ে যাবে। হে আল্লাহ, যদি আমি একথা রাসূলুল্লাহর সা. মুখ থেকে শুনে থাকি তাহলে এই রহমত আমার ঘরেও পাঠাও এবং আমাকেও তার যথেষ্ট অংশ দান কর।’

সেদিন বাড়ি ফিরে মুআজ রাদি. দেখলেন, তার ছেলে আবদুর রহমান প্লেগে আক্রান্ত হয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। তীব্র যন্ত্রণায় তার চোখ-মুখ বিবর্ণ। ছেলের করুণ এই দৃশ্য দেখে তিনি বললেন, ‘তোমার রব যা বলেছেন, তাই সত্যি। সুতরাং কখনো তুমি সন্দেহপ্রবণ হবে না।’ (সূরা বাকারা:১৪৭)। ছেলের কপালে হাত রেখে তিনি বললেন, ‘ইন শা আল্লাহ! আমাকে তুমি ধৈর্যশীল হিসেবেই পাবে।’ (সূরা সাফফাত, ১০২)

মুআজ রাদি. জানেন, তার সান্ত্বনায় ব্যথা কমবে না। তবুও তিনি সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ছেলের কপালে হাত বুলাচ্ছেন। আরামের জন্য মাথার চুলগুলো আলতো করে টেনে দিচ্ছেন। তবে বেশিক্ষণ তাকে সান্ত্বনা দিতে হলো না। তার ছেলের প্রাণপাখি উড়ে গেলো। তিনি তাকিয়ে রইলেন। কদিন আগে মৃত্যুবরণ করেছে তার স্ত্রী। এখন মৃত্যুবরণ করলো তার ছেলে। এবার সত্যি তিনি বড্ড একা হয়ে গেলেন।

ছেলেকে দাফন করে যখন তিনি ঘরে ঢুকলেন, দেখলেন তার ডানহাতের শাহাদাত আঙুলে একটি ফোঁড়া বেরিয়েছে। ব্যথা করছে। ব্যথা ক্রমশ বাড়ছে। তবে এই ব্যথায় তিনি একটুও নাখোশ হলেন না। বরং বললেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে আমার ব্যথায় ব্যথিত কর। আমি যে তোমাকে কত ভালোবাসি তা তুমি ভালোই জান।’

মুআজ রাদি.কে দেখতে একের পর এক লোকজন আসছে। তিনি তাদের সবাইকে বলছেন, ‘তোমরা আমল করো। যতটুকু হায়াত বাকি আছে, তা ফুলে-ফলে ভরিয়ে তুলো। এমন একদিন আসবে, আমল করতে ইচ্ছে করবে, কিন্তু সুযোগ পাবে না। মৃত্যুর পূর্বেই সামর্থ্যনুযায়ী দান করো। সৎকর্মকেই পরবর্তীদের মিরাস হিসেবে রেখে যাও। মনে রেখো—যতটুকু সম্পদ তুমি খাবে, পরবে, খরচ করবে, ততটুকুই তোমার। বাকিটুকু মিরাস। ‘
কথা বলতে বলতে মুআজ রাদি. এর ব্যথা প্রচণ্ড বেড়ে গেলো। ব্যথার তীব্রতায় তিনি বলতে লাগলেন, ‘আয় আল্লাহ! অতিদ্রুত আমার প্রাণটা বের করে নিন। আমি বিশ্বাস করি—আমার সঙ্গে আপনার মহব্বতের রসায়ন আপনি ভালো করেই জানেন।’

রাত নেমেছে। তীব্রমাত্রায় বেড়েছে মুআজ রাদি. এর ব্যথা। বারবার চেতনা হারাচ্ছেন৷ চেতনা ফিরলেই জিজ্ঞেস করছেন, সকাল হয়েছে? সকাল হয়নি বললেই চুপ হয়ে যান। চোখ মুদে ফেলেন৷ এই রাত যেন কাটছেই না। রবারের মতো কেবল লম্বা হচ্ছে। দুঃখ আর যন্ত্রণার রাতগুলো এত দীর্ঘ হয় কেন? মুআজ রাদি. আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘সকাল হয়েছে?’ সকাল হয়নি তখনো। সুবহে কাজিব দেখা যাচ্ছে। রাত পেরুলেই যেন তীব্র যন্ত্রণার অবসান ঘটবে।

অবশেষে সকাল হলো। মিনারে মিনারে বেজে উঠলো ফজরের আজান। মুআজ রাদি.কে বলা হলো, ‘সকাল হয়েছে।’ সকাল হয়েছে শুনেই তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। ব্যথাক্লিষ্ট মুখে ফুটলো মৃদু হাসি। তিনি বললেন, ‘এমন রাত থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই, যার প্রভাত জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। স্বাগতম মৃত্যু, স্বাগতম। তুমি সেই বন্ধুর কাছে এসেছ যে একেবারে রিক্ত ও নিঃস্ব। ইয়া ইলাহী, আমি তোমাকে কতটুকু ভালোবাসি তা তুমি জান। আজ তোমার কাছে আমার বড় আশা। আমি কখনও দুনিয়া এবং দীর্ঘ জীবন এই জন্য কামনা করিনি যে তা বৃক্ষ রোপণ ও নদী খননে ব্যয় করবো; বরং যদি কামনা করে থাকি, তবে তা এ জন্য, যাতে প্রচণ্ড গরমে মানুষের তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারি, উদারতা ও দানশীলতার প্রসার ঘটাতে এবং জিকিরের মজলিসসমূহে আলেমদের সাথে বসতে পারি।’

এই বলে মুআজ রাদি. কান্নায় ভেঙে পড়লেন। লোকজন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘আপনি রাসূল সা.-এর সাহাবী, উঁচু মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তি। আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বললেন, ‘আমার না আছে মরণ ভয়, আর না আছে দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ। তবে আমার জানা নেই—আমি জান্নাতে যাব নাকি জাহান্নামে। এই ভয়েই আমি কাঁদছি।’

মুআজ ইবনে জাবাল রাদি. ইন্তেকাল করলেন। তার জানাযার নামাজ পড়ালেন আমর ইবনুল আস রাদি.। তাকে কবরে রেখে আমর ইবনুল আস যখন উপরে উঠে এলেন, তিনি বললেন, ‘মুআজ! আল্লাহ তায়ালা আপনার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। আমরা জানি—আপনি মুসলমানদের কল্যানকামী ছিলেন। আপনি অপরাধীর জন্য শক্ত-কঠোর এবং মুমিনদের জন্য নরম-হৃদয় ছিলেন।’

আবু উবায়দা এবং মুআজ ইবনে জাবাল রাদি.-এর ইনতেকালের পর শামের ইসলামি সেনাবাহিনীর দায়িত্ব চলে এলো আমর ইবনুল আস রাদি. এর হাতে। মহামারী প্লেগের সংক্রমণ রোধে এতদিন মনে মনে তিনি যে পরিকল্পনার কথা ভাবছিলেন, তা বাস্তবায়নের সুযোগ এসে গেলো। দায়িত্ব হাতে পেয়ে তিনি বিলম্ব করলেন না। বিলম্ব করার কোনো সুযোগও ছিল না। ততদিনে শামের বিশ হাজারের বেশি লোক প্লেগের নির্মম শিকারে পরিণত হয়ে গেছে। এ সংখ্যা আর বাড়তে দেয়া যায় না।

আমর ইবনুল আস ঘোষণা দিলেন—মহামারী সংক্রমণ রোধে বসতি ছেড়ে সবাই পাহাড়ে চলে যান। আশা করছি এতে মহামারীর প্রকোপ কমবে।

ঘোষণা দিয়ে তিনি নিজেও পাহাড়ে চলে গেলেন। বসতি ছেড়ে লোকজন বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন পাহাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। এতে সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুর হাহাকার কমতে লাগলো। আমর ইবনুল আস খলিফা ওমরের নিকট একটি চিঠি পাঠালেন। তাতে লিখলেন—সালামুন আলাইকা। আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করছি, যিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নাই। পরসংবাদ—মুআজ ইবনে জাবাল রাদি. ইনতেকাল করেছেন। মহামারীতে মৃত্যু তীব্রভাবে বেড়েছে। সংক্রমণ রোধে লোকজনকে আমি বসতি ছেড়ে পাহাড়ে চলে যেতে বলেছি। আমি খুব ভাল করেই জানি এবং বিশ্বাস করি—বসতিতে অবস্থান করলেই মৃত্যু বরণ করবে এমন নয়। আবার বসতি ছেড়ে গেলেই মৃত্যু থেকে বেঁচে থাকবে এমনও নয়। ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।

আমর ইবনুল আসের চিঠি পড়েই ওমর রাদি. জানতে পারেন—মুআজ রাদি. আর নেই। ওমর রাদি. বিমর্ষ হয়ে গেলেন। একের পর এক প্রিয়তম মানুষগুলো চলে যাচ্ছে। মহামারী কত মানুষের কত প্রিয়জন নিয়ে গেছে, তার হিসেবও নেই। তিনি সবাইকে শোকসংবাদ শুনিয়ে বললেন, ‘আল্লাহ তায়ালা মুআজের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। তার মৃত্যু দিয়ে তিনি এই উম্মতের ইলমের বিশাল অংশ তুলে নিয়ে গেলেন। প্রায় সময় তিনি যে পরামর্শ দিতেন, তা আমরা কবুল করে নিতাম। দেখতাম—তার পরামর্শেই উপকার হচ্ছে বেশি। তার ইলম আমাদেরকে উপকৃত করেছে, কল্যানের দিকে রাহনুমায়ি করেছে। আল্লাহ তায়ালা তাকে নেককারদের প্রতিদান দান করুন।’

১০

আমওয়াস মহামারীতে শামের বড় বড় সেনাপতি এবং জেনারেলগণ মৃত্যুবরণ করায় ওমর রাদি. দারুণ উদ্বিগ্ন ছিলেন। সংক্রমণ রোধ হলে শামের কয়েকজন অফিসার চিঠি লিখে জানালো, শামে মৃতদের মিরাস বণ্টন নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের ওপর এতবড় ঝড় বয়ে গেছে, তাদেরকে একটু দেখে আসারও দরকার। ওমর রাদি. মজলিসে শূরার সঙ্গে পরামর্শে বসলেন। সবার সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি শামে যাবেন। সেখানের নাগরিকদের মিরাস সম্পর্কিত জটিলতা নিরসন করবেন। প্রশাসন ব্যবস্থাকেও সাজিয়ে তুলবেন।

ওমর রাদি. শামে এলেন। এবার তাকে অভ্যর্থনা জানাতে আবু উবায়দা এলেন না, এলেন না মুআজ ইবনে জাবাল, ইয়াজিদ ইননে সুফিয়ান, শুরাহবিল ইবনে হাসানা। কেউ এলেন না। তবে তাদের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন ওমর নিজেই। তাদের স্মৃতি বুকে নিয়ে মৃতদের মিরাস বণ্টন করলেন সুষমভাবে। যুদ্ধের জন্য গড়ে তুললেন সেনাবাহিনী, বন্ধ করে দিলেন শামের সীমান্ত। আব্দুল্লাহ ইবনে কায়েসকে প্রত্যেক জেলার উপকূলবর্তী এলাকার অফিসার নিয়োগ করলেন। মুআবিয়াকে বানালেন দামেশকের গভর্নর। আবার নতুন করে শামে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করলেন। তারপর তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দিলেন। তাতে বললেন, ‘আমাকে আপনাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আল্লাহ আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা পালন করে গেলাম। আপনাদের যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বৃদ্ধি করেছি, বাসস্থান ও যুদ্ধক্ষেত্র বিস্তৃত কডেছি। আমাদের শিক্ষা ও জ্ঞান আপনাদের কাছে পৌঁছিয়েছি। আপনাদের জন্য সেনাবাহিনী গঠন করেছি, খাদ্য ও রাষ্ট্রীয় অনুদানের ব্যবস্থা করেছি। কেউ যদি এমন কিছু জানেন, যা আমাদের বাস্তবায়ন করা দরকার, আমাদেরকে জানাবেন। আমরা বাস্তবায়ন করব ইনশাআল্লাহ। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।’

ভাষণ শেষ করতে করতেই নামাজের সময় হলো। লোকজন আবেদন করলো, ‘আমিরুল মুমিনিন! হজরত বেলাল রাদি. যদি আজান দিতেন, তাহলে খুশী হতাম।’ তিনি বেলাল রাদি.কে আজান দেবার নির্দেশ দিলেন।

বেলাল রাদি. আজান দেয়া শুরু করলেন। রাসূল সা. এর উপস্থিতিতে যেই সুরে আজান দিতেন, অবিকল তেমন সুরেই। তার আজানের প্রতিটি শব্দে যেন রাসূল সা. এর স্মৃতি এবং গন্ধ লেগে আছে। রাসূল সা. এর ইনতেকালের পর বেলাল রাদি. আজান দেয়া ছেড়ে দিয়েছেন। কদাচিৎ কোথাও কেউ আবেদন করলেই তিনি আজান দেন। আজ এতদিন পর বেলালের আজান শুনে সবাই কাঁদতে শুরু করলো। কী প্রবল আর তুমুল কান্না। একেকজনের চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছিলো দাড়ি। সবচে আকুল হয়ে কাঁদছিলেন ওমর রাদি.। এ আজান শুধু আজান নয়, স্মৃতির জগতে নিয়ে যাওয়া এক সুর। সেই সুরে সবাই হারিয়ে যাচ্ছে। বেলালের আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর ধ্বনি সবার রক্তে বইছে। আশহাদু আন্না মুহাম্মাদানের সুর সবার শিরায় ঢেউ তুলছে। বহুদিন পর আজ বেলাল হাইয়া আলাস সালার তাড়নায় সবাইকে তাড়িত করছেন। হাইয়া আলাল ফালাহর প্রেরণায় উজ্জীবিত করছেন। বেলাল আজানের শব্দগুলো যত টানছেন, শ্রোতাদের মনে তত আকর্ষণ বাড়ছে। তারা আজানের শব্দের সঙ্গে উড়ে যাচ্ছেন হাওয়ায়। মিশে যাচ্ছেন একান্ত ব্যক্তিগত কল্পনায়।

সমাপ্ত

 

আগের সংবাদপথের ফুল
পরবর্তি সংবাদউদয়