আমাদের নারী এবং আলি তানতাবির অভিজ্ঞতা

কাজী মাহবুবুর রহমান:

আল্লাহ তাআলা মানুষ জাতিকে মোটাদাগে দুটি ভাগে ভাগ করে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। এক ভাগ নারী আরেক ভাগ পুরুষ। এবং এই দুটি ভাগকে একটি অপরটির জন্য সম্পূরক করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালার ইনসাফে কোনো ত্রুটি নেই। তিনি সকল ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে। পুরুষকে দিয়েছেন পৃথক দায়িত্ব ও বৈশিষ্ট্য। তেমনিভাবে নারীকেও দিয়েছেন পৃথক দায়িত্ব ও বৈশিষ্ট্য। এবং উভয়কেই করেছেন সম্মানিত। এই সরল ব্যখ্যার বিপরীতে একজনকে অপরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে আত্মকলহ ও জিঘাংসা তৈরীর প্রয়াস মানবসভ্যতার জন্য ক্ষতিকর ও লজ্জাজনক।

ইসলামে নারীর অধিকার, শিক্ষা, সম্পদ ইত্যাদি নিয়ে প্রতিদিন নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে বিতর্ক। ভীনদেশি এনজিও সংস্থাগুলির পাশাপাশি আমাদের দেশীয় মিডিয়াও তৎপর হয়ে উঠেছে নারীদের মধ্যে অযাচিত পুরুষবিদ্বেষের প্রবেশ ঘটিয়ে দেয়ার হীন উদ্দেশ্যে। বস্তুত এইসব বিদ্বেষের শেকড় নারী-অধিকার কিংবা নারী-স্বাধীনতার অভ্যন্তরে নয়, এর মূলে রয়েছে পবিত্র ইসলামের সঙ্গে সকল ভুল ইজমের বহুদিনের পুরনো বিরোধ। নারীর আবেগ ও সচেতনতাকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে তারা মূলত পবিত্র ইসলামের বিপরীতে সমগ্র মানবজাতিরই একটি অবিচ্ছেদ্য বিশাল অংশকে দাঁড় করিয়ে দিতে চায়। তাদের এই প্রয়াসের ফসল দিনশেষে না উঠবে নারীর ঘরে, না মানবসভ্যতাকে এনে দিতে পারবে ইতিবাচক কোনো ফলাফল।

খ্যাতিমান আরবি সাহিত্যিক আলী তানতাবী লিখেছেন, তাঁর বন্ধু ড. বাহজাহ তাঁকে বলেছেন, তিনি আমেরিকাতে একটি কনফারেন্সে মুসলিম নারী ও নিজ সম্পদে তাঁর একক অধিকার-বিষয়ে আলোচনা করছিলেন; মুসলিম নারীর সম্পদে রয়েছে তাঁর একচ্ছত্র অধিকার। তাঁর সম্পদে স্বামী বা পিতা কারোরই হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই। কোনো নারী প্রাপ্তবয়স্কা হওয়ার পরও যদি সে দরিদ্র হয় তাহলে তাঁর ব্যয়ভার বর্তাবে তাঁর পিতা বা ভাইয়ের উপর। যদি পিতা বা ভাই কেউ না থাকে সেক্ষেত্রে (পর্যায়ক্রমে) নিকটাত্মীয়দের উপর। বিবাহ পর্যন্ত অথবা তার স্বচ্ছলতা আসা পর্যন্ত তারা তার ব্যয়ভার বহন করবে। তারপর যখন বিবাহ হবে তখন তার সকল দায়-দায়িত্ব ন্যস্ত হবে স্বামীর উপর। যদিও স্বামী সম্পদহীন সাধারণ শ্রমিক হয় আর স্ত্রীর অঢেল সম্পদ থাকে।

একথা শুনে একজন প্রসিদ্ধ আমেরিকান লেখিকা দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, ‘আপনি যেমনটি বলছেন, নারীর জীবন যদি আপনাদের সমাজে এমন সুখেরই হয়, তাহলে আমাকে নিয়ে চলুন জনাব! আমি সেখানে ছয় মাস থাকব, তারপর আমাকে খুন করে ফেলুন! (অর্থাৎ, ছয় মাস এমন সুখের জীবন কাটানোর পর মরতেও আমার কোনো আপত্তি নেই।)’

ড. বাহজাহ তাঁর একথা শুনে আশ্চর্য হলেন। তাঁর অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলেন এবং এমন মন্তব্যের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন তিনি নিজের এবং সেখানকার নারীদের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে বললেন, একজন আমেরিকান নারী বাহ্যত দেখা যায় স্বাধীন, আসলে সে পরাধীন। মনে হয় সে সম্মানিত, আসলে সে লাঞ্ছিত। ছোট ছোট বিষয়ে দেখা যায় তারা নারীকে সম্মান দেখাচ্ছে, কিন্তু বড় বড় বিষয়ে তারা তাকে লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত করে। গাড়ি থেকে নামার সময় হাত ধরে নামাচ্ছে, ঘরে বা কোথাও প্রবেশের সময় তাকে আগে প্রবেশ করতে দিচ্ছে। কখনো কখনো ট্রামে পুরুষ দাঁড়িয়ে গিয়ে নারীকে বসতে দিচ্ছে অথবা নারীর চলার জন্য রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীতে অন্যান্য অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে নারীর সাথে অনেক হীন আচরণ করা হয়, যা অসহনীয় ও ভাষায় প্রকাশ করার অযোগ্য।

এখানে একটি মেয়ে যখন প্রাপ্তবয়স্কা হয়, পিতা তার থেকে হাত সরিয়ে নেয়। তার জন্য বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। পিতা আপন কন্যাকে বলে, এখন নিজে উপার্জন করে খাও। আজ থেকে আমার কাছে তোমার আর কোনো চাওয়া-পাওয়া অবশিষ্ট নেই। তখন মেয়েটি নিরুপায় হয়ে একাই জীবন সাগরে ঝাঁপ দেয়। সে জানে না সেই সাগরের গভীরতা। জানে না ঢেউ-স্রোতের প্রবলতা। জানে না কুমির-হাঙরের হিংস্রতা। এমনকি সে এ-ও জানে না জীবন সাগরের উজান-ভাটা কী জিনিস? কীভাবে সে মোকাবেলা করবে এসবকিছুর। কিন্তু তার পরিবারের তাতে কিছুই যায় আসে না। সে শ্রমের বিনিময়ে খাবে, না শরীরের বিনিময়ে, তা তাদের ভাববার বিষয় নয়। তারা তাকে জিজ্ঞেস করবে না, সে নিজের উপার্জনে খাচ্ছে কিনা। আর এটা শুধু আমেরিকার কথা নয়, সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বের চিত্র।

প্রফেসর ড. ইয়াহইয়া আশশাম্মা‘ আমাকে আজ থেকে ৩৩ বছর আগে (তিনি প্যারিস থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফেরার পরপরই) বলেছেন, তিনি একটি বাসায় গেলেন, সে বাসার একটি কক্ষ ভাড়া নেয়ার জন্য। তিনি বাসায় ঢোকার সময় দেখলেন, একটি মেয়ে চোখ মুছতে মুছতে বের হচ্ছে। তিনি কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা জানালো, সে এ বাড়িরই মেয়ে। সে স্বাধীনভাবে একা থাকার জন্য আমাদের থেকে পৃথক হয়ে গেছে। ড. ইয়াহইয়া বললেন, তাকে যে আমি কাঁদতে দেখলাম! তখন তারা বলল, হ্যাঁ, সে এসেছিল আমাদের বাসার একটি রুম ভাড়া নেয়ার জন্য, কিন্তু আমরা তাকে ভাড়া দিতে রাজি হইনি। তিনি বললেন, কেন? তারা বলল, কারণ সে ২০ ফ্রাঙ্ক দিতে চাচ্ছে। কিন্তু অন্যের কাছে ভাড়া দিলে আমরা পাবো ৩০ ফ্রাঙ্ক। (সূত্র : মাআন্নাস, পৃষ্ঠা ১৬৯-১৭৬)

আলী তানতাবির রচনাটি আরও দীর্ঘ। কিন্তু এতখানি বলার পর আমাদের আর কিছু বলার থাকে না। প্রসঙ্গক্রমে কেন পশ্চিমের কথাই বারবার ফিরে আসে? কেননা আমাদের মায়েদেরকে হলিউডের পর্দায় পশ্চিমা কালচার এবং নারীস্বাধীনতা দেখিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়। বস্তুত হলিউডের পশ্চিম আর ১২ বছরের নাবালক কন্যার গৃহতাড়িত হওয়ার পশ্চিম এক নয়৷ এবং এক নয় স্বাধীনতার নামে নারীর পারিবারিক বন্ধনমুক্তির পশ্চিমা এবং বর্ষীয়সী মায়ের বৃদ্ধাশ্রমে ধুকে ধুকে একদিন মরে যাওয়া।

মূলত নারীর অধিকার ও মর্যাদাকে পবিত্র ইসলামের বিপরীতে দাঁড় করানোর যেই প্রয়াস ও সুযোগ, এটা ইসলাম থেকে তৈরী হয়নি। হয়েছে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলেই। এবং সমাজে যেহেতু সবারই একটি ধর্মীয় পরিচয় থাকে, তাই যে ব্যক্তি অপরাধ করে আমাদের অবচেতন মনেই তার কৃত অপরাধ কিঞ্চিত হলেও তার ধর্মীয় পরিচয়কে প্রভাবিত করে। আর সেই সুযোগটাই গ্রহণ করেছে ইসলামের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণকারীরা।

আমাদেরও অবহেলা এবং ভ্রান্তি রয়ে গেছে অনেক। পরিস্থিতি বুঝে উঠতেই লেগে গেছে অনেক বছর। নারীদের ইসলামি শিক্ষার জন্য সোচ্চার হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল অনেক আগেই। তবে আমরা আশাবাদী। বাংলাদেশে বালিকা মাদরাসাশিক্ষার বিপ্লব শুরু হয়েছে। আমাদের কন্যারা গর্বের সঙ্গে হিজাব পরিধান করছে। প্রতিটি জেলায় বালিকা মাদরাসা সন্তোষজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও পাচ্ছে মূল্যবান ইসলামি শিক্ষাসেবা।

আজকের দিনে, স্থানে স্থানে গড়ে ওঠা বালিকা মাদরাসাগুলো আমাদের আন্দোলিত করে। এই মাদরাসাগুলোকে নিয়ে, এই মেয়েগুলোকে নিয়ে চমৎকার একটি স্বপ্ন দেখি আমরা। এদের চেহারায়, এদের কল্পিত অবয়বে আমরা হজরত আয়েশার মুখচ্ছবি দেখতে পাই। সকল ভীরুতা ও অসত্যের বিপরীতে তারা দ্বীনের মশাল হাতে আগলে রাখে আমাদের অলিন্দ। প্রয়োজনে বেরিয়ে আসবে ঘরের বাইরেও, যতটুকু ইসলাম সম্মতি দেয়। এমন একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি।

আগের সংবাদশবে বরাত উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আয়োজন
পরবর্তি সংবাদনারী ফেকাহবিশারদ ও তাঁদের পরিচালিত পাঠ্যসভা