(হাসান রোবায়েত। দ্বিতীয় দশকে বাংলাদেশের যেকজন তরুণ ভালো কবিতা লেখছেন, হাসান রোবায়েতের নাম নিঃসন্দেহে তাঁদের প্রথম সারিতে। একুশে বইমেলায় তাঁর ‘ এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে’ আলাদা একটা সাড়া ফেলেছিল পাঠক মহলে। ঢাকার পাশাপাশি কলকাতায়ও তিনি সমানভাবে সমাদৃত। সম্প্রতি কলকাতার ‘আদম সম্মাননা’র জন্য মনোনীত হয়েছেন। ফাতেহের ঈদসংখ্যার জন্য তাঁর সঙ্গে আলাপে বসেছেন কাজী মাহবুবুর রহমান।)
কাজী মাহবুবুর রহমান
কেমন আছেন ভাই?
হাসান রোবায়েত
আলহামদুলিল্লাহ। ভালো।
কাজী
বাসায় রঙ করতেছেন শুনলাম, কদ্দূর গোছায়া উঠলেন?
রোবায়েত
চার বছর পর আমি যে নিচতলার দেড়টা রুম নিয়া থাকি সেটা মালিক রঙ করে দিচ্ছে। দেয়ালে রক্তের শিরা-উপশিরার মতো উইপোকার ঘরে ছেয়ে গেছিলো। বই খাইছে প্রায় হাজার দশেক টাকার। সব জিনিশপত্র একলা একলা বাইর করা আবার ওঠানো, সাজানো সবই খুব ক্লান্তির কাজ। শেষমেশ রুমের কাজ হয়ে গেছে। দাওয়াত নেন একদিন গরিবের ডেরায়।
কাজী
শুনে খারাপ লাগল । বিশেষত দশ হাজার টাকার বই উইপোকায় খেয়ে ফেলাটা খুবই দুঃখজনক। চোখের সামনে এই ক্ষতি হতে দেয়া কি কেবল কবি হওয়ার কারণেই? জনশ্রুতি আছে, কবিরা অগোছালো হয়।
রোবায়েত
নাহ। আমার এই নিচতলাটা মনে হয় অভিশপ্ত। নানান কিসিমের পোকামাকড়। প্রথম যখন এইখানে উঠি, ফ্লোরে ঘুমাইতাম। পরে দেখি ছোট ছোট বিচ্ছু ঘুরতেছে। ভয়ে, টাকা ধার করে একখান লোহার খাট কিনছিলাম। শেলফে বই রাখলেই উইপোকায় খায়।
কাজী
এই বাসায় কতবছর যাবত আছেন ভাই?
রোবায়েত
চার বছরের কিছু বেশি।
কাজী
কবিতা লেখার শুরুটা কবে থেকে?
রোবায়েত
২০১২ এর সেপ্টেম্বর/অক্টোবর থেকে মেবি।
কাজী
এখন আমাদেরকে কবিতা লেখার শুরুর দিকের দুই একটা সুখ-দুখের গল্প বলেন। কোনো কিছুতে খুব কষ্ট বা আনন্দ পেয়েছিলেন, এমন!
রোবায়েত
লেখার শুরুর দিকের আনন্দের চেয়ে বেদনাই মনে হয় বেশি থাকে। একজন তরুণ কবির প্রধাণ শত্রু হয়ে ওঠে তারই কবিতা। সে যা লিখছে সেটা সত্যিই কবিতা হচ্ছে কিনা এই দ্বিধাই তাকে বেশি কষ্টে ফেলে।
এর পরে আছে প্রকাশের তাড়না। প্রকাশ-সংক্রান্ত একটা কষ্ট আমার ছিল শুরুর দিকে। তখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে ‘বাক্’ নামে দুর্দান্ত একটা ওয়েবজিন বের হতো (এখনো হয়)। সেখানে লেখার খুব খায়েশ হতো। যতবার লেখা পাঠিয়েছি প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। একবার বাক্-এর সম্পাদক অনুপম মুখোপাধ্যায় আমার পাঠানো একটা লেখা পড়ে জানালেন যে লেখাটা বাক্-এর পরবর্তী সংখ্যায় যাচ্ছে। আমি তো খুশিতে টলমল। বাক্ তখন প্রতি এক মাস পরপর ভারতীয় সময় রাত ১২ টায় বের হতো। আমি সারা মাস প্রতীক্ষায় আছি আমার ছাপানো লেখা দেখব। কিন্তু এক মাস পর দেখলাম আমার কবিতাটা ছাপা হয়নি। খুবই দুঃখ পেয়েছিলাম।
কাজী
এবার একটা আনন্দের গল্প শোনান। কষ্টের সঙ্গে কাটাকাটি হোক!
রোবায়েত
আনন্দ লেখার জীবনে প্রচুর পাইছি। যেমন, ঘূর্ণ্যমান দেরাজের গান, পানাহ্, বৃহস্পতিবার, মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এইসব লেখা শেষ করার পর মারাত্মক আনন্দ হয়েছে। তবে সবচেয়ে আনন্দ বোধ হয়, রাসুলকে নিয়ে কবিতাটা লিখতে আমার তিন দিন সময় লাগছিল। দ্বিতীয় রাতে আমি ফাতেমা রাদিআল্লাহু আনহাকে স্বপ্নে দেখি। এর চেয়ে আনন্দ এখনো আর পাইনি।
কাজী
কবিতা প্রসঙ্গে আসি। ছয়সাত বছর ধরে আপনি কবিতা লিখছেন। আপনার কবিতার টুলস, ভাষা, মেটাফোর, বাক্য ভাঙাচোরা ইত্যাদি বিষয়গুলো ভিন্নধর্মী। আপনার প্রতিটি গ্রন্থই টেক্সটের author-এর পরিচিতি বহন করছে। এই স্বাতন্ত্র্য কী করে তৈরি হলো, এর পেছনে কারও অবদান আছে?
রোবায়েত
অবদান যেটুকু সেইটা আমার পরিশ্রমের। নিজের লেখার প্রতি আমার মুগ্ধতা নাই। একসময় অনেক সমালোচনা শুনতে হয়েছে দুর্বোধ্যতার অভিযোগে, অথচ প্রচুর পাঠকের ভালোবাসা আমি পাই। নিজের চয়েজ অব ডিকশন আর অ্যালগরিদমকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। কারও পরামর্শই শোনিনি।
কাজী
আপনি আপনার কবিতায় মাঝেমাঝেই আধ্যাত্মিকতা ও ধার্মিকতার প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন, এটা আপনার কবিতায় কেন জরুরি হয়ে উঠল?
রোবায়েত
কবিতার জন্য তা-ই জরুরি কবি যা ইমাজিন করে। আমার ইমাজিনেশনের জগৎ তো বৈচিত্র্যময় সেখানে ধর্ম অনেকগুলো টুলস নিয়ে হাজির থাকে। আমার আম্মা যখন জায়নামাজ থেকে উঠে আমাকে খাইতে দেন বাড়িতে গেলে, আব্বু যেমন ফোন করলে বলেন নামাজ ঠিকমতো পড়ছি কিনা! একজন রিক্সাচালক যখন আমাকে সিটে বসিয়ে বিসমিল্লাহ বলে প্যাডেলে পা দেয়—সবই তো আমার সোসাইটির অংশ। সুতরাং ধর্ম যে মেটাফর, উপমা এমন অনেক কিছু হয়েই টেক্সটে ঢুকবে সেটা খুবই সাধারণ। আর অধ্যাত্ম বিষয়টা আমার লেখায় কীভাবে আসে সেটার কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচ নাই, ধর্ম নাই। রামকৃষ্ণ পরমহংসের ‘কথামৃত’ আমার একটা প্রিয় বই। আমার অধ্যাত্ম হয়তো অমন।
কাজী
আপনার মাদরাসার জীবনসহ বিরাট একটা অংশ জুড়ে ইসলাম আছে। এবং আপনার কবিতায়ও সেগুলিই বেশি। আপনি এর বাইরে খুব যাচ্ছেন না, এটা কেন? এর বাইরে গেলে কি আপনার ফ্লপ করার সম্ভাবনা আছে?
রোবায়েত
এটা আপনার ভুল অবজারভেশন। আমার দুইটা বই ভালো করে পড়লেই বুঝতে পারবেন বিচিত্র টুলস আসছে আমার লেখায়। কিছুক্ষণ আগেই তো বললাম মহাভারতের কথা। এমন অনেক বিষয়ই আছে যা আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে।
কাজী
হতে পারে। ভিন্নপ্রসঙ্গে যাই, বাংলা কবিতার বড়দের ভেতর কাকে ভালো লাগে, এবং কেন ভালোলাগে?
রোবায়েত
বড় বলতে কাদেরকে বুঝাচ্ছেন?
কাজী
কন্টেম্পোরারি না আর কি। মোটাদাগে ৩০ থেকে ৮০। আগে-পরেও হইতে পারে।
রোবায়েত
কে কোনো দশকের কবি এইটা নিয়া আমার ঝামেলা আছে হিশাবে। আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক, মাসুদ খান, বিষ্ণু বিশ্বাস, সান্তনু চৌধুরী, জুয়েল মাজহার ইনাদের কবিতা ভালো লাগে। আরও কেউ কেউ আছেন, নাম মনে পড়ছে না।
কাজী
নজরুলের জন্মেরদিনকাল যাচ্ছে, আপনি নজরুলকে কীভাবে গ্রহণ করেছেন?
রোবায়েত
হি ইজ আ গ্রেট পোয়েট অফ পিপল।
কাজী
কয়েকদিন আগে আদম সম্মাননায় আপনার নাম ঘোষণা হলো, কেমন লাগতেছে, আমদেরকে একটু অনুভূতি জানান!
রোবায়েত
এইসব সম্মাননা নিয়া আমার কোনো অনুভূতি নাই। আমি বরং বিরক্ত।
কাজী
যেকোনো সম্মাননার বিষয়ে কি একই মতামত?
কাজী
আপাতত এমনই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব হয় পছন্দের ব্যক্তির সুপারিশে। তো, আমার নামটা হয়তো আদমকে কেউ সুপারিশ করেছিল তাই তারা আমাকে বেছে নিয়েছেন। তবে, কলকাতা থেকে যেহেতু আমার দুইটা বই প্রকাশিত হয়েছে—’ঘুমন্ত মার্কারি ফুলে’ আর ‘আনোখা নদী’—এবং এই দুইটা বইয়েরই পাঠক-রেসপন্স অনেক বেশি, বেশ কয়েকটা রিভিউও হয়েছে। সেসব কারণে আদম কর্তৃপক্ষ যদি সত্যিই আমাকে পড়ে সম্মাননা দিয়ে থাকে সেইটা আমার জন্য আনন্দদায়ক হবে।
আমি কর্তৃপক্ষকে বারবার নিষেধ করেছিলাম আমাকে সম্মাননা না দিতে। আমার বরং প্রবল ইচ্ছা ছিল ‘আদম’ থেকে কোনো বই করার। তারা সেটা করতে চেয়েছেন আগামী কলকাতা বইমেলায়।
তাছাড়া আদম ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রিয় প্রকাশনী। তারা আমার বই করলে আমি সম্মানিত ফিল করবো। সেটা সম্মাননার চেয়েও বেশি। কারণ তাতে করে পশ্চিমবঙ্গের আরও বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছে যাব আমি। আর আদমের প্রকাশনী-সংক্রান্ত উৎকৃষ্টতার ভক্ত আমি।
কাজী
আপনার সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে’র কথা বলি। কবি কেন ফ্যাসিবাদের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠলেন? ফ্যাসিবাদ রাজনীতির শব্দ। আপনার দৃষ্টিতে কবিতা কীভাবে রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখে?
রোবায়েত
কবি তো মঙ্গলগ্রহ থেকে তার দেশকে পর্যবেক্ষণ করেন না। মানুষের সঙ্গেই তার মেলামেশা। তার জনগোষ্ঠী যদি ফ্যাসিবাদে আক্রান্ত হয় তার প্রতিক্রিয়া কবিকেও স্পর্শ করে। আর আমি তো মনে করি কবি ইজ মোর পলিটিক্যাল দ্যান আ পলিটিশিয়ান। তো, ফ্যাসিবাদে আক্রান্ত দেশের কবি হয়ে আমি নিজেও তো তার শিকার। সুতরাং আগ্রহী না বরং ফ্যাসিবাদের ল্যাবিরিন্থেই আমাদের বসবাস। ‘এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে’ বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের আমলনামা বলতে পারেন।
কাজী
‘এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে’ নিঃসন্দেহে একটি সাহসী কাজ। আপনি ফ্যাসিস্ট সরকারকে ‘মুসোলিনীর মা’ বলেছেন, এটা ইমপোর্টেন্ট। তবে পুরো বইটাতেই ফ্যাসিবাদগ্রস্ত সময়ের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের আখ্যান ধরা আছে, কোথাও কি উত্তরণের পথও বলে দেয়া আছে?
রোবায়েত
সরাসরি উত্তরণের চেষ্টা রাজনীতিবিদদেরই করতে হবে। কবিরা কেবল তার জনগোষ্ঠির মানস ব্যাখ্যা করতে পারে। তবে অনেক সমালোচক বইয়ের শেষ দীর্ঘকবিতা ‘মোহাম্মাদ, সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ পড়ে এমনটা মন্তব্য করেছেন যে মোহাম্মাদ সা.-এর জীবনী এবং আদর্শতে ফ্যাসিজম থেকে মুক্তির উপায় আছে। লাকাদ কানা লাকুম ফি রাসুলিল্লাহি উসউওয়াতুন হাসানা—এমন।
কাজী
ইন্টারেস্টিং! এক সময় শোনা যেত কবিতাগ্রস্ত রোবায়েত। আজকাল গদ্যও লেখতেছেন। গদ্যের দিকে ঝোঁকার অনুপ্রেরণা কোত্থেকে?
রোবায়েত
আমার শৈশবের স্মৃতি, ধরমপুর, মাদরাসার লম্বা বারান্দা, মসজিদের পানির হাউজে লাল লাল মাছ, তালতলার মাধুডাঙা, ধানখেত—এসব মাঝে মধ্যেই বলকে উঠত একটু একলা থাকলেই। একসময় দেখছিলাম অনেক স্মৃতিই আমিই ভুলে যাচ্ছি যেখানে অজস্রবার যেতে চাই আমি। এইসব বিস্মৃতির হাত থেকে মুক্ত হতেই গদ্যে হাত দিই আমি।
কাজী
গদ্যলেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন, নাকি কবি হিসেবেই?
রোবায়েত
আমি গদ্যেও শেষ পর্যন্ত কবিই।
কাজী
বাহ! শুভকামনা রইলো ভাই। সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
রোবায়েত
আপনাদেরকেও ধন্যবাদ। দোয়া করবেন আমার জন্য।