আলী শরীয়তীর দৃষ্টিতে হজের মর্ম ও মাকসাদ

রাকিবুল হাসান

আধুনিক যুগে ইসলামি চিন্তাভাবনা সমৃদ্ধকরণ ও নবায়নের ক্ষেত্রে কাজ করেছিলেন, এমন একজন ইরানি চিন্তাবিদ আলী শরিয়তী। মানুষের মনে ঝেঁকে বসা আচারসর্বস্ব বিশ্বাসের জমিনে তিনি আদর্শিক সংস্কারের চারা রোপণ করেছিলেন। আওয়াজ তুলেছিলেন জাগরণের, মুক্তির, সচেতনতার। মূলত রাজনৈতিক চিন্তাবিদ এবং কর্মী হিসেবে তাঁর উত্থান। কিন্তু তাঁর সত্ত্বায় বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সামাজিক জাগরণ আন্দোলনের এই শক্তিশালী রূপটির বাইরে তার আরও একটি রূপ আছে, যা তাঁর ইসলাম বিষয়ে লিখিত কিতাবাদিতে খুব সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে। যেমন—তাযকিয়া, তাসাউফ। দুটি কিতাব ‘দোআ’ এবং ‘হজ’-এ তাযকিয়া ও তাসাউফ প্রসঙ্গটি সাবলীলভাবেই উঠে এসেছে।

আলী শরিয়তী নিজেই বলেছেন, ‘তাঁর কিতাবগুলোকে তিনটি মূল শিরোনামে ভাগ করা যায়।

১. ইসলামিয়্যাত—’তাযকিয়া এবং তাসাউফ’
২. সামাজিক—’বিপ্লব এবং সংস্কার’
৩. মরুভূমি—’মরূভূমির দর্শন’

এই প্রবন্ধে আমরা আত্মশুদ্ধি এবং আত্মপরিচয়ের পথে আলী শরিয়তীর যে অভিজ্ঞতা, তা তুলে ধরার চেষ্টা করবো। যেগুলো হজের সফরে গিয়ে তিনি অর্জন করেছেন এবং এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা তাঁর বিভিন্ন কিতাবে দিয়েছেন।

আলী শরিয়তী : জীবন ও সংগ্রাম

ডিসেম্বর, ১৯৩৩ ইংরেজি; খোরাসান প্রদেশের মাশহাদ শহরের নিকটেই মুজাইনান গ্রামে আলী শরিয়তী জন্মগ্রহণ করেন। এক শিক্ষিত পরিবারে তাঁর বেড়ে ওঠা। তাঁর বাবা ছিলেন প্রসিদ্ধ ইসলামি লেখক ও চিন্তাবিদ। বাবা মুহাম্মদ তাকি শরিয়তীর ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এবং যে ইলমি আবহাওয়ায় আলী শরিয়তী বেড়ে উঠেছেন, তাঁর পরবর্তী ইলমি এবং ধর্মীয় জীবনে এর যথেষ্ট প্রভাব ছিলো।

১৯৫৫ সালে আলী শরিয়তী মাশহাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদে ভর্তি হন। এবং ১৯৫৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। মাশহাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চলাকালীন ১৯৫৬ সালে তিনি তাঁর সহপাঠী বুরান শরিয়তীকে বিয়ে করেন। ১৯৫৯ সালে ইসলামি ইতিহাস এবং সামাজিক বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের জন্য ফ্রান্সে পাড়ি জমান আলী শরিয়তী।

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পথিকৃৎ হিসেবে ধরা হয় আলী শরিয়তীকে। কারণ, ইসলামি বিপ্লবের আগ মুহূর্তে ১৯৭৯ সালে তাঁর প্রচেষ্টা এবং পরিকল্পনা ইরানে মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক সংহতি আরও জোরালো, আরও শক্তিশালী করেছিলো।

শৈশবে, মাধ্যমিক স্তরে পড়বার সময়ই তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। চল্লিশের দশকের শেষদিকে তিনি এবং তার বাবা যোগ দিয়েছিলেন ইরানের বামপন্থী আন্দোলনে। যা তখন ব্যাপকভাবে অনুরণিত হয়েছিলো। এরপর ১৯৫৪ সালে যোগ দিয়েছিলেন মুসাদ্দেকের আন্দোলনে। যা তখন জাতীয় আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলো। মুসাদ্দেকের পতনের পর আলী শরিয়তী আয়াতুল্লাহ জাঞ্জানি এবং মেহদী বাজারগান প্রতিষ্ঠিত জাতীয় প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেন। তখন তাকে গ্রেফতার করা হয়।

ছয়মাস কারাগারের প্রকোষ্ঠে নির্মম জীবন যাপন করতে হয়। গ্রেফতারের কারণে ১৯৫৮ সালে স্নাতক পরীক্ষায় বসা হয়নি। ১৯৫৯ সনে স্নাতক পরীক্ষা দিয়ে চলে যান ফ্রান্সে। ইসলামি ইতিহাস এবং সামাজিক বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করে ইরানে ফিরে আসেন। ইরানে ঢুকবার সময় সীমান্তে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। কিছুদিন পর ছেড়েও দেয়া হয়।

এবার ছাড়া পাওয়ার পর তিনি মাশহাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।

শরিয়তীর ক্যারিয়ারে টার্নিং পয়েন্ট ছিলো হুসেনি-ই-ইরশাদ, যা একটি বৈজ্ঞানিক কেন্দ্র হিসেবে চালু হয়েছিলো। মুরতাজা মোতাহেরীর মতো একাধিক ইরানি বিজ্ঞানী এবং বুদ্ধিজীবী এই কেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলেন। শরিয়তী এই বৈজ্ঞানিক কেন্দ্রকে নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণা এবং তাদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিকভাবে সংহতকরণের এক মঞ্চ হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর লেকচারগুলো ‘পাশ্চাত্যকরণ’, ‘বাদশার দাসত্ব’, ‘ভ্রান্ত চিন্তাবিদ’ এবং ধর্মের বিরুদ্ধে যারা ধর্মকে ব্যবহার করে সহিংসতা ছড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে কাজ করতো।

তখন ১৯৭৩ সালে আলী শরিয়তী এবং তাঁর বাবাকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ ১৮ মাস কারাগারে নির্যাতন ভোগের পর ১৯৭৫ সালে আলজেরিয়ান কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে তাদের মুক্তি দেয়া হয়। কারাগার থেকে বেরোবার পর যেকোন ধরণের কার্যক্রম আলী শরিয়তীর জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। সেইসঙ্গে তাঁর ওপর গোয়েন্দা নজরদারীও করা হচ্ছিল।

১৯৭৭ সালের মে মাসে তাকে লন্ডন যেতে অনুমতি দেয় ইরান কর্তৃপক্ষ। লন্ডনের রাজধানীতে কিছুদিন থাকার পর হঠাৎই তাঁর মৃত্যু হয়। সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়, আলী শরিয়তীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।

আলী শরিয়তী : প্রকল্প এবং পরিকল্পনা

আলী শরিয়তীর দার্শনিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্পটিকে কূপ খননের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।

কোদাল দিয়ে মাটিতে খনন করে চলছেন। মাটির গভীরে যাবার জন্য এই যে কোপাচ্ছেন, তিনি জানেন না কতটুকু গভীরে গেলে জলের দেখা পাবেন। কিন্তু তিনি শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ দেখলেন, গভীরে যাবার পর, গলগল করে বেরিয়ে আসছে পানি। কূপের শীতল জলের স্পর্শে তার অদ্ভুত এক শিহরণ। প্রথমে একটু, তারপর চতুর্দিক থেকে শব্দ তুলে বেরিয়ে আসছে পানি।

আচারসর্বস্ব, রক্ষণশীল, অন্ধ অনুকরণে আচ্ছন্ন সমাজ ঠিক এই কূপের মতোন। মাটির নীচে যেমন ঘুমিয়ে থাকে পানি, তেমনি নিস্তরঙ্গ এই সমাজের অতলেও লুকিয়ে আছে ঢেউ, সত্যিকার আদর্শের ঢেউ। কূপ খননের মতোই তিনি সমাজের গভীরে যেতে চান। অন্ধ অনুকরণ এবং কুসংস্কারের আবরণ সরিয়ে তাদের আদর্শের জায়গাটিকে উন্মুক্ত করতে চান।

জাতীয় এবং সামাজিক মুক্তির প্রকল্পটি তিনি অভ্যন্তরে বাসা বেঁধে থাকা অন্ধ অনুকরণ ও রক্ষণশীলতার সমালোচনা করার মাধ্যমে শুরু করেন। তাঁর এই সমালোচনা রক্ষণশীল গোঁড়া ধর্মীয় সংস্কৃতির মুখোশ খুলে দেয়। তাদের সামনে উপস্থাপন করে আদর্শভিত্তিক সংস্কৃতি, যা ইসলামের মূল প্রাণ, মূল ধর্ম। ‘ধর্মের বিরুদ্ধে ধর্ম’ তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটিতে বিষয়টি খোলামেলাভাবে আলোচিত হয়েছে।

আলী শরিয়তী ‘রিটার্ন টু সেলফ’ বইটিতে তাঁর চিন্তার প্রকৃতি সম্পর্কে কিছুটা ব্যাখা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইসলামকে তাঁর পুনরাবৃত্তিমূলক চিত্র, অন্ধ অনুকরণ ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রথা থেকে দূরে রাখা উচিত, যা অবক্ষয়ের সবচে বড় কারণ। বরং ইসলামকে এমনভাবে উপস্থাপন করা উচিত, যা মানুষের অনুভবকে জাগ্রত করে, চেতনাশীল আদর্শের পথে পরিচালিত করে।’

তাঁর প্রকল্প ছিলো— ভ্রান্ত চিন্তাবিদদের হতাশাজনক সংস্কৃতি থেকে ইসলামকে একটি অনুপ্রেরণামূলক মতাদর্শে রূপান্তরিত করা। কালের ধূলোয় যেটা চাপা পড়ে গেছে। আব্দুল জব্বার রিফাঈ’র দৃষ্টিতে—আলী শরিয়তীর এই প্রতিরোধমূলক চিন্তা, ধর্মকে মানুষের অন্তরঙ্গ করে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা, ইসলামের সামাজিক বিষয়গুলোর ওপর জোর প্রদান মূলত ইসলামকে নিরেট সংস্কৃতি থেকে আদর্শে রূপান্তরিত করার প্রয়াস। তবে শাস্ত্রীয় ধর্মতত্ত্বের পড়াশুনা থেকে দূরে থাকায় কখনো কখনো প্রগতিশীলদের প্রভাবে প্রভাবিতও হয়েছেন।

মুসলিমদের নিরেট সংস্কৃতির সুখ স্বপ্ন থেকে আদর্শের চেতনায় কর্মতৎপর করে তোলার এই প্রয়াস অাধুনিক তিন ইসলামি চিন্তা পুরুষের প্রকল্পের সাথে মিল আছে। তিন চিন্তাপুরুষ হলেন—আল্লামা ইকবাল, সাইয়্যেদ কুতুব, ইসমাঈল ফারূকী রহ.।

ইবাদাতের ক্ষেত্রে আলী শরিয়তীর দৃষ্টিভঙ্গি

ইবাদাতের ক্ষেত্রে আলী শরিয়তীর দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের জ্ঞানসম্ভার তথা ফিকহ, ইলমে আকাইদ এবং তাসাউফের সাথে সম্পৃক্ত। সম্পৃক্তিটা এই হিসেবে—ফিকহ, আকাইদ এবং তাসাউফ মানুষের ইবাদতে এমন এক শক্তি তৈরী করে, যা তাকে বহিরাগত সাম্রাজ্যবাদ এবং অভ্যন্তরীন নৈরাশ্যবাদের মোকাবিলা করতে পারে।

শরিয়তী বলেন, ‘ইসলামকে সামাজিক ঐতিহ্য থেকে আদর্শিক প্রতিচ্ছবিতে রূপান্তরিত করতে হবে। একটি শেখানো জ্ঞান থেকে আচার-অনুষ্ঠান, আচার-ব্যবহার এবং আমলে জীবন্ত করে তুলতে হবে। যা আখেরাতে মানুষের সওয়াব অর্জনে ফলপ্রসু। তাহলে আখেরাতের সওয়াবের জন্যই মানুষ মৃত্যুর আগে নিজের দায়িত্ব ভেবে আমলে মশগুল হবে। ত্যাগ-কুরবানি দিবে। অন্তর থেকে ইসলামকে ভালোবাসবে।

এজন্যই ইসলামের ইবাদাতগুলোকে শরিয়তী আরও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। ফিকহি মাসআলার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মাথা না ঘামিয়ে তিনি খুঁজতে চেষ্টা করেছেন ইবাদাতের মৌলিক উদ্দেশ্য এবং মূল হাকিকত। খুঁজে দেখতে চেষ্টা করেছেন ব্যক্তি এবং উম্মাহর জীবনে ইবাদাতের ভূমিকা কেমন? কেমন করে ইবাদাত একজন মানুষকে নতুনভাবে গঠিত করে, উন্মোচিত করে। কীভাবে ইবাদাত বর্তমানের সংকট থেকে মুসলমানদের মুক্ত করে।

এ প্রসঙ্গে শরিয়তী বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্ক তৈরী এবং তাঁর নৈকট্য লাভের জন্য ব্যক্তির প্রচেষ্টাকেই ইবাদাত বলে। ইসলামে ইবাদাতের আরেকটি রূপ আছে, যা হজে সবচে বেশি প্রকাশিত হয়। তবে অন্যসব ধর্মে একজন ব্যক্তির সুন্দর চরিত্র গঠন এবং মার্জিত জীবন যাপনকে বলে ইবাদাত। ইসলামের ইবাদাতের রূপটা সামগ্রিক। বাড়াবাড়ি নেই, ছাড়াছাড়ি নেই। ইসলামে সমাজ, জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইবাদাতের কোন নিয়ম নেই। বরং সমাজ, বাস্তব জীবন এবং অন্য আরও অনেক মানুষের সঙ্গে থেকেই ইবাদাত করে যেতে হয়। আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায়।

এসব বিবেচনায় শরিয়তী দায়িত্ব এবং কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর হজের সফরকে আগে রেখেছেন। এখানে সব দেশের সব মোহনার মানুষ এক হয়ে যায়। বর্ণ গন্ধ ভুলে একসঙ্গে আল্লাহর ইবাদাতে মগ্ন হয়।

হজ : আলী শরিয়তীর অভিজ্ঞতা

আলী শরিয়তীর সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক রচনায় হজের নিদর্শন এবং হজের মর্মের বর্ণনা বিশেষভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। হজ সম্পর্কীয় তিনটি কিতাব লিখেছেন তিনি।

১. হজ : পঞ্চম ফরজ (আরবিতে অনুবাদ হয়েছে)
২. হজ : হজের দর্শন এবং মর্ম (আরবিতে অনুবাদ হয়েছে)
৩. ইবরাহীমের সাথে সাক্ষাৎ (অনূদিত হয়নি)

তাঁর রচনায় হজের নিদর্শনের প্রবল উপস্থিতির দুটি কারণ হতে পারে।

১. তিনটি বড় মূল্যবোধকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো শরিয়তীর চিন্তা-চেতনা ; ক. তাওহীদ খ. শাহাদাত গ. হজ।

২. শরিয়তীর রচনায় বিষয় বৈচিত্র্য অনেক। তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি সব ধরনের লেখক, আবার কোন ধরনের-ই লেখক না।’ এজন্যই তার একাডেমিক লেখাগুলোতো সাহিত্য বিষয়ক মতামতের পাশাপাশি থাকতো অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য, যুদ্ধের কাহিনী, উপদেশ, চিঠি। লিখতে বসে তাঁর চিন্তা প্রবাহিত হতো বিভিন্ন দিকে, বিভিন্ন সরোবরে। এই হিসেবে হজের আলোচনাও চলে এসেছে।

প্রবন্ধের বাকী অংশে আমরা হজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে শরিয়তী যে গুরুত্বপূর্ণ অর্থ ও মূল্যবোধের কথা বলেছেন, তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করবো।

হজের সবচে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য

শরিয়তী বলেন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই হজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডগুলো সুবিন্যস্তভাবে পালন করা হয়। মৌলিক তিনটি চিন্তায় এই উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়। প্রতিবিম্বিত হয় খুব জোরালোভাবে।

১. হজ হলো আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরী করার কার্যক্রম।

এই একটি হজের মাধ্যমে অনেকগুলো কাজ একসাথে একই সময়ে করা হয়ে ওঠে। যেমন—ক. আদম আ. এর সৃষ্টির ঘটনা মনে পড়ে। খ. ঐক্য ফুটে উঠে। গ. অতীতের সোনালী ইতিহাস চোখের সামনে ভেসে উঠে। ঘ. ইসলামি আকিদা দৃঢ় হয়। ঙ. ভূখণ্ড এবং ভাষা আলাদা হলেও সব মুসলিম যে একই জাতি, একই উম্মাহ, তা বোধে নাড়া দেয়।

২. দৈনন্দিন জীবনে মানুষ যে চার ধরনের মিথ্যের মুখোশ পরে থাকে, হজ তা খুলে ফেলতে আহবান করে।

ক. নেকড়ের মুখোশ, যা হিংস্রতা এবং ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে। খ. মেষ শাবকের মুখোশ, যা অপমান এবং নির্ভরশীলতা প্রকাশ করে। গ. শেয়ালের মুখোশ, যা কপটতা প্রকাশ করে। ঘ. ইঁদুরের মুখোশ, যা ধূর্তামি প্রকাশ করে।

৩. হজের সারাংশকে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি উপাদানে বিন্যস্ত করা যায়। ক. যোগাযোগ নীতি। খ. ঐক্য। গ. সুসংগঠিত আন্দোলন বা কর্মচাঞ্চল্য।

তিনটি উপাদানের ব্যাখ্যা।

ক. যোগাযোগ নীতি

শরিয়তী বলেন, প্রতি বছরই মানুষ এই জায়গাটির সঙ্গে, ইতিহাসের উৎস এবং ইতিহাসের সোনালি মানুষদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরী করে। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের বন্ধন অটুট করে। ইবরাহীম আ. থেকে যে মহান আধ্যাত্মবাদ এবং মূল্যবোধ ছড়িয়ে পড়েছে, প্রজন্মকে তা শেখায়। শেকড়ের সাথে, উৎসের সাথে জড়িয়ে পড়ে এখানে এলেই। যে শেকড় প্রতিনিয়তই কাটতে চায় শত্রুরা। এর অর্থ এই দাঁড়ায়—প্রতি বছরই শেকড়ের সাথে, ইতিহাসের সাথে, মানতবতার মহান পয়গামের সাথে মানুষের সম্পর্ক এবং যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়।

খ. ঐক্য

শরিয়তী বলেন, হজে নিজের দেশ-ভূমি ছেড়ে মানুষ এক জায়গায় একত্রিত হয়। একশ ধরনের পরিবেশ থেকে একশ ধরনের মানুষ এসে উপস্থিত হয় এখানে। এই সম্মিলনটাই তাদের মধ্যে ঐক্যের মর্ম এবং এক্যের চিন্তা প্রতিষ্ঠিত করে দেয়।

পৃথিবীতে অনেক সম্মেলন হয়। একেকটা সম্মেলন আয়োজন করে একই চিন্তা ও চেতনার মানুষ। কিংবা একই গোষ্ঠী ও পরিবেশের মানুষ। এসব সম্মেলন থেকে হজের সম্মেলন পুরোই আলাদা। এখানে হাজার গুণের হাজার মানুষ, হাজার মন ও মননের হাজার ব্যক্তি উপস্থিত হয়। কে কোন দেশের, কেউ খেয়াল করে না। সবাই একসঙ্গে চলে, তাওয়াফ করে, সাঈ করে। পৃথিবীর আর কোন সম্মেলনে এমনটা দেখা যায় না।

গ. কর্মচাঞ্চল্য

শরিয়তী বলেন, হজের যে বিষয়টি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তা হলো সদা কর্মচাঞ্চল্য। হজের প্রস্তুতি থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত কোন অবসর নেই। আর অবসর নেয়াটা উচিতও না।

হজের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যগুলোর সাথে আরও একটি উদ্দেশ্যের দিকে শরিয়তী ইঙ্গিত করেছেন। তিনি বলেছেন, হজ আকিদাগত বিভ্রান্তি থেকেও মুক্তি দেয়। অর্থহীন এবং লক্ষ্যহীন জীবনে অর্থ দেয়, লক্ষ্য দেয়। নিমোক্ত কাজগুলো তাই গুরুত্বপূর্ণ।

নিয়ত

মিকাতে প্রবেশের পূর্বেই নিয়ত স্পষ্ট করে নিতে হয়। নিয়তের মূলকথা কী? মানুষের ঘর থেকে আল্লাহর ঘরের দিকে আহবান। একজন ব্যক্তির ঘর থেকে সকল মানুষের ঘরের দিকে যাত্রা। শ্রেণিবৈষম্য থেকে সমতা এবং সততার দিকে প্রত্যাবর্তন। প্রতিদিনের পরিচিত কাপড় খুলে কাফনের দুটুকরো কাপড় পড়া, দৈনন্দিন জীবন থেকে অন্যরকম এক জীবনে পা দেয়া। এতদিন ছিলো অন্ধকার ও অপূর্ণতার জীবন। এখন দয়ালু পরম মমতাময় আল্লাহর ভরসায় আলোর দিকে যাত্রা। নতুন দৃষ্টি মেলে এখন দেখা শুরু হবে জীবন, মানুষ এবং নিজেকে।

ইহরাম

মিকাতে ঢুকেই দৈনন্দিনের কাপড় পরিবর্তন করে পড়তে হয় ইহরামের শুভ্র লেবাস। কেন? কারণ মানুষের কাপড় মনে করিয়ে দেয় জীবনের রং, শ্রেণিবৈষম্য, চিন্তার মতভিন্নতা। যেই বৈষম্যগুলো মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে বিভেদ সৃষ্টি করে। সীমানা তৈরী করে। দৈনন্দিনের কাপড়ে ‘আমি’ ট্যাগ লেগে থাকে, ‘আমরা’ ট্যাগ লাগানো যায় না। এজন্য শুভ্র লেবাস পড়তে হয়, যেন সবাই ‘আমরা’ হয়ে উঠতে পারি। সাদা-কালো, ধনী-গরীব, উঁচু-নীচুর কোন ফারাক যেন না থাকে।

মিকাত

শরিয়তী মিকাত এবং ইহরামের দর্শন বর্ণনা করে বলেন, মিকাতে ঢুকবার সময় তোমার কাপড় খুলে ফেলো। পরিধান করো সাদা দুটুকরো কাফনের কাপড়। যেন তুমি মৃত্যুর কাছাকাছি, মৃত্যুকেই অনুভব করছো। আপন সত্ত্বাকে বিলীন করে সবাই নতুন একটি রূপ ধারণ করে। এটাই মানুষের রূপ, যে রূপে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মিকাতে ‘আমরা’ জন্ম নেয়ার জন্য সব ‘আমি’ মৃত্যুবরণ করে।’

নিষিদ্ধ জিনিসসমূহ

হজে যা নিষিদ্ধ করা হয়, তা এজন্য যে—ব্যবসা, সামাজিক বৈষম্য, ঘর-বাড়ি, বংশ-মর্যাদা মনে করিয়ে দেয়। মিকাতের আগের জীবন থেকে যখন পরের জীবনে প্রবেশ করা হয়, তখনই নতুন জীবন এবং বিপ্লবের সূচনা হয়। যেখানে তুচ্ছতা, বৈষম্য, বৈরিতা নিষিদ্ধ, কেবল ঐক্যের জয়।

তাওয়াফ-সাঈ

হজ তাওয়াফ এবং সাঈর মাঝে একটা বন্ধন তৈরী করে দেয়। জীবনজুড়ে জন্ম নেয়া বিপরীতমুখী প্রশ্নগুলোরও সমাধান দিয়ে দেয়। বস্তুতান্ত্রিক না আদর্শিক? বুদ্ধিবৃত্তিক না আধ্যাত্মিক? মানুষের ইচ্ছা না আল্লাহর ইচ্ছা? আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল না মানুষের ওপর নির্ভরতা? এখানে, এই হজে, আল্লাহ তায়ালা-ই উত্তর দিয়ে দেন—দুটোই।

সবশেষে এতটুকুই বলতে চাই, শরিয়তী সমুদ্রকে একটি পাত্রে প্রবাহিত করতে চেয়েছেন। আপনার চিন্তাকে জাগ্রত করার জন্য। আপনার প্রথম অনুভবে ফিরে আসার জন্য। তিনি এতকিছু বলেছেন, তার সারাংশ হলো—কা’বা হলো একটি দিক, কেবলা। এটা মানুষের লক্ষবিন্দু নয়। কা’বা তাওয়াফ করলেই হজ শেষ হয়ে যায় না, বরং হজ শুরু হয়। শুরু হয় বাস্তব জীবনে হজ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা এবং অনুভব বাস্তবায়ন করার অন্তহীন যুদ্ধ।

আল জাজিরা অবলম্বনে

লেখক : বিভাগীয় সম্পাদক, ফাতেহ টুয়েন্টি ফোর 

আগের সংবাদলাউড়ের রাজ্যে দেড়দিন
পরবর্তি সংবাদইমামুল হারামাইন জুয়াইনী : মুসলিম সভ্যতার বিকল্পহীন আলেম