ইফতেখার জামিল:
কোন অস্বাভাবিক বিপর্যয় ঘটলে ধর্মীয় অঙ্গনে অনেক প্রশ্ন ও বিতর্ক শুরু হয়। ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, অগ্নিকাণ্ড বা মহামারী। যেসব বিপর্যয়ে মানুষ জীবন-মৃত্যু-ধ্বংস-দুর্ভোগের শিকার হয়, সেসব কার ওপর কেন ঘটছে, মানুষ সেটা জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করে। তাতে দ্বিমত ও বিতর্ক তৈরি হয়, তৈরি হয় দ্বিধা-বিভক্তি। এগুলো কি নিছক প্রাকৃতিক ঘটনা, নাকি এর পেছনে আছে অদৃশ্য অনৈতিকতা, আল্লাহ যেসব অনৈতিকতা দমনের জন্য বিপর্যয় প্রেরণ করেছেন? যদি তাই হয়, তাহলে যারা বিপর্যয়ের শিকার, তারা সবাই কি খারাপ মানুষ?
যদি আল্লাহ প্রকৃতির মাধ্যমে সবসময় হস্তক্ষেপ করেই থাকেন, তাহলে সিরিয়ার মুসলমানদের কেন দুর্ভোগ শেষ হচ্ছে না, গাজা কেন ইজরাইলি বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না? মক্কায় কেন ক্র্যান দুর্ঘটনা সংঘটিত হল, অথচ বাইতুল্লাহ তো আল্লাহর নির্দেশিত নিরাপদ স্থান। যারা ভালো মানুষ, পৃথিবীতে কি তারাই ভালো থাকবে, অথবা অন্যভাবে বললে, খারাপ অবস্থায় আছে বলেই কি আমরা কাউকে খারাপ বলতে পারি? সর্বোপরি করোনা মহামারী কি আমাদের মন্দ কাজের শাস্তি, যদি শাস্তিই হয়, তাহলে মহামারীকে মুমিনদের জন্য রহমত ও কাফেরদের জন্য আজাব বলা হয় কী হিসেবে—এটা কি ডবল ষ্ট্যাণ্ডার্ড নয়?
কোন অমুসলিম দেশে বিপর্যয় ঘটলে মুসলমানরা একে আল্লাহর শাস্তি বলে মন্তব্য করেন, তখন উদারপন্থীরা বলেন প্রাকৃতিক ঘটনার কোন নৈতিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। বিপর্যয়ে তো মুসলমানরাও পড়েন, যদি তাই হয়, তাহলে নিছক বিপর্যয়ে পড়লেই সরাসরি আল্লাহর শাস্তি বলার সুযোগ নেই। মোটকথা বিপর্যয়-নৈতিকতাকে কেন্দ্র করে আছে অনেক কালাম— প্রশ্ন ও সংশয়। এই লেখায় আমরা সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।
শাস্তি ও পরীক্ষা দর্শন : ইসলাম যেভাবে দেখে
অনেকে মনে করেন, ভালো অবস্থায় থাকলেই ভালো মানুষ, অবস্থা খারাপ হলেই বলবো খারাপ মানুষ। পৃথিবীতে ভালো মানুষরাই উত্তম প্রতিদান পাবেন, পক্ষান্তরে অত্যাচারী, দুর্নীতিবাজ ও নীতিহীন মানুষরা পাবেন জাগতিক শাস্তি। মূলত এই চিন্তা ভারতীয় কর্ম দর্শন থেকে গৃহীত— যার মূল অনুমান হচ্ছে, ভালো কাজ ও ইচ্ছায় জাগতিক সুখ পাওয়া যায়, আবার মন্দ কাজ ও ইচ্ছায় পাওয়া যায় জাগতিক দুঃখ-কষ্ট। বস্তুবাদী আধ্যাত্মিকতাতেও এই প্রবণতা পাওয়া যায়— যেহেতু বস্তুবাদে বস্তুই সব, বস্তুতেই শুরু ও শেষ, তাই জান্নাত-জাহান্নামের বদলে পৃথিবীতেই মানুষ ভালো ও মন্দ কাজের প্রতিদান পাবে, এই হচ্ছে বস্তুবাদী আধ্যাত্মিকতার মূল প্রস্তাব।
শেখ ফজলুল করিমের কবিতায় এই তত্ত্ব ফুটে উঠেছে,
‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর!
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনি পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরষ্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে।’
অবশ্য বস্তুবাদীদের অনেকের মতে সুখ-দুঃখ-বিপর্যয় প্রাকৃতিক বিষয়, এর সাথে নৈতিক কার্যকারণগত কোনকিছু সংযুক্ত নয়। প্রাকৃতিক বা বৈজ্ঞানিক কার্যকারণগত মাধ্যমেই সুখ-দুঃখ-বিপর্যয় নির্ধারিত হয়, এগুলো নৈতিক কোন বিষয় নয়। ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের বরাত দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
‘the final causes of all social changes and political revolutions are to be sought, not in men’s brains, not in men’s better insights into eternal truth and justice, but in changes in the modes of production and exchange. They are to be sought, not in the philosophy, but in the economics of each particular epoch.’
— Friedrich Engels, Socialism: Scientific and Utopian (1880)
এর সাথে ইসলামের শাস্তি ও পরীক্ষা দর্শনের মৌলিক কিছু পার্থক্য আছে। ইসলামে বিপদ ও পরীক্ষা ভালো ও খারাপ সবারই আসতে পারে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, জান ও মালের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।’ ( ১৫৫, সূরা বাকারা)
পার্থিব সুখ-দুঃখকে মানুষ খোদায়ী সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টি ভাবতে পারে, এই ইশারা কোরআনেই পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষ এমন যে, যখন তার পালনকর্তা তাকে পরীক্ষা করেন, তারপর সম্মান ও অনুগ্রহ দান করেন, তখন সে বলে, আমার পালনকর্তা আমাকে সম্মান দান করেছেন। আর যখন আল্লাহ তাকে পরীক্ষা করেন, তারপর রিযিক সংকুচিত করে দেন, তখন সে বলে, আমার পালনকর্তা আমাকে হেয় করেছেন। ( ১৬-১৭, সূরা ফাজর ) আল্লাহ এই ভুল ধারণা ভাঙ্গার জন্য পরমুহূর্তেই বলেন, না, এটা অহেতুক ধারণা মাত্র।
ইমাম কাতাদাহ রাহ. উল্লেখিত আয়াতের তাফসীরে বলেন, পার্থিব প্রাচুর্য বেশী থাকলেই এটা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সম্মানের প্রমাণ নয়, আবার দরিদ্রতা থাকলেই আল্লাহর অসম্মান ও অসন্তুষ্টি নয়। আল্লাহর আনুগত্যেই তার সন্তুষ্টির প্রমাণ, নাফরমানিতে অসন্তুষ্টি। ( তাফসীরে তাবারী)।
ইবনে আতাউল্লাহ ইসকান্দারি রহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘তুমি যদি আল্লাহর কাছে তোমার অবস্থান কী, সেটা জানতে চাও, তাহলে দেখো, আল্লাহ তোমাকে কেমন কাজে নিয়োজিত রেখেছেন।’ অর্থাৎ যদি দেখো, তুমি ভালো কাজে নিয়োজিত, তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালো অবস্থানে রেখেছেন। আর যদি দেখো, তুমি খারাপ কাজে নিয়োজিত, তাহলে আল্লাহ তোমাকে খারাপ অবস্থানে রেখেছেন।
বস্তুত সুখ-দুখকে সরাসরি প্রতিদান মনে করা যাবে না ; মানুষ যদি দুনিয়াতেই তার সব ভালো ও মন্দ কাজের প্রতিদান পেয়ে যায়, তাহলে আখেরাত, হিসাব ও শাস্তির কোন মর্ম ও গুরুত্ব বাকি থাকে না। কেননা তারা তাদের প্রতিদান দুনিয়াতেই পেয়ে গেছে, তাহলে স্বতন্ত্রভাবে আখেরাত, হিসাব ও শাস্তির বিশেষ কোন মূল্য থাকছে না। বিপর্যয় ও শাস্তির এই ব্যাখ্যা করলে ছোট নিষ্পাপ শিশুর ক্যান্সার কীভাবে হল, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে কষ্টসাধ্য চেষ্টা করতে হবে না।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আল্লাহর ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য
পৃথিবীতে কোনকিছুই আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে সংঘটিত হয় না। সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সংযুক্ত, কোনকিছুই নিছক আকস্মিক বা প্রাকৃতিক নয়—সবকিছুই আল্লাহর হুকুম ও হেকমতের কাছে বাধ্য। তবে নির্দিষ্ট ঘটনায় আল্লাহর হেকমত ঠিক কী, সেটা আমরা অনেকক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। কেননা আগেই যেমন বলেছি, সুখ ও দুখ উভয়টাই আল্লাহর পরীক্ষা; উভয়ের মাধ্যমেই ভালো বা মন্দ পরিণতি ও প্রতিদান আসতে পারে। কে কোন ঘটনা কীভাবে গ্রহণ করছে, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে।
আমাদের জাগতিক জীবনে যেসব পরীক্ষা, বিপর্যয় ও প্রাচুর্য আসছে, তাকে আকস্মিক বা কারণহীন বলার কোন সুযোগ নেই। এমনকি আমরা যদি নির্দিষ্ট কারণ নাও জানি, তবুও তাকে কারণহীন— অন্য শব্দে বললে আল্লাহর হুকুম ও হেকমতহীন বলা যাবে না। কেননা এতে জাগতিক জীবন অর্থহীনতায় রুপান্তরিত হয়। একইভাবে কোনকিছু নিছক প্রাকৃতিকও হতে পারে না। কেননা এতেও জীবন ও জগত আল্লাহর হুকুম ও হেকমত থেকে মুক্ত হয়ে যায় ; অর্থহীনতায় রুপান্তরিত হয়ে যায় — যা মূলত বস্তুবাদী ব্যাখ্যারই সম্প্রসারিত রুপ।
আল্লাহ বলেন, ‘আমি নভোমণ্ডল, ভুমণ্ডল এবং তাদের উভয়ের মধ্যবর্তী যা আছে তা তাৎপর্যহীন সৃষ্টি করিনি।’ ( ৮৫, সূরা হিজর )
মোটকথা সুখ-দুখকে যেমন বাহ্যিক অবস্থা দেখে ভালো বা মন্দ বলা যাবে না, ভালো-মন্দের পরিণতি হিসেবে দেখা যাবে না, একইভাবে তাকে অর্থহীনও বলা যাবে না। কেননা জীবন-জগতের অনেক ঘটনা বাহ্যিকভাবে ভালো বা মন্দ মনে হলেও আদতে বাস্তবতা বাহ্যিক অবস্থার মতো নাও হতে পারে। পাশাপাশি জীবন-জগতকে আকস্মিক-প্রাকৃতিক বলা মূলত সেগুলোকে মর্ম-অর্থহীন এবং আল্লাহর হুকুম-হেকমতহীন বলারই নামান্তর।
অবশ্য নির্দিষ্ট বিপর্যয়ে মর্ম-অর্থ কখন কী আরোপিত হয়, সেটা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তাই কাউকে সুখে বা দুখে থাকতে দেখলে একে এককাট্টা নেয়ামত বা আজাব বলার সুযোগ নেই। সুখে থাকলে শোকরিয়া আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি দুখে থাকলে সবর করতে বলা হয়েছে।
সাধারণভাবে কাফের-গুনাহগার গোষ্ঠীর বিপর্যয়কে আজাব ও মোমিনের বিপর্যয়কে পরীক্ষা হিসেবে দেখার সুযোগ রয়েছে। তবে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে নিশ্চিত করে আজাব বা পরীক্ষা বলার সুযোগ নেই ; অনিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে। কেননা শেষ অবস্থা আল্লাহই ভালো জানেন, পাশাপাশি কবুলিয়তের বিষয়টিও আল্লাহর কাছে অর্পিত।
বিপর্যয় ব্যাখ্যায় মুমিনের করণীয়
* মুমিন বিশ্বাস করে, কোনকিছুই অর্থহীন বা মর্মমুক্ত নয়। সবকিছুই আল্লাহর হুকুম ও হেকমতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তবে সর্বক্ষেত্রে, বিশেষত বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট করে নৈতিক উক্তি করা ঠিক নয়। কেননা আল্লাহর হুকুম ও হেকমত অনেক বেশী বৈচিত্র্যপূর্ণ।
* মুমিন বিশ্বাস করে, আল্লাহ পৃথিবীতে নেয়ামত ও বিপর্যয় দান করেন। আংশিক প্রতিদান ও পরিণতি দান করেন, তবে চূড়ান্ত হিসাব, প্রাচুর্য ও শাস্তি আখেরাতেই প্রদত্ত হবে। এর আগে দুনিয়াতে বাহ্যিক নেয়ামত ও বিপর্যয় উভয় রকম— ভালো ও মন্দ ব্যাখ্যার সুযোগ রাখে।
* মুমিন বিশ্বাস করে, যেহেতু সে সুখ ও দুখ উভয়টাকে পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে, তাই তার কাছে নেয়ামত ও বিপর্যয় উভয়টিই আল্লাহর রহমত। পাশাপাশি কাফের যেহেতু সুখকে চূড়ান্ত সফলতা ও দুখকে চূড়ান্ত ব্যর্থতা হিসেবে দেখে তাই কাফেরের জন্য সুখ ও দুখ উভয়টিই আজাব।
* মুমিন প্রত্যেক ঘটনা থেকে শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করে। নিজের মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করে। সবকিছুকেই পরীক্ষা মনে করে ; কাজেই মনে করে সবকিছুই মোমিনের জন্য আল্লাহর রহমত। আবার কাফেরের জন্য সবকিছুকেই মন্দ মনে করে, তার সবকিছুকেই আজাব।
* মুমিন বিপর্যয় আসলে তাকে মোকাবেলার চেষ্টা করে। কেননা বিপর্যয় আল্লাহর সুন্নত ও প্রাকৃতিক নিয়মকে অবলম্বন করেই পরিবাহিত হয়, তাই আল্লাহর সুন্নতের মাধ্যমে তাকে মোকাবেলা করা সম্ভব বা তার ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। ইবনে আতাউল্লাহ ইসকেন্দারি যেমন বলেছেন, আপনার নিজের অবস্থান, সক্রিয়তা ও কাজেই বিপদ, বিপর্যয় ও পরীক্ষা আলাদা করতে হবে।
আল্লাহ আপনার নিয়ত ও সক্ষমতাকেই দেখবেন। সক্ষমতার মধ্যে আপনার নিয়ত ও চেষ্টা যত ভালো হবে, আপনি ততবেশী প্রতিদান ও পরিণতি লাভ করবেন।
বি::দ্র:
এ বিষয়ে ফাতেহের এই দুটি লেখা পড়তে পারেন।
১. ইসলাম ও সংক্রমণ : মুসলিম চিন্তার ঐতিহাসিক পাঠ। ২. মহামারী ব্যাখ্যায় মুসলিম বোঝাপড়া