আহমাদ সাব্বির
হ্যাঁ, ওটা আমাদের আসাদই ছিল৷ আমাদের লম্বু আসাদ৷
আসাদের নামের সাথে প্রথম কখন কীভাবে এই ‘লম্বু‘ বিশেষণ যুক্ত হলো তা এক রহস্য৷ অধিকাংশের সন্দেহ—কাজটা আমাদের স্কুলের ক্রীড়া–শিক্ষক কার্তিক স্যারের৷ ছাত্রদের গঠন ও গায়ের রঙের সাথে সঙ্গতি রেখে নানান জনকে নানান খেতাবে ভূষিত করা স্যারের একটা শখ ছিল৷ এটা বড় খবর হলো না, বড় খবর হলো আমাদের আসাদকে এখন সবাই তার ওই বিশেষণ–সহকারেই স্মরণ করে৷ প্রথম প্রথম আসাদ ওই ‘লম্বু আসাদ‘ ডাকে সাড়া দিত না, মৃদু আপত্তি করত৷ কিন্তু সাড়া না দিয়ে আর কতদিন! কাছের মানুষদের অনবরত প্রচেষ্টায় সে নিজেও একসময় ওই ‘লম্বু আসাদে‘ই অভ্যস্ত হয়ে পড়ল৷ ‘লম্বু‘ বিশেষণের প্রবল দাপটের মুখে পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত আসাদের ‘আসাদ‘ হারিয়ে গেল৷ একসময় এমন হলো—আসাদকে ‘লম্বু আসাদ‘ না বললে সে নিজেও সাড়া দিতে ভুলে যেত৷
আসাদের বাবা সম্বন্ধে আমরা কিছু জানতাম না৷ আসাদ নিজেও কিছু জানত না; কিংবা আমাদের বলত না৷ ওর যখন বছর–দুই বয়স, কী এক রোগে ওর বাবা মারা যান৷ তবে তার হাতের ডালপুরি খুব মজাদার হতো বলে শুনেছি গ্রামের মুরব্বিদের মুখে৷
আসাদের মাকে আমরা চিনতাম৷ তিনি খুবই সজ্জন মহিলা ছিলেন৷ সাদাসিধে আলাভোলা কিসিমের একজন গৃহিণী৷ তার যে পুরাতন মরিচা পড়া সেলাই মেশিনটি ছিল সারাদিন তিনি সে মেশিনটির হুইল ঘোরানোতে ব্যস্ত থাকতেন৷ এ থেকেই তার সংসারের চাকা সচল থাকত এবং আসাদের পড়ালেখাও৷
আসাদকে ঘিরে তা যথেষ্ট উঁচুদরের স্বপ্ন আশা ও আকাঙ্ক্ষা ছিল৷ এটা সব মায়েরই থাকে বৈকি৷ তিনি আসাদকে খুবই সাহসী ও শক্তপোক্ত ছেলে ভাবতেন৷ যেখানে অন্য মায়েরা নিজেদের সন্তানদের দুর্বল ক্যাবলাকান্ত মনে করতেন ৷ মূলত তফাতটা এখানেই ছিল আসাদের মায়ের সাথে গ্রামের অন্যান্য মায়েদের৷
আসাদকে নিয়ে গ্রামে খুব মজার একটা গল্প প্রচলিত ছিল৷ গল্পটির এই ব্যাপক প্রচারণার পেছনে আসাদের মায়ের ভূমিকাই ছিল মুখ্য৷ সুযোগ পেলেই তিনি গল্পটি শোনাতেন৷ আমি নিজেও তাঁর মুখে গল্পটি চার বার শুনেছি৷ চতুর্থবার শুনেছি আমার বড়বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে৷ যেকোনো কথা বেশ উপভোগ্য ও রসিয়ে বলার কায়দাটা রপ্ত ছিল আসাদের মায়ের৷ তা ছাড়া আসাদের গল্পটাও ছিল সত্যিই বেশ মজার ও সাহসিকতাপূর্ণ৷
‘শীতের রাইত৷ জ্বরে আমার গা ঠকঠক কইরা কাঁপতে থাহে৷ হারিকেনের আলো বাড়াইয়া আসাদ পড়তাছে৷ আমি জ্বরের চোটে বাইরে বইয়া থাকতে পারি না৷ ভাত খাইয়া ল্যাপের মইদ্যে ঢুকি৷ শুইয়া শুইয়া হুনতে থাহি আসাদ পড়তাছে…।’
এভাবেই তিনি প্রতিবার গল্পটি বলা শুরু করতেন৷ কথা বলবার সময় তাঁর চোখ–মুখ আশ্চর্য ভঙ্গি করত৷ যেন তিনি মুখ দিয়েই কেবল নয়, চোখ দিয়েও কথা বলছেন৷ মাঝে মধ্যে দুই হাত শূন্যে ছুঁড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে নাড়তেন৷ এতে করে তাঁর বর্ণিত গল্প আরও অধিক মাত্রায় উপভোগ্য হয়ে উঠত৷
‘আমি ল্যাপের ভিত্রে শুইয়া আসাদের পড়া শুনতাছি৷ আমার কিছুটা ঝিমুনি মতন আইছে৷ হঠাৎ শুনতে পাইলাম আমাদের ছাদে ধপ্ কইরা একটা আওয়াজ হইল৷ আমাগো বাড়ি তো দেখছই; কেমন ভূতুড়ে বাড়ি! চারধারে খালি জঙলা৷ দিনের আলোতেও ডর লাগে৷ কোন কালের বাড়ি! আমার ভয় হইল— মাথার উপ্রে আবার ভাইঙ্গা না পড়ে!
‘কিছুক্ষন থাইমা শব্দটা আবারও শুনলাম। এইবার মনে হইল কেউ হাঁটতাছে৷ এদিকে দেহি আসাদের পড়ার শব্দ বন্ধ হইয়া গেছে৷ আমি পড়ার আওয়াজ না পাইয়া টেবিলের দিকে চাইলাম, দেহি আসাদ নাই৷ আমি উইঠা দরজা পর্যন্ত গেছি এমন সময় জোরে একটা চিক্কুর কানে আইলো৷ মনে হইল আসাদের চিল্লানি! আমি মই বাইয়া ছাদে উইঠা দেহি আসাদ একখান খুনতা লইয়া খাড়াইয়া আছে৷ আর ওর পায়ের কাছে কী যেন একটা পইড়া আছে৷ কাছে যাইতে দেহি— মানুষ! রক্তে মানুষটার জামা ভিইজ্যা গেছে৷ আসাদের চিল্লানি জোরেই হইছিল৷ চিল্লানি শুইনাই মনে কয়, দেখলাম সুলতান মোল্লার বাড়ির সকলে চইলা আইছে৷ মোল্লা কাছে আইসা হাঁক পাড়ে : “মইরা গেছে নাকি! আসাদ কই? কামডা করল কী ভাইগ্না!” মোল্লার পোলা সুজন কাছে গিয়া মানুষটারে নাড়াচাড়া দিয়া কয়: “মরে নাই মনে হয়, অহনও জান আছে৷ ভ্যান ডাকেন৷ সদরে নিতে হবে৷” আসাদের কপাল ভালো৷ চোরডা সাইরা উঠছিল৷’
আবেগময় ওই বালকবেলায় আমরা বন্ধুরা যখন আসাদের কাছে সাহসে–ভরা এই গল্পের বিস্তর জানতে চাইতাম সে হো হো করে হেসে উঠত৷ বলত, ‘কে জানত যে হালায় চোর! আমি তো ভূত ভাইব্যা পিডানিখান দিছিলাম৷’ একথা বলেই শরীর দুলিয়ে আবারও হো হো হাসির গমক ওঠাত৷ এমনই ছিল আমাদের বন্ধু; লম্বু আসাদ৷
দৈর্ঘ্যে–প্রস্থে আসাদ যে আমাদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে ক্লাস সেভেনে ওঠার আগে এটা আমরা কেউ আঁচ করতে পারিনি৷ সেভেনে ওঠার পর একদিন আমরাও অকস্মাৎ আবিষ্কার করে উঠি—আমাদের দলে আসাদকে বড় বেমানান ঠেকছে৷ সবচেয়ে বেমানান ঠেকছে বাট্টু নান্টুকে৷ স্কুল থেকে ফেরার পথে ওরা দুজন যখন পাশাপাশি হাঁটে দূর থেকে মনে হয় যেন বিশালাকায় জাহাজের পাশে কোনো ডিঙি নৌকা নদীর জলে ভেসে চলেছে৷
‘লম্বু‘ তকমাটা সেই সময়ে আসাদের গায়ে লাগে৷
হঠাৎ করে চেনাজানা আসাদ ‘লম্বু আসাদ‘ হয়ে যাওয়াতে সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন সম্ভবত আসাদের মা৷ তিনি তাঁর বহুল প্রচারিত গল্পে একটি পুনশ্চ জুড়ে দেয়ার সুযোগ পেয়ে যান৷ এরপর থেকে গল্পটা শেষ করেই তিনি বলে উঠতেন— ‘আমার আসাদ আর্মিতে যাইব৷ মাশাল্লাহ! ওর গতর যা হইতাছে! খাড়াইলেই এক চান্সে আর্মিতে নিয়া নিবো৷ সাহস তো অর আছেই!’
আমরা বন্ধুরা রসিকতা করে বলতাম— ‘তুই তো দোস্ত আর্মি হতে পারবি না!’ ওর বিমর্ষ চেহারা দেখে আমাদের করুণা হতো৷ ও মন খারাপ করে বলত— ‘ক্যান?’ আমরা হেসে দিয়ে বলতাম— ‘তুই দোস্ত বেশি লম্বা হয়ে গেছিস৷ আর্মিদের একটা নির্দিষ্ট মাপ আছে৷ তুই সব দিক দিয়া এক্সট্রা৷’
শেষমেষ আমাদের মুখের কথাই সত্য হয়ে যায়৷ আসাদের আর আর্মিতে যাওয়া হয় না৷ গায়ে গতরে ‘বেসাইজ‘ হয়ে গেছে সে–কারণে না; পরের বছর অর্থাৎ ক্লাস এইটে উঠে আমরা যখন নতুন শ্রেণিতে ভর্তির আনন্দে বিভোর তখন একদমই হঠাৎ করে ওর মা মারা গেলেন৷ ওর মায়ের এমন হঠাৎ মৃত্যুতে যদিও পৃথিবীর কোথাও কিছু থমকে যায়নি কিন্তু আসাদের লেখাপড়া থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে৷ মায়ের সাথে হারিয়ে যায় আর্মিতে যাওয়ার স্বপ্নটাও৷
আসাদের মায়ের মৃত্যু আমাদের জন্য খুবই দুঃখজাগানিয়া ছিল৷ অথচ আসাদকে দেখে মনে হচ্ছিল ওর যেন কিছুই হয়নি; ওর জীবন থেকে কিছুই খোয়া যায়নি৷ আমরা ওর মায়ের জানাজায় গিয়েছি, কিছু সান্ত্বনা–বাক্য ওকে বলা উচিত বলে ভাবছি, তখন ও কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠেছিল—‘গল্পটা বলার কেউ আর থাকল না রে!’
হ্যাঁ, এই আমাদের আসাদ৷
মর্গের লোকটি সাদা–বসন একটু সরালে আমি লম্বু আসাদকে শনাক্ত করি৷ যদিও চেহারা দেখে চেনার কোনো উপায় ছিল না৷ কোনো শক্ত আঘাতে তা একপ্রকার থেঁতলে গেছে৷ তবে সেই প্রশস্ত বুক, লম্বা ছয় ফুট দীর্ঘ নিথর দেহ লাশ–কাটা ঘরেও অন্য লাশগুলো থেকে আসাদের স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান রেখেছে৷ এ দলে তাকে বেমানান লাগছে, যেমন বেমানান মনে হতো আমাদের দলে৷
আসাদের মা মারা গেলে আসাদের আর পড়া হয় না; আর পড়তে না পারার কারণে আর্মিতেও ওর যাওয়া হয় না৷ তবু জীবন তো টেনে নিতে হবে৷ জীবনকে সমুখে ঠেলে নেয়ার তাগিদে ওর মায়ের মরচে ধরা সেই সেলাই মেশিনটি বিক্রি করে এবং আরও কিছু পৈতৃক জমি বন্ধক রেখে মুরব্বিদের পরামর্শে একটি ইজিবাইক কিনে নেয় আসাদ৷ আসাদের মেধা নিয়ে আমাদের কোনো সংশয় ছিল না; দুদিনেই সে ইজিবাইক চালানোটা রপ্ত করে নেয়৷ আমরা স্কুল ছেড়ে কলেজে উঠি আর আসাদও আমাদের গ্রামে পাক্কা ইজিবাইক–চালক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে৷ আমরা কলেজ যাবার পথে কিংবা ফেরার পথে সদলবলে ওর ইজিবাইকে চেপে বসি৷ কখনও ভাড়া পরিশোধ করি; অধিকাংশ সময়ই সে সুযোগ আমাদের হয় না৷ আমাদের থেকে আলাদা পরিচয়ে পরিচিত হয়ে উঠলেও আসাদের সাথে আমাদের বন্ধুতায় কোনো খামতি আসে না৷ আমরা পরস্পরের বন্ধুই থেকে যাই৷
আজ বিকালে কলেজ থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে বেরোবার প্রস্তুতি সারছি৷ এরই মধ্যে সুমন্তর ফোনকল আমার সারা শরীর নাড়িয়ে দিয়ে যায়৷ সুমন্ত ও প্রান্ত থেকে বলে ওঠে— ‘নির্বাচন অফিসের সামনে ট্রাকের সাথে এক ইজিবাইকের সংঘর্ষে চালকসহ ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে এবং শোনা যাচ্ছে ইজিবাইক–চালক আমাদের বন্ধু লম্বু আসাদ৷’
সুমন্তের কথায় কেবল সন্দেহ ছিল যে চালক আমাদের বন্ধু আসাদ হতে পারে৷ কিন্তু তবুও ওই দুর্ঘটনায় দুমড়ে–মুচড়ে যাওয়া ইজিবাইক চালকের স্থানে কেন যেন আমি আসাদের মুখটাই কল্পনা করে ওঠি৷ আর তাতেই আমার মনোজগতে অসহনীয় তোলপাড় শুরু হয়ে যায়৷ আবার নিজেকে প্রবোধ দিই : আসাদ তো পাক্কা চালক। এভাবে চলন্ত ট্রাকের সামনে গিয়ে সে পড়বে কেন!
এভাবে দ্বিধাগ্রস্ত আমি সদর হাসপাতালে এসে পৌঁছি এবং একসময় কাঁপা কাঁপা পদবিক্ষেপে লাশকাটা ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াই৷ বুক চাপড়ে হাত–পা ছুড়ে ক্রন্দনরত নারী–পুরুষ দেখি৷ বুঝে নিই— এরা নিহতের স্বজনই হবেন৷ স্বজন ছাড়া আর এমন করে কাঁদে ক’জন!
সবুজ শার্ট পরিহিত একজন আমাকে ভেতরের ঘরে আহ্বান জানায়৷ আমি তার পিছু নিই৷ কিছুক্ষণ হাঁটার পর লোকটি আমাকে যেখানে দাঁড় করিয়ে দেয় সেখানে সারবাঁধা ছয়টি মৃতদেহ দেখতে পাই৷ লোকটি শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে একটি মৃতদেহের চেহারা থেকে সাদা বসন সরালে আমি নিশ্চিত হই—দুমড়ে–মুচড়ে যাওয়া ইজিবাইকটির চালকের স্থানে সত্যি সত্যিই আসাদ বসে ছিল৷ আমাদের বন্ধু লম্বু আসাদ৷
বাইরের ক্রন্দনরত নারী–পুরুষের সাথে আরও একটি নতুন কণ্ঠস্বর যুক্ত হয় এবং আমি বুঝি— সেটা আমারই কণ্ঠস্বর৷ কিন্তু আমি বুঝি না—আসাদের মৃত্যু আমাকে কাঁদায় কেন? তবে কি ও আমার স্বজন ছিল? ছিল কি আমারই আপনজন?
ক্রমে ঘন হতে থাকে কান্নার স্বর৷ দূরে, লাশকাটা ঘরের বাইরে কদমে ছাওয়া গাছটিতে ডেকে ওঠে একটা ডাহুক পাখি৷ ডাহুকের ডাকে বিষাদ ছড়িয়ে পড়ে সদর হাসপাতালের আকাশ পেরিয়ে আসাদের রক্তে স্নাত হওয়া মহাসড়কের বিস্তির্ণ আকাশে।
লেখক : তরুণ গল্পকার