
মুনশী নাঈম:
প্রায় শতবর্ষ জ্বলতে থাকা একটি নক্ষত্র নিভে গেল ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২। যে নক্ষত্র জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন ইসলামি বিধি-বিধান বয়ান করে পৃথিবীর এই কন্টকাকীর্ণ পথ আলোকিত করার জন্য। তিনি বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম স্কলার এবং বর্ষীয়ান আলেমেদ্বীন শায়খ ইউসুফ আল কারজাভি। আধুনিক উদ্ভূত নানা জটিল সমস্যার সাবলীল ও গভীর ইজতিহাদভিত্তিক সমাধানমূলক দেড় শতাধিক গবেষণা-গ্রন্থের রচয়িতা তিনি।
স্থানীয় সময় সোমবার দুপুরে কাতারের রাজধানী দোহায় তার ইন্তেকাল হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। স্থানীয় ও রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম তার ইন্তেকালের বিষয়টি নিশ্চিত করে। একইসাথে শায়খ কারজাভির ছেলে কবি আব্দুর রহমান ইউসুফ টুইটবার্তায় বাবার মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে লিখেন, ‘থেমে গেছে দৌড়, ঘোড়া থেকে নেমে গেলেন ঘোড়সওয়ার।’ শায়খ কারজাভির ফেরিভাইড ফেসবুক পেজ ও টুইটার একাউন্ট থেকেও তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। শায়খের পেজে লেখা হয়, ‘ইমাম শায়খ ইউসুফ কারজাভি ইন্তেকাল করেছেন। তিনি তার গোটা জীবন ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠায় উৎসর্গ করেছেন।’
জন্ম, শৈশব ও শিক্ষা
মহান মনীষী শায়খ ড. ইউসুফ আল কারজাভি ১৯২৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মিসরের উত্তর নীলনদের তীরবর্তী সাফাত তোরাব গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই গ্রামেই দাফন করা হয় মিশরের সর্বশেষ সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ বিন হারিস আল-জুবাইদিকে। মাত্র দুই বছর বয়সে তার বাবা ইন্তেকাল করেন। ফলে তার লালন-পালনের দায়িত্ব পড়ে চাচার ওপর। শৈশব মিসরেই কাটান।
মাত্র ১০ বছর বয়সে শায়খ কারজাভি কুরআনে কারিমের হাফেজ হন। এরপর আল আজহার কারিকুলামে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন। উচ্চ মাধ্যমিকে জাতীয় মেধায় দ্বিতীয় হন। প্রাচীন ইসলামী বিদ্যাপীঠ আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উসুলুদ দ্বীন অনুষদ থেকে অনার্স করেন ১৯৫২-৫৩ সালে। ১৮০ জন ছাত্রের মধ্যে তিনি হন প্রথম। ১৯৫৪ সালে আরবি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক করেন। ৫০০ ছাত্রের মধ্যে তিনি হন প্রথম। আরবি ভাষায় স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা করেন ১৯৫৮ সালে। ১৯৬০ সালে উলুমুল কুরআন এবং সুন্নাহর উপর পিএইচডি করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীর সম্মান সহ ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তার থিসিসের বিষয় ছিল: সামাজিক সমস্যা সমাধানে জাকাতের প্রভাব।
কর্মজীবন
কারজাভি কিছুদিন মসজিদে খতিব এবং শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। পরে মিসরের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘Institute of Imams’ এর পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ পান। পরে তাকে আল আজহারের ইসলামি সংস্কৃতি বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে প্রকাশনা তদারকি করার জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৬১ সালে তিনি কাতার চলে আসেন। তাকে কাতারের মাধ্যমিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ডিন হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৩ সালে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের বীজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় কাতার কলেজ অফ বয়েজ অ্যান্ড গার্লস। কারজাভিকে ইসলামি বিভাগ দেখাশোনার জন্য এই কলেজে নিয়ে আসা হয়। কাতার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে তিনি ১৯৭৭ সালে এর ‘শরীয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের প্রতিষ্ঠাকালীন ডিন নিযুক্ত হন। ১৯৯০ পর্যন্ত তিনি এখানে কর্মরত থাকেন এবং একই বছর তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সীরাত ও সুন্নাহ গবেষণা কেন্দ্র’। ১৯৯০-৯১ সালে আলজেরিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের Scientific Council-এর চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন । ১৯৯২ সালে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সীরাত ও সুন্নাহ গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর হিসেবে পুনরায় কাতার ফিরে আসেন।
পুরস্কার
শায়খ ইউসুফ কারাজাভি ১৪১১ হিজরি, ১৯৯০ সালে ইসলামী অর্থনীতিতে অবদান রাখায় ব্যাংক ফয়সল পুরষ্কার লাভ করেন। ইসলামি শিক্ষায় অবদানের জন্য ১৪১৩ হিজরি, ১৯৯৪ সালে মুসলিম বিশ্বের নোবেল খ্যাত কিং ফয়সাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন । ১৯৯৬ সালে মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানের কাছ থেকে লাভ করেন বিশিষ্ট একাডেমিক গিভিং অ্যাওয়ার্ড। ১৯৯৭ সালে ব্রুনাই সরকার তাকে ‘হাসান বাকলি’ পুরষ্কারে ভূষিত করে। সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক কৃতিত্বের জন্য ১৯৯৯ সালে লাভ করেন আল-ওয়াইস পদক, সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২০০৮ সালে কাতার রাজ্য থেকে লাভ করেন ইসলামিক স্টাডিজের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রশংসা পুরস্কার। ২০০৯ সালে পান মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কার। ২০১০ সালে জর্ডানের মেডেল অব ইন্ডিপেন্ডেন্স পুরস্কার পান জর্ডানের রাজা থেকে।
লেখালেখির ময়দানে
আধুনিক উদ্ভূত নানা জটিল সমস্যার সাবলীল ও গভীর ইজতিহাদভিত্তিক সমাধানমূলক শতাধিক গবেষণা-গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। তার গ্রন্থগুলো প্রকাশের পরপরই পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে জ্ঞানী, গবেষক, বোদ্ধামহল ও সাধারণ মানুষের কাছে সেগুলো ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। তার গ্রন্থ সংখ্যা অন্তত ১৭০টি।
তার কিছু বইয়ের নাম
الحلال والحرام في الإسلام; مئة سؤال عن الحج والعمرة والأضحية; كتاب فتاوى معاصرة; تيسير الفقه للمسلم المعاصر; من فقه الدولة في الإسلام; فقه الزكاة ; فقه الطهارة; فقه الصيام; فقه الغناء والموسيقى; فقه اللهو والترويح; دراسة في فقه المقاصد; في فقه الأقليات الإسلامية; الفقه الإسلامي بين الأصالة والتجديد; الاجتهاد في الشريعة الإسلامية; المدخل لدراسة الشريعة الإسلامية; الفتوى بين الانضباط والتسيب;
তার লেখার বেশকিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এক. তার লেখা ইসলামি তুরাছ তথা কুরআন সুন্নাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। আবার তিনি সমকালীন যুগকেও ভুলেননি। দুটোর সমন্বয় করেছেন। দুই. তার লেখায় রয়েছে ইলমি নিরীক্ষণ, বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাভাবনা এবং ইসলাহি দৃষ্টিভঙ্গি। তিন. তার লেখা ঐতিহ্য এবং সাম্প্রদায়িক বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি পশ্চিম বা প্রাচ্য থেকে আমদানি করা মতবাদ নির্ভরতা থেকে মুক্ত ছিল। চার. তার লেখায় থাকতো সহজ মধ্যপন্থা। বাড়াবাড়িও থাকতো না, ছাড়াছাড়িও থাকতো না। পাঁচ. তার লেখা পড়লেই পাঠক বুঝতে পারে তার উষ্ণতা ও আন্তরিকতা। বলা হয়, তার লেখায় থাকে ফকিহের সুক্ষ্মদৃষ্টি, সাহিত্যিকের মনোহারী বাক্য, দাঈর উষ্ণতা এবং মুজাদ্দিদের দৃষ্টিভঙ্গি।
ফতোয়া প্রদানে
কারজাভির সবচে প্রোজ্জ্বলতম দিক ফিকহ। যে সম্মেলন বা সিম্পোজিয়ামেই তিনি বক্তৃতা দিতে যেতেন, ইসলাম বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন তিনি। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ইসলামি বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু। তার নিকট প্রচুর চিঠিপত্রও আসতো। আসতো ফতোয়ার জিজ্ঞাসা। এত এত চিঠি ও জিজ্ঞাসা আসতো, তিনি সবগুলোর উত্তরও দিতে পারতেন না। কখনও ফোনেও তিনি ইসলামি জিজ্ঞাসার জবাব দিতেন।
তিনি কিভাবে ফতোয়া দিতেন তা বর্ণনা করেছেন فتاوى معاصرة গ্রন্থে। তার সারাংশ হলো—তিনি সবসময় সহজ করতে চান, কঠিন করতে চান না কিছু। তবে অবশ্যই তা দলিল-প্রমাণের আলোকে। কারো অন্ধ অনুসরণ না করে গ্রহণযোগ্য মাজহাবগুলোর আলোকে তিনি ফতোয়া দিতেন। মানুষের ফতোয়ার জবাব দিতেন তাদের যুগের ভাষায়। যেটা তাদের জন্য ভালো হবে, সেটাই বলতেন। যেটা উপকার করবে না, সেটা বলতেন না। ফতোয়া দিতেন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে সবদিক স্পষ্ট করে।
দাওয়াহ ও ইসলাহ
কারজাভি যাই করেছেন, তার প্রধান লক্ষ্য ছিল দাওয়াহ এবং ইসলাহ। তিনি তার কৈশোরে, ষোলো বছর বয়সেই দাওয়াতের কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন জিনিসকে দাওয়াতের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
তার দাওয়াতের ঐতিহ্যবাহী একটি মাধ্যম ছিল মসজিদের মিম্বর। তিনি যখন উসুলুদ দিনের ছাত্র, তখন একটি মসজিদে খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। পরবর্তীতে মসজিদটির নাম ‘মসজিদে শাইখে ইউসুফ’ হয়ে যায়। জুমার নামাজে এখানে হাজার হাজার মুসল্লি উপস্থিত হতো। ১৯৫৬ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মিশরের ধর্ম মন্ত্রণালয় তাকে কায়রোর জামে জামালিক মসজিদে খতিবের দায়িত্ব দেয়। এতেও বিশাল জমায়েত হতো। আবদে নাসের তার খুতবা দেয়া নিষেধ করার আগ পর্যন্ত তিনি এতে খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
কাতার এসেও তিনি মসজিদের মিম্বরকে দাওয়াতের কাজে লাগান। তিনি উমর ইবনুল খাত্তাব মসজিদে খুতবা দিতেন। তার খুতবা কাতার টিভিতে সম্প্রচার করা হতো। তেমনিভাবে ঈদুল আজহা এবং ঈদুল ফিতরেও খুতবা দিতেন। বিশেষ করে কায়রোর আবেদিন স্কয়ারে খুতবা দিতেন। এছাড়াও জুমার পর তার সাপ্তাহিক দরস হতো। প্রতি সোমবার সন্ধ্যায়ও দরস হতো। প্রতি রমজানে আসরের পর শেখ খলিফা হামাদের মসজিদে দরস দিতেন। ত্রিশবছর এখানে দরস দিয়েছেন। তারাবির পরও একটা দরস নিতেন।
দাওয়াতের মাধ্যম হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছিলেন মিডিয়াকেও। রেডিও-টিভিতে তার অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতো। যেমন তার প্রসিদ্ধ একটি অনুষ্ঠান—মিশকাতুন নবুওয়াহ। তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানও করতেন। করতেন সাওয়াল-জওয়াব বিষয়ক অনুষ্ঠানও। কাতার রেডিও শুরু হওয়ার পর তিনি ‘নুর-হেদায়া’ নামক একটি অনুষ্ঠান শুরু করেন। কয়েকদশক চলার পর তার নিজস্ব ব্যস্ততায় তা ছেড়ে দেন। কাতার টিভিতে প্রতি শুক্রবার সন্ধায় প্রচারিত হতো তার অনুষ্ঠান—হাদয়ুল ইসলাম। এটিও কাতার টিভির সূচনা থেকেই চলছে। এটি কাতার, বাহরাইন, আমিরাত এবং পূর্বাঞ্চলের দর্শকরা দেখে থাকে।
অডিও-ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার পাশাপাশি পাঠযোগ্য গণমাধ্যমেও সরব ছিলেন তিনি। তিনি বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রবন্ধ লিখতেন, গবেষণা প্রকাশ করতেন। মিসরের আজহার, নুরুল ইসলাম, মিম্বারুল ইসলাম এবং দাওয়াহ পত্রিকায়, দামেশকের ‘হাজারাতুল ইসলাম’ পত্রিকায়, কুয়েতের মুজতামা এবং আরাবি পত্রিকায়, বৈরুতের ‘শিহাব’ পত্রিকায়, ভারতের ‘বা’সুল ইসলামি’ পত্রিকায় কাতারের দোহা এবং উম্মাহ পত্রিকায়, রিয়াদের দাওয়াহ পত্রিকায়, আবুদাবির মিনারুল ইসলাম পত্রিকায় এবং লেবাননের ‘মুসলিমুল মুআসির’ পত্রিকায় তিনি লিখতেন। তিনি সাপ্তাহিক এবং দৈনিক পত্রিকাতে লিখতেন, সাক্ষাৎকার দিতেন। বলা যায়, তিনি ছিলেন বর্তমান জগতের ইসলাহি ধারার প্রধান আলেম।
সাংগঠনিক খেদমত
বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন শায়খ কারজাভি। মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকদের অভিজাত সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলার্সের (International Union of Muslim scholars) সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। একইসাথে জর্ডানের রয়্যাল অ্যাকাডেমি ফর ইসলামিক কালচারাল অ্যান্ড রিচার্জ (Royal academy for Islamic culture and research), ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (OIC), রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী এবং ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টার, অক্সফোর্ডের সম্মানিত সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আয়ারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফাতওয়া অ্যান্ড রিচার্জের (European Council For Fatwa and Research) প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
এছাড়াও তিনি ছিলেন কাতারের সুপ্রিম কাউন্সিল ফর এডুকেশনের সদস্য, কাতারের ফতোয়া কর্তৃপক্ষের সদস্য, কাতার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ব্যাংক, বাহরাইন এবং করাচিতে ফয়সাল ইসলামিক ব্যাংক, আল- সুইজারল্যান্ডের তাকওয়া ব্যাংক, দাওয়া সংস্থার বোর্ড অফ ট্রাস্টির সদস্য, আফ্রিকার ইসলামিক ফিকহ একাডেমি, খার্তুমে কেন্দ্রিক, ইসলামিক ফিকহ একাডেমির সদস্য। মক্কার মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ, জেদ্দায় ইসলামিক কনফারেন্স সংস্থার ফিকহ কাউন্সিলের একজন বিশেষজ্ঞ, ইসলামাবাদের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। তিনি ছিলেন কায়রোতে ইসলামিক ইকোনমিক সোসাইটির একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, কাতারের সভ্যতায় মুসলিম অবদানের উপর গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক বোর্ডের সদস্য, কুয়েতে জাকাতের আন্তর্জাতিক শরিয়া বোর্ডের সভাপতি এবং ইসলামিক সভ্যতার উপর গবেষণার জন্য রয়্যাল একাডেমির সদস্য (জর্ডানে আল আল-বাইত ফাউন্ডেশন)। তিনি কুয়েতে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক চ্যারিটেবল অর্গানাইজেশনের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং এর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন।
কারাবরণ
ইখওয়ানুল মুসমিমিনের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে তাকে বেশ কয়েকবার কারাবরণ করতে হয়। প্রথমবার ১৯৪৯ সালে রাজকীয় আমলে। এরপর প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসেরের আমলে তিনবার। ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে প্রথমবার। একই সালের নভেম্বর মাসে দ্বিতীয়বার। এবার তিনি ২০ মাস কারাগারে কাটান। শেষবার ১৯৬৩ সালে।
দেশত্যাগ ও কারাদণ্ডাদেশ
মিসরীয় জাতিসত্ত্বার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও শেষ জীবনের বড় একটি অংশ শায়খ কারজাভি কাতারে বসবাস করেছেন। মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণেই দেশ ত্যাগে বাধ্য হন তিনি। ২০১৫ সালে মিসরের একটি আদালত শায়খের অনুপস্থিতিতেই তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ জারি করে। এর আগে ১৯৬১ সালে তিনি প্রথম বারের মতো কাতারে পাড়ি জমান।
বিবাহ ও সন্তানাদি
শায়খ কারজাভি দুইটি বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী মিসরীয়। তার নাম ইসআদ আব্দুল জাওয়াদ। তাকে বিয়ে করেন ১৯৫৮ সালে। প্রথম স্ত্রীর ঘরে তার তিন মেয়ে ও চার ছেলে জন্মগ্রহণ করে। মেয়েদের নাম: ইলহাম, সিহাম, উলা ও আসমা। ছেলেদের নাম: মোহাম্মদ, আব্দুর রহমান ও ওসামা। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম আয়েশা। তিনি মরক্কান বংশোদ্ভূত।
তার ইন্তেকালে বাংলাদেশী আলেমদের অভিব্যক্তি
দেশের বিশিষ্ট ইসলামিক ব্যক্তিত্ব শায়খ আহমাদুল্লাহ লিখেন, বিশ্ববিখ্যাত ইসলামিক স্কলার ড. ইউসুফ আল-কারদাবী মৃত্যু বরণ করেছেন। মহান আল্লাহ তাঁকে রহমতের চাদরে আবৃত করুন। তিনি ছিলেন সমকালীন প্রভাবশালী চিন্তক ও লেখকদের অন্যতম। তাঁর চিন্তা ও রচনা দ্বারা যুগ যুগ ধরে মুসলিম উম্মাহ ও মানবজাতি উপকৃত হবে ইন-শা-আল্লাহ। আল্লাহ তাঁর ভুলত্রুটি মার্জনা করে তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের অধিবাসী হিসেবে কবুল করুন। আমীন।
ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী ও মহাসচিব মুফতী ফয়জুল্লাহ এক বিবৃতিতে বলেন, শায়খ কারজাভি সমসাময়িক বিশ্বে ইসলাম ও মুসলমানদের দিকনির্দেশনামূলক মতামত প্রদানের জন্য ছিলেন বিশ্বব্যাপী সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র। এছাড়াও তিনি ছিলেন আধুনিক নানা জটিল মাসআলার সমাধানমূলক শতাধিক গ্রন্থ রচয়িতা। প্রখ্যাত এই মনীষী আলেম কাতারে তিন দশকের নির্বাসিত জীবনেও জ্ঞান-গরিমা, গবেষণা ও তথ্য এবং তত্ত্বে সমহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন। আমরা মরহুম এই আলেম মনিষীর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই বিবৃতিতে বলেছেন, আল্লামা ইউসুফ আল কারজাভি তার গোটা জীবন ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠায় উৎসর্গ করেছেন। মুসলিমদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন শায়খ কারজাভি। আধুনিক উদ্ভূত নানা জটিল সমস্যার সাবলীল ও গভীর ইজতিহাদভিত্তিক সমাধানমূলক শতাধিক গবেষণা-গ্রন্থের রচনা করেন তিনি। এছাড়াও তিনি ইসলামী অর্থনীতিতে অসামান্য অবদান রাখেন। মহান রব্বুল আলামিন আল্লামা ইউসুফ আল কারজাভির সকল নেক কাজকে কবুল করে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন।