
আহমাদ রিফআত:
ইতিহাসের দর্পণে
ইতিহাসের ছিন্নপত্র আর কালের আবর্তন থেকে সময়ের বার্তা ও শতাব্দীর আহ্বান বুঝতে ভুল করলে যেমন অতীতের হাতে মার খেতে হয়, তেমনি মার খেতে হয় বর্তমান ও ভবিষ্যতের হাতেও ! এই অবনমনের শতাব্দীতে মাথা উত্তোলনের প্রয়াস মুসলিম দুনিয়ায় কি কম হচ্ছে? শহরে-নগরে-বন্দরে গাওয়া হচ্ছে নব উত্থানের গান। স্লোগানে-স্লোগানে পুলকিত হচ্ছে চারপাশ। কিন্তু কোথায় জাগরণ? কোথায় সফলতার স্বর্ণ শিখর? বরং দেখা যাচ্ছে বরাবরের মতো এবারেরও পরাজয় বাস্তবতা। তা হলো—বারবারই আমরা ইতিহাস পাঠে ভুল করছি। অনেকে ইতিহাসের একান্ত প্রয়োজনীয়তা, যথার্থতা ও বস্তুনিষ্ঠতা অস্বীকারও করছি। কিন্তু সময়ের পালাবদল আর কালের অমোঘ আবর্তন আমাদের ঐ একই বার্তা বারবার দিয়ে যায়। শুনিয়ে যায় অতীত চেনার একই পয়গাম। বলে যায়— অতীত থেকে শিক্ষা লাভের ব্যথাভরা আর্তনাদ। ইতিহাস তো সময়ের স্বচ্ছ দর্পন। কালের আবর্তেও যা অম্লান রয়ে যায়। ইতিহাস— বর্তমান ও অতীতের মধ্যে এক অন্তহীন সংলাপ। আত্মসমালোচনার বস্তুনিষ্ঠ মাধ্যম।
এখানে আমাদের আরেকটি ভুল হলো, আমরা সবসময়ই ইতিহাসের প্রকৃতি বুঝতে ভুল করি। প্রকৃত ইতিহাস তো সেটাই যার মধ্যে থাকবে অতীত আবর্তন। যা ঘটেছিল। কেন ঘটেছিল। সমস্যার ইতিবৃত্ত। মানব সভ্যতার ধারাবাহিক ও সত্যনিষ্ঠ ঘটনাচক্রের ভেতর-বাহির। এসবের স্বরূপ প্রকটিত হবে ইতহাসের পাতায় পাতায়। ইতিহাসের শিক্ষা এটাই, সে কখনো বর্তমান বাদে অতীতে নিয়ে মত্ত হতে বলে না। ইতিহাস বলে না অতীত নিয়ে আত্মভোলা হতে। ইতিহাস বলে—অতীত গৌরবগাঁথা থেকে প্রেরণা নিতে। আদর্শ খুঁজে নিয়ে বর্তমান সাজাতে। ইতিহাস বলে—অতীতকে বর্তমানে এনে ভবিষ্যতের দিশা খুঁজে নিতে। অতীত ব্যার্থতার গ্লানি মুছে সময়ের পয়গাম আত্মস্থ করতে। ইতিহাস বলে— অতীতের নিঃশ্বাস থেকে বর্তমানের রসদ সংগ্রহ করতে। এজন্য ব্যথাভরা কণ্ঠে আবারো বলছি—বর্তমানকে বুঝতে এবং সময়ের লাগাম নিজ হাতে নিতে অবশ্যই অতীত বুঝতে হবে। হাঁটতে হবে অতীত ইতিসের দেখিয়ে দেয়া পথে। মনে রাখবেন, ইতিহাসের অপ্রিয় সত্য এটাই, ভবিষ্যৎ তারাই সাজাতে পারবে, যারা বর্তমানের উত্থান-পতন অতীতের কালেভদ্রে খুঁজে নিতে পারবে। কারণ, ইতিহাসই সেই বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন, যাতে কোনো সভ্যতা নিজেই তার উত্থান-পতনের অতীত ব্যাখ্যা পেয়ে থাকে।
ইতিহাস কি ও কেন?
১. ইতিহাস কেবল একটি জাতির উন্নতি ও উত্তরণের সোপান-ই নয়; ইতিহাস জাতিগত অবক্ষয়ের পিষ্টতা থেকে নিস্কৃতির হাতিয়ারও। আজ আমাদের ইতিহাস বিমুখতাকে পুঁজি করেই শত্রুপক্ষ তাদের সবচেয়ে সফল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে অপপ্রচারকে।
২. আজকের পৃথিবীতে মুসলিম উম্মাহর পতনে জন্য নিজেদের অতীত-বিস্মৃতি অন্যতম প্রধাণ কারণ। প্রকৃতপক্ষে ইতিহাস একটি জাতির শেকড়ের ন্যায় । যে শেকড় বেয়ে বেয়ে কোনো জাতি পৌঁছে উন্নতির শেখরে। আর এই ইতিহাস বিমুখতা যেমন শিকড়চ্যুত হওয়া, তদ্রুপ শিখরে উন্নিত হওয়ারও প্রথম বাধা। ইতিহাস অধ্যায়ন আমাদের যেমন শিকড়ের সন্ধান দেবে, তদ্রুপ দিকনির্দেশনা দেবে শেখরে পৌঁছার। উজ্জ্বল ও সমুউজ্জ্বল ভবিষ্যত গঠন করার প্রেরণা যোগাবে।
৩. আমাদের এই ভূমণ্ডল এবং এতে বিদ্যমান প্রকৃতির সব কিছু সুনির্দিষ্ট অপরিবর্তনীয় নীতি-নিয়ম মেনে চলে। এগুলো আল্লাহ তায়ালার চিরন্তন ও শাশ্বত রীতি। অটল ও অপরিবর্তনীয় নীতি। ইতিহাস পাঠ হল—প্রত্যেকে এসকল খোদায়ী রীতি ও নিয়মের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তাআলার চিরন্তন রীতি ও নীতি অনুধাবন করতে পারব। পারবো অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সঠিক ও সুন্দর ভবিষ্যত নির্মাণ করতে। হ্যা! একথা সত্য—নিয়মের যেমন ব্যাতায় ঘটে, ব্যতিক্রম হয় সময়ের কোন কোন পালাবদলের, তদ্রুপ কখনো কখনো ঐশী রীতিরও ব্যতিক্রম ঘটে। তা আল্লাহ্ তায়ালাই ঘটান। এই ব্যতিক্রম ঘটাও চিরচেনা নীতির অন্তর্ভুক্ত। আর আল্লাহ্ তায়ালা এসবকিছু করেন, শিক্ষা গ্রহণ বা আপন বড়ত্বের প্রতিফলের জন্য। সেটাও এক ঐশী নিয়মের অধীনে। তবে ঐশী যে সূত্রটি সেখানেও পরিলক্ষিত হয়—নিয়ম ও নিয়মের ব্যাতায়; এ দুয়ের মাঝে পার্থক্যটা উনিশ-বিশ হয়ে থাকে। এর বেশি নয়।
৪. পৃথিবীর সবকিছুর যেমন নির্ধারিত রীতিনীতির অধীনে আবর্তিত হয়, তদ্রুপ জাতিগোষ্ঠীর উত্থান-পতন ও অবস্থার পরিবর্তনও হয় আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত রীতিনীতির অধীনে। সর্বযুগের সকল শক্তিধর বা সুপার পাওয়ারের উত্থান-পতন সবকিছুই এই রীতি নীতির অধীনে আবর্তিত। সুতরাং ইতিহাসে যে কোনো জাতি, পৃথিবীর যে কোনো কালে, যে কোনো ভূখণ্ডে উত্থান-পতনের যে সুনির্ধারিত রীতিনীতি অনুসরণ করছে দিনশেষে তার পরিণতি সে ভোগ করবেই। হয় এর সুফল ঘরে তুলবে বা পরাজয়ের গ্লানি ললাটে মেখে ক্ষণিক বা স্থায়ী বিদায় নেবে। অতীতের এই হাজারো পরিণতি এবং সফলতা ও বিফলতার সূত্র তুলে ধরা হয় ইতিহাস অধ্যায়ের পাতায় পাতায়। সেখানে অবর্তিত হয় হাজার বছরের উত্থান-পতন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, সদর-অন্দর বাজিয়ে বাজিয়ে, খুঁড়ে-খুঁটে বিভিন্নভাবে উত্থাপিত হয় সেই অতীতমাখা পাঠগুলো।
৬. আপনি যখন অতীত ইতিহাস পাঠ করছেন এর বাস্তবতা হলো- প্রকারান্তরে আপনি আগত ভবিষ্যতের অলিখিত ঘটনাবলী বিস্তারিত পাঠ করছেন। কারণ সময়ের ঘটনাপ্রবাহ তো সেই রীতিনীতি ও নিয়মের অধীনে আবর্তিত হবে যে নিয়ম ও রীতিনীতি প্রবর্তিত হয়েছিল অতীতের ঘটনাগুলো। কারণ এগুলো পালাবদলের মহান আল্লাহ তাআলার সুনির্ধারিত রীতি-নীতি। আপনি আল্লাহ্-র নিয়ম নীতিতে কোন ব্যত্যয় পাবেন না। এজন্য ইতিহাস পাঠ করলে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন, কোথায় আপনি পা রাখবেন এবং কোথায় রাখবেন না। প্রকারান্তরে ইতিহাস আপনাকে ভবিষ্যতেরে গন্তব্য নির্ধারণ করে দেবে।
৭. জাগ্রত জাতির নিদর্শন হলো নিজেদের ইতিহাস পাঠ করা। ইতিহাস আমাদেরকে আমাদের জাগ্রত করে,অতীতের সঙ্গে যুক্ত করে।
৮. ইতিহাস কেবলই শিক্ষা গ্রহণ বা ইবরাত হাসিলের জন্য নয়। ইতিহাস দ্বীনি দাওয়াতও বটে। এজন্য একজন দায়ী ইলাল্লাহ সঠিক ইতিহাসের মাধ্যমে জাতিকে ইসলামের দাওয়াতও দিয়ে থাকেন। যা সময়ের সকল কঠিন অবস্থায় তাদের হিম্মতকে শাণিত করে। সাথে সাথে ভুলে যাওয়া বা ভুলে থাকা শিক্ষাকে পুণর্জীবিত করে। ইসলামের সুমহান ও সমুজ্জ্বল দুই আলোকবর্তিকা—দাওয়াত ও জিহাদের প্রতি উৎসাহিত করে। শিক্ষা দেয় আত্ম-বিসর্জেনের। এছাড়াও ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে পূর্ববর্তীদের জীবন ও ইসলামের প্রচার-প্রসারে তাদের আত্মত্যাগের বিমূর্ত ছবি অঙ্কন করা থাকে। যুগে যুগে কিভাবে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, গৃহযুদ্ধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতাগুলো ইসলামের সত্যতাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে তার স্পষ্ট পাঠ তুলে ধরা হয় ইতিহাসের দর্পণে। ইসলামে প্রকৃত রাষ্টনীতির মূলকথা কী, কোন নিয়মের আবর্তে কী হয়, এবং এর অন্যথা ঘটলে কী পরিণতি হয় সককিছুই থাকে ইতিহাসের আয়নায়। তেমনি ইসলামের সুমহান মূলনীতির, কর্ম বা মৌনবিরোধিতার কারণে উম্মতে মুসলিমা কী কী অস্থিরতার শিকার হয়েছিলো এসব পাঠগুলোই থাকে বাস্তব ইতিহাস পাঠে।
আদর্শ ইতিহাস কেমন হবে?
উত্থান-পতনই এই পৃথিবীর অতীত-জীবনের ছন্দ। ইতিহাস যেমন কোন জাতির জন্য সাময়িক অপমান, কালেভদ্রে সেটাই তাদের জন্য বিজয় পাঠ। ইতিহাস পাঠের সময় বিষয়টি মনে রাখবেন—যে জাতি তার পেছনের ইতিহাস সংরক্ষণ করে না, পড়ে না এবং বিন্দুমাত্র চর্চা করে না, সে জাতি কোনদিনই মাথা উঁচু করে করে দাঁড়াতে পারবে না। আর এটিই ইতিহাস পাঠের মূল রহস্য ও চাবিকাঠি। পূর্বেও বলেছি- ইতিহাস তো সেটাই যার মধ্যে থাকবে অতীত আবর্তন। যা ঘটেছিল। কেন ঘটেছিল। সমস্যার ইতিবৃত্ত। মানব সভ্যতার ধারাবাহিক ও সত্যনিষ্ঠ ঘটনাচক্রের ভেতর-বাহির। এসবের স্বরূপ প্রকটিত হবে ইতহাসের পাতায় পাতায়। এজন্য একটি আদর্শ ইতিহাসে যেমন প্রেক্ষাপট, কারণ, ফলাফল বর্ণিত হবে, তদ্রুপ সেখানে বিধৃত হবে বর্তমান সময়ে ঘুরে দাঁড়াবার বিস্তারিত বিবরণ। এসবকিছু ছাড়া ইতিহাস পাঠ হবে অন্তঃসারশূন্য। রুহু বিহীন। মৃত।
ইতিহাস পাঠ: প্রয়োজনীয়তা ও পদ্ধতি
ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম হলো—ইতিহাস বারবার পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। কখনো তার বাহ্যিক সুরত-অবয়ব ভিন্ন হলেও তার ফলাফল এবং ঘটনাপ্রবাহ প্রাই একই রকম হয়ে থাকে। একটু কষ্ট করে ভেতরটা তলিয়ে দেখলেই মনে হবে এ যেন নতুন কোনো ঘটনাই নয়। এজন্য আমরা যখন অতীতের ইতিহাসগুলো পাঠ করবো এবং বর্তমান সময়ের সাথে মিলিয়ে পূর্বের কোন ঘটনাকে বিশ্লেষণ করবো, তখনই আমরা বস্তুনিষ্ঠ বাস্তব ইতিহাস পাঠে সক্ষম হবো। আমাদের মনে রাখতে হবে—ইতিহাস পাঠে সবসময় প্রয়োজন সজাগ দৃষ্টি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হবে আদি ইতিহাসের কোন অধ্যায়টি আমাদের বর্তমান ইতিহাসের কোন অধ্যয়ের সাথে বা নির্দিষ্ট কোন ঘটনার সাথে সম্পূর্ণ বা আংশিক সামঞ্জস্যশীল। দুয়ে দুয়ে মিলে গেল উদ্ধার করতে হবে সময়ের পাঠ। তাদের অতীত এবং আমাদের বর্তমান পরিণতি। বের করে আনতে হবে ফলাফল। টেনে আনতে হবে সম্ভাব্য দিকসমূহ। মূলত এভাবে ইতিহাস পাঠ করলেই সেটা হবে অতীতের দর্পণে বর্তমান সময়ের ইতিহাস পাঠ। আর, ইতিহাস পাঠের পূর্বে যদি এ বিষয়গুলো আপনার মাইন্ড সেটআপ করে নিতে পারেন তাহলেই আপনি বর্তমান ইহিতাসকে সহজেই পাঠ করতে পারবেন। উদ্ধার করতে সক্ষম হবেন সময়ের গুপ্তবার্তা। অতীত ইতিহাসের ছন্দে-ছত্রে যদি দেখতে পান বর্তমান ঘটনাটির ফ্ল্যাশব্যাক কল্যাণকর ও মঙ্গল জনক হয়, তবে স্পষ্ট সে পন্থাটিই অবলম্বন করতে হবে যে পথ অবলম্বন করেছিলেন আমাদের সালাফ-পূর্ববর্তীগণ। পক্ষান্তরে অতীতের দর্পণে বর্তমান যদি হয় লজ্জাজনক ও পরাজয় আশ্রিত, তাহলে আমরা পূর্ববর্তীদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবো। সেসময়ের কতক কোন উপায়ে অমোঘ পরিণতি থেকে বেঁচে ছিলেন, কোন আদর্শকে মানদণ্ড ধরে বিরত থেকেছেন সেটা গ্রহণ করবো। তাদের পরাজয় ও লজ্জার পথ পরিহার করব।
ইতিহাস পাঠের গুরুত্ব
উপরে উল্লিখিত পদ্ধতিতে ইতিহাস পাঠ করলে আপনার সত্তা ধীরে ধীরে ইতিহাস প্রাণবন্ত ও সজীব হয়ে উঠবে। তরতরে ইতিহাস আপনার টানটান উত্তেজনা বৃদ্ধি করবে। অতীতের মিশেলে নতুন কিছু করা বা সময়ের দিক-দর্শন খুঁজে বের করতে আপনি হবেন সরব। খুঁজে ফিরবেন জাগরণ। সবসময় মনে রাখবেন—আমাদের ইতিহাস পাঠ হবে প্রক্রিয়াশীল হওয়ার জন্য। কেবল সান্ত্বনা লাভ, নিছক ঘটনাকে জানা বা বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ ইতিহাসবিদ হওয়ার জন্য নয়। এ উদ্দেশ্যে ইতিহাস পাঠ করা মোটেও উচিত নয়। ইতিহাস পাঠের সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। তা হল—ইতিহাসের ফাঁকে ফাঁকে, সকল ছত্র-ছন্দে ইবরত ও শিক্ষা অনুসন্ধান করা। এটি কুরআনি তালিম। পবিত্র কুরআনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পূর্ববর্তীদের ইতিহাস-কাসাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ থেকে ইতিহাস পাঠের গুরুত্বও অনুধাবন করা যায়। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে পূর্ববর্তীদের যেসকল ঘটনাবলী উল্লেখ করেছেন, তার একটি উদ্দেশ্য হলো—যাতে মুসলমানগণ অতীত জাতিগুলোর সাথে আল্লাহর চিরাচরিত এবং অবধারিত রীতিনীতি ও কানুনগুলো জানতে পারে। তাদের ভবিষ্যৎ-দর্পণে কোন ঘটনা সংঘটিত হবার পূর্বেই যেন অতীতের আলোকে তার সঠিক তালিম ও পরিণাম জেনে সঠিক পন্থা ও কর্মনীতি গ্রহণ করতে পারে। নিশ্চিত হতে পারে তার অমোঘ পরিণতি সম্পর্কে। ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব এজন্য, তার থেকে সময়ের পাঠ হাসিল কার যায়। তবে একজন ইতিহাসের ছাত্রের মনে রাখা উচিত—নির্দিষ্ট ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনার, সময়ের প্রতিটি ইতিহাসের যাবতীয় সকল দিক পাঠ করা ছাড়া তা থেকে পূর্ণ উপকৃত হওয়া এবং শিক্ষাগ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ, কুরআনের ভাষ্যমতে ইতিহাস হল তাদাব্বুর ও তাফাক্কুরের জন্য। গভীর চিন্তা ভাবনা এবং হিতোপদেশ গ্রহণের জন্য। এ লক্ষ্যকে সামনে রাখলেই একটি পূর্ণ এবং বিস্তৃত পাঠের প্রয়োজন দেখা দেয়।
আঞ্চলিক ইতিহাস ও জাতীয় ইতিহাসের পার্থক্য
‘আঞ্চলিক ইতিহাস’ ইতিহাসের একটি স্বতন্ত্র পাঠ। গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। ভৌগলিক দৃষ্টিকোণ থেকে অঞ্চল বা স্থানীয় ইতিহাস বললে বুঝায়—কোন সম্প্রদায়, ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট অঞ্চলের, নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ইতিহাসসমূহ। আঞ্চলিক ইতিহাস পরিচিতি আরো সহজ করে বললে, অঞ্চলিক ইতিহাস হল—স্থানীয় ইতিহাসের এমন সুবিন্যস্ত পাঠ যা থেকে অতি সহজে ঐ অঞ্চলের ইতিহাসের ছোট–বড় নানান ঘটনা প্রবাহের পাঠ ও মর্ম বিশ্লেষণ উপলব্ধি করা যায়। যেখানে নির্দিষ্ট সভ্যতার উত্থান ও পতন, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পট পরিবর্তন, অগ্রগতি সামান্য ব্যবধানে আবার পশ্চাৎগতি সবগুলোই ফুটে ওঠে। আর এ বিষয়গুলো জাতীয় ইতিহাসের তুলনায় আঞ্চলিক ইতিহাস থেকে বেশি ফুটিয়ে তোলা যায়। এছাড়া আঞ্চলিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, অসংখ্য বীর, নারী-পুরুষের আত্মদান। অসামান্য অত্মত্যাগের নানান গুণগাঁথা। অদম্য মনোবলের স্মৃতিকথা। স্থানীয় ইতিহাসে থাকে নির্দিষ্ট এলাকার ছোট-বড় ঘটনা। জানা যায় ঘটনাগুলোর প্রকৃত সদর-অন্দর। এর সাথে সাথে এক মলাটে লিপিবদ্ধ হওয়ায় এর আবেদন কয়েকগুণ বেড়ে যায়। নির্দিষ্ট অঞ্চলের ঘটনাগুলো ইতিহাসের মাপকাঠিতে ওজন করে সময়ের নির্দিষ্ট মেসেজ খুঁজে নেয়া যায়।
আঞ্চলিক ইতিহাসের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য
১. বিশাল দেশ বা ব্যাপক এলাকার পরিবর্তে ক্ষুদ্র এলাকাকে নির্দিষ্ট করে সেই এলাকার ইতিহাস অন্বেষণ করা হয় অঞ্চলের ইতিহাস গ্রন্থে। যার ফলে এমন ইতহাসও এখানে স্থান পায় যা বৃহৎ দেশ বা ব্যপক এলাকার ইতিহাস আলোচনা করলে বাদ পড়ে যেত।
২. বিশাল জনপদ বা একাধিক জনগোষ্ঠির পরিবর্তে একটি একক জনপদ ও নির্দিষ্ট গোষ্ঠির আলোচনা করা হয় আঞ্চলিক ইতিহাসে। ফলে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠির স্বভাব-অভ্যাস, ন্যাচার-প্রকিতি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারা জানা যায়।
৩. আঞ্চলিক ইতিহাসে আর্থ-সামাজিক বিবর্তন, শিল্প–স্থাপত্য, লোকসংস্কৃতি, স্থানীয় শাসকের ইতিবৃত্ত প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের সুবিন্যস্ত আলোচনা ঠায় পায়। তাই সেগুলোর মানদণ্ডে বিচার করা যায় তাদের বিজয় ও ভাগ্যের দুর্গতির লক্ষণসমুহ।
৪. সুবিশাল প্রামাণ্য ইতিহাসে সব জায়গার পরিচিতি থাকে না। গুরুত্ব বেশি না থাকলে বা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা না ঘটলে সেই স্থানের বিবরণও থাকে না। সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক ইতিহাস পাঠে এই অভাব পূরণ করে।
৫. জাতীয় ইতিহাস রচনার সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই আঞ্চলিক ইতিহাসকে শুধুমাত্র উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তার থেকে বিশেষ পাঠ, শিক্ষা ও মর্ম তুলে ধরা হয় না। ঐ এলাকার ঘটনা প্রবাহকেও কোন ঐকিহাসিক পটপর্যালোচনার আলোকে বিশ্লেষণ করা হয় না। কিন্তু অঞ্চলিক ইতিহাসে সবগুলোর সুযোগই রয়েছে।
৬. আঞ্চলিক ইতিহাসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল—অঞ্চলিক ইতিহাসে স্থানীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতির অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রায় সকল চালচিত্র তুলে ধরা হয়। একই সাথে সময়ের বিবর্তনে কোন কারণে সেসকল ঐতিহ্য মুছে গেল এবং কোন কারণে নব্য সংস্কৃতি আমদানি হল সেটা বুঝে সচেতন হওয়া যায়। জানা যায়, কালের বিবর্তন ছোয়ায় এসকল সৌধ মুছে বিলিন হওয়ার হৃদয়-বিদারক কাহিনি। সহজেই অত্মস্থ করা যায় উন্নতি-অবনতির। হিসেব কষা যায় প্রাপ্তি ও লসের।
৭. আঞ্চলিক ইতিহাসের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের রাজনৈতিক উত্থান পতনের দীর্ঘ কাহিনির ধারা বর্ণনা এবং সময়ের সাথে সাথে তার বহুমুখী চেহারা একসাথে দেখে নেয়া যায়। ফলে তার থেকে সহজেই একটি নির্দিষ্ট পতন বা উত্থানের রহস্যগল্প টেনে আনা যায়।
৮. আঞ্চলিক ইতিহাসের মাধ্যমে যেহেতু জনগোষ্ঠীর স্বভাব-অভ্যাস, ন্যাচার-প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যায়, তাই এর থেকে তাদের অর্জন ও কলঙ্কের ইতিহাস জানার পাশাপাশি এসকল অবদান-কলঙ্কের পেছনের কারণ বিশ্লেষণ করা যায়। সময়ের পালাবদলে তাদের ক্ষতি-বিসর্জনের কারণগুলিও ফুটে উঠে এই অঞ্চলিক ইতিহাসের পত্র-পাতায়। তাছাড়া জাতীয় ইতিহাস হল, অঞ্চলিক ইতিহাসেরই সমষ্টি। তাই প্রকারন্তরে স্থানীয় ইতিহাস চর্চা মূলত জাতীয় ইতিহাসকেই সমৃদ্ধ করে থাকে।
বিষয়টি এভাবে বুঝতে পারেন—যখন আমরা গোটা বিশ্বের মানচিত্রের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, তখন আমরা গোটা বিশ্বেরই সামান্য পরিচয় পেয়ে থাকি। যা একক দেশ বিবেচনায় খুবই অল্প। কিন্তু যখন কোন দেশ বা জেলা কিংবা এলাকার মানচিত্রে তাকাই তখন ঐ এলাকার আরও বিশদ তথ্য পাই।
ইতিহাসের ক্ষেত্রেও একই কথা। তবে এখানে একটা পার্থক্য মাথায় রাখবেন—ইতিহাস কেবল মানচিত্রই নয়, আপনি তাকিয়ে থাকবেন, দেখে-পড়ে মন জুড়াবেন। বরং ইতিহাস হল পরিচিতি, তথ্য ও বিশদ বর্ণনার গুদামঘর। সময়ের আবর্তে যেখান থেকে আপনি খুঁজে নেবেন কালের রসদ। আর পাঠ গ্রহণের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন একটি নির্দিষ্ট ইতিহাস। নির্দিষ্ট সময়সীমা। নির্দিষ্ট এলাকার দীর্ঘ ঘটনা প্রবাহ। এদিক থেকে আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা করাই কাম্য।
এখানে আপনি আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করবেন, যখন আমরা স্কুল-কলেজ বা মাদ্রাসা-বিদ্যালয়ে ইতিহাস চর্চা করি, প্রায়শই ইতিহাসের সকল বৃহত্তর, নাটকীয় এবং অকল্পনীয় ঘটনাগুলি আলোচনা করা হয়ে থাকে। যা ছাত্র-ছাত্রীগণ পরিক্ষার ভয়ে নিছক কিচ্ছা-কাহিনি হিসেবেই গ্রহণ করে। পড়ে থাকে। ফলে একসময় এই পশ্চাদপদতার কারণে দিনদিন দেশ ও জাতি ইতিহাস সম্পর্কে আরো গাফেল হয়ে থাকে। এখানে একটি বিষয়টি খুব মনে রাখবেন—একটি সচল জাতিকে পঙ্গু করতে বা হিজড়ায় রূপান্তর করতে এ ধরনের নাটকীয় বা আকাশ কুসুম ইতিহাস চর্চা চরম ভূমিকা রাখে। অপর দিকে দানব বিশ্বের চলমান শিল্পায়নের গুনগাঁথা, দু’ দু’ বার বিশ্বযুদ্ধের নাটকীয় ইতহাস এবং লুণ্ঠনে গড়া বৃহৎ অর্থনৈতিক দাপট এবং পশ্চিমের একতরফা উন্নত ও অগ্রগতির ইতহাস চর্চা যোগায় হতাশার রসদ। এজন্য সময়ের প্রয়োজন ও দাবী হল নাটকীয়তা বর্জন করে বাস্তব ইতিহাস তুলে ধরা। যা হবে সহজ। এক মলাটে। অল্প কথায়। এদিক থেকে আমি মনে করি আঞ্চলিক ইতিহাস সময়ের সবচে উপযোগী এন্টিডোট হিসেবে কাজ করবে। কারণ একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ইতিহাস নিয়ে আপনি আলোচনা করলে সহেজেই এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করতে পারবেন, এই বৃহৎ ঘটনাগুলিতে এই ছোট শহরের মানুষগুলো কি কি পদক্ষেপ নিয়েছিলো? তারা কিভাবে টিকে ছিল? সেখানে বসবাসকারীদের উপর কিরূপ প্রভাব ফেলেছিল? এজন্য আমি বলবো—আঞ্চলিক ইতিহাস হবে ইতিহাস চর্চার নতুন দিগন্ত। জ্ঞানের নতুন সূর্যদয়।