মাহমুদ আব্দুল্লাহ :
এমন একজন মানুষের কথা ভাবুন যিনি পৃথিবীর জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে দু-দুটি শাস্ত্রের জনক হিসেবে পরিচিত ৷ এছাড়া তার খ্যাতি আছে ইতিহাস রচনায়, দক্ষতা ছিল ভাষা ও কাব্যে এবং জানতেন গণিত, দর্শন, ইসলামী শরিয়া ও ফিকহ সহ আরো নানা শাস্ত্র। বলছিলাম চতুর্দশ শতকের মহান মনীষী ইবনে খালদুনের কথা।
ইবনে খালদুন, পুরো নাম হচ্ছে ওলী উদ্দীন আবু যায়েদ আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে খালদুন আল হাদরামী। চতুর্দশ শতকে উত্তর পশ্চিম আফ্রিকায় বিখ্যাত খালদুন পরিবারে জন্ম আবদুর রহমানের। ডাক নাম আবু যায়েদ হলেও বংশের প্রতিষ্ঠাতা খালদুনের সাথে সম্পৃক্ত করে বিশ্বব্যাপী তাঁর পরিচিতি ইবনে খালদুন নামে। অধুনা তিউনিসিয়ার তিউনিস শহরে ১৩৩২ সালের ২৭ মে মোতাবেক পয়লা রমজান ৭৩২ হিজরিতে তার জন্ম।
ইবনে খালদুন নামে তার পরিচিতি হলেও এই খালদুন নামের ব্যক্তিটি তার কততম পূর্বপুরুষ তা নিশ্চিত করে জানা যায় না। তবে নামের শেষে হাদরামী উপাধী আমাদেরকে তাদের আদি নিবাস সম্পর্কে ধারণা দেয়। অষ্টম খৃস্টাব্দে আজকের ইয়েমেনের হাদরামাউত এলাকা থেকে তাদের পরিবার ভাগ্যের সন্ধানে পাড়ি জমান সুদূর স্পেনে, যখন সদ্য আরবদের হাতে স্পেন বিজিত হয়েছে। ধারণা করা হয় পূর্বপুরুষ খালেদের নামই স্প্যানিশ উচ্চারণে পরিণত হয় ‘খালদুন’এ। সাধারণ পরিবার থেকে খালদুনদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে নবম খৃস্টাব্দের শেষে, যখন এই পরিবারের এক সন্তান কুরাইব ইবনে খালদুন স্পেনের শেভিলায় একটি রাজ্যস্থাপন করেন। খালদুন পরিবারের যথার্থ প্রতিষ্ঠাতা তিনি।
১২৪৮ খৃস্টাব্দে খালদুন পরিবার স্পেনের বাস্তু ত্যাগ করে উত্তর আফ্রিকায় পাড়ি জমান, তখন স্পেনে পতন ঘটেছে আল মুয়াহহেদ পরিবারের। আর ক্রমশ খৃস্টান আক্রমণে আতংকিত বহু স্প্যানিশ মুসলিম পরিবার উত্তর আফ্রিকায় বসবাস শুরু করেছে। সেখানেও খালদুন পরিবারের খ্যাতি ও পরিচয় ছিল, সেই সূত্রে হেফসী সাম্রাজ্যের দরবারে চাকরির মাধ্যমে তিউনিসিয়ায় তারা স্থায়ী হন। এই বাস্তু পরিবর্তনেরও শতবর্ষ পর ১৩৩২ এ আবদুর রহমান তথা ইবনে খালদুনের জন্ম।
ইবনে খালদুনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী মুসলিম রীতিতে। হিজরী চতুর্দশ শতকে স্পেন ছিল মুসলিম জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রস্বরূপ, বসবাস ও বেড়ে ওঠা আফ্রিকায় হলেও পূর্বপুরুষের সূত্রে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল স্পেনের জ্ঞানচর্চার সাথে। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ঐতিহ্য ও নিজস্ব মেধা ইবনে খালদুনকে গড়ে তুলেছিল যুগের অনন্য প্রতিভা হিসেবে। তাঁর পিতা মুহাম্মাদ ছিলেন পরিবারের অন্যান্য পুর্বপুরুষ থেকে ব্যতিক্রম, রাজনীতিতে নিরাসক্ত বিদ্যান ব্যক্তি। ইবনে খালদুনের শিক্ষার শুরু হয় পিতার হাত ধরেই।
এছাড়া শৈশবে কুরআন শেখেন মুহাম্মদ ইবনে সাদ ইবনে বোররালের কাছে। শামসুদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে জাবির ছিলেন হাদিসের শিক্ষক। মালেকি ফিকহের পাঠ গ্রহণ করেন মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ, মুহাম্মদ আল কাসীর ও মুহাম্মদ ইবনে আবদুস সালামের নিকট। এছাড়া তিনি দক্ষতা অর্জন করেন যুক্তিবিদ্যা, দর্শন ও গণিতে। একজন সত্যিকার জ্ঞানপিপাসুর শিক্ষাজীবন কেবল নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষাজীবনেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ইবনে খালদুন তার নিয়মতান্ত্রিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি পেশাগত জীবনেও সর্বদা জ্ঞানীদের সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন। যে অভিজ্ঞতা তাকে পরবর্তী জীবনে বিপুল ও বিস্তৃত পরিমণ্ডলে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে।
ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ জীবন
১৩৪৮-৪৯ সালে স্পেন ও আফ্রিকা অঞ্চলে আঘাত হানে ব্ল্যাক ডেথ খ্যাত প্লেগ মহামারী, ইবনে খালদুনের বর্ণনায়, যার আক্রমণে নগরের পর নগর এমনভাবে বিরান ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে যে, বহু এলাকার মানচিত্র পরিবর্তন হয়ে যায়, বহু রাজত্বের পতন ঘটে। এই মহামারীতে ইবনে খালদুন পিতা মাতা উভয়কেই হারান, যখন তার বয়স মাত্র সতেরো বছর। এই আকস্মিক দুর্যোগের ফলে তাঁর স্বাভাবিক জ্ঞানার্জনে বাধা সৃষ্টি হয়, ইবনে খালদুন যাত্রা শুরু করেন জ্ঞানীদের সান্নিধ্যলাভের মাধ্যমে বিদ্যার্জনের দীর্ঘ পথে। এসময়ে মারিনি সম্রাটের দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
পারিবারিকভাবে খালদুন পরিবারের পেশা ছিল বিভিন্ন সম্রাটের দরবারে মন্ত্রীত্ব ও পরামর্শদান। ইবনে খালদুনও তার ব্যতিক্রম নন, পেশাগত জীবন শুরু করেন ইবনে তাফারজীন নামক এক গোত্রপ্রধানের সাহিবে আলামা হিসেবে।
তবে একজন উচ্চাকাঙ্খী তরুণ হিসেবে চিঠিপত্রের শুরুতে কল্যাণকামনার বাণী লেখার কাজে (সাহিবে আলামা) ইবনে খালদুন সন্তুষ্ট ছিলেন না। সিদ্ধান্ত নেন জন্মস্থান তিউনিস ত্যাগ করবেন। এক সৈন্যদলের সাথে মিশে গিয়ে ১৩৫২ তে তিউনিস ত্যাগ করে প্রথমে আশ্রয় গ্রহণ করেন মুরাবিত গোত্রের ধর্মীয় শিক্ষকদের নিকট, সেখান থেকে সিউটা, কাফসা, বিস্করা, বগী ইত্যাদী শহরে ভ্রমণ করে পুনরায় অধুনা মরক্কোর ফেজে মারিনি সম্রাটের দরবারে যোগ দেন। কিন্তু সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে সম্রাট আবু ইনান তাকে কারারুদ্ধ করেন, যা দীর্ঘায়িত হয়েছিল দেড় বছর পর্যন্ত।
১৩৫৮ তে আবু ইনানের মৃত্যুর পর মুক্তি পেয়ে যোগ দেন হেফসী সম্রাট আবু সলীমের দরবারে, এখানে তাকে বিচারকের পদ দেয়া হয়। তার পতনের পর ১৩৬২ তে গমন করেন তৎকালীন একমাত্র স্প্যানিশ মুসলিম রাজ্য গ্রানাডায়, সেখানকার প্রধানমন্ত্রীর সাথে সখ্যতা গড়ে উঠলেও স্বাভাবিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের ফলে দরবারে বেশিদিন কাটানো হয়ে ওঠে না। ১৩৬৫ ফ্রেব্রুয়ারিতে যোগ দেন বগীর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।
পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে সবসময় দরবার সংশ্লিষ্ট কাজেই ইবনে খালদুন নিজেকে জড়িয়েছিলেন। কিন্তু সেসব দরবারকে কখনোই নিজের জায়গা হিসেবে বিবেচনা করেননি, ফলে স্থায়ীভাবে কোন একটি রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত না হয়েও উত্তর আফ্রিকার রাজনীতিতে প্রভাবশালী ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও এর ফলে তিনি বারবার মুখোমুখি হয়েছেন বিপদের, এমনকি ১৩৭৫ এ যখন তার প্রাণ সংহার হওয়ার আশংকা সৃষ্টি হলো তখন আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন আফ্রিকান বেদুইন গোষ্ঠী বনী আরিফের। তাঁরা তাকে সপরিবারে থাকার জন্য কেনআতু বনী সালামা নামে এক দুর্গ ও গ্রাম জায়গীর প্রদান করে।
দীর্ঘ দুই যুগের সদা-বিক্ষুব্ধ জীবন পেরিয়ে এসে ইবনে খালদুন এখানকার সুস্থির জীবনে মনোযোগী হন তার রচনার দিকে। সিদ্ধান্ত নেন বিশ্বের ইতিহাস রচনা করবেন নিজস্ব মতামতের আলোকে। যে বিশ্ব-ইতিহাসের ভূমিকাস্বরূপ রচনা করেন আল মুকাদ্দিমা, যা তাকে পরবর্তীতে এনে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি আর শ্রদ্ধা।
পারিবারিক জীবন
ইবনে খালদুন আত্মজীবনী লিখে যাওয়া সত্ত্বেও তাঁর পারিবারিক জীবন সম্পর্কে নিশ্চিত করে তথ্য পাওয়া যায় খুব কমই। কারো কারো ধারণা তিনি বিয়ে করেছিলেন জীবনের শুরুতে তিউনিসিয়া ত্যাগের পূর্বেই, আবার কারো ধারণা(৩) দেশ ত্যাগের পর বিস্করায় অবস্থানকালে বিয়ে করেছিলেন। স্ত্রী পুত্রের ব্যাপারে সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও এতটুকু নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে মিশরে অবস্থানকালে ইবনে খালদুন তাদেরকে মিশরে আনিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, তারা আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরের কাছে জাহাজডুবিতে মারা যায়। এই দুর্ঘটনার পর ইবনে খালদুন কিছুকাল বৈরাগ্য অবলম্বন করেন। এটি ১৩৮৪ সালের কথা।
নতুন সফর শুরু
দীর্ঘ সাত বছর সময়ে কেলআতু বনী সালামা আর তিউনিস মিলিয়ে রচনা করেন তার অমূল্য গ্রন্থ কিতাবুল ইবার। চতুর্দশ শতকের বিশ্বে মিসর হয়ে উঠছিল সভ্যতা ও ক্ষমতার কেন্দ্র। একজন রাজনীতির মানুষ হিসেবে স্বদেশে নিজের চারপাশে গড়ে ওঠা ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তি পেতে এবং স্বচক্ষে সভ্যতার নিদর্শনসমূহ দেখতে ইবনে খালদুন সিদ্ধান্ত নেন তিউনিসিয়া ত্যাগ করে যাবেন মিশরে। ১৩৮৩ তে ইবনে খালদুন আজীবনের জন্য নিজ দেশ ও জন্মভূমি ত্যাগ করে রওনা দেন নতুন দেশের উদ্দেশ্যে, এটাই ছিল পরিবার ও স্বদেশের সাথে তার সর্বশেষ সাক্ষাৎ।
পরিবর্তিত পরিবেশে নতুন দেশ হওয়া সত্বেও কায়রোর জীবনে তিনি দ্রুতই প্রবেশ করেন। ততদিনে তার রচনার খ্যাতি সাগর পেরিয়ে মিশরেও ছড়িয়েছে। সদ্য ক্ষমতায় আসা রাজা মালিক জহির বারকুক তাকে প্রস্তাব দেন মাদরাসায়ে জহিরিয়ায় অধ্যাপনার দায়িত্ব গ্রহণের। তার কিছুদিন পর গ্রহণ করেন মিশরের মালিকি মাজহাবের প্রধান বিচারকের পদ। মাঝে কয়েকবার পদচ্যুত হওয়া সত্তেও আমৃত্যু তিনি সে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন বিদ্যায়তনের অধ্যাপনায় এ সময় তিনি নিজেকে যুক্ত করেন। তার মধ্যে মাদরাসায়ে জহিরিয়া, মাদরাসায়ে কৌমিয়া, সারাগাতমিশিয়া মাদরাসা ও বাইবার মাদরাসা উল্লেখযোগ্য।
১৪০০ খৃস্টাব্দে ইবনে খালদুন ভ্রমণ করেন দামেশক, ফিলিস্তিন, জেরুসালেম, বেথেলহেম ইত্যাদী প্রাচীন শহর। এর আগে ১৩৮৭ সালে হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা মদীনা সফর করেন। এভাবে স্পেন থেকে উত্থিত হওয়া এক মনীষা সে যুগের প্রায় সকল সভ্যতার কেন্দ্র ভ্রমণ করেন।
১৪০০ খৃষ্টাব্দের শেষে তাতারিরা সিরিয়ায় আক্রমণ চালালে মালিক জহির বারকুক তাতারি সম্রাট তৈমুরলঙ্গ এর বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন, যে বাহিনিতে ইবনে খালদুনও ছিলেন। এই সময় উভয় বাহিনির সন্ধি প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ইবনে খালদুনের সাথে তৈমুরলঙ্গ এর সাক্ষাৎ ঘটে। যদিও শেষে তাতার বাহিনী সেই সন্ধিচুক্তিকে অমান্য করে। কিন্তু তৈমুরলঙ্গের অনুরোধে ইবনে খালদুন তার সারাজীবনের সফরনামা লিপিবদ্ধ করেন। (১)
ইবনে খালদুনের মনীষা
ইবনে খালদুনের রচনাবলীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত রচনা আল মুকাদ্দিমা। এটি স্বতন্ত্র কোন গ্রন্থ না হওয়া সত্ত্বেও এর খ্যাতি তাঁর জীবদ্দশাতেই ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘তারিখে ইবনে খালদুন’ নামের বিশ্ব ইতিহাস লেখার ভূমিকা হিসেবে এই গ্রন্থটি তিনি লেখেন। কিন্তু পরবর্তীকালে তার বিষয়ের অভিনবত্ব ও নতুনত্বের কারণে এটির গ্রহনযোগ্যতা মূল গ্রন্থকে ছাড়িয়ে যায়।
এখানে ইবনে খালদুন তার বিস্তৃত ভ্রমণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে মানবসমাজ বিষয়ে তার মৌলিক ধারণাসমূহ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। প্রাণী ও জগতের উদ্ভব থেকে শুরু করে মানব সমাজের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, সভ্যতার সৃষ্টি সম্পর্কে বিস্তারিত ও শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে তিনিই প্রথম লিপিবদ্ধ করেন৷ এ বিষয়ে আরব চিন্তাবিদ শাকিব আরসালান বলেন, ‘ইবনে খালদুনের পূর্বে জ্ঞান-ইতিহাসে আমরা এমন কোন জ্ঞানসাধক বা দার্শনিকের খোঁজ পাই না, যিনি সমাজের গতি প্রকৃতি ও সমাজের উত্তরণ অধঃপতনের স্বাভাবিক নীতিমালা, যাকে আমরা সমাজবিজ্ঞান বলি, সে বিষয়ে কোন পৃথক পুস্তক রচনা করেছেন।’ (২)
আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে সরাসরি উল্লেখ না করলেও তা গঠনের নানান উপাদান সম্পর্কে আল মুকাদ্দিমায় বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। জাতীয়তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র তৈরী, রাষ্ট্রে জনশক্তির প্রয়োজন ও প্রভাব, উৎপাদনের ধারাবাহিকতায় কৃষক, মজুর ও শিল্পের অবস্থান, বিজয়ী ও বিজিতের পারস্পরিক সম্পর্ক, রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ইত্যাদি প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনা তার এই মুকাদ্দিমাকে আজও বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ পাঠকের আগ্রহের বিষয় বানিয়ে রেখেছে। আধুনিক সমাজ বিজ্ঞানের জনক হিসেবে অগস্ত কোঁতের পরিচিতি থাকলেও এটি স্পষ্ট যে তিনি ইবনে খালদুনের রচনাবলীর সহায়তা গ্রহণ করেছিলেন। (৩) তাই আধুনিক সমাজতাত্ত্বিক আর্নল্ড টয়েনবি বলেছেন,‘ইবনে খালদুনের দর্শন জ্ঞানের ইতিহাসে এক অনতিক্রম্য অবস্থানে অধিষ্ঠিত আছে।’(১)
সমাজতত্ব ছাড়াও ইবনে খালদুনের আরেকটি পরিচয় ইতিহাস-দর্শনের জনক হিসেবে। ইসলামের প্রাথমিক সময় থেকেই ইতিহাস রচনার রীতি চালু থাকলেও তার হাত ধরে একটি নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হয়। কেবল বর্ণনার ওপর নির্ভর না করে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার আলোকে ইতিহাস বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পন্থা তিনিই সর্বপ্রথম তার মুকাদ্দিমায় লিপিবদ্ধ করেন। যার আলোকে যে কোন প্রচলিত ইতিহাসকে যথাযথ মূল্যায়ণ করা সম্ভব হয়।
এ প্রসঙ্গে ফরাসী অরিয়েন্টালিস্ট কারা দে ভক্স (Carra De Vaux) মুসলিম চিন্তকদের নিয়ে লিখিত তার ‘Les penseurs de I’Islam’ বইতে বলেন, ‘আফ্রিকা জ্ঞানের ইতিহাসে জন্ম দিয়েছে প্রথম সারির সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুনকে, যাঁর পূর্বের পৃথিবীতে এমন কোনো জ্ঞানের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না, যা ইতিহাসের দর্শন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা দিতে পেরেছে। কারণ জাতিসত্ত্বার আধ্যাত্মিক অবস্থা, এর ওপর আরোপিত পরিবর্তনশীলতার কার্য-কারণ, রাষ্ট্র জন্মের প্রক্রিয়া, বিবর্তন, উত্থান পতন, এরই মাঝে বেড়ে ওঠা সভ্যতা সংস্কৃতির বৈচিত্র নিয়ে ইবনে খালদুন তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল মুকাদ্দিমায় যে অতলস্পর্শী আলোচনা করেছেন, খৃষ্টিয় অষ্টাদশ শতকের পূর্বে আধুনিক ইউরোপেও আমরা এমন চিন্তাবিদের সন্ধান পাই না, যিনি ইতিহাসের গুপ্ত রহস্যগুলো উন্মোচনে সক্ষম হয়েছেন। এদিক থেকে ইবনে খালদুন বুদ্ধিবৃত্তিক ধারায় মন্তেস্কু (Montesquieu), ম্যাবলি (Mably), তারদে (Tarde), গবিন্যো (Gobineau) এর মতো সমাজচিন্তকদের অগ্রজপুরুষ।’(২)
অবশ্য এই শাস্ত্রকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্য আলোচিত স্থান ও চরিত্রের সাথে পুরোপুরি পরিচিতি থাকা আবশ্যক। যে বিষয়ে অভিজ্ঞতাস্বল্পতার কারণে এমনকি তাঁর তারিখে ইবনে খালদুনেও এই দর্শনকে পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হয় নি। এর কারণ হিসেবে চতুর্দশ খৃস্টাব্দের সীমাবদ্ধতাকে আমলে নেয়া প্রয়োজন।
তারিখে ইবনে খালদুন ও আল মুকাদ্দিমা ছাড়াও তার বিখ্যাত রচনা হচ্ছে আত্মজীবনী আত তারিফু বি ইবনে খালদুন ওয়া রিহলাতিহী শারকান ওয়া গারবা।
ইবনে খালদুন চতুর্দশ শতকের মনীষী হলেও খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন আধুনিককালে, যখন থেকে সমাজতত্ত্ব ও ইতিহাস দর্শন আধুনিক শাস্ত্র হিসেবে পঠনপাঠন শুরু হয়। এবং বিশেষজ্ঞদের মহল থেকে সাধারণ পাঠকদের নিকট তিনি গত শতাব্দীতে জনপ্রিয় হতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে এই জনপ্রিয়তা সব মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি ২০১৫ সালে তার নামে তুরস্কে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।(৪)
মৃত্যু
ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের জনক এই মহান মনীষি ১৪০৬ সালের ১৭ মার্চ কায়রোতে মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র :
১. আল মুকাদ্দিমা (বাংলা অনুবাদ)। অনুবাদক : গোলাম সামদানী কোরাইশি। দিব্যপ্রকাশ। তৃতীয় মুদ্রণ ২০১৫।
২. ইবনে খালদুন কেন প্লেটো এরিস্টটল ও আল ফারাবীর থেকে ভিন্ন, শাকিব আরসালান। অনুবাদ, আব্দুল্লাহিল বাকি। ত্রৈমাসিক পুনর্পাঠ, জানুয়ারি-মার্চ সংখ্যা। ২০২০।
৩. বাসামাত ইবনে খালদুন, আল জাযিরা আল ওসাইকিয়্যাহ। https://youtu.be/yJKZhYvli8Q
৪. https://www.ihu.edu.tr/