হুজাইফা আওয়াদ:
ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সকল শাখা- প্রশাখায় ইমামে আজম আবু হানিফা রহ.-এর অবিশ্বাস্য পাণ্ডিত্যের কথা জানেন না, এমন মুসলিম কমই মিলবে । ইতিহাসবেত্তাগণ এ সাফল্যের নেপথ্যে থাকা অনেক ব্যাখ্যা হাজির করার চেষ্টা করেছেন। প্রথমত, ইমাম আজম ইরাকের মাটিতে জন্ম লাভ করেন, যেখানে নানা সভ্যতার বৈচিত্র্যপূর্ণ উপস্থিতি ছিল , ফলে তিনি সমাজের হালচাল ও জনমানুষের আকুতির জায়গাটা ধরতে পেরেছিলেন সহজেই। দ্বিতীয়ত, শৈশব থেকে বাণিজ্য-সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়েছিলেন, যা তাকে ইসলামি অর্থব্যবস্থা ও লেনদেনের ক্ষেত্রে শাস্ত্রজ্ঞ হতে সহায়তা করেছে।
এবং সবশেষে বিশ্ব রাজনীতির চক্রাবর্ত খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন ; ইরাকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের গভর্নর হিসেবে যোগদান, নির্বিচারে রক্তপাত ঘটানো, তার পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে ইয়াযিদ ইবনে মুহাল্লাব ও খালিদ ইবনু আব্দিল্লাহ আল কিসরীর দায়িত্বগ্রহণ (এদের প্রত্যেকেই ছিলো ইতিহাসের নির্মম বর্বরতার নির্মাণপুরুষ)। কয়েক বছরের মাঝেই উমাইয়া খিলাফতের পতন ও আব্বাসীয়দের রাজ ক্ষমতায় আরোহণ। তাছাড়া আব্বাসী খুলাফা কর্তৃক ‘আলাওয়ী’ তথা আহলে বাইত ও হজরত আলী রাদি.- এর পক্ষাবলম্বীদের উপরে অকথ্য নির্যাতনের সুদীর্ঘ উপাখ্যান, এ সবগুলোই হজরত ইমামের জীবদ্দশায় তার চোখের সামনে ঘটেছিলো। ইতিহাস বলে, এমন বহু বিষয় ইমাম আবু হানিফা রহ.- এর চিন্তা ও উপলব্ধির সাগরে প্রবলভাবে রেখাপাত করে, তার সাফল্যের নেপথ্য উপকরণ হিসেবে পরোক্ষ ভূমিকা রাখে।
ইমাম আবু হানিফা রহ. কালাম ( ইলমে কালাম বা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ) শাস্ত্রকেও অস্বীকার করেননি। বরং তিনি এর মৌলিক নীতিমালা আয়ত্ত করেছিলেন, যদিও পরবর্তীতে কালাম শাস্ত্রে খুব একটা সময় দেননি, কিন্তু তার ফিকহী মাযহাব প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ইলমুল কালাম বহু জায়গায় তাকে অব্যাহতভাবে নীরব-সঙ্গ দিয়ে গেছে।
এবার আসি আমাদের আজকের মূল আলোচনায়।
আহলে বাইত তথা রাসুল সা.- এর পরিবার ও বংশধরের ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফার অবস্থান কী ছিলো, তিনি তাদেরকে কিভাবে দেখতেন, এক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক মূল্যায়ন কী ছিলো- ইসলামী তুরাসের (legacy) অংশ হিসেবে এসব আমাদের জানা থাকা দরকার। ইমাম আবু হানিফার মত মহান বরিত ব্যক্তির কর্মপন্থা অবশ্যই সালাফের সামগ্রিক কর্মপন্থার মৌলিক চিত্রায়ন হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। শুধু তিনি একা নন, চার ইমামের সকলেই আহলে বাইত সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন প্রকাশ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী রহ.- কে একবার রাফেজী হওয়ার অপবাদ দেওয়া হলে তিনি উত্তরে বলেন- ‘ রাসূলের পরিবারকে ভালোবাসার অর্থ হয় যদি ‘রাফেজী হওয়া হয়’, তাহলে উভয় জগৎ সাক্ষী থাকুক যে, আমি রাফেজী’।
ইমামে আজমও আহলে বাইতকে প্রচণ্ড মাত্রায় ভালোবাসতেন, খলিফাদের সাথে দ্বন্দ্ব হলে আহলে বাইতের পক্ষাবলম্বন করতেন। তবে হ্যা, এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বহুবার বলেছেন, হজরত আবু বকর ও ওমর রাদি. সর্বাবস্থায় হযরত ওসমান ও আলী রাদি. থেকে শ্রেষ্ঠতর। এর অর্থ হলো, ইমাম সাহেবের আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা ছিলো ভাবাবেগের জায়গা থেকে, যা রাসূলের ভালোবাসা থেকেই সঞ্চারিত। সাহাবিদের মুশাজারা তথা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোমল বিভাজনে কখনোই সালাফ এক পক্ষাবলম্বন করে অপর পক্ষকে ছোট করে তাচ্ছিল্য করবার হীন মানসিকতা লালন করতেন না। তারা ভালোবাসতেন, কিন্তু শরিয়ার সীমা লঙ্ঘিত হতে দিতেন না। তাদের এই ভালোবাসা কখনোই উম্মাহর মূলধারা তথা আহলুস সুন্নাহ থেকে স্খলন ঘটাবার মত কিছু ছিলো না।
একবার ইমামে আজম মুহাম্মদ আল বাকির ( জাফর সাদিকের পিতা ও ইমামিয়া মতবাদের নেতৃস্থানীয় একজন) এর সাথে সাক্ষাতকালে জিজ্ঞেস করেন, ‘আবু বকর ও ওমর রাদি. সম্পর্কে আপনার কী অভিমত? মুহাম্মদ আল বাকির এই দুই মহান সাহাবীর প্রশংসা করে তাদের বিভিন্ন বক্তব্য উদ্ধৃত করতে শুরু করেন। ইমাম সাহেব বলেন, ‘ইরাকের অনেকে তো বলে, আপনি দুই মহান খলিফা থেকে নিজেকে মুক্ত দাবী করে থাকেন!’
মুহাম্মদ আল বাকির উত্তর দেন- ‘আল্লাহর পানাহ, কাবার রবের শপথ! তারা মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে। তুমি কি জানো না হজরত ওমর কে? তিনি তো সে ব্যাক্তি, যার কাছে হজরত আলী রাদি. আপন মেয়ে উম্মে কুলসুমকে অর্পণ করেছেন। তুমি কি জানো না উম্মে কুলসুম কে? তার দাদা রাসুল সা., দাদি জান্নাতের সর্দার খাদিজা রাদি., মা হজরত ফাতিমাতুয যাহরা রাদি., আর পিতা হযরত আলী রাদি.। যদি হজরত ওমর রাদি. তার জন্য যোগ্য না হতেন, কেন তার কাছে হযরত আলী নিজের কন্যাকে সপে দেবেন!’। এই মুহাম্মদ আল বাকির ইমাম আবু হানিফা রহ.- এর অন্যতম উস্তাদ ; তিনি ছাড়াও যায়দ ইবনু আলী, আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ইবনুল হাসান সহ আহলে বাইতের একাধিক বরেণ্য ব্যাক্তি থেকে ইমামে আজম ইলম গ্রহণ করেছেন।
ইমামে আজমের জীবনের বায়ান্ন বছর কেটেছে উমাইয়া শাসনামলে, বাকি বাইশ বছর আব্বাসী শাসনকালে। ইসলামী ইতিহাসের মহা প্রতাপশালী দুই শাসনামল ইমামে আজম স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। যখন যায়দ ইবনু আলী রহ. ১২১ হিজরিতে তৎকালীন শাসক হিশাম ইবনে আব্দুল মালিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, আবু হানিফা রহ. তাকে সমর্থন করেন। তিনি বলেন- ‘আমি নিজেও যাইদের এ আন্দোলনে যোগ দিতাম, যদি না মানুষ তাকে নিঃসঙ্গ ছেড়ে যাওয়ার আশংকা থাকতো, যা তার পিতা যাইনুল আবিদিনের বেলায় ঘটেছিলো। তবে, আমার অর্থ-সহায়তা তার জন্য অবশ্যই পাঠিয়ে দেবো।’
যাইদ ইবনু আলীর বিপ্লবী অভিযানের অনির্বাণ ১৩২ হিজরিতে নিভে যায় তার শাহাদাতের মধ্য দিয়ে। কিছু কালের মাঝেই পুত্র ইয়াহয়াকে খুরাসানে এবং দৌহিত্র আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াহয়াকে ইয়েমেনে শহিদ করা হয়।
যায়দ ইবনু আলী রহ.- এর জন্য ইমাম আবু হানিফার হৃদয়ে একটা বড় মর্যাদার স্থান ছিলো, তিনি তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতেন, নিজ উস্থাদের আসনে স্থান দিয়েছিলেন ইমাম সাহেব। নির্মম এ ঘটনা আহলে বাইতের এই মহান মনীষী ও তার পরিবারের সাথে ঘটে যাওয়ার ফলে ইমাম আবু হানিফা উমাইয়া খলিফদের প্রতি প্রবল মাত্রায় ক্ষুব্ধ হন। ইয়াযীদ ইবনু হুবাইরা ছিলো হিশাম নিযুক্ত কুফার গভর্নর। সে ইমাম ছাহেবের কাছে সিলমোহর-সহ প্রতিনিধি দল পাঠায়। প্রস্তাব ছিলো কুফার সর্বোচ্চ আদালতের ‘প্রধান বিচারপতি’ হওয়ার। কিন্তু ইমাম সাহেব এই প্রস্তাব অংকুরই শেষ করে দেন স্পষ্ট বাক্যে- ‘আল্লাহর শপথ! হিশাম যদি আমাকে ওয়াসিতে’র মসজিদের দরজাগুলো গণনা করতে নির্দেশ দেয়, তবুও আমি সেখানে প্রবেশ করবো না, আর যেখানে একজনকে নির্মমভাবে শহিদ করার পর আমার হাতের সিলমোহর দিয়ে তার রক্তের বৈধতা দেওয়ার প্রশ্ন আসে, সেটা তো আমার পক্ষে আরো অসম্ভব!’
এর পর ইমাম সাহেবের উপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন, শেষ পর্যন্ত তিনি ইরাক ছেড়ে মক্কায় হিজরত করতে বাধ্য হন। ১৩২ এর শেষ ভাগে উমাইয়া শাসনের পতন হলে আব্বাসীয়রা রাজ ক্ষমতায় আরোহণ করে। এরপর দীর্ঘ চার/পাচ বছর মক্কায় কাটিয়ে ফের কুফায় প্রত্যাবর্তন করেন ইমাম আজম রহ.।
আব্বাসীয়রা ছিলো হাশেমী বংশীয়। তাই ইমামে আজম তাদের থেকে কল্যাণের আশা করেছিলেন। স্ব- প্রণোদিত হয়ে বায়াতও গ্রহণ করেছিলেন। তারা ছিলো আহলে বাইতের চাচার সন্তান, তাই বিশ্বাস ও আস্থার জায়গাটাও ছিলো মজবুত। প্রাথমিক অবস্থায় তাদের সাথে সখ্যতা থাকলেও সম্পর্কে টানাপোড়ন শুরু হয় মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল্লাহ ও ইব্রাহীম – আহলে বাইতের এই দুই ভাইয়ের বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। আব্বাসী খলিফা আবু জাফর মানসুর যখন আহলে বাইতের প্রতি প্রকাশ্যে বিরূপভাব পোষণ শুরু করেন, তখনই এই বিদ্রোহের সূচনা হয়। ইতিহাস এই বিপ্লবী আন্দোলনকে ‘সাওরাতুন নাফসিয যাকিয়্যা’ (নফসে যাকিয়ার বিপ্লব) নামে চেনে। ইমামে আজম আব্বাসী সেনানায়ক হাসান ইবনে কহতুবাকে বহুভাবে নিরুৎসাহিত করার প্রয়াস পান, যেন তাদের মাঝে এই যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতি না সৃষ্টি হয়। কিন্তু কার কথা কে শোনে! এই দুই ভাই আব্বাসী সেনাদের হাতে নিহত হন। এর পর ক্রমশই খলিফা আবু জাফর মানসুরের প্রতি ইমাম আবু হানিফা বিতৃষ্ণ হতে থাকেন। যার পরিসমাপ্তি ঘটে যুলুম নির্যাতনের কারাবাস শেষে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে..।
এখানে একটি সঙ্গত প্রশ্ন উঠতে পারে, তা হল- ইমাম আবু হানিফা রহ. কি বিদ্যমান শাসনব্যবস্থার সমালোচনা তখনই করতেন, যখন আহলে বাইতের প্রতি কোন অবিচার চোখে পড়তো, তবে তো তিনি কেবল নিজস্ব চিন্তা ও মূল্যোবোধের ডিফেন্স করতে সচেষ্ট ছিলেন, সামাজিক চিন্তা ও মূল্যবোধের সাথে তার যোগসূত্র ছিলো নিতান্ত? ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়, তিনি অহর্নিশ সমাজের বৃহৎ স্বার্থে কথা বলেছেন, মূল্যবোধ ও অধিকার রক্ষায় আওয়াজ উঁচু করেছেন, সত্য বিচ্যুত হওয়া মাত্রই বিচার বিভাগের খোলামেলা সমালোচনা করেছেন। ইরাকের দাজলা নদীর তীরে অবস্থিত মাওসিলবাসী একবার খলিফা আবু জাফর মানসুরের ‘বায়াত’ (আনুগত্যের অঙ্গীকার) অকার্যকর ঘোষণা দেয়। খলিফা তাদের বিরুদ্ধে আদেশ জারি করে, যদি তারা পুনরায় ‘বায়াত’ ভঙ্গ করে, তাহলে তাদের রক্ত বৈধ। (অর্থাৎ, তাদেরকে হত্যা করতে হবে) এই চুক্তিতে তারা সম্মত হয়। এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য বিজ্ঞ ফকীহ আলেমদেরকে সমবেত করেন। একজনকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তর দেন- ‘হে আমিরুল মুমিনিন! আপনার ক্ষমতার হাত তাদের উপর প্রশস্ত, আপনার বক্তব্য তাদের জন্য অবশ্য পালনীয়। আপনি যদি ক্ষমা করেন, তবে আপনি ক্ষমাশীলদের অন্তর্ভুক্ত, আর যদি শাস্তি দেন, তাহলে অবশ্যই তারা শাস্তির উপযুক্ত’। নীরবতা ভেঙে ইমাম সাহেব কথা শুরু করলেন- ‘ আমিরুল মুমিনিন! তারা আপনার কাছে এমন শর্তে স্বাক্ষর করেছে, যার অধিকার তাদের নেই। আপনি তাদের উপরে এমন কিছু চাপিয়ে দিয়েছেন, যার অধিকার আপনার নেই। কারণ, কোন মুসলিমের রক্ত বৈধ হয় কেবল হাদিসে বর্ণিত কারণগুলো পাওয়া গেলে, যার সবগুলোই এখানে অনুপস্থিত। আর খলিফার শর্তের চাইতে আল্লার শর্ত পূরণ-ই অধিকতর ন্যায্য ও উপযুক্ত’।
শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে কোন অবিচার দেখলে আবু হানিফা রহ. কখনোই চুপ থাকতে পারতেন না, চাই সেটা আহলে বাইতের প্রতি হোক, কিংবা সমাজের অন্য যে কারো প্রতিই হোক। আর এ কারণেই তিনি ছিলেন শাসকগোষ্ঠীর অব্যাহত উদ্বেগের কারণ। আবু জাফর মানসুর যখন ইমাম সাহেবের সত্য কণ্ঠের তীব্রতা দেখে বার বার বিপাকে পড়ছিলেন, কৌশল করে তার সামনে প্রধান বিচারকের লোভনীয় পদের প্রস্তাব করলেন। কিন্তু সেটাও অবলীলায় ফিরিয়ে দিলেন ইমাম আজম। ফলে কারারুদ্ধ অবস্থায় জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়েছিলো তাকে। এভাবেই ইমাম আবু হানিফা রহ. সূচনালগ্ন থেকে শেষ অবধি জীবন্ত পরাবাস্তবতার দৃষ্টান্ত কায়েম করেছেন, যেখানে ইমাম সাহেব তার বৌদ্ধিক জীবনের সবটুকু যাপন করে গেছেন। -রাহিমাহুল্লাহু তায়ালা রাহমাতান ওয়াসিয়াহ।
মাসাদির:
১-আল মানাকিব- ইবনুল বাযযাযী
২- তারিখু বাগদাদ- খতীব আবু বকর আল বাগদাদী
৩-আবু হানিফা, হায়াতুহু ওয়া আসরুহু-ইমাম আবু যুহরা
৪- ইমাম আবু হানিফা কি সিয়াসী যিন্দেগী
মাওলানা মানাযির আহসান গিলানী
৫-আবু হানিফা ওয়া আলুল বাইত- মাহমুদ জামিল