
ইমরান রাইহান:
১
নিশাপুর পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। শহরের ফটক বন্ধ হওয়ার একটু আগে আমাদের কাফেলা শহরে প্রবেশ করে। শহরের প্রাচীর পেছনে রেখে আমাদের কাফেলা এগিয়ে যায় সামনের দিকে, প্রাচীন শহরের বিভিন্ন অলিগলি ডানে-বামে চলে গেছে। সওদাগরের কাফেলার সাথে আমার সফর শেষ, তাদেরকে আর প্রয়োজন নেই। কুশল বিনিময় সেরে বিদায় নিলাম। মাগরিবের নামাজ পড়লাম শহরের জামে মসজিদে। প্রশস্ত চত্বরের বাইরে ঘোড়াটা শক্ত করে বেঁধে রাখলাম। সামান্য জিনিসপত্র আছে ঘোড়ার পিঠে, তবে হারানোর সম্ভাবনা কম। এসব শহরে চোর-ডাকাতের উপদ্রব নেই। উমাইয়া আমলে কিছুদিন এখানে দুষ্কৃতিকারীরা সমস্যা করতো, কিন্তু আব্বাসিরা ক্ষমতায় এসে তাদেরকে দমন করে।
এই মসজিদে আমি আগেও এসেছি। গত বছর যখন পিতার সাথে নিশাপুর আসি, তখন এখানকার ইমামের সাথে দীর্ঘ সময় কথা হয়েছিল। আমার পিতা কিছুদিন ইমাম আবু হানিফার সান্নিধ্য পেয়েছিলেন, একথা শুনে ইমাম সাহেব আপ্লুত হন। আগ্রহ নিয়ে বারবার ইমাম আবু হানিফা সম্পর্কে প্রশ্ন করছিলেন।
‘তিনি আমার উস্তাদ। আমার চোখে তিনি ছিলেন একটি কেন্দ্রবিন্দু, তাকে ঘিরে আবর্তিত হতো জ্ঞানশাস্ত্রগুলো। তাকে আমি দেখেছি কুফার বাজারে কাপড় বিক্রি করতে, তখন তিনি ছিলেন সেখানের শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী। আবার তিনি যখন ফিকহের মজলিসে দরস দিতেন, ছাত্ররা তখন তন্ময় হয়ে তার কথা শুনতো। উগ্র খারেজিরা তার কাছে আসতো রুক্ষতা আর কঠোরতা নিয়ে, পাঁয়তারা খুঁজতো তাকে বেকায়দায় ফেলতে, কিন্তু প্রতিবারই তিনি তীক্ষ্ম মেধা আর ক্ষুরধার যুক্তি দিয়ে তাদের বোকা বানিয়ে দিতেন। রাতের বেলা তাকে দেখতাম দীর্ঘ কিয়ামুল লাইলে ব্যস্ত আছেন, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন গোটা জগত থেকে, এখানকার কোনো কোলাহল বা ক্লান্তি কিছুই তাকে সরাতে পারতো না নিজের কাজ থেকে। তিনি নুমান ইবনু সাবিত। ইমাম আবু হানিফা। তার সান্নিধ্যে কাটানো সময়গুলো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়’ পিতার কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজছে।
পুরোনো ইমাম সাহেবকে দেখলাম না। তার বদলে তরুণ এক ইমাম সাহেব নামাজ পড়ালেন। তার সাথে কথা বলবো ভেবেও বিরত রইলাম। টানা সফরে বেশ ক্লান্ত লাগছে। দ্রুত একটা সরাইখানা খোঁজা দরকার।
গতবার দেখেছি, বাজারের শেষপ্রান্তে একটা ভালো সরাইখানা আছে। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি, কোলাহল থেকে দূরে। ধীরে ধীরে সেদিকে এগুলাম। রাস্তায় মানুষজনের ভীড় দ্রুত কমে যাচ্ছে, পারসিয়ান শহরগুলোর বৈশিষ্ট্য এটি, সন্ধ্যার পরেই সব কর্মব্যস্ততা কমে যায়। আমার মত আমার ঘোড়াটিও ক্লান্ত, আদর করে ঘোড়ার ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিলাম।
একজন আর্মেনিয়ান দাস সরাইখানার ফটক খুলে দিল। ঘোড়াকে আস্তাবলে রেখে এলাম। রাতের মত ওর খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে। একজন চাকর হাম্মাম দেখিয়ে দিল। উষ্ণ পানিতে সারাদিনের ক্লান্তি ধুয়ে দিলাম। গোসল শেষে সুগন্ধি মেখে বের হতেই দেখি বেশ ফুরফুরে লাগছে। চাকরটি গরম খাবার নিয়ে এল।
এশার নামাজের পর সরাইখানার সামনে আসর বসলো। একজন চাকর প্রদীপ দিয়ে গেল। অবশ্য প্রদীপের দরকার ছিল না। আকাশে মস্ত থালার মত চাঁদ উঠেছে। নকশা করা চাদর বিছানো হয়েছে। একটু দ্বিধা হলেও বসলাম। এসব আসরে অনেক কিছু শোনা যায়, জানা যায়। মধ্যবয়সী একজন কথা বলছেন। নামাজের আগে তার সাথে পরিচয় হয়েছে। তার বাড়ি কাশগড়। সওদাগরি পন্য নিয়ে যাচ্ছেন হামদানে। ব্যবসায়িক কাজে নানা দেশ ঘুরেছেন। বিচিত্র অভিজ্ঞতা ঝুলিতে জমা করেছেন। তিনি বেশ জোরের সাথে কথা বলছেন। কন্ঠে একটা দৃঢ়তা। তিনি বলে চলেছেন,
‘আবু জাফর মানসুর যেদিন মারা গেলেন সেদিন আমি মক্কায়। সময়টা হজের মৌসুম। আমি বসে আছি কাবার চত্বরে। একটু দূরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সুফিয়ান সাওরি। আহ, সেই দৃশ্য এখনো ভাসছে আমার চোখে। তার মাথা ছিল ফুজাইল ইবনু ইয়াজের কোলে। দুই পা ছিল সুফিয়ান ইবনু উয়াইনার কোলে। চুপচাপ তাকিয়ে এই দৃশ্য দেখছি, এমন সময় একজন এসে কিছু একটা বললো। ফুজাইল ইবনু ইয়াজ ও সুফিয়ান ইবনু উয়াইনার চেহারায় কিছুটা চিন্তা ও ভয় ফুটে উঠে। তারা সুফিয়ান সাওরিকে নম্র কণ্ঠে কিছু একটা বলেন। সুফিয়ান সাওরি উঠে দাঁড়ালেন। কাবার গিলাফ ধরে উপরের দিকে তাকিয়ে কী যেন বললেন। মনে হলো খুব আবেগ নিয়ে কোনো দোয়া করছেন। একটু পরে আবার আগের জায়গায় ফিরে এলেন। তাকে বেশ নিশ্চিন্ত দেখাল। আমার কিছুটা কৌতুহল হলো গোটা ব্যাপারটার প্রতি। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারিনি। জিজ্ঞেস করার উপায়ও নেই। অযথা মাথা খাটিয়ে লাভ নেই ভেবে তাকিয়ে রইলাম বাইতুল্লাহর দিকে।
কিছুক্ষণ পরেই শুরু হলো চাঞ্চল্য। লোকজনের মধ্যে কোলাহল ছড়িয়ে পড়ে। সংবাদ এসেছে খলিফা আবু জাফর মানসুর মক্কায় আসার পথে মারা গেছেন। তখন পুরো ব্যাপারটা জানিনি। কয়েকদিন পরে জেনেছিলাম মূল বিষয়। আবু জাফর মানসুর নানা কারণে ক্ষিপ্ত ছিলেন সুফিয়ান সাওরির উপর। সুফিয়ান সাওরি রাজদরবার এড়িয়ে চলতেন। তিনি বলতেন, মানুষের মুখাপেক্ষী হওয়ার থেকে আমার দশ হাজার দিনার চলে যাওয়াও আমার কাছে প্রিয়। সে বছর আবু জাফর মানসুরের রাগ সম্ভবত অন্য সময়ের চেয়ে চড়ে ছিল। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, আমি মক্কায় আসার আগেই সুফিয়ান সাওরিকে শূলিতে চড়াও। তার আদেশ পেয়ে মক্কায় প্রস্তুত করা হল শূলি। সেই সংবাদই আমার সামনে এসেছিল সুফিয়ান সাওরির কাছে। তখন তিনি কাবার গিলাফ ধরে দোয়া করেছিলেন, হে আল্লাহ, আবু জাফর মানসুর যদি মক্কায় প্রবেশ করে তাহলে আমি আপনার দায়মুক্ত। একটু পরেই সংবাদ আসে আবু জাফর মানসুর পথেই মারা গেছেন। কত বছর আগের কথা, কিন্তু এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে’।
বেশ রাত হয়েছে। লোকজন উঠে দাঁড়ায়। আমি বাগানে একা দাঁড়িয়ে রই। একটা অচেনা ফুলের সুবাস পাচ্ছি। মনটা উদাস লাগছে। আমার বসতির কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে মায়ের কথাও। মায়ের সাথে আমার শেষ দেখা ৬ মাস আগে। সেদিন আমি মার্ভে যাচ্ছিলাম ছোট একটি কাফেলার সাথে। মায়ের চেহারায় একইসাথে শোক ও দৃঢ়তা খেলা করছিল। এক সপ্তাহ আগে আমার পিতা ইন্তেকাল করেছিলেন। কত স্বপ্ন ছিল আমাদের। কথা ছিল, পিতা আমাকে হাত ধরে নিয়ে যাবেন তার বন্ধু আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের কাছে। তাকে অনুরোধ করবেন আমাকে যেন দরসে বসার অনুমতি দেয়া হয়। ইলম অর্জনের স্বাভাবিক পদ্ধতি অনুসারে এতদিন আমি নিজ এলাকার আলেমদের দরসে বসেছি। তারা আমাকে সনদ ও ইজাযাহ দিয়েছেন। এখন আমাকে হাদিসের অন্বেষণে সফর করতে হবে নানা শহরে। এখন থেকে শুরু হবে আমার রিহলাহ। এই রিহলাহর শুরু হবে মার্ভ থেকে। সেখানে আছেন আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক। তিনি ও আমার পিতা একসাথে কুফার মসজিদে ইমাম আবু হানিফার দরসে বসেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক এখন ইলমের আকাশে প্রদীপ্ত সূর্য। তার কাছে আমাকে যেতেই হবে। পিতার আকস্মিক মৃত্যু এই স্বপ্ন ও পরিকল্পনা এলোমেলো করে দেয়। বিদায়ের সময় মায়ের চোখ ছলছল করছিল। তিনি আমাকে নসিহাহ দিচ্ছিলেন নানা বিষয়ে। আমাকে বলছিলেন ইলমের আদব, উস্তাদের আদব এসব বিষয়ে যেন সতর্ক থাকি। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিলেন তিনি। ছোট ভাইবোনকে চুমু খেয়ে বিদায় নিলাম আমি।
মিরাবাদে আমাদের ছোট পল্লি পেছনে পড়ে রইলো। ধূসর এলাকা পাড়ি দিয়ে আমাদের কাফেলা ছুটে চললো মার্ভের দিকে। আমি একবার পেছন ফিরে তাকাই। আমাদের পল্লির কাঠামো দ্রুত ছোট হয়ে পেছনে সরে যাচ্ছে। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হলো আমার। পেছনে শুধু আমার পল্লীকে ফেলে এসেছি এমন নয়, পল্লির সাথে আমার কৈশোর ও দূরন্তপনার হাজারো স্মৃতিকেও ফেলে এসেছি।
আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের সাক্ষাত পেতে কোনো সমস্যা হলো না। আমার পিতার পরিচয় দিতেই তিনি উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। পিতার মৃত্যুসংবাদ শুনে অনেকক্ষণ চুপ রইলেন। আমার থাকার ব্যবস্থা হলো তার ঘরের পাশে এক কামরায়। আমার খাবার দাবারের ব্যবস্থা করার জন্য একজন চাকরকে বলে দিলেন তিনি।
মার্ভ শহরটি আকারে খুব বড় না হলেও বেশ জমজমাট। ভৌগলিক দিক থেকে এই শহরটির অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো এলাকার ব্যবসায়ী কাফেলা সহজেই এখানে আসতে পারে। বিকেলটা ঘুরে বেড়ালাম শহরের বাজারে। কী নেই সেখানে। আমাদের ছোট পল্লিতে একসাথে কখনো এত জিনিস দেখিনি। ভারতের ব্যবসায়ীরা নিয়ে এসেছে উদ কাঠের সুগন্ধি। দামেস্ক থেকে এসেছে কাশানি নামে ছয়কোনা টালি। পারস্য ও ইরাক থেকে এসেছে কার্পেট ও জায়নামাজ। আর্মেনিয়া থেকে ব্যবসায়ীরা এনেছে কুশন। বসরার ব্যবসায়ীরা এনেছে খেজুর। মানুষের কোলাহল ও হৈচৈ পাশ কাটিয়ে হাঁটতে থাকি। ফলের দোকানের সামনে সুগন্ধ ভাসছে। একজন বৃদ্ধ খুবানি বিক্রি করছেন। এই ফল এসেছে শীতপ্রধান অঞ্চল থেকে। পকেটে অল্প কিছু অর্থ আছে। চাইলে খুবানি কিনে খাওয়া যায়। কিনবো ভেবে দোকানের সামনে দাঁড়াই। দাম জিজ্ঞেস করব এ সময় মনের পর্দায় ভেসে উঠে আমার পরিবারের সদস্যদের চেহারা। জানি না আমার মা ও ভাই বোনরা এখন কেমন আছেন, তারা কী খাচ্ছেন। তাদের ফেলে আমি একা খুবানি খাবো, বিষয়টা মন সায় দিল না। আমি সামনের দিকে হাঁটতে থাকি, উদ্দেশ্যহীন, একা।
২
মার্ভে আমার প্রথম রাতটি কাটলো নির্ঘুম। পরিবারের বাইরে এই প্রথম একা কোথাও এসেছি। পিতার সাথে বেশকিছু জায়গা সফর করেছিলাম নানা সময়। কিন্তু একা কোথাও যেতে দেয়নি মা। এবার তিনি একা আমাকে এখানে পাঠালেন, কারণ তিনি স্বপ্ন দেখেন তার ছেলে একদিন বড় আলেম হবে। সুফিয়ান ইবনু উয়াইনা, সুফিয়ান সাওরি কিংবা আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের মতো। বিকেলে বাজারে অনর্থক ঘুরেছি ভেবে আফসোস হলো। মার্ভে আমার এই সফর তো শহর দেখার জন্য নয়। আমি এখানে এসেছি ইলমের অন্বেষণে। আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের সীনার ভেতরে ইলমের যে ভাণ্ডার সঞ্চিত, আমি এসেছি তা থেকে কিছু নিতে। কেন অযথা আমার সময় নষ্ট করলাম আজ।
আব্বা আমাকে বলেছিলেন তার জীবনের কথা। একবার তিনি মদিনায় ইমাম মালেকের দরসে বসেছিলেন। সেদিন মদীনায় কোথাও থেকে একটা হাতি এসেছিল। অনেকেই আগে হাতি দেখেনি। ফলে সবাই দরস ছেড়ে বের হয়ে যায়। আন্দালুস থেকে আসা এক তরুণ, যে ছিল বাবার বেশ ঘনিষ্ঠ, সে দরসেই বসে থাকে। বাবারা যখন ফিরে আসেন তখন তাকে সেখানে বসা দেখে তারা অবাক হন। জিজ্ঞেস করেন, তুমি হাতি দেখতে যাওনি কেন? ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া মাসমুদি নামে বাবার সেই বন্ধু জবাব দিয়েছিল, আমি সাগর পাড়ি দিয়ে এখানে হাতি দেখতে আসিনি। আমি এসেছি ইলম অর্জন করতে।
বাবা যতবার এই ঘটনা আমাদের শোনাতেন প্রতিবার বলতেন, ‘হে আমার সন্তানেরা, ইলমের জন্য তোমরাও নিজেদের এভাবেই সঁপে দিয়ো।’ নানা চিন্তার মধ্য দিয়ে রাত পোহালো। মসজিদ থেকে শোনা গেল মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ফজরের আজান।
দরসে আমার সাথে যে ছেলেটি বসেছে সে এসেছে সমরকন্দ থেকে। এই শহর জয় হয়েছে কুতাইবা বিন মুসলিমের হাতে। কুতাইবা বিন মুসলিমের সাথে আমার দাদার একবার সাক্ষাত হয়েছিল। বাবার মুখে অনেকবার শুনেছি সে গল্প। বাবা প্রায়ই আমাদের সাথে কুতাইবা বিন মুসলিমের কথা বলতেন। তার মৃত্যুর ঘটনা বলে আফসোস করতেন। বাবা বলতেন, হে আমার সন্তানেরা, তাড়াহুড়া করো না। কুতাইবা যদি তাড়াহুড়া করে বিদ্রোহ না করতেন তাহলে হয়তো তার এই নির্মম পরিণতি হত না।
সমরকন্দের সহপাঠির কাছে সামান্য একটু কাগজ আছে। তাকে আমার ঈর্ষা লাগছে। সে চাইলেই হাদিস লিখে ফেলতে পারবে অথচ আমার কাছে কোনো কাগজ নেই। নানা জায়গায় কাগজের কারখানা প্রতিষ্ঠা হয়েছে সত্য, কিন্তু কাগজের দাম এখনো সবার হাতের নাগালে আসেনি। সমরকন্দের সহপাঠীর কাছে শুনলাম কাগজের গল্প। ১৩৩ হিজরিতে আবু মুসলিম খোরাসানির বাহিনীর সাথে চীনের ট্যাং সাম্রাজ্যের একটি যুদ্ধ হয়, তালাস নদির পাড়ে। যুদ্ধে আব্বাসিরা বিজয়ী হয়। এই যুদ্ধে বন্দি হয় বেশকিছু কাগজ তৈরির কারিগর। তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে আসা হয় সমরকন্দে এবং এখানে স্থাপিত হয় কাগজের কল। আমার সহপাঠির বাড়ি সমরকন্দে, সুতরাং তার কাছে কাগজ থাকবে এটা বেশ স্বাভাবিক বিষয়।
আমাদের দরস হচ্ছে শহরের জামে মসজিদে। ফজরের পর একজন ঘোষক বাজারে হেঁটে ঘোষণা দিয়েছেন আজ আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক দরস দিবেন। আমরা দরসে বসেছি পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে, গায়ে মেখেছি সুগন্ধি। এটা হাদিসের দরসের আদব ও সম্মান। শুনেছি ইমাম মালিকও তার দরসে এভাবে সুগন্ধি মেখে বসতেন। আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক এখনো আসেননি। সবাই তার প্রতীক্ষায় আছি। ছাত্রদের মাঝে কয়েকজন ছাত্রকে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পেছনের দিকে যারা বসেছে তারা ইবনুল মুবারকের সব কথা নাও শুনতে পারে। তাই ইবনুল মুবারক কোনো হাদিস বর্ননা করার পর বা কিছু বলার পর তারা দাঁড়িয়ে সেই আলোচনা পেছনের লোকদের শুনিয়ে দিবেন। এদের একটা সুন্দর নাম আছে। মুস্তামলি। অনেক সময় কারো দরস কত বড়, তা বুঝাতে বলা হয়, তার দরসে এতজন মুস্তামলি দরকার হয়। আজকের দরসে অন্তত ২০ জন মুস্তামলি প্রস্তুত আছেন।
আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক দরসে এলেন ধীর কিন্তু দৃঢ়পদে। আমাদের মনে হলো, ঘন অন্ধকারের ভেতর থেকে এগিয়ে আসছেন শুভ্র পোশাক পরিহিত কেউ। তার চেহারায় রয়েছে অপার্থিব এক ঔজ্জ্বল্য। তার চেহারার দিকে তাকালে মন হয়ে উঠে প্রশান্ত। তার চলনে ফুটে উঠছে ব্যক্তিত্বের আভা। এটি ইলমের প্রভাব, আমলের নুর। অদ্ভুত, মনে মনে ভাবি আমি। এ এক অপূর্ব সম্পদ, দুনিয়ার কোনো সম্পদ দিয়েই যা ক্রয় করা যায় না। বাগদাদের খলিফার কাছেও নেই এই রত্ন, এই সম্পদ। আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের সামনে খলিফা নিজেও নিজেকে শূন্যহস্ত মনে করতে বাধ্য। মনে পড়লো, গত বছর আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক গিয়েছিলেন রাক্কা শহরে। তাকে সাদরে গ্রহণ করতে এগিয়ে এসেছিল শহরবাসী। এত বেশি মানুষের সমাগম হয় যে, বাতাসে ধূলো উড়তে থাকে। মেঘলা দিনের মত অন্ধকার হয়ে যায় শহরের আকাশ। খলিফা হারুনুর রশিদ তখন রাক্কা শহরেই অবস্থান করছিলেন। তিনি প্রাসাদের বারান্দায় দাড়িয়ে দেখছিলেন এ দৃশ্য। অবাক হয়ে প্রহরীদের তিনি জিজ্ঞেস করেন ঘটনা কী? তারা জানায়, খোরাসান থেকে একজন আলেম এসেছেন। তাকে দেখতে ভীড় করেছে উৎসুক জনতা। তাদের চলাচলে উড়ছে ধুলো। এ কথা শুনে খলিফার স্ত্রী যুবাইদা মন্তব্য করেন, ইনিই তো আসল বাদশাহ, ইনি প্রজাদের মন দখল করে আছেন।
আজ আমি বসে আছি সেই আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের কাছে। আজ তিনি আমাদের চোখে যে সম্মান পাচ্ছেন, তা ইলমের কল্যানেই। পিতার কাছে শুনেছি, ইবনুল মুবারক ইলম অর্জন শুরু করেছিলেন বেশ পরে। তখন তার বয়স ২০/২২ বছর। যৌবনে কিছুদিন তিনি খেলাধুলা ও বিনোদনে ব্যস্ত ছিলেন। একবার আমার বাবার সামনে ইমাম আবু হানিফা তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ইবনুল মুবারক, তুমি কী করে ইলমের পথে এলে? তখন ইবনুল মুবারক বলেছিলেন, একরাতে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। স্বপ্নে দেখি, গাছের ডালে একটি পাখি বসে আছে। পাখিটি বলছে, যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে এখনো কী তাদের অন্তর আল্লাহর ভয়ে ভীত হওয়ার সময় আসেনি? আমি স্বপ্নের ভেতর বলে উঠি অবশ্যই।
এই একটি স্বপ্ন ইবনুল মুবারককে আমূল বদলে দেয়। তিনি খেলাধুলো ছেড়ে পড়ালেখায় মন দেন। ইলম অর্জনে সফর শুরু করেন। ইলমের অন্বেষণে তিনি ছুটে যান মার্ভ থেকে মিসর। আমার দাদার একজন বন্ধু ছিলেন, হারুন বিন মুগিরা। তিনি বাস করতেন রায় শহরে। তিনি হাসান বসরির সাক্ষাত পেয়েছিলেন। হাসান বসরি থেকে তিনি একটি হাদিস বর্ণনা করতেন। আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক যখন এই সংবাদ পান তখন তিনি মার্ভ থেকে এক হাজার কিলোমিটার সফর করে রায় শহরে যান, শুধু এই একটি হাদিস সংগ্রহ করার জন্য। আমার বাবা একবার রায় শহরে গিয়েছিলেন, তখন হারুন বিন মুগিরা বিস্ময়ের সাথে এই ঘটনা শুনিয়েছিলেন।
মনে মনে ভাবি, অল্পমূল্যে কিছুই অর্জিত হয় না। সবকিছুর জন্যই ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। চড়া দাম দিতে হয়। ইবনুল মুবারক অনেক কষ্ট স্বীকার করেছেন, ঘুরে ঘুরে ইলম অর্জন করেছেন, ফলে আজ মুসলিম বিশ্বের নানা অঞ্চল থেকে ছাত্ররা ছুটে আসছে তার দরসে। এইতো কিছুদিন আগে এক ব্যক্তি গিয়েছিল সুফিয়ান সাওরির সাথে দেখা করতে।
‘তুমি কোথা থেকে এসেছ?’ জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি।
‘খোরাসান থেকে’ লোকটি জবাব দিয়েছিল।
‘তোমাদের কাছে তো প্রাচ্যের সবচেয়ে বড় আলেম আছেন’
‘কে তিনি?’ লোকটি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
‘আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক’
‘তিনি প্রাচ্যের সবচেয়ে বড় আলেম?’ লোকটি প্রশ্ন করেছিল অবাক হয়ে।
‘হা, তিনি পূর্ব অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আলেম। শুধু পূর্ব অঞ্চল নয়, পূর্ব-পশ্চিম সকল অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আলেম তিনি’ সুফিয়ান সাওরি দৃঢ় কন্ঠে বলেছিলেন।
সেই মজলিসে অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ফলে ঘটনাটি অল্পসময়ে দ্রুতই প্রসিদ্ধ হয়ে যায়।
আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক হাদিস পড়ালেন আমাদের। গম্ভীর কণ্ঠে তিনি বলে চললেন, আখবারানা উমারুবনু সাইদিবনি আবি হুসাইন, ক্বলা হাদ্দাসানি আবদুল্লাহিবনু আবি মুলাইকা আন উকবাতাবনিল হারিস ………।পুরো দরসগাহে নেমে এল পিনপতন নিরবতা। ধীর লয়ে একের পর এক হাদিস বলে গেলেন আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক, সহপাঠীরা কেউ লিখে নিল, মেধাবীরা মুখস্থ করে নিল।
মার্ভে আমার সময় বয়ে চলে। আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের ইলমের ভাণ্ডার থেকে উপকৃত হলাম প্রতিনিয়ত, যতই আহরণ করি ততই আরো তৃষ্ণা বেড়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক নিজেও একদিন আমাদের দরসে বললেন, আলেমের জন্য ইলমের সফর সারাজীবন। যখনই সে ইলমের অন্বেষণ থামিয়ে দিবে, সে জাহেলের কাতারে দাঁড়াবে।
দিনের বেলা ব্যস্ত থাকি দরসে। ইবনুল মুবারকের দরস শেষ হলে সহপাঠিদের সাথে ইলমের নানা বিষয়ে আলোচনা করি। একেকজন একেক বিষয়ে পারদর্শী। আলোচনার মাধ্যমে সবার জ্ঞানগুলো আরো সমৃদ্ধ হয়, আরো শোণিত হয়ে উঠে। হেরাত থেকে এসেছে এক ছাত্র। সে আরবী ব্যকরণে খুব দক্ষ। তার পিতা ছিলেন আবু আমর বিন আলা বসরির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফলে আরবী ব্যাকরণে তার দক্ষতা পারিবারিক সূত্রেই। তার সাথে নাহুর বিভিন্ন নিয়মকানুন নিয়ে আলোচনা করি। দিনের বেলা ব্যস্ত থাকি, ফলে বাড়ির কথা, মায়ের কথা খুব একটা মনে পড়ে না। কিন্তু রাতে যখন বিছানায় গা এলিয়ে দেই, স্মৃতিরা এসে ভীড় করে, নিজেকে খুব একা মনে হয়। আমার এলাকার কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে খেলার মাঠের কথা, বন্ধুদের কথা। মায়ের কথা খুব বেশি মনে পড়ে। স্বামীকে হারানোর পর সন্তানকেও বিদায় জানিয়েছেন অনির্দিষ্টকালের জন্য। আমার মায়ের দুঃখ যেন আমাকেও স্পর্শ করে।
বলখ থেকে এক ছাত্র এসেছে। একদিন বিকালে তার সাথে হাঁটতে বের হই। আমরা হেঁটে শহরের বাইরে এক প্রশস্ত ময়দানে চলে এলাম। কথায় কথায় সে বললো, ইবনুল মুবারক অনেক বড় মুহাদ্দিস, সন্দেহ নেই। আমার আফসোস হয়, তিনি আবু হানিফার ছাত্র। আবু হানিফার নানা সমস্যা ছিল। তিনি হাদিসের উপর যুক্তিকে প্রাধান্য দিতেন। তার ফিকহ যুক্তি নির্ভর ফিকহ। আমাদেরকে অবশ্যই যুক্তির উপর হাদিসকে প্রাধান্য দিতে হবে।
বিষয়টি আমার নিজের কাছেও খুব একটা স্পষ্ট না। তাকে কোনো জবাব দিতে পারলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম পরদিন দরসে আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারককে জিজ্ঞেস করবো।
পরদিন একটা ঘটনা ঘটলো। ইবনুল মুবারক সেদিন দরস দেননি। সেদিন দেখা হলো শাম থেকে আসা একজন আলেমের সাথে। তিনি ইমাম আওযায়ির সান্নিধ্য পেয়েছেন। তার কাছে শুনলাম অদ্ভুত এক গল্প।
ইমাম আওযায়ি থাকতেন শামে। নানা সময় ইমাম আবু হানিফা সম্পর্কে নানা কথা তার কানে এসেছিল। তিনি ইমাম আবু হানিফাকে পছন্দ করতেন না। কেউ তার থেকে ইলম নিক এটাও চাইতেন না। একবার আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক গেলেন ইমাম আওযায়ির কাছে। তিনি জানতেন ইমাম আওযায়ি আবু হানিফাকে পছন্দ করেন না। তাই ইবনুল মুবারক তার সামনে ইমাম আবু হানিফা সম্পর্কে কোনো কথা বললেন না। তিনি যে ইমাম আবু হানিফার কাছে পড়ছেন তাও জানালেন না। ইবনুল মুবারকের কাছে একটি খাতা ছিল। সেখানে তিনি আবু হানিফার কাছ থেকে শেখা বিভিন্ন মাসআলা লিখে রেখেছিলেন। ইমাম আওযায়ি খাতাটি দেখে কৌতূহলী হন। তিনি ইবনুল মুবারকের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে খাতাটি পড়তে থাকেন। ইতিমধ্যে নামাজের সময় হয়। ইমাম আওযায়ি নামাজ পড়ে আবার খাতাটি পড়া শুরু করেন। এই খাতায় লেখা ছিল নুমান বিন সাবিত। ইমাম আউযায়ী পড়া শেষে জিজ্ঞেস করেন এই নুমান কে? আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন, ইনিই আবু হানিফা। একথা শুনে ইমাম আউযায়ি বিস্ময়ে অবিভূত হন। তিনি আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারককে বলেন, তার সাথে লেগে থাকো। তার সান্নিধ্যে থাকো।
এরপর থেকে ইমাম আওযায়ি আর কখনো ইমাম আবু হানিফা সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য করেননি।
সময় বয়ে চলে, জীবন বদলে যায়। আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের কাছে প্রায় ৬ মাস হাদিস পড়লাম। তার দরসের স্মৃতিগুলো এখনো চোখে ভাসছে। ইবনুল মুবারকের কাছে পড়া শেষ। আমাকে এখন আরো দূরে যেতে হবে। আমার স্বপ্ন বাগদাদ যাওয়া। স্বপ্নের শহর বাগদাদ, সেখানে আছেন কাজি আবু ইউসুফ। তিনি এখন মুসলিম বিশ্বের প্রধান কাজী। তার কাছে আমাকে ফিকহ পড়তেই হবে। মার্ভ থেকে বিদায়ের দিনটি ছিল খুবই কঠিন। একদিকে বাগদাদের হাতছানি, অন্যদিকে প্রিয় উস্তাদ আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের বিচ্ছেদ, এই দুইয়ের মাঝে সমন্বয় করা ছিল আমার জন্য খুবই কঠিন। আমার চোখে ছিল পানি, উস্তাদের চোখও টলমল করছিল। বিদায়ের আগে ইবনুল মুবারক জরুরি কিছু নসিহাহ দিলেন তিনি আমাকে।
৩
রাত গভীর হচ্ছে। ঘুমাতে হবে। কাল সকালে আবার সফর শুরু আমার। এবারের গন্তব্য বাগদাদ। কিন্তু বাগদাদ পৌঁছার আগে আমাকে পাড়ি দিতে হবে বেশ লম্বা পথ। বাগদাদ পৌঁছতে প্রায় এক মাস লেগে যাবে। আগামীকালের সফর হবে কিরমানের উদ্দেশ্যে। একা একা এত লম্বা পথ সফর করা নিরাপদ নয়। আমাকে খুঁজে নিতে হবে কোনো সওদাগরের কাফেলা, তাদের সাথে চলে যাব কিরমানের দিকে।
আমাকে থাকতে দেয়া হয়েছে ছোট একটা কামরায়। দেয়ালে মাটির প্রলেপ। এককোণে সলতে দেয়া একটা প্রদীপ জ্বালানো। প্রদীপের আলোয় আমার কাঁপা ছায়া ভাসছে দেয়ালে। কামরায় বেশ সুগন্ধি। ভাল করে খেয়াল করে দেখি, প্রদীপের পাশে ছোট একটি কৌটায় সুগন্ধি রাখা। নাহ, এদের ব্যবস্থাপনা বেশ ভাল। অবশ্য খারাপ হলেই বা কী, সফরের এই পথে কোথাও এক রাতের বেশি কাটানোর উপায় নেই আমার।
ভাগ্য ভালো, সকালে এক কাফেলার সন্ধান পেয়ে গেলাম। তারা শিরাজ যাবে। আমি তাদের সাথে জুটে গেলাম। ব্যাপারটা আমার জন্য স্বস্তিকর। বাগদাদ যেতে আমাকে শিরাজ অতিক্রম করতে হবে। এটি কিরমানের পরের শহর। এদিক দিয়ে ভালই হলো, লম্বা পথের জন্য সঙ্গী পেলাম।
সূর্যটা তেতে উঠার আগে আমরা নিশাপুর ছাড়লাম। ধীরে ধীরে গরমের তীব্রতা বাড়লো, পথের উত্তপ্ত ধুলো এসে সুঁইয়ের মত বিঁধলো নাকেমুখে। ছোট কিছু পল্লীর পাশ কাটালাম আমরা। দুপুরে পানির সন্ধানে থামলাম প্রাচীন এক কূপের পাশে। চামড়ার থলেগুলো পানি ভরে নিলাম, দুহাতের আঁজলা ভরে তৃপ্তিসহকারে পান করলাম সুপেয় পানি। সন্ধ্যার একটু আগে ছোট একটা পল্লির কাছে পৌঁছলাম আমরা। জায়গাটার নাম গালে জারি। পল্লির লোকেরা আমাদের দেখে খোঁজখবর নিতে এল। এই ফাঁকে সওদাগররা কিছু কেনাবেচা করে ফেললো। এখানকার মহিলারা নানা নকশাদার কাপড় তৈরী করে। তাদের কাছ থেকে নগদ অর্থে এসব কাপড় কিনে নিল কাফেলার লোকজন। এলাকার লোকজন আমাদের কাফেলা থেকে কিনলো কিছু বাসনপত্র। আমরা রাতটা কাটালাম পল্লির বাইরে। বাহনগুলোকে একপাশে বেঁধে রেখে তাবু খাটানো হলো। সারাদিন সফরের ধকলে শরির ক্লান্ত ছিল। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই গভীর ঘুমে চোখ বুজে এল।
পরদিন সকালে আবার সফর শুরু হলো। ছোট ছোট বালিয়াড়ি পাশ কাটালাম আমরা, পথে একবার মরুঝড়ের মুখোমুখি হলাম। তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি, তবে পুরো শরির বালুতে ভরে গেল। ঘামের সাথে বালু মিশে চটচটে হয়ে যায়। খুব অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি। আমাদের কাফেলায় বয়স্ক একজন মানুষ আছেন। তার পিতা ছিলেন মুহাম্মদ বিন কাসিমের বন্ধু। দেবল বিজয়ের সময় তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাথেই ছিলেন। বয়স্ক মানুষটির মুখে শুনলাম সে সব গল্প।
পথে সাসানিদের পরিত্যক্ত কিছু স্থাপনার পাশ কাটালাম আমরা। এক কালে তাদের কত শক্তি ও গর্ব ছিল। ক্ষমতার দম্ভে তারা ছিল মাতোয়ারা, তাদেরকে দেখলে মানুষের অন্তর হত প্রকম্পিত। আজ তাদের কোনো নামনিশানাও নেই। তাদের এসব স্থাপনা এখন পরিত্যক্ত, সেখানে বাসা করেছে নিশাচর পাখি। এটাই দুনিয়ার পরিণতি।
একঘেয়ে দিন কেটে গেল। রাতের বেলা আমরা খুঁজে বের করলাম ছোট একটি খেজুর বাগান। সাথে ছোট একটি জলাধার আছে। নিজেরা পানি পান করে পশুদেরকেও পান করালাম। বাগানের পাশে তাবু খাটানো হলো। সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও আমি একা বসে রইলাম। সামনের দিনগুলোর কথা ভাবছি। গন্তব্যের শেষ মাথায় আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে, তা চিন্তিত করছে। কাজি আবু ইউসুফ কত বড় মানুষ, তার কত ব্যস্ততা। তিনি কি আমাকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করবেন? আমাকে তার দরসে বসার সুযোগ দিবেন? এসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সবকিছু সহজই হবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ বান্দার নিয়তের বিশুদ্ধতা ও ইখলাস দেখেন। আমার ইলম অর্জনের পথটি তিনি সহজ করে দিবেন ইনশাআল্লাহ, মনে মনে ভাবলাম।
তৃতীয়দিন বিকালে আমরা কিরমান পৌঁছি। এখানে একটি সরাইখানায় আমরা রাত কাটাই। বাজার থেকে কিছু কেনাকাটা করা হল। আমি একটি চাদর কিনলাম। আসার পথে আমার চাদরটি হারিয়ে গেছে। সম্ভবত মরুঝড়ে। কেনাকাটার কারণে রওনা হতে দেরি হয়ে গেল। কিরমান থেকে আমরা বের হলাম পরদিন দুপুরে। ভাগ্যক্রমে, এখানে আমাদের এলাকার এক লোকের সাথে দেখা হয়। সে এসেছিল ব্যবসার কাজে। তাকে আমি আগ থেকেই চিনি। সে ছিল বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। তার কাছে আমার পরিবারের খবর পেলাম। মা কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন, এখন সুস্থ আছেন। তাকে বললাম, মাকে যেন আমার সালাম জানায়। আমি সুস্থ আছি, বাগদাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, এগুলো যেন বলে উনাকে।
সেদিন সন্ধ্যায় আমরা একটি পল্লী এলাকায় থামলাম। আমাদের ইচ্ছা ছিল পল্লির বাইরে তাবু করে থাকবো, কিন্তু এলাকার লোক অতিথিপরায়ণ। তারা আমাদেরকে কোনোভাবেই বাইরে থাকতে দিবে না। জোর করে নিয়েই গেল আমাদের। রাত কাটলো এলাকার সর্দারের প্রশস্ত গৃহে। রাতে ভাল ঘুম হলো না। মাঝরাতে একবার মনে হলো বাইরে কারা যেন হাঁটছে, ফিসফিস করে কথা বলছে। ফজরের নামাজের পর দেখি আমাদের সবার জন্য নাস্তা চলে এসেছে। এই নাস্তা কখন করা হয়েছে, ভেবে অবাক হই। পরে জানতে পারি, রাতের বেলাই তারা আমাদের জন্য খাবার তৈরী করে ফেলেছে, কারণ তারা জানতো সকালে আমরা আবার সফর শুরু করবো। বিষয়টি বেশ দ্বিধায় ফেলে দিল আমাদেরকে। এই মানুষগুলো খামাখা এত কষ্ট করলো। এলাকার লোকজনের চেহারায় কোনো দ্বিধা বা কষ্ট দেখা গেল না, মেহমানদারির সুযোগ পেয়ে সবাই কেমন যেন আনন্দিত।
আবার শুরু হলো একঘেয়ে যাত্রা। দীর্ঘসময় ধরে ঘোড়ার পিঠে বসে থেকে পিঠ ব্যাথা করে মাঝে মাঝে। মাঝে মাঝে সূর্য বেশ তেতে উঠে। দরদর করে ঘাম ঝরে শরির থেকে। জামা ভিজে লেপ্টে যায় শরীরের সাথে।
শিরাজ শহরে আমাদের দুদিন থাকতে হলো। আবহাওয়া খুব খারাপ এখানে। দুদিন বসে রইলাম সরাইখানায়। সময়টা কাটলো লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলে। শিরাজ বেশ প্রাচীন শহর। তবে শিরাজ শহরের বর্তমান কাঠামো গড়ে উঠেছে উমাইয়া শাসনামলে। এ সময় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আস সাকাফির ভাই, মুহাম্মদ বিন ইউসুফ আস সাকাফি শহরের বর্তমান কাঠামোর গোড়াপত্তন করেন। মুহাম্মদ বিন ইউসুফ ছিলেন এই শহরের গভর্নর। সিন্ধ বিজেতা মুহাম্মদ বিন কাসিমও কিছুদিন এই শহরে অবস্থান করেছিলেন। পুরনো এক বৃদ্ধের মুখে শুনলাম আমরা যে সরাইখানায় উঠেছি, এর সামান্য দূরেই ছিল মুহাম্মদ বিন কাসিমের থাকার জায়গা। মনটা উদাস হয়ে গেল। একদিন এ পথেই হেঁটে গেছেন মুহাম্মদ বিন কাসিম। এই শহরেই ছিল মুসলিম বাহিনীর গুরুত্বপূর্ন সেনানিবাস। এখানে আসা যাওয়া করেছে মুজাহিদদের বরকতময় কাফেলা। এই মুজাহিদরা নিশ্চিন্ত জীবনের মায়া ত্যাগ করে বেছে নিয়েছিলেন এক অনিশ্চিত জীবন। নতুন নতুন ভূখন্ড জয় করেছেন তারা, তাদের সবার নাম আজ আমাদের জানা নেই, নেই তাদের কবরের চিহ্নও। তারা উম্মাহকে উপহার দিয়েছেন একটি সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য। উত্তরসূরিদের জন্য নির্মান করেছেন একটি নিরাপদ আবাসভূমি। এখন আমরা যে নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করছি তার পেছনে রয়েছে তাদের অবদান।
অবাক করা বিষয় হলো, এখন মুসলিম বিশ্বের যে সীমানা তা জয় হয়েছে উমাইয়াদের আমলেই। আব্বাসি আমলে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো এলাকা মুসলমানরা জয় করেনি। যদিও বর্তমান খলিফা হারুনুর রশিদ তার পিতার শাসনামলে কয়েকবার রোমানদের সাথে লড়াই করেছেন এবং জয়ী হয়েছেন কিন্তু এ সময় উল্লেখযোগ্য কোনো এলাকা মুসলমানদের হাতে আসেনি। এখন জ্ঞানের নানা শাস্ত্র বিকশিত হচ্ছে, জ্ঞানচর্চার পথ সুগম হয়েছে, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে সেই সকল অখ্যাত মুজাহিদদের অবদান।
তৃতীয়দিন সকালে আমি শিরাজ থেকে বের হই। পল্লি এলাকার কিছু লোক এসেছিল কেনাকাটা করতে। তাদের সাথে জুটে যাই। যতদূর পারি একসাথে যাব, বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।
শিরাজ থেকে ১৫ দিন সফর করে এলাম আবাদান শহরে। টানা সফরে কিছুটা অসুস্থ হয়ে যাই। এখানে একজন চিকিৎসকের সাথে দেখা করি। চিকিৎসক বয়সে আমার চেয়ে একটু বড়, তরুণ। বাগদাদে খলিফার রাজ চিকিৎসক জিবরিল বিন বখতিশুইর কাছে চিকিৎসাবিদ্যা শিখেছেন। তিনি কিছু ওষুধ দিলেন আমাকে। তিনদিন পর সুস্থ হলাম। এখন আমার গন্তব্য বসরা। ছোট একটি কাফেলার সাথে রওনা হলাম বসরার পথে। এদিকের এলাকাগুলো পারস্যের এলাকার মত শুষ্ক নয়। এদিকটা বেশ সুজলা সুফলা। মাঝে মাঝে ছোট ছোট নহর দেখা যাচ্ছে। সাথে রয়েছে খেজুর বাগান। দিনের বেলা বেশ বাতাস থাকে। এই বাতাসটা কেমন যেন অদ্ভুত। গায়ে লাগলেই একটা হিমেল অনুভূতি কাজ করে, মনটা উদাস হয়ে যায়।
তিনদিনের সফর শেষে বসরায় পৌঁছলাম। শহরে প্রবেশ করতেই একটা কোমলতা অনুভব হলো। মনে হলো কেমন একটা প্রশান্তি ছড়িয়ে আছে এই শহরের আলো-বাতাসে। আমার একজন শিক্ষক একবার আমাকে বলেছিলেন, প্রতিটি শহরের নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। একেক শহরে তুমি দেখবে একেক রুপ। যদি তুমি কুফায় যাও তাহলে দেখবে সেখানকার লোকজন হজরত আলী রা. এর ভক্ত। আলাবিদের বাইরে অন্য কারো প্রতি তাদের আগ্রহ নেই। বসরার লোকজন নিরীহ, শান্তিপ্রিয়। সেখানে বরাবরই যুহদ ও তাসাউফের চর্চা বেশ জমজমাট। কোনো প্রকার হানাহানি ও ক্ষমতার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ নেই। তাদের প্রসিদ্ধ প্রবাদ, ‘আল্লাহর বান্দা হিসেবে নিহত হও, হত্যাকারী হয়ো না’। অর্থাৎ, মাজলুম হও, জালেম হয়ো না। উত্তর ইরাকের জাযিরা অঞ্চলে দেখবে খারেজিদের প্রাধান্য। শামের লোকজন উমাইয়াদের ভক্ত। এমনকি এখন আব্বাসিরা ক্ষমতায় এলেও শামের লোকজনের মন থেকে উমাইয়াদের ভালোবাসা মুছে ফেলা যায়নি। মক্কা-মদীনার লোকেরা আবার অন্যরকম। উমাইয়াদের প্রতি তাদের তেমন একটা প্রীতি ছিল না, এখন আব্বাসিদের প্রতিও তাদের তেমন কোনো আবেগ নেই। এর কারণ হলো তারা কাছ থেকে খোলাফায়ে রাশেদার শাসন দেখেছে, ফলে অন্য কারো শাসন তাদের মুগ্ধ করতে পারেনি।
বসরায় ঢুকে উস্তাদের কথাটির সত্যতা পেলাম। এখানকার লোকজনের চলাফেরা ও কথাবার্তায় একটা স্নিগ্ধতা রয়েছে। তাদের আখলাক খুবই সুন্দর। বসরা এলাকাটিও অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশ উন্নত। এখানে বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন ইমারত চোখে পড়লো। এখানকার জামে মসজিদটি নির্মিত হয়েছে শ্বেত মার্বেল পাথর দিয়ে। এর চত্বরে সূর্যের আলো যখন প্রতিফলিত হয়, তা এক দেখার মত দৃশ্য। উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর শাসনামলে এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন উতবা বিন গাজওয়ান। পরে আবু মুসা আশআরি (রা. যখন এ এলাকায় আসেন তিনি এর অবকাঠামো সংস্কার করেন।
শহরটি গড়ে উঠেছে পরিকল্পিতভাবে। শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট কয়েকটি নহর। এমনই একটি নহরের পাশে মুহাম্মদ বিন সুলাইমান হাশেমির দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ। তিনি বসরার শীর্ষ ধনীদের একজন। একটু দূরে প্রাচীন এক প্রাসাদের ধবংসাবশেষ। প্রাসাদটির ফটক ভেঙ্গে গেছে, ভেতরের দেয়ালগুলোও ক্ষয়ে জীর্ণ হয়েছে। এটি ছিল আউস বিন সালাবার প্রাসাদ। উমাইয়া শাসনামলে তিনি ইরাক ও খোরাসানের গভর্নর ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বংশধররা অন্য এলাকায় চলে যায়, তাঁর প্রাসাদটি হয়ে উঠে পরিত্যক্ত।
আমি গন্তব্যের কাছাকাছি চলে এসেছি। বসরা থেকে বাগদাদ যাবো নৌপথে। চাইলে সড়কপথেও যাওয়া যায়, কিন্তু নৌকা ভ্রমণকেই প্রাধান্য দিলাম। আমি মরু অঞ্চলের মানুষ। নৌপথে সফরের অভিজ্ঞতা নেই। তাই বেশ উত্তেজনাবোধ করছি। বিকালে বাজারে একজন মাঝির সাথে দরদাম ঠিক করে এলাম। কাল সকালে তারা খেজুর নিয়ে বাগদাদ যাবে। সামান্য কিছু অর্থ দিলেই তাদের সাথে সফর করতে পারবো।
আমাদের যাত্রা শুরু হলো খুব ভোরে। কাঠের নৌকায় করে আমরা যাত্রা শুরু করি বাগদাদের উদ্দেশ্যে। ছোট একটি নহর থেকে শুরু হয় আমাদের যাত্রা। নহরটি চলে গেছে খেজুর বাগানের মাঝ দিয়ে। হালকা বাতাস বইছে। দুজন মাঝি দাঁড় টানছে। পানি কেটে সামনের দিকে এগুচ্ছে নৌকা। এই নহর মিশেছে সোজা দজলা নদীতে। সেদিন দুপুরে এক জায়গায় নৌকা থামিয়ে কিছু রান্না করা হলো। খাবার শেষে আবার শুরু হলো যাত্রা। সন্ধ্যার দিকে আমরা একটা বসতির পাশে নৌকা থামাই। রাতটা এখানেই কাটানো হয়। পরদিন সকালে আবার সফর শুরু। দুপুরের একটু পরে আমরা বাগদাদের কাছাকাছি পৌঁছে যাই। দূর থেকে একটি শুভ্র প্রাসাদ নজরে আসে। মাঝিকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, এটিই খলিফা হারুনুর রশিদের প্রাসাদ। পুরো মুসলিম বিশ্ব যাকে চেনে কসরুল খুলদ নামে। মনটা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠে। অবশেষে আমি পৌঁছে গেছি বাগদাদে। বাগদাদ শুধু আব্বাসিদের রাজধানী নয়, বরং এটি এখন পুরো বিশ্বের রাজধানী। বাল্যকাল থেকে আমি শুনছি এই শহরটির নাম। অবশেষে আমার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের নৌকা ভিড়বে দজলা নদীর ঘাটে। প্রথমবারের মত আমি পা রাখবো বাগদাদের মাটিতে।
বাগদাদ নামটি মনে হতেই আমার উস্তাদ আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের কথা মনে পড়লো। তিনি এ শহরকে বাগদাদ নামে ডাকা পছন্দ করেন না। তার মতে বাগদাদ শব্দের অর্থ দেবতার দান। তিনি এই শহরকে বলেন মদিনাতুস সালাম, যে নামটি রেখেছিলেন এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা আবু জাফর মানসুর। শুধু আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক নন, ইমাম আসমাঈও এই মত পোষণ করেন। তবে আলেমদের অন্য অংশের মতে বাগদাদ মূলত বাগ ও দাদ দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। এর অর্থ দাদ নামক এক ব্যক্তির বাগান।
আমাদের নৌকা এগুতে থাকে। আমার মনে পড়ে বাগদাদ শহর প্রতিষ্ঠার ঘটনাগুলো। এসব আমি কিছু শুনেছি আমার পিতার মুখে, কিছু শুনেছি উস্তদদের মুখে।
বাগদাদ শহরটি প্রতিষ্ঠা করেন দ্বিতীয় আব্বাসি খলিফা আবু জাফর মানসুর। এ শহর প্রতিষ্ঠার আগে তিনি কুফার সীমান্তবর্তী একটি শহর হাশিমিয়্যাতে অবস্থান করতেন। ১৪১ হিজরীতে এই শহরে আবু জাফর মানসুরের উপর একটি হামলা চালানো হয়, যার ফলে তিনি বাধ্য হন নিজের জন্য নিরাপদ একটি আবাসস্থল খুঁজে নিতে।
এই হামলার পেছনের ঘটনাটি বেশ রোমাঞ্চকর। ১৩৬ হিজরীতে আবু জাফর মানসুরের হাতে নিহত হন আবু মুসলিম খোরাসানি। তিনি ছিলেন একজন দুধর্ষ সেনাপতি, আব্বাসিদের উত্থানে যার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। কিন্তু ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তিনি নিহত হন। আবু মুসলিম খোরাসানির হত্যাকাণ্ডের পর সবচেয়ে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল রওয়ান্দিয়া ফিরকার লোকেরা। তারা ছিল খোরাসানের বাসিন্দা। আবু মুসলিম তার আন্দোলনে তাদেরকে নিজের সাথে রেখেছিলেন। ফলে তার সাথে এই ফিরকার লোকদের সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। এই ফিরকার লোকেরা পূনর্জন্মে বিশ্বাস করত। তাদের বিশ্বাস ছিল আদম আ. এর রুহ আবু মুসলিম খোরাসানির মধ্যে স্থানান্তরিত হয়েছিল। আবু মুসলিমের মৃত্যুর পর তা স্থানান্তরিত হয়েছে উসমান ইবনে রাহিকের মধ্যে। ইনি ছিলেন খলিফার প্রহরীদলের প্রধান। এই ফিরকার লোকদের বিশ্বাস ছিল তাদের খাবার ও পানিয়ের যোগানদাতা হলেন আবু জাফর মানসুর। তিনিই তাদের প্রভু। একদিন তারা দলবদ্ধভাবে হাশিমিয়া শহরে এসে খলিফার প্রাসাদের চারপাশে তাওয়াফের ন্যায় ঘুরতে থাকে। এসময় তারা বলছিল, এটি আমাদের রবের প্রাসাদ। খলিফা তখন তাদের দুশো জনকে বন্দি করেন। এতে তারা মানসুরের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারা বলতে থাকে, আপনি কেন আমাদের লোকদের গ্রেফতার করলেন। তারা কারাগারে হামলা করে নিজেদের লোকদের মুক্ত করে। ক্রমেই হট্টগোল ও কোলাহল বাড়তে থাকে। তাদের লোকেরা শহরের ফটক বন্ধ করে দেয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যে খলিফাকে তারা নিজেদের প্রভু বলে বিশ্বাস করতো, তার উপরই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তাকে হত্যা করার জন্য একে অপরকে উত্তেজিত করতে থাকে। খলিফা তাদের শান্ত করার জন্য প্রাসাদ থেকে বের হয়ে আসেন। এ সময় তিনি ছিলেন অনেকটাই অরক্ষিত। রাওয়ান্দিরা তাকে ঘিরে ফেলে। খলিফার ভাগ্য ভালো, কোনো বিপদ হওয়ার আগেই শহরের নিয়মিত সেনাবাহিনী এগিয়ে আসে এবং তারা রাওয়ান্দিদের কচুকাটা করে ফেলে। এরপর আর কখনো তাদের দেখা যায়নি।
কিন্তু এই ঘটনার ফলে খলিফা সিদ্ধান্ত নেন, নিজের জন্য তিনি একটি নিরাপদ শহর নির্মাণ করবেন। খলিফা তার লোকজন নিয়ে কুফা থেকে বের হন। তিনি বিভিন্ন এলাকা সফর করে বর্তমানে যেখানে বাগদাদ শহরের অবস্থান, এই এলাকায় পৌঁছেন। খলিফা লক্ষ্য করলেন এই খালি জায়গাটা নদীর তীরে অবস্থিত। ফলে যেকোনো অঞ্চল থেকে এখানে সহজে জলপথে জিনিসপত্র আনা নেয়া করা যাবে। খলিফা এখানে কয়েক রাত অবস্থান করলেন তাবু খাটিয়ে। দেখলেন এখানে সবসময় নির্মল মৃদুমন্দ বায়ু প্রবাহিত হয়, ফলে বসবাসের জন্য জায়গাটা বেশ চমৎকার। খলিফার নির্দেশে শুরু হলো শহরের নির্মাণকাজ। খলিফার আদেশে শহরের মাঝখানে নির্মাণ করা হয় প্রাসাদ। এর পাশে নির্মাণ করা হয় জামে মসজিদ। পরে এটি প্রসিদ্ধ হয় জামে আবু জাফর মানসুর নামে।
মাঝিদের পাওনা মিটিয়ে বাগদাদে প্রবেশ করি। শহরের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া প্রশস্ত সড়ক ধরে সামনে এগুতে থাকি। বসরায় একজন আমাকে বলেছে কম দামে ভালো সরাইখানা চাইলে কারখ অঞ্চলে যেতে হবে। কারখের বাজারে বেশকটি সরাইখানা আছে। খরচ কম, মানও ভালো। একটু খুঁজে একটি সরাইখান্য উঠি। ক্লান্তিতে শরিরটা ধরে আছে, কিন্তু মনে বেশ আনন্দ। আগামিকালই উপস্থিত হব কাজি আবু ইউসুফের দরসে।
আসরের নামাজ পড়লাম জামে আবু জাফর মানসুরে। বৃদ্ধ ইমামের সুললিত তাকবীরে মনে প্রশান্তি বয়ে গেল। নামাজের পর মসজিদের চত্বরে বসলাম। মৃদু হিমেল বায়ু বইছে। সফরের সব ক্লান্তি ঝেড়ে দিচ্ছে। আরো অনেকেই চত্বরে বসে আছে। তাদের মুখে নানা গল্প। কৌতূহল নিবৃত্ত করতে না পেরে উঠে দাঁড়াই। একপাশে কয়েকজন বসে গল্প করছে। মনে হচ্ছে উন্মুক্ত আড্ডা। তাদের সাথে বসি। দুয়েকজন ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালেও কিছু বললো না। বুঝতে পারলাম, এই আড্ডায় যে কেউ বসার অনুমতি আছে। কথা বলছেন মাঝবয়সী একজন। তাঁর কন্ঠ বেশ ভরাট। তিনি বলছেন, ‘কয়েক বছর আগের কথা। ইমাম আ’মাশ এসেছিলেন কাজি আবু ইউসুফের সাথে দেখা করতে। সাক্ষাতের পর তিনি একটি মাসআলা জিজ্ঞেস করলেন। আবু ইউসুফ সুন্দর করে মাসআলাটি বলে দিলেন। আ’মাশ প্রশ্ন করলেন, তুমি এই মাসআলা কোথায় পেয়েছো? উত্তরে আবু ইউসুফ বললেন, আপনি নিজেই এই হাদিসটি আমাদেরকে বর্ণনা করেছিলেন। এরপর আবু ইউসুফ সেই মাসআলা সংক্রান্ত হাদিসটি বলে দিলেন। শুনে আ’মাশ বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, হে ইয়াকুব, আমি এই হাদিসটি তোমার পিতামাতা একত্রিত হওয়ার আগ থেকেই জানি। কিন্তু আমি এই হাদিসের এই ব্যাখ্যা এতদিনেও বুঝিনি।’
লোকটি কথা বলে চললেন। আমার মন ভরে গেল। বাগদাদ এসেই আবু ইউসুফের আলোচনা শোনার সৌভাগ্য হলো। আগামিকাল সকালেই ইনশাআল্লাহ তার সাথে আমার দেখা হবে। আমি বসবো তার দরসে। ফিকহের যে জ্ঞান তিনি সঞ্চয় করেছেন আবু হানিফার দরসে বসে, সেই জ্ঞানের কিছু অংশ সংগ্রহের চেষ্টা করবো আমিও।
এশার নামাজে আবু ইউসুফের এক ছাত্রের সাথে পরিচয় হলো। সে এক বছর ধরে উনার দরসে বসছে। তার কাছে নানা বিষয় জানলাম। কথায় কথায় জানালাম, আমিও পড়তে এসেছি। একথা শুনে সে আমাকে কিছু উপদেশ দিল, ‘খুব সতর্ক থাকবে। তার মজলিসের আদব বজায় রাখবে। কথা বলার আগে ভেবে নিবে, কথাটি বলা উচিত হচ্ছে কিনা। আমি কয়েকদিন তার মজলিসে বসেছি। আমাদের সাথে এক লোক তার মজলিসে বসতো, কিন্তু সে কোনো প্রশ্ন করতো না। চুপচাপ থাকতো। একদিন আবু ইউসুফ বললেন, তুমি কথা বলো না কেন? পরে সে জিজ্ঞেস করলো, রোজাদার ইফতার করবে কখন? আবু ইউসুফ বললেন, যখন সূর্যাস্ত হবে তখন। সে আবার প্রশ্ন করে, যদি মধ্যরাত পর্যন্ত সূর্য অস্ত না যায় তাহলে কী করবো? এ প্রশ্ন শুনে আবু ইউসুফ হেসে বললেন, তোমার জন্য চুপ থাকাই উত্তম’
সরাইখানায় ফিরে আসি। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ক্লান্তি এসে ভর করে। মনে ভাসছে নানা চিন্তা। কবে নিজের গ্রামে ফিরতে পারব জানা নেই। ততদিনে কত আপনজনকে হারাবো তাও অজানা। এমনও হতে পারে গ্রামে ফিরে দেখবো অনেকেই আর নেই। জোর করে মাথা থেকে এসব চিন্তা তাড়িয়ে দেই। এসব ভাবা যাবে না। ভাবলে আবেগ এসে ভর করবে। ইলমের একাগ্রতা নষ্ট হবে। আমাকে এখন একাগ্রতা ধরে রাখতে হবে সবকিছুর আগে।
আমার রিহলাহ এখনো শেষ হয়নি, বরং রিহলাহ সবে শুরু।
(কৈফিয়ত- এই লেখায় যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা সকলেই ঐতিহাসিক চরিত্র। তার সাথে সম্পৃক্ত যে সকল উক্তি বা ঘটনা এসেছে তাও ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। তারিখু বাগদাদ, ওফায়াতুল আইয়ান, সিয়ারু আলামিন নুবালা, শাজারাতুয যাহাব, হিলয়াতুল আউলিয়া, মুজামুল বুলদান, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে এসব তথ্য নেয়া হয়েছে। স্থানের নামগুলোও সঠিক। স্থাপনার বর্ননাগুলোও ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। যেমন, বসরার জামে মসজিদ সম্পর্কে যে তথ্য দেয়া হয়েছে তা ইতিহাসগ্রন্থে বর্ণিত আছে। আউস বিন সালাবার প্রাসাদ সংক্রান্ত তথ্যটিও বানোয়াট নয়। হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দির শেষভাগ পর্যন্ত এই প্রাসাদের ধবংসাবশেষ টিকে ছিল)