
শাইখুল আজম আবরার
আমার দাখিল এবং আলিম—দু’টোতেই সাইন্স ছিল। কনভেনশনাল অ্যাডুকেশন সিস্টেমে দাখিল হলো এসএসসি সমমান আর আলিম হলো এইচএসসি সমমান। একজন কীর্তিমান অলস ও ফাঁকিবাজ ছাত্র হবার পরেও ওপরওয়ালা তাঁর নিজ কৃপায় কীভাবে কীভাবে যে স্টেরিয়োটাইপড ‘ভালো’ রেজাল্ট পাইয়ে দিয়েছিলেন, তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। মাদরাসাকে যে ফ্যামিলিগুলো পছন্দ করেন, তাদের সাইন্স নিয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চাওয়া ছেলেমেয়েরা স্বাভাবিকভাবে মাদরাসায় কেবল দাখিল পর্যন্ত পড়ে। শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে সাইন্স ব্যাকগ্রাউন্ডের অধিকাংশ ছাত্রই ইন্টারমিডিয়েট লেভেলে গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়।
আমি ছিলাম কমসংখ্যক সেই ব্যতিক্রম ছাত্রদের একজন। ফ্যামিলির ইচ্ছার (বিশেষ করে আমার আম্মু) প্রতি সম্মান দেখিয়ে স্বেচ্ছায় আলিমে আমি মাদরাসাতেই সাইন্সে ভর্তি হই। আম্মুর পরামর্শ অনুযায়ী দু’টো প্ল্যানকে সামনে রেখে এমন ডিসিশান নেয়া। প্ল্যান এ : সাইন্স নিয়ে পড়ার কারণ ছিল মেডিক্যালে ট্রাই করা। প্ল্যান বি : মাদরাসায় পড়ার কারণ ছিল কোনো কারণে মেডিক্যালে না হলে মাদরাসাতেই কন্টিনিউ করা।
আলিম পরীক্ষার পর জরুরি ভিত্তিতে আমার ডান হাতের একটা অপারেশন করাতে হয় এবং প্রায় তিন মাসের মতো বিশ্রামে থাকতে হয়। এই অসুস্থতা এবং এর দরুণ মেডিক্যালের প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ না হওয়ায় ভর্তিপরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা হয়ে ওঠেনি। এদিকে আব্বুর পরামর্শ ছিল একটা বছর গ্যাপ না দিয়ে আপাতত কোথাও ভর্তি হয়ে পরবর্তী বছর মেডিক্যালে ট্রাই করা। ফলে প্ল্যান বি–এর অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম–এর ফ্যাকাল্টি অব শারিয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ–এর হাদিস ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হই।
এর মধ্যে একটা বিপত্তি বাঁধে। পড়তে গিয়ে ফ্যাকাল্টি ও ডিপার্টমেন্টকে ভালোবেসে ফেলি। ভেতর থেকে এই ফ্যাকাল্টিতে পড়াশোনা চালিয়ে নেবার একটা প্রেরণা আসে। ফলে দ্বিতীয় বছর মেডিক্যালে ট্রাই করার ঝক্কি ঝামেলা বাদ দিয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে শরিয়াহ ফ্যাকাল্টিতে পড়াশোনা চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। অ্যারাবিক মিডিয়ামে পড়াশোনা হবার কারণে আরবিতে দক্ষ হওয়ার একটা তাড়া সৃষ্টি হয়। প্রতিটি সেমিস্টারে একেকটি কোর্সের মাধ্যমে ইসলামিক স্টাডিজের একেকটি মাস্টারপিস সাবজেক্টের বিশাল জগতের সাথে পরিচিত হতে থাকি। সেই সাথে নতুন নতুন অনেকগুলো আরবি বইয়ের সাথে পরিচয় ঘটে। ইসলামিক স্টাডিজকে নতুন করে জানার একটি সফর শুরু হয়। শুরুর দিকে লাইব্রেরিতে গিয়ে অজস্র মাস্টারপিস বইয়ের সমারোহ দেখে নিজেকে খুব ছোট আর অসহায় মনে হতো! ভাবতাম, জীবন এতো ছোট কেন? এক জীবনে এসব বই শেষ করা কি আদৌ সম্ভব হবে কোনোদিন?
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আমার জানামতে সাবজেক্ট হিসেবে ইসলামিক স্টাডিজ আছে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, সামান্য কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিভিন্ন সরকারি কলেজে। আর ইসলামিক স্টাডিজকে ফ্যাকাল্টি করে এর অধীনে বিশেষায়িত বিষয় (যেমন : কুরআন, হাদিস, দা’ওয়াহ) আছে এমন বিশ্ববিদ্যালয় বোধহয় দুটো আছে। একটি পাবলিক; ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া। আর অন্যটি প্রাইভেট; আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। এর বাইরে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অনুমোদনকে সামনে রেখে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন আলিয়া মাদরাসাতে বিশেষায়িত বিষয় আছে।
লেখাটির এ পর্যায়ে এসে ইসলামিক স্টাডিজের হাইওয়েতে আমার ছোট্ট সফরের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু পর্যালোচনা শেয়ার করছি।
১. ইসলামিক স্টাডিজের মূল ভাষা আরবি হওয়ায় এর অধিকাংশ তুরাস হলো আরবিতে। ফলে কোনো স্টুডেন্ট যদি বিশাল এই মহাসাগরে অবগাহন করতে চায়, তাহলে তাকে ন্যুনতম লেভেলের আরবি–দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত—উভয় প্রকারের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।
২. শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে ক্লাসে অনেক সময় পুরো বই পড়ানো বা যথাযথ আকারে পড়ানো সম্ভব হয় না। ফলে অনার্স মাস্টার্স শেষ করে ছাত্রদের দূর্বলতা থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে এক্সট্রা কারিকুলার উদ্যোগ হিসেবে রিডিং ক্লাব করা যেতে পারে। যেখানে সিস্টেমেটিকভাবে বিভিন্ন ক্লাসিক্যাল ও আধুনিক বইপত্রের মতন বা টেক্সট এবং শরাহ বা কমেন্টারি পড়া হবে।
৩. প্রতিষ্ঠানে আরবি–দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ডিবেটিং ক্লাব, বক্তৃতার ক্লাবসহ বিভিন্ন কো–কারিকুলার কার্যক্রম হাতে নেয়া যেতে পারে।
৪. ছাত্রদের দাওয়াহ, ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাস্তব প্রয়োজনকে সামনে রেখে কিছু কার্যকরী ওয়ার্কশপ হাতে নেয়া যেতে পারে।
৫. ইসলামিক স্টাডিজের স্টুডেন্টদের নিজেদের স্বার্থেই ইংরেজিতে ন্যুনতম লেভেলের দক্ষতা সৃষ্টি করা উচিত। ক্যারিয়ারের পাশাপাশি অ্যাকাডেমিক প্রয়োজনেও এই বিষয়টি সমান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিভিন্ন মাস্টারপিস রচনা ইংরেজি ভাষায় রচিত। বইগুলোকে তারস্বরে পড়ে ঠিকঠাকভাবে বুঝতে ইংরেজিতে পড়ার বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। ব্যাপারটি যেকোনো ভাষার রচনার ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্য।
৬. স্রেফ পরীক্ষা–কেন্দ্রিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে কোয়ালিটি রিসার্চের দিকে মনযোগী হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে ছাত্রদের রিসার্চ মেথোডলজি নিয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণের আওতায় আনা দরকার। পাশাপাশি রিসার্চ করার জন্য পর্যাপ্ত স্পন্সর ও ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থাও থাকা দরকার। একটি সুসমন্নিত উদ্যোগ ইসলামিক স্টাডিজ থেকে রিসার্চ অরিয়েন্টেড প্রজন্ম বের করে আনতে পারে।
শেষমেষ আমার একটা ছোট্ট পর্যবেক্ষণ দিয়ে শেষ করি লেখাটা। নন–ইসলামিক স্টাডিজের যতগুলো বিষয় আছে, বিষয়গুলোর পেছনে যত ক্রিয়েটিভ কাজ হয়, ইসলামিক স্টাডিজের পেছনে তেমন কোনো কাজ হয় বলে আমার চোখে পড়ে না। কিছুটা ‘চলছে গাড়ি যাত্রাবড়ি’ টাইপ অবস্থা। এমন গতিহীন অবস্থার মধ্য দিয়ে ডাইনামিক তালিবুল ইলম বা আলেম আসলে উঠে আসা সম্ভব কিনা সেই প্রশ্ন আপনাদের কাছে রাখলাম।
মূল্যবান সময় নষ্ট করে অগোছালো একটা লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
লেখক : ছাত্র, আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম