
আবু সাঈদ:
ইসলামী সভ্যতার এক প্রোজ্বল দৃষ্টান্ত লাইব্রেরি ব্যবস্থা। এটা কেবল সভ্যতারই অংশ নয়, শিল্পও বটে। এর মাধ্যমে ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষিত হয়। জানা যায় বিভিন্ন জাতির দান-অবদান। এজন্য ইসলামের সূচনা-কাল থেকেই মুসলমানরা লাইব্রেরি ব্যবস্থার প্রতি ছিল বড় যত্নবান। আমির-সুলতান থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণও লাইব্রেরির প্রতি খুব আগ্রহী ছিল। ফলে মুসলমানদের ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছিল বহু লাইব্রেরি। সেগুলো ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বই-পুস্তকে পরিপুষ্ট। পাঠাগারগুলোর সমৃদ্ধি একটি ঘটনা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে কাসীর রহমতুল্লাহি আলাইহি আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবীর এক সচীব একবার এক লক্ষ কিতাব একসাথে সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু এতে সুলতান-সভাসদদের থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণেরও কেউ অবাক হয়নি। বরং সবাই আশ্চর্য হয়েছিল কিতাব-স্বল্পতায়। তাদের কাছে এক লক্ষ কিতাব সংগ্রহ নিতান্তই সাধারণ মনে হয়েছে।’ লক্ষ কিতাবের বিশাল সম্ভার যাদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করতে পারেনি, তাদের পাঠাগারের সমৃদ্ধি পাঠক সহজেই অনুমান করে নিতে পারবেন।
পাঠাগার ব্যবস্থার সূচনা
হিজরি সালের প্রথম শতাব্দীতে যেসব খলিফা অতিবাহিত হয়েছেন, লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় তাদের আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। কিতাব সংগ্রহ ও পাঠাগারের সমৃদ্ধি এক ধরনের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর অবশ্য কারণও ছিল। তখন ক্ষমতার মসনদে যেতে হলে শরীয়তের প্রাজ্ঞ ব্যক্তি হতে হতো। ইলমের ময়দানে সমকালীন উলামায়ে কেরাম কর্তৃক স্বীকৃত হতে হতো। এজন্য তারা একদিকে যেমন কিতাব সংগ্রহ ও পাঠাগারের সমৃদ্ধির প্রতি জোর দিতেন, অনুরূপ বিভিন্ন কিতাবাদী অধ্যয়নপূর্বক শরীয়তে পরিপুষ্ট হবার প্রতিও মনোনিবেশ করতেন। আলেমদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা, লাইব্রেরিকে তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া, লেখালেখি ও রচনার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা ছিল তাদের অন্যতম ব্রত। আলেমদের স্বীকৃতি তার সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে আলেমদের অবদান তার সময়কালকে উজ্জ্বল রাখবে। এজন্য নিজেদের স্বার্থেই আলেমদের সাথে সম্পর্ক রাখা খলিফাদের জন্য অবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের মত অন্যান্য সভ্যতা সংস্কৃতির প্রতিও খলিফাদের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। এজন্য অন্যান্য ভাষার জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থাদি অনুবাদের প্রতিও তারা গুরুত্ব দিতেন। ফলে তাদের পাঠাগারে অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের কিতাবাদিরও বিশাল সম্ভার গড়ে উঠেছিল। জীবনীভিত্তিক ইতিহাসের গ্রন্থবলীতে এর বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে।
প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক জালাল উদ্দীন কিতফি প্রণীত আখবারুল উলামা বিআখবারিল হুকামা গ্রন্থে এসেছে, খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজিজ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর গ্রন্থাগারে চিকিৎসাশাস্ত্রের বিখ্যাত কিতাব আহরানুন নাস ছিল। একবার এ কিতাবের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা উঠলে তার গুণাগুণে তিনি মুগ্ধ হন।সেবককে তিনি কিতাবটি গ্রন্থাগার থেকে এনে তার নামাজের স্থানে রাখতে বলেন। যেন কিতাবটি আদ্যোপান্ত পড়ে শেষ করতে পারেন। শেষ করার পর তার কাছে মনে হলো, কিতাবটির ব্যাপক প্রচার-প্রসার হওয়া উচিত। পরে এ বিষয়ে তিনি ইস্তেখারা করেন। চল্লিশ দিন পর যখন তার মন সায় দিলো, তিনি কিতাবটির ব্যাপক প্রচার-প্রসার শুরু করলেন।
ইমাম ইবনে আব্দিল বার রহমতুল্লাহি আলাইহি তার অমর গ্রন্থ জামিউ বয়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহিতে বলেন, ইমাম যুহরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহমতুল্লাহি আলাইহি তার খেলাফতকালে বড় বড় মুহাদ্দিসদের কাছে এই মর্মে পত্র প্রেরণ করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে সকল হাদিস বিশুদ্ধ সূত্রে তাদের নিকট পৌঁছেছে, তা যেন খলিফা বরাবর লিখে পাঠায়। তখন আমরা বিপুলসংখ্যক সহিহ হাদিসের সংকলন তৈরি করি। তিনি সংকলনগুলো খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত সকল শহরে প্রেরণ করেন।
ঘটনা দুটি থেকে একথা প্রতীয়মান হয় যে, খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রহমতুল্লাহি আলাইহি যেভাবে সুনানে রাসুলের প্রচার-প্রসার করেছেন, অনুরূপ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার প্রচার-প্রসারেও অবদান রেখেছেন। উভয়টির মাঝে কোন বৈপরীত্য জ্ঞান করেননি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, তিনিসহ অন্যান্য উমাইয়া খলিফাদের খেলাফতকালে দ্বীনি ইলমের প্রচার-প্রসারই অধিক পরিমাণে হয়েছে। তবে খেলাফতের অধীনে যেসব পাঠাগার গড়ে উঠেছে, তাতে দ্বীনি বিষয়াদির মতো জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার কিতাবাদিরও বিপুল সমাহার ছিল। প্রখ্যাত আরবি সাহিত্যিক ইয়াকুত হামাবি মু’জামুল উদাবা গ্রন্থে বলেন, ‘উমাইয়া খলিফা খালিদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া ছিলেন বিশিষ্ট কবি। ছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞান ও রসায়ন শাস্ত্রেরও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব।… কথিত আছে, তিনি আরব-আজমের কোন ইলম শেখা বাকি রাখেননি।’ ইবনে খাল্লীকান বলেন, তিনি চিকিৎসা ও রসায়ন শাস্ত্র বেশ ভালোভাবেই আয়ত্ত্ব করেছিলেন। এ বিষয়ে তার কিছু কিতাব রয়েছে। সেগুলো তাঁর জ্ঞানের গভীরতার পরিচয় বহন করে।
আব্বাসীদের শাসনামলে লাইব্রেরি ব্যবস্থা
উমাইয়া শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৩২ হিজরীতে। ক্ষমতার পালাবদলে খেলাফতের নিয়ন্ত্রণ যায় আব্বাসীদের অধিকারে। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাইরে মুসলমানদের অবাধ বিচরণ শুরু হয়। হেকমত-ফালসাফা ও অন্যান্য শাখা মুসলমানদের পদচারণায় মুখরিত হয়। এ ব্যাপারে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হাজী খলিফা রহমতুল্লাহি আলাইহি কাশফুয যুনুন গ্রন্থে বলেন, ‘শোনো, উমাইয়াদের শাসনামলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার চর্চা ছিল সীমিত পরিসরে। খেলাফতের নিয়ন্ত্রণ যখন আব্বাসীদের হাতে যায়, বিশেষ করে আব্বাসী দ্বিতীয় খলিফা মনসুর এর যুগে পুরোদমে সেসবের চর্চা শুরু হয়। তিনি যেমন ফিকাহ শাস্ত্রের মহীরুহ ছিলেন, দর্শনশাস্ত্রেরও ছিলেন মহাদিকপাল। তিনি দার্শনিকদের খুব মূল্যায়ন করতেন।’
ইমাম ইবনুল আরাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তারিখু মুখতাসারিদ দুয়াল গ্রন্থে কাজী সায়েদ আন্দালুসী থেকে আব্বাসীদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্রমবিকাশ তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘খেলাফতের নিয়ন্ত্রণ যখন আব্বাসীদের হাতে আসে, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও তার ব্যাপক প্রচার প্রসারের প্রতি তারা বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেন। পুরোদমে এর চর্চা শুরু করেন দ্বিতীয় খলিফা মনসুর। পরে তার নাতি খলিফা মামুনুর রশিদের খেলাফতকালে তা পূর্ণতা লাভ করে। খলিফা মামুন বিশ্বের যেখানে যে ইলম ছিল, সংশ্লিষ্টদের কাছে তা তলব করেন। তিনি রোমানদের কাছে দর্শনশাস্ত্রের কিতাবাদি চেয়ে পত্র প্রেরণ করেন। তারা কিতাবাদি প্রেরণ করলে মামুন দক্ষ ও অভিজ্ঞ অনুবাদকদের মাধ্যমে তার অনুবাদ করিয়ে নেন। মানুষকে তা পড়া ও শেখার প্রতি জোর তাগিদ দেন।’
এ বিন্দুতে অবশ্য ইবনে খালদুনের দ্বিমত রয়েছে। তিনি বলেন, ‘খলিফা মনসুরই প্রথম রোমানদের থেকে দর্শনের কিতাবাদি সরবরাহ করেন। রোমানরা মামুনের অনুরোধে বিজ্ঞ অনুবাদকদের মাধ্যমে দর্শন ও পদার্থ বিজ্ঞানের নানা কিতাব অনুবাদ করে প্রেরণ করেছিল। কথিত আছে, সেসবের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞানের জগৎ বিখ্যাত গ্রন্থ উকলিদাস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি ছিল। এসব কিতাব পড়ে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের আগ্রহ তীব্র হয়ে ওঠে।’
এখান থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয় যে, ইসলামি ইলমের ময়দানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার প্রবেশ মুসলিম খলিফা ও তার দরবারের বিজ্ঞ আলেমদের মাধ্যমে হয়েছে। তবে তা কোন ধরনের অন্যায়ের শিকার হয়নি। সংশ্লিষ্টদের অবদান যথাযথভাবে স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু মধ্যযুগে ইউরোপীয়রা যখন ইসলামি শিক্ষা লাভ করেছে, এক্ষেত্রে তারা মুসলমানদের অবদান সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে। গোপন করেছে ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ অনেক বাস্তবতা।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক খতিবে বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তারিখে বাগদাদ গ্রন্থে বলেন, খলিফা মনসুর উলামায়ে কেরামকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় কিতাব রচনার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। তার অনুরোধেই ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি আল মুআত্তা গ্রন্থ সংকলন করেছিলেন। তিনি মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক রহমতুল্লাহি আলাইহিকে মানব সভ্যতার ইতিহাস রচনা করতে বলেছিলেন।
খলিফা মনসুর উলামায়ে কেরামকে যেভাবে কিতাব রচনার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন, ইলম সংরক্ষণের জন্য তদ্রুপ কাগজে লেখার প্রতিও উৎসাহ দিতেন। তখন মানুষ চামড়া-হাড্ডি ইত্যাদিতে লিখে ইলমের সংরক্ষণ করতো। তিনি উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে কাগজ তৈরির ব্যবস্থা করেন। চামড়া ইত্যাদিতে লেখা হলে মুছে যেতো। সুবিধাবাদীদের তা মুছে নিজেদের মনগড়া কিছু যোগ করারও সুযোগ থাকতো। কাগজে সে সুযোগ নেই। কাগজের লেখা ঘষে তোলা হলে বোঝা যায়। তখন জালিয়াতিও স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক কালকাসান্দি সুবহুল আ’শা গ্রন্থে বলেন, পরবর্তীতে হারুনুর রশিদ রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করে কাগজে লেখাকে বাধ্যতামূলক করে দেন।
রচনা ও অনুবাদের ধারা খলিফা হারুনুর রশিদের যুগেও অব্যাহত ছিল। বরং হারুনুর রশিদের খেলাফতকালকে রচনা ও অনুবাদের সোনালী যুগ বলা চলে। তার হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী ইতিহাসের বিখ্যাত গ্রন্থাগার দারুল হিকমাহ। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক কালকাসান্দি ইসলামী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগারগুলোর আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন, ইসলামী ইতিহাসের সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার তিনটি। প্রথমটি আব্বাসীয় খলিফারা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাতে এ পরিমাণ কিতাব ছিল যা গণনা করে শেষ করার মত নয়। গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান কিতাবাদিতে পৃথিবীর অন্য কোথাও তার তুলনা মেলা ভার। দ্বিতীয়টি ফাতেমী খলিফারা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাতেও গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদির প্রচুর মজুদ ছিল। তৃতীয়টি বনী উমাইয়ার শাসকবৃন্দ প্রতিষ্ঠা করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদিতে তাও কোন অংশে কম ছিল না।
ঐতিহাসিক আন-নাদিম আল-ফিহরিস্ত গ্রন্থে দারুল হিকমাহ প্রসঙ্গে বলেন, দারুল হিকমাহর সর্বপ্রথম পরিচালক ছিলেন আবু সাহাল ইবনে নওবখ্ত। তিনি ব্যক্তি হিসেবে অভিজ্ঞ অনুবাদক ছিলেন। তার তত্ত্বাবধানেই দারুল হিকমাহর অনুবাদকরা অনুবাদ-কার্য সম্পাদন করতেন। ইসলামি ইতিহাসের প্রসিদ্ধ এই মাকতাবার প্রথম পরিচালক হিসেবে আজও তিনি অমর হয়ে আছেন।
তখন মাকতাবা হয়ে উঠেছিল সরকারি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। ফলে সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মত মাকতাবার কার্যক্রমের জন্যও লোক নিয়োগ দেওয়া হতো। মাকতাবায় কাজ করার প্রতি তখন মানুষের প্রবল আগ্রহ ছিল। মানুষ প্রতিযোগিতামূলকভাবে এতে অংশগ্রহণ করতো। তিনটি বড় বড় সালতানাতে এ প্রতিষ্ঠান বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে।
এক. বাগদাদ কেন্দ্রিক আব্বাসী সালতানাত ও তাদের অধীনস্থ অঞ্চলগুলোতে। এ সালতানাতের অধীনে পরিচালিত হতো বায়তুল হিকমাহ। এর পরিচালক ছিলেন সাহল ইবনে হারুন।
দুই. মিশর শাম ও পশ্চিমা কিছু ইসলামী রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত ছিল ফাতেমী সালতানাত। এর অধীনে পরিচালিত হতো দারুল ইলম। এর পরিচালক ছিলেন প্রখ্যাত লেখক শাবিশাতি। আদ-দিরায়া তার অমর কীর্তি।
তিন. আন্দালুস ও পাশ্চাত্যের আরো কিছু অঞ্চল জুড়ে ছিল উমাইয়া সালতানাত। তাদের অধীনে পরিচালিত হতো খিযানিতুল উলুমি ওয়াল কুতুব। এর পরিচালক ছিলেন তালিব কুসাই সাকলাবী। তিনি ছিলেন উমাইয়া শাসক খলিফা মুস্তানসির বিল্লার আযাদকৃত গোলাম।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মাকরী নাফহুত তীব গ্রন্থে খিযানাতুল উলুমি ওয়াল কুতুব সম্পর্কে বলেন, এ মাকতাবা প্রতিষ্ঠা করেন উমাইয়া শাসক খলিফা মুস্তানসির বিল্লাহ। ইলমের প্রতি তিনি ছিলেন যারপরনাই অনুরক্ত। আলেমদের খুব শ্রদ্ধা করতেন। কিতাব সংগ্রহ করা ছিলো তার অদম্য নেশা। ফলে এ মাকতাবায় তিনি এত বিপুলসংখ্যক গ্রন্থমালার সমাবেশ ঘটান যে, এরপূর্বে এত কিতাবের পসরা কেউ বসাতে পারেনি।
ইমাম ইবনে হাযম জাহিরি রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, খিযানাতুল উলুমের পরিচালক তালিদ কুসাই আমাকে বলেন, মাকতাবার কিতাবাদির মোট চুয়াল্লিশটি তালিকা রয়েছে। প্রত্যেকটি তালিকা বিশ পৃষ্ঠা জুড়ে। কিতাবের এই বিপুল সমাহারের কারণে তা উলামায়ে কেরামের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে খলিফা লোক পাঠাতেন। যেখানে যে কিতাব পাওয়া যেত, সংগ্রহ করে আনাতেন। ফলে গ্রন্থাগারটি এতটাই সমৃদ্ধ হয়েছিল যে, তার পূর্বের ও পরের কেউ এত সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
ফাতেমীদের মাকতাবা
ফাতেমীদের মাকতাবার বিশালতা নিয়ে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে আবী শামা রাওযাতাইন ফি আখবারিদ দাওলাতাইন গ্রন্থে উল্লেখ করেন, এটা ছিল তৎকালের ‘সপ্তাশ্চর্যের’ একটি। কথিত আছে, কায়রোর রাজপ্রাসাদে (ফাতেমীদের রাষ্ট্রীয় ভবনে) এত বিশাল মাকতাবা ছিল যে, তৎকালে এর কোন নজির ছিলনা। এই মাকতাবার অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল নুসখার আধিক্য। একেকটা কিতাবের শতাধিক নুসখাও মজুদ ছিল। কথিত আছে, এক তাফসীরে তাবারীরই বারোশো নুসখা ছিল। নুসখার আধিক্যের মতো মূল গ্রন্থের সংখ্যাও অনেক ছিল।
সুলতানদের বইয়ের রাজ্য
এতো গেলো খলিফাদের কিতাব সংগ্রহের সৌখিনতা। সুলতানরা কি তবে পিছিয়ে ছিলেন? সালতানাত টিকিয়ে রাখার জন্য তাদেরও তো প্রয়োজন ছিল আলেমদের সমর্থন। ইতিহাস বলে, এজন্য সাধ্যের সবটুকু উজাড় করে সুলতানরাও মাকতাবা গড়ে তুলতেন। সমাহার ঘটাতেন বিপুল সংখ্যক রচনাবলীর। নিজে শরয়ী বিষয়ে পরিপুষ্ট হতেন। আলেমদেরও কাছে ডাকতেন। বিভিন্ন বিষয়ে রচনার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। প্রয়োজনীয় কিতাবাদি সরবরাহ করতেন। সুলতানি মাকতাবার কিছু নমুনা তবে পেশ করা যাক।
কয়েকটি সুলতানি মাকতাবা
এক. প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সাফদি নুকাতুল হামায়ান গ্রন্থে উল্লেখ করেন, লেবাননের ত্রিপোলি শহরে তখন বনু আম্মার আলকাত্তানীর সুলতানগণ শাসন করতেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি সংগ্রহ করে সেখানে তারা গড়ে তুলেছিলেন এক বিশাল মাকতাবা। তারা ফাতেমী সালতানাতের অধীনতা স্বীকার করতেন।
দুই. প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে আবী উসাইবিয়া উয়ূনুল আমবা গ্রন্থে বলেন, জগৎ বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা বোখারার অধিপতি সুলতান নুহ ইবনে মানসুর আস-সামানীর মাকতাবা সম্পর্কে বলেন, সুলতান একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার ব্যক্তিগত ডাক্তার চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সর্বত্র সুখ্যাতি থাকায় সভাসদরা আমাকে ডাকে। আমি গিয়ে সুলতানের চিকিৎসা কাজে অংশগ্রহণ করি। কিছুদিন সুলতানের চিকিৎসার নিবিড় তত্ত্বাবধান দরকার ছিল। সে সুবাদে রাজপ্রাসাদে আমি থেকে যাই। রাজপ্রাসাদের মাকতাবার সুখ্যাতি ছিল দশদিক। তাই মাকতাবা পরিদর্শন ও কিছু সময় অধ্যয়নের অনুমতি গ্রহণ করি। মাকতাবাটি ছিল বিশাল, সুবিন্যস্ত ও বহু কক্ষবিশিষ্ট। প্রত্যেকটি কক্ষে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের কিতাবাদি রাখা হয়েছে। সুদৃশ্য আলমারিতে অত্যন্ত মনোরমভাবে কিতাবগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন কক্ষ পরিদর্শন করে আমি ইতিহাসের কক্ষে প্রবেশ করলাম। কিতাবের তালিকায় এমন অনেক কিতাবের নাম দেখলাম, যার নাম অনেক মানুষই জানেনা। এমনও কিছু কিতাব দেখতে পেলাম, যা সেখানে জীবনের প্রথম ও শেষ বারের মতই দেখেছিলাম।
তিন. নূহ সামানীর সমকালীন সুলতান ছিলেন আযদুদ্দীন আল-বায়ুহি। তিনিও গড়ে তুলেছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহু গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি সমৃদ্ধ এক বিশাল গ্রন্থালয়। এই মাকতাবা সম্পর্কে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মাকদাসি আহসানুত তাকাসীম গ্রন্থে বলেন,আযদুদ্দাওলা সিরাজে এক বিশাল গ্রন্থালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পৃথিবীর কোথাও এত বিশাল মাকতাবা আমার চোখে পড়েনি। তাতে ৩৬০ টি কক্ষ রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের বিষয় ছিল ভিন্ন। প্রত্যেক কক্ষের জন্য ছিলেন আলাদা পরিচালক, তত্ত্বাবধায়ক ও কিতাব সংগ্রহকারী। যেন একেকটি কক্ষ একেকটি মাকতাবা। এতে নিয়োগ দেওয়া হতো সময়ের সেরা ব্যক্তিবর্গকে। ন্যায়পরায়ণতা ও তাকওয়ার পরীক্ষায় তারা হতেন শতভাগ উত্তীর্ণ। কিতাব সংগ্রহের জন্য তাদেরকে পৃথিবীর দিক দিগন্তে পাঠিয়ে দেওয়া হত। তারা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কিতাব সংগ্রহের চেষ্টা করতেন। ফলে সেসময় পর্যন্ত রচিত সকল কিতাব সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে ওঠেছিল।
সভাসদদের বইয়ের রাজ্য
খলিফা ও সুলতানদের দ্বারা তাদের সভাসদবৃন্দও প্রভাবিত হয়েছিলেন। তারাও গড়ে তুলেছিলেন খ্যাতনামা বহু মাকতাবা। সেসবের আলোচনাও স্থান পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়। তাদেরও কিছু নমুনা পরিবেশন করা হলো।
এক. বায়ুহি সালতানাতের মন্ত্রীপ্রধান ফজল ইবনে আমিদ গড়ে তুলেছিলেন বিশাল এক কিতাবকানন। এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বিশিষ্ট দার্শনিক মাস্কুয়াহ। তিনি তার অমর গ্রন্থ তাজারিবুল উমামে এই মাকতাবা সম্পর্কে বলেন, খোরাসানের বাহিনী যখন বায়ুহী সালতানাত দখল করে সর্বত্র লুটতরাজ আর ধ্বংসযজ্ঞের রাজত্ব কায়েম করে, লুটতরাজ থেকে বাদ পড়েনি মন্ত্রী-প্রধানের বাড়িও। তারা ঘোড়ার আস্তাবল, ধন-সম্পদ ও অন্যান্য বিষয়-আশয় লুণ্ঠন করে। কিন্তু মাকতাবার প্রতি কোনো অবিচার করেনি। এ সময় আমি লক্ষ্য করেছি, মন্ত্রীপ্রধান সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন তার এ মাকতাবা নিয়ে। তার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই মাকতাবা। এতে এতপরিমাণ কিতাব ছিল যে, শতাধিক উট বোঝাই করা হলেও তা শেষ হবে না। দর্শন ও পদার্থবিজ্ঞানের বিশাল সম্ভার ছিল এতে।
দুই. বায়ুহি মন্ত্রী সাহেব ইবনুল ঈমাদেরও ছিল বিপুল সংখ্যক কিতাবের সমাহার। ঐতিহাসিক ইয়াকুত হামাবি তার অমর কীর্তি মু’জামুল উদাবাতে এ গ্রন্থাগারের মূল্যায়নে ইবনুল ঈমাদেরই একটি উক্তি উল্লেখ করেছেন। ইবনুল ঈমাদ বলেন, আমার এই বইবাড়িতে দুই লক্ষ ছয় হাজার বই আছে।
অতঃপর ইয়াকুত হামাবি বলেন, একবার নূহ সামানী গোয়েন্দা মারফত ইবনুল ঈমাদকে প্রস্তাব করেন, আপনি আমার সালতানাতে চলে আসেন। আপনাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। ইবনুল ঈমাদ সে প্রস্তাব এ বলে প্রত্যাখ্যান করেন যে, আমি এমন সম্প্রদায়কে কিভাবে বিদায় জানাব, যাদের অবদানে গড়ে উঠেছে আমার ভীষণ জনপ্রিয়তা। উন্নীত হয়েছি আমি এই মহা মর্যাদায়। আমার রয়েছে বিশাল কিতাবকানন। চার শতাধিক উটও তা বহন করে শেষ করতে পারবে না। অন্যান্য বিষয়াদি তো আছেই। তবে বলুন আমি আপনার সালতানাতে কিভাবে গমন করি!
ইয়াকুত হামাবী রাই শহরের একটি বিরল মাখতুতার (হাতে লেখা পান্ডুলিপি) আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, এক ইতিহাসবিদ লিখেছেন, এ কিতাবটি তিনি ইবনুল ঈমাদের ওয়াকফকৃত মাকতাবায় দেখেছিলেন। হয়তো আমাদের এই আলোচিত মাকতাবাই সেই মাকতাবা, যার কথা সেই ঐতিহাসিক’ লিখেছেন।
লেখকদের বইয়ের রাজ্য
মাকতাবা প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত লেখকবৃন্দও। তারাও গড়ে তুলতেন বিশাল বিশাল বইবাড়ি। মাকতাবার ইতিহাসে তাদেরও রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে তাদেরও পাওয়া যায় বিশেষ সন্ধান। নিম্নে তাদেরও কিছু নমুনা পেশ করা হল।
এক. প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে কাসীর রহমতুল্লাহি আলাইহি আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে বলেন, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী রহমতুল্লাহি আলাইহির ব্যক্তিগত লেখক ফাযেল বাইসানী একবার লাখখানেক কিতাব একসাথে ক্রয় করেছিলেন। কিন্তু এ ঘটনা তৎকালে কোন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারেনি। যেন ব্যাপারটি নিতান্তই সাধারণ ছিল।
দুই. ঐতিহাসিক কালকাসান্দি উল্লেখ করেন, সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী যখন ফাতেমী সালতানাতের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছিলেন, তখন তাদের মাকতাবা বিক্রির মনস্থ করেন। আইয়ুবী সালতানাতের কাজী ফাযিল একাই তা ক্রয় করে নেন। পরে তার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায়ে ফাজেলিয়ার গ্রন্থাগারে সব ওয়াকফ করে দেন। সমৃদ্ধ এ গ্রন্থাগারটি আইয়ুবী সালতানাতের শেষ দিন পর্যন্ত মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আলেমদের বইয়ের রাজ্য
এবার আসা যাক উলামায়ে কেরামের বইয়ের রাজ্যে। আলেমদের কিতাব সংগ্রহের সূচনা হয়েছে সাহাবায়ে কেরাম রাযিআল্লাহু আনহুমের যুগ থেকেই। প্রত্যেক সাহাবীর কাছেই ছিল কোরআনের মুসহাফ ও অন্যান্য জ্ঞান সম্বলিত ইলমি আধার। কুরআন সংকলনের ইতিহাসে এসবই ছিল সংকলনের ভিত্তি। অনেক সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমের কাছে হাদিসও লেখা ছিল। সহিফায়ে আবু হুরাইরা, সহিফায়ে ইবনে ওমর তার একেকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ইবনে সাআদ তার তাবাকাতে কুবরা গ্রন্থে উল্লেখ করেন, হাররার যুদ্ধের সময় হযরত উরওয়া ইবনে যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহুর কিতাবাদি পুড়ে যায়। তিনি সেসবের জন্য অনেক আফসোস করতেন। তিনি বলতেন,সে কিতাবগুলো আমার কাছে আমার ধন-সম্পদ, পরিবার-পরিজন ও প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয় ছিল। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, সাহাবায়ে কেরামের যুগেও কিতাবাদির প্রচলন ছিল। ইলম বিলুপ্তির ভয়ে লিখে রাখার প্রতি তারাও ছিলেন বিশেষ যত্নবান। এজন্য ধরা হয় ধর্মকেন্দ্রিক বই-পুস্তকের সংগ্রহ সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকেই শুরু হয়েছে।
ইমাম ইবনু আবদিল বার রহমতুল্লাহি আলাইহি জামিয়ূ বয়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ইমাম ইউনুস ইবনে ইয়াজিদ আল-আইলী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম যুহরী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে বললাম, ‘আপনার কিতাবগুলো আমাকে দেখান। তিনি কিছু কিতাব নিয়ে এলেন। তাতে কবিতা ছিল।’ এর দ্বারা বুঝা যায়, উলামায়ে কেরামের কাছে ধর্মীয় কিতাবাদির পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ের কিতাবাদিও ছিল।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আন-নাদিম বলেন, ইমাম ওয়াকি রহমতুল্লাহি আলাইহি ইন্তেকালের সময় বিশাল এক মাকতাবা রেখে যান। তাতে ছয় সিন্দুক কিতাবাদি ছিল। একেকটি সিন্দুক তুলতে অন্তত দুই পুরুষের প্রয়োজন পড়তো। তাঁর দুইজন ক্রীতদাস ছিল। এরা রাতদিন লেখালেখিতেই ব্যস্ত থাকতো।
ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত মাকতাবা গড়ার প্রতি উলামায়ে কেরামের আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে। একসময় তা এতটাই প্রবল হয় যে, একেকজন আলেম আমির-উমারা এমনকি সুলতানদের মত মাকতাবা গড়ে তুলতেন। তখন কোন আলেমের কাছে পাঁচ হাজার কিতাব থাকলে বলা হতো, তিনি তো রাজকীয় গ্রন্থাগারের অধিপতি। এজন্যই প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে যিবারাহ আস-সানআনী মুলহাকে তাবে গ্রন্থে ফকীহ আহমদ ইবনে আব্দুল আজিজ রহমতুল্লাহি আলাইহিকে ‘রাজকীয় গ্রন্থাগারের অধিকারী’ আখ্যায়িত করেছেন। জীবনীভিত্তিক ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে এর আরো বহু নজির পাওয়া যাবে।
মাকতাবার প্রকারভেদ
গ্রন্থাগার তখন বিভিন্ন ধরনের হত। ব্যক্তিগত লাইব্রেরি যেমন ছিল, গণগ্রন্থাগারও ছিল। ছিল অনেক ওয়াকফকৃত কিতাবকানন। ওয়াকফের মাকতাবা সাধারণত মাদরাসা, মসজিদ বা খানকা কেন্দ্রিক গড়ে উঠতো। যিনি এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতেন, তিনিই এসব গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা করতেন। তবে কিতাব ওয়াকফে অন্যরাও অংশ নিতেন। আবার ব্যক্তিগত পাঠাগারও কখনো ব্যক্তির ওসিয়তের কারণে ওয়াকফের পাঠাগারে রূপ নিতো। খলিফা-সুলতান সভাসদ ও উলামায়ে কেরাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পাঠাগার ছিল ব্যক্তিগত পাঠাগারের পর্যায়ভুক্ত। সে সম্পর্কে পূর্বে বিশদ বিবরণ গত হয়েছে। এবার তবে গণপাঠাগারের কিছু নজির পেশ করা যাক।
গণ পাঠাগার প্রসঙ্গ
আব্দুল হাকিম জুমাহী কর্তৃক মক্কার সন্নিকটে প্রতিষ্ঠিত মাকতাবাটিকে গণগ্রন্থাগারের উদাহরণ হিসেবে আনা যায়। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় হিজরী প্রথম শতকের শেষ দিকে। বর্তমানে বিভিন্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত ক্লাবের সাথে এর অনেকটা মিল রয়েছে। এটা কেবলই লাইব্রেরী ছিল না। এতে সাংস্কৃতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। অনুষ্ঠিত হতো বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও। স্বল্প অবসরের জন্যও ছিল নানা ক্রীড়ার ব্যবস্থা। এর পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত ছিল তৎকালীন বিশিষ্ট কবি আহওয়াস আনসারী। এ গণগ্রন্থাগার প্রসঙ্গে কোরেশীয় ঐতিহাসিক জুবায়ের বিন বাক্কার জামহারাতু নাসাবি কুরাইশ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, জুমাহী মক্কার নিকটে একটি গৃহ নির্মাণ করেন। এতে দাবা ও পাশা খেলার ব্যবস্থা ছিলো। শিশুদের জন্য ছিল বিভিন্ন খেলার আয়োজন। কিতাবাদিরও ছিল বিশাল সম্ভার। গৃহটির দেয়ালে কীলক লাগানো ছিল। অবসর যাপনের জন্য মানুষ সেখানে যেতো। জামা খুলে কীলকে ঝুলিয়ে রাখতো। এরপর নিজ পছন্দের খেলায় মেতে উঠতো। কেউ কেউ মন দিত বই পড়ায়।
ওয়াকফের মাকতাবা
মসজিদ-মাদ্রাসা খানকা বা হাসপাতাল কেন্দ্রিক মাকতাবার উদাহরণও ইতিহাসে প্রতুল। মু’জামুল বুলদান গ্রন্থে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইয়াকুত হামাবী বলেন, ‘খোরাসানের মারও শহরের জামে মসজিদে ছিল এক বিশাল মাকতাবা। তাতে ছিল অমূল্য সব গ্রন্থের বিপুল সমাহার। যদি তাতারিরা এ শহরে ধ্বংসযজ্ঞ না চালাতো, তবে এ একটি মাকতাবার কারণে এ শহর সকলের ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতো। এই মাকতাবাগুলো যদি ধ্বংস না হতো, আমি আজীবন এ শহরে থেকে যেতাম। এই শহর সবদিক থেকেই ইলম অর্জনের উর্বর ভূমি। মানুষগুলো অমায়িক। দারুণ সৌহার্দ্যপূর্ণ। এখানের মাকতাবাগুলো যেন অমূল্য রত্নের বিরল খনি। আমি যখন এদেশ ছাড়ি, এখানে দশ দশটি মাকতাবা ছিল। তা মূল্যবান কিতাবে এতটাই সমৃদ্ধ ছিল যে, বিশ্বজুড়ে আমি তার কোন তুলনা খুঁজে পাইনি।’
তারপর হামাবী খোরাসানের মাকতাবা দশটির আলোচনা করেছেন। ১-২. জামে মসজিদে দুটি মাকতাবা ছিল। একটিকে আজিজিয়া অন্যটিকে কারিমিয়া বলা হত। আজিজিয়াতে প্রায় তের হাজার কিতাব ছিল। ৩. সুলতান মুস্তাওফি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় একটি ওয়াকফের মাকতাবা ছিল। ৪-৫. দুই সামআনির নামে দুটি মাকতাবা ছিল। ৬.আল মাদরাসাতুল আমিদিয়াতে ছিল একটি মাকতাবা। ৭. নিজামুল মুলক হাসান ইবনে ইসহাক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ছিল আরেকটি মাকতাবা। ৮. মাজদুল মালিক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ছিল ভিন্ন একটি মাকতাবা। ৯.আল খাযায়িনুল খাতুনিয়া নামের ছিল অন্য একটি মাকতাবা। ১০. মাদ্রাসায়ে সুফিয়ার খানকায় জমিরিয়া নামের একটি মাকতাবা ছিল।
ইয়াকুত হামাবি এসব মাকতাবা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। জমিরিয়া প্রসঙ্গে বলেন, এই মাকতাবা থেকে কিতাব নেওয়া সবচেয়ে সহজ ছিল। আমার ঘরে সব সময় এ মাকতাবার অন্তত দুই শত কিতাব থাকতো। আমি এসব কিতাব মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করতাম। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য টুকে রাখতাম। আমি এসবে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, পরিবার-পরিজনের কথা পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলাম। আমি আমার এ কিতাব (মু’জামুল বুলদান) এর অধিকাংশ তথ্য এখান থেকেই সংগ্রহ করেছিলাম।
এগুলো ব্যক্তি বা জনসাধারণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ওয়াকফের মাকতাবা। ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে সুলতান কর্তৃক নির্মিত মাদ্রাসাগুলোতে ওয়াকফের বিভিন্ন মাকতাবার আলোচনা এসেছে।
ওয়াকফের সুলতানি মাকতাবা
এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে আব্বাসী খলিফা মুস্তানসির বিল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায়ে মুস্তানসিরিয়ার মাকতাবা। ৬৪০ হিজরী সনে খলিফা নিজে এর উদ্বোধন করেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে গুয়াতা হাওয়াদেসে জামেআহ গ্রন্থে এ মাকতাবা সম্পর্কে বলেন, এ মাকতাবায় অনেক গুরত্বপূর্ণ কিতাবাদি ছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে ১৬০ টি উট বোঝাই করে এর কিতাবাদি আনা হয়েছিল। খলিফার ব্যক্তিগত পাঠাগারের পরিচালক জিয়া উদ্দিন আহমদ কিতাবগুলো সুবিন্যস্ত করেছিলেন। এর পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ করা হয় অভিজ্ঞ দশজন ব্যক্তির উপর। তাদের একজন ছিলেন শামস ইবনে আলী কাতবি। এই গ্রন্থাগারটি মোগলদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়।
ওয়াকফকৃত গ্রন্থাগারগুলোর সমৃদ্ধির কারণ
ওয়াকফকৃত গ্রন্থাগারগুলো সাধারণত অন্যান্য গ্রন্থালয়ের চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ হতো। এর কারণও ছিল। একজন আলেমের যখন মৃত্যুর ক্ষণ ঘনিয়ে আসতো, তখন তার সবচে বেশি পেরেশানি থাকতো এসব কিতাব নিয়ে। হতে পারে এসব এমন ব্যক্তির হাতে পড়বে, যে কদর বুঝবে না। যথাযথ হক আদায় করবে না। তাই অনেকে মৃত্যুর আগেই কিতাবগুলো কোথাও ওয়াকফ করে দিতেন। কেউ আবার মৃত্যুর পূর্বে তা ওয়াকফের জন্য ওসিয়ত করে যেতেন। জীবনীভিত্তিক ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে এর অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এর দ্বারা বুঝা যায়, ওয়াকফ করা তখন আলেমদের সাধারণ আচারে পরিণত হয়েছিল। এভাবে বিভিন্ন আলেমের জীবনভর সংগ্রহ যদি কোন গ্রন্থাগারে একত্রিত হয়, তবে তার সমৃদ্ধির সাথে অন্যান্য গ্রন্থাগার কুলিয়ে পারে? নিম্নে জীবনীভিত্তিক ইতিহাসের গ্রন্থাবলী থেকে বিভিন্ন আলেমের ওয়াকফের ঘটনা তুলে ধরা হলো।
১. হামাবি মু’জামুল বুলদান গ্রন্থে বলেন, প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে হিব্বান বাস্তি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি মৃত্যুর পূর্বে এক লোককে ওসিয়ত করে যান, মৃত্যুর পর সে যেন তার কিতাবগুলো দারুল কুতুবে পৌঁছে দেয়। যারা এগুলো থেকে অনুলিপি করতে চায়, তাদের জন্য যেন সুযোগ রাখা হয়।
২. ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে জাযলাহ আত-তীব রহমতুল্লাহি আলাইহি মৃত্যুর পূর্বে তার কিতাবাদি ইমাম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহির মাজার সংলগ্ন মাকতাবায় ওয়াকফ করে দেন।
৩. প্রখ্যাত মুহাদ্দিস খতিবে বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি মৃত্যুর সময় তার কিতাবাদি ওয়াকফ করে দেওয়ার ওসিয়ত করে যান।
৪. মুহাম্মদ ইবনুল বান্ধী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ পরিমাণ কিতাব সংগ্রহ করেছিলেন, সমসাময়িক অন্য কেউ সে পরিমাণ সংগ্রহ করতে সমর্থ হননি। তিনি তার সকল কিতাব দামেস্কের সামিসাথী খানকার গ্রন্থাগারে ওয়াকফ করেন।
৫. ইমাম আবুল মাআলি আর রাশিদি তার কিতাবাদি আল জামিউল মানিঈর গ্রন্থাগারে ওয়াকফ করেন।
৬. আল্লামা হামাবী মু’জামুল বুলদান গ্রন্থে বলেন, রশিদ উদ্দিন ওয়াতওয়াত এক কিতাবে লিখেছেন,আমি আমার হালাল উপার্জনে হাজারখানেক বই ক্রয় করি। এবং তার সবকয়টি মুসলমানদের উপকারার্থে ওয়াকফ করি।
৭.ইমাম ইবনে কাসীর রহমতুল্লাহি আলাইহি আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে বলেন, খলিফা মুস্তানসির বিল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায়ে মুস্তানসিরিয়ার গ্রন্থাগারে খলিফা এ পরিমাণ কিতাব ওয়াকফ করেছিলেন যে, পৃথিবীতে এর জুড়ি মেলা ভার।
কোন কোন আলেম মৃত্যুর পূর্বে কিতাবাদি বিক্রিও করে দিতেন। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি আদ্দুরারুল কামিনা গ্রন্থে বলেন, ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহমতুল্লাহি আলাইহি কিতাব সংগ্রহের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্ত ছিলেন। ফলে তার মাকতাবায় এ পরিমাণ কিতাব জমা হয়েছিল যে, তার ছেলেরা নিজেদের প্রয়োজনীয় কিতাবাদি রাখার পর যেসব কিতাব ছিল, দীর্ঘ কাল পর্যন্ত তা বিক্রি করেছিল।
আবার কেউ কেউ দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে কিতাব বিক্রি করতে বাধ্য হতেন। তবে তখন তারা এতোটাই কষ্ট পেতেন, যেন প্রিয়জন হারানোর ব্যথাকেও তা হার মানাবে। কেউ আবার যুহুদ অবলম্বনের মানসে কিতাবাদি জ্বালিয়ে দিতেন। ইমাম জাহেয রহমতুল্লাহি আলাইহি আল-বয়ান ওয়াত-তিবইয়ান গ্রন্থে প্রখ্যাত ভাষাবিদ আবু আমর ইবনুল আলা আল-বাসরীর জীবনীতে উল্লেখ করেন, আরবি ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে তিনি এ পরিমাণ কিতাবাদি রচনা করেন যে, কিতাবের স্তুপ তার মাকতাবার ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। অতঃপর তিনি যখন যুহুদ অবলম্বনের ইচ্ছা করলেন, এসব পুড়িয়ে দেন। সমাজের যথাযথ মূল্যায়নের অভাবেও অনেকে কিতাবাদি পুড়ে ফেলেছিলেন। বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শাফেয়ী ফকিহ আবু হাইয়ান আত-তাওহিদী রহমতুল্লাহি আলাইহি কী বেদনা বিধুর বচনে তার কিতাব পুড়ানোর কথা ব্যক্ত করেছেন! তিনি বলেন, ‘শোনো, আমি আমার কিতাবাদি পুড়িয়ে ফেলবো না কেনো বলো। রাতদিন একাকার করে কষ্ট ক্লান্তির অবশেষে ইলমের কত অজানা দিগন্ত তাতে উন্মোচন করেছি। আমি এসব কার জন্য লিখেছি বলো! মানুষ কি এর যথাযথ মূল্যায়ন করেছে! বয়স তো আর কম হয়নি। নব্বইয দশক পরও কি আর অপেক্ষা করা যায়! তবে এসব কিতাব আর কার জন্য রেখে যাব! মূল্যায়নের অভাবে আমার পূর্বের অনেকেও তো তাদের কিতাব জ্বালিয়ে দিয়েছেন। তারা তো অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাদের অনুসরণই তবে শ্রেয়। এজন্য আমিও আমার কিতাব পুড়িয়ে ফেলেছি।’
কারো কারো কিতাব অনিচ্ছায় দুর্ঘটনায় পুড়ে যেতো। হাফেজ যাহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাজকিরাতুল হুফফাজ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ১৬৭ হিজরীতে মিশরের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনে লাহিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহির কিতাব এক দুর্ঘটনায় পুড়ে যায়। তিনি কিতাব থেকেই হাদিস বর্ণনা করতেন। এই ঘটনার পর তিনি যখন স্মৃতি থেকে হাদিস বর্ণনা শুরু করেন, স্মৃতিবিভ্রাটজনিত বিভিন্ন ভুলের শিকার হন।
আল্লামা ইবনে কাসীর রহমতুল্লাহি আলাইহি আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ইমাম খিরাকি হাম্বলী রহমতুল্লাহি আলাইহি বাগদাদে গড়ে তুলেছিলেন এক বিশাল গ্রন্থাগার। বাগদাদে যখন খারেজীদের উৎপাত শুরু হল, বিভিন্নজন সাহাবায়ে কেরামের শানে গুস্তাখি শুরু করলো, তিনি বাগদাদ থেকে বেরিয়ে যান। আর তার কিতাবাদি রেখে যান এক মাকতাবায়। এসময় এক অগ্নিঘটনায় সে গ্রন্থাগার উড়ে যায়। ফলে খিরাকির কিতাবগুলোও নিঃশেষ হয়ে যায়।
ইয়াকুত হামাবি মু’জামুল উদাবা গ্রন্থে উল্লেখ করেন, উসমান ইবনে জিন্নী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, শায়খ আবু আলী আল-ফারসি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, একবার বাগদাদে বিরাট এক অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে বাগদাদবাসীর কিতাবাদি সব পুড়ে যায়।… আমি তখন শায়খকে বললাম, তবে কী বলে আপনি নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিলেন? শায়খ অত্যন্ত বেদনাতুর কন্ঠে আমাকে বললেন, আরে, আমি তো শোকে পাথর হয়ে দীর্ঘ দুই মাস পর্যন্ত কারো সাথে কথাই বলতে পারিনি।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মাকরিযী আল মাওয়ায়েজ ওয়াল ইতেবার গ্রন্থে বলেন, একবার কায়রো পাহাড়ের এক কেল্লার মাকতাবায় আগুন ধরে যায়। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদির এক বিশাল সম্ভার ছিল। সেখানকার ক্রীতদাসরা পুড়ে যাওয়া কিতাবাদির পাতাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে শহরে বিক্রি করেছিল। মানুষ পোড়া পাতাগুলো থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি লাভ করেছিলো।
অনেকের কিতাব পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। ইমাম ইবনুল জাওযী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ৫৫৪ সালে একবার ভয়াবহ বন্যা হয়। তখন আমার সব কিতাব ডুবে নষ্ট হয়ে যায়। একটিমাত্র কিতাব বেঁচে যায়। তাতে ইমাম আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহির স্বহস্তে লিখিত দুটি পৃষ্ঠা ছিল।
ইবনে আবী উসাইবিয়া এ বিষয়ে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ও চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, আমির আবুল ওয়াফা মুবাশ্বির ইবনে ফাতেক ইলম অন্বেষণে ছিলেন অত্যন্ত আগ্রহী। বিভিন্ন স্থান থেকে কিতাব সংগ্রহ করে তিনি গড়ে তুলেছিলেন বিশাল এক বইয়ের রাজ্য। অধিকাংশ সময় কিতাব নিয়েই পড়ে থাকতেন। যখন সফরে বের হতেন, সঙ্গে বই-খাতা নিতেন। কোথাও যাত্রাবিরতি হলে কিছু লিখতেন। কিংবা পড়তেন। তিনি লেখাপড়াকেই নিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিবেচনা করতেন। তার স্ত্রী ছিলেন খানদানি ঘরের মেয়ে। তবে কিতাবাদি পড়ার অভ্যাস ছিল না। আবার স্বামীর এ অভ্যাসকে তার উপর অবিচার মনে করতো। এজন্য আমির যখন মারা যান, এ মহিলা কিতাবাদির উপর তার ক্ষেদ মেটালো। তাদের বাড়ির মাঝে ছিল এক বিশাল জলাশয়। মহিলা তার দাসী সহ আমিরের সকল কিতাব জলাশয়ে ছুড়ে মারল। সংবাদ পেয়ে মানুষজন ছুটে গেলে কিছু কিতাব হেফাজত করা সম্ভব হয়। তবে অনেক কিতাবই ডুবে নষ্ট হয়ে যায়।
রাজনৈতিক জিঘাংসার ফলেও অনেক মাকতাবা ধ্বংস হয়ে যায়। বহিরাগত শত্রুরাও কম ক্ষতি করেনি মাকতাবা শিল্পের। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সরকারের রোষানলেও হারাতে হয়েছে অনেক মাকতাবা। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক কালকাসান্দি ইসলামী সভ্যতার সর্ববৃহৎ তিন মাকতাবার পরিণতি আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, যতদিন ফাতেমীয় খিলাফত ছিল, তাদের মাকতাবা টিকে ছিল। যখন ফাতেমী সালতানাতের সূর্য ডুবে গেল, তাদের মাকতাবাও ধ্বংস হয়ে গেল। উমাইয়াদের মাকতাবাও তাদের খেলাফতের পতনে ভেঙ্গে পড়ল। আব্বাসীদের মাকতাবা তাতারীরা গুঁড়িয়ে দিল।
ইমাম ইবনুল আসীর রহমতুল্লাহি আলাইহির আল কামেল নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ৫৫৫হিজরীর যুদ্ধে যখন কাজী ইবনুল মুখাররাম বন্দী হন, তার কিতাবাদি বাজেয়াপ্ত করা হয়। সেসবে দর্শনশাস্ত্রের অনেক কিতাব ছিল। সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সাওয়া নগরীর মাকতাবা সম্পর্কে ইয়াকুত হামাবী বলেন, তাতারীরা যখন সাওয়া নগরী দখল করে, তারা সে শহরের মাকতাবা ধ্বংস করে দেয়। মাকতাবাটি এতটাই সমৃদ্ধ ছিল যে, তার মতো দ্বিতীয় আরেকটি কোথাও ছিল না।
ইলম অন্বেষণে আলেমগণের ত্যাগ
ধনীর ঘরে জন্ম নিলেও আলিমগণ পরিশেষে অসচ্ছলই হয়ে যেতেন। ইলম অন্বেষণের পেছনে বাবার রেখে যাওয়া সমস্ত সম্পদ ব্যয় হয়ে যেত। এজন্য দরিদ্রতা ছিল আলেমগণের নিত্যদিনের সঙ্গী। আলেমদের জন্য কিতাব কেনা ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তথাপি তারা পানাহার ও পরিচ্ছদের ওপর কিতাব সংগ্রহ করাকে প্রধান্য দিতেন। স্বেচ্ছায় দরিদ্র্যতা গ্রহণ করতেন।
ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাহাজিবুল আসমা ওয়াল লুগাত গ্রন্থে বলেন, ইমাম ইবনুল মাদীনী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন যে পরিমাণ হাদিস লিখেছেন অন্য কেউ সে পরিমাণ হাদিস লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। তার পিতা মাঈন মৃত্যুর সময় তার জন্য দেড় লক্ষ দিরহাম দেখে যান। (বর্তমানে তা ১.৩ মিলিয়ন ডলার হবে।) তিনি সম্পত্তির সবটুকু হাদিস অন্বেষণে ব্যয় করেন। শেষ পর্যন্ত তার অবস্থা এই হয়েছিল যে, পরার মতো তার কোন জুতা ছিল না।
ইমাম ইবনুল জাওযী রহমতুল্লাহি আলাইহি তার ছেলের কাছে লেখা এক পত্রে ইলম অন্বেষণে ব্যয় করা অর্থ সম্পর্কে বলেন, প্রিয় বৎস! আমার পিতা ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। মৃত্যুর সময় তিনি আমার জন্য রেখে যান অঢেল সম্পদ। কিন্তু আমি যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছি, আমার আত্মীয়-স্বজন আমাকে মাত্র বিশ দিনার ও দুটি ঘর দিয়েছে। আর বলেছে, সর্বসাকুল্যে এ-ই তোমার পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তি। আমি এ বিশ দিনার দিয়ে কিতাব সংগ্রহ করে নিয়েছি। বাড়িদুটিও বিক্রি করে ইলম অন্বেষণে ব্যয় করেছি। অতঃপর সম্পদ বলতে আমার আর তেমন কিছু ছিল না। তবুও তোমার পিতা এই আমি লাঞ্চিত হইনি কখনো।
ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি যাইলু তাবাকাতিল হানাবিলা গ্রন্থে বর্ণনা করেন, ইমাম ইবনুল খাশশাব হাম্বলী রহমাতুল্লাহি আলাইহি যে মুহাদ্দিস প্রয়াত হতেন, তার কিতাবাদি কিনে রাখতেন। ফলে তার কাছে অনেক মাশায়েখের কিতাব জমা হয়েছিল। তিনি সবসময় জামার আস্তিনে কিতাব রাখতেন। মৃত্যুর সময় তার সব কিতাব ওয়াকফ করার জন্য ওসিয়ত করে গিয়েছিলেন। তবে এক-দশমাংশ কিতাবই ওয়াকফ করা হয়েছিল। বাকিগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল।
ইমাম যাহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাজকিরাতুল হুফফাজ গ্রন্থে বলেন, ইমাম আবুল আ’লা আল হামাযানী রহমতুল্লাহি আলাইহি হামাযানে এক বিশাল গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিলেন। নিজের সব কিতাব তাতে ওয়াকফ করেছিলেন। অনেক কিতাবের লেখকের স্বহস্তে লিখিত নুসখাও সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। বড় বড় বিভিন্ন কিতাব সুন্দর ও সুস্পষ্ট হস্তাক্ষরে লাভ করেছিলেন। অধিক পরিমাণে হাদিস সংগ্রহ ও বিভিন্ন কিতাবের মূল কপি সংগ্রহে সমকালীনদের মধ্যে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ। তিনি যা লিখতেন নোকতা ও হরকত দিয়ে লিখতেন।
ইবনে হাজার আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি ইম্বাউল উমর গ্রন্থে উল্লেখ করেন, মিশর ও শাম অঞ্চলের কাজী ইব্রাহিম রহমতুল্লাহি আলাইহি কিতাব সংগ্রহে ছিলেন খুবই সৌখিন। তিনি যে কিতাব কিনতেন, তার সর্বোত্তম নোসখা কিনতেন। এরপর যদি লেখকের হাতে লিখিত কোন নোসখার সন্ধান পেতেন, তাও সংগ্রহ করে নিতেন। ফলে লেখকের স্বহস্তে লিখিত কিতাবের এক বিশাল সম্ভার তার মাকতাবায় গড়ে উঠেছিল। মৃত্যুর সময় তিনি এসব জামাল উদ্দিন মাহমুদ আসতাদারের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তিনি এসব কায়রোর জামিউল কারদারীতে ওয়াকফ করেন।
লাইব্রেরির নিয়ম-নীতি
লাইব্রেরির কিতাব সংরক্ষণের জন্য উলামায়ে কেরাম বহু জোর দিয়েছেন। তারা ফতোয়া দিয়েছেন, কিতাব চুরি করা হারাম। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনুল জাওযী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, অনেকে এমন কিছু বিষয়কে সাধারণ মনে করে, যা আদৌ সাধারণ নয়। বরং এই বিষয়ে শিথিলতা করা বড় অন্যায়। যেমন ছাত্ররা কিতাব ধার নিয়ে ফেরত না দেওয়া…! এসব বিষয় হালকা মনে হলেও মোটেই বৈধ নয়।
যারা কিতাব ওয়াকফ করতেন, কিতাব সংরক্ষণের স্বার্থে কিছু নিয়ম নীতিও বেঁধে দিতেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম তাজ উদ্দিন সুবকী রহমতুল্লাহি আলাইহি মুঈদুন নিয়াম গ্রন্থে বলেন, সাধারণত ওয়াকফকারীগণ কিতাবাদি সংরক্ষণের স্বার্থে ব্যবহারের কিছু নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করেন। যেমন, কিতাব নেওয়ার জন্য সমমূল্যের কোন জিনিস বন্ধক রাখতে হবে। এরূপ শর্তারোপ করা বৈধ। এক্ষেত্রে পরিচালক কাউকে বন্ধক ছাড়া বই দিতে পারবে না। তবে বন্ধকি জিনিস থেকে লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষও কোন ধরনের ফায়দা গ্রহণ করতে পারবে না। কাউকে ফায়দা গ্রহণের সুযোগও দিতে পারবে না।
ইমাম ইবনে জামাআহ রহমতুল্লাহি আলাইহি তার অমর গ্রন্থ তাজকিরাতুস সামী’ ওয়াল মুতাকাল্লিম-এ বলেন, কারো কিতাব কেনার সামর্থ্য থাকলে অনুলিপি করার অনুমতি নেই। যদি কিতাব কেনার সামর্থ্য না থাকে, তবে অনুলিপিকারদের মাধ্যমে অনুলিপি করিয়ে নেবে। তাও সম্ভব না হলে নিজে অনুলিপি করার অবকাশ রয়েছে।
ইবনে জামাআহ রহমতুল্লাহি আলাইহি আরো বলেন, যখন পাঠাগারের কোন কিতাব অনুলিপি করতে চাইবে, কিতাবটি জমিনের উপর খুলে বসবে না। বরং দুইদিকে দুইটি জিনিস দিয়ে নিবে। অথবা কিতাবটি রেহেলে রাখবে। অত্যন্ত যত্নের সাথে পৃষ্ঠা উল্টাবে। যেন কিতাবের পাতা নষ্ট না হয়। বাধাইও যেন দুর্বল না হয়। তিনি আরো বলেন, কারো থেকে কিতাব নিলে কিতাবদাতার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। কিতাব যত্নের সাথে রাখবে। এতে কোন পাদটীকা কাটবে না। কোন ভুল নজরে পড়লে সম্পাদনাও করবে না। প্রয়োজন শেষ হলে দ্রুত ফিরিয়ে দিবে। মালিকের ফেরত চাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকবে না। কিতাবকে খাতায় পরিণত করবে না। বানাবেনা বিশ্রামের বালিশ। গরমের সময় হাত পাখা রূপেও ব্যবহার করবে না। ক্লান্তি ঘোঁচাতে দিবে না হেলানও। মাকতাবার কিতাব-হলে বসে যেমন অধ্যয়নের অবকাশ আছে, বাড়ি নিয়েও পড়ার অনুমতি রয়েছে। তবে অবশ্যই মাকতাবার নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হবে। যিনি মাকতাবার পরিচালক হবেন, তাকে অবশ্যই কিতাবাদির তালিকা তৈরি করে রাখতে হবে। সুশৃংখলভাবে সুদৃশ্য আলমারিতে সাজিয়ে রাখতে হবে। কীট-সমস্যার সমাধানে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। পাঠকদের অধ্যয়নের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। মাকতাবার বাইরে কাউকে কিতাব দিতে হলে নির্দিষ্ট নিয়ম মান্য করতে হবে। এভাবে পাঠক-পরিচালক সবাই মিলে যথাযথভাবে আমানতের হেফাজত করতে হবে। তবেই মাকতাবা ব্যবস্থা টিকে থাকবে যুগযুগান্তর ধরে।
পরিশেষে বলতে চাই, আজ ইলম অর্জনের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেছে। চাপা পড়ে গেছে কিতাব সংগ্রহের ইচ্ছাও। রাজা বাদশাদেরও অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে লাইব্রেরী ব্যবস্থার প্রতি। তাই ইসলামী সভ্যতার উজ্জ্বল এ দিকটি আজ দূর অতীতের কোথাও মিলে যাচ্ছে। স্থান করে নিচ্ছে কেবল ইতিহাসের পাতায়। ফিরে আসুক সেই লাইব্রেরী ব্যবস্থা আরেকবার।