আবদুস সাত্তার আইনী
১.
অধিকাংশ আলোচক ও গবেষক মনে করেন, ইসলামোফোবিয়া (ইসলামভীতি) পরিভাষা ও ধারণাটির উদ্ভব ও বিস্তারের প্রধান কারণ হলো ২০০১ সালের ৯ই সেপ্টেম্বরে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলা। শুধু আমেরিকায় নয়, পরবর্তী–সময়ে ইউরোপের প্রায় সব দেশে এই ধারণার বিস্তার ঘটেছে। মার্কিন ও ইউরোপীয় জনমণ্ডলী কর্তৃক এই স্লোগান বেছে নেওয়ার দুটি কারণ রয়েছে : একটি হলো ইসলাম ও মুসলামদের বিপদ থেকে আত্মসুরক্ষার মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরোধ এবং দ্বিতীয়টি হলো মিডিয়ার প্রচার–প্রসার। তারা এই সিদ্ধান্তে চলে এসেছে যে, ৯ই সেপ্টেম্বরের ঘটনায় অভিযুক্তরা সবাই মুসলিম (সৌদি আরবের ১৯ নাগরিক) এবং তারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের মধ্যে এমন মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে যে, ইসলাম ও মুসলমানরা ক্ষতিকর, সুতরাং তাদের থেকে সুরক্ষা ও তাদের প্রতিরোধ জরুরি।
বিশ্বের মুসলমানগণ সৌদি নাগরিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে নিরপেক্ষ গণআদালতের বিচারিক কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেনি। তারপরও তারা চূড়ান্তভাবে অভিযুক্ত হয়েছে। এই অভিযোগ ও তার পরবর্তী ঘটনাপরম্পরার শিকার যে কেবল সৌদি আরবের ১৯ নাগরিক হয়েছে তা নয়, বিশ্বের একশো সত্তর কোটি মুসলমানও তার শিকার হয়েছে। পৃথিবীর পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত, তাদের নিজ দেশে ও প্রবাসে তারা অভিযোগপরবর্তী শাস্তি ও আক্রমণের শিকার হয়েছে। মুসলিম সংখ্যালঘুরা শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে আমেরিকায় তারা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে।
শাস্তির বড় অংশ ভোগ করেছে আফগানিস্তান। দেশটি দখলদারত্ব, হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসের শিকার হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর এসব শাস্তি চলতেই থাকল। এমনকি ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে পাস হলো জাস্টা [১] আইন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভেটো উপেক্ষা করে নাইন ইলেভেন বিল ‘জাস্টা’ পাস হয়। বিলটি পাসের পক্ষে সিনেটে ৯৭টি ভোট পড়ে আর বিপক্ষে পড়ে মাত্র একটি। হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভে ৩৪৮–৭৭ ভোটে বিলটি পাস হয়। এই আইনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে কোনো দেশের নাগরিক সন্ত্রাসী হামলা চালালে সে–দেশের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে মার্কিন নাগরিকেরা। সেপ্টেম্বরের ঘটনায় একটি দেশের নাগরিকেরা অভিযুক্ত ছিল, এই আইনের ফলে সকল দেশের নাগরিককে অভিযুক্ত করার পথ খুলে যায় এবং অভিযোগের বলয় বিস্তৃতি লাভ করে। বিশ্বের মুসলমানরা বিনাকারণেই ইসলামোফোবিয়ার শাস্তির শিকার হয়। ইসলামোফোবিয়ার চূড়ান্ত পরিণাম হলো মুসলিম দেশগুলোতে সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দখলদারীত্ব। এই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ যে, মুসলমানরা কীভাবে ইসলামোফোবিয়ার মোকাবিলা করবে, তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অভিযোগ খণ্ডন করবে এবং ইসলাম–বিরোধী যুদ্ধের মুখোমুখি হবে।
২.
ইসলামি সভ্যতা ও পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্বের চিন্তাগত মূলনীতি বহু প্রাচীন। ইউরোপীয় গির্জা কর্তৃক ইসলামবিরোধী শত্রুতা ও ইউরোপের দেশগুলোতে ইসলামের প্রচার–প্রসারের বিরোধিতায় তার সূচনা ঘটে। তাদের শত্রুতা ও বিরোধিতা সামরিক যুদ্ধের রূপ নেয়। স্বয়ং ভ্যাটিকান সিটির পোপ রিকনকোয়েস্টার [২] ধারণা থেকে ক্রুসেড যুদ্ধের ঘোষণা দেন। সিরিয়া ও বাইতুল মুকাদ্দাসকে খ্রিষ্টীয় রোমান সাম্রাজ্যের অধীন ফিরিয়ে নেওয়াই ছিল তাদের অভিপ্রায়। তাদের দৃষ্টিতে এ–সকল দেশের বাসিন্দারা ইসলামি আরব ‘দখলদার’দের বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। জাযিরাতুল আরব থেকে আগত ‘দখলদার’দের কবল থেকে তাদের মুক্তি দেওয়া হলে তারা দ্রুতই খ্রিষ্টধর্মে ফিরে আসবে। অর্থাৎ, ইসলামের বিস্তৃতির পর থেকেই পাশ্চাত্যের ইসলাম–পাঠ ভ্রান্তিপূর্ণ ও শত্রুতায় আকীর্ণ।
খ্রিষ্টীয় দশম শতক থেকে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে সরাসরি ক্রুসেডে লিপ্ত হয়। পাশ্চাত্যের গির্জা কর্তৃক ইসলামের বিশ্লেষণ কখনোই ইসলামকে আসমানি বা ঐশী ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করেনি। তাদের বুদ্ধিগত ও অন্তর্গত সন্তুষ্টি তো দূরের কথা। তারা বদ্ধমূল ধারণা পোষণ করেছে যে, ক্রুসেড যুদ্ধ জনমণ্ডলীকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে আনবে। কারণ, ক্রুসেড তাদেরকে মুসলিম ‘দখলদার’দের হাত থেকে মুক্তি দেবে। কিন্তু দীর্ঘকাল ক্রুসেড (ধর্মযুদ্ধ) অব্যাহত রাখার পর পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এই যুদ্ধের শিরোনাম পাল্টে দিয়েছে এবং একে ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ নামে আখ্যায়িত করেছে। তবে তারা অস্ত্র ও সামরিক শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা থেকে বেরোতে পারেনি। বরং সার্বিকভাবে এ–দুটির ওপরই নির্ভর করেছে।
৩.
সভ্যতার দ্বন্দ্ব ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধের প্রাথমিক সূচনা ঘটেছে খ্রিষ্টান মিশনারি ও খ্রিষ্টবাদের আক্রমণের মধ্য দিয়ে, দ্বিতীয় দফায় আক্রমণ এসেছে প্রাচ্যবিদদের থেকে। মুসলমানদের শক্তি যখন শেষ হয়ে আসছিল, সেই সময় দুটি বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা ঘটল। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ওপর নানাভাবে দখলদারত্ব প্রতিষ্ঠা পেল; তারা নিজেদের বা তাদের রাষ্ট্রকে রক্ষা করার মতো সক্ষমতা পেল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ক্রুসেড সর্বশেষ পরিণতি লাভ করে। অটোমান সাম্রাজ্য (উসমানি সালতানাত)-এর পতন ঘটে এবং খণ্ড–বিখণ্ড হয়ে ইউরোপীয়দের আধিপত্যে চলে যায়। ফরাসি জেনারেল অঁরি জোসেফ ইউজিন গুরু [৩] সিরিয়ায় আক্রমণ করে তা দখল করে নেয়ার পর সালাহউদ্দিন আইয়ুবির মাজারে প্রবেশ করেন। তাঁর সমাধিতে পদাঘাত করে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি আর কতকাল ঘুমিয়ে থাকবে, হে সালাহউদ্দিন! আমরা তো এখানে উপস্থিত হয়েছি এবং সিরিয়া দখল করে নিয়েছি।’ গুরুর এই দাম্ভিকতায় ক্রুসেডের ধারণাই প্রকাশ পেয়েছে।
উসমানি সালতানাতের পতন ও রাজনৈতিকভাবে তা বণ্টিত হয়ে যাওয়ার পর ইসলামি উম্মাহর গোটা অবকাঠামো ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক সত্তার রূপ পরিগ্রহ করে। ভিন্ন ভিন্ন জাতীয়তাবাদ, দল–উপদল, চিন্তাগত ভিন্নতায় মুসলিম উম্মাহ বিখণ্ডিত অস্তিত্বে বহুরূপী হয়ে ওঠে।সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, বামপন্থা, ধর্মীয় পন্থা ইত্যাদি নামে দল–উপদলে বিভক্ত হয়ে তারা অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। এভাবে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে যায়। এই সময় ইসলামি উম্মাহ সামরিক জান্তা ও একনায়কতান্ত্রিক শাসনের কবলে নানা প্রকারের শাস্তি ভোগ করে। তারপর তারা নতুন ইসলামি ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচয়ের দিকে ধাবিত হয়। এই বুদ্ধিবৃত্তির রাজনৈতিক প্রকল্প খণ্ডিত ও দুর্বল অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে তার চিন্তাগত ও রাজনৈতিক সংশোধনের দিকে এগিয়ে যায়।
ইসলামি বিশ্বের প্রত্যেক রাষ্ট্রে এই নবচেতনা ও আন্দোলনের বিস্তার ঘটল। আরবে, তুরস্কে, ইরানে, ভারতে, পাকিস্তানে, মালয়েশিয়ায় ও অন্যান্য দেশে ইসলামি দাওয়াত ও জাগরণের স্ফূরণ দেখা গেল। পশ্চিমা বিশ্ব প্রথমে এর নাম দিলো ‘ইসলামি জাগরণ’। এটা বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের শুরুর ঘটনা। তারপর তারা এই জাগরণের নাম দিলো ‘মৌলবাদী আন্দোলন’। কারণ, মুসলমানরা এই জাগরণের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় শেকড়ে ফিরতে শুরু করেছে, তাদের মধ্যে উম্মাহ–চেতনা বলীয়ান হতে শুরু করেছে। মুসলমানদের ধর্মীয় শেকড়ে ফিরে আসা ও উম্মাহ–চেতনায় ঋদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটি একটি স্বাভাবিক প্রবণতা—কারণ, এগুলোর প্রতি ভালোবাসা তাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল। এর ফলে তারা সামরিক ও রাজনৈতিক উপনিবেশ এবং একনায়কতন্ত্র তাদের ওপর যে–সব ‘পরিচয়’ চাপিয়ে দিয়েছিল সেগুলো বাহুল্য বিবেচনা করে প্রত্যাখ্যান করে।
এ–কারণে পশ্চিমা বিশ্ব নব্বই দশকের শুরুতে ইসলামি জাগরণের নাম দেয় ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ এবং তারা রাজনীতির সঙ্গে ইসলামের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলার চেষ্টা করে। গণমানবের ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন তাদেরকে ভীত করে তোলে। বিশেষ করে যখন এই জাগরণ সামাজিক জীবনের অনুষঙ্গে সীমাবদ্ধ না থেকে ইসলামি চেতনাঋদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যায় এবং হিজাব গ্রহণ বা মসজিদ আবাদ করা বা ইসলামি গ্রন্থরাজির প্রকাশ ও প্রচার ইত্যাদি বলয় থেকে বেরিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ভাবাদর্শগত বুনিয়াদি পরিচয় নির্মাণ করে।
ইসলামি বিশ্বাস ও চেতনায় ঋদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন সভ্যতার অভিযাত্রায় নতুন রূপরেখা বাস্তবায়নের চেষ্টা করল, যুগের আধুনিক মূল্যবোধের সঙ্গে তার বোঝাপড়া তৈরি হলো, গণমানবের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও মানবাধিকারের মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করল, স্বাধীনতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের কথা বলল। শুধু তাই নয়, অন্যান্য সভ্যতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল, তাদের সঙ্গে আদান–প্রদানের সূত্র নির্মাণ করল। ফলে অন্যান্য সভ্যতার, বিশেষ ইউরোপীয় পুঁজিবাদী সভ্যতার নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিকভাবে সতর্ক হয়ে উঠলেন। খ্রিষ্টবাদী ও ইহুদিবাদী নেতারাও ধর্মীয় ও আদর্শগত দিক থেকে সচেতন হয়ে উঠলেন। তাঁরা ভাবলেন যে, পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামের এক নতুন জাগরণ ও স্ফূরণের মুখোমুখি হতে চলেছে, যাকে তারা অতীতে কলঙ্কপীড়িত ও গোলমালগ্রস্ত রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ব্যয় করেছিলেন।
তাঁরা দেখলেন, আমেরিকান ও ইউরোপীয় সমাজগুলো ইসলাম ও মুসলমানদের স্বাধীন চিত্তে ও ভালোবাসার সঙ্গে গ্রহণ করতে শুরু করেছে এবং এই প্রবণতা ব্যাপকহারে বাড়ছে। প্রাচ্যীয় সমাজগুলো ইসলামি রাজনৈতিক আন্দোলনকে শুধু যে সামাজিক বলয়ে বেছে নিয়েছে তা নয়, বরং মিউনিসিপ্যাল ও পার্লামেন্টারি নির্বাচনেও তারা ইসলামি আন্দোলনের পক্ষে তাদের রায় ব্যক্ত করেছে। এমনকি ছোট ছোট সংগঠনও, যেমন কর্মজীবী মানুষের সমবায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংস্থাগুলোও ইসলামি আন্দোলনের ধারণাকে তাদের মৌলিক আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমের সাংস্কৃতিক পূর্বাভাসকেন্দ্রগুলো প্রথমত ইউরোপ–আমেরিকায় ইসলামের ভবিষ্যৎকে মোকাবিলা করার জন্য পরিকল্পনা প্রস্তুত করে এবং দ্বিতীয়ত মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে একনায়কতান্ত্রিক ও অন্যান্য শাসনব্যবস্থার দ্বারা তা প্রতিহত করে।
পাশ্চাত্যের জাতিগোষ্ঠীর সন্তানদের মাঝে ইসলামের নবচেতনার বিস্তারে পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এমনকি কয়েকটি ইউরোপীয় রাষ্ট্র আশঙ্কা করে যে, কয়েক দশক পর তাদের সমাজে ইসলামি পরিচয় ও ভাবধারার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং পাশ্চাত্যের জাতিগোষ্ঠীকে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা ও ইসলামি মূল্যবোধ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার রূপরেখা প্রস্তুত করা অপরিহার্য; তাদের মধ্যে ইসলামি নিদর্শন মসজিদ–মিম্বার ইত্যাদির প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে হবে। এভাবেই নব্বই দশকে সামাজিক ইসলামোফোবিয়ার সূচনা ঘটে।
কিন্তু ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনাবলির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সরকারি সহযোগিতায় ইসলামোফোবিয়া শৃঙ্খলিত ও আনুষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। এসব অমানবিক ঘটনা ঘটানোর উদ্দেশ্য ছিল সার্বিক মাত্রায় ইসলামোফোবিয়ার সামাজিক স্তর থেকে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় স্তরে রূপান্তর ঘটানো। গত দশ–পনেরো বছরে ইউরোপে যতগুলো বোমা হামলা ও গুলি বর্ষণ বা সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে তার সবগুলো ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও নীলনকশার ধারাবাহিক পর্ব। পশ্চিমে ও প্রাচ্যে এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে ইসলামি সংগঠনের নাম দিয়ে, যাতে গণমানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলা যায়। এসব ঘটনার উদ্দেশ্য ছিল একটিই : ‘ইসলামোফোবিয়া প্রকল্প’কে সফলতা দান।
৪.
পশ্চিমা সরকারগুলো তাদের দেশে ইসলামোফোবিয়ার বিস্তার ও তীব্রতাসাধনে বেশ বাড়াবাড়ি করেছে। তারা এই অন্ধ নীতি অনুকরণে ভ্রান্তির শিকার হয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার কট্টর ডানপন্থী দলগুলো এই নীতির সমর্থন জুগিয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে ইউরোপীয় সমাজের ছেলে–মেয়েরা যে–ইসলামকে আলিঙ্গন করেছে এবং যা তাদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দিয়েছে তা কখনোই তাদের শত্রু হতে পারে না। ইউরোপীয় নীতির ভ্রান্তি এই জায়গায় যে, তারা ইসলামোফোবিয়া প্রজেক্ট হাতে নিয়ে তাদের সমাজে বিশৃঙ্খলা ও ভাঙনের সৃষ্টি করেছে। কারণ, বর্তমান সময়ে মুসলমানরা সব ইউরোপীয় সমাজ–কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক উপাদান। ইউরোপের প্রত্যেক সমাজেই ওই দেশীয় বা ওই দেশের বংশোদ্ভূত লাখ লাখ মুসলমান বসবাস করে।
তাছাড়া মুসলিম বিশ্ব থেকে লাখ লাখ মুসলমান ইউরোপের দেশগুলোতে গিয়ে দীর্ঘ কয়েক দশক বসবাস করছে এবং তারা ও তাদের সন্তানেরা ওই দেশেরই নাগরিক বলে বিবেচিত হচ্ছে। এই সকল মুসলমান নিজেদের দায়িত্বশীল নাগরিক বিবেচনা করে এবং ইউরোপীয় ও আমেরিকান সমাজ বিনির্মাণে তাদের যথেষ্ট নিষ্ঠা, শ্রম ও অবদান রয়েছে। কিন্তু সরকারি নীতি গোটা সমাজকে তাদের ব্যাপারে ভীত করে তুলেছে। তারা সমাজের মধ্যে স্পষ্টভাবে মেরুকরণ করেছে এবং বিভেদ ও ঘৃণার বীজ ছড়িয়েছে। দুঃখজনক ব্যাপার এই যে, ইউরোপীয় সরকারগুলো মিথ্যাচার ও প্রতারণার মধ্য দিয়ে সাফল্য আয়ের ব্যাপারে বাজি রেখেছে।
তারা তাদের দেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এবং এসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম এমনকিছু ভিনদেশি সংগঠন কর্তৃক পরিচালিত হয়েছে যার সম্পর্কে মুসলমানরা কিছুই জানে না। পশ্চিাম সরকারগুলো ও তাদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া এসব ঘটনাকে ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে মুসলানদের বিরুদ্ধে প্রচার করেছে এবং তার দায় মুসলমানদের ওপর চাপিয়েছে। অথচ মুসলমানরা এসব সন্ত্রাসবাদী ঘটনা প্রত্যাখ্যান করেছে ও নিন্দা জানিয়েছে। তাহলে কেনো তাদের এসবের দায় বহন করতে হবে? এটা স্পষ্টভাবে ইউরোপ ও আমেরিকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে অধিকার–লঙ্ঘন ও তাদের কোণঠাসা করার হীন প্রয়াস।
পশ্চিমা সরকাগুলো তাদের সমাজে ইসলাম–ভীতি ছড়িয়ে দেওয়ার ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারেনি। তাদের সব শ্রেণির নাগরিদের ওপর এর কী প্রভাব পড়তে পারে তাও তারা ভেবে দেখেনি। যদিও তারা সন্ত্রাস ও সহিংসতার দায় চাপিয়েছে ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর। এ–কথা মনে রাখা উচিত যে, ইসলাম পাশ্চাত্যের সমাজগুলোতে কোনো ভিনদেশি পর্যটক হিসেবে যায়নি। বরং তা তাদের সমাজের স্বাভাবিক ও মৌলিক উপাদান। ইসলাম হলো ন্যায়পরায়ণতা ও ইনসাফের ধর্ম। তার বিশ্বাস ও চিন্তা অনুসরণীয় এবং তার আদর্শ ও মূল্যবোধ মানবিক। সরকার চাইলেও তাদের নাগরিকদের মন ও মগজ থেকে ইসলামকে মুছে ফেলতে পারবে না। মিথ্যা ও প্রতারণার বেসাতি বেশিদিন টিকবে না। তাসের ঘরের মতোই তা ভেঙে পড়বে। কারণ, পরিণামে সত্য মিথ্যাকে দূরীভূত করবেই। সুতরাং পাশ্চাত্যের নেতৃবৃন্দ যদি ইসলাম–বিরুদ্ধ নীতি পরিবর্তন করে, তবে সেটাই হবে তাদের জন্য কল্যাণকর।
৫.
আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতা নির্মাণে যাঁরা অবদান রেখেছেন মুসলমানরা তাদের অগ্রদূত। মধ্যযুগে বা ইউরোপের অন্ধকার যুগে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের পক্ষে গির্জা–কেন্দ্রিক ধর্মীয় জুলুম ও অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হতো না যদি না তারা স্পেন ও সিসিলিতে ইসলামি সভ্যতার আলো গ্রহণ করতেন। তার প্রত্যেক শাস্ত্রের ইসলামি গ্রন্থাবলি ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এই ক্ষেত্রে ইবনে হায্ম, ইবনে রুশ্দ, ইবনে তুফায়েল প্রমুখ আন্দালুসীয় মুসলিম মনীষী গ্রন্থাবলি প্রাধান্য পেয়েছে।
ইউরোপীয় সমাজগুলোতে যে–কোনো তাত্ত্বিক বা প্রায়োগিক জ্ঞানের জাগরণ ও বিকাশ ঘটেছে, দেখা গেছে যে, তার উৎস, উপাদান ও গ্রন্থাবলি ইসলামি সভ্যতা থেকে ধার করে নেওয়া হয়েছে। যাঁরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ইতিহাস পাঠ করেছেন তাঁরা এসব ব্যাপারে অনবহিত নন। ইসলামি সভ্যতা ও চিন্তাধারা থেকে ধার করার ব্যাপারটি নতুনভাবে শুরু হবে বলে আশা করা যায়।
৬.
ইসলামোফোবিয়ার মোকাবিলায় প্রধানত ইউরোপীয় ও আমেরিকান মুসলমানদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। শুধু ইউরোপীয় বা মার্কিন মুসলমানবান্ধব বুদ্ধিজীবীদের নির্ভরশীল থাকলে হবে না। পাশ্চাত্যের মুসলিম নাগরিকদের আত্মসুরক্ষায় ও তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ ও শঙ্কাহীন করার লক্ষ্যে তাদেরই যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রচেষ্টা ব্যয় করতে হবে। তারা তাদের আচার–আচরণে, কর্মে–কথায়, আদান–প্রদানে ইসলামের চারিত্রিক শিক্ষার বাস্তবিক রূপ ফুটিয়ে তুলে সমাজ ও রাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দেবে ইসলামের মাহাত্ম্য আসলে কী। তারপর তাদের কাছে ইসলামের বিশ্বাস ও আদর্শ, চিন্তা ও মূল্যবোধ তুলে ধরবে।
এই ক্ষেত্রে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মুসলমানদের চেয়ে পাশ্চাত্যের মুসলমানদের দায়িত্ব অনেক বেশি। পশ্চিমা মিডিয়াজগতের ইসলাম–বিরুদ্ধ অবস্থান ও প্রচার–সম্পর্কে তারাই বেশি অবহিত এবং এ–ব্যাপারে তাদের পক্ষেই সঠিক কার্যপদ্ধতি গ্রহণ করা সম্ভব। মিডিয়াজগতের মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডার তাদের ভাষাতেই দিতে হবে এবং সকল মুসলমাকে নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। পাশ্চাত্যে মুসলমানরা তাদের ভূমিকা পালনে এগিয়ে এলে গোটা মুসলিম বিশ্বের সহায়তা–সহযোগিতা তাদের পাশে থাকবে।
টীকা
[১] Justice Against Sponsors of Terrorism Act (JASTA).
[২] রিকনকোয়েস্টা (Reconquista) : এটি একটি স্পেনিশ শব্দ। এর অর্থ পুনর্বিজয়। রিকনকোয়েস্টা দ্বারা ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের স্পেন জয় শুরু করে ১৪৯১ খ্রিস্টাব্দে গ্রানাডার পতন পর্যন্ত ৭৮১ বছরের সময়কালকে বোঝানো হয়। ইতিহাসবিদগণ কোভাডোঙ্গার যুদ্ধকে রিকনকোয়েস্টের সূচনা বিবেচনা করেন। এতে পেলাজিয়াসের নেতৃত্বাধীন একটি সেনাবাহিনী ইবেরিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে উমাইয়া বাহিনীকে পরাজিত করে ক্ষুদ্র খ্রিস্টান রাজ্য অ্যাস্টুরিয়াস প্রতিষ্ঠা করে।
[৩] অঁরি জোসেফ ইউজিন গুরু (Henri Joseph Eugène Gouraud) : তিনি একজন ফরাসি জেনারেল। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ফ্রেঞ্চ ফোর্থ আর্মির নেতৃত্ব প্রদানের ফলে সমধিক পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ১৯৬৭ সালের ১৭ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৪৬ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।
লেখক : বিশিষ্ট গবেষক ও অনুবাদক