ইহরামের কাপড়ে বিদায়: যেমন ছিলেন হাজী সাহেব হুজুর

রাকিবুল হাসান নাঈম:

তিনি হাজী সাহেব হুজুর নামে প্রসিদ্ধ। বাইতুল্লাহর প্রেম এবং সবুজ গম্বুজের ভালোবাসার ছটা সবসময় দ্যুতি ছড়াতো তার চোখেমুখে। খুব সাদামাটা চলন, বিনয়ী বলন। এই লালবাগ মাদরাসায় তার শিক্ষকতার বয়স অর্ধ শতাব্দী। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় তিনি কিছুই চাইতেন না। বলতেন, ‘যখন শুনবা, তোমাদের হাজী সাহেব হুজুর এন্তেকাল করেছেন, তখন তোমরা একবার সূরা ফাতিহা ও তিন বার সূরা ইখলাস পাঠ করবা।’ যেন প্রস্তুত হয়েই ছিলেন পরম প্রভুর সাক্ষাতের জন্য।

তিনি জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদরাসার সদরে শুরা ও শায়খুল হাদিস মাওলানা হাজী হাবীবুর রহমান। ১৬ নভেম্বর, মঙ্গলবার বেরিয়েছিলেন ওমরার উদ্দেশ্যে। গায়ে ইহরামের শুভ্র সফেদ কাপড়। কিন্তু ইহরামের ডানায় কাবার আকাশে উড়াল দেয়া হলো না তার। ডাক এসে গেলো পরম প্রভুর, ডাক এসে গেলো জান্নাতের। এয়ারপোর্ট গিয়ে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার সময় দাঁড়ানো অবস্থায় স্ট্রোক করলেন। চারদিন চিকিৎসায় থাকার পর ইন্তেকাল করলেন ২২ নভেম্বর মঙ্গলবার রাত ১২.২০ মিনিটে।

ব্যক্তিগত জীবন

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত শান্ত মেজাজের ধীর-স্থির একজন মানুষ। আত্মীয়তার সম্পর্কে তিনি ছিলেন হযরত হাফিজ্জী হুজুর রহ-এর নাতনি-জামাই। তার তিন সন্তান এবং এক মেয়ে।

হুজুরকে নিয়ে কথা হয় তার দীর্ঘদিনের খাদেম মাওলানা হেলালুদ্দিনের সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘২০০৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আমি হুজুরের কাছাকাছি ছিলাম। বিশেষ করে মেশকাত ও দাওরার বছর। হুজুর দরসে এলে আমি তার জন্য পান কিনে আনতাম। আমি যেদিন ক্লাসে থাকতাম না, হুজুর আমার খোঁজ নিতেন। আমি তার চুল কেটে দিতাম। পরিবারের বাজারসদাই করতাম। এমনতি তিনি কুরবানির গরু কিনতে গেলেও সঙ্গে আমাকে নিয়ে যেতেন। যতটুকু দেখেছি, তিনি ছিলেন অত্যন্ত অত্মমর্যাশীল একজন মানুষ। চলনে-বলনে পরিমিতি রক্ষা করতেন। যেন তার চলনে-বলনে তার জীবনের কোনো ক্ষতি না হয়।

তার আরেকটি গুণ ছিল, তিনি সদা সত্য উচ্চারণে ছিলেন আপোষহীন। জুমার খুতবা শুরু করতেন ‘আল হাক্কু মুররুন’ তথা ‘সত্য কথা তিতা’ বাক্যটি দিয়ে। পাশাপাশি তিনি ছিলেন অত্যন্ত রুচিশীল। পোশাকে, খাবারে, আচরণে সবক্ষেত্রে। তার সবকিছুতে রুচির প্রকাশ ঘটতো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় তিনি ছিলেন অনন্য।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যে গুণটি তিনি পরম যত্নে আগলে রেখেছিলেন, তা হলো ইলমের পিপাসা। ছাত্র জীবনে তিনি যেমন মেহনতি ছিলেন, ঠিক শিক্ষকতার জীবনেও মেহনতি ছিলেন। তার এক ছাত্র কাতার চলে গিয়েছিল। দেশে ফিরে ছাত্রটি যখন তার সঙ্গে দেখা করতে এল, তিনি তার সঙ্গে মুসাফাহা করলেন না। অভিমান নিয়ে বললেন, আমরা তোমাদের মানুষ করি। পড়াই। শেখাই। আর তোমরা বিদেশ চলে যাও।

পারিবারিক জীবন

তার পারিবারিক জীবন ছিল সুন্নতে রাসুলের উদাহরণ। মাওলানা হেলালুদ্দিন বলেন, আমি তার পরিবারের সঙ্গেও মিশে গিয়েছিলাম। পারিবারিক জীবন ছিল তার নিতান্তই সাদামাটা। লালবাগে তার বাড়ি দেখলেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। কতটা সাধারণ জীবন যাপন করতেন তিনি।

সন্তান প্রতিপালনে হুজুর ছিলেন বেশ যত্নবান। লালবাগ জামেয়ার প্রাক্তন ছাত্র এবং মাকতাবাতুল ইসলামের কর্ণধার মাওলানা আহমাদ গালিব বলেন, হাজি সাহেব হুজুরকে সেই ক্ষুদ্রকাল থেকে চিনি, জানি। ৯০-এর দশকে যখন লালবাগে মুসা হুজুরের কাছে পড়ি তখন হাজি সাহেব হুজুরের তিন ছেলে ছিলেন আমার সহপাঠী; মাওলানা ইবরাহিম, মাওলানা ইসমাইল ও মাওলানা ইসহাক। মাওলানা ইবরাহিম জামিয়াতুস সালামের সিনিয়র শিক্ষক, মাওলানা ইসমাইল সাহবানিয়ার শিক্ষক, মাওলানা ইসহাক জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগের শিক্ষক এখন। হুজুর তার সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলেছেন।

লালবাগ জামেয়ার ফারেগ মাওলনা মাহমুদুল ইসলাম খান বলেন, হুজুর সন্তানদেরকে সুচারুরূপে পরিচালিত করতেন। ফলে তার সব সন্তানই আলহামদুলিল্লাহ যু ইসতি’দাদ ও বাআখলাক হয়েছে। বড় ও ছোট ছেলে উপমহাদেশের প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুল মালেক সাহেবের ঘনিষ্টজন।

শিক্ষকতার জীবন

তার শিক্ষকতা বয়স অর্ধ শতাব্দী। তার কাছে পড়েছে হাজার হাজার ছাত্র। কিন্তু এই দীর্ঘ শিক্ষকতার জীবনে কোনো ছাত্র তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে পারেনি। এতটাই একনিষ্ঠতার সঙ্গে পড়াতেন তিনি।

লালবাগ জামেয়ার ফারেগ আলেম লেখক মাওলানা সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর হুজুরের স্মৃতিচারণ করে বলেন, হাজী সাহেব হুজুর অত্যন্ত নরমদিল মানুষ ছিলেন। আমার মুহতারাম উস্তাদ ছিলেন তিনি। মিশকাত জামাতে তাফসিরে বায়জাভি পড়াতেন। দাওরা জামাতে পড়াতেন তরিমিজি শরিফ। ছোটখাটো মানুষটা দরসে আসতেন সাদাসিধেভাবে। তাঁর চলন-বলন, কথা-কাজে কখনো ‘বহুত বড় আলেম’ টাইপের প্রভাব ছিল না। তিনি বড় একটা ওয়াজ-মাহফিলে যেতেন না। নাম কামানোর সস্তা প্রবণতা থেকে নিজেকে হামেশা পরহেজ করে চলতেন।

শিক্ষকতায় হুজুরের একনিষ্ঠতা প্রসঙ্গে সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর বলেন, মুফতী আমিনী রহ. সময়কালীন লালবাগ মাদরাসা মানেই রাজনীতি, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। সবাই হয়তো মনে করতো, লালবাগ মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা নিশ্চয় সবসময় রাজনীতির ডামাডোলে সময় কাটায়। মোটেও এমন কোনো প্রবণতা ছিল না। মুফতী আমিনীর রহ.-এর সময়কালে তিনি কেবল একাই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। তাঁর সঙ্গে মাদরাসার তিন-চারজন শিক্ষক ছিলেন যারা সবসময় সঙ্গ দিতেন। এছাড়া বাদবাকি আর কোনো শিক্ষকই প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতেন না। তাদের কাজ ছিল কেবলই দরস-তাদরিস। হাজী সাহেব হুজুর, আবদুল হাই সাব হুজুর, মুহিব্বুল্লাহ সাব হুজুর, বাবা হুজুর, রহিম সাব হুজুর, মাকসুদ সাব হুজুর এরা কখনোই রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতেন না। পড়া ও পড়ানো ছাড়া তাদের জীবনের আর কোনো মাকসাদই ছিল না। আমিনী রহ. রাজনীতি আর তাদরিস সম্পূর্ণ আলাদা করে রেখেছিলেন। হাজী সাহেব ছিলেন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

লালবাগ জামেয়ার প্রাক্তন ছাত্র এবং মাকতাবাতুল ইসলামের কর্ণধার মাওলানা আহমাদ গালিব বলেন, দীর্ঘদিন পর্যন্ত তিনি লালবাগ জামিয়ার শীর্ষস্থানীয় শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন। দরসে এসে কোনো দিকে না তাকিয়ে কিতাব পড়াতেন অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। হাজি সাহেব হুজুরের একটি কথা মনে পড়ছে। একবার কুরবানির কাজের জন্য ছাত্রদের তারগিবি-তারতিবি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘ভালা কারেগা ভালা পায়েগা, বুরা কারেগা বুরা পায়েগা, সাজা পায়েগা।’ বহুকাল আগের সেই কথা এখনো মনে আছে। জীবনভর তিনি ভালো করে গেছেন, নিশ্চয়ই এখন তিনি ভালোই পাবেন।

লালবাগ জামেয়ার ফারেগ মাওলনা মাহমুদুল ইসলাম খান বলেন, লালবাগ জামেয়ার সবচে প্রবীণ উস্তায ছিলেন তিনি। চলতি বছর জামেয়া শারিফিয়া আরাবিয়ার উস্তাযদের এক ইসলাহী মজমায় হযরত নিজেই বলেছেন, আমি লালবাগ জামেয়ায় এসেছি বাইশ বছর বয়সে। তিনি মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে মাদরাসায় ভর্তি হন। এখন আমার বয়স চুরাশি বছর। ৬২ বছর যাবৎ লালবাগ জামেয়ায় আছি। মুহতারাম উস্তাযের কাছে তিরমিযী আউয়াল পড়ার খোশ কিসমত হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ। পুরো দরসে তাশাহহুদের সুরতে বসে অবনত মস্তকে তাকরির করতেন। সবদিক ফুটিয়ে তুলে তাকরির করতেন। কোন বিষয় অস্পষ্ট রাখতেন না।

মাওলানা হেলালুদ্দিন বলেন, হুজুরের কাছে আমি বাকুরাতুল আদব, বায়জাবি, তিরমিজি এবং বুখারী সানি পড়েছি। হুজুর দরসে বসে টানা পড়াতেন। দরসের সময় ফোন এলে কথা বলতেন না। ফোন রিসিভ করে কয়েক সেকেন্ড দরস শুনিয়ে কেটে দিতেন কল। হাদিসের দরসে বসতেন তাশাহ্হুদের আসনে। হাদিসের দরসে তার যে বিনয় এবং ভক্তি ছিল, তা এখন বিরল। মনে হতো, তিনি হাদিসে একদম ডুবে গেছেন।

আমলি জীবন

হুজুরের আমলি জীবন ছিল অনুসরণীয়। সুন্নতে নববির জীবন্ত উদাহরণ ছিলেন তিনি। মাওলানা হেলুলুদ্দিন বলেন, হুজুর যখন নামাজে দাঁড়াতেন, বিনয় ফুটে থাকতো চেহারায়। তিনি দীর্ঘ কেয়াম করতেন। ধীরস্থিরভাবে নামাজা আদায় করতেন। তাড়াহুড়া করতেন না।

মুফতী আনসারুল হক ইমরান ফাতেহকে বলেন, হুজুর একজন আল্লাহ ওয়ালা বুজুর্গ ছিলেন। সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। আর ছাত্রদের বলতেন, তোমরা দোয়া কইরো, আল্লাহ যেন আমারে এহরামের কাপড় পরা অবস্থায় মওত দান করেন। গত বুধবার এহরামের কাপড় পরে পরিবার, আত্মীয়, লালবাগ জামেয়ার আসাতিজা ও ছাত্রদের থেকে বিদায় নেন। এয়ারপোর্টে পৌছে বিমানে ওঠার পূর্বমুহূর্ত স্ট্রোক করেন। আজ সেই ইহরাম পরিধান অবস্থায় চিরবিদায় নিলেন।

আগের সংবাদলালবাগ জামেয়ার শাইখুল হাদীস হাজী হাবীবুর রহমানের ইন্তেকাল
পরবর্তি সংবাদ৭ দিনেও কৃষকের লাশ দেয়নি বিএসএফ