দন্তস্য চৌধুরী:
উৎসর্গ : নেসারুদ্দিন রুম্মানকে।
[উৎসর্গ মানুষ কেন করে জানি না; তবে এটুকু বুঝি—এর ভেতর দিয়ে মূলত সে-ব্যক্তিটির প্রতি একটা অনুরাগের প্রকাশ করা হয়। আমি আমার প্রথম গল্প-প্রচেষ্টাটি নেসার ভাইকে উৎসর্গ করে তার প্রতি আমার অনুরাগকে প্রকাশ করলাম। প্রসঙ্গত আরেকটি কথা বলি, এই গল্পে দুর্বল বাক্যসমূহ দিয়ে দাম্পত্য জীবনের একটা টানাপোড়েনের ছবি দেখাতে চেষ্টা করা হয়েছে, কোথাও কোথাও। বলা বাহুল্য, তার পুরোটাই কাল্পনিক ও এসবের সাথে আমার বাস্তব দাম্পত্য জীবনের কোন সম্পর্ক নাই। আমি তো, আলহামদুলিল্লাহ, বিয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রলম্বিত এক মধুচন্দ্রিমার মধ্যেই আপ্লুত হয়ে আছি।
যাগগে, গল্পটা পড়ুন।——দ. চৌ.]
শওকতের বন্ধুরা শিল্পকে হেনতেন বলছে
দোতলার জানালার সামনে দাঁড়িয়ে শওকত বাইরে বিছিয়ে থাকা রোদের চরিত্রটা বোঝার চেষ্টা করছে। চরিত্র ঠিক করতে পারলে একে সুন্দর দেখে একটা নাম দেওয়ার ইচ্ছা তার। ঠিক নাম না; একটা যুতসই বিশেষণ। শওকত লেখক মানুষ। শব্দ আর দৃশ্য নিয়ে তার কারবার। একটা বস্তু বা দৃশ্যকে সে খুঁটিয়ে দেখে চরিত্রটা বুঝার চেষ্টা করে। এরপর সে-অনুভব থেকে একটা শব্দ বের করে এনে জিহ্বার আগায় নেড়েচেড়ে দেখে। দুয়ের মাঝে ক্রসকানেকশনটা ঠিকঠাক হয়ে গেলে ভেতরে ভেতরে একটা উল্লাস বোধ করে শওকত। এতে তার প্রাণ যেন স্বস্তি ও আরাম পেয়ে সতেজ হয়ে উঠে। ছুটে যাওয়া মনোযোগটা আবারো রোদের দিকে টেনে আনলো। দুপুরের দিকে যে রোদ থাকে, একে অনেকে চড়চড়ে রোদ বলে। দুপুর গড়িয়ে যাওয়া রোদটাকে কি কড়কড়ে রোদ বলা যায়? ভাবা দরকার। কিন্তু বিকাল হওয়ার আগে আগে যে রোদটা বিছিয়ে থাকে, এই যে এখন, একে কী বলা যায়? মচমচে রোদ?
শওকত যখন নিজের রুচি আর ‘মচমচে’ শব্দটার উপর বিরক্ত হয়ে রোদের আরেকটু ভেতরে ঢুকার চেষ্টা করল, ঠিক সেই সময় রোদটা গেল চলে। প্রকৃতির মাঝে একটা ম্যাজিক্যাল পরিবর্তন এলো। একটু সময়ের ভেতর আকাশ হলো মেঘলা। এর মাঝে শুরু হলো বাতাস। দেখতে দেখতে বাতাসটা বেড়ে গিয়ে গাছপালার ভেতরে গভীর আলোড়ন তুলে ফেলল। বেশ দূরে, বাঁশঝাড়ের মাথাগুলো যেখানে নুয়ে নুয়ে পড়ছে, সেখানে একটা চিল উড়ছে। প্রবল বাতাসের কারণে চিলের রাজকীয় প্রবাহটা একটা দ্বিধার মধ্যে আটকে গেছে। বেচারা জীবনানন্দ! একটু আগায়, আবার বাতাসের ধাক্কায় তেরসাভাবে পিছিয়ে পিছিয়ে যায়। কিন্তু এর ভাবসাব দেখে মনে হয় ব্যাপারটা সে উপভোগ করছে খুব। ‘শালার চিলা!’—চিলটাকে অযথাই একটা গালি দিয়ে শওকত দৃশ্যটার ভেতর ডুবে গেল। মাঝে মাঝে কিছু দৃশ্য তাকে বিচিত্র অনুভব দেয়। যেমন এখন, তার মনে হচ্ছে নুয়ে পড়া বাঁশঝাড়, হুহু বাতাস আর পানসে-রঙা আকাশসহ পুরো জিনিসটা তার বুকের ভেতর ঢুকে গেছে। সেখানে একটা চিল এগোতে গিয়ে পিছলে পেছনে সরে যাচ্ছে বার বার। শওকত দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে ঘনীভূত হচ্ছিল, টের পেল একটা ঘোরের মত কোন একটি কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে, যেখানে নিশ্চয়তা নাই, অনিশ্চয়তাও নাই। এমন সময় টুং করে একটা শব্দ হলো। শব্দটা শওকতের খুব পছন্দের। প্রথমে জোরালো, এরপর চমৎকার নিয়ন্ত্রিতভাবে ক্রম-লয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়। যেন বা শব্দটাকে কেউ পেছন থেকে এসে আলতো টানে নিয়ে গেল স্মৃতির ভিতর। পুরো ঘটনাটা ঘটতে মাত্র দুই সেকেন্ড সময় লাগে। অথচ এই এর মধ্যেই কী অসাধারণ একটা মূর্ছনা তৈরী হয়। শিল্প ব্যাপারটা আসলে এমনই—সামান্যকে অসামান্য করে তোলে। শওকতের মনে হলো, এই শেষ বাক্যটা যদি সে সিঁড়ির আড্ডায় বলে বসত, তাহলে পুলাপান হই হই করে উঠত।
– ‘কী হেনতেন যে বলেন, শিল্প সামান্যকে অসামান্য করে তোলে! হা হা.. এই সব ভিজা কথাবার্তা শুনলে হাসি পায় খুব; মনে হয় সেক্সপিয়রের যুগে আছি, তা শিল্পটা কী?’
– ‘ক্যান! শিল্পের শক্তিরে তুই অস্বীকার করবি?’
– ‘না, তা করব ক্যান? কিন্তু শিল্পের যে প্রতিষ্ঠিত অর্থ আছে, অর্থাৎ, কোন কিছুরে সুন্দর কইরা তোলা, এইটা মানতে আপত্তি আছে। সুন্দর না কইরা থাকাও শিল্প হইতে পারে; এবং সুন্দর ও অসুন্দর কোন কিছু না কইরা থাকাও শিল্প হইতে পারে। দেখার বিষয় হইলো তুমি এরে অবজার্ভ করতেছ কীভাবে। শিল্প বাস্তবে নাই, আছে তোমার মনে।’
– ‘তোর মাথা!’
– ‘হা হা হা… এগজেক্টলি!’
শওকত খেয়াল করলো, ওদের উপর ওর মেজাজ খারাপ হয়ে পড়েছে। বিশ্রি একটা গালি দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সে রকম কিছু না পেয়ে অস্ফুট স্বরে শুধু বলল—শয়তানগুলা! এই ছেলেগুলো অদ্ভুত কিসিমের। এরা আকৃতিকে অস্বীকার করে এবং সমস্ত কিছুকে করুণা দিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলতে চায়। যেন আনন্দ নাই, বেদনা নাই—অন্তহীন এক ঠাট্টায় বেঁকে আছে সমস্ত মুখ-চরাচর।
শওকত বলল সে একটা অপ্রচলিত (অর্থাৎ অচল) গল্প লেখবে
টুং। শব্দটা আবার হলো। হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেঞ্জারের এই শব্দটা সবসময় ভালো লাগলেও এখন শওকত কিছুটা বিরক্তি বোধ করল। সে নিজের ভেতরে তন্ময় হয়ে ছিল, এই শব্দ এসে তার প্রগাঢ় আত্মাকে যেন ছিদ্র করে দিল। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে মাহবুব আমিনের ম্যাসেজ। একটা নামি সাহিত্য ম্যাগাজিনের সম্পাদক সে। বয়সে ছোট হলেও সম্পর্কটা বন্ধুর মত।
— সালাম, ভাই! কেমন আছেন?
— ওয়াসসালাম, এই তো আছি-টাছি; একটা চিল উড়ছে শুধু। আপনাদের কী খবর?
— হা হা… কী যে বলেন, আপনি খুব মজার মানুষ। আমরা? আছি, ভালোই।
— হুম, সেরকমই তো থাকা উচিত, যেহেতু খারাপ থাইকা লাভ নাই। আর চিলটা আগাইতে পারতেছে না। পিছলে পিছলে যায়, জীবনের মত, কিংবা জীবনানন্দ।
— হা হা.. শুনেন! ঈদসংখ্যার জন্য একটা লেখা দেন, যা মন চায়।
— গল্প দিব?
— দিতে পারেন।
— আমি এতে অভ্যস্থ না। পারব কি না বুঝতেছি না; কিন্তু মাথায় একটা আইডিয়া ঢুইকা গেছে।
— ভাই, লেখেন, আপনি পারবেন। আমি সম্পাদক, আমি জানি কে কী পারবে। তা কী বিষয়ে?
— মনস্তাত্ত্বিক ভণ্ডামি।
— হা হা… ইন্টারেস্টিং। আপনি ছফার উপন্যাস পড়ছেন?
— হুম, বেশি না; তিনচারটা হবে। ভালোই তো। পুষ্প বৃক্ষ…টা মাস্টারপিস, গাভী বিত্তান্ত চাবুকের মত লাগছে; ছফা এখানে ফাইটা পড়ছেন। উনি অবশ্য এমনিতেও যখন-তখন ফাইটা-পড়া লোক; হা হা হা… আরেকটা পড়ছিলাম ‘মরণবিলাস’। অড লাগছে। আরো কী কী যেন পড়লাম। ক্যান?
— বেশি চিন্তাশীল মানুষ গল্প-উপন্যাস লেখলে একটা সমস্যা হয়…
— নানা কিছু শিখাইতে থাকে, আর খালি দার্শনিকতা মারায়? মানে, গল্প বলা থুয়ে মাস্টারি করতে শুরু করে?
— হা হা হা… ঠিক তা-ই। এই জায়গাটায় একটু সতর্ক থাকবেন।
— আপনি ভাববেন না, সম্পাদক! আমি এতো গভীরে যাব-টাব না; সিম্পল। সমকালের কিছু টুল-টাল ব্যবহার করব আরকি; এই ধরেন, ফেসবুক ইন্সটা।
— ফেসবকু-টেসবুক নিয়া ইদানিং কিন্তু বেশ লেখাজোকা হইতেছে। দেইখেন, একেবারে কমনগ্রাউন্ডের কিছু না হয় যেন।
— আচ্ছা, আচ্ছা, প্রচলিত কিছু হবে না। আমি না হয় অপ্রচলিত ও অচল একটা গল্পই লেখব। শওকতের কণ্ঠে চাপা নির্মল রসিকতা; সেই রসিকতা কানেও বেজেছে কিছুটা। সম্পাদক সহাস্য রিপ্লাই দিলেন—আচ্ছা, আপনি আপনার মত করে লেখেন আরকি। শওকত হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ও দুইচোখে দুই রক্তিম ভালবাসাযুক্ত ইমুটা সম্পাদকের ওয়ালে আলগোছে রেখে দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে বেরিয়ে এলো।
শওকত তাকে বলল : অথৈ দৃষ্টির ভেতর আস্ত বিকেলটা সেঁধিয়ে গেছে
একটা লেখার জন্য সুপ্রচুর আলস্যের দরকার, আর দরকার অন্তহীন হাঁটার অবসর। শওকত দুই হাত পেছনে বেঁধে মাথা নিচু করে হাঁটছে, আলতো পায়ে। রুমটা বেশ বড়সর, হেঁটে আরাম পাওয়া যাচ্ছে। শওকত গভীর ভাবনায় ডুবে গল্পটা ধরার চেষ্টা করছে। একটা উজ্জ্বল জানালার পাশ দিয়ে হাঁটতো সে। এই ‘ত’ এর মধ্যে যে নিরবিচ্ছিন্ন চলমানতা আছে, ব্যাপারটা এরকম কিছু ছিল না; বলা ভালো হেঁটেছিল। উজ্জ্বল ও কুয়াশাচ্ছন্ন, নরম, সুন্দর একটি জানালা; অথৈ দৃষ্টির আনন্দের ভেতর, কোথাও হারিয়ে যাবার হাহাকার সমেত, কখনোই খুঁজে না পাওয়ায় বিদ্ধ হয়ে, অনিশ্চয়তার আকুলতায়, অদ্ভুত সেইসব বিকেলগুলোতে।
—আচ্ছা, শুনেন তো, এইভাবে হাঁটেন কেন?
—এই তো, এমনি, ভালো লাগে।
—এটা কোন কথা! প্রতিদিন, এতো সুদীর্ঘ পথ!
—কেন নয়?; সুদীর্ঘ দৃষ্টির ভেতর।
—আপনার হাঁটাটা খুব সুন্দর। কিন্তু বাম দিকে একটু ঝুঁকে থাকেন, এইটা একটু কেমন লাগে।
—হাঁটাটা কমন, বামদিকে ঝুঁকে থাকাটা আমি। আমাকে ফেলে দিতে বলছেন!
—এসব কীরকম কথা! অদ্ভুত আর দুর্বোধ্য।
—হুম, হা হা হা… উজ্জ্বল ও কুয়াশাচ্ছন্ন, নরম, সুন্দর; অথৈ দৃষ্টির ভেতর আস্ত বিকেলটা সেঁধিয়ে গেছে।
—পাগল!
শওকত একটু থেমে চোখ বন্ধ করল। মাথা থেকে দৃশ্যটা বের করে একদম খালি করার চেষ্টা করছে। আজকে বিকেলের ভেতরেই গল্পটাকে ধরতে হবে। ধরতে গিয়ে সে টের পেল কাজটা মোটেই সহজ কিছু নয়। তার মাথায় যেটা ঢুকেছে—একটা ছায়ার মত; সাকুল্যে পাঁচ লাইন হবে। এর মধ্যে কোন শব্দ নাই, চিত্র নাই; অশরীরী একটি উপস্থিতির আভাসমাত্র। ফলে, সুনির্দিষ্ট শব্দ দিয়ে একে তালাশ করা যাচ্ছে না এবং পূর্ণ চোখে এর দিকে তাকালে কিছুই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মৃদু কুয়াশার মত, ধরতে গেলে নাই। শওকত জানে এখন তাকে একটা খেলা খেলতে হবে—এর দিকে তাকানো যাবে না, কোন কাঠামোতে বন্দি করতে চাওয়া যাবে না; পরোক্ষ ও উপস্থিতহীন হয়ে একে একটা কুয়াশার কুণ্ডুলির মত বেড়ে উঠতে দিতে হবে। শওকতের মাথায় এখন আরেকটা দৃশ্য ঢুকে গেছে।
—উঁহু, তুমি তাকালে তো হবে না।
—আচ্ছা, এই যে চোখ বন্ধ করলাম।
—ধুর, তুমি কিচ্ছু বুঝো না। এমন অন্ধের মত বসে থাকতে বলছি?
—তাইলে কী করব? তুমিই তো বললে।
—চোখ বন্ধ রেখেও একটু একটু তাকাইতে হবে।
—মানে, তোমাকে ফাঁকি দিতে হবে, আবার সেটা বুঝতেও দিতে হবে?
—হি হি হি.. হুম। তুমি একটা বোকা!
বিয়ের পর পর শওকত সবচেয়ে বেশি যে উপাধিটা পেয়েছে, তাহলো—তুমি একটা বোকা। কত কত সময় সে এমন বোকা হয়ে আনন্দ নিয়ে বসে থেকেছে। তার কাছে মনে হলো গল্পটাও রেবেকার মত—একটা বানোয়াট ধোঁকার ভেতর দিয়ে ধরা পড়তে চায়। অথবা, দেয়ালের গায়ে জলের ছিটা দেওয়ার পর সেখানে যেমন নানা কাঠামোর সম্ভাবনা থাকে—গল্পটা যেন এমন: নির্দিষ্ট কোন ছবির আকাঙ্ক্ষা নয়; আলতো দৃষ্টিতে একটু সময় তাকিয়ে থাকলে মনের মত একটা কাঠামোকে ভাসিয়ে তোলা যায়। এরপর খুব দ্রুত পেন্সিল দিয়ে বন্দি করে ফেলতে হয় সেই ছবি। শওকত একটা কুয়াশাকে; রেবেকার মত; উজ্জ্বল, কুয়াশাচ্ছন্ন, নরম ও সুন্দর; অথৈ দৃষ্টির ভেতর, যেখানে আস্ত বিকেলটা সেঁধিয়ে গেছে; একটা জলজ সম্ভাবনাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ঘিরে চক্কর কাটতে লাগলো। শওকত টের পেল তার আত্মা যেন নরম তন্তুর মত ছড়িয়ে পড়ছে, দৃষ্টি ঘনীভূত হচ্ছে। হাঁটা থামিয়ে কখন যে সে এক জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে পড়েছে, টের পায়নি।
—আচ্ছা মানুষ তো আপনে! আশ্চর্য!
বহুদূর থেকে তীক্ষ্ম একটা চিৎকার তন্তুগুলোকে ছিঁড়ে ফেলল। রেবেকা দাঁড়িয়ে আছে, একেবারে কাছটিতে। চেহারায় বিষাদ ও ক্লান্তির ছাপ। চুলগুলো এলোমেলো। জামাকাপড় ময়লা আর স্যাঁতস্যাতে হয়ে আছে। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে এই সময়টাতে তার একটু বিশ্রামে যাবার কথা। কিন্তু আজকে মনে হয় কাজটাজ সেরে উঠতে পারেনি। এই ডাকটার মাঝে একটা আদুরে শাসনের রেশ আছে, অবসাদ আছে এবং এসবের আড়ালে আছে বিষাদ ও একটুখানি অভিমানমাখা অভিযোগ। অভিযোগটা কানে বাজে না; মনের মাঝে অস্পষ্ট ছায়াপাত করে।
—‘কী হয়েছে বলো তো!’ শওকত একটা মেকি ঝগড়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
—‘কী হয়েছে! রুমের দিকে একটু গেলে-টেলে কী হয়? আমার এদিক দিয়ে জান বের হয়, আর আপনি এখানে ফুলবাবু হয়ে ঘুরছেন!’ রেবেকার কণ্ঠে ঝাঁঝ। শওকত জানে ঝাঁঝটা রেবেকার স্বভাবসুলভ আদুরে শাসনের মিষ্টি তরঙ্গ থেকে উঠে এসেছে, ক্যামাফ্লোজ পরে। কিন্তু ইদানিং তা কি একটু সত্য সত্য হয়ে উঠছে? কানে কানে বাজে যেন। শওকত স্মিত হেসে রণে ভঙ্গ দেয়।
—কিছু করতে বললে আমি না করেছি কোনদিন?
—আমাকে বলতে হবে কেন? আপনি দেখেন না কিছু? নিজের থেকে একটু খবর নিছেন কোন সময়? এভাবে চলে না, বু্চ্ছেন?
—আজব, তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?
—কীভাবে কথা বলব? আপনি আমার জায়গায় হলে বুঝতেন।
—ক্যান? আমি কি হেল্প করি না?’
—হেঁ, করেন তো, কিন্তু আমার বেকায়দা সময়গুলাতেই আপনি নাই। আজকে কয়দিন ধরে বলছি একটা হ্যান্ডশাওয়ার লাগিয়ে দেন; বাচ্চার কাঁথাগুলো আমার হাত দিয়ে সাফ করতে হয়; আপনি কানেই তুলেন
না।
—সরি ফর দ্যাট!
—পাইছেন একটা সরি। সরি বললেই তো সব শেষ হয় না।
—‘এভাবে বললে অনেক কষ্ট লাগে, রেবেকা, প্লিজ! এসব খুবই ছোট ঘটনা, বাদ দাও। জীবনটা অনেক বড় কিছু।’ শওকত এই শেষ অংশটা বলতে চায়নি, কিন্তু রিফ্লেক্সের কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই বেরিয়ে এসেছে। জানে, এখন তার নিদারুণ মাসুল দিতে হবে।
—এইসব দার্শনিকমার্কা কথাবার্তা আমার সামনে বলবেন না।’
—ভুল বললাম?
—না; ভুল জায়গায় বলছেন।
—কি জানি!
—না বোঝার তো কিছু নাই। আপনি জরুরী একটা কাজে বাইরে যাবেন, দেখলেন জুতা একটা নাই। ধরেন, এটা হারিয়ে গেছে। অন্য কোন জুতাও নাই। এটা অবশ্যই ছোট ঘটনা। এর কারণে দেশে বিপ্লব শুরু হয়ে যাবে না; কিন্তু আপনি থেমে যাবেন; এই তো? লাইফের বেসিক ঠিক না রেখে দার্শকি কথাবার্তা বিরক্তিকর।
—‘তুমি আমার সাথে ঝগড়া করছো। তোমার কি মনে আছে, বিয়ের পর পর আমাদের সম্পর্কটা এমন ছিল না। তুমি অনেক বদলে গেছ, রেবেকা; কোথাও যেন খুঁজে পাই না।
বলতে বলতে শওকতের গলা ধরে এলো। দু চোখে টলমল করছে না-ঝরা অশ্রুর ফোঁটা। শওকত ভেবে পেল না, এখন যে পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে, তাতে গলা ধরে আসাটা স্বাভাবিক; কিন্তু এই সামান্য পরিস্থিতিতে চোখে পানি আসার মত আবেগ কি আসলে রেবেকার জন্য অনুভব করছে? ইদানিং কেমন যেন একটু রুক্ষতা শুরু হয়েছে দুজনেরই হৃদয়-জমিনে। চৈত্রের ফাটল এখনও শুরু হয়নি যদিও। তারপরও পানি এলো কেন? শব্দের প্রভাব? শব্দ যদি ঠিকঠাক ফেলা যায়, মানুষ মিথ্যা ঘটনায়ও কাঁদে। একটু করুণ সুরের গান শুনলে মানুষ কেঁদে ফেলে। শওকতের মনে হলো, আমাদের জীবনজুড়ে নানাভাবে ছড়িয়ে আছে এইসব শব্দের মিথ্যায়ন। ‘আমিই খারাপ; আমি পারি না আসলে’—রেবেকা হঠাৎ ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো।
রেবেকা যখন নিজেকে খারাপ বলে ঘোষণা দেয়, এর অর্থ হলো সে পিছনের সবকিছু ভুলে কোমল হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। এই সময়টাতে শওকতের আনন্দ হয় খুব। কিন্তু ভেতরে একটা সুক্ষ্ম অপরাধবোধও কাজ করে। রেবেকার অভিযোগ আসলে সঠিক। শওকতের অনেক গাফিলতি আর অবহেলা সে পায়; কিন্তু শওকত বার বার তাকে শব্দ দিয়ে ইমোশনাল করে ফেলে। শওকতের মনে হলো লেখক হিসেবে এখানে সে শব্দের অন্যায় একটা সুযোগ গ্রহণ করছে। এসব ভাবতে ভাবতে শওকত যখন নীচে নেমে আসছে, তখন টের পেল সে তার গল্পের প্রথম দিকের ছবিটা পেয়ে গেছে। কী তীব্র সে ছবি। কিন্তু সে কি শব্দ দিয়ে ধরতে পারবে, সবটাকে? প্রশ্ন-চিহ্নের শেষ বিন্দুটা তার চোখবাহিত হয়ে বড়সর একটা পাথররূপে নেমে যাচ্ছে ডুবে যাচ্ছে বুকের ভেতর। এর কিছুকাল পর শওকত তার গল্পটা লিখতে বসল।
রাজু তার সমস্ত সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা নিয়ে ফিরে আসছে মিরার দিকে
মিরা জানে এখন কী ঘটবে। রাজু একটু আগে দরজায় ঝুলিয়ে রাখা প্যান্টের কোমর থেকে চামড়ার বেল্টটা নিয়ে আসবে। দরজার কাছে যাওয়া আর আসার ভঙ্গিটা প্রতিবার একইরকম হয়। দৃশ্যটা মুখস্থ হয়ে গেছে মিরার। ঠোঁটদুটো পরস্পর চেপে থাকে। চোয়ালের নড়াচড়া দেখলে বুঝা যায় উপরের পাটির দাঁতগুলো নিচের পাটির উপর শক্তি খাটাচ্ছে খুব। কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ে এবং চোখের দৃষ্টিটা ঠিক সামনে নয়; তেরসাভাবে কোথায় যেন ফেলে রাখে। চোখের ধারালো দৃষ্টি ছাড়া শরীরের অন্য কোথাও উত্তেজনার কোন আলামত নেই। চেহারা দেখলে শুধু এটুকু বুঝা যায়—কারো কথায় তার মেজাজ খারাপ হয়েছে; কিন্তু সে যে মূলত মিরাকে পিটানোর জন্য চামড়ার বেল্টটা হাতে নিতে যাচ্ছে, তা বুঝার কোন উপায় নাই। রাজু গম্ভীরমুখে মাথাটা একটু বাঁ দিকে হেলিয়ে ধীর পায়ে বেল্টটার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। সামান্য এটুকু জায়গা সে সময় নিয়ে পার হয়। ধীরতার এই ব্যাপারটা রাজুর স্বভাবের অসম্ভব সুন্দর একটি দিক। যেন তার কোন তাড়া নেই।
রাজু সুন্দর, সুপুরুষ। তার চেয়েও বেশি সুন্দর তার সচলতাটি। মিরার মনে আছে, বিয়ের পর পর সে রাজুর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত। যে পরিবেশেই হোক, রাজু খুব সুন্দর করে গুছিয়ে বসতে পারে। তার বসার স্বতঃস্ফুর্ত ভঙ্গিতে পরিবেশটা যেন স্বচ্ছন্দ ও নান্দনিক হয়ে উঠে। যখন উঠে দাঁড়ায়, স্লো মোশনের মত, অসম্ভব এক নিরবিচ্ছিন্নতার সাথে, চেহারায় সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের ছাপ নিয়ে। মিরা ওর প্রত্যেকটা তাকানোকে আলাদা করে ধরতে পারে। যেন আকাশের মত দৃষ্টির রঙ আর তাকানোর ধরণ তার। আর কী সুন্দর করে হাঁটে। অনেকে যেমন পা সোজা রেখেই স্টেপ নেয়, ওর হাঁটাটা এমন নয়। সে পা উঠায়, এরপর হাঁটুর কাছটাতে পরিমাণমত ভাঙ্গা পড়ে, এরপর মাঝারি দূরত্বে পা ফেলে ফেলে প্রতিটি পদক্ষেপে সে খুব স্বস্তি ও সুনিশ্চিতভাবে এগিয়ে যায়। এমনকি ও যখন ফ্রীজ থেকে পানির বোতল বের করে মুখ খুলতো, মিরা তাকিয় থাকত। সকল কাজেই একটা ছন্দ, একটা শিল্প ও নান্দনিকতায় ভরপুর হয়ে থাকে, তা যে সামান্য কাজই হোক। রাজুর কথা বলাও সুন্দর। দৃষ্টির বার্তা, শরীরের ভাষা আর উচ্চারিত শব্দ—এ তিনের মাঝে খুব সুন্দর সংযোগ ঘটাতে পারে সে। মিরার কেমন পাগল পাগল লাগত রাজুর এই ব্যাপারগুলো। রাজু তার সেই সমস্ত সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা নিয়ে চামড়ার বেল্টটা হাতে করে ফিরে আসছে মিরার দিকে।
ফ্লাশব্যাকে দুইটা কুত্তা মিরা আর রাজুকে দৌড়ানি দিল
কী হিংস্র আর ভয়ংকর লাগছে এখন রাজুকে। মিরা টের পেল হিমশীতল একটা ভয় চিকন সাপের মত কিলবিল করে তার মেরুদণ্ড দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। আরো টের পেল, বেশ কিছু দিন যাবত সে রাজুকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতে শুরু করেছে। আজ নিয়ে পঞ্চমবারের মত মিরাকে বেল্ট দিয়ে পিটাতে যাচ্ছে রাজু।
—‘তোমাকে কতবার বলেছি,’ বেল্টের পিতলের দিকটা কব্জিতে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে চিবিয়ে কথা বলতে শুরু করল রাজু। বেল্টের সাথে সাথে শব্দগুলোও যেন, মিরাও যেন, হাতের মধ্যে পেঁচিয়ে যাচ্ছে। ‘আমার সাথে এইভাবে আর্গু করবা না। তোমার এইসব ঘাউড়ামি মার্কা কথা আমার হাড্ডিতে গিয়ে লাগে।’ রাজুর মাত্রই তিন-চার শব্দের ছোট্ট মন্তব্যটা মিরার এতো ভালো লাগছে। রাজু কী সুন্দর করেই না বলল—‘মিরা, তোমার কথা বলা অদ্ভুত সুন্দর!’। এরকম মন্তব্য সে আগেও শুনেছে, অন্যদের থেকে; কিন্তু বিয়ের এক মাসের মাথায়, আঙিনাতে দুইটি চেয়ারে পাশাপাশি বসে, কোমল বিকেলটিতে, এই আজকের মত এতো আনন্দ হয়নি কখনো।
—কিন্তু তুমি তো তখন পর্যন্ত আমার কোন কথা শুনতে পাওনি!’ মিরা রাজুর নাকটা আলতো টেনে দিল।
—হুম। এটা আসলে বলা মুশকিল। হা হা হা… সবকিছু মিলিয়েই তো ভালো লেগেছে। তোমার সবকিছুই তো সুন্দর।
—আচ্ছা, ধরো মানলাম, আমার সবকিছু সুন্দর, হা হা হা…, তারপরও প্রথম কোন জিনিস দেখে তোমার মনে হলো এই মেয়ের সাথে বিয়ে না হলে আমার কিছু একটা হয়ে যাবে? এমন স্পেসিফিক কিছু?
—হুম, তোমাকে যখন দেখতে গেলাম, তখন তুমি আমার দিকে চোখ ফেলতে পারছিলে না। লজ্জায় ভেঙে পড়ছিলে। এটা খুবই কমন একটা ব্যাপার, না? কিন্তু এটাই আমার খুব ভালো লাগছিল।
—দুষ্ট, তুমি অনেক্ষণ তাকিয়েছিলে বুঝি?
—নাহ, একপলকমাত্র। আসলে আমারও লজ্জা লাগছিল খুব। এতো লজ্জা পাব ভাবিনি আগে। তখনের মানসিক অবস্থাটা স্বাভাবিক হিসাব দিয়ে অনুমান করা যায় না আসলে। খুবই অন্যরকম হয়ে থাকে মন।
—হুম, ঠিক বলেছো।
—কিন্তু তুমি তো আমাকে মোটেও দেখোনি।
—কে বললো? হা হা হা… কী মনে করো আমাকে? আমি সময় নিয়ে বেশ কয়েকবার দেখেছি তোমাকে, চুরি করে।
বেল্টের নিচের অংশটা সাপের মত বাঁকা হয়ে ঝুলে আছে। দেড় হাত মত দূরে থাকতে রাজু থামবে, এরপর বেল্টটাকে একটা ঝাড়া দিবে। সে সময় তার পুরো শরীরটা একটা সুন্দর তরঙ্গের মত দুলে উঠবে। এটা ঘটবে আর পাঁচ সেকেন্ডের ভিতরে।
—তুমি অবশ্যই তোমার কথা বলতে পারো। কিন্তু অযৌক্তিক কথা বলবে কেন?
—তোমার মনমত না হইলেই অযৌক্তিক? যুক্তিটা ঠিক করে দিবে কে, শুনি? মিরার কণ্ঠে অভিযোগ আর হাহাকার।
—আমাকে বুঝাও, একটা ফোন করতে তোমার পনের দিন লাগছে কেন?
—আমি দিব তো বলছি, কিন্তু এখানে, তুমি জানো, কিছু অস্বস্তি আছে, টাইমিংয়ের ব্যাপার আছে, মনে থাকার বিষয় আছে—সব কিছু মিলিয়ে হয়ে উঠেনি। কিন্তু তুমি আমাকে যেভাবে ফোর্স করছো, আমার মায়ের খবর নিয়েছ কয়দিন? গত ছয়মাসের ভিতরে একবার ফোন দিয়েছ?
—এইসব সাধারণ জিনিসগুলোও যখন বুঝিয়ে বলা লাগে, তখন মেজাজ খারাপ হয়। আমি তোমার মায়ের সংসারে গিয়ে থাকছি না যে, আমার সবসময় খোঁজখবর রাখা লাগবে; কিন্তু তুমি তো মায়ের সংসারে আছ; তোমার আর আমার অবস্থান এক না।
—খোঁজখবর নেওয়াকে এখন তুমি অবস্থান দিয়ে ভাগ করছ! আজিব তোমার হিসাব। তোমাকে আমার চেনা হয়েছে। বোকা মেয়ে তো, শুরুতে মানুষ চিনতে ভুল করেছিলাম।
—তোমার দেমাগ বেশি। সব সুন্দরীরাই এমন—দেমাগে মাটিতে পা পড়ে না। মানুষকে মানুষ বলে হিসাব করে না। কিন্তু আমার সামনে অবশ্যই মুখ সামলে কথা বলতে হবে। বেয়াদবি আমি সহ্য করতে পারি না।
—তুমি একটা জঘন্য রেসিস্ট, হিংস্র আর প্রচণ্ড স্বার্থবাজ মানুষ। কখনো বলিনি। আজকে বলে দিলাম। হেঁ, রাগ নিয়েই বলছি, কিন্তু কথাটা তুমি রাগের উপর দিয়েই ছেড়ে দিয়ো না।
রাজু বেল্ট-প্যাঁচানো হাতটা উপরে উঠাচ্ছে।
—হেঁ, হাতটা আরেকটু উঠাও; দ্রুত করো। আচ্ছা, দাঁড়াও, আগে ব্যাগটা দাও আমার হাতে। মিরা ব্যাগটা হাতে নিযে দেয়ালের ওপারে ছেড়ে দিল, ঘাসের উপর। বেশ উপর থেকে পড়েছে ব্যাগটা। ভেতরে পাথরের কিছু জিনিসপত্র আছে, কী অবস্থা হলো কে জানে। চকলেটগুলো মনে হয় গুড়ো হয়ে গেছে। অবশ্য ঘাসগুলো পুরো হওয়াতে কিছুটা রক্ষা পাওয়া গেছে হয়তো।
—শুনো, ওই যে, একটা ইটের মাথা বের হয়ে আছে, ওটাতে পা রাখো। হেঁ, এবার শরীরটাকে ঝাঁকি দিয়ে একটু উপরে তোল, এরপর হাতটা আমার কাছাকাছি নিয়ে আসো। দ্রুত করো। রাজুর চেহারাটা ঘেমে গেছে, সেখানে মাঝারি গোছের একটা ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে। হাতটা কাছাকাছি আসা মাত্র মিরা খপ করে ধরে ফেললো। শরীরের বেশির ভাগ অংশ দেওয়ালের ওপাশে ঝুলিয়ে রেখেছিল আগেই, ফলে, রাজুর ভারী শরীরটা ধরে রাখতে বেগ পেতে হয়নি তার। এক সময় দুজনেই উঠে বসলো দেওয়ালের উপর। দুইপাশে দুই পা ছড়িয়ে রাজু হাঁপাচ্ছে খুব। ভয়াল চেহারার কুকুর দুটো এখনো কিছুটা দূরে এবং কী কারণে যেন থেমে গেছে। সম্ভবত ধরতে পারবে না ভেবে হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার মনস্থ করেছে। কিন্তু সেই লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। দুই পা সামনে বিছিয়ে, ওদের দিকে মুখ করে, পাশাপাশি বসে আছে ভয়ালদর্শন হাউন্ড দুটো। এমন সময় সাদা এপ্রোন পড়া দুইজন তরুণ বেরিয়ে এলো কাছের ছোট বাংলোটা থেকে। চেহারায় কিছুটা অপ্রস্তুত ভাব। ‘উই আর সরি, ম্যাম!’ তরুণ দুজন মিরার দিকে তাকিয়ে বো’ করল। ‘বি ইজি, স্যার। এই বাংলো এলাকাটা রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া। পথের শুরুতে বড়সর একটা সাইন ছিল, আপনারা হয়তো খেয়াল করেননি। অবশ্য, কুকুর দুটো শুধু ভয় দেখিয়ে পাহারার কাজ করে; কারো ক্ষতি করে না। বাট, ইট ওয়াজ আ বিগ মিসটেইক; উই আর ভেরি সরি, স্যার!’ মিরা আর রাজু দুজনেই গল্পে মেতেছিল, ফলে সাইনটা খেয়াল করেনি। এখন হাসি পাচ্ছে খুব। ‘আপনারা চাইলে এদেরকে সাথে করে নিয়ে যেতে পারেন। খুব ভদ্র কুকুর। যে কেউ কমান্ড করতে পারে।’ তরুণ দুজন মিষ্টি হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুললো।
—‘নো, নো, ইটস ওকে। কুকুর আমি এমনিতেও কিছুটা ভয় পাই।’ রাজু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।
—‘ধন্যবাদ স্যার। দেয়ালের ওপাশে মাঠটা পার হলেই চমৎকার ঝর্ণা পাবেন; নির্জন এলাকা। পানিতে পা ডুবিয়ে বসার ব্যবস্থা আছে। ছোট্ট একটা বোটও আছে। খাবার দাবার কিছুর প্রয়োজন হলে সার্ভিস নাম্বারে কল, প্লিজ! আপনাদের ভ্রমণ আনন্দময় হোক। ইনজয়!’ বিয়ের পর ওরা হানিমুনে এসেছে, ইন্ডিয়াতে। অবশ্য, ছয় মাস পেরিয়ে গেছে, ফলে একে ঠিক হানিমুন না বলে ‘লেটমুন’ই বলা ভালো, হয়ত। রাজুর ইচ্ছে ছিল চিটাগাংয়ের দিকে যাওয়ার; মিরা হাসতে হাসতে একদিন বললো, জানো, বিয়ের আগে আমি কিছু টাকা জমিয়েছিলাম স্বামীকে নিয়ে দূরে কোথাও যাওয়ার জন্য। তুমি কিছু যোগ করলে আমরা হয়তো ইন্ডিয়া থেকে আসতে পারি। টাকার পরিমাণটা কম ছিল না। মিরার ভাষায়—এটা হবে আমাদের রাজকীয় সফর। এর অন্যতম উপাদান হবে খুবই চমৎকার একটা হোটেলে রাতগুলো কাটানো। ব্যাঙ্গুলুরে ওরা যে হোটেলটাতে উঠেছে, বিশাল জায়গা নিয়ে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, একে হোটেল না বলে ছোটখাট একটা পর্যটনকেন্দ্র বলা ভালো। পাহাড়, ঝর্ণা, হ্রদ, নদী, সাঁকো, বিশাল আকৃতির মাঠ, সুনসান ঘন জঙ্গল—সবটা মিলিয়ে সাজানো গোছানো অপূর্ব এক আধুনিক গ্রাম যেন। হোটেলের নামটাও তা-ই—‘মডার্ন ভিলেজ’।
—চলো, হ্রদের দিকটা ঘুরে আসি। লাফ দিতে পারবে? না সিঁড়ি আনতে বলব?
—হুম, আমি পারব। দাঁড়াও, আগে সুবিধামত বসে নেই। হেঁ, এবার তুমি গুনো। মিরা চোখে দুষ্টুমি নিয়ে জবাব দিল।
—ওকে, ওয়ান, টু, থ্রি… গো!
—না, তোমার কথায় নাকি!
মিরা লাফ দেয়নি। বাচ্চাদের মত মুখভঙ্গি করে হাসছে খিল খিল করে। রাজু কপট রাগ দেখিয়ে হালকা একটু ধাক্বা দিল। মিরা এলিয়ে পড়লো, দেওয়ালের ওপাশে, সবুজ ঘাসের উপর।
—দাঁড়াও, তুমি আমার মত লাফ দিবা না। আমি হেল্প করছি।
এই পাঁচ-ছয় মাস রাজু কোন ধরণের নিয়ম-টিয়ম মেনে চলেনি। খাবার-ঘুম একদমই বেসামাল। ব্যায়াম করে না অনেক দিন হলো। ফলে, স্বাস্থ্যটা বেশ বেড়ে গেছে। বেঢপ আকারে না গেলেও চলাফেরায় কিছুটা সীমাবদ্ধতা চলে এসেছে। এই যেমন এখন, এটুকু উঁচু থেকে লাফ দিতে ভয় ভয় করছে।
—আগে পা দুইটা এই পাশে নিয়ে আসো। এরপর একটু নুয়ে হাত দুটো নিচের দিকে নামাবে আমার দিকে।
মিরা উঠে কথাগুলো বলতে বলতে একেবারে কাছটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। পাতা মেলে ধরে হাত দুটো উপরে তোলে বললো, এবার হাত নামাও। রাজুর হাতটা নেমে আসছে নিচের দিকে। মিরা ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। চোখ বন্ধ। দুই হাত উপরে তোলে মাথা নুইয়ে ফেলেছে। দিশেহারা লাগছে খুব। ভেবে পাচ্ছে না কী করবে। কিন্তু এই বেল্টের বাড়ি কোনভাবেই সহ্য করার মত নয় মিরার পক্ষে। মিরার মনে পড়ে ছোটবেলার মক্তবের কথা। মক্তবের দাদা হুজুর খুব ভালো মানুষ ছিলেন। যত্ন নিয়ে সবাইকে পড়াতেন আর অনেক আদর করতেন। তাঁর হাসি ছিল খুব সুন্দর। মিরার মনে আছে, একবার হাসলে সেই হাসির রেশ তার চেহারায় লেগে থাকতো অনেক্ষণ। লম্বা জুব্বা-পরা শান্ত, সৌম্য, শুভ্র শশ্রুমণ্ডিত, পরিচ্ছন্ন একজন মানুষ ছিলেন তিনি। হাতে একটা চমৎকার কাঁচাপাকা কঞ্চি থাকত। এমন আধাপাকাই হতে হবে। পুরোপুরি পেকে হলুদ হয়ে গেলে পাশের বাঁশঝাড় থেকে নতুন আরেকটা এনে দিতে হত। কিন্তু পিটুনি দিতেন খুব কম, মাঝে মাঝে। তবে, সেই পিটুনিও যেনতেনভাবে না; সবাইকে লাইনবেঁধে দাঁড়াতে হতো। হুজুর বসা থাকতেন জলচৌকির মত ছোট একটা খাটে। তারপর একজন একজন করে ডাক পড়তো, জবাবদিহি করতে হতো; এমনকি সবার অপরাধ অভিন্ন হলেও জবাবদিহিতাটা আলাদ আলাদাভাবে করতে হত। এরপর দুই হাতে দুইটা বাড়ি। এই বাড়ি দুটো ছিল মিরার জন্য অসহ্য এক যাতনার কাল। সে চামড়া আর গোশতের উপর কোনরূপ আঘাত সহ্য করতে পারে না। লাইনে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের পানি মুছতো আর আকুল হয়ে ভাবতো—এই তো, আর দুই মিনিট পরেই সময়টা শেষ হয়ে যাবে। দুঃস্বপ্নের মত অসহ্য এক সময় ছিল এই অপেক্ষার মুহুর্তগুলো। এরপর হাতের তালুতে সপাং করে এসে যখন বাড়িটা পড়ত, মনে হত জান বুঝি বেরিয়ে যাবে। এতো অসহ্য ব্যাথা। ধারালো একটা ব্লেড দিয়ে কলিজায় বুঝি টান মেরেছে কেউ। মিরা তার বিশেষ কিছু অনূভুতি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারে। রাজুর সাথে এরকম গল্প বলার দারুণ কিছু সময় গেছে তার। একদিন, বিকেল বেলা, জানালার পাশে বসে এই অনুভূতিটা মিরা শুনিয়েছিল সবিস্তারে। রাজু চমৎকার একজন শ্রোতা।
সেদিন মিরার বিবরণ শুনে রাজুর চোখে পানি চলে এসেছিল। মিরার মনে হয়, একটা মানুষ সারা জীবনে সামান্য কিছু দৃশ্য উপার্জন করতে পারে। রাজুর চোখে পানি, গভীর মায়া নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে—এই দৃশ্য মিরার কাছে খুবই স্বপ্নময় আর অপার্থিব লাগে। মিরা দু্ই হাত উপরে তোলে, কিন্তু জানে, এটা অনর্থক। হাত দিয়ে সে কিছুই আটকাতে পারবে না। ভয়ে সে হু হু করে কেঁদে ফেললো—
—আমাকে এভাবে মারবে না, রাজু, প্লিজ!’ মিরার কণ্ঠটা ভাঙা কাঁচের টুকরোর মতো ছড়িয়ে পড়লো পুরো রুমের ভেতর। ‘তুমি হাত দিয়ে মারো; প্লিজ, তুমি জানো আমি বেল্টের বাড়ি সহ্য করতে পারি না…’
কথা শেষ করার আগেই বিদ্যুতবেগে বেল্টটা এসে মিরার পিঠে ছোবল বসিয়েছে। প্রথমে কিছুই টের পাওয়া যায়নি। কেমন ভোঁতা একটা অনুভূতি। এরপরই তীক্ষ্ম ও তীব্র একটা ব্যাথা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য কীট যেন, কিলবিল করে, মুখে নীল বিষ নিয়ে, দংশন করতে করতে, দ্রুত বেগে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে পিঠ জুড়ে। ব্যাথার তীব্রতা আঘাত করছে সরাসরি মস্তিষ্কের কোষগুলোতেও। মিরার পিঠ বাঁকা হয়ে গেল আপনাতেই। রাজু অস্ফুট স্বরে কী একটা কথা বার বার বলছে আর চমৎকার ছন্দ মেনে একের পর এক মেরে যাচ্ছে, ধীরলয়ে। প্রথম বাড়িটা খাওয়ার পর মিরা শুধু বলছিল, ‘ওফ, মা গো, আমি মরে যাব।’ এরপর সে কান্নার কথাও ভুলে গেছে। উঠে দাঁড়িয়ে নানাভাবে প্রতিটি বাড়ি ফিরানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সুন্দর চেহারাটা হয়ে উঠেছে করুণ। একটি বাড়ি পড়ার আগে সেখানে একটা আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠছে, এই আঘাতটা হয়ত ফিরানো যাবে। কিন্তু বাড়িটা পড়ার সাথে সাথে প্রবল যন্ত্রণায় কালো হয়ে যাচ্ছে মুখ, যুদ্ধবিধ্বস্ত, আশাহত ও পরাজয়ের গ্লানিতে জর্জরিত এক সৈনিকের চেহারার মত। পরক্ষণেই নতুন উদ্যমে ব্যাকুল হয়ে উঠছে, পরের আঘাতটা ফিরিয়ে ফেলার আশায়। কিন্তু একটা সময় গিয়ে দেখলো এভাবে আর পারা যাচ্ছে না। তার ভেতরের অসম্ভব ব্যথা, অসংখ্য কান্না, প্রবল অভিমান, নিদারুণ ঘৃণা ও অপমানের অসহ্য অনুভূতি সব একসাথে হয়ে গলার কাছটাতে আটকে আছে। ফলে, সে যখন হাউমাউ করে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে, তখন সবগুলো জিনিস একসাথে বন্ধনমুক্ত হয়ে শব্দে পরিণত হয়। সে সময় তার কণ্ঠ ফেটে যায় এবং এতো অভুতপূর্ব ও বিশ্রীভাবে তা বাতাসে সম্প্রচারিত হয় যে, শুনলে গা শিউরে উঠে, শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়—‘আমি তোরে কী করছি? তুই প্রত্যেকটা দিন এইভাবে আমারে মারোছ কেন? কুত্তার বাচ্চা, কী করছি আমি তোরে। আমারে জবাই করে ফেল।’
এটুকু লেখার পর শওকত কলমটা হাত থেকে রেখে চেয়ারে হেলান দিল।
শওকত ভাঙা গ্যাসের চুলা নিয়ে শহরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে
ওর কি মিরার জন্য মন খারাপ হয়েছে? সম্ভবত। বুকটা কেমন ভারী ভারী লাগছে। কিন্তু সে মূলত ভাবছে অন্য একটা সমস্যা নিয়ে। রাজুর প্রতি মিরার অসাধারণ আকর্ষণ ছিল। রাজুর কথাবার্তা চলাফেরা সবকিছুই তার ভালো লাগত। আর, মিরা? রাজু মাঝে মাঝে বলতো, হাসিতে মুখ উজ্জ্বল করে—‘তুমি এতো ভালো কেন? জানো, মাঝেমাঝে তোমাকে আমার পিটাইতে ইচ্ছে করে, এই জন্য।’
কথাটা এতো আনন্দ নিয়ে বলতো রাজু, যেন বৃষ্টিতে ভিজেছে; চেহারায়, ভুরুতে, থুঁতনিতে লেগে আছে স্বচ্ছ জলের ফোঁটা—এমন একটা আনন্দ তার মুখটাকে তখন কোমল করে রাখত। মিরা বলতো, তুমি আমাকে পূর্ণ করেছো। আমরা দুজন মিলে একটা আলোর বৃত্ত রচনা করব, এর অর্ধেকটা আছে তোমার হাতে, বাকি অর্ধেকটা আমার ভেতর। শওকত ভেবে পায় না পরস্পরের প্রতি এমন আকর্ষণ থাকার পরও সম্পর্কটা কীভাবে এমন বিশ্রী অবস্থায পৌঁছুলো? আর, ধরা যাক খারাপ হলোই বা, তাই বলে এমন অমানুষের মত পিটানোর পর্যায়ে চলে যাবে?
—হ্যালো, শ্রদ্ধেয় লেখক জনাব শওকত সাহেব?
—জি, ম্যাম!
—আমাদের গ্যাসের চুলা নষ্ট হয়েছে। সুইচে আগুন ধরে যায়। আজকের ভিতরে ঠিক করে আনা চাই।
—জি, জি। আমি এক্ষুণি যাচ্ছি, ম্যাম, আপনি চিন্তা করবেন না।
শওকত মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কিচেনে এলো। আজ রেবেকার মনটা বেশ ফুরফুরে মনে হচ্ছে। কণ্ঠ শুনলেই খুশির আভাস টের পাওয়া যায়। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। খোলা চুলে অপূর্ব লাগছে দেখতে। শওকত চেহারাটা যথাসম্ভব গম্ভীর করে, সেখানে একটা প্রশ্ন ফুটিয়ে, বিরক্ত স্বরে বললো,
—কী ব্যাপার। এতো খুশি খশি কেন? আমি আসলেই তো সব নাই হয়ে যায়।
শওকত জানে কথাটা রেবেকাকে আঘাত করবে, কিন্তু তবু ইচ্ছে করে করেছে কাজটা। কেন করল সেটা শওকতের কাছেও স্পষ্ট না। হয়তো অনিশ্চিত ও অস্পষ্ট একট অভিযোগের প্রতিকার করতে চাইছে, অথবা অবচেতনে প্রতিশোধপরায়ণতাও কাজ করে থাকতে পারে। কিন্তু কীসের প্রতিশোধ? শওকত কিছুটা টের পেল, এটা মনের ধোঁযাশাপূর্ণ একটা অবস্থান। এখানে মানুষ নানাবিধ শব্দকে লুকিয়ে ফেলে, অযাচিত দৃশ্যসমূহকে ব্লার করে দেয় এবং বুদ্ধিকে সীমিত করে নিজের স্বার্থকে একটি নৈতিক আবরণে সমর্থিত করে তোলতে চায়। শওকত কোন একটা দিককে ঠিক করে উঠতে পারে না, তার আগেই রেবেকার মুখটা কালো হয়ে যায়। শওকত জানে এই ঝড়টা তাকে এক সময় সামলাতে হবে। হয়তো আজ, না হয় দুদিন পর; কিন্তু আসবে তা সুনিশ্চিত।
.ঈদসংখ্যার গল্পলেখক শওকত ইসলাম ভাঙা গ্যাসের চুলা নিয়ে যখন পথে নামল, তখন রোদ মরে গিয়ে গরম-টরম বেশ সহনীয় একটা মাত্রায় চলে এসেছে। এই সময়ে রিকশা পাওয়াটা একটা মুশকিল। দ্রুত ফেরার জন্য রেবেকা যে ভারী শব্দসমূহ ব্যবহার করেছিল এবং তার ভিতরে একটা ভীষণ তাড়া তৈরীর জন্য যে-সকল মুখভঙ্গি করেছিল, শওকত সে-সবকিছু ভুলে অত্যন্ত ধীর পায়ে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে খারাপ লাগছে না। ফলে গমন-সম্ভব কিছু রিকশা পেয়েও সে না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাচ্ছে, নির্বিকারভাবে। কয়েক জায়গায় ফোন করতে হবে। নিজের লেখালেখি, বিশেষত গদ্যটা নিয়ে সমঝদার কারো সাথে আলাপ করা দরকার। শওকত ঘর থেকে বেরিয়েছিল বেলা আড়াইটার দিকে, বিকাল সাড়ে চারটার দিকে দেখা গেল শহরের একমাত্র চুলা-মিস্ত্রির দোকনের সামনে সে ভাঙা চুলার বস্তাটা হাতে দাঁড়িয়ে আছে, আর মগ্ন হয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে।
—সাব্বির, কেমন আছেন?
—এই তো ভাই, ভালো আছি, আপনি কেমন?
সাব্বিরের কণ্ঠে বিনয় ও আনন্দের যৌথ আভাস। সাব্বির শওকতের জুনিয়র এবং বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু সম্পর্কটা ঠিক ছোট ভাই-সুলভ না, আবার পুরোপুরি বন্ধুত্বপূর্ণও না। এ দুয়ের মাঝামাঝি, সুন্দর, আন্তরিকতাপূর্ণ ও উপভোগ্য। সেই মাঝামাঝি অবস্থান থেকে শওকত তাকে নাম ধরে ডাকে, কিন্তু সম্বোধনে তুমি-আপনিতে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। আজকে অনেক দিন পর আলাপ।
—সাব্বির, আপনার কি সময় আছে?
—হ, ভাই, কী যে বলেন! এই তো রাস্তায় হাঁটতেছি।
—আমার লেখাটা কি পড়ছিলা?
—জি ভাই, পড়ছি। কিন্তু মূল্যায়ন করমু কী দিয়া? আমি তো সমালোচনার নিয়মনীতি জানি না।
—নিয়মনীতি ফালতু ব্যাপার। তুমি তোমার মত করে কও। এইসব ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই তার নিজস্ব নিয়মে হাজির।
—হুঁ, ভাই, সুন্দর কইছেন। তো, আমার কাছে মনে হইছে কি, প্রথম প্যারায় আপনি যেটা কইছেন, আমি হইলে এইটা ফিকশন দিয়া দেখাইতাম। এ ছাড়া পুরা লেখাটা একটা সুন্দর রচনা। আমার ভাল্লাগছে।
—আচ্ছা, বেশ, ব্যাখ্যা না কইরা ফিকশন দিয়া ম্যাসেজ তৈরী করা অবশ্যই উৎকৃষ্ট রচনার লক্ষণ; এইখানে একটা নোট দিয়া রাখি। এই লেখায় আমি মূলত স্মৃতি কথা লেখতে যাই নাই; স্মৃতিকেন্দ্রিক কিছু বিবরণ রাখছি শুধু। কারণ, আমার মনে হইছে এই অংশটা নিয়া স্মৃতি লেখার টাইম এখনও হয় নাই।
—এইটা একটা দারুণ কথা বলছেন। আমার একটা মন্তব্য আছে, আপনার কথাটাই, বা তার একটু ব্যাখ্যা—আমার মনে হয় কি, স্মৃতিকথা আর জীবনীর মাঝে একটু ফারাক আছে। এইটা একাডেমিক স্বীকৃত কোন ফারাক না, হয়তো; কিন্তু আমি সম্পূর্ণ নিজের অনুভব থেকে বলতেছি। স্মৃতিটা কেমন? এইটা হলো মদের মত। মিকশ্চারটা আপনে অনেকদিন রাইখা দিবেন। তখন এর মধ্যে একটা এক্সট্রা ফ্লেভার আসবে। দেন আপনি এইটা নিবেন।
—ঠিক তা-ই। আমাদের জীবনের সকল কিছুই আসলে তো স্মৃতি হয় না। বেশিরভাগ জিনিসই হারায়ে যায়। মনে থাকে অল্পকিছু বিশেষ ব্যাপার। সেইটা থেকেও অনেক অংশ আমরা ভুইলা-টুইলা যাই। এরপর বহুদূর অতীত থিকা এইগুলারে আমরা আবার নতুন কইরা আবিস্কার করি। তখন এর মধ্যে এমন সব নতুন মহিমা ও ফিল যুক্ত হয়, বাস্তবে ঘটনাটা ঘটবার সময় যা মূলত ছিল না। এই দিক থেকে স্মৃতিকথা, যা জীবনী নয়, বেশ কিছু অংশে বাটপারী মূলত; মানে, সুন্দর মিথ্যা।
—হুম, এই মিথ্যা অংশটুকুই তো মূলত স্মৃতির সৌন্দর্য। বলতে পারেন, অনেক সময় আমরা এইটুকুর জন্যই একজনের স্মৃতিকথা পড়তে আগ্রহী হই। যাগগা, আমি স্পেসিফিকলি একটা প্রশ্ন করার জন্য ফোন করলাম।
—জি, ভাই।
—আমার মনে হইতেছে কি, গদ্যের ক্ষেত্রে আমি বিশেষ এক রকমের বাকভঙ্গিতে আটকায়া গেছি, বিশেষ কিছু শব্দ বার বার ব্যবহার করতেছি, আর, আমার কাছে লাগতেছে একটা লেখায় আমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেমন যেন একটু আপ্লুত ভাব নিয়া নাকি সুরে কান্নাকাটি কইরা যাইতেছি। লোকজন এইটারে খারাপ বলতেছে না; কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা পেইনফুল। ইদানিং লেখা আগাইতেছে না এইসব কারণে। অনটেস্ট একটা গল্প লেখতেছি, এইখানেও এই ঝামেলা হইতেছে। এই যে আপনাদের জাফর ইকবাল, একটা সময় ওর প্রবন্ধের ধরণটা ভাল্লাগত। কিন্তু কিছু দিন পড়ার পর এখন ওর প্রবন্ধ দেখলেই মেজাজ খিচড়ে যায়। প্রথম প্যারা পড়লেই আমি বুইঝা যাই শালারপুতে এইখানে কী কইতে যাইতেছে।
সাব্বির কী একটা মন্তব্য করতে যাচ্ছিল, এমন সময় একটা কল ঢুকলো। নীলপরীর ফোন।
—হ্যালো?
—জি, হ্যালো, ম্যাম?
—কই আপনি?
—এই তো রাস্তায়।
—রাস্তায়! গ্যাসের চুলা ঠিক করতে সেই যে গেলেন, ফিরার নামগন্ধ নাই। আধা ঘন্টার কাজ সারতে আপনার এতোক্ষণ লাগে?
—আসছি তো, গ্যাসের চুলা ঠিক করা সহজ কাজ না। সময় লাগে।
—আপনি এতোক্ষণ কী করছিলেন আমাকে বলেন। তিনবার কল দিলাম, ওয়েটিং। কার সাথে এত কথা!
—তুমি এসবের কী বুঝবা? বাদ দাও।
—হেঁ, আমি তো আপনার কিছুই বুঝি না; মুর্খ মানুষ।
‘মানুষ’ এর সবটুকু শুনতে পাওয়ার আগেই ‘নীলপরী’ ফোন রেখে দিয়েছে। শওকত কিছু সময় মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাঙ্গা গ্যাসের চুলাটা নিয়ে ত্রস্ত পায়ে দোকানের ভিতরে ঢুকলো। দোকানির হাতে কাজের ভিড় পড়ে গেছে। একটু সময় বসতে হবে। শওকত চুলাটা দোকানির হাতে বুঝিয়ে দিয়ে একটা টুলে এসে বসল। সে কি কিছুটা ভীত হয়ে পড়েছে? এটা আসলে ঠিক ভীতি না; অস্বস্তি ও খারাপ লাগা। এই সময় সে একটা অদ্ভুত কাজ করল। কাজটা যে সে খুব একটা সচতেনভাবে করছে তা না। অনেকটা অবচেতনে, রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষ যেমন বেখেয়ালে একটা গাছের পাতা ছিঁড়ে নেয়, অনেকটা তেমন। সে মোবাইলটা বের করে ‘নীলপরী’ নামটা কেটে দিয়ে সেখানে লিখল ‘রেবেকো’। কাজটা শেষ করার পর পরই খট করে প্রশ্নটা তার মাথায় ঢুকে গেল—এটা সে কেন করল? রেবেকোকে সে অনেকগুলো নাম দিয়েছিল : মায়া, রাত্রি, নীলাচল, জলজ মেয়ে, বালিকা, মেঘবতী, নীলপরী… আরো কত কী। রেবেকার জন্য ব্যাপারটা ছিল দারুণ সারপ্রাইজের মত। নতুন নাম দেখতে পেলে এতো খুশি হত। তখন শওকতের মনে হতে থাকত, একটা মানুষকে আসলে কত সহজে খুশি করে ফেলা যায়। সর্বশেষ ছিল এই ‘নীলপরী’। অনেক দিন হলো এর জায়গায় নতুন কিছু আসছে না। নতুন আরেকটা নাম দেওয়া দরকার। সন্ধ্যার আগে আগে যখন বাড়ি ফিরছিল, তখন তার ডান পায়ের জুতাটা ভোঁতা একটা আওয়াজ করে ছিড়ে গেল। ছিঁড়া জুতা নিয়ে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে ঈদসংখ্যার গল্পলেখক শওকত ইসলাম যখন বড়িতে প্রবেশ করছে, ঠিক তার আগ মুহুর্তে
রেবেকার জন্য নতুন একটা নাম পেল সে—শুকতারা।
বিথী মিরার বুকের উপর উপুড় হয়ে হু হু করে কাঁদছে
মিরা ঘুমের ভিতরেই টের পেল কেউ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, খুব নরমভাবে। কচি হাতের ছোট ছোট আঙুলগুলো মাঝেমাঝে চুল নিয়ে খেলা করছে। মিরা পাহাড়ের খুব উঁচুতে, মেঘের কাছাকাছি, খোলামত একটা জায়গায় বসে আছে, হাঁটুতে মুখ গুঁজে। জায়গাটা অচেনা। আশপাশে অনেক দূর পর্যন্ত ঘন জঙ্গলের প্রান্তর। অনেক নিচে থেকে তাকে ডাকছে কেউ, দূরাগত ক্ষীণ শব্দে—আম্মু, আম্মু! কি মিষ্টি করুণ কণ্ঠ পিচ্চিটার। পরক্ষণেই মনে হলো ডাকটা যেন কোন জলপতনের ভেতর থেকে আসছে। মিরা আস্তে আস্তে চোখ মেলল। বিথী বসে আছে, একেবারে বুকের কাছটা ঘেঁষে। বিথী দেখতে হয়েছে মিরার মতই। মাথার ঘনকালো চুলগুলো বেশ লম্বা হয়েছে। কপাল আর চোখের কিছু অংশ ঢাকা পড়ে আছে সে চুলে। মিরার খুব ইচ্ছে হচ্ছে বিথীকে দু হাতে নিয়ে নিজের সাথে সজোরে চেপে ধরে। আর তখনই বুকের ভেতর একটা নক্ষত্র খসে পড়ল, একটা চাঁদ ঢেকে গেল মেঘে মেঘে, সুন্দর ছোট্ট একটি পাথর টুপ করে হারিয়ে গেল ঝর্ণার স্বচ্ছ জল-প্রবাহের ভেতর।
—আম্মু!
—হুঁ
—তোমার কি কষ্ট হয়?
—হুঁ
—চলে যাবে?
—না। কই যাব?
—মামার কাছে।
—না রে, আমি লাইফটাকে দেখছি।
—কী দেখবে তুমি? লাইফ তো শেষ হচ্ছে।
—আসলে এ ছাড়া উপায় কি? তোর মামার ব্যস্ত জীবন। উনি নিজের মত করে সেটেল হয়েছেন, সেখানে আমি একটা আলগা উপস্থিতি হব। তুই আসলে বুঝবি না এসব। এটা আমি চাই না।
—তাহলে কী করবে, তুমি?
—জানি না, সোনামনি।
—তুমি কি আব্বুকে ঘৃণা করো?
মিরা কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলো। চোখে টলমল করছে জল।
—তুমি আসলে ঘৃণাই করো, কিন্তু নিজের কাছে স্বীকার করতে পারছ না। কারণ, এটা তুমি বিশ্বাস
করতে চাও না।
—আমি আসলে কী করব বুঝতে পারি না।
—আম্মু, তুমি একা হও, নিঃসঙ্গ ও নির্জন হও। নিশ্চুপ, নিঃশব্দ, যেখানে ঘৃণা নাই, ভালোবাসা নাই, মনোরম এক শূন্যতা শুধু…
বিথী মিরার বুকের উপর উপুড় হয়ে হু হু করে কাঁদছে।
—বিথী, তুই এতো ছোট বয়সে এত এত কথা শিখলি কই?
—আম্মু, আমি তো কেউ না আসলে। তুমিই আমাকে নির্মাণ করেছো। তুমি তো কথা বলো মূলত নিজের সাথে।
মিরা উঠে বসল। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রুমের ভেতরটা আবছা অন্ধকার। ঘরে আর কেউ নেই। একটা প্রকাণ্ড শুন্যতা মিরার মাথার উপর ঝুলে আছে শুধু। চার বছর আগের একটি দিন, যেদিন বিথী মিরার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিঃশব্দে মরে গেল, কোলের উপর, সেদিনের শূন্যতার সাথে আজকের শূন্যতাটির তফাৎ সামান্যই। মিরার ঠোঁটে প্রচণ্ড তেজস্বিতা নিয়ে জ্বলছে এক টুকরো আগুন মিরা বাড়ির পেছন দিকটাতে বেরিয়ে এলো। জয়পুর হাটে শহরের কাছে সোনাদিঘী গ্রামে ছোট্ট ছিমছাম একটা বাড়ি। রাজু শহরের ইউএনও অফিসে চাকরি করে। দুজনেরই গ্রাম পছন্দ খুব, তাছাড়া গ্রামে একটু বেশি জায়গায় উঠোন-আঙিনা নিয়ে আয়েশ করে থাকা যাবে, তাই শহরে না থেকে দুজনে মিলে এখানে এসে একটা বাড়ি করেছে। পেছনে ছোট পুকুর, তার পাশে উঠোনের মত এক চিলতে সমতল ভুমি। এখানে মিরার একটা বাগান ছিল এক সময়। অনেক দিন হলো যত্ন নেওয়া হয় না। এখন বলা যায় বাগানের ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। অযত্নে বুনো লতাপাতা ঘাস বেড়ে উঠেছে ইচ্ছেমত। এসবের ভীড়ে ফুলের গাছগুলো হারিয়ে গেছে। কয়েকটা গোলাপের গাছ অবশ্য এখনো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এগুলোও বুনো চেহারা নিয়ে অন্যদের সাথে মিশে গেছে। কয়েকটা রক্তিম ফুল বুনো পরিবেশটার মধ্যেও কেমন আলো ছড়াচ্ছে। মিরা একটা চেয়ার এনে আরাম করে বসলো। রাজু ঘরে নেই। আজকে অফিস বন্ধ। এই সাত সকালে কোথায় বেরোলো কে জানে। মিরা চেয়ার থেকে উঠে ঘুরে ঘুরে বাগানটা দেখতে লাগলো। মনটা দ্রবিভূত হয়ে আছে, কত আনন্দ নিয়ে ছোট্ট এই বাগানটা সে করত। ফুলের চারাগুলো রাজুই এনে দিত, নানা জায়গা থেকে। গরম ভাতের সাথে খুব-ঝাল কাঁচা মরিচ খাওয়ার শখ ছিল ওর। দুইটা দুধ মরিচের চারা এনেছিল অনেক খুঁজে-পেতে। মিরা খুব যত্ন নিতো গাছ দুটোর। একটা গাছ শেষ পর্যন্ত টিকাতে পারেনি। বাকি একটায় ঝাঁক বেঁধে মরিচ আসতো। ছোট ছোট মরিচ, আলো হয়ে ফুটে থাকতো গাছজুড়ে। তুলসি গাছটা মরে গেছে প্রায়; শুধু কাণ্ডটা দাঁড়িয়ে আছে, কোন রকম। সাদা গোলাপের তিনটা চারা ছিল, এখন একটাও দেখা যাচ্ছে না। প্রত্নতাত্তিকের আবিষ্ট মন নিয়ে সে আনমনে হাঁটছিল, হঠাৎ দেখল চিকন একটা সাপ, সোনালি ফুটি ফুটি, হাত তিনেক লম্বা হবে শরীরটা, একটা বুনো গাছের গায়ে পেঁচিয়ে আছে; মাথাটা শূন্যে দুলছে, একটু একটু। কী সুন্দর, শান্ত, ধীর, নান্দনিক ও ভয়ংকর। মিরা ভয় পেয়ে দ্রুত পা চালিয়ে রুমে চলে এলো। মনে হলো অনেকগুলো চিকন, সুন্দর, বিষধর সাপ তার পুরো শরীরকে পেঁচিয়ে ধরেছে। যেন শান্ত, ধীর ও নান্দনিক… দুপুর গড়িয়ে গেছে, রাজু এখনও ফিরেনি। মিরা দুপুরের রান্নার কাজ গুছিয়ে এনেছে। গোছল করে খেয়েদেয়ে বিছানায় যাবে। আগে হলে একা একা না খেয়ে রাজুর জন্য অপেক্ষা করত। কথাটা মনে হওয়ার পর কেমন একটু বিব্রত বোধ করল। মিরা-রাজুর জীবন প্রণালী ও সম্পর্কটা এখন এমনভাবে চলছে, একে কোন সংজ্ঞায় ধরা সম্ভব নয়। তারা একসাথে আছে এবং নাই—দুটোই সমান সত্য হয়ে উঠছে দিন দিন। এমন সময় রাজু এসে ঘরে ঢুকলো। মিরার জন্য একটা গিফটের প্যাকেট নিয়ে এসেছে। মিরা প্যাকেটটা গ্রহণ করেনি। শুধু ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলেছে, এসব দিয়ে আমি কী করব? চেহারায় কোন অভিব্যক্তি নেই—না আগ্রহ, না অভিমান। রাজু কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে মিরার চেহারায় তাকাল, দেখলো, মিরা হাসছে। রাজুর মনে হলো, যেন হাসি নয়; মিরার ঠোঁটে প্রচণ্ড তেজস্বীতা নিয়ে
জ্বলছে এক টুকরো আগুন।
নিলীমা বরকন্দজকে ব্লক মেরে দিচ্ছে
মিরা এসে নিজের রুমটাতে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। একটু পর শুনতে পেল কোথাও ভাঙছে কিছু। রাজু কি ড্রেসিংটেবিলের গ্লাসটা ভাঙলো? নাকি কাঁচের সুন্দর জগটি? যেটি বাণিজ্যমেলা থেকে খুব কমদামে কিনতে পেরে মিরা দারুণ উৎফুল্ল হয়েছিল? ভাঙুক। সবকিছুই তো ভেঙে পড়ছে। সে খুব দ্রুত ফেসবুকটাতে লগইন করতে পেরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিছু সময়ের জন্য বাস্তব জগতটাকে বেমালুম ভুলে থাকার এ এক আশ্চর্য উপায়। রাজুর সাথে সম্পর্কটা খুব খারাপ হবার পরপরই সে নিজের নামের আইডিটা বাদ দিয়ে নিলীমা নামে নতুন একটা আইডি খুলেছে। ছোট্ট একটা পোস্ট লেখল—
‘মানুষ নাকি তার স্বপ্নের সমান বড়। হা হা নয়?’
এরপর সে নোটিফিকেশনগুলো চেক করতে লাগলো। এক সপ্তাহ ফেসবুকে ছিল না, বিচিত্ররকমের
নোটিফিকেশন এসে ভরে গেছে। একটু পর টন্ করে আওয়াজ হলো। বরকন্দজ তার পোস্টে কমেন্ট করেছে।
—হা হা হবে কেন? দারুণ একটা কথা।
—কচু।
—আপনেরে তো ভাল জানতাম।
—তো?
—নষ্ট হইসেন কবে থেকে?
মিরা বরকন্দজের সবগুলো রিপ্লাইয়ে এংরি রিয়্যাক্ট করলো। শেষটাতে শুধু হা হা দিয়ে বরকন্দজের ইনবক্সে গিয়ে ম্যাসেজ করল :
—আপনের ঠ্যাং ভাঙব।
—হা হা .. ঠ্যাং তো ভাঙা দরকার আপনারটা। এক সপ্তাহ কোথায় ডুবেছিলেন? কত খুঁজলাম।
—ব্যস্ততা ছিল কিছু। যাগগে, আপনার কী খবর?
— আমি তো অলওয়েজ ভালো থাকি। আপনি?
—আছি, এই তো, চলে যাচ্ছে আরকি।
‘অলওয়েজ ভালো থাকি’ আর ‘এই তো, চলে যাচ্ছে আরকি’ মিলে সময়ের গতির ভেতর একটু পরিবর্তন আনে। সময়, দ্রুত চলতে গিয়ে একটু যেন থেমে গেছে, দুলছে যেন, অদৃশ্য এক পেন্ডুলামের মত। নিলীমা অকারণেই একটু দ্রবিভূত হয়। জিজ্ঞেস করে—
—আচ্ছা, বলতে পারেন, সম্পর্ক মানে কী?
—যোগাযোগ। বরকন্দজ সতর্কতার সাথে রিপ্লাই দেয়, সংক্ষেপে।
—তার সাথে আমার সম্পর্ক আছে, আমরা তো সম্পর্ক শব্দটা এরকম বাক্যেই ব্যবহার করি, একে কি শুধু যোগাযোগ দিয়ে ব্যখ্যা করা যায়?
—তা যায় না। তাহলে বলতে পারি যোগাযোগের ধারাবাহিকতা।
—আপনি একটা দোকান থেকে প্রায়ই এটা-সেটা কিনেন। দোকানির সাথে লেনদেন ছাড়া অন্য কোন আলাপ হয় না, এখানে তো ধারাবাহিকভাবে একটা যোগাযোগ তার সাথে হচ্ছে, একে কি সম্পর্ক বলবেন?
—এহে, এতো দেখছি লেডি সক্রেটিস। হা হা হা… আচ্ছা, আপনিই বলুন।
—আমার মনে হয় কি জানেন? সম্পর্ক একটা উপলব্ধির নাম। আপনি বলছিলেন না যোগাযোগ? এটা ঠিক আছে; কিন্তু যোগাযোগটা হয় মনের সাথে মনের।
—কি জানি, আচ্ছা, এটা বাদ দাও। চলো অন্য বিষয়ে আলাপ করি। বরকন্দজ এই আলাপে যেন স্তিমিত হয়ে পড়ে। যেন তার কষ্ট হয়। নিলীমা তা বুঝে অথবা বুঝে না। এরপর অনেক্ষণ হলো নিলীমা কোন রিপ্লাই দিচ্ছে না। ম্যাসেঞ্জারের তিনটা বিন্দু শুধু অবিরত লাফাচ্ছে।
বরকন্দজ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। সে টের পেল হঠাৎ তার মনটা বিষণ্ন হয়ে পড়েছে। ম্যাসেঞ্জার থেকে চোখ সরিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। একটু পর ম্যাসেজের আওয়াজ শুনে ফিরল মোবাইলের দিকে।
—শুনুন, আমি জানি, এখনের এই কথাগুলোর জন্য আপনি হয়তো প্রস্তত নন। হয়তো কষ্ট পাবেন, জানি না। কষ্ট পেলেও মাফ করে দিবেন। আমার খুব ইচ্ছে হতো আপনাকে তুমি বলে ডাকি। একদিন একটা ম্যাসেজ লিখেও কেটে ফেলেছিলাম, মনে আছে? আপনি খুব জোরাজোরি করছিলেন কী লিখেছিলাম বলার জন্য। এ নিয়ে আমরা তিনদিন কথা পর্যন্ত বলিনি, অভিমানে। আজকে বলি। সেদিনের ম্যসেজে তেমন কিছুই ছিল না। আমি বলেছিলাম, আপনাকে তুমি বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পরে খুব লজ্জা লাগছিল, কিছুটা অস্বস্তিও। তোমার আসল নাম কি, কোথায় থাকো, কী করো, আমি জানি না। কখনো বলোনি। আমিও বলিনি আমার নাম-পরিচয়। একটা ব্যাপার হয়তো তুমিও জানো, অনলাইন মানুষের সবটাকে প্রকাশ করতে পারে না। ফলে, তুমি আমাকে ফেসবুকের পোস্টে, কমেন্ট-রিপ্লাইয়ে আর ম্যাসেঞ্জারে একজন উচ্ছ্বল তরুণী হিসেবেই দেখেছ, কিন্তু জানো না যে, আমি আসলে খুবই দুঃখী একটা মানুষ। আমার এই দুঃখের ভেতর তুমি একটা স্বপ্নাচ্ছন্ন পৃথিবী তৈরী করেছ। এখানে নদী আছে, প্রান্তর আছে, সুন্দর ঘরবাড়ি ও সবুজ গাছপালা আছে, পাখির কোলাহল আছে। আমার বেদনাভরা জীবনের ভেতর এই স্বপ্নময় পৃথিবীর ভার আমি সইতে পারছি না। তোমার মত একজন মানুষ পেলে আমার জীবনটা অন্যরকম হতো—এই চিন্তা আমাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। আমি অনেক ভেবেছি, কিন্তু আমাকে ক্ষমা করবে, ভুলে যাবে। তোমার আইডির নাম নিয়ে আমি সবসময় আপত্তি করতাম, বলতাম চেঞ্জ করো। আর, আমি ডাকতাম তোমাকে ‘প্রিয় সুন্দর’ বলে, মনে মনে। কিন্তু, আজকে সরাসরিই ডাকি, কী বলো? প্রিয় সুন্দর, এটাই আমার লাস্ট ম্যাসেজ। আমি চাইলে এই ম্যাসেজটা আমি সীমাহীন শব্দসংখ্যায় লিখতে পারতাম, এতো কথা জমেছে আমার বুকে। কিন্তু দুঃখ বাড়িয়ে কী লাভ, বলো? তারচেয়ে কি এই ভালো নয়, ছোট্ট ‘যাই’ বলে খুব দ্রুত আমরা হারিয়ে যাব ছায়া আর অন্ধকারের ভেতর। এরপর আর কোথাও খুঁজে পাব না কেউ কাউকে। আমি জানি আমার কেমন লাগছে এবং তোমার কেমন লাগছে এই ম্যাসেজ পড়ে, তা-ও আন্দাজ করতে পারছি; তবু, আমি পারছি না আসলে। বিদায়, প্রিয় সুন্দর!
ম্যাসেজটা সেন্ড করেই নিলীমা সাথে সাথে বরকন্দজ নামের আইডিটাকে ব্লক করে দিল, যেন কোথাও কেউ নেই; কেউ ছিল না।
শওকত, তোমার স্ত্রী—রেবেকা, নাই
বরকন্দজের আড়ালে মূলত রাজুই ছিল এবং নীলিমা নামে এতো দিন ধরে রাজু যার সাথে হৃদয়ের লেনদেন করছে, সে মূলত নিজেরই স্ত্রী—মিরা। নিজের স্ত্রীকেই সে ভালোবেসে এসেছে এতোদিন, নিজেরই অজ্ঞাতে। শওকতের ইচ্ছে ছিল গল্পের শেষে গিয়ে দুজনের মাঝে পরিচয় করিয়ে দিবে। এই নাটকিয় মূহুর্তটি কিভাবে ঘটাবে, দুজন কীভাবে বিস্মিত হবে, ধাক্কা খাবে, তারপর কী হবে, সব কিছু ভেবে গুছিয়ে রেখেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজটা করতে তার ভালো লাগেনি। কেন? হেপি এন্ডিং দিলে গল্প ভালো হয় না এই জন্য? একটা বিচ্ছেদ রেখে দিতে হবে, একটা নিষ্ঠুর অপ্রাপ্তির বেদনা, হাতের কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেলা—এই রকমের তীক্ষ্ম বেদনাগুলো থাকলে গল্পটা হয়তো হিট করবে; নিন্তু দুটো মানুষ, যারা ছয় বছরের দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে নিজেদেরকে খুঁজে পায়নি, মাত্র তিন মাসের সামান্য অ- পরিচয়ের ভিতর দিয়ে কী তুমুলভাবে আবিস্কার করেছে পরস্পরকে; এ কি জীবন নয়? এই গল্প সে লেখবে না কেন? শওকতের খুব ইচ্ছে ছিল এখানে পতন নয়, জীবনের জয় হবে। কিন্তু এখন ইচ্ছে হচ্ছে না মূলত অন্য একটা কারণে। রাজুর মানসিক অবস্থানটি তার কাছে অত্যাধিক জটিল মনে হয়েছে। এই যে স্ত্রীকে ঘৃণা করা, প্রহার করা, আবার ক্ষণকাল পরে, সেই একই ব্যক্তি, যার চিন্তা ও অনুভব, রুচি ও অভিজ্ঞতা, মনন ও কথার সুর এক ও অভিন্ন, তার সাথেই অন্য নামের আড়ালে থেকে গভীর প্রেমে লিপ্ত হতে পারা, শওকত এই জায়গাটির কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছে না। নারী যদি ভিন্ন কেউ হতো, তাহলে হিসেবটা সহজ ছিল; কিন্তু এখানে তো মূলত সে নিজের স্ত্রীকেই উন্মোচিত করেছে, নতুন এক রূপে। ফুল বিছানো পথে হেঁটে গিয়ে সে মূলত মিরার হৃদয়টিতেই প্রবেশ করেছে, যে হৃদয়টিকে এই সে-ই বিষে বিষে নীল করে রেখেছে দিনের পর দিন। এটা কেন সম্ভব? শওকতের কেন
যেন মনে হচ্ছে, নীলিমার পরিচয় পাওয়ার পর রাজুর মধ্যে একটা পতনের সৃষ্টি হবে, এবং সে কিছুটা হতাশ ও হতোদ্যম হয়ে পড়বে। সে ভেবে পাচ্ছে না এখন কী করবে। ধীরে ধীরে একটা ঘোরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। কপাল ঘামছে এবং একটা জিজ্ঞাসার আবর্তে ক্রমেই অসহায় হয়ে পড়ছে। মিরা, রেবেকা, নীলিমা—তিন জন নারী, তার থেকে একটু দূরে, তাকে মাঝে রেখে, তার দিকে মুখ করে তেরসাভাবে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের চেহারায় কোন অভিব্যক্তি নাই। কোন চাওয়া ও জিজ্ঞাসা নাই। শুধু স্মিত একটু হাসিতে খোদাই হয়ে আছে সুন্দর ও অসুন্দরের উর্ধ্বে উঠা আবহমান এই তিন নারীমূর্তির মুখচ্ছবি। শওকতের পায়ে দ্বিধা, হাত নিশ্চল; কিন্তু অনুভূতি? তীক্ষ্ম ফলার মত হয়ে আছে যেন, ধনুকের ছিলার মত টান টান যেন, ‘আমাকে ভুলে যেয়ো’ বলা তরুণীর অভিমানের মত প্রখর যেন। টের পায়, হৃদয়ের গহীন অন্ধকারে কোথাও এক ফোঁটা রোদ ঢুকেছে। এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শুনা গেল। ক্লান্ত পায়ে উঠে আসছে কেউ, ধীর গতিতে। পদশব্দের মাঝে ঘুমের আবেশ ও ঘুমুতে না পাবার আক্ষেপ বেজে বেজে উঠছে। শওকত ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত দেড়টা। রেবেকা আসছে। যখন প্রবল বাতাস উঠেছে, এই আমসত্ব-রঙা রাত্রিতে; যখন নৈঃশব্দের ভেতর ছোট্ট একটি শব্দ আড়মোড়া ভাঙছে, তখন রেবেকা উঠে আসছে, ধীর পায়ে, যেন গতকাল আসেনি, এবং কোন দিন আসেনি। শওকত চোখ বন্ধ করে রেখেছে। পেছনে দরজা খোলার আওয়াজ হলো। রুমের ভিতর প্রবেশ করেছে, তার স্ত্রী, রেবেকা। এবং শওকত যখন চোখ খুলে আলস্যে ঘুরে তাকাল, দেখল, সেখানে রেবেকা নাই; দাঁড়িয়ে আছে অন্য এক নারীমুর্তি—নিলীমা।