মাওলানা ইমদাদুল হক
ঈদ আরবি শব্দ। ঈদ মানে ফিরে আসা। যে উৎসব প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসে আরবিভাষায় তাকে ঈদ বলে। সকল জাতি–গোষ্ঠীর বার্ষিক উৎসবই ঈদ। যেমন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক জাতির ঈদ রয়েছে, আর এটা আমাদের ঈদ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৯৫২; সহিহ মুসলিম, হাদীস : ৮৯২; সুনান নাসায়ি, হাদিস : ১৫৯৩)। ঈদ উৎসব যেহেতু নতুন নতুন আনন্দ নিয়ে প্রতি বছর ফিরে আসে এজন্য আমরা বলি, ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। ইসলামের রয়েছে দুটি ঈদ : ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আজহা।
ঈদুল ফিতরের আনন্দ মূলত সিয়াম পালনকারীর জন্য। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রোজাদারের দুটি খুশি : একটি ফিতরের সময়, আরেকটি তার রবের সাথে সাক্ষাতের সময় (বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসায়ি)।
ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সিয়াম পালনকারীর প্রতিশ্রুত প্রতিদান প্রত্যাশার আনন্দ ঈদুল ফিতর─তার পূর্বাপর পাপরাশি ক্ষমা করা হয়েছে, সে রাজাধিরাজ রবের সাক্ষাতে তাঁর কাছ থেকে প্রতিদান গ্রহণ করবে! তার জান্নাতে প্রবেশের জন্য রয়েছে আলাদা তোরণ!
পক্ষান্তরে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি রমাজান পেয়েও তার গুনাহ মাফ করাতে পারল না সে ধ্বংস হোক। কা‘ব ইবনে উজরাহ রা. বলেন, ‘নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে বললেন, তোমরা মিম্বারের নিকট একত্রিত হও। আমরা হাজির হলাম। তিনি প্রথম সিঁড়িতে পা রেখে বললেন, আমিন। দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রেখে বললেন, আমিন। তৃতীয় সিঁড়িতে পা রেখে বললেন, আমিন।
‘তিনি যখন নেমে এলেন আমরা বললাম, “হে আল্লাহর রাসুল, আমরা আজ আপনার থেকে যা শুনলাম তা আগে কখনো শুনিনি।” তিনি বললেন, “আমার কাছে জিবরিল আ. এসেছিলেন। আমি প্রথম সিঁড়িতে পা রাখলে তিনি বললেন, যে রমজান পেল কিন্তু তার পাপ ক্ষমা হলো না সে ধ্বংস হোক। আমি বললাম, আমিন। দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখলে তিনি বললেন, যার কাছে আপনার আলোচনা হলো কিন্তু সে আপনার ওপর দরুদ পড়ল না সে ধ্বংস হোক। আমি বললাম, আমিন। আমি তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখলে তিনি বললেন, যে বৃদ্ধ মাতাপিতা বা তাদের কোনো একজনকে পেল কিন্তু তারা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাল না সে ধ্বংস হোক। আমি বললাম, আমিন (মুস্তাদরাক হাকিম, হাদিস নম্বর ৭২৫৬)।”’
আল্লাহর আদেশ বা অনুমতি ছাড়া জীবরীল আ. আসেন না। অর্থাৎ তাঁকে মহান আল্লাহই পাঠিয়েছেন একথা বলতে যে, যে রমজান পেল কিন্তু তার পাপ ক্ষমা হলো না সে ধ্বংস হোক। আর আমাদের দয়ার নবিও একথার উপর বলে দিয়েছেন, ‘আমিন: হে আল্লাহ, কবুল করো।’ সুতরাং রমজানে পাপরাশি ক্ষমা করিয়ে নিতে না পারলে তার ধ্বংসও অনিবার্য।
রোজাদারের ঈদুল ফিতরের আনন্দ তাই আশা ও আশঙ্কার মাঝে দোদুল্যমান। তার এ অবস্থা ওই ছাত্রের সাথে তুলনীয়, যে যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে, পরীক্ষাও হয়েছে আশানুরূপ, পরীক্ষা শেষে তার মনে আশা আছে, একটা ভালো রেজাল্ট তার হবে। তবে তার প্রকৃত আনন্দ রেজাল্টের দিন যখন একটা ভালো ফল তার হাতে আসবে। তার আগ পর্যন্ত আশার আনন্দের সাথে সাথে ‘কী হয় কী হয়’ আশঙ্কাও তার কাটে না।
রোজাদার একমাস ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে সিয়াম সাধনার তওফিক পেয়েছে। এখন তার মনে প্রতিশ্রুত প্রতিদান পাওয়ার প্রত্যাশা─ যে রব যথাযথভাবে রমজান পালনের তওফিক দিয়েছেন তাঁর প্রতিশ্রুত প্রতিদানও তিনি দেবেন! তবুও আখেরাতে রবের কাছ থেকে প্রতিদান পাওয়ার আগ পর্যন্ত তার আশঙ্কা কাটে না─তার সাধনা প্রতিদানের উপযুক্ত হয়েছে তো! রব্বে কারিম তার ইবাদত কবুল করেছেন কী! রোজাদার তাই ঈদ আনন্দে বল্গাহারা হয়ে যেতে পারে না।
এ কথাই ফুটে উঠেছে ইমাম আওজায়ি রহমতুল্লাহি আলায়হির মন্তব্যে। এক ঈদুল ফিতরের দিন দামেশকের পথেঘাটে আনন্দের ঢল নেমেছে। এইসব বল্গাহীন আমোদ–আহ্লাদ দেখে তিনি মন্তব্য করলেন, ‘আল্লাহ যদি এদেরকে রমজানে ক্ষমা করে দিয়ে থাকেন, তবে এদের শোকর আদায় করা উচিৎ ছিল। আর শোকর তো এমন বেলেল্লা আমোদের মাধ্যমে প্রকাশ পায় না। আর যদি রমজানে তাদের পাপরাশি ক্ষমা হয়ে না থাকে, তবে তো আজ তাদের ভীত হওয়ার দিন, ক্রন্দন করার দিন। কিন্তু ভয় ও ক্রন্দনের লক্ষণ তো এটি নয়।’ (মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, কুড়ানো মানিক, পৃ. ১৮)।
পিতামাতা, শিক্ষক, অভিভাবকের কথা মেনে ভবিষ্যত–জীবন গঠনে ব্রত ছাত্রের আর কাউকে পরোয়া না করা নগদ মৌজে মজে থাকা বখাটে ছেলেটির আনন্দের উপলক্ষ আর তা প্রকাশের পদ্ধতি এক হয় না। তেমনি আখেরাতের অনন্ত জীবনে বিশ্বাসী মুমিনের আর শুধু দুনিয়ার জীবন নিয়ে মজে থাকা অবিশ্বাসীর জীবনাচার, জীবনে আনন্দের উপলক্ষ ও তা প্রকাশের ভাষা ও পদ্ধতি এক হবে না। মুমিনের প্রকৃত আনন্দের দিন হাশরে আপন রবের কাছ থেকে ডানহাতে আমলনামা প্রাপ্তির দিন, যেদিন সে নিজেকে চিরসফলদের অন্তর্ভুক্ত বলে জেনে নিশ্চিত হবে।
আমাদের ঈদ আনন্দ হোক বিশ্বাসী মুমিনের ঈদ আনন্দ। যে আনন্দে খুশি আর সংযম একীভূত থাকে।
লেখক : শিক্ষক, মাদরাসাতুত তাকওয়া, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা।